মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
আসসালামু আলাইকুম, Hadith.one বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে! আমাদের সার্ভারের মেয়াদ ১১ অক্টোবর ২০২৫ এ শেষ হবে, এবং এবং ওয়েবসাইট টি চালানোর জন্য আমাদের কোনো ফান্ড নেই।
🌟 আপনার দান এই প্ল্যাটফর্মকে বাঁচাতে পারে এবং প্রতিটি হাদিস পড়ার মাধ্যমে সদকাহ জারিয়ার অংশীদার হতে পারেন!
🔗 অনুগ্রহ করে আপনার দানের মাধ্যমে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি চালিয়ে নিতে সাহায্য করুন!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!
আল্লাহ রাব্বল আলামীনের যাবতীয় প্রশংসা এবং আমাদের সর্দার মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম, তার পরিবারবর্গ ও পরবর্তী বংশধর, এবং তার সকল সাহাবীর ওপর দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক।
বক্ষ্যমান বইটির ব্যাপারে প্রাথমিক ধারণা একটি প্রবন্ধের চেয়ে বেশি কিছু ছিল না। প্রথম দিকে মনে করেছিলাম যে, মুসলমানদের অধঃপতন এবং দুনিয়ার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব থেকে সরে যাবার কারণে মানব জাতির কী ক্ষতি হয়েছে তা মোটামুটিভাবে চিহ্নিত করব এবং দেখাতে চেষ্টা করব পৃথিবীর মানচিত্রে ও তাবৎ জাতিগোষ্ঠীর মাঝে তাদের অবস্থানগত মর্যাদা কী। এর পেছনে এর বেশি আর কোন উদ্দেশ্য ছিল না যে, মুসলমানদের মনে এই ক্ষমাহীন অপরাধ ও গাফিলতি সম্পর্কে যেন অনুশোচনা জাগে যা তারা মানব জাতির ক্ষেত্রে করেছে। অতঃপর এর প্রতিকার ও সংশোধনকল্পে তারা যেন সযত্ন প্রয়াসী হয়, তাদের মধ্যে যেন এর প্রেরণা সৃষ্টি হয়। সেই সাথে দুনিয়াবাসী তাদের সেই দুর্ভাগ্য সম্পর্কেও যেন অবহিত হতে পারে, যেই দুর্ভাগ্যের সম্মুখীন মুসলিম নেতৃত্ব থেকে মাহরূম হবার কারণে তাদেরকে হতে হয়েছে। তারা যেন অনুভব করতে পারে যে, এই অবস্থার মধ্যে বড় রকমের কোন কল্যাণকর পরিবর্তন ততক্ষণ পর্যন্ত হতে পারে না, হওয়া সম্ভব নয় যতক্ষণ পর্যন্ত না দুনিয়ার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব বস্তুপূজারী ও খোদাভীরুহীন মানুষের হাত থেকে বের করে সেই সব আল্লাহভীরু মানুষের হাতে তুলে দেয়া হবে যারা আল্লাহর পয়গম্বর ও নবী-রসূলদের ওপর ঈমান রাখে, তাদের দেয়া হেদায়েত (পথ-নির্দেশনা) ও শিক্ষামালা থেকে আলো। ও দিক-নির্দেশনা গ্রহণ করে থাকে এবং যাদের কাছে আখেরী নবীর দীন ও শরীয়ত এবং দীন ও দুনিয়ার পথ-প্রদর্শন ও নেতৃত্ব দানের নিমিত্ত একটি পূর্ণাঙ্গ সংবিধান বর্তমান।
উল্লিখিত উদ্দেশ্যে ও লক্ষ্যে সাধারণ মানব ইতিহাস ছাড়াও ইসলামী ইতিহাস সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা করে দেখানো হয়েছে যে, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাব কেমন জাহিলী পরিবেশে হয়েছিল, মানবতা তখন অধঃপতনের কোন স্তরে পৌঁছে গিয়েছিল? তাঁর দাওয়াত ও প্রশিক্ষণ কেমনতরো উম্মাহ সৃষ্টি করেছিল। সেই উম্মাহর বোধ-বিশ্বাস, আখলাক-চরিত্র, শিক্ষা ও জীবন-চরিত কেমন পূত-পবিত্র ছিল? তারা কিভাবে পৃথিবীর ক্ষমতার চাবিকাঠি ও নেতৃত্বের বাগডোর নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছিল? তাঁদের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব দুনিয়ার সভ্যতা-সংস্কৃতি ও জীবন-যিন্দেগী, মোল।
মানুষের রুচি-প্রকৃতি ও প্রবণতার মাঝে কী প্রভাব ফেলেছিল, কী ভাবে তারা পৃথিবীর গতিধারা জগত জোড়া আল্লাহ্ বিস্মৃতি ও সামগ্রিক জাহেলিয়াত থেকে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী ও ইসলামের দিকে মোড় নিল এরপর কেমন করে সেই উম্মাহর মধ্যে অধঃপতন দেখা দিল ও তাকে দুনিয়ার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের আসন থেকে সরে যেতে হলো এবং কিভাবে এই নেতৃত্ব ও কতত্ত্ব দুর্বল ও অলস, আল্লাহর পরিচয় সম্পর্কে জ্ঞাত একটি জাতির হাত থেকে বেরিয়ে আল্লাহর পরিচয় সম্পর্কে অজ্ঞ, শক্তিশালী ও বস্তুপূজারী য়ুরোপের হাতে গিয়ে পড়ল, এরপর স্বয়ং য়ুরোপেই এই বস্তুপূজা ও ধর্মদ্রোহিতা কিভাবে দেখা দিল ও তা বিকশিত হলো, পাশ্চাত্য সভ্যতার মূল মেযাজ কি? এর মূল প্রকৃতি কি কি উপাদানে তৈরি, য়ুরোপের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব পৃথিবীর ওপর কী প্রভাব ফেলে এবং সমাজ জীবনকে তা কিভাবে প্রভাবিত করে, দুনিয়ার গতিধারা কোন দিকে এবং এক্ষেত্রে মুসলমানদের দায়িত্ব ও কর্তব্য কী এবং সে কিভাবে এই দায়িত্ব পালন করতে পারে, দিকভ্রান্ত মানবতাকে সন্ধান দিতে পারে তার সঠিক পথ ও প্রকৃত গন্তব্যস্থলের।
লেখার কালেই লেখকের কাছে একথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বিষয়টি একটি প্রবন্ধের নয় বরং একটি বিরাট বিস্তৃত গ্রন্থের এবং এ ধরনের একটি গ্রন্থ রচনা সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন। স্বয়ং মুসলমানদের ধারণাই এ ব্যাপারে পরিষ্কার নয়। তারা নিজেদের জীবনের সঙ্গেই কোন সম্পর্ক ও সংশ্লিষ্টতা অনুভব করে না এবং দুনিয়ার ব্যাপারে তাদের কোন যিম্মাদারী আছে বলেই মনে করে না। বহুলোক এমন আছেন যারা মুসলমানদের অধঃপতনকে একটি জাতীয় দুর্ঘটনা ও স্থানীয় ঘটনার বেশি মনে করেন না এবং এ ব্যাপারে তাদের আদৌ কোন অনুভূতিই নেই যে, এটা কত বড় সর্বব্যাপী দুর্ঘটনা ছিল এবং মানবতার জন্য কত বড় দুর্ভাগ্য।
আসল কথা হলো, এই বাস্তব সত্যকে এড়িয়ে ও উপেক্ষা করে আমরা যেমন ইসলামের ইতিহাস বুঝতে পারব না, তেমনি বুঝতে পারব না মানব জাতির ইতিহাসকেও। এই যুগকে যথাযথ ও সন্দেহাতীতভাবে নিরুপণও করতে পারব , যে যুগ এই মুহূর্তে দুনিয়ার বুকে বিরাজ করছে। তেমনি এই সর্বগ্রাসী বিপ্লবের সঠিক কার্যকারণও আমরা নির্ধারণ করতে পারব না যা দুনিয়ার ইতিহাসে আত্মপ্রকাশ করেছে। যে বিপ্লব ইসলামী বিপ্লবের পর সর্ববৃহৎ বিপ্লব। পার্থক্য কেবল এতটুকু যে, প্রথম বিপ্লব ছিল মন্দ থেকে ভালোর দিকে, অকাণ থেকে কল্যাণের দিকে, অমঙ্গল থেকে মঙ্গলের দিকে। পক্ষান্তরে এই বিপ্লব ভাল থেকে মন্দের দিকে, কল্যাণ ও মঙ্গল থেকে অকল্যাণ ও অমঙ্গলের দিকে। প্রথম বিপ্লব ছিল মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাব ও ইসলামী দাওয়াতে উত্থানের ফসল আর দ্বিতীয় বিপ্লব উম্মতে মুহাম্মাদিয়ার পতন এবং ইসলামী দাওয়াতের ক্ষেত্রে গাফিলতি ও শৈথিল্য প্রদর্শনের পরিণতি। আজ মুসলমানদের মধ্যে নিজেদের ওপর আস্থা, ইসলামী রূহ তথা ইসলামী প্রাণ-সত্তার দিকে প্রত্যাবর্তনের আবেগ ও কর্মস্পৃহা সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন, তাদেরকে তাদের হৃত মর্যাদার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং পরিষ্কারভাবে বলা যে, তারা দুনিয়াকে নতুন করে গড়বার গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র কর্মে অত্যন্ত কার্যকর ও সক্রিয় উপাদান (Factor) হিসাবে ভূমিকা পালনকারী শক্তি, চলমান কোন মেশিনের যন্ত্র কিংবা কোন নাট্যমঞ্চের কুশলী অভিনেতা (Actor) নন।
যেই দেশ ও পরিবেশে লেখকের জন্ম, যেখানে লেখক লালিত-পালিত ও বর্ধিত এবং যেখানে এ ধরনের একটি গ্রন্থ রচনার খেয়াল জেগেছিল তার দাবি ছিল, এই গ্রন্থ সে দেশের ভাষায় লিখিত হবে (অর্থাৎ উর্দুতে)। কিন্তু এক বিশেষ ধারণার বশে উৰ্দর পরিবর্তে আমাকে আরবী ভাষায় লিখতে হয়েছে, উর্দুর বিপরীতে আরবীকে অগ্রাধিকার দিতে হয়েছে।
আরবী ভাষা নির্বাচন ও অগ্রাধিকার প্রদানের কারণ লেখকের এই অনুভূতি যে, আরব দেশগুলো আজ হীনমন্যতাবোধে আক্রান্ত এবং আত্মবিস্মৃতির সব চাইতে বেশি শিকার। দুনিয়া যদিও এককালে তাদের থেকেই নতুন জীবন ও নবতর ঈমান লাভ করেছিল, অথচ আজ সেখানকার পরিবেশই সবচেয়ে বেশি নির্বাক নিস্তব্ধ এবং তাদেরই সমুদ্র সর্বাধিক শান্ত ও তরঙ্গহীন। প্রাচ্যের কবি আল্লামা ইকবাল আজ থেকে অনেক বছর আগে এসব দেশের দিকে তাকিয়ে যা বলেছিলেন তা মোটেই অযথা বলেন নি;
শুনি না আমি সেই আযান মিসর ও ফিলিস্তীনে,
পাহাড় ও পর্বতকে দিয়েছিল যা জীবনের পয়গাম।
যে সিজদায় প্রকম্পিত হতো ধরণীর অন্তরাত্মা,
মিম্বর ও মেহরাব আজ অধীর প্রতীক্ষায় তার।
য়ুরোপের নৈকট্য, বিশেষ রাজনৈতিক অবস্থা এবং সেসব দামাল সন্তানদের সংখ্যাল্পতার দরুন, সৌভাগ্যবশত ভারতবর্ষের মাটিতে যাদের অব্যাহতভাবে জন্ম হয়েছে, আরবের পবিত্র ভূখণ্ড যাঁদের অস্তিত্ব থেকে দীর্ঘকাল যাবত মাহরূম ছিল, আরব বিশ্বকে য়ুরোপের চাতুর্য ও কুটকৌশলের সহজ শিকারে পরিণত করে। শায়খ হাসান আল-বান্দা মরহুম ও তার আন্দোলন এবং আল-ইখওয়ানুল মুসলেমূন (মুসলিম ব্রাদারহুড)-এর আগে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে কোন শক্তিশালী। ইসলামী আন্দোলন কিংবা কোনরূপ কর্মতৎপরতা ছিল না। আরব বিশ্বের কোথাও অস্থিরতা ও অটুট মনোবলের চিহ্ন দৃষ্টিগোচর হতো না। সেখানকার লোকেরা হয়তো যুগের সঙ্গে সন্ধি করে নিয়েছিল কিংবা হতাশ হয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে পড়েছিল অথবা স্রোতের অনুকূলে গা ভাসিয়ে দিয়েছিল। আরব বিশ্বের অবস্থা পর্যবেক্ষণকারী এবং তার গৌরবময় অতীত ও দুঃখজনক বর্তমানের মাঝে তুলনাকারী অত্যন্ত আক্ষেপ ও ব্যথা নিয়ে বলছিলেনঃ
হেজাযের এ কাফেলায় একজন হুসায়নও নেই।
যদিও দিজলা ও ফোরাত আজও তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ।
এই কষ্টকর ও বেদনাময় অনুভূতিই কলমের গতি উর্দু থেকে আরবীর দিকে ফিরিয়ে দেয়।
আরবরা তাদের ইতিহাস ও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই আজ আন্তর্জাতিক ও বিশ্বনেতৃত্ব গ্রহণের অধিকারী এবং গোটা সভ্য জগতের ওপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা রাখে। লোহিত সাগর ও ভূমধ্য সাগরের মাঝেই তাদের অবস্থান। অবস্থান তাদের দূর প্রাচ্যের মধ্যভাগে। বিশ্বব্যাপী। নতুন বিপ্লব ও ইসলামী পুনর্জাগরণের জন্য আরব জাহান ও মধ্যপ্রাচ্যের চাইতে অধিক উপযোগী ভূখণ্ড আর কোনটিই হতে পারে না। এসব কারণেই একজন হিন্দী বংশোদ্ভূত হয়েও লেখক আরবী ভাষাকেই এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের জন্য নির্বাচন করেছেন এবং এ গ্রন্থ সর্বপ্রথম আরবীতেই লেখা হয় এবং (আরবি) নাম রাখা হয়।
এ সময়েই (১৯৪৭ সালে) হেজাযের প্রথম সফরের সুযোগ ঘটে। সেখানে প্রথম বারের মত লেখক আরব দেশ ও সেদেশের বাসিন্দাদের খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ পান যাদের জন্য এ বই লেখা হয়েছিল। হেজায় অবস্থান ও আরব জাহানের লোকদের সঙ্গে পরিচয় লেখকের ধারণাকে আরও শক্তি জোগায় এবং এ বইয়ের যথা সম্ভব সত্ত্বর প্রকাশের প্রয়োজনীয়তাকে আরও তীব্রতর করে তোলে। মক্কা মুআজ্জমায় অবস্থানকালে লেখক গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ের আবশ্যকতা আরও তীব্রভাবে অনুভব করেন এবং জাহিলী যুগের সামগ্রিক চিত্র আরও স্পষ্টতর করে অংকন ও বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা দরকার বোধ করেন যে, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাবের সময় দুনিয়ার অবস্থা কি ছিল এবং কোন ধর্মীয়, নৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও উনিশ অর্থনৈতিক পরিবেশের মধ্যে তিনি ইসলামের দাওয়াত পেশ করেছিলেন। ইসলামী বিপ্লবের শ্রেষ্ঠত্ব এবং তার বিস্ময়কর ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদান ততক্ষণ। পর্যন্ত বোঝা যাবে না যতক্ষণ না জাহিলিয়াত যুগের সমগ্র পরিবেশ ও তার চিত্র সামনে আসে। এ জন্যই প্রয়োজন মনে করেছি জাহেলিয়াতে পরিপূর্ণ এ্যালবাম পেশ করার। এসময় দেখতে পেলাম জাহিলী যুগ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপকরণ খুবই দুষ্প্রাপ্য। কিছু বিক্ষিপ্ত তথ্য পাওয়া যায় বটে, কিন্তু সেগুলো বিভিন্ন পুস্তকের হাজারো পৃষ্ঠার মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সে সব তথ্য-উপাত্ত একত্র করা এবং ঐ সব বিক্ষিপ্ত ও বিস্রস্ত অংশের সাহায্যে জাহেলিয়াতের পরিপূর্ণ এ্যালবাম তৈরি করা যাতে সে যুগের সমগ্র জীবনে। সামনে এসে যায়সীরাতুন নবীর একটি বিরাট বড় খেদমত। মক্কা মুআজ্জমায়। অবস্থানকালে লেখক প্রাচীন ও আধুনিক কালের লিখিত গ্রন্থাবলীর এমন এক ভাণ্ডার পেয়ে যান এই এ্যালবাম তৈরিতে যা বিরাট সাহায্য করেছে। হিন্দুস্তানেও অধ্যয়ন ও গবেষণার ধারা অব্যাহত থাকে এবং এই অধ্যায় পূর্ণতা পায় ও পুস্তকের অন্তর্ভুক্ত হয়। এতে করে পুস্তকটি আরও সমৃদ্ধ হয়। এরই সাথে সাথে এই ধারণাও সৃষ্টি হয় যে, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সালামের আর্বিভাবের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া এবং ইসলামী দাওয়াতের অনান্য বৈশিষ্ট্যগুলোও বিস্তারিতভাবে তুলে ধরি। সেই সাথে এই দাওয়াতের মেযাজ ও এর কর্মপন্থা কি, আম্বিয়া আলায়হিমু’স-সালাম স্ব-স্ব যুগের বিগড়ে যাওয়া পৃথিবীর কিভাবে সংস্কার ও সংশোধন করতেন, তাঁদের দাওয়াত ও চেষ্টা-সাধনার ধরন অপরাপর সংস্কারক ও নেতৃবৃন্দের থেকে কতটা ভিন্ন, তাঁদের দাওয়াতের প্রতিক্রিয়াই কি হতো কিংবা কিভাবেই বা লোকে একে অভ্যর্থনা জানাত, জাহেলিয়াত কিভাবে তার মুকাবিলায় এসে দাঁড়াত এবং এর মুকাবিলায়। কি কি ও কোন্ ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করত, আর আম্বিয়া আলায়হিমু'স-সালাম। তাদের অনুসারীদের কি ভাবে প্রশিক্ষণ দান করতেন, তাদেরকে গড়ে তুলতেন, এরপর তাঁদের দাওয়াত কিভাবে বিজয় লাভ করত এবং কিভাবেই-বা এর প্রভাব-প্রতিক্রিয়া ও পরিণতি জাহির হতো তাও খোলাখুলি তুলে ধরি। এটা এ বইয়ের একটি অপরিহার্য অধ্যায় যা ছাড়া এ বই অসম্পূর্ণ থেকে যেত।
লেখক চাচ্ছিলেন, বইটি যেহেতু আরবী ভাষায় লেখা বিধায় এটি মিসরের কোন অভিজাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত হোক এবং যথাযোগ্য পরিচিতি পাক যাতে করে যেই উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সামনে নিয়ে এটি লেখা হয়েছিল তা সফল হয়। দীর্ঘ অপেক্ষার পর (আরবি) নামক প্রতিষ্ঠানকে এতদুদ্দেশ্যে নির্বাচিত করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি মিসরের একটি মর্যাদাবান ও অভিজাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান হিসেবে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে খ্যাত।
বইয়ের ভূমিকা লেখার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ড. আহমদ-আমীন, সাবেক প্রধান, ভাষা বিভাগ, মিসর ‘ভার্সিটি-কে অনুরোধ জ্ঞাপন করা হয়। ড. আহমদ আমীন ইতোমধ্যেই দু’ল ইসলাম ও ফজরুল ইসলাম’ নামক দু'টো বই লিখে ব্যাপক খ্যাতি ও পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তাঁর অর্ন্তদৃষ্টি ও সুস্থ চিন্তা-চেতনা লেখককে সে সময় বেশ প্রভাবিতও করেছিল। পুস্তকের পাণ্ডুলিপি ড. আহমদ আমীনের খেদমতে পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং এ সম্পর্কে একটি রিভিউ রিপোর্ট পেশের জন্যও অনুরোধ জানানো হয়। তিনি প্রকাশনা কমিটি বরাবর তার পেশকৃত রিভিউ রিপোর্টে পুস্তকটি প্রকাশের পক্ষে জোরালো সুপারিশ করেন এবং কৃত অনুরোধের প্রেক্ষিতে একটি ভূমিকাও লেখেন।
কিন্তু বইটি প্রকাশের পর দেখা গেল, ভূমিকা লেখক হিসেবে ড. আহমদ আমীনকে নির্বাচন করে লেখক ভুল করেছেন। কেননা কোন বইয়ের ভূমিকা লেখার জন্য লেখকের সুস্থ চিন্তা-চেতনা, সূক্ষ্ম দৃষ্টি ও ব্যাপক পাণ্ডিত্যই যথেষ্ট নয়। এজন্য প্রয়োজন ভূমিকা লেখক মূল বইয়ের পেশকৃত বক্তব্য ও বিষয়বস্তুর প্রতি সহানুভূতিশীল ও একমত হবেন এবং লেখকের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের। উৎসাহী সমর্থক হবেন, লেখকের বক্তব্যের ব্যাপারে পূর্ণ প্রত্যয়ী ও এর সাফল্যের ব্যাপারে আন্তরিকভাবেই আকাক্ষী হবেন। ভূমিকা লেখকের মধ্যে এসব বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে কমতি ছিল। তিনি ছিলেন কেবলই একজন চিন্তাশীল লেখক এবং একজন সফল ঐতিহাসিক। ইসলামের পুনর্জাগরণও যে সম্ভব এবং সে যে পুনরায় সমগ্র বিশ্বের নেতৃত্ব দিতে সক্ষম সে ব্যাপারে খুব একটা আশাবাদী নন। একেও তিনি একটি তত্ত্বগত ও ঐতিহাসিক বিষয়ের মতই। ভাবতে পারেন, কিন্তু এর প্রতি নিজের অন্তরের গভীরে বিশেষ কোন আবেগ ও আশা-ভরসা পোষণ করেন না। মূলত গ্রন্থের মূল স্পিরিটের সঙ্গে ভূমিকা লেখকের বিশেষ কোন সম্বন্ধ ছিল না।
ফল হলো এই, তাঁর লিখিত ভূমিকা হলো নিষ্প্রাণ, প্রভাবশূন্য ও আবেদনহীন দায়সারা গোছের। মিসর, ফিলিস্তীন ও হেজায ভূমিতে সর্বত্রই এটা অনুভূত হয়েছে যে, ভূমিকা বইয়ের মূল্য ও মর্যাদা বাড়িয়ে দেবার পরিবর্তে তার মূল স্পিরিটকেই আহত করেছে এবং বইটাকে হাল্কা করে দিয়েছে। কিন্তু তখন। যা হবার তা হয়ে গিয়েছে। তীর ধনুক থেকে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও বইটি আলোচ্য প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত হওয়ায় সব দিক থেকেই উপকার হয়েছে। কেননা, আলোচ্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বইটি সেসব মহলে পৌঁছে গেছে। যেখানে নির্ভেজাল ধর্মীয় বই ও ইসলামের দাওয়াত সম্বলিত পুস্তক-পুস্তিকা খুব সহজে গৃহীত হয় না।
১৯৫১ সনে যখন মধ্যপ্রাচ্যে ভ্রমণের সুযোগ হলো-তখন এটা দেখে বড় আশ্চর্য লাগল এবং আনন্দও অনুভব করলাম যে, বইটি সে সব দেশে বড় আগ্রহের সাথে পঠিত হচ্ছে এবং অত্যন্ত উষ্ণ আবেগের সাথে বইটিকে স্বাগতম জানানো হয়েছে যা প্রকাশ পাবার দু-তিন মাসের মধ্যেই সমগ্র আরব বিশ্বে পৌঁছে গিয়েছিল। ইসলামী দলগুলো অত্যন্ত আগ্রহের সাথে গ্রহণ করেছে। ইসলামী চিন্তায় উদ্বুদ্ধ বিভিন্ন শ্রেণীর লোক নিজেদের পক্ষ থেকে এ বই-এর প্রচার-প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। মিসরের ইখওয়ানুল মুসলিমূনের প্রশিক্ষণী সিলেবাসের অন্তর্ভূক্ত করা হয়। স্টাডি সার্কেল ও ট্রেনিং প্রশিক্ষণী গোষ্ঠী থেকে নিয়ে জেল খানা পর্যন্ত এর প্রচার ও প্রসারের কাজ করা হয়। আদালতের বিতর্কে ও পার্লামেন্টের বক্তৃতায়ও এ বই থেকে উদ্ধৃতি প্রদান করা হয়েছে। আধুনিক ও প্রাচীনপন্থী উভয় শ্রেণীই একে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখেছে। বিষয়টি যেমন গ্রন্থকারের জন্য মর্যাদা ও কৃতজ্ঞতার ব্যাপার তেমনি আরবদের প্রশস্ত অন্তর, সৎ সাহস ও সত্য প্রেমের সুস্পষ্ট প্রমাণও বটে। বইটিকে তারা যেভাবে গ্রহণ করেছেন এবং এর দূরপ্রান্তের একজন লেখককে যেভাবে উৎসাহিত করেছেন ও সাহস যুগিয়েছেন স্বদেশেও যা আশা করা যেত না।
মিসরে অবস্থানের সময়ই বই-এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের সুযোগ এসে যায়। এ সময় গ্রন্থকারের একনিষ্ঠ বন্ধু ও গ্রন্থের বিশেষ একজন ভক্ত মুহাম্মাদ ইউসুফ মূসা, সাবেক উস্তাদ, জামিউল আযহার এবং প্রফেসর, ইসলামিক ল,কায়রো ইউনির্ভারসিটি) স্বীয় কমিটি ‘জামা আতুল আযহার লিন্নাশরি ওয়া তা’লীফ- এর পক্ষ থেকে দ্বিতীয়বার বইটি প্রকাশের আগ্রহ প্রকাশ করেন। লেখকের ইঙ্গিতে তারা আহমাদ আমীনের কাছ থেকে এর অনুমতিও নিয়ে নেন। ফলে পূর্ব ভুলের প্রতিকারের সুযোেগ সৃষ্টি হয়। অধিকন্তু এমন একজন ব্যক্তির দ্বারা গ্রন্থের ভূমিকা লেখানোর সুযোগ আসে যিনি গ্রন্থের লক্ষ্য ও স্পিরিটের সাথে পরিপূর্ণ প্রত্যয় রাখেন এবং লক্ষ্যের দিকে শক্তিশালী আহ্বানকারী। এ কাজের সবচে’ যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন সায়্যিদ কুতুব (র.)। কারণ সায়্যিদ কুতুব (র.) ছিলেন আধুনিক মিসরে ইসলামী চিন্তা ও ইসলামী দাওয়াতের সবচেয়ে শক্তিশালী পতাকাবাহী। তাঁর কলম বিগত কয়েক বছর যাবত যুব সমাজের মধ্যে ইসলামী চিন্তা-চেতনা ও আত্মমর্যাদা সৃষ্টির কাজে উৎসর্গীত ছিল। তার ব্যক্তিত্বে সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি, বিশ্বকে অধ্যয়ন, আধুনিক সাহিত্যের শক্তিশালী কলম ও রীতিমত একজন নিষ্ঠাবান দাঈর আবেগ ও নিষ্ঠা এবং একজন নুতন মুসলমানের জোশ-জযবার সমাবেশ ঘটেছিল। তিনি তার অবস্থানগত কারণে মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করার পরও একজন নওমুসলিমই ছিলেন। পরিবেশ তাকে ইসলাম থেকে অনেক দূরে ঠেলে দিয়েছিল। কিন্তু আল-কুরআনের অধ্যয়ন ও গবেষণা, পাশ্চাত্য সভ্যতার ব্যর্থতা ও দেওলিয়াপনা তাঁকে ইসলামের দিকে ফিরিয়ে আনে। তাই তিনি নতুন আবেগ-উচ্ছাস, নতুন দৃঢ়তা ও প্রত্যয় নিয়ে ইসলামের দিকে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি দারুল উলুম মিসুর (বর্তমান কায়রো ভার্সিটির অংশ)-এর স্কলার। সাহিত্য সমালোচনার মধ্য দিয়ে তাঁর সাহিত্য জীবন শুরু হয়। তিনি খুব দ্রুত সুধী সমাজে স্বীয় অবস্থান সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। তাঁর ( সাহিত্য সমালোচনা ) ,(আল-কুরআনের শিল্প-সৌন্দৰ্য) ,(আল-কুরআনে মহা প্রলয়ের দৃশ্য) যা এ যুগের স্মরণীয় ও সাহিত্য সমাজে বরণীয় সফল গ্রন্থসমূহের অন্যতম। দীর্ঘ দিন যাবৎ শিক্ষা বিভাগের সাথে জড়িত ছিলেন। এ বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ে পড়াশোনার জন্য তাঁকে বেশ কিছু কাল আমেরিকাতেও অবস্থান করতে হয়। অবস্থানকালে পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্ধকার দিকগুলো তার সামনে দিবালোকের মত ফুটে ওঠে। পাশ্চাত্য সভ্যতা ও এর জীবন দর্শনের ব্যর্থতার করুণ দৃশ্য তিনি স্বচক্ষে দেখার সুযোগ লাভ করেন। এতে তাঁর বিশ্বাস ও প্রত্যয় এবং ইসলামের সাথে সম্পর্ক আরও বৃদ্ধি পায় ও সুদৃঢ় হয়। তার মাঝে ইসলামী দাওয়াতের আবেগ ও উচ্ছাস আরও বর্ধিত হয়। আমেরিকা থেকে ফিরে আসার পর তিনি ইসলামের আবেগ-উদ্বেলিত দাঈ ও পাশ্চাত্য সভ্যতার বিচক্ষণ সমালোচকে পরিণত হন। সর্বদা আধুনিক ইসলামী সাহিত্য সৃষ্টিতে নিজকে ব্যস্ত রাখেন। তাঁর চিন্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি ইসলামকে সমগ্র মানবতার জন্য একটি চিরন্তন ও বিশ্বজনীন পয়গাম মানেন, ছাড়া পৃথিবীতে মুক্তি ও শান্তি আসতে পারে না। তাঁর লেখনীর বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, তিনি অপারগতা ও আত্মরক্ষার পক্ষে নন বরং তিনি পাশ্চাত্য সভ্যতার মূলে কঠোর আঘাত হানেন এবং প্রতিপক্ষকে অগ্রসর হয়ে আক্রমণ করেন। তিনি ইসলামের ভেতর কোন দূর্বলতা ও অসম্পূর্ণতা অনুভব করেন না। তিনি ইসলামকে একটি পরিপূর্ণ ও সর্বাঙ্গীন জীবন-বিধান হিসেবে পূর্ণ বিশ্বাস ও প্রত্যয়ের সাথে উপস্থাপন করেন। তাই তাঁর লেখা পাঠকদের মাঝে ইসলামের ওপর পরিপূর্ণ নির্ভরশীলতা, প্রত্যয় ও নবজীবন দান করে এবং পাশ্চাত্য চিন্তাধারা ও সমাজ ব্যবস্থার জৌলুসকে উপেক্ষা করার শক্তি জোগায়। যুব সমাজ তাঁর গ্রন্থসমূহ ও প্রবন্ধমালা পাঠে অত্যন্ত প্রভাবিত হয়ে থাকে। তার গ্রন্থ (আরবি) (ইসলামের সামাজিক সুবিচার) (বাংলায় অনুদিত) (যদিও তার কোন কোন বক্তব্যের সাথে মতপার্থক্য আছে) এ ধরনের প্রচেষ্টার সফল উদাহরণ এবং আধুনিক ইসলামী আরবী সাহিত্যের মাঝে বিশিষ্ট মর্যাদার দাবিদার।
জনাব সায়্যিদ কুতুব বইটি অত্যন্ত আগ্রহ ভরে পাঠ করেন। তাঁর সাপ্তাহিক আলোচনা সভায় বইয়ের সারসংক্ষেপ পেশ ও তার ওপর আলোচনা-পর্যালোচনাও হতো যাতে লেখকেরও অংশ গ্রহণ করার সুযোগ হয়েছিল। ভূমিকা লেখার গোযারিশ করা হলে তিনি সানন্দে গ্রহণ করেন এবং এমন অপূর্ব সুন্দর ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ ভূমিকা লিখেন যার ভেতর তিনি গোটা বই-এর নির্যাসকে একত্র করে ফেলেন। এ ভূমিকা যা বর্তমানে বই-এর জন্য শোভা ও সৌন্দর্য, বই-এ এক নতুন অধ্যায়ের সংযোজন করে যা গোটা বই-এর সুন্দর সারসংক্ষেপ। সায়্যিদ কুতুবের পাণ্ডিত্যপূর্ণ ভূমিকা ছাড়াও মরহুম ডঃ মুহাম্মদ ইউসুফ মুসাও মেহেরবানী করে একটি ভূমিকা লেখেন যার ভেতর তিনি বই সম্পর্কে তাঁর অন্তরের অভিব্যক্তি ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ ধারণা ব্যক্ত করেন। এ ছাড়া লেখকের অকৃত্রিম বন্ধু শায়খ আহমদ শেরবাসী (উস্তাদ, জামিউল আযহার) লেখকের অজান্তেই নিজের বিশেষ ভঙ্গিতে গ্রন্থকারের পরিচয় ও সংক্ষেপে লেখকের জীবন-বৃত্তান্ত লেখেন। এ দু'টো ভূমিকা অনুবাদ করার প্রয়োজন মনে করা হয়নি।
১৯৪৬ সনে একথা ভেবে যে- না জানি কবে আসল আরবী গ্রন্থ প্রকাশিত হয়, লেখক গ্রন্থখানিকে উর্দু ভাষায় অনুবাদের ব্যবস্থা করেন। এ অনুবাদ গ্রন্থ মুসলমাকে তানাযযুল ছে দুনিয়া কো কিয়া কসান পচা' নামে প্রকাশিত হয়। প্রথম সংস্করণে বইটির অংগ-সজ্জা, কাগজ ও ছাপা ইত্যাদি বইয়ের বিষয়বস্তু, গুরুত্ব ও মর্যাদার সাথে সংগতিপূর্ণ ছিল না। বইটির প্রাথমিক দু'টি অধ্যায় মুহাম্মদ (স)-এর আবির্ভাবের আগে ও মুহাম্মদ (ﷺ) -এর আবির্ভাবের পরে] যা ৪৭-এর পর সংযোজন করা হয়েছে এবং গুরুত্বপূর্ণ অনেক সংযোজন। যা মূল আরবী গ্রন্থ প্রকাশের পূর্বপর্যন্ত ছিল না। এ পর্যন্ত মিসর থেকে গ্রন্থের দুটি সংস্করণ বের হয়ে গিয়েছে এবং তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশের পথে এবং সংযোজনের ফলে বই-এর কলেবর দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। অতঃপর উর্দুতে বইটির নতুন সংস্করণ প্রকাশ করার ইচ্ছা জন্ম নেয়। এ সময় সামাজিক ও রাজনৈতিক নানাবিধ কারণে এর অনুবাদ করার আমার ফুরসত হচ্ছিলো না। তাই এসবের অনুবাদের দায়িত্ব আমার প্রিয় সহকর্মীদের ওপর অর্পণ করি। আল্লাহর শোকর যে তারা সে খেদমত অত্যন্ত সুচারুরূপে আঞ্জাম দেন। এসব খেদমতের মাঝে সবচে বড় অংশ আবদুল্লাহ ফুলওয়ারী নদভী (ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক, নদওয়াতুল উলামা) এবং মাওলানা মুহাম্মাদ রাবে নদভী, শিক্ষক (ভাষা ও সাহিত্য, নদওয়াতুল উলামা) কে অর্পণ করা হয়। কিছু অংশ স্নেহের ভ্রাতুস্পুত্র মাওলানা মুহাম্মাদ আল-হাসানীর কলমেও আনজাম পেয়েছে। আমি উক্ত প্রিয়ভাজনদের কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ এবং তাদের জন্য দু'আ করছি। কারণ তাদের প্রচেষ্টাই বইটি আলোর মুখ দেখার উপযুক্ত হয়েছে। এখন বইটি “ইনসানী দুনিয়া পর মুসলমাকে উরূজ ও যাওয়াল কা আছর” (বিশ্বে মুসলমানদের উত্থান পতনের প্রভাব) নামে উর্দু ভাষায় প্রকাশিত হচ্ছে।
গ্রন্থকার বই-এর ক্ষেত্রে কোন নতুন আবিষ্কার, বিশেষ গবেষণা ও ইজতিহাদের দাবি করেন না আর না নিজের ব্যাপারে কোন অতি উচ্চ ধারণা পোষণ করেন। এ বইটি একটি নিষ্ঠাপূর্ণ ও নিরপেক্ষ ঐতিহাসিক পর্যালোচনা মাত্র এবং একটি স্বাভাবিক প্রশ্নের জ্ঞানগর্ভ জবাব। হতে পারে এ প্রশ্ন অনেকের মস্তিষ্কেই এসেছে এবং বিভিন্নভাবে তার উত্তর প্রদান করা হয়েছে। লেখক শুধু এতটুকু করেছেন যে, উক্ত প্রশ্নটি সকলের সামনে উত্থাপন করেছেন এবং একে একটি স্বতন্ত্র বিষয় বানিয়ে এ সম্পর্কিত ঐতিহাসিক উপাদানসমূহ একত্র করে দিয়েছেন। এতে যদি কোন অন্তরে সামান্যতম অনুভূতি ও চেতনা সৃষ্টি হয়, কোন হৃদয়ে নুতন ব্যথা ও বেদনার উদ্রেক করে, তবে গ্রন্থকার তার প্রচেষ্টায় সফল। প্রত্যেক কল্যাণময় বিপ্লব ও নতুন সমাজ গড়ার জন্য অন্তরকে জাগ্রত করা এবং মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ অত্যন্ত প্রয়োজন। তাই সঠিক লক্ষ্যে ইতিহাসকে বিন্যাস এবং এমন লেখনী ও রচনাবলীর প্রয়োজন যা যুক্তি ও প্রমাণ সর্বদিক থেকে মন-মস্তিষ্ক, অন্তর ও আত্মাকে পরিতৃপ্ত করতে সক্ষম। অপর দিকে তা পাঠকের অন্তরে প্রত্যয় ও দৃঢ় বিশ্বাস জন্ম দেবে এবং কর্মের আবেগ সৃষ্টি করবে। অতির। ন ও বিনয় উভয় থেকে মুক্ত হয়ে এ কথা বলার সাহস করা যায় যে, বইটি স্বীয় বিষয় ও উপাদানের দিক থেকে এ ধারার একটি গুরুত্বপূর্ণ ও উপকারী গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে এবং এ গ্রন্থ থেকে দল-মত নির্বিশেষে সকল চিন্তার অধিকারী মুসলমান উপকৃত হতে পারেন।
وماتوفیقی الابالله عليه توكلت واليه انيب
১৫ রবিউছ-ছানী, ১৩৭৩ হি.
আবুল হাসান আলী নদভী
بسم الله الرحمن الرحيم
মিসরের খ্যাতিমান সাহিত্যিক ইসলামী চিন্তাবিদ অমর শহীদ সাইয়েদ কুতুব লিখিত ভূমিকা
আজ এমন একজন ব্যক্তির ভীষণ প্রয়োজন, যিনি মুসলিম উম্মাহর সেই আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনবেন, যা তাদেরকে উজ্জীবিত চেতনায় শুধু সামনে চলার পথ-নির্দেশ করবে।
যিনি তাদেরকে বলবেন, 'তোমাদের একটি গর্বিত অতীত ছিল।' বলবেন, ‘তোমাদের সামনে স্বপ্নভরা, আশাভরা একটি ভবিষ্যতও অপেক্ষা করছে।
যিনি তাদেরকে সাবধান করে বলবেন- স্বীয় দ্বীন সম্পর্কে তাদের সীমাহীন অজ্ঞতার কথা, হতাশাব্যঞ্জক গাফিলতির কথা। যিনি তাদের চোখে চোখ রেখে পরিষ্কার করে বলবেন- এই দীন কোন উত্তরাধিকার’ নয় বরং তা অর্জন করতে হয়। হাসিল করতে হয় শাণিত বিশ্বাস দিয়ে, জাগ্রত চেতনা দিয়ে।
আমি আনন্দিত। আমি পুলকিত। আমি আমার প্রতীক্ষিত সেই মহান ব্যক্তির দেখা পেয়েছি। তিনি হলেন বর্তমান বিশ্বের অন্যতম রাহনুমা ও মুরুব্বী হযরত মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী। তাঁর অমর রচনা (মুসলমানদের পতনে বিশ্ব কী হারালোঃ)-র মাধ্যমে তিনি অবিকল সেই কথাগুলোই মুসলিম উম্মাহুকে বলেছেন যা একটু আগে আমি উল্লেখ করলাম। সত্যি বলতে কি, এই বিষয়ের ওপর আমি আমার এই সংক্ষিপ্ত জীবনে ‘আগে-পরে' যত বই পড়েছি, নিঃসন্দেহে এ বই তার মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবি রাখে।
ইসলামের আকীদা কোন ঠুনকো আকীদা নয়। এই আকীদা উন্নতি ও চির উৎকর্ষের আকীদা।
এই দীনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, তা মুমিনের হৃদয়-মনে অহংকার নয় সম্মান ও মর্যাদাবোধের সৃষ্টি করে। সৃষ্টি করে আরো এই চেতনা যে, অন্য কিছুতে নয় একমাত্র ইসলামী চেতনাবোধ ও বিশ্বাসের ভিতর দাঁড়িয়েই তাদেরকে স্বস্তি অনুভব করতে হবে। শান্তির ঠিকানা খুঁজতে হবে। তাদের ওপর রয়েছে গোটা বিশ্বের মানুষকে মুক্তির পথের ঠিকানা ও সন্ধান বাৎলে দেওয়ার। দায়িত্ব। তাদেরকে অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবী থেকে উদ্ধার করে আলোকময় পৃথিবীর পথ দেখানোর দায়িত্ব, যে আলো এসেছে সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে। ইরশাদ হচ্ছে
“তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত। মানবতার কল্যাণের জন্যেই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা মানুষকে কল্যাণের পথে ডাকবে আর অকল্যাণ থেকে দূরে রাখবে আর ঈমান রাখবে শুধুমাত্র আল্লাহর ওপর।”
“এই ভাবে আমি তোমাদেরকে এক মধ্যপন্থী উম্মতরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি যাতে তোমরা সাক্ষীস্বরূপ হতে পার মানবজাতির জন্যে এবং রাসূল সাক্ষীস্বরূপ হবেন তোমাদের জন্যে।”
হাঁ, এই গ্রন্থে পাঠকের উদ্দেশ্যে সে সব কথাই তিনি বলেছেন। পাঠকের হৃদয়-মনে তা প্রোথিত করার হৃদয়গ্রাহী উপস্থাপনা বেছে নিয়েছেন। এই গ্রন্থের গতিময়, প্রাণময় ও আবেগময় ভাষা ও উপস্থাপনায় পাঠকের মন আলোড়িত হয়। ঠিকই কিন্তু বল্পাহারা হয় না। কোন অপ্রীতিকর সাম্প্রদায়িকতাও এখানে পাঠকের মনকে কলুষিত করে না বরং তথ্য ও তত্ত্বভিত্তিক যুক্তির মাধ্যমে এ গ্রন্থের উদ্দেশ্য ও আবেদনকে অত্যন্ত বর্ণিল ভংগীতে চমৎকার উপস্থাপনায় ও অত্যন্ত হৃদয়-নন্দিত করে পাঠকের আবেগ-অনুভূতি ও সেই বিচার-বুদ্ধির কাছে পরিবেশন করা হয়েছে। কোন অস্পষ্টতা নেই, কোন প্রচ্ছন্নতা নেই, নেই কথায় কথায় কোন দ্বন্দ্বও। তাই কোন চাপাচাপি ছাড়াই অথচ ঠিক লেখকের ইচ্ছে মতই পাঠককে সিদ্ধান্ত নিতে একটু ও বেগ পেতে হয় না। এটাই এ গ্রন্থের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
ইসলামপূর্ব যুগে এই পৃথিবীর অবস্থা কেমন ছিল, তিনি তাঁরও একটি চিত্র এঁকেছেন। সুসংহত চিত্র। কোথাও বাড়াবাড়ি নেই। কোথাও লুকোচুরি নেই। উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিম সব দিকের চিত্রই রয়েছে এতে। হিন্দুস্তান থেকে চীন, চীন থেকে রোম ও রোম থেকে পারস্যসহ মোটামুটি সমগ্র দুনিয়ার সামাজিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক সে চিত্র।
এই চিত্রে উন্মোচন করা হয়েছে য়াহদী ও খ্রিস্ট ধর্মের স্বরূপ। যদিও তারা আসমানী ধর্মের অনুসরণের দাবিদার। এই চিত্রে ছিল প্রতিমাপূজারী হিন্দু ও বৌদ্ধদের কথাও। অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হলেও এই চিত্রে তাদেরও একটি পরিপূর্ণ অবস্থা বিবৃত হয়েছে। আর মূল গ্রন্থের সূচনা এখান থেকেই।
এই চিত্রাংকন এক সুসংহত চিত্রাংকন। লেখক এখানে নিজস্ব চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণা চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করেন নি। কোন গোড়ামী ও জিদকে কেন্দ্র করেও তাঁর লেখনী ও আলোচনা আবর্তিত হয়নি। তিনি বরং সকল প্রকার গণ্ডীমুক্ত হয়ে নতুন-পুরনোর সমন্বয় ঘটিয়ে পূর্বযুগ এবং বর্তমান যুগের অনেক গবেষক ও ঐতিহাসিকের মতামতও অত্যন্ত ইনসাফের সাথে উল্লেখ করেছেন। অথচ এদের অনেকেই ছিলেন ইসলাম বিদ্বেষী। ইসলামী ইতিহাসকে বিকৃত করার অভ্যাস মিশে ছিল এদের কারো কারো অস্থি-মজ্জায়।
তিনি এমন এক দুনিয়ার চিত্র তুলে ধরেছেন যখন পৃথিবীতে ছেয়ে গিয়েছিল জাহেলিয়াতের অন্ধকার। মানুষের বিবেক যখন সত্যের পক্ষে সাড়া দিত না।
মানুষের মন তখন নিষ্ঠুরতায় কেঁপে উঠত না। নির্বাসিত নীতি ও নৈতিকতা নীরবে শুধু কাঁদত। জুলুম-নিপীড়নের ভয়াবহতায় বারবার দুলে উঠত বনী আদমের এই আবাস। নিরন্তর ভেসে আসত এখানে-ওখানে নির্যাতিত মানবতার বুকফাটা আর্তনাদ। আসমানী ধর্ম তখনও ছিল কিন্তু ছিল বিকৃত ও প্রভাবহীন। তাতে ছিল না আত্মার কোন খোরাক, জীবনের কোন বার্তা। বিশেষত খ্রিষ্ট ধর্ম।
.... এরপর লেখক ইসলামী যুগের চিত্রাংকন শুরু করেছেন। জাহেলিয়াতের তিমির ভেদ করে হেসে উঠল পৃথিবী। এই চিত্রের সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে পাঠক যতই ওপরে উঠবেন, ততই দেখবেন ইসলামের আলো-রশি। এখানে চিত্রিত হয়েছে মানবাত্মার মহামুক্তির কথা। এ মুক্তি সংশয় ও কুসংস্কার থেকে। গোলামী ও দাসত্ব থেকে। নৈতিক অবক্ষয় ও চারিত্রিক ধ্বস থেকে।
এখানে মানবতার মুক্তি নিশ্চিত হয়েছে ইসলামী অনুশাসনের ছায়াতলে ইসলামের সুনপম আদর্শের পরশে। এখানে কোথাও নেই দুর্বলের ওপর সবলের সীমালংঘন ও বাড়াবাড়ি। এখানে কোথাও নেই গোত্রে গোত্রে ও জাতিতে-জাতিতে হানাহানি ও মারামারি।
এই চিত্রে আরো ফুটে উঠেছে জাহেলিয়াতের চির অমানিশা থেকে মুক্ত হয়ে একটি ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র স্থাপিত হওয়ার বর্ণিল ছবি। একের পর এক। যার ভিত্তি সততা, পবিত্রতা, আল্লাহ ভীতি ও আমানতদারী।
--- যার ভিত্তি আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস এবং নিঃশর্ত আনুগত্য ও স্বতস্ফূর্ত আত্মসমর্পণ।
.... যার ভিত্তি ন্যায়-বিচার ও সত্যের গলাগলি আর অন্যায়-অবিচার ও মিথ্যার সাথে পাঞ্জা লড়ালড়ি।
..... যার ভিত্তি নিরন্তর নিষ্ঠাপূর্ণ কাজের ভিতর দিয়ে পরকালমুখী করে সাজিয়ে চলা।
...... যার ভিত্তি জীবন-প্রবাহের বিস্তৃত পরিসরে সবাইকে সবার অধিকার বুঝিয়ে দেয়া এবং অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।
এ সবই বাস্তবতার রূপ নিয়ে মানুষের জীবনকে স্পর্শ করেছিল তখন যখন সর্বত্র নেতৃত্ব ছিল ইসলামের। কর্তৃত্ব ছিল ইসলামের। যখন সব কিছুই আবর্তিত হতো ইসলামকে কেন্দ্র করে। ইসলামী অনুশাসনকে মাথায় রেখে। যখন একেবারেই অকল্পনীয় ছিল ইসলামবিহীন নেতৃত্ব কর্তৃত্ব।
সেদিন ভালো করে প্রমাণিত হয়েছিল জীবন-ব্যবস্থা হিসাবে ইসলামই উপযুক্ত।
আকীদা হিসাবে ইসলামই শ্রেষ্ঠ। আদর্শ হিসাবে ইসলামই চির অনুসরণীয়।
এরপর লেখকের কলমে বড় বেদনাময় চিত্র ফুটে ওঠে। সে চিত্র মুসলিম উম্মাহ্র দুর্দিনের চিত্র। নেতৃত্ব থেকে তাদের দূরে নিক্ষিপ্ত হওয়ার চিত্র। তাদের অধঃপতনের করুণ চিত্র। যে অধঃপতন একদিকে ছিল যেমন আত্মিক, অন্যদিকে। তেমনি বাহ্যিক। এখানে লেখক মুসলমানদের এই আত্মিক ও বাহ্যিক অধঃপতনের কারণগুলো বর্ণনা করেছেন। ধর্মীয় অনুশাসনের মৌলিকত্ব থেকে দূরে সরে আসার ও নেতৃত্বহারা হওয়ার কারণে কী দুর্যোগ ও দুঃসময় নেমে এসেছিল তাদের ওপর এবং পাশাপাশি প্রায় প্রতিযোগিতামূলকভাবে পূর্বের সেই জাহেলিয়াতের দিকে ছুটে যাওয়ার কারণে কী সর্বনাশী ঝড় বয়ে গিয়েছিল তাদের ওপর দিয়ে। সে চিত্রও লেখক তুলে ধরেছেন।
দূর্ভাগ্যক্রমে এই সময়টাতেই অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী পার্থিব জ্ঞান-বিজ্ঞানে নতুন নতুন আবিস্কারের মাধ্যমে উন্নতির শীর্ষচূড়ায় উপনীত হয়।
লেখক অত্যন্ত আমানতদারী ও সততার সাথে এই চিত্র তুলে ধরেছেন, যেখানে নেই উস্কানীমূলক কোন কথা নেই আবেগোদ্দীপক কোন উপস্থাপনা। যা কিছু ঘটেছে এবং যেখানে ঘটেছে তা-ই তিনি অবিকল তুলে ধরেছেন কোন প্রকার অতিশয়োক্তি ও রংমিশ্রণ ছাড়াই।
হাঁ, এই চিত্র পাঠকের মনে বড় রেখাপাত করে। তার মনকে বড় গভীরভাবে ছুঁয়ে যায়। পাঠক এসব পড়তে পড়তে গভীরভাবে অনুভব করতে থাকেন যে, অবশ্যই চলমান জাহেলী নেতৃত্বের অবসান হতে হবে। দিশেহারা মানব কাফেলাকে এই জাহেলিয়াতের অন্ধকার থেকে উদ্ধার করে ইসলামী নেতৃত্বের আলোকোজ্জ্বল ভুবনে নিয়ে আসতে হবে।
পাঠক আরো অনুভব করেন যে, দিশেহারা মানব কাফেলাকে সঠিক পথের। দিশা দেওয়ার জন্যে ইসলামী নেতৃত্বের কী অপরিসীম প্রয়োজন এবং এই নেতৃত্বের অনুপস্থিতি মানুষের জন্যে কী ভয়ংকর ও বেদনায়ক পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
সত্যি কথা হলো, মুসলমানদের নেতৃত্বের আসন থেকে দূরে সরে আসার কারণে যে ভয়াবহ পরিণতি নেমে আসে, তা শুধু মুসলমানদের জন্যেই নেমে আসে না বরং তা গোটা মানবতাকেই গ্রাস করে ফেলে। পৃথিবীর ইতিহাস যার নজীর পেশ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আরেকটু সামনে গিয়ে পাঠকের মনে নিজের অজান্তেই সৃষ্টি হয় অনুশোচনা ও আক্ষেপের অনুভূতি। স্রষ্টা প্রদত্ত দানের জন্যে সৃষ্টি হয় কৃতজ্ঞতাবোধ। সৃষ্টি, হয় হারিয়ে যাওয়া মুসলিম নেতৃত্ব পুনরুদ্ধারের সংকল্পবোধও।
এই গ্রন্থের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, নেতৃত্ব হারানোর ফলে মুসলিম উম্মাহর ওপর যে অধঃপতন নেমে এসেছে, লেখক সেই অধঃপতনকে ‘জাহিলিয়াত’ শব্দের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন। লেখকের এই ব্যতিক্রমী উপস্থাপনা সব যুগের জাহেলিয়াতের স্বরূপ উন্মোচিত করেছে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে। তিনি প্রমাণ করেছেন যে, যুগের পরিবর্তনে জাহেলিয়াতের মধ্যে পোশাক পরিবর্তন এলেও মৌলিকভাবে জাহেলিয়াত একই। ইসলাম-পূর্ব জাহেলিয়াত আর বিংশ শতাব্দির জাহেলিয়াত একই পরিণতির দিকে মানুষকে ঠেলে দেয়। যেখানেই জাহেলিয়াতের অনুপ্রবেশ ঘটবে, সেখানেই নীতি-নৈতিকতা ও ন্যায়-অন্যায় বোধ বিলুপ্ত হবে। সুতরাং জাহেলিয়াতের কোন স্থান-কাল-পাত্র নেই বরং যখনই উম্মতের মধ্যে বিবেক-বুদ্ধি ও চিন্তা-চেতনা ও নৈতিক অবক্ষয় ও চারিত্রিক ধ্বস দেখা দেবে, তখনই বুঝতে হবে জাহেলিয়াত তাদের মধ্যে জেঁকে বসেছে। যখনই উম্মাহ ইসলামী অনুশাসনকে এড়িয়ে বল্গাহারা জীবনে তৃপ্তি খুঁজে ফিরবে, তখনই বুঝতে হবে জাহেলিয়াতের বেড়াজালে তারা আটকা পড়েছে।
এই জাহেলিয়াতেরই করুণ পরিণতি ভোগ করছে আজ বিশ্ব মানবতা, যেমনটি ভোগ করেছিলো প্রাক-ইসলামী যুগের সেই বর্বর দিনগুলোতে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/788/6
রিডিং সেটিংস
Bangla
English
Bangla
Indonesian
Urdu
System
System
Dark
Green
Teal
Purple
Brown
Sepia
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
Kfgq Hafs
Qalam
Scheherazade
Kaleel
Madani
Khayma
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
Kalpurush
Rajdip
Bensen
Ekushe
Alinur Nakkhatra
Dhakaiya
Saboj Charulota
Niladri Nur
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।