মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
আসসালামু আলাইকুম, Hadith.one বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে! আমাদের সার্ভারের মেয়াদ ১১ অক্টোবর ২০২৫ এ শেষ হবে, এবং এবং ওয়েবসাইট টি চালানোর জন্য আমাদের কোনো ফান্ড নেই।
🌟 আপনার দান এই প্ল্যাটফর্মকে বাঁচাতে পারে এবং প্রতিটি হাদিস পড়ার মাধ্যমে সদকাহ জারিয়ার অংশীদার হতে পারেন!
🔗 অনুগ্রহ করে আপনার দানের মাধ্যমে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি চালিয়ে নিতে সাহায্য করুন!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!
মুসলিম প্রাচ্যে মানুষের উন্নতি-অগ্রগতি ও চরমোঙ্কর্ষের মান ছিল খুবই উন্নত। এজন্য দীন ও দুনিয়া এবং ইলম ও আমলের সমন্বয়ে বহুবিধ মানবীয় গুণ দ্বারা ভূষিত এবং মানবীয় উৎকর্ষ এমন বহু বিক্ষিপ্ত শাখা-প্রশাখার সম্মিলন অনিবার্য ছিল যার মধ্যে এ যুগের হীনমন্যতা ও সংকীর্ণ দৃষ্টি পরস্পরবিরোধী মনে করে থাকে এবং কোন মানুষের মধ্যে একই সময় এসব গুণের যে সমাবেশ ঘটতে পারে তা কল্পনা করতেও অধিকাংশ অক্ষম। সমগ্র মুসলিম বিশ্বে কেবল ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম রাজা-বাদশাহ, তাদের উযীর-নাযীর ও আমীর-উমারার জীবন-চরিতের ওপরই দৃষ্টিক্ষেপণ করুন। আপনি দেখবেন বুলন্দ হিম্মতি, উন্নত মনোবল, চরমোকর্ষ ও নিত্য-নতুন বৈশিষ্ট্য, রাজকীয় পোশাকের নিচে দরবেশী আলখাল্লা, রাজনৈতিক অভিযান মগ্নতার সঙ্গেই ইবাদত-বন্দেগীতেও মশগুল ও তৎপর, সেই সাথে লেখাপড়া ও জ্ঞান চর্চার এমন সব দুর্লভ নমুনা মিলবে যার নজীর সাধারণ মানব ইতিহাসে মেলা ভার এবং যার সত্যতা এ যুগের সংকীর্ণ মানসিকতা ও মানবীয় উন্নতি ও চরমোৎকর্ষ সম্পর্কে সীমিত ধারণা বিশ্বাস করতে বারবার পীড়া অনুভব করবে।
সুলতান শামসুদ্দীন আলতামাশের সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ও এর রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও রাজনীতি বিষয়ক ব্যস্ততার অবস্থা ভারতীয় ইতিহাসের ছাত্র মাত্রেরই জানা। কিন্তু এই সাথে এটাও লক্ষ্য রাখতে হবে, তাঁর ইন্তিজামী ব্যস্ততা, রাজকীয় প্রয়োজন, এর চাহিদা ও দাবি এবং যুদ্ধ-বিগ্রহ ও ভ্রমণের আধিক্য তাঁর ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা ও নিয়মিত আমলসমূহ পালনের ক্ষেত্রে এতটুকু ব্যত্যয় সৃষ্টি করতে পারে নি। হযরত কুতবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী(র.) ইনতিকালের সময় ওসিয়ত করে গিয়েছিলেন, আমার জানাযা তিনি পড়াবেন যার আসরের সুন্নত ও তকবীরে উলা কখনো ফওত হয়নি। অতঃপর এই ওসিয়ত ঘোষিত হলে সুলতান স্বয়ং সম্মুখে অগ্রসর হন এবং তার জানাযা পড়ান।
সুলতান গিয়াসুদ্দীন বলবন, নাসিরুদ্দীন মাহমূদ, ফীরোয শাহ তুগলক প্রমুখের ধর্মীয় জীবন ও মযহাবী আনুগত্যের অবস্থা সম্পর্কে সকলেই অবগত। গুজরাটের সুলতানগণ, বিশেষভাবে দীন ও দুনিয়ার সমন্বয়কারী এবং এক একজন বাহ্যত প্রভাবশালী শাসক হলেও স্বভাবগতভাবে যুগের “জুনায়দ বাগদাদী” তুল্য দরবেশ ছিলেন। মাহমুদ শাহ ১ম ও তদীয় পুত্র সুলতান মুজাফফর শাহ হালীম-এর জীবন কাহিনী এর সর্বোত্তম সাক্ষ্য। ভারতীয় ঐতিহাসিক মাওলানা হাকীম সাইয়েদ আবদুল হাই(র.) মুজাফফর শাহ হালীম-এর জীবন কাহিনী লিখতে গিয়ে তদীয় “ইয়াদে আয়্যাম” নামক গ্রন্থে বলেনঃ
“মাহমুদ শাহুর পর তদীয় উপযুক্ত সন্তান মুজাফফর শাহ হালীম পিত সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। জ্ঞান ও বিদ্যাবত্তার ক্ষেত্রে তিনি আল্লামা মুহাম্মদ ইবন মুহাম্মদ এলায়েজীর শাগরিদ ছিলেন এবং হাদীস পড়েছিলেন আল্লামা জামালুদ্দীন মুহাম্মদ ইবন ওমর বাহরূকের কাছে। তিনি এমন বয়সে কুরআন মজীদ হেফজ করার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন যেই বয়স সম্পর্কে শেখ সাদী বলেন।
درایام جوانی چنان که افتد دانی
“এই ইলমী যোগ্যতার সাথে তাকওয়া ও আযীমতরূপ সম্পদও তিনি আল্লাহ্র পক্ষ থেকে লাভ করেছিলেন। গোটা জীবনটাই কুরআন ও হাদীসের ওপর আমল করেছেন। সব সময় ওযু অবস্থায় থাকতেন। জামাআতের সাথে সালাত আদায় করতেন। সমগ্র জীবনে একদিনের জন্যেও সিয়াম পরিত্যাগ করেন নি। কখনো মদ স্পর্শ করেন নি, কখনো কারোর প্রতি অহেতুক কঠোরতা প্রদর্শন করেন নি। অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহার করে কখনো নিজের মুখ কলুষিত করেন নি। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, পবিত্রতার এই প্রতিমূর্তির মধ্যে সৈনিকসুলভ গুণাবলী ও রাজ্য পরিচালনার কুশলতার সর্বোত্তম মাত্রায় সমন্বয় ঘটেছিল। মালব। বিজয়ের কাহিনী ইতিহাসে পাঠ করুন। এ থেকেই তাঁর চরিত্রের মহত্ত্ব পরিমাপ করুন। যে সময় মালবের সুলতান মাহমুদ শাহর অলসতা ও ভুল ব্যবস্থাপনার দরুন তদীয় মন্ত্রী মন্দলে রায় রাজ্যভার নিজের হাতে তুলে নেন এবং মাহমুদ শাহকে উৎখাত করে রাজ্য থেকে ইসলামের যাবতীয় নিদর্শন নিশ্চিহ্ন করে পৌঁত্তলিক প্রথার প্রচলন ঘটাতে সচেষ্ট হন, তখন মুজাফফর শাহ হালীমের ইসলামী মর্যাদাবোধ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। তিনি এক বিশাল বাহিনী নিয়ে মালব অভিমুখে যাত্রা করেন এবং মাশ্যে পৌঁছে তা অবরোধ করেন। মন্দলে রায় সে একা এই বাহিনীর মুকাবিলা করতে পারবে না ভেবে রানা সংঘকে মুল্যবান উপহার-উপঢৌকনের প্রলোভন দিয়ে তাকে সাহায্যের জন্য ডেকে পাঠান। রানা সংঘ তখনো সারেঙ্গপুর অবধি পৌঁছে নি, ওদিকে সুলতান মুজাফফর শাহ হালীম তাকে সৌজন্য প্রদর্শনের উদ্দেশে ফৌজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আগেই পাঠিয়ে দেন। ফলে রানা সংঘ আর সামনে অগ্রসর হতে সাহস পায় নি। এদিকে মন্দলে রায় চতুর্দিক থেকে সামরিক সাহায্য পাবার পূর্বেই সুলতান দুর্গ দখল করে নেন।
“অতঃপর দুর্গ দখলের পর যেই মুহূর্তে সুলতান মুজাফফর শাহ হালীম দুর্গের ভেতর প্রবেশ করেন এবং সঙ্গী আমীর-উমারা সুলতান সমভিব্যাহারে মালব সুলতানের রাজকীয় শোভা-সমৃদ্ধি, রাজকোষ ও গুপ্ত ধনভাণ্ডার পরিদর্শন করেন এবং রাজ্যের সমৃদ্ধি সম্পর্কে অবহিত হন, তখন তারা সাহস করে। সুলতান মুজাফফর শাহ সমীপে নিবেদন করেন, এই যুদ্ধে প্রায় দু'হাজার বীর সেনানী আমাদের শাহাদত লাভ করেছে। এত বিপুল ক্ষয়-ক্ষতির পর এই দেশ আবার সেই সুলতানকে প্রত্যর্পণ করা সমীচীন নয় যার ভ্রান্ত ব্যবস্থাপনার দরুন মন্দলে রায় এই রাজ্য দখল করতে সক্ষম হয়েছিল। সুলতান মুজাফফর শাহ একথা শুনতেই পরিদর্শনে সেখানেই ক্ষান্ত দেন এবং দুর্গের বাইরে বেরিয়ে গিয়ে মাহমুদ শাহকে বললেন, আমার সঙ্গী-সাথীদের কাউকেই আর দুর্গের ভেতর যেতে দেবেন না। মাহমুদ শাহ অনেক পীড়াপীড়ি করলেন এবং আকাক্ষা ব্যক্ত করলেন, সুলতান কয়েকটা দিন দুর্গের ভেতর বিশ্রাম করুন। কিন্তু সুলতান। মুজাফফর তার এই অনুরোধ কবুল করেন নি। তিনি পরে নিজেই এই রহস্য প্রকাশ করেছিলেন, আমি এই জিহাদ কেবল আল্লাহর রোমন্দী হাসিলের জন্যই করেছিলাম। কিন্তু আমীর-উমারার প্রকাশিত বক্তব্য থেকে আমার আশংকা হলো, আল্লাহ না করুন, কোন খারাপ নিয়ত আমার দিলে সৃষ্টি হয়ে যায় এবং আমার নিয়তের সততা ও ইখলাস নষ্ট না হয়ে যায়। আমি সুলতান মাহমুদের ওপর কোন অনুগ্রহ করিনি, বরং মাহমুদই আমার ওপর অনুগ্রহ করেছেন। ফলে তার কারণেই এই (জিহাদে অংশ গ্রহণের মাধ্যমে) মহামূল্যবান সৌভাগ্য লাভ হলো।
“ইনতিকালের মুহুর্ত ঘনিয়ে আসতেই সুলতান উলামায়ে কিরাম ও সাম্রাজ্যের অমাত্যবর্গের এক মজলিসে নেমতের শুকরিয়া হিসেবে বলেছিলেন, আল্লাহ্র অপার অনুগ্রহ ও কৃপায় আমি কুরআন হেফজ করার সাথে সাথে প্রতিটি আয়াত সংশ্লিষ্ট জরুরী মসলা-মাসাইল, হুকুম-আহকাম, শানে নযুল ও তাজবীদ সংক্রান্ত মূলনীতির ইলম হাসিল করি। স্বীয় উস্তাদ আল্লামা জামালুদ্দীন মুহাম্মদ ইবন ওমর বাহরূক থেকে যেসব হাদীসের সনদ নিয়েছি সেসব হাদীস। সনদ ও মতন (মূল পাঠ ও এর বর্ণনাসূত্র) বর্ণনাকারী রাবীদের হালতসহ আমার মুখস্থ আছে। আল্লাহর ফযলে ফিক্হ বিষয়ে আমার সেই জ্ঞান আছে যেই জ্ঞান সম্পর্কে হাদীস পাকে বর্ণিত। (আরবি) “আল্লাহ তাআলা যার কল্যাণ কামনা করেন তাকে দীনের সমঝ (ফিকহ) তথা জ্ঞান দান করেন। তাকে ফকীহ বানিয়ে দেন। আর বর্তমানে কয়েক মাস থেকে সৃফিয়ায়ে। কেরাম ও মাশায়েখে ইজামের তরীকায় আত্মশুদ্ধির সাধনায় (তাযকিয়ায়ে নক্স) মশগুল এবং (আরবি) (যে যেই কওম বা সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য অনুসরণ করবে সে সেই সম্প্রদায়ের অন্তর্গত হবে)-এর ভিত্তিতে তাদের বরকত লাভের ব্যাপারেও আশাবাদী। আল্লামা বাগাবীর তফসীর মাআলিমু'ত-তানযীল’ একবার খতম করেছি। এরপর দ্বিতীয়বার শুরু করেছি। অর্ধেক পর্যন্ত পৌঁছে গেছি। বাকীটুকু আশা করছি, ইনশাআল্লাহ জান্নাতে গিয়ে শেষ করব।
“জুমুআর নামাযের নিকটবর্তী হতে মৃত্যুর লক্ষণ প্রকাশ পেতে শুরু করে। তিনি উপস্থিত লোকদের মসজিদে যাবার হুকুম করলেন এবং নিজে জোহর সালাত আদায় করলেন এবং বললেনঃ সালাতুজ্জোহর হোমাদের এখানে আদায় করলাম, আসর আল্লাহ চাহেত জান্নাতে গিয়ে আদায় করব। ইনতিকালের সময় তাঁর যবানে হযরত ইউসুফ আলায়হিস সালামের এই দোআ উচ্চারিত হচ্ছিল যা ছিল স্বয়ং সুলতানের নিজের অবস্থারই প্রতিচ্ছবি
“হে আমার রব! তুমি আমাকে রাজ্য দান করেছ এবং স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দিয়েছ। হে আকাশমণ্ডলি ও পৃথিবীর স্রষ্টা! তুমিই ইহলোক ও পরলোকে আমার অভিভাবক। তুমি আমাকে মুসলিম হিসেবে মৃত্যু দাও এবং আমাকে নেককারদের অন্তর্ভুক্ত কর।” (সূরা ইউসুফ, ১০১ আয়াত)
শের শাহ সূরীর (মৃ. ৮৫২ হি.) সময়ানুবর্তিতা ও নিয়মিত আমলসমূহের তালিকাসূচী যা ঐতিহাসিকগণ তাদের ইতিহাস গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন, দেখা যেতে পারে। এ যুগের একজন মধ্যম শ্রেণীর ব্যস্ত মানুষের পক্ষেও যেখানে এই সময়সূচী অনুসরণ করা কঠিন সেখানে এরকম একজন ব্যস্ত-সমস্ত বাদশাহর পক্ষে যাঁকে মাত্র পাঁচ বছরের স্বল্পতম মুদতে শত বছরের কাজ করতে হবে এবং বাহ্যত যাকে আপন প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ব্যস্ততা এক মুহুর্তের জন্যও অবকাশ দিতে প্রস্তুত ছিল না, দেওয়া সম্ভবও ছিল না এটা কারামতই বলতে হবে।
“শের শাহ রাত্রির এক-তৃতীয়াংশ বাকী থাকতেই ঘুম থেকে জেগে যেতেন। এরপর তিনি গোসল করতেন এবং নফল পড়তেন। ফজর নামাযের পূর্বেই নিয়মিত ওজীফা ও তসবীহসমূহ আদায় শেষ করতেন। এরপর বিভিন্ন শ্রেণী ও বিভাগের হিসাবাদি দেখতেন এবং দিনের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সম্পর্কে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দান করতেন এবং রোজকার করণীয় কাজ সম্পর্কে বলে দিতেন যাতে দিনের বেলা নানাবিধ প্রশ্ন তাকে পীড়িত না করে। এই সব থেকে মুক্ত হয়ে তিনি সালাতুল ফজরের জন্য ওযূ করতেন এবং জামাআতের সঙ্গে ফজরের সালাত আদায় করতেন। অতঃপর যিকির-আযকার ও বিভিন্ন ওজীফা আদায়ের মধ্যে মশগুল হয়ে যেতেন। ইতোমধ্যে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা সম্রাটকে সালাম দেবার জন্য হাযির হতেন। সম্রাট সালাতুল ইশরাক থেকে ফারেগ হয়ে আগত লোকদের কার কি প্রয়োজন জেনে নিতেন এবং ঘোড়া, এলাকা কিংবা জায়গীর ও ধন-সম্পদ যার যেমন। প্রয়োজন পড়ত দিতেন। অতঃপর মামলা-মোকদ্দমার বাদী-বিবাদীর দিকে মনোযোগ দিতেন, উপস্থিত অভিযোগের প্রতিকার করতেন এবং তাদের অভাব পূরণ করতেন। এরপর শাহী ফৌজ ও অস্ত্রশস্ত্র পরিদর্শন করতেন এবং ফৌজে ভর্তি হতে ইচ্ছুক প্রার্থীর যোগ্যতা পরিমাপপূর্বক যোগ্য প্রার্থীকে নিয়োগ দানের। নির্দেশ দিতেন। অতঃপর রাষ্ট্রের দৈনন্দিন আমদানী ও অর্থ পরিদর্শন করতেন। এরপর সাম্রাজ্যের প্রধান অমাত্যবর্গ, আমীর-উমারা, রাষ্ট্রদূত ও আইনজীবিগণ হাযির হতেন। স্ৰমাট তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতেন। এরপর প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও কর্মীবৃন্দের আর্জি পেশ করা হত। তিনি তা শুনতেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশ লেখাতেন। এরপর দুপুরের খানা খেতেন। উলামায়ে কিরাম ও মাশায়েখ দস্তরখানে তার সঙ্গে শরীক হতেন। এরপর জোহরের সালাত পর্যন্ত দু’ঘন্টা তিনি ব্যক্তিগত কাজকর্ম করতেন এবং খাবারের পর সামান্য বিশ্রাম (কায়লুলা) করতেন। অতঃপর জামাআতের সঙ্গে জোহরের সালাত আদায় করতেন। এরপর কুরআন মজীদ তেলাওয়াত করতেন। এর থেকে মুক্ত হয়ে তিনি পুনরায় রাষ্ট্রীয় কাজে মশগুল হয়ে যেতেন। ঘরে কিংবা বাইরে যেখানেই তিনি থাকুন না কেন, এই নিয়মের কোন ব্যত্যয় হতো না। তিনি বলতেন, বড় মানুষ তো তিনি যিনি তাঁর গোটা সময় জরুরী ও প্রয়োজনীয় কাজে ব্যয় করেন।
সম্রাট আওরঙ্গীব আলমগীরের বিস্তারিত জীবন-ইতিহাস পাঠ করলে জানতে পারবেন, এই দুনিয়াদার বাদশাহ যিনি কাবুল ও কান্দাহার থেকে নিয়ে সুদূর দাক্ষিণাত্য পর্যন্ত বিস্তৃত ভূভাগে রাজ্য পরিচালনা করতেন এবং এই সমগ্র বিস্তৃত সাম্রাজ্য স্বয়ং দেখাশোনা করতেন, তত্ত্বাবধান করতেন, তিনি তাঁর বুলন্দ হিম্মত ও অটুট ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে এতটা সময় বের করে নিতেন যে, তামাম রাষ্ট্রীয় ব্যস্ততা সত্ত্বেও আওয়াল ওয়াতেই তিনি জামা'আতের সাথে সালাত আদায় করতেন। জুমুআর সালাত জামে মসজিদে গিয়ে আদায় করতেন। সুন্নত ও নফলের পাবন্দী করতেন। ভীষণ গ্রীষ্মেও তিনি রমযানের পুরো রোযাই রাখতেন এবং রাত্রে তারাবীহ পড়তেন। রমযানের শেষ দশকে মসজিদে ই'তিকাফ করতেন। সোমবার, বৃহস্পতিবার ও জুমুআর দিন নিয়মিত সিয়াম পালন করতেন। সর্বদাই ওষু অবস্থায় থাকতেন। যিকর-আযকার ও দোআ মাছুরার পাবন্দ ছিলেন। প্রতিদিন সকালে কুরআন মজীদ তেলাওয়াত করতেন এবং শতাধিক রকমের রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক ব্যস্ততা ও বিক্ষিপ্ত তবিয়ত সত্ত্বেও এমন পরিপূর্ণ একাগ্রতার সঙ্গে হযরত মুজাদ্দিদ আলফে ছানী (র.)-র পৌঁত্র হযরত খাজা সায়ফুদ্দীন থেকে আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতেন যে, তিনি অর্থাৎ খাজা সায়ফুদ্দীন তদীয় পিতা খাজা মুহাম্মদ মাসূম (র.)-কে সম্রাটের মধ্যে যিকরে ইলাহীর আছর জাহির হবার কথা লিখে জানান। দৈনন্দিন ব্যস্ততা সত্ত্বেও আরও এতটা সময় তিনি বের করে নিতেন যাতে করে ‘ফাতাওয়ায়ে আলমগীরি’ নামক সুপ্রসিদ্ধ ফতওয়ার কিতাব সংকলনের কাজে যা তার নির্দেশে সে যুগের উলামায়ে কেরাম সংকলিত ও বিন্যস্ত করছিলেন, সময় দিতে পারেন। প্রতিদিন সংকলনের কাজ যতদূর অগ্রসর হতে তিনি সেটুকু শুনতেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দান করতেন।
সম্রাট আলমগীরের সিংহাসন আরোহণের কাল কতটা ঝাবিক্ষুব্ধ ও ঝটিকাসংকুল ছিল ইতিহাস পাঠক মাত্রেরই তা জানা। এ যুগেই তাকে সাম্রাজ্যের আমূল পুনর্গঠন করতে হয়। উথিত ফেতনা তাঁকে দমন করতে হয়। কিন্তু এটা সম্রাট আলমগীরেরই অদম্য মনোবল ও অটুট ইচ্ছাশক্তির পরিচায়ক ছিল যে, তিনি এরূপ উত্তাল তরঙ্গবিক্ষুব্ধ যুগেও যখন তার মাথা তোলার অবকাশ ছিল না তখন তিনি কুরআন মজীদ হেফজ করবার জন্য সময় বের করেছিলেন এবং তদীয় “হাদীসে আরবান”-এর ভাষ্য লিখেছিলেন। আলমগীরেরই একটি স্বরচিত কবিতা এরূপঃ
غم عالم فراوان است ومن يك غنچه دل دارم
چنان درشیشه ساعت کنم ریگ بیابان را
‘কিন্তু তিনি এই (আরবি)-এর মধ্যে যেভাবে (আরবী) বন্ধ করেছেন তা তাঁর উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ থেকেই পরিষ্কারভাবে প্রতিভাত।
আমীর-উমারা ও উযীরদের মধ্যে দেখলে আপনি আবদুর রহীম বৈরাম খান খানান, জুমলাতুল মালিক সাদুল্লাহ খান আল্লামী, মাজদুদ্দীন মুহাম্মদ ইব্ন মুহাম্মদ এলায়েজী, ইখতিয়ার খান, আফযাল খান ও মসনদে আলী আবদুল আযীয আসিফ খানের মত সর্বগুণসম্পন্ন বুযুর্গ দেখতে পাবেন। এদের মধ্যে কেবল দু’জনের (আবদুর রহীম খান খান ও আসিফ খান) সংক্ষিপ্ত আলোচনা এখানে করা হলো।
আবদুর রহীম খান পাঠ্য কিতাব মাওলানা মুহাম্মদ আমীন ইন জানী ও কাযী নিজামুদ্দীন বাদাখশানীর কাছে পড়েন এবং হাকীম আলী গীলানী ও আল্লামা ফতহুল্লাহ শীরাযী থেকেও তিনি বিশেষভাবে উপকৃত হন। অতঃপর গুজরাটে অবস্থানকালে আল্লামা ওয়াজীহুদ্দীন ইবন নসরুল্লাহ গুজরাটী থেকে আরও অধিক ইল্ম হাসিল করেন। এসব খ্যাতনামা শিক্ষক ছাড়াও তাঁর দরবার বিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ ও শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতদের কেন্দ্র ছিল। এসব পণ্ডিতের সঙ্গে কৃত আগাগোড়া জ্ঞানগর্ভ আলোচনা দ্বারা তিনি উপকৃত হতেন, এমন কি তিনি সব ধরনের বিষয়ে গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। জ্ঞানের অধিকাংশ শাখায় ও সাহিত্যের ময়দানে সুন্দর রুচি, সমালোচনামূলক দৃষ্টি ও চূড়ান্ত মতামত প্রদানের অধিকার রাখতেন। তিনি ভাষাবিদ ছিলেন, বিশেষত সাতটি ভাষায় তার পাণ্ডিত্য ছিল স্বীকৃত। আবদুর রাযযাক খানী “মা’আছিরুল-উমারা” নামক গ্রন্থে লিখেন, আরবী, ফারসী, তুর্কী ও হিন্দী ভাষায় তাঁর পরিপূর্ণ দখল ছিল। এসব ভাষায়। তিনি অলংকারপূর্ণ ও ওজস্বী কণ্ঠে কথা বলতেন এবং অবলীলায় কবিতা রচনা করতেন।
জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের সাথে সাথে যুদ্ধবিদ্যা ও সৈনিকবৃত্তির ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন অনন্য এবং শৌর্যবীর্য ও বীরত্বের ক্ষেত্রেও ছিলেন যশ ও খ্যাতির অধিকারী। গুজরাট, সিন্ধু ও দাক্ষিণাত্য বিজয় তার বীরত্ব ও সুশাসনের স্মৃতিবাহী।
আচার-ব্যবহার ও দয়া-দাক্ষিণ্যের দিক দিয়ে দেখলে দেখতে পাবেন, সমস্ত ঐতিহাসিক তার উত্তম চরিত্র, কোমল ব্যবহার, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা, বিনয় ও তার প্রশংসায় মুখর।
যদি আপনি তার বদান্যতার দিকে তাকান তবে সেক্ষেত্রে সাইয়েদ গোলাম আলী বিলগিরামীর সাক্ষ্য নিন। তিনি বলেন, যদি আবদুর রহীম খানখানার প্রতিদান ও পারিতোষিক দাঁড়িপাল্লার একদিকে রাখা হয় আর অন্য দিকে রাখা হয় সাফাবী বাদশাহদের প্রতিদান ও পারিতোষিক তাহলে আবদুর রহীম খান-খানার পাল্লাই ভারী হবে।১
[১. খাযানায়ে আমেরা; ]
লেখাপড়ার প্রতি দুর্নিবার আগ্রহ ও অধ্যয়নের ক্ষেত্রে মগ্নতার অবস্থা ছিল এই যে, ঠিক যুদ্ধক্ষেত্রেও অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করে বইয়ের পাতা খুলে রাখতেন যাতে পড়তে পারেন। গোসলের সময়ও কিতাব হাতে থাকত। খাদেমগণ সামনে দাড়িয়ে থাকত বই খুলে। গোসল করবার সাথে সাথে তাঁর বই পড়াও অব্যাহত থাকত।
ধর্মের প্রতি ঝোঁক ও স্বভাব-প্রকৃতির সামর্থ্যের অবস্থার পরিমাপ আপনি এ থেকে করতে পারবেন হযরত মুজাদ্দিদ আলফেছানী (র.)-র মনোযোগ ও দৃষ্টি আকর্ষণের দ্বারা তিনি ধন্য ছিলেন এবং তিনি সেই সব সৌভাগ্যবানের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যাদেরকে হযরত মুজাদ্দিদ আলফেছানী (র.) চিঠি লিখেছিলেন এবং যারা তাঁর আস্থাধন্য ছিলেন। তাঁকে লিখিত মুজাদ্দিদ সাহেবের পত্রাদি থেকে তাঁর প্রতি তাঁর হৃদয়ের টান ও গভীর সম্পর্কের কথা জানা যায়।
গুজরাটের উযীর আসিফ খানের অবস্থা সম্পর্কে আপনি পড়লে দেখবেন, সামগ্রিকতা ও চরম উৎকর্ষের অন্য আরেকটি চিত্র দৃষ্টিগোচর হবে।
আসিফ খানের আসল নাম ছিল আবদুল আযীয়। তিনি ছিলেন পিতা হামীদুল মুক-এর জ্যেষ্ঠ পুত্র। কিছু কিতাব তিনি তাঁর পিতা থেকেই পাঠ করেন এবং হাদীস ও ফিকহ কাযী বুরহানুদ্দীন নহরওয়ালে থেকে হাসিল করেন। দর্শনশাস্ত্রে উস্তাদ আবুল ফযল গাযারূনী ও আবুল ফযল আস্ত্রাবাদীর ছাত্র ছিলেন। লেখাপড়ার পাট চুকাবার পর শাহী দরবারে গমন করেন। বাহাদুর শাহর যুগে মন্ত্রিত্ব লাভ করেন। মাহমুদ শাহর যুগে এটর্নী জেনারেল-এর পদে অধিষ্ঠত হন। এত সব পদে অধিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও তিনি পঠন-পাঠন ও জ্ঞানগত আলোচনার ধারা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কায়েম রাখেন। বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক বিপ্লবের দরুন দীর্ঘকাল তিনি মক্কা মুআজ্জমায় অবস্থান করেন। সেখানে হারামায়ন শারীফায়ন-এর উলামায়ে কিরাম ও অপরাপর। শহর নগরের জ্ঞানী-গুণী তাঁর ইলমী ও আমলী যোগ্যতা, ধর্মীয় দৃঢ়তা ও মযবুতী এবং ইবাদত-বন্দেগীর ক্ষেত্রে গভীর মগ্নতাদৃষ্টে অত্যন্ত অভিভূত হন। সে যুগের বিখ্যাত আলেম আল্লামা ইবনে হাজার মক্কী আসিফ খানের মর্যাদা ও প্রশংসায় একট স্বতন্ত্র পুস্তকই লিখেছেন এবং সম্ভবত কোন উপমহাদেশীয় আলেমের প্রশংসা বর্ণনায় একজন স্বীকৃত আরব আলেমের এটাই সর্বপ্রথম লিখিত পুস্তক যেখানে তার মর্যাদাগত শ্রেষ্ঠত্ব, তাকওয়া-পরহেযগারী ও পবিত্রতার বিরাট স্তব-স্তুতি গাওয়া হয়েছে।
হারামায়ন শারীফায়ন-এর উলামায়ে কিরামের সাক্ষ্য যে, আশপাশের প্রতিবেশী, খাদেমকুল ও উচ্চ পদমর্যাদা সত্ত্বেও তার মক্কা মুআজ্জমায় অবস্থানকালীন জীবন ছিল একেবারেই দরবেশসুলভ। তাহাজ্জুদ নামাযে দশ পারা কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করতেন। ইবনে হাজার মক্কীর সাক্ষ্য এই যে, মক্কা মুআজ্জমায় দশ বছর অবস্থানকালীন মসজিদে হারামে তার কোন জামাআত কাযা হয়নি। মাতাফের একেবারে সামনেই ছিল তার আবাস। সব সময় তাঁকে নফল সালাত, যির-আযকার, তসবীহ-তাহলীল, মুরাকাবা কিংবা। অধ্যয়নের মধ্যেই ডুবে থাকতে দেখা গেছে। বড় বড় কিতাবের দরস ও উলামায়ে কিরামের সঙ্গে ইলমী আলোচনা-সমালোচনা ও গবেষণার ধারা অব্যাহত থাকত। হারাম শরীফের উলামায়ে কিরাম অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে তার ইলমী মাহফিলগুলোতে শরীক হতেন। সর্বোচ্চ দর্জার পাঠ্য কিতাব ও ধর্মীয় সর্বোন্নত মানের কিতাবাদির জটিল বিষয়গুলোর ওপর জ্ঞানগর্ভ ও তাত্ত্বিক আলোচনা হতো এবং এসবের ওপর গবেষণা চলত।
জ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা ও মর্যাদা প্রদানের অবস্থা ছিল এরূপ, ইবনে হাজার মক্কী বলেনঃ যে যুগে আসিফ খান মক্কায় এসে বসবাস করছিলেন সে সময় মক্কায় বিস্ময়কর রকমের রওনক সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। উলামায়ে কিরাম ও ফুকাহায়ে ইজাম তাঁর সান্নিধ্য ও সাহচর্যকে দুর্লভ সম্পদ মনে করতেন। জ্ঞানের চর্চা বৃদ্ধি পেয়েছিল। মক্কার লোকেরা ইলম হাসিলের জন্য বিরাট প্রয়াস চালিয়েছিল। চতুর্দিক থেকে ছাত্ররা ছুটে এসেছিল, তারা ইলম হাসিলের ওপর স্থায়ীভাবে মনোনিবেশ করেছিল এবং জ্ঞানের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রহস্যসমূহকে এই উদ্দেশে অনুসন্ধান চালাত যাতে সেগুলোকে আসিফ খানের সামনে পেশ করতে পারে, দৃঢ়তা জন্মাতে পারে এবং কঠিন বিষয়গুলোকে আত্মস্থ করে যাতে করে এর মাধ্যমে তার নৈকট্য লাভ করতে পারে। এসবই এই উদ্দেশে ছিল যে, তিনি জ্ঞানী-গুণীদের ওপর অনুগ্রহ ও বদান্যতার বৃত্তকে এতটা বিস্তৃত করে দিয়েছিলেন যার নজীর তার সর্মকালে বরং দীর্ঘকাল থেকেই মেলা ছিল ভার, এমন কি মক্কা মুআজ্জমার প্রতিটি অলি-গলিতে তার জন্য এভাবে দুআ উচ্চারিত হতো যেভাবে হজ্জ মৌসুমে লাবায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক আওয়াজ উখিত হয়।
আসিফ খানের খ্যাতি ও গুণাবলীর চর্চা এত দূর গিয়ে পৌঁছে ছিল যে, তুরস্কের সুলতান তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং মক্কার শরীফের মাধ্যমে শাহী সম্মান ও মর্যাদা সহকারে তাঁকে কনস্টান্টিনোপলে ডেকে পাঠান এবং অত্যন্ত মনোযোগ ও ভক্তি-শ্রদ্ধার সাথে ব্যাপক গুণাবলীর আধার এই গুণী মনীষীর সাথে কথা বলেন।
একজন সফর সঙ্গী, যিনি মক্কা মুআজ্জমা থেকে কনস্টান্টিনোপল পর্যন্ত আসিফ খানের সঙ্গে সফর করেছিলেন, বর্ণনা করেছেন, এই গোটা সফরে আসিফ খান কখনো কোন রুখসতের ওপর আমল করেন নি, বরং সর্বদাই তিনি আযীমতের ওপর আমল করেছেন যেমনটি তিনি ঘরে থাকা অবস্থায় করতেন। মিসরের শাসনকর্তা খসরূ পাশা আসিফ খানের জন্য খেলাত প্রেরণ করেন। কিন্তু তিনি তা গ্রহণে তার অপারগতা প্রকাশ করলে মিসরীয় দূত এই বলে গ্রহণ করতে পীড়াপীড়ি করেন, শাসনকর্তার সন্তুষ্টির নিমিত্ত আপনি একবারের জন্য গায়ে দিন। যাতে বলা যায়, আপনি তা গ্রহণ করেছেন। কিন্তু আসিফ খান এই বলে আবারও তা গ্রহণে তাঁর আপত্তি জ্ঞাপন করেন, খেলাত হিসেবে প্রেরিত কুবাটি রেশমের তৈরি বিধায় কোনভাবেই আমি তা গায়ে চড়াতে পারি না।
এতে কোনই সন্দেহ নেই, সব রাজা-বাদশাহই মুজাফফর শাহ হালীম কিংবা আলমগীর আওঙ্গীব নন এবং সকল আমীর ও উযীরই আবদুর রহীম খান খানান। ও আসিফ খান ছিলেন না। কিন্তু এতেও সন্দেহ নেই, মানুষের মহত্ত্ব ও উৎকর্ষের মাপকাঠি সে যুগে সাধারণভাবে অনেক উন্নত ছিল। তার বড়ত্ব ও সফলতার জন্য এমন বহু গুণ ও উৎকর্ষ অপরিহার্য ভাবা হতো যা পরবর্তীকালে, বিশেষ করে পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী শাসন কর্তৃত্বের যুগে মর্যাদার আবশ্যকীয় শর্তবহির্ভূত হয়ে গেছে। যে মাপকাঠি লোকের দৃষ্টির সামনে সব সময় থাকত, সাধারণ মানুষও তা আশা করত এবং হিম্মতের অধিকারী লোকেরাও নিজেদেরকে এর এতটা পাবন্দ মনে করত যে, সব সময় এর সাধ্য-সাধনা করত এবং এ ব্যাপারে অলসতা। প্রদর্শনকে ক্ষমার অযোগ্য ভাবত। পার্থিব উন্নতি ও মর্যাদার উন্নত থেকে উন্নততর সিঁড়িও তাদের মধ্যে ধর্মের ব্যাপারে দোটানা ভাব সৃষ্টি করতে পারত না। জাগতিক ও বৈষয়িক কর্মব্যস্ততার ভীড় এবং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব। অপরিহার্য ধর্মীয় কর্তব্য, এমন কি সুন্নত ও নফলের মত ইবাদতের ব্যাপারেও সামান্যতম অলসতা সৃষ্টি হবার অবকাশ দিত না। আরাম-আয়েশ ও ভোগ-বিলাসের উপকরণ ও সম্পদ তাদের ভেতর দৈহিক আরাম-আয়েশ কামনা সৃষ্টি হতে দিত না। অপরাপর বিষয় ও শাখার অধঃপতনের সাথে এই উন্নত মানসিকতা ও সামগ্রিকতার মধ্যেও অবনতি দেখা দেয় এবং সেই নমুনা যা প্রতিটি যুগেই অধিক হারে দৃষ্টিগোচর হয় তা কুত্রাপি দৃষ্টিগোচর হতে থাকে। কিন্তু তারপরও সেই মানদণ্ড অবশিষ্ট ছিল এবং মানুষের দিল ও দিমাগ তথা মন ও মস্তিষ্কের ওপর এরই রাজত্ব ছিল। স্ব স্ব যুগের উন্নত মনোবল ও অটুট ইচ্ছাশক্তির অধিকারী লোকেরা এই মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হবার জন্যে সচেষ্ট থাকতেন। এবং এজন্য নিজেদের আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাস ও কামনা-বাসনাকে কুরবান করতেন। ১৮৫৭ সালের বিপ্লবের কিছু আগের এবং এরপর ভারতবর্ষের প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী ও জ্ঞানী-গুণী লোকদের দিকে তাকান।
আপনি মুফতী সদরুদ্দীন খান, নওয়াব কুতুবুদ্দীন খান, টুংকের শাসনকর্তা নওয়াব উযীরুদ্দৌলা মরহুম, রামপুর রাজ্যের শাসনকর্তা নওয়াব কালবে আলী খান, প্রধান সচিব মুনশী জামালুদ্দীন খান, ভুপাল রাজ্যের মন্ত্রী নওয়াব সাইয়েদ সিদ্দীক হাসান খান প্রমুখের মত সামগ্রিক গুণাবলীর অধিকারী এমন সব বুযুর্গের সাক্ষাৎ মিলবে যাদের মধ্যে রাজ্য ও প্রশাসন এবং জ্ঞান ও গরিমার সাথে সাথে সংসারবিরাগীর বৈরাগ্য তথা যুদ, ইবাদতগুযারদের তৎপরতা, শিক্ষার্থীদের ন্যায় গভীর একাগ্রতা ও অধ্যয়নের প্রতি আগ্রহ এবং সৈনিকদের ন্যায় স্ফূর্তির সমাবেশ ঘটেছিল এবং এ তারই পরিণতি ছিল, জীবনের আদর্শ ও মানদণ্ড সমুন্নত ছিল এবং সর্বকালে দিল্ ও দিমাগের ওপর আদর্শেরই রাজত্ব চলে।
পাশ্চাত্যের বস্তুগত ও অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব ও সভ্যতা-সংস্কৃতির যুগে মানুষের জীবনের অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় আদর্শ এবং দৃষ্টান্তমূলক কল্পনা অনেক নীচে নেমে গেছে। কেবলই ভাল খাবার, ভাল বেশ-ভূষা ও পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান, সমাজে সম্মানিত ও বিশিষ্ট লোকদের মধ্যে পরিগণিত হওয়া এবং সমশ্রেণীর লোকদের মধ্যে সম্মান ও পদমর্যাদা লাভই জীবনের একমাত্র আদর্শে পরিণত হয়েছে। নবী-রসূলদের জীবন-চরিত আজ মানুষের দৃষ্টি থেকে উধাও হয়ে গেছে। দীন ও দুনিয়ার সমন্বয়, মেধা ও জ্ঞানগত, আধ্যাত্মিক ও ব্যবস্থাপনাগত উৎকর্ষ, হালাল রূযী উপার্জন প্রভৃতির ন্যায় গুণে গুণান্বিত লোকদের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ও প্রাধান্য লোপ পেয়েছে এবং এমন সব লোকের প্রভাব তাদের মস্তিষ্কের ওপর জেঁকে বসেছে এবং আদর্শ, নমুনা ও জীবনে সফলতা লাভের চূড়ান্ত কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দৃষ্টি ও কল্পনার সামনে পাহাড়সম দাঁড়িয়ে গেছে যারা নৈতিক চরিত্র ও মেধাগত দিক দিয়ে ব্রুটিযুক্ত এবং কীর্তিকাণ্ডের দিক দিয়ে অত্যন্ত অধঃপতিত, জ্ঞানগত উৎকর্ষ ও যথার্থ গুণাবলী থেকে মাহরূম, চারিত্রিক মানের দিক দিয়ে নীচ ও সাধারণ পর্যায়ের, নীচু শ্রেণীর মানুষ কিংবা অর্থনৈতিক জীব এবং টাকা উপার্জনের চেতনাহীন ও নিষ্প্রাণ মেশিন। দৈহিক আরাম-আয়েশপ্রিয়তা এতটা প্রাধান্য লাভ করে এবং ক্রীড়া-কৌতুক জীবনের এমন এক বিরাট অংশ জুড়ে বসে যে, ইবাদতবন্দেগী, ধর্মীয় অবধারিত কর্তব্যসমূহ পালন ও আধ্যাত্মিক প্রয়োজনাদির দিকে মনোেনিবেশ দেবার জন্য আর কোন অবকাশ থাকেনি। এই মুহূর্তে আপনি যদি প্রগতিশীল ও সংস্কৃতিবান লোকরে সময়সূচীর প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন তাহলে প্রাচীন ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতির ধারক ঐসব লোকের সময়সূচী এবং বিংশ শতাব্দীর বর্তমান সময়সূচীর মধ্যে এত বিরাট ফারাক দেখতে পাবেন, মনে হবে এরা একই দেশ ও জাতিগোষ্ঠীর সদস্য নন এবং এ দুয়ের মধ্যে বছরের নয়, শতাব্দীর দূরত্ব ও বিশাল গরের ব্যবধান রয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/788/150
রিডিং সেটিংস
Bangla
English
Bangla
Indonesian
Urdu
System
System
Dark
Green
Teal
Purple
Brown
Sepia
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
Kfgq Hafs
Qalam
Scheherazade
Kaleel
Madani
Khayma
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
Kalpurush
Rajdip
Bensen
Ekushe
Alinur Nakkhatra
Dhakaiya
Saboj Charulota
Niladri Nur
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।