HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

মুখতাসারুল ফিক্হিল ইসলামী

লেখকঃ মুহাম্মদ বিন ইবরাহীম বিন আব্দুল্লাহ আত্ তুয়াইজিরী

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
মুখতাসারুল ফিক্হিল ইসলামী

প্রথম অধ্যায় : তাওহীদ ও ঈমান

মুহাম্মদ বিন ইবরাহীম বিন আব্দুল্লাহ আত্ তুয়াইজিরী

অনুবাদ :

ইকবাল হোসাইন মাসূম

সম্পাদনা :

আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান

সূরা বাকারা : ২১-২২
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ وَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ ﴿21﴾ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ فِرَاشًا وَالسَّمَاءَ بِنَاءً وَأَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجَ بِهِ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزْقًا لَكُمْ فَلَا تَجْعَلُوا لِلَّهِ أَنْدَادًا وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ ﴿22﴾ ( سورة البقرة : 21-22)

হে মানব সকল! তোমরা স্বীয় প্রতিপালকের ইবাদত কর যিনি তোমাদের এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদের সৃষ্টি করেছেন, এতে তোমরা আল্লাহ ভীরু ও মুত্তাকী হতে পারবে। যিনি তোমাদের জন্যে ভূমিকে বিছানা এবং আকাশকে ছাদ স্বরূপ স্থাপন করে দিয়েছেন। আর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে তোমাদের জন্যে ফল-ফসল উৎপাদন করেছেন তোমাদের খাদ্য হিসাবে। অতএব তোমরা জেনে- শুনে আল্লাহর সাথে অন্য কাউকেও সমকক্ষ করোনা। (সূরা বাকারা : ২১-২২)

১- তাওহীদ:
তাওহীদ হচ্ছে বান্দাকে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যে আল্লাহ তাআলা এক ও অদ্বিতীয়। রুবুবিয়্যাত (প্রভুত্ব), উলুহিয়্যাত (উপাস্যত্ব) এবং আসমা ও সিফাত (নির্ধারিত সত্ত্বাবাচক ও গুনবাচক নাম)-এর ক্ষেত্রে তাঁর কোন শরীক ও সমকক্ষ নেই।

বিশ্লেষণঃ

অর্থ্যাৎ বান্দাকে সুনিশ্চিতভাবে জানা ও স্বীকার করা , যে আল্লাহ তাআলা এককভাবে সকল বস্ত্তর মালিক ও প্রতিপালক। সকল কিছুর তিনিই সৃষ্টিকর্তা, সমগ্র বিশ্বকে তিনিই এককভাবে পরিচালনা করছেন, (তাই) একমাত্র তিনিই সকল ইবাদত- উপসনার উপযুক্ত, এতে তাঁর কোন শরীক ও অংশীদার নেই। তিনি ভিন্ন সকল উপাস্য বাতিল ও অসত্য। তিনি সর্বোতভাবে যাবতীয় পরিপূর্ণ গুণাবলী ও বৈশিষ্টে বৈশিষ্টমন্ডিত। সকল প্রকার দোষ ও অপূর্ণাঙ্গতা থেকে মুক্ত ও পবিত্র।

সকল সুন্দর নাম ও উচ্চ গুণাবলি তাঁর জন্যেই নির্দিষ্ট।

২- তাওহীদের প্রকারভেদ
সকল নবী-রাসূল মানুষদের যে তাওহীদের প্রতি দাওয়াত দিয়েছেন এবং যে তাওহীদ বিষয়ে সকল ঐশী গ্রন্থ অবতীর্ণ হয়েছে সেটি দু’ভাগে বিভক্ত।

প্রথমঃ

আল্লাহকে জানা ও মানার ক্ষেত্রে তাঁর একত্ববাদ। এটাকে তাওহীদুর রুবুবিয়্যাহ ওয়াস সিফাত বলা যায়। অর্থ্যাৎ প্রভূত্ব, নাম ও গুণাবলির ক্ষেত্রে আল্লাহর একত্ববাদ।

এ একত্ববাদের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার অস্তিত্বকে প্রমাণ করা হয় এবং তাঁর নাম, সিফাত এবং কর্মাবলীর ক্ষেত্রে তাঁকে এক ও অদ্বিতীয় বলে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।

বিষয়টিকে বিশ্লেষণ করলে এভাবে বলা যায়। বান্দা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করবে এবং স্বীকৃতি দেবে যে এককভাবে আল্লাহ তা‘আলাই এ নিখিল বিশ্বের স্রষ্টা, মালিক এবং পালনকর্তা। তিনিই একে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করছেন। তিনি স্বীয় সত্ত্বা, নাম, গুণাবলি ও কর্মের ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ। তিনি সর্বজ্ঞ, সবকিছু পরিবেষ্টন ও নিয়ন্ত্রণকারী। রাজত্ব তাঁরই হাতে। সকল কিছুর উপর পূর্ণ ক্ষমতাবান। তাঁর রয়েছে সুন্দর সুন্দর নাম ও সুমহান গুণাবলি।

لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ

‘কোন কিছুই তাঁর অনুরূপ নয়। তিনি সব শুনেন, সব দেখেন।’ [সূরা আশ-শুরা-১১]

দ্বিতীয়ঃ কর্ম ও উপাসনা-প্রার্থনার ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার একত্ববাদ

একে তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ ওয়াল ইবাদাহ বলা হয়। অর্থাৎ যাবতীয় ইবাদত-উপাসনা যেমন: দো‘আ , সালাত, ভয়, আশা ইত্যাদির মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলাকে এক বলে বিশ্বাস করা, মেনে নেয়া এবং সকল প্রকার ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্যই নিরংকুশ করা।

একটু বিশ্লেষণে গিয়ে আমরা এভাবে বলতে পারি, বান্দাকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস ও স্বীকার করা যে, একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই এককভাবে সমস্ত সৃষ্টির ইবাদত-উপাসনার অধিকার সংরক্ষণ করেন। সকল মাখলূকের উপাস্য হওয়ার অধিকার একমাত্র তাঁরই। তিনিই ইবাদতের উপযুক্ত, তিনি ভিন্ন অন্য কেউ এ অধিকার রাখে না বরং কেউ উপযুক্তও নয়। সুতরাং দো‘আ, সালাত, সাহায্য প্রার্থনা, তাওয়াক্কুল, ভয়, আশা, যবেহ ও মান্নতসহ যাবতীয় ইবাদতের যে কোন একটি ইবাদতও আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো উদ্দেশ্যে সম্পাদন ও নিবেদন করা যাবে না। যে ব্যক্তি গায়রুল্লাহর উদ্দেশ্যে একটি মাত্র ইবাদতও সম্পাদন-নিবেদন করবে শরীয়তের দৃষ্টিতে সে কাফের ও মুশরকি বলে বিবেচিত হবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন:

وَمَنْ يَدْعُ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آَخَرَ لَا بُرْهَانَ لَهُ بِهِ فَإِنَّمَا حِسَابُهُ عِنْدَ رَبِّهِ إِنَّهُ لَا يُفْلِحُ الْكَافِرُونَ

‘আর যে কেউ আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্যকে ডাকে, তার কাছে যার কোন সনদ নেই। তার হিসাব তার পালনকর্তার নিকট। নিশ্চয় কাফেররা সফলকাম হবে না।’ [সূরা আল-মুমিনুন : ১১৭।]

এই তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ কে-ই অধিকাংশ মানুষ অস্বীকার করেছে। আর তাই আল্লাহ তা‘আলা অসংখ্য নবী-রাসূল মানুষদের নিকট প্রেরণ করেছেন। তাঁরা এসে তাদেরকে এক আল্লাহর ইবাদত এবং তিনি ভিন্ন অন্যদের উপাসনা-বন্দনা পরিত্যাগ করতে নির্দেশ দিয়েছেন।

(১) এরশাদ হচ্ছে:

وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ

‘আপনার পূর্বে আমি যে রাসূলই পাঠিয়েছি তাঁকে এ প্রত্যাদেশই প্রেরণ করেছি যে, আমি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই। সুতরাং একমাত্র আমারই ইবাদত কর।’ [সূরা আম্বিয়া: ২৫।]

(২) আরো এরশাদ হচ্ছে:

وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ

‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি এ মর্মে যে তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাগুত থেকে দূরে থাক।’ [সূরা নাহল : ৩৬]

তাওহীদের সার-নির্যাস:
পৃথিবীতে সঙ্ঘটিত ও সঙ্ঘটিতব্য সকল ঘটনা-অনুঘটনা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকেই এবং তাঁর ইশারাতেই হয়ে থাকে। এখানে অন্য কোন মাধ্যম ও কার্যকারণের ন্যূনতম ভূমিকা নেই। প্রত্যেক মানুষ সকল বিষয়কে উপরোক্ত বিশ্বাসের আলোকে বিচার করবে। এটিই হচ্ছে মূলত তাওহীদের সার কথা। সুতরাং ভাল-মন্দ, উপকার-ক্ষতি সবকিছু এক আল্লাহর পক্ষ থেকেই। এখানে অন্য কিছুর কোন দখল নেই। আর তাই একমাত্র তাঁরই ইবাদত করবে, যে ইবাদতের মাধ্যমে তাঁর একত্ববাদকে প্রতিষ্ঠিত করবে। তাঁর সাথে অন্য কারো ইবাদত-উপাসনা করবে না।

তাওহীদের ফলাফল
সর্বক্ষেত্রে এক আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করা, মাখলূকের বিরুদ্ধে অভিযোগ-অনুযোগ, তাদেরকে তিরস্কার-ভৎর্সনা পরিহার করা। আল্লাহ তা‘আলাকে ভালবাসা, তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর সিদ্ধান্ত ও নির্দেশাবলী প্রসন্নচিত্তে মেনে নেয়া।

মানুষ তার সহজাত প্রকৃতি এবং এ নিখিল বিশ্বের প্রতি চিন্তা-গবেষণা, এর সাভাবিক কর্মকান্ড সুনিয়ন্ত্রিতভাবে পরিচালিত হওয়া ইত্যাদির প্রতি সজাগ দৃষ্টিপাত ও পর্যবেক্ষনের কারণে অতি সহজেই তাওহীদুর রুবুবিয়্যাহ কে স্বীকার করে নেয়। তবে শুধু মাত্র এটুকুন স্বীকারোক্তিই ঈমান বিল্লাহ তথা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন এবং আযাব থেকে মুক্তির জন্যে যথেষ্ট নয়। এ স্বীকারোক্তিতো ইবলিসও দিয়েছিল। তাবত মুশরিকরাও আল্লাহকে রব বলে স্বীকার করে। তাসত্ত্বেও এ স্বীকৃতি তাদের কোন উপকারে আসেনি। কারণ তারা তাওহীদুল ইবাদাহ বা আল্লাহকে একমাত্র মা’বূদ বলে স্বীকার করেনি। সুতরাং যে ব্যক্তি শুধুমাত্র তাওহীদুর রুবুবিয়্যাহর স্বীকৃতি দেবে সে মুসলিম ও একত্ববাদী বলে স্বীকৃতি পাবে না এবং তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ তথা আল্লাহকে একমাত্র ইলাহ বলে স্বীকার করা পর্যন্ত তার জীবন ও সম্পদ নিরাপদ বলে বিবেচিত হবে না। তাকে অবশ্যই সাক্ষ্য দিতে হবে যে আল্লাহ তা’আলা ব্যতীত সত্যিকার কোন ইলাহ নেই, তিনি এক, তাঁর কোন শরীক-সমকক্ষ নেই, তিনিই সকল ইবাদতের একমাত্র উপযুক্ত। সাথে সাথে সকল এবাদতে নিজেকে যুক্ত করতে হবে তাঁর সাথে কাউকে শরীক করা চলবে না।

তাওহীদুর রুবুবিয়্যাহ ও তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ ওতপ্রোতভাবে জড়িত, একটি ছাড়া অপরটিকে গ্রহণযোগ্য নয়।

তাওহীদুর রুবুবিয়্যাহ, তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ-কে আবশ্যক করে অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলাকে রব বলে মেনে নিলে ইলাহ (উপাস্য) বলেও মানতে হবে। সুতরাং যিনি একথা স্বীকার করবেন যে আল্লাহ তা‘আলাই একমাত্র প্রতিপালক, সৃষ্টিকর্তা, মালিক ও রিযিক দাতা। তাকে অবশ্যই এ কথাও মানতে হবে যে তাহলে আল্লাহ তা‘আলাই এককভাবে ইবাদতের উপযুক্ত। অতএব, বিপদাপদে একমাত্র তাঁকেই ডাকতে হবে। তাঁর নিকটই প্রার্থনা করতে হবে। তাঁর কাছেই ফরিয়াদ করতে হবে। তাঁর উপরই ভরসা করতে হবে। কোন একটি ইবাদতও তাঁকে ভিন্ন অন্য কারো দিকে ফিরানো যাবে না, অন্য কারো নিমিত্তে সম্পাদন করা যাবে না। অনুরূপভাবে তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ, তাওহীদুর রুবুবিয়্যাহকে আবশ্যক করে সুতরাং যিনি একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত উপসনা করেন তাঁর সাথে কাউকে শরীক করেন না তাঁর ব্যাপারে অবশ্যই বলা যায় যে তিনি আল্লাহ তা‘আলাকে প্রতিপালক, স্রষ্টা ও মালিক বলেও বিশ্বাস করেন।

রুবুবিয়্যাহ ও উলূহিয়্যাহ যখন একত্রে উল্লেখিত হবে তখন উভয়ের অর্থ ভিন্ন ভিন্ন হবে। রবের ( الرب ) অর্থ হবে মালিক, নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনাকারী আর ইলাহ্ এর অর্থ হবে সত্যিকারের উপাস্য যিনি এককভাবে সকল ইবাদতের উপযুক্ত।

যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন-

قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ ﴿1﴾ مَلِكِ النَّاسِ ﴿2﴾ إِلَهِ النَّاسِ ﴿3﴾

‘বলুন আমি আশ্রয় চাই মানুষের প্রতিপালকের নিকট, মানুষের মালিকের নিকট, মানুষের ইলাহ ও উপাস্যের নিকট।’ [সূরা নাস : ১-৩]

আবার কখনো কখনো শুধুমাত্র একটিকে উল্লেখ করে উভয় অর্থ বুঝানো হয়। অর্থাৎ রব বলে ইলাহ ও রব, আবার ইলাহ বলে রব ও ইলাহ। যেমন আল্লাহ তা‘আলার বাণী-

قُلْ أَغَيْرَ اللَّهِ أَبْغِي رَبًّا وَهُوَ رَبُّ كُلِّ شَيْءٍ ( الأنعام :164)

‘আপনি বলুন, আমি কি আল্লাহ ব্যতীত অন্য ইলাহ খোঁজব, অথচ তিনিই সবকিছুর প্রতিপালক।’ [সূরা আন’আম: ১৬৪]

তাওহীদের ফযীলত
(১) আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

الَّذِينَ آَمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُمْ بِظُلْمٍ أُولَئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُمْ مُهْتَدُونَ ﴿82﴾

‘যারা ঈমান এনেছে এবং স্বীয় ঈমান ও বিশ্বাসকে যুলুমের (শিরক) সাথে মিশ্রিত করেনি তাদের জন্যেই রয়েছে শান্তি ও নিরাপত্তা এবং তাঁরই হিদায়াত প্রাপ্ত।’ [সূরা আন’আম:৮২]

(২)

وعن عبادة بن الصامت رضي الله عنه أن النبي صلى الله عليه وسلم قال : من شهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له , و أن محمدا عبده و رسوله , و أن عيسى عبد الله ورسوله وكلمته ألقاها إلى مريم وروح منه والجنة حق والنار حق , أدخله الله الجنة على ما كان من العمل . ( متفق عليه )

‘সাহাবী উবাদা বিন সামেত রাদিয়াল্লহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দেবে যে আল্লাহ ছাড়া সত্যিকার কোন ইলাহ নেই তিনি এক তাঁর কোন শরীক নেই। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা এবং রাসূল। ঈসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল, তাঁর কালেমা যা তিনি মারইয়াম কে প্রদান করেছেন এবং প্রদান করেছেন তাঁর পক্ষ থেকে রূহ। এবং আরো সাক্ষ্য দেবে জান্নাত সত্য এবং জাহান্নাম সত্য, আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন তাঁর আমল যা-ই থাকুক।’ [হাদীসটি সহীহ বুখারী ও মুসলিম উভয় কিতাবে বর্ণিত হয়েছে, ইমাম বুখারী রহ. ৩৪৩৫ ক্রমিক নম্বারে বর্ণনা করেছেন এখানে বর্ণিত হাদীসের ভাষা বুখারীর। আর ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেছেন ২৮ ক্রমিক নম্বরে।]

তাওহীদ পন্থীদের পুরস্কার
(১) আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন:

وَبَشِّرِ الَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أَنَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ كُلَّمَا رُزِقُوا مِنْهَا مِنْ ثَمَرَةٍ رِزْقًا قَالُوا هَذَا الَّذِي رُزِقْنَا مِنْ قَبْلُ وَأُتُوا بِهِ مُتَشَابِهًا وَلَهُمْ فِيهَا أَزْوَاجٌ مُطَهَّرَةٌ وَهُمْ فِيهَا خَالِدُونَ

‘হে নবী! যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে, আপনি তাদের এমন জান্নাতের সুসংবাদ দিন, যার পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহমান থাকবে। যখনই তারা খাবার হিসাবে কোন ফলপ্রাপ্ত হবে, তখনই তারা বলবে, এতো অবিকল সে ফলই যা আমরা ইতিপূর্বেও লাভ করেছিলাম। বস্ত্তত: তাদেরকে একই সাদৃশ্যপূর্ণ ফল প্রদান করা হবে এবং সেখানে তাদের জন্যে শুদ্ধচারিনী (পূতপবিত্র) রমণীকূল থাকবে। তারা সেখানে অনন্তকাল অবস্থান করবে।’ [সূরা বাক্বারা: ২৫।]

(২)

وعن جابر رضي الله عنه قال : أتى النبي صلى الله عليه وسلم رجل فقال : يا رسول الله ما الموجبتان ؟ فقال : من مات لا يشرك بالله شيئا دخل الجنة , ومن مات يشرك بالله شيئا دخل النار . متفق عليه

‘সাহাবী জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট জনৈক ব্যক্তি এসে জানতে চাইলো ইয়া রাসূলাল্লাহ! অবধারিতকারী বিষয় দুটো কি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন: যে ব্যক্তি এমতাবস্থায় মারা যাবে যে, আল্লাহর সাথে কোন (কিছুকে) শরীক করেনি, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে আল্লাহর সাথে শিরক করে মারা যাবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’ [মুসলিম হাদীস নং: ৯৩]

কালেমায়ে তাওহীদের মহত্ব ও মর্যাদা
عن عبد الله بن عمرو بن العاص رضي الله عنهما أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : إن نبي الله نوحا عليه السلام لما حضرته الوفاة قال لابنه : إني قاصّ عليك الوصية : آمرك باثنتين و أنهاك عن اثنتين , آمرك بـ ( لا إله إلا الله ) فإن السماوات السبع و الأرضين السبع لو وضعت في كفة ووضعت لا إله إلا الله في كفة , رجحت بهن لا إله إلا الله , ولو أن السماوات السبع , والأرضين السبع , كن حلقة مبهمة قصمتهن لا إله إلا الله , وسبحان الله وبحمده , فإنها صلاة كل شيء , وبها يرزق الخلق , وأنهاك عن الشرك والكبر ... أخرجه أحمد والبخاري في الأدب المفرد .

‘সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন: আল্লাহর নবী নূহ আলাইহিস সালাম মৃত্যুমুখে পতিত হলে স্বীয় ছেলেকে অসিয়ত করে বললেন: আমি তোমাকে দু’টো বিষয়ে আদেশ করছি এবং অন্য দু'’টো সম্পর্কে নিষেধ করছি। আদেশ করছি- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (( لا إله إلا الله সম্পর্কে। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলাকে একমাত্র ইলাহ বলে মেনে নেবে। কারণ সাতটি আকাশ এবং সাতটি যমীনকে যদি এক পাল্লায় রাখা হয় আর লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ অন্য পাল্লায়, তাহলে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ঐ সকল আকাশ যমীনকে নিয়ে ঝুলে পড়বে। আর সাত আকাশ ও সাত যমীন যদি পরস্পর শৃংখলাবদ্ধ থাকত। তাহলে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ তাদের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিত।

আর সুবহানাল্লাহ ওয়াল হামদুল্লিাহ বেশী বেশী করে বলবে। কারণ এটি সকল বস্ত্তর সালাত ও তাসবীহ, এর মাধ্যমেই সৃষ্টিজীবকে রিযিক দেয়া হয়। আর নিষেধ করছি শিরক ও অহংকার থেকে...।’ [হাদীসটি সহীহ, বর্ণনায় আহমদ হাদীস নং (৬৫৮৬) এবং বুখারী আল আদাবুল মুফরাদ গ্রন্থে হাদীস নং (৫৫৮)। দেখুন শায়খ আলবানীর আসসিলসিলা তুস সহীহাহ। হাদীস নং (১৩৪)।]

১০
তাওহীদের পূর্ণতা
বান্দার তাওহীদ ও একত্ববাদ তখনই পূর্ণতা লাভ করবে যখন সে কেবলমাত্র এক আল্লাহর ইবাদত করবে এবং সকল প্রকার তাগুতকে এড়িয়ে চলবে ।

যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেছেন :

وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ

‘আমি সকল উম্মতের মধ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি এ মর্মে যে তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাগুত থেকে নিরাপদ থাক, তাদের এড়িয়ে চল।’ [সূরা নাহল : ৩৬।]

১১
তাগুতের পরিচয়
তাগুত বলা হয় ঐ ব্যক্তি বা বস্ত্তকে যার ব্যাপারে বান্দা সীমা লঙ্ঘন করে। সেটি বাতিল মা’বূদও হতে পারে যেমন মূর্তি-প্রতিমা আবার অনুসৃত নেতাও হতে পারে যেমন গণক-পুরোহিত, পাদ্রী, ধর্ম যাজক, উলামায়ে সূ কিংবা মান্যতা ও আনুগত্য গ্রহণকারীও হতে পারে যেমন, আল্লাহর আনুগত্য ত্যাগকারী আমীর উমারা ও কর্তৃত্বশীল নেতা-কর্তাবৃন্দ ইত্যাদি।

১২
প্রধান প্রধান তাগুত।
তাগুতের সংখ্যা অনেক, এদের মাঝে প্রধান হচ্ছে পাঁচটি।

(ক) ইবলিস। আল্লাহ তার অনিষ্ট থেকে আমাদের পানাহ দান করুন।

(খ) যার ইবাদত করা হয় এবং সে এতে সন্তুষ্ট।

(গ) যে ব্যক্তি লোকদের নিজের ইবাদতের প্রতি আহবান করে।

(ঘ) যে ব্যক্তি ইলমে গায়েব জানে বলে দাবী করে।

(ঙ) যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলা নাযিলকৃত বিধান বাদ দিয়ে ভিন্ন আইনে বিচার-শাসন পরিচালনা করে।

মহান আল্লাহ তা’আলা বলেন :

اللَّهُ وَلِيُّ الَّذِينَ آَمَنُوا يُخْرِجُهُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا أَوْلِيَاؤُهُمُ الطَّاغُوتُ يُخْرِجُونَهُمْ مِنَ النُّورِ إِلَى الظُّلُمَاتِ أُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ ﴿257﴾

‘যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ তাদের অভিভাবক, তাদেরকে তিনি অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনেন। আর যারা কুফরী করে তাদের অভিভাবক হচ্ছে তাগুত। তারা তাদেরকে আলো থেকে বের করে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। এরাই হলো দোযখের অধিবাসী। চিরকাল তারা সেখানেই থাকবে।’ [সূরা বাকারা: ২৫৭।]

১৩
৩- ইবাদত ইবাদতের অর্থ ও তাৎপর্য:
ইবাদতের একমাত্র উপযুক্ত ও যোগ্য দাবিদার হচ্ছেন মহান আল্লাহ তা’আলা। ইবাদতের ভেতর দু’টি দিক আছে, সেই বিষয়দ্বয়ের উপর ইবাদত প্রয়োগ হয়।

(এক) দাসত্ব : অর্থাৎ পূর্ণ ভক্তি-শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সাথে আল্লাহ তা’আলার নির্দেশাবলী পালন ও নিষেধাবলী বর্জন করার মাধ্যমে তাঁর বশ্যতা স্বীকার করা ও তাঁর অনুগত হয়ে থাকা।

(দুই) যার মাধ্যমে ইবাদত করা হয় : আর এটি অনেক ব্যাপক, সংক্ষেপে বলা যায়, প্রত্যেক কথা ও কাজ যা আল্লাহ তা‘আলা পছন্দ ও অনুমোদন করেন। সেটি যাহেরী (দৃশ্যমান) হতে পারে কিংবা বাতেনী (অদৃশ্যমান)। যেমন দু‘আ, যিকির, সালাত, মুহাববত ইত্যাদি।

উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়- সালাত একটি ইবাদত, এটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে দাসত্বের বহিঃপ্রকাশ। অতএব আমরা সালাতের মাধ্যমে পূর্ণ ভক্তি-শ্রদ্ধা, মুহাববত-ভালবাসার সাথে হীন ও নত হয়ে এক আল্লাহর ইবাদত করি। আর শুধুমাত্র অনুমোদিত ইবাদতই সম্পাদন করি।

১৪
মানব ও জিন সৃষ্টির তাৎপর্য :
মহাপ্রজ্ঞাময় আল্লাহ তা’আলা জিন ও মানুষ অহেতুক সৃষ্টি করেননি। এজন্যে সৃষ্টি করেননি যে, তারা শুধুমাত্র খাবে, পান করবে, ক্রীড়া-কৌতুক ও খেলাধুলায় মত্ত থাকবে। বরং এক মহৎ ও মহান উদ্দেশ্যে সৃজন করেছেন। আর তা হচ্ছে তারা তাঁর ইবাদত করবে, তাঁকে এক বলে জানবে, তাঁর সম্মান প্রদর্শন করবে, তাঁর বড়ত্ব প্রকাশ করবে, এক কথায় তাঁর আনুগত্য করবে। আর এসব উদ্দেশ্য সমুন্নত রাখতে গিয়ে তারা তাঁর সকল নির্দেশাবলী বাস্তবায়ন করবে সর্বোচ্চ আন্তরিকতায়। সকল নিষেধাবলী থেকে বিরত থাকবে সর্বোচ্চ সতর্কতায়। তাঁর নির্ধারিত সীমাতে অবস্থান করবে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টায় এবং তিনি ভিন্ন সকল কিছুর ইবাদত পরিহার করবে সর্বোচ্চ ঘৃণায়। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন-

وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ

‘আমি মানব ও জিন সৃজন করেছি শুধুমাত্র আমারই ইবাদত করার জন্যে।’ [সূরা যারিয়াত: ৫৬।]

১৫
ইবাদত ও দাসত্ব প্রকাশের পদ্ধতি:
মহান রাববুল আলামীন আল্লাহ তাআলার ইবাদত ও দাসত্ব ভিত্তিশীল হচ্ছে দুটি মূলনীতির উপর।

আল্লাহর প্রতি পূর্ণ ভালবাসা ও পরিপূর্ণ ভক্তি-শ্রদ্ধা।

নিজেকে একেবারে তুচ্ছ ও হীন জ্ঞান করে তাঁর পূর্ণ বশ্যতা স্বীকার করা।

আর এ মূলনীতিদুটো নির্ভর করে আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতির উপর।

আল্লাহ তা’আলার অপরিসীম ইহসান-অনুগ্রহ, দয়া ও রহমত, ফযল ও করম -যেগুলো সে প্রতিনিয়ত গ্রহণ করে চলেছে- সবসময় হৃদয়পটে উপস্থিত রাখা এবং চিন্তার দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করা। যা আল্লাহকে ভালবাসতে বাধ্য করবে, হৃদয়ে-মনে তাঁর মুহববত ও আজমত সৃষ্টি করবে।

নিজ ত্রুটি-বিচ্যুতি, অযোগ্যতা, অপূর্ণতা এবং কর্ম ও আমলের প্রতি দৃষ্টি দেয়া, নিজের অক্ষমতা, অসহায়ত্ব ও দীনতা সম্পর্কে চিন্তা করা। এগুলো আল্লাহর বশ্যতা স্বীকারের মানসিকতা সৃষ্টি করবে এবং তাঁকে মান্য করার প্রেরণা যোগাবে।

বান্দা তার রব পর্যন্ত পৌঁছার সবচে নিকটতম ও সহজ রাস্তা হচ্ছে তাঁর প্রতি সব সময় মুখাপেক্ষী হয়ে থাকা, পাশাপাশি নিজেকে অসহায় ও দীন-হীন জ্ঞান করা। নিজের অবস্থা-অবস্থান, যোগ্যতা ও ক্ষমতা ইত্যাদির প্রতি দৃষ্টি না দেয়া, এসব গুণাবলী তার মধ্যে আছে বলেও চিন্তা না করা বরং নিজের সকল জরুরত-হাজত সবকিছুই আল্লাহর নিকট উপস্থাপন করা। সাথে সাথে এ বিশ্বাস অটুট রাখা যে আল্লাহ যদি তাকে ত্যাগ করেন তাহলে অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্থ হবে বরং একেবারে ধ্বংস হয়ে যাবে।

আল্লাহ তা’আলা বলেন-

وَمَا بِكُمْ مِنْ نِعْمَةٍ فَمِنَ اللَّهِ ثُمَّ إِذَا مَسَّكُمُ الضُّرُّ فَإِلَيْهِ تَجْأَرُونَ ﴿53﴾ ثُمَّ إِذَا كَشَفَ الضُّرَّ عَنْكُمْ إِذَا فَرِيقٌ مِنْكُمْ بِرَبِّهِمْ يُشْرِكُونَ ﴿54﴾ لِيَكْفُرُوا بِمَا آَتَيْنَاهُمْ فَتَمَتَّعُوا فَسَوْفَ تَعْلَمُونَ ﴿55﴾ ( النحل /৫৩-৫৫)

‘তোমাদের কাছে যে সমস্ত নিয়ামত আছে, তা আল্লাহরই পক্ষ থেকে। অতঃপর তোমরা যখন দুঃখ-কষ্টে পতিত হও তখন তাঁরই নিকট কান্নাকাটি কর-ব্যাকুল ভাবে, তাকেই আহবান কর। এরপর যখন আল্লাহ তোমাদের বিপদ-কষ্ট দূরীভূত করে দেন, তখনই তোমাদের একদল স্বীয় পালনকর্তার সাথে অংশীদার সাব্যস্ত করতে থাকে। যাতে অস্বীকার করে ঐ নিয়ামত , যা আমি তাদের দিয়েছি। অতএব মজা ভোগ করে নাও-সত্বরই তোমরা জানতে পারবে।’ [সূরা নাহল : ৫৩-৫৫।]

১৬
ইবাদত করার দিক থেকে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও পরিপূর্ণ মানুষ।
ইবাদত ও দাসত্বের দিক থেকে মানুষদের মধ্যে সবচে পরিপূর্ণ ও শ্রেষ্ঠতম হচ্ছেন নবী ও রাসূলগণ। কারণ, মানুষদের মধ্যে তাঁরাই আল্লাহকে পরিপূর্ণ রূপে চিনেছেন ও তাঁর সম্পর্কে সবচে বেশী জেনেছেন। অন্যদের তুলনায় তাঁদের হৃদয়েই আল্লাহর প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা বেশী।

তাছাড়া আল্লাহ তাঁদেরকে মানুষদের নিকট রাসূল বানিয়ে প্রেরণ করার মাধ্যমে তাঁদের মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছেন। সুতরাং তাঁরা দু’দিক থেকে মর্যাদাবান। রিসালাতের মর্যাদা এবং নির্ভেজাল দাসত্বের মর্যাদা।

শ্রেষ্ঠত্বের দিক থেকে নবীদের পরবর্তী স্থনেই আছেন সিদ্দীকবৃন্দ। আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি যাদের বিশ্বাস ও স্বীকৃতি পূর্ণতা পেয়েছে এবং যারা আল্লাহর নির্দেশের প্রতি সদা অবিচল থেকেছেন। অতঃপর শহীদগণ এরপর সৎকর্মশীল সাধারণ মুসলমানবৃন্দ।

আল্লাহ তা’আলা বলেন:

وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَالرَّسُولَ فَأُولَئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِينَ وَحَسُنَ أُولَئِكَ رَفِيقًا { النساء /৬৯}

‘আর যে কেউ আল্লাহর হুকুম এবং তাঁর রাসূলের নির্দেশ মান্য করবে, তাহলে যাঁদের প্রতি আল্লাহ নেয়ামত দান করেছেন, সে তাঁদের সঙ্গী হবে। তাঁরা হলেন নবী, সিদ্দীক, শহীদ ও সৎকর্মশীল ব্যক্তিবর্গ। আর তাঁদের সান্নিধ্যই হল উত্তম।’ [সূরা নিসা: ৬৯।]

১৭
বান্দার উপর আল্লাহর অধিকার :
আকাশ ও যমীনে বসবাসকারী সকলের উপর আল্লাহর হক ও অধিকার হচ্ছে, তারা তাঁর ইবাদত করবে এবং (কোন কিছুকে) তাঁর সাথে শরীক করবে না। তাঁর আনুগত্য করবে নাফরমানী করবে না। তাঁকে স্মরণ করবে-ডাকবে, ভুলে থাকবে না। তাঁর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করবে, কুফরী করবে না। এবং যে উদ্দেশ্যে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে সে উদ্দেশ্যের বিপরীত তার থেকে কোন কিছু প্রকাশ পাবে না। অজ্ঞতার কারণেই হোক বা অপারগতার কারণে, বাড়াবাড়ির আঙ্গিকেই হোক বা অলসতার আঙ্গিকে। সুতরাং আল্লাহ তা’আলা যদি আকাশ ও পৃথিবীবাসীকে শাস্তি প্রদান করেন, তাহলে সে অধিকার তাঁর রয়েছে, শাস্তি দিলে সেটিও অন্যায্য হবে না। আর যদি দয়া করেন তাহলে সেটি হবে তাদের আমলের তুলনায় অনেক বেশী ।

عن معاذ بن جبل رضي الله عنه قال : كنت ردف النبي صلى الله عليه وسلم على حمار يقال له نفير قال : فقال : (( يا معاذ تدري ما حق الله على العباد , وما حق العباد على الله؟ قال : قلت : الله و رسوله أعلم . قال : فإن حق الله على العباد أن يعبدوا الله و لا يشركوا به شيئا و حق العباد على الله عز و جل أن لا يعذب من لا يشرك به شيئا )) قال : قلت يا رسول الله , أفلا أبشر الناس ؟ قال :(( لا تبشرهم فيتكلوا . متفق عليه .

সাহাবী মু‘আয বিন জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করছেন, আমি ‘নুফাইর’ নামক গাধার উপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তাঁর পিছনে বসা ছিলাম। তিনি আমাকে বললেন: মু‘আয তুমি কি জান, বান্দার উপর আল্লাহর কি হক রয়েছে? এবং বান্দারই বা আল্লাহর কাছে কি অধিকার (পাওনা) রয়েছে? আমি বললাম: এ বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভাল জানেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: বান্দার উপর আল্লাহর হক (অধিকার) হচ্ছে। তারা তাঁর ইবাদত করবে, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। আর আল্লাহর নিকট বান্দার অধিকার হচ্ছে, যে ব্যক্তি তাঁর সাথে শরীক করবে না তিনি তাকে শাস্তি দেবেন না। শুনে আমি বললাম: ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি কি এ সুসংবাদ লোকদের শোনাব না? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: না, শোনাবে না। তাহলে তারা এর উপর ভরসা করে আমল ছেড়ে দেবে। [বুখারী হাদীস নং ২৮৫৬ এবং মুসলিম হাদীস নং ৩০। হাদীসের ভাষ্য মুসলিম থেকে নেয়া।]

১৮
ইবাদত ও দাসত্বের উৎকর্ষ ও পরিপূর্ণতা
১- মানুষ বলতেই তিন অবস্থার যে কোন একটিতে অবস্থান করে।

*আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত নেয়ামতসমূহ যেমন সচ্ছলতা, সুস্থতা, নিরাপত্তার মধ্যে। তখন তার দায়িত্ব হচ্ছে আল্লাহর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।

*পাপ অন্যায় ও অপরাধ মূলক কাজে লিপ্ত অবস্থায় থাকা। তখন তার কর্তব্য হচ্ছে উক্ত পাপ পরিহার করে কৃত অপরাধের জন্যে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা।

* বিপদ ও মুসীবতের মধ্যে থাকা, যার মাধ্যমে আল্লাহ তাকে পরীক্ষা করতে চান। এ অবস্থায় তার করণীয় হচ্ছে সবর ও ধৈর্য ধারণ করা। যে ব্যক্তি উক্ত তিন অবস্থায় বর্ণিত তিন করণীয় সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারবে সে ইহকাল ও পরকাল উভয় জগতেই সুখী হবে।

২- মহান আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় বান্দাদের উবূদিয়্যত তথা দাসত্ব ও ধৈর্য্য পরায়ণতা যাচাই করার উদ্দেশ্যে মাঝে মধ্যে বিপদ-মুসীবতে নিপতিত করেন। এর মাধ্যমে তাঁর উদ্দেশ্য মূলত তাদের ধৈর্য ও দাসত্বের অবস্থা পরীক্ষা করা। তাদের শাস্তি দেয়া কিংবা ধ্বংস করা তাঁর লক্ষ্য নয়।

সুতরাং প্রতিটি বান্দার উপর আল্লাহ তা‘আলার অধিকার রয়েছে যে, তারা তাঁর দাসত্ব বরণ করে তাঁর আনুগত্য করবে দুঃসময়ে, যেমনি দাসত্ব করে থাকে সুসময়ে। আনুগত্য করবে নিজেদের অপছন্দনীয় ক্ষেত্রে, যেভাবে করে থাকে পছন্দনীয় বিষয়াবলীর ক্ষেত্রে। অধিকাংশ মানুষ সহজ ও নিজ পছন্দনীয় বিষয়াবলীর ক্ষেত্রে উবূদিয়্যতের হক আদায় করে থাকে ঠিকই। তবে অধিক কৃতিত্বপূর্ণ ও মর্যাদাকর হচ্ছে কষ্টকর ও অপছন্দনীয় ক্ষেত্রে উবূদিয়্যতের হক আদায় করা। বান্দাদের অবস্থান এক্ষেত্রে বিভিন্ন ও তারতম্যপূর্ণ ।

সুতরাং প্রচন্ড উষ্ণতার সময় ঠান্ডা পানি দিয়ে অযু করা উবূদিয়্যত। সুন্দরী নারী বিবাহ করা উবূদিয়্যত। অনুরূপভাবে প্রচন্ড শীতে ঠান্ডা পানি দিয়ে অযু করাও উবূদিয়্যত। তীব্র মানসিক চাহিদা সত্ত্বেও মানুষের ভয়ে নয় বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পাপের কাজ বর্জন করা উবূদিয়্যত। ক্ষুধার কষ্ট স্বীকার করে ধৈর্য ধারণ করাও উবূদিয়্যত। তবে এ দু’ধরনের উবূদিয়্যতের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে।

যে ব্যক্তি সুসময় ও দুঃসময়, পছন্দনীয় ও কষ্টকর উভয় ক্ষেত্রে উবূদিয়্যতের হক আদায় করবে সে আল্লাহ তা’আলার সেসকল পূণ্যবান বান্দার অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাবে যাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে

لا خوف عليهم ولا هم يحزنون

অর্থাৎ যাদের কোন ভয় নেই এবং যারা বিচলিত হবে না। তার শত্রু কখনই তার উপর বিজয়ী হতে পারবে না ,আল্লাহ তাকে হিফাজত করবেন। তবে হ্যাঁ, শয়তান কালে-ভদ্রে তার উপর অতর্কিত হামলা চালাতে পারে। কারণ বান্দা মাঝে মধ্যে গাফলত ও অসর্তকতা, প্রবৃত্তির তাড়না ও ক্রোধের পরীক্ষায় পতিত হয় আর শয়তান মূলতঃ এ তিন দরজা দিয়েই মানুষের ভিতর প্রবেশ করে। আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক বান্দার উপর তার নফস, প্রবৃত্তি ও শয়তানকে ক্ষমতা দিয়ে চাপিয়ে দিয়েছেন। এর মাধ্যমে তাদের পরীক্ষা করেন যে তারা কি এদের আনুগত্য করে? না স্বীয় পালন কর্তার?

মানুষের উপর আল্লাহ তা’আলার অনেক নির্দেশ রয়েছে, পাশাপাশি নিজ নফসেরও কিছু চাহিদা রয়েছে। আল্লাহ মানুষদের থেকে ঈমান ও নেক আমল চান, আর কুপ্রবৃত্তি তাদের নিকট সম্পদ ও খাহেশাতের সম্পাদন চায়। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের নিকট পরকালের সুখ-সমৃদ্ধির জন্যে আমল কামনা করেন, আর নফস কামনা করে দুনিয়ার প্রাচুর্য ও ধন-সম্পদ। আল্লাহ চান বান্দা পরকালীন জীবনে সুখ-শান্তি লাভের জন্য বেশী বেশী আমল করুক, আর নফসের চাহিদা হচ্ছে দুনিয়ার সমৃদ্ধি ও সুখের জন্যে পরিশ্রম করুক। আর ঈমান হচ্ছে মুক্তির পথ ও আলোকবর্তিকা, যার মাধ্যমে সত্য-কে মিথ্যা থেকে পৃথক করা যায়। আর এটিই হচ্ছে পরীক্ষার স্থান।

১। আল্লাহ তা’আলা বলেন :

أَحَسِبَ النَّاسُ أَنْ يُتْرَكُوا أَنْ يَقُولُوا آَمَنَّا وَهُمْ لا يُفْتَنُونَ ﴿2﴾ وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِينَ صَدَقُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِينَ ﴿3﴾

‘মানুষ কি মনে করে যে, তারা এ কথা বলেই অব্যাহতি পেয়ে যাবে যে, আমরা ঈমান এনেছি এবং তাদের পরীক্ষা করা হবে না ? আমি তাদেরকেও পরীক্ষা করেছি, যারা তাদের পূর্বে ছিল। আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন যারা সত্য বলেছে এবং নিশ্চয়ই জেনে নেবেন মিথ্যুকদেরকে।’ [সূরা আনকাবূত : ২-৩।]

২। আল্লাহ আরোও বলেন-

وَمَا أُبَرِّئُ نَفْسِي إِنَّ النَّفْسَ لَأَمَّارَةٌ بِالسُّوءِ إِلَّا مَا رَحِمَ رَبِّي إِنَّ رَبِّي غَفُورٌ رَحِيمٌ

‘আমি নিজেকে নির্দোষ বলি না। নিশ্চয় মানুষের মন মন্দকর্ম প্রবন, কিন্তু সে নয়, আমার পালন কর্তা যার প্রতি অনুগ্রহ করেন। নিশ্চয়ই আমার পালনকর্তা ক্ষমাশীল দয়ালু্।’ [সূরা ইউসুফ: ৫৩।]

৩। আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলছেন:

فَإِنْ لَمْ يَسْتَجِيبُوا لَكَ فَاعْلَمْ أَنَّمَا يَتَّبِعُونَ أَهْوَاءَهُمْ وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنَ اتَّبَعَ هَوَاهُ بِغَيْرِ هُدًى مِنَ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ

‘অতঃপর তারা যদি আপনার কথায় সাড়া না দেয়, তবে জানবেন, তারা শুধু নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। আল্লাহর হেদায়াতের পরিবর্তে যে ব্যক্তি নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, তার চাইতে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে? নিশ্চয় আল্লাহ জালেম সম্প্রদায় কে (সঠিক) পথ দেখান না।’ [সূরা আল-কাসাস: ৫০।]

১৯
৪-শিরক
শিরক বলা হয়: আল্লাহ তা’আলার প্রভুত্ব বা তাঁর উপাসনা-বন্দনা অথবা তাঁর নাম ও গুণাবলির এর ক্ষেত্রে শরীক (সমকক্ষ-অংশীদার) নির্ধারণ করা।

সুতরাং কোন মানুষ যদি বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তা‘আলার সাথে আরো সৃষ্টিকর্তা আছে অথবা তাঁর কোন সাহায্যকারী আছে তাহলে সে মুশরিক বলে বিবেচিত হবে। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কাউকে ইবাদতের উপযুক্ত বলে বিশ্বাস করবে সেও মুশরিক বলে গণ্য হবে। আবার কেউ যদি বিশ্বাস করে যে, আল্লাহর নির্ধারিত নাম ও গুণাবলির কোন সমকক্ষ আছে। তাহলে শরীয়ত তাকেও মুশরিক বলে ধরা হবে।

২০
শিরকের ভয়াবহতা :
১। আল্লাহর সাথে শিরক করা বড় ধরনের অন্যায়। কেননা এর মাধ্যমে আল্লাহর বিশেষ হক্ব-তাওহীদের উপর আঘাত হানা হয়। তাওহীদ হচ্ছে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ইনসাফ আর শিরক সর্বোচ্চ পর্যায়ের অন্যায়, সবচে ঘৃণিত ও নিকৃষ্ট বস্ত্ত। কারণ: এর মাধ্যমে বিশ্ব প্রতিপালক মহান আল্লাহ তা’আলাকে খাটো করা হয়, তাঁর আনুগত্য ও বশ্যতা স্বীকার থেকে অহংকার বশত বিরত থাকা হয়, একমাত্র তাঁর অধিকারকে অন্যের দিকে ফিরানো হয় এবং অন্যকে তাঁর সমপর্যায়ের জ্ঞান করা হয়।

শিরকের ভয়াবহতা কত মারাত্মক ? আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরাআনে মুশরিকদের ক্ষমা করবেন না মর্মে ঘোষণা করেছেন।

আল্লাহ বলেন-

إن الله لا يغفر أن يشرك به و يغفر ما دون ذلك لمن يشاء

‘নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা শিরকের অপরাধ ক্ষমা করবেন না, এর চেয়ে নিম্ন পর্যায়ের পাপ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন।’ [সূরা নিসা:৪৮।]

২। শিরক তথা আল্লাহ তা’আলার অংশীদার স্থির করা সবচে বড় গুনাহ। যে ব্যক্তি আল্লাহ ভিন্ন অন্য কিছুর ইবাদত করল সে ইবাদতকে নিজস্ব স্থান থেকে সরিয়ে অনুপোযুক্তস্থানে নিবেদন করল এবং অযোগ্য সত্তার নিমিত্তে সম্পাদন করল। এটি বড় জুলুম এবং মারাত্মক অন্যায়।

এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন :

إن الشرك لظلم عظيم

‘নিশ্চয় শিরক মহা অন্যায়।’ [সূরা লোকমান : ১৩।]

৩। শিরকে আকবর সকল নেক আমলকে বরবাদ ও নিষ্ফল করে দেয়। ধ্বংস ও ক্ষতিকে অনিবার্য করে তুলে। এবং শিরক হল সবচে বড় মারাত্নক পাপগুলোর প্রধান।

আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন:

وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ

‘আপনার প্রতি এবং আপনার পূর্ববর্তীদের প্রতি প্রত্যাদেশ হয়েছে, যদি আল্লাহর শরীক স্থির করেন, তবে আপনার আমল নিষ্ফল হবে এবং আপনি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভূক্ত হবেন।’ [সূরা যুমার: ৬৫।]

হাদীসে এসেছে -

وعن أبي بكرة رضي الله عنه قال : قال النبي صلى الله عليه وسلم :(( ألا أنبئكم بأكبرالكبائر؟ )) ثلاثا , قالوا : بلى يا رسول الله , قال : (( الإشراك بالله , وعقوق الوالدين )), و جلس و كان متكئا (( ألا و قول الزور )) قال : فما زال يكررها حتى قلنا : ليته سكت . ( متفق عليه )

সাহাবী আবু বাকরাহ রদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করছেন- নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন : আমি কি তোমাদের আকবারুল কাবায়ের (সবচে বড় গুনাহ) সম্পর্কে বলব না? এ কথাটি তিনি পর পর তিনবার বললেন, সাহাবারা আরয করলেন, হ্যাঁ- ইয়া রাসূলাল্লাহ। তখন নবীজী বললেন: আল্লাহর সাথে শরীক করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেলান দেয়া ছিলেন এরপর সোজা হয়ে বসে বললেন: ভাল করে শোন! এবং মিথ্যা বলা, বর্ণনাকারী বলছেন: এ কথাটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বারবার বলে যাচ্ছিলেন একপর্যায়ে আমরা (মনে মনে ) বললাম: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি নীরব হয়ে যেতেন। [বর্ণনায় বুখারী হাদীস নং ২৬৫৪ এবং মুসলিম হাদীস নং ৮৭। হাদীসের ভাষ্য বুখারীর ।]

২১
শিরকের নিকৃষ্ট পরিণাম
মহান আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনের চার আয়াতে শিরকের চারটি নিকৃষ্ট পরিণাম ও জঘন্য দিক বর্ণনা করেছেন। সেগুলো নিম্নরূপ :

(১)আল্লাহ তাআলা বলেন :

إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدِ افْتَرَى إِثْمًا عَظِيمًا

‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে লোক তাঁর সাথে শরীক করে। তিনি ক্ষমা করেন এর নিম্ন পর্যায়ের পাপ যার জন্যে তিনি ইচ্ছা করেন। আর যে লোক আল্লাহর অংশীদার সাব্যস্ত করল, সে যেন বড় অপবাদ আরোপ করল।’ [সূরা নিসা : ৪৮।]

(২) আল্লাহ আরো বলেন :-

وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا بَعِيدًا

‘যে লোক আল্লাহর সাথে শরীক করল সে সুদূর গোমরাহী ও বিভ্রান্তিতে পতিত হল।’ [সূরা নিসা : ১১৬।]

(৩) আল্লাহ তা’আলা অন্যত্র বলছেন :

إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنْصَارٍ

‘নিশ্চয় যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থির করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন এবং তার বাসস্থান হবে জাহান্নাম। অত্যাচারী-জালিমদের কোন সাহায্যকারী নেই।’ [সূরা মায়েদা : ৭২।]

(৪) অন্যত্র এরশাদ হচ্ছে :

وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَكَأَنَّمَا خَرَّ مِنَ السَّمَاءِ فَتَخْطَفُهُ الطَّيْرُ أَوْ تَهْوِي بِهِ الرِّيحُ فِي مَكَانٍ سَحِيقٍ

‘এবং যে কেউ আল্লাহর সাথে শরীক করল, সে যেন আকাশ থেকে ছিটকে পড়ল। অতঃপর মৃতভোজী পাখী তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল। অথবা বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে কোন দূরবর্তী স্থানে নিক্ষেপ করল।’ [সূরা আল-হজ্ব: ৩১।]

২২
শিরককারীদের শাস্তি :
(১) আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন :

إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ وَالْمُشْرِكِينَ فِي نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا أُولَئِكَ هُمْ شَرُّ الْبَرِيَّةِ

‘আহলে কিতাব ও মুশরিকদের মধ্যে যারা কাফের, তারা জাহান্নামের আগুনে স্থায়ীভাবে থাকবে। তারাই সৃষ্টির অধম।’ [সূরা আল বাইয়্যিনাহ : ৬ ।]

(২) আল্লাহ আরো বলেন -

إِنَّ الَّذِينَ يَكْفُرُونَ بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ وَيُرِيدُونَ أَنْ يُفَرِّقُوا بَيْنَ اللَّهِ وَرُسُلِهِ وَيَقُولُونَ نُؤْمِنُ بِبَعْضٍ وَنَكْفُرُ بِبَعْضٍ وَيُرِيدُونَ أَنْ يَتَّخِذُوا بَيْنَ ذَلِكَ سَبِيلًا ﴿150﴾ أُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ حَقًّا وَأَعْتَدْنَا لِلْكَافِرِينَ عَذَابًا مُهِينًا ﴿151﴾

‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারী, তদুপরী আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি বিশ্বাসে তারতম্য করতে চায় আর বলে যে, আমরা কতককে বিশ্বাস করি এবং কতককে প্রত্যাখ্যান করি এবং এরই মধ্যবর্তী কোন পথ অবলম্বন করতে চায়। প্রকৃতপক্ষে এরাই সত্য প্রত্যাখ্যানকারী। আর যারা সত্য প্রত্যাখ্যানকারী তাদের জন্যে তৈরী করে রেখেছি অপমানজনক আযাব।’ [সূরা নিসা: ১৫০-১৫১।]

(৩) হাদীসে এসেছে

وعن عبد الله بن مسعود رضي الله عنه قال : قال النبي صلى الله عليه وسلم : من مات وهو يدعو من دون الله ندا دخل النار ( متفق عليه )

বিখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-যে ব্যক্তি এমতাবস্থায় মারা যাবে যে, আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কোন সমকক্ষকে ডাকছে (অর্থাৎ শিরক করা অবস্থায় মারা যাবে) সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। [হাদীসটি বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে ।হাদীস নং যথাক্রমে ( ৪৪৯৭) এবং (৯২)।]

২৩
শিরকের ভিত্তিমূল:
যে মূলভিত্তির উপর ভিত্তি করে শিরকের উৎপত্তি সেটি হচ্ছে, ‘‘গাইরুল্লাহর সাথে সম্পর্ক ’’। যে ব্যক্তি গাইরুল্লাহর সাথে সম্পর্ক করবে আল্লাহ তাকে তার দিকে ছুড়ে দেবেন। তাকে একারণে আযাব দেবেন , অপদস্ত করবেন। সে নিন্দিত হবে। তার কোন প্রশংসাকারী থাকবে না। অসহায় ও পরিত্যক্ত হবে। কোন সাহায্যকারী পাবে না। যেমন আল্লাহ বলেন -

لَا تَجْعَلْ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آَخَرَ فَتَقْعُدَ مَذْمُومًا مَخْذُولًا ﴿22﴾

আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্য স্থির করোনা। তাহলে তুমি নিন্দিত ও অসহায় হয়ে পড়বে। [সূরা ইসরা: ২২।]

২৪
৫- শিরকের প্রকার
শিরক দুই প্রকার :

শিরকে আকবর (বড় শিরক) এবং শিরকে আসগর (ছোট শিরক)।

২৫
(১) শিরকে আকবর
শিরকে আকবর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে দ্বীন থেকে বহিস্কার করে দেয়। পূর্বেকৃত সকল নেক আমল নিষ্ফল ও ব্যর্থ করে দেয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জীবন ও সম্পদ অনিরাপদ ও হালাল হয়ে যায়। শিরক অবস্থায়- তাওবা না করে- মারা গেলে চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামে থাকতে হবে।

শিরকে আকবর হচ্ছে সম্পূর্ণ বা আংশিক ইবাদত গাইরুল্লাহর জন্য নিবেদন, অর্থাৎ যে কোন একটি ইবাদত আল্লাহ ভিন্ন অন্য কারো নিমিত্তে সম্পাদন করা। যেমন আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো কাছে দোয়া-প্রার্থনা করা, জ্বিন-শয়তান, ক্ববরবাসী ও এ জাতীয় কারো উদ্দেশ্যে পশু যবেহ করা, নজর-মান্নত করা। অনুরূপভাবে গাইরুল্লাহর নিকট এমন জিনিস প্রার্থনা করা যার উপর আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো ক্ষমতা নেই। যথা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নিকট ধন-সম্পদ ও আরোগ্য প্রার্থনা করা। গাইরুল্লাহর নিকট বৃষ্টি ও প্রয়োজনীয় জিনিস তলব করা। এবং এ জাতীয় সকল কাজ : যা জাহেল-মুর্খ লোকেরা ওলি-আউলিয়াদের কবরে অথবা পাথর, গাছ ও এ জাতীয় প্রতিমার নিকট গিয়ে করে থাকে।

২৬
শিরকে আকবরের কিছু নমুনা :
(১) ভয় এর ক্ষেত্রে শিরক :

আল্লাহ তা’আলা ব্যতীত অন্য কিছু যেমন মুর্তি, প্রতিমা, তাগুত, মৃত বা অদৃশ্য জ্বিন ও মানুষ ইত্যাদিকে ক্ষতি করবে অথবা অনাকাঙ্ক্ষিত কিছুতে আপতিত করবে মর্মে ভয় করা। এরূপ ভয় ও ভীতি দ্বীনের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ যা শুধু মাত্র আল্লাহ তা’আলার সাথে নির্দিষ্ট। এখন যদি কেউ এটিকে আল্লাহ ভিন্ন অন্য কারো দিকে সম্পর্কিত করে তাহলে সে আল্লাহর সাথে বড় শিরক করল বলে বিবেচিত হবে।

আল্লাহ বলেন-

فلا تخافوهم و خافون إن كنتم مؤمنين . آل عمران / ১৭৫

‘সুতরাং তোমরা তাদের ভয় করো না। আমাকে ভয় কর যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাক।’ [সূরা আল ইমরান: ১৭৫]

(২) তাওয়াক্কুল এর ক্ষেত্রে শিরক :

সকল কাজে সর্বাবস্থায় আল্লাহ তা’আলার উপর তাওয়াক্কুল (ভরসা) করা একটি শীর্ষ পর্যায়ের ইবাদত যা কেবলমাত্র আল্লাহ তা’আলার উদ্দেশ্যেই সম্পাদিত হওয়ার দাবী রাখে। সুতরাং যদি কোন ব্যক্তি এমন বিষয়ের ক্ষেত্রে গাইরুল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করল যে বিষয়ের উপর আল্লাহ তা’আলা ব্যতীত অন্য কেউ ক্ষমতা রাখে না। তাহলে সে আল্লাহর সাথে শিরক করল। যেমন কেউ অনিষ্ট প্রতিরোধ, উপকার ও রিযিক অর্জন ইত্যাদি বিষয়ে মৃত ও অদৃশ্য ব্যক্তিবর্গের উপর তাওয়াক্কুল করল (যে অমুক সহায় থাকলে কোন চিন্তা নাই ইত্যাদি)। আর এরূপ শিরক;শিরকে আকবরের অন্তর্ভূক্ত।

আল্লাহ তা’আলা বলেন :

وعلى الله فتوكلوا إن كنتم مؤمنين . المائدة / ২৩

‘এবং একমাত্র আল্লাহ তা’আলার উপরই তাওয়াক্কুল কর যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক।’ [সূরা মায়েদা : ২৩]



(৩) মুহাববতের ক্ষেত্রে শিরক :

আল্লাহ তা’আলার মুহাববত, এমনই এক মুহাববত যার আবেদন অনেক ব্যাপক, যা পরিপূর্ণ বিনয় এবং সর্বাত্মক আনুগত্যকে অনিবার্য করে। ‘এ মুহাববত একেবারেই স্বতন্ত্র’ এ পর্যায়ের মুহাববতের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে অন্য কেউ শরীক হতে পারে না। আল্লাহকে যেমন মুহাববত করা হয় যদি কোন ব্যক্তি অন্য কাউকে এ পর্যায়ের মুহাববত করে, তার অর্থ হচ্ছে ঐ ব্যক্তি মুহাববত ও তা’যীমের ক্ষেত্রে আল্লাহ তা’আলার শরীক ও সমকক্ষ স্থির করছে। আর এটিই শিরক।

আল্লাহ তা’আলা বলেন :

وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَتَّخِذُ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَنْدَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللَّهِ وَالَّذِينَ آَمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِلَّهِ

‘আর কিছু লোক এমনও রয়েছে যারা অন্যান্যকে আল্লাহর সমকক্ষ সাব্যস্ত করে এবং তাদের প্রতি তেমনি ভালবাসা পোষণ করে, যেমন আল্লাহর প্রতি ভালবাসা হয়ে থাকে। কিন্তু যারা আল্লাহর প্রতি ঈমানদার তাদের ভালবাসা ওদের তুলনায় বহুগুণ বেশী।’ [সূরা বাকারা: ১৬৫]

(৪) আনুগত্যের ক্ষেত্রে শিরক :

গাইরুল্লাহকে মান্য করা ও তাদের আনুগত্য করার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করা থেকেই মূলতঃ শিরক ফিত তাআত তথা আনুগত্যের ক্ষেত্রে শিরকের উৎপত্তি। যেমন আল্লাহ তা’আলা কর্তৃক হারামকৃত বিষয়কে হালাল বা হালালকৃত বস্ত্তকে হারাম করার ক্ষেত্রে উলামা, শাসনকর্তা, উমারাদের আনুগত্য করা। সুতরাং যেসব লোক এসব ক্ষেত্রে তাদের আনুগত্য করবে, (এর মাধ্যমে মূলত) তারা শরয়ী বিধান অনুমোদন, প্রয়োগ এবং হালাল বা হারাম করার ক্ষেত্রে আল্লাহ তা’আলার সমকক্ষ-শরীক সাব্যস্ত করেছে বলে বিবেচিত হবে। আর এসব কাজ শিরকে আকবরের অন্তর্ভূক্ত।

যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন-

اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا إِلَهًا وَاحِدًا لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ

‘তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের ধর্মজাযক ও সংসার-বিরাগী তাদের প্রভূ রূপে গ্রহণ করেছে। এবং মারিয়াম তনয়কেও। অথচ তারা আদিষ্ট ছিল একমাত্র মা’বুদের ইবাদতের জন্যে। তিনি ভিন্ন কোন মাবুদ নেই। তারা যে তাঁর শরীক সাব্যস্ত করে, তিনি তা থেকে পবিত্র।’ [সূরা তাওবা: ৩১]

২৭
নিফাকের প্রকার :
নিফাক দুই প্রকার যথা:

১-নিফাকে আকবর আর এটি হচ্ছে নিফাকে ই'তেকাদী (বিশ্বাসগত নিফাক)। যেমন বাহ্যিকভাবে ইসলাম প্রকাশ করা আর ভিতরে ভিতরে কুফর পোষণ করা। নিফাকে আকবরের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ইসলামের দৃষ্টিতে কাফের। জাহান্নামের সর্বশেষ স্তরে হবে পরকালে তাদের ঠিকানা।

আল্লাহ তাআলা বলেন :

إن المنافقين في الدرك الأسفل من النار و لن تجد لهم نصيرا .

‘নিঃসন্দেহে মুনাফেকরা জাহান্নামের সর্বনিম্নস্তরে থাকবে। আর আপনি কখনো তাদের কোন সাহায্যকারী পাবেন না।’ [সূরা নিসা : ১৪৫]

২-নিফাকে আমলী বা কর্মে নিফাক। এ ধরনের নিফাকের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি দ্বীন থেকে বহিস্কৃত হয় না, তবে সে আল্লাহ ও রাসূলের অবাধ্য ও নাফরমান বলে গণ্য হয়।

عن عبد الله بن عمرو رضي الله عنهما أن النبي صلى الله عليه وسلم قال : أربع من كن فيه كان منافقا خالصا ومن كانت فيه خصلة منهن كانت فيه خصلة من النفاق حتى يدعها : إذا ائتمن خان، و إذا حدث كذب، وإذا عاهد غدر، و إذا خاصم فجر . ( متفق عليه )

‘আব্দুল্লাহ বিন আমর রাদিয়ালাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত- নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন: চারটি দোষ- যে ব্যক্তির মধ্যে একসাথে সবগুলো পাওয়া যাবে সে পরিপূর্ণ মুনাফেক বলে বিবেচিত হবে। আর যার মধ্যে ঐ দোষচতুষ্টয়ের একটি পাওয়া যাবে, সে সেটি পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত তার মধ্যে নিফাকের একটি নিদর্শন বিদ্যমান বলে ধরা হবে। (দোষ চারটি হচ্ছে) আমানত রাখা হলে খেয়ানত করে। কথা বললে মিথ্যা বলে। প্রতিশ্রুতি দিলে বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং ঝগড়া -বিবাদ করলে অশীলল কথা বলে।’ [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং বুখারী: ৩৪ এবং মুসলিম: ৫৮।]

২৮
(২) শিরকে আসগর বা ছোট শিরক:
ছোট শিরক বলতে সে সকল কাজকে বুঝানো হয় যাকে হাদীসে শিরক বলে নাম দেয়া হয়েছে কিন্তু সেগুলো শিরকে আকবেরর পর্যায়ে পড়ে না।

শিরকে আসগর তাওহীদকে ত্রুটিযুক্ত করে ঠিক, কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে দ্বীন হতে বহিষ্কার করে না। তবে এটি শিরকে আকবর পর্যন্ত পৌঁছবার রাস্তা-সন্দেহ নেই।

শিরকে আসগর সম্পাদনকারীর হুকুম-তাওহীদপন্থী অপরাধীদের হুকুমের অনুরূপ। তাকে শাস্তি প্রদান করা হবে তবে কাফেরদের মত চির জীবনের জন্য জাহান্নামে যাবে না। তার জীবন, সম্পদ হালাল ও অনিরাপদ নয়। শিরকে আকবর, সম্পাদনকারীর জীবনের সকল নেক আমল বিনষ্ট করে দেয়, আর শিরকে আসগর শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট আমলকে নষ্ট করে, সকল আমল নয়।

যেমন কোন ব্যক্তি মানুষের প্রশংসা কুড়ানোর উদ্দেশ্যে একটি নেক আমল সম্পাদন করল। -সুন্দর করে সালাত আদায় করল বা সদকা-খয়রাত করল, রোযা রাখল এমনিভাবে আল্লাহর যিকির করল এসব আমল দ্বারা তার উদ্দেশ্য কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন নয় বরং মানুষদের দেখানো ও প্রশংসা কুড়ানো। এরূপ রিয়া-লৌকিকতা কোন আমলের সাথে মিশ্রিত হলে, সেটি সে আমলকে বিনষ্ট করে দেয়। তবে শুধুমাত্র সেই আমলকেই বিনষ্ট করে , তার (রিয়ামুক্ত) অন্যসব আমল অক্ষত থাকে।

পবিত্র কোরআনে শিরক শব্দটি বহু বার উল্লেখ হয়েছে, সকলস্থানেই এর দ্বারা শিরকে আকবরকে বুঝানো হয়েছে। শিরকে আসগরের আলোচনা হাদীসে মুতাওয়াতিরে বিভিন্নভাবে এসেছে।

(১) আল্লাহ তাআলা বলেন :

قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَمَنْ كَانَ يَرْجُوا لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا

‘বলুন! আমিও তোমাদের মতই একজন মানুষ, আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয় যে, তোমাদের ইলাহই একমাত্র ইলাহ। অতএব, যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সাক্ষাত কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং স্বীয় পালনকর্তার ইবাদতে কাউকে শরীক না করে।’ [সূরা কাহফ: ১১০]



(২) হাদীসে এসেছে

وعن أبي هريرة رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم :(( قال الله تبارك وتعالى : أنا أغنى الشركاء عن الشرك من عمل عملا أشرك فيه معي غيري تركته و شركه )) . أخرجه مسلم

‘আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহ তাবারাকা ওয়াতাআলা বলছেন : আমি সকল শরীক-সমকক্ষ থেকে সম্পূর্ন মুক্ত ও বে-নিয়ায। যে ব্যক্তি কোন নেক আমল সম্পাদন করল এবং তাতে আমার সাথে অন্যকেও শরীক করল তাহলে আমি তাকেও পরিত্যাগ করি এবং তার শিরককেও।’ [বর্ণনায় মুসলিম হাদীস নং: ২৯৮৫]

২৯
শিরকে আসগরের কিছু নমুনা :
আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নামে শপথ করা, এভাবে বলা : যা আল্লাহ ও অমুক ইচ্ছা করেছেন, যদি আল্লাহ ও অমুক না থাকত . . , এটি আল্লাহ ও অমুকের কৃপায় পাওয়া, আল্লাহ ও অমুক ব্যতীত আমার আর কেউ নেই এ জাতীয় কথা বলা।

এ ধরণের কথা বলার প্রয়োজন হলে এ ভাবে বলা যায়, যা আল্লাহ চেয়েছেন অতঃপর অমুক চেয়েছে।

(১) হাদীসে এসেছে

عن ابن عمر رضي الله عنهما قال : سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول :(( من حلف بغير الله فقد كفر أو أشرك )). أخرجه ابوداود والترمذي .

‘সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি- যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কিছুর নামে শপথ করল, সে কুফরী করল বা শিরক করল। [বর্ণিত হাদীসটি সহীহ, বর্ণনায় আবুদাউদ হাদীস নং ৩২৫২ এবং তিরমিযী হাদীস নং ১৫৩৫ হাদীসের ভাষ্য তিরমিযীর।]

(২) হাদীসে এসেছে

و عن حذيفة رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال : لا تقولوا ما شاء الله وشاء فلان ولكن قولوا ما شاء الله ثم ما شاء فلان )). ( أخرجه أحمد وابوداود )

‘হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন : তোমরা এরূপ বলোনা : আল্লাহ ও অমুক যা চেয়েছেন। বরং এরূপ বল : আল্লাহ তা’আলা যা চেয়েছেন অতঃপর অমুক যা চেয়েছে। [হাদীসটি বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত হয়েছে, বর্ণনায় আহমদ হাদীস নং ২৩৫৪, দেখুন আসসিলসিলাতুস সহীহাহ নং ১৩৭ এবং আবু দাউদ হাদীস নং ৪৯৮০। ভাষ্য আবু দাউদের।]

শিরকে আসগর, সম্পাদনকারীর নিয়ত ও মন-মানসিকতার কারণে কখনো কখনো শিরকে আকবরে পরিণত হয়ে যায়। তাই প্রত্যেক মুসলমানের ছোট বড় সর্ব প্রকার শিরক থেকেই বেঁচে থাকা একান্ত জরুরী। কারণ শিরক বড় ধরণের অন্যায়, মারাত্মক গুনাহ যা আল্লাহ ক্ষমা করবেন না মর্মে ঘোষণা করেছেন।

আল্লাহ তাআলা বলেন-

إن الله لا يغفر أن يشرك به و يغفر ما دون ذلك لمن يشاء .

‘নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা শিরকের গুনাহ ক্ষমা করেন না। তিনি ক্ষমা করেন এরচে নিম্ন পর্যায়ের গুনাহ, যাকে ইচ্ছা করেন।’ [সূরা নিসা: ৪৮]

৩০
কতিপয় কর্ম ও কথা যা শিরকের অন্তর্ভূক্ত বা তার মাধ্যম :-
এমন অনেক কথা ও কর্ম আছে যা সম্পাদনকারীর অবস্থা ভেদে শিরকে আকবর বা শিরকে আসগরের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায়। মনের অবস্থার কারণে কারো কারো ক্ষেত্রে ছোট শিরক হিসেবে বিবেচিত হয়। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে বড় শিরক। সেগুলো হয়ত একেবারেই তাওহীদ পরিপন্থী যা তাওহীদের মূল আবেদনকেই নিঃশেষ করে দেয় অথবা তার স্বচ্ছতাকে কলুষিত করে দেয়। শরীয়ত এসব বিষয় সম্পর্কে কঠিনভাবে সতর্ক করেছে। নিম্নে তার কিছু নমুনা প্রদান করা হল:

(১) বিপদ-মুসীবত দূর কিংবা প্রতিরোধ কল্পে আংটি, রিং, সূতা, তাগা, ও কাইতন জাতীয় কিছু পরিধান করা, এসব-ই শিরক।

(২) কু-দৃষ্টির অনিষ্ট থেকে রক্ষা কল্পে বাচ্চাদের শরীরে মাদুলী, পুঁতি, হাড্ডি ও কাগজে লেখা প্রভৃতি জাতীয় তাবীজ লটকানো। এটিও শিরকের অন্তর্ভূক্ত।

(৩) পাখি, মানুষ, যমীন বা এ জাতীয় জিনিষ দ্বারা শুভ-অশুভ নির্ণয় করা ও অশুভ বিতাড়ন করা। এসব কর্ম হচ্ছে শিরক। কারণ এর মাধ্যমে যে মাখলূক নিজ উপকার-ক্ষতির ক্ষমতা রাখে না সে মাখলূক দ্বারা ক্ষতি হতে পারে বিশ্বাসে গাইরুল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা হয়। এ ব্যাপারটি মূলত শয়তানের প্রবঞ্চনা। এটি তাওাক্কুল পরিপন্থী।

(৪) গাছপালা, পাথর, বিভিন্ন নিদর্শনাবলি, মাযার-কবর ও এ জাতীয় বস্ত্ত দ্বারা বরকত লাভ করা ও শুভ কামনা করা। এসব বস্ত্ততে বরকত আছে মর্মে বিশ্বাস করা। এগুলো শিরক। কেননা এর মাধ্যমে বরকত লাভ করার জন্যে গাইরুল্লাহর পিছনে ছুটাছুটি করা হয় এবং তাদের সংশ্রবে আসা হয়।

(৫) যাদু :

যাদু বলা হয়: যা অস্পষ্ট এবং যার কার্যকারণ ও সূত্র অতি সুক্ষ্ম । অর্থাৎ এমন তন্ত্র-মন্ত্র, ঝাঁড়-ফুক ও চিকিৎসার নাম যা অন্তর ও শরীরে আছর করে। আছরকৃত মানুষকে অসুস্থ করে দেয় বা নিহত করে কিংবা স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিভেদ-বিরোধ সৃষ্টি করে। এটি একটি শয়তানী কর্ম। এর মাঝে অনেকগুলো এমনও আছে যা শিরক ব্যতীত সম্পন্ন হয় না।

যাদু শিরক, কারণ যাদুর মাধ্যমে গাইরুল্লাহ তথা শয়তানদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা হয় তাদের সংশ্রবে যাওয়া হয় এবং যাদু প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকারান্তরে ইলমে গায়েবের দাবী করা হয়।

আল্লাহ তা’আলা বলেন:

وَمَا كَفَرَ سُلَيْمَانُ وَلَكِنَّ الشَّيَاطِينَ كَفَرُوا يُعَلِّمُونَ النَّاسَ السِّحْر

‘সুলাইমান কুফর করেনি, শয়তানরাই কুফর করেছিল। তারা মানুষদের যাদু বিদ্যা শিক্ষা দিয়েছিল।’ [সূরা বাকারা: ১০২]

তবে কিছু কিছু যাদু আছে যা শিরক নয়, কবীরা গুনাহ। যেমন চিকিৎসার জন্য যাদু করা।

(৬) ভবিষ্যদ্বানী ও পৌরহিত্য:

কাহানা (পৌরহিত্য) হচ্ছে, ইলমে গায়েবের দাবী করা। যেমন জ্বিন-শয়তানদের সূত্রে প্রাপ্ত খবরের উপর ভিত্তি করে সত্বর পৃথিবীতে কি কি সংঘটিত হবে- মর্মে খবর পরিবেশন করা। এটি শিরক। কারণ এর মধ্যে গাইরুল্লাহর তাক্বাররুব বা নৈকট্য কামনা করা হয় এবং অদৃশ্যের জ্ঞান সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে আল্লাহ তা’আলার অংশীদারিত্বের দাবি করা হয়।

عن أبي هريرة رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال : (( من أتى كاهنا أو عرّافا فصدقه بما يقول فقد كفر بما أنزل على محمد )) أخرجه أحمد والحاكم

‘প্রখ্যাত সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করছেন, নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে ভবিষ্যৎবক্তা অথবা গণকের নিকট আসল এবং তার বর্ণনাকৃত বক্তব্যকে সত্য বলে স্বীকার করল সে মুহাম্মদের উপর নাযিলকৃত দ্বীন ও শরীয়ত কে অবিশ্বাস-অস্বীকার করল।’ [হাদীসটি বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত হয়েছে। বর্ণনায় আহমদ (হাদীস নং ৯৫৩৬) এ হাদীসের ভাষ্য তাঁরই। হাকেম হাদীস নং ১৫ দেখুন ইরওয়াউল গালীল-(২০০৬)]

(৭) জ্যোতিষি ও নক্ষত্ররাজীর মাধ্যমে ভবিষ্যদ্বানী করা:

নক্ষত্ররাজীর অবস্থা ও অবস্থানের মাধ্যমে পৃথিবীতে সংঘটিতব্য বিষয়াবলী সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা ও নির্দেশনা দেয়া। যেমন: ঝড়-তুফান, বৃষ্টি-বাদল, রোগ-বালাই, শীত-গ্রীষ্ম ইত্যাদির আগমন, জলবায়ূর পরিবর্তন সম্প©র্র্ক আগাম খবর দেয়া। এসব শিরক, কেননা এতে অদৃশ্যের জ্ঞান ও বিশ্ব পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে শরীকের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

(৮) নক্ষত্ররাজী দ্বারা বৃষ্টি প্রার্থনা:

অর্থাৎ বৃষ্টিপাত কে নির্দিষ্ট নক্ষত্র উদয় বা অস্তের সাথে সম্বন্ধযুক্ত করা। যেমন এরূপ বলা ‘অমুক নক্ষত্রের কারণে আমরা বৃষ্টি পেয়েছি,। বৃষ্টি বর্ষণকে আল্লাহর দিকে সম্বন্ধযুক্ত না করে তারকার দিকে করা হল। আর এটিই শিরক, কারণ বৃষ্টি হওয়া-না হওয়া সব আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে কোন গ্রহ-নক্ষত্র বা এরূপ অন্য কিছুর নিয়ন্ত্রণে নয়।

(৯) নিয়ামতরাজীকে গাইরুল্লাহর দিকে সম্বন্ধযুক্ত করা:

ইহকাল ও পরকালে মানুষ যত নিয়ামত ভোগ করছে বা করবে, সর্বপ্রকার নিয়ামত একমাত্র আল্লাহ তা’আলার দান। তিনিই অনুগ্রহ করে মানুষদের এগুলো দিয়েছেন। এখন যদি কেউ কোন একটি নেয়ামতকেও আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো দান বলে দাবি করে, তাহলে এটি হবে শিরক ও কুফর। যেমন কেউ আরোগ্য ও পানি প্রাপ্তিকে গাইরুল্লাহর দিকে সম্বন্ধযুক্ত করে বলল, আমি অমুকের কৃপায় আরোগ্য লাভ করেছি। অমুকের অনুগ্রহে পানি পেয়েছি। অথবা স্থল, জল বা আকাশ পথে নিরাপদে ভ্রমনের নিয়ামতকে যথাক্রমে ড্রাইভার, মাঝি বা বৈমানিকের দিকে সম্বন্ধযুক্ত করে বলল, ড্রাইভার, মাঝি ও বৈমানিকের কল্যানে এ যাত্রায় নিরাপদে সফর শেষ করতে পেরেছি। অনুরূপভাবে দেশের শান্তি, শৃংখলা, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ইত্যাদিকে সরকার বা জনগনের চেষ্টা-পরিশ্রমের ফসল বলে বিশ্বাস করা এবং তাদের কৃতিত্ব বলে দাবি করা।

একজন মুসলমানের ঈমানের দাবি হচ্ছে দুনিয়ার যাবতীয় নিয়ামতরাজী একমাত্র আল্লাহ তা’আলার অনুগ্রহের ফসল। সবকিছু একমাত্র তাঁরই দান বলে স্বীকার করা এবং তাঁর কৃতজ্ঞতা স্বীকার ও শুকরিয়া আদায় করা।

আর মানুষসহ সৃষ্টির কাছে যা আছে তা হচ্ছে সামান্য উপকরণ মাত্র, এগুলো কখনো কখনো ফল দেয় আবার কখনো দেয়না, কখনো উপকারে আসে আবার কখনো আসে না।

আল্লাহ তা’আলা বলেন :

وَمَا بِكُمْ مِنْ نِعْمَةٍ فَمِنَ اللَّهِ ثُمَّ إِذَا مَسَّكُمُ الضُّرُّ فَإِلَيْهِ تَجْأَرُونَ ﴿53﴾

‘তোমাদের কাছে যে সমস্ত নিয়ামত আছে, তা আল্লাহরই পক্ষ থেকে। অতঃপর তোমরা যখন দুঃখে কষ্টে পতিত হও তখন তাঁরই নিকট কান্নাকাটি কর তাকেই ব্যাকুল ভাবে ডাকা-ডাকি কর।’ [সূরা নাহল: ৫৩]

৩১
৬- ইসলাম মানবজাতির জন্য ইসলামের প্রয়োজনীয়তা :
ইহকাল ও পরকাল উভয় জগতে মানবজাতির যাবতীয় কল্যাণ, উন্নতি ও অগ্রগতি একমাত্র ইসলামের মধ্যেই নিহিত। তাদের কল্যাণ ও উন্নতির জন্যে ইসলামের প্রয়োজন খাবার-পানীয়’র প্রয়োজনের চেয়ে কোন অংশে কম নয় বরং বেশী। প্রত্যেক মানুষ শরীয়ত মানতে বাধ্য। সে সব সময় দুটি তৎপরতার মধ্যে অবস্থান করে।

একটি তৎপরতা দ্বারা উপকারী জিনিষ অর্জন করে। অপরটি দ্বারা ক্ষতিকর বস্ত্তকে প্রতিহত করে। আর ইসলাম হচ্ছে এমন একটি জ্যোতি যার মাধ্যমে উপকারী ও ক্ষতিকর সকল বিষয় সুস্পষ্ট হয়ে যায়।

৩২
ইসলাম ধর্মের তিনটি স্তর রয়েছে। ইসলাম, ঈমান ও ইহসান। প্রতিটি স্তরের স্বতন্ত্র কিছু মৌলিক বিষয় রয়েছে। ইসলাম, ঈমান ও ইহসানের মধ্যে পার্থক্য :-
(১) ইসলাম ও ঈমানকে যদি একইস্থানে-একত্রে উল্লেখ করা হয়। তাহলে ইসলাম দ্বারা উদ্দেশ্য হবে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা সম্পাদনযোগ্য বাহ্যিক আমল। যেমন ইসলামের পাঁচ রুকন: কালেমার স্বাক্ষ্য, সালাত, সিয়াম, যাকাত ও হজ্ব। আর ঈমান এর অর্থ হবে, অন্তর দ্বারা সম্পাদনযোগ্য বিশ্বাসগত আমল যেমন ঈমানের ছয়টি মৌলিক বিষয় হল; আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস, কিতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাস, ফেরেশতকুলের প্রতি বিশ্বাস...

আর যদি ইসলাম ও ঈমানকে আলাদা আলাদা উল্লেখ করা হয় তাহলে একটি দ্বারা উভয়টি বুঝানো হবে। তখন প্রত্যেকটি অপরটির অর্থ ও হুকুম শামিল করবে।

(২) ইহসানের পরিধি ঈমানের পরিধি অপেক্ষা ব্যাপক আর ঈমানের পরিধি ইসলামের পরিধির চেয়ে বিস্তৃত।

ইহসান নিজের দিক থেকে ব্যাপক। কেননা সে ঈমানকে শামিল করে। তাই একজন বান্দা ঈমানকে পূর্ণাঙ্গ রূপে বাস্তবায়ন করা ব্যতীত ইহসানের স্তর পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না। আর ইহসান- বাস্তবায়নকারী মুহসিনদের দিক থেকে খাস। কারণ আহলে ইহসান (মুহসিন), আহলে ঈমানেরই (মুমিন) অন্তর্ভূক্ত একটি দল।

অতএব প্রত্যেক মুহসিন মুমিন, কিন্তু প্রত্যেক মুমিন মুহসিন নয়।

(৩) ঈমান নিজের দিক থেকে ইসলাম অপেক্ষা ব্যাপক। কারণ ঈমান, ইসলামকে শামিল করে। তাই বান্দা ইসলামকে পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়ন না করে ঈমানের স্তর পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না। আর ঈমান আহলে ঈমান-মুমিনদের দিক থেকে খাস। কেননা আহলে ঈমান, আহলে ইসলামেরই একটি দল-। সকলেই নয়। অতএব প্রত্যেক মুমিন মুসলিম, কিন্তু প্রত্যেক মুসলিম মুমিন নয়।

৩৩
ইসলামের অর্থ :
মনে-প্রাণে আল্লাহ তা’আলার একত্ববাদের স্বীকৃতি দেয়া। ইবাদতের মাধ্যমে তাঁর আনুগত্য করা এবং শিরক ও মুশরিকদের সাথে সম্পর্কে ছিন্ন করা। অতএব যে ব্যক্তি এক আল্লাহকে মেনে নেবে- তাঁর নিকট আত্মসমর্পণ করবে, সে মুসলিম বলে বিবেচিত হবে। আর যে আল্লাহকে মানবে সাথে সাথে অন্যের বশ্যতাও স্বীকার করবে সে মুশরিক বলে বিবেচিত হবে। এবং যে ব্যক্তি আল্লাহকে মানবে না, তাঁর নিকট আত্মসমর্পন করে তাঁর আনুগত্য স্বীকার করবে না সে কাফের ও অহংকারী বলে গণ্য হবে।

৩৪
৭- ইসলামের রুকনসমূহ ইসলামের রুকন পাঁচটি:
عن ابن عمر رضي الله عنهما قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم :(( إن الإســلام بني على خمس : شهادة أن لا إله إلا الله و أن محمدا رسول الله , وإقام الصلاة , وإيتاء الزكاة , وصيام رمضان , وحج البيت )). متفق عليه .

বিশিষ্ট সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন : ইসলামের ভিত্তি রাখা হয়েছে পাঁচটি বিষয়ের উপর। এ সাক্ষ্য দেয়া যে আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত সত্যিকার কোন মা’বূদ (উপাস্য) নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল, সালাত কায়েম করা, যাকাত আদায় করা, রমযান মাসে সিয়াম পালন করা এবং বাইতুল্লাহর হজ্ব করা। [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম, বুখারী হাদীস নং ৮ মুসলিম হাদীস নং ১৬, হাদীসের ভাষ্য মুসলিমের।]

‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’র সাক্ষ্য দেয়ার অর্থ:

আল্লাহ তা’আলা ব্যতীত সত্যিকার কোন মাবূদ-উপাস্য নেই মর্মে মৌখিক ও আন্তরিক স্বীকৃতি প্রদান করা। তিনি ব্যতীত যত মা’বূদ আছে তাদের উপাস্যত্ব বাতিল এবং তাদের ইবাদতও বাতিল।

‘‘লা ইলাহা ইল্লাললাহু’’ প্রত্যাখ্যান ও স্বীকৃতি সম্বলিত বাক্য। ( لا إله / লা ইলাহা) বলে আল্লাহ ব্যতীত সকল উপাস্যকে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। إلا الله )/ ইল্লাল্লাহ) বলে শুধুমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতকে প্রতিষ্ঠিত ও গ্রহণ করা হয়েছে। স্বীকার করা হয়েছে যে, তাঁর ইবাদতে কোন শরীক নেই, যেমনি করে তাঁর রাজত্বে কোন শরীক-সমকক্ষ নেই।

‘‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’’র সাক্ষ্য দেয়ার অর্থ :

নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশের আনুগত্য করা, তিনি যে খবর দিয়েছেন সেগুলোর স্বীকৃতি দেয়া, যা নিষেধ করেছেন, তা পরিহার করা এবং একমাত্র তাঁর অনুমোদিত পন্থায়ই আল্লাহর ইবাদত করা।

৩৫
৮- ঈমান :
ঈমান হচ্ছে:

আল্লাহ তা‘আলা, তাঁর ফেরেশতাকুল, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রাসূলগণ এবং কিয়ামত দিবসের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা এবং বিশ্বাস স্থাপন করা তাকদীরের ভাল-মন্দের প্রতি। ঈমান কথা ও কর্মের সমষ্টির নাম। জিহবা ও অন্তরের কথা এবং জিহবা, অন্তর ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রতঙ্গের কর্ম। নেককাজের মাধ্যমে ঈমান বৃদ্ধি পায়-সুদৃঢ় হয় এমনিভাবে পাপ কাজের মাধ্যমে হ্রাস পায়।

ঈমানের শাখা-প্রশাখা :

عن أبى هريرة رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم :(( الإيمان بضع وسبعون أو بضع و ستون شعبة , فأفضلها قول لا إله إلا الله , و أدناها إماطة الأذى عن الطريق , والحياء شعبة من الإيمان )) أخرجه مسلم

প্রখ্যাত সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ঈমানের সত্তর বা ষাটের অধিক শাখা-প্রশাখা রয়েছে। সর্বোত্তম হচ্ছে, ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ বলা (অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলাকে একমাত্র উপাস্য বলে স্বীকার করা ও ঘোষণা দেয়া)। আর সর্বনিম্ন হচ্ছে, কষ্টদায়ক বস্ত্ত চলাচলের রাস্তা থেকে অপসারণ করা এবং লজ্জা ঈমানের একটি বিশেষ শাখা। [বর্ণনায় মুসলিম, হাদীস নং- ৩৫]

৩৬
ঈমানের স্তর বিন্যাস:
ঈমানের নিজস্ব একটি স্বাদ আছে, মজা ও মাধুর্য আছে এবং তার নিজস্ব একটি প্রকৃতি ও হাকীকত আছে।

(১) ঈমানের স্বাদ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :

)) ذاق طعم الإيمان من رضي بالله ربا و بالإسلام دينا وبمحمد رسولا )). أخرجه مسلم

অর্থাৎ যে ব্যক্তি মহান আল্লাহ তা‘আলাকে প্রতিপালক, ইসলামকে ধর্ম এবং মুহা্ম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে রাসূল বলে সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ করতে পারবে সে ঈমানের স্বাদ আস্বাদন ও অনূভব করতে পারবে। [মুসলিম হাদীস নং- ৩৪]

(২) ঈমানের মজা ও মাধুর্য সম্পর্কে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করছেন :

(( ثلاث من كن فيه وجد حلاوة الإيمان : أن يكون الله ورسوله أحب إليه مما سواهما , وأن يحب المرء لايحبه إلا لله , وأن يكره أن يعود في الكفر كما يكره أن يقذف في النار )) متفق عليه

তিনটি বিশেষ গুণ, যার মধ্যে এগুলো বিদ্যমান থাকবে সে ঈমানের মজা অনুভব করতে পারবে। যার নিকট আল্লাহ ও রাসূল, পৃথিবীর অন্য সকল ব্যক্তি ও বস্ত্ত অপেক্ষা অধিক প্রিয় হবে। যে ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যেই ভালবাসবে এবং যে ব্যক্তি আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে যেমন অপছন্দ করে, কুফরে ফিরে যাওয়াকে ঠিক অনুরূপ অপছন্দ করবে। [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং বুখারী- ১৬, মুসলিম ৪৩ হাদীসের ভাষ্য বুখারীর।]

(৩) আর ঈমানের হাকীকত, যে ব্যক্তির মাঝে দ্বীনের মৌলিকত্ব ও সঠিক বুঝ (হাকীকত) বিরজমান থাকবে, দ্বীনের জন্যে চেষ্টা করবে শ্রম দেবে; ইবাদত করবে, দাওয়াত দেবে, হিজরত করবে, নুসরত করবে, জিহাদ করবে, অর্থ ব্যয় করবে বরং দ্বীনের জন্যে চেষ্টা-মেহনত করতে গিয়ে সম্ভাব্য সকল কাজে অংশ গ্রহণ করে সামর্থের শতভাগ নিংড়ে দেবে সে-ই প্রকৃত অর্থে ঈমানের হাকীকত ও প্রকৃত অবস্থা বুঝতে পারবে এবং তা নিজের মাঝে ধারণ করতে সক্ষম হবে।

(১) আল্লাহ তা’আলা বলেন :

إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آَيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ ﴿2﴾ الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ ﴿3﴾ أُولَئِكَ هُمُ الْمُؤْمِنُونَ حَقًّا لَهُمْ دَرَجَاتٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَمَغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيمٌ ﴿4﴾) الأنفال /২-৪(

‘প্রকৃত ঈমানদার তারাই, যখন আল্লাহ তাআলার নাম নেয়া হয় তখন ভীত হয়ে পড়ে তাদের অন্তর আর যখন তাদের সামনে আল্লাহর আয়াত (নিদর্শন) ও কালাম পাঠ করা হয়, তাদের ঈমান বেড়ে যায় এবং তারা স্বীয় পালনকর্তার প্রতি ভরসা পোষণ করে। যারা সালাত কায়েম করে এবং আমার দেয়া রিযিক থেকে ব্যয় করে। তারাই সত্যিকার মুমিন। তাদের জন্যে রয়েছে স্বীয় পালনকর্তার নিকট মর্যাদা, ক্ষমা এবং সম্মানজনক রুযী।’ [সূরা আনফাল : ২-৪]

(২) আল্লাহ তাআলা আরো বলেন :

وَالَّذِينَ آَمَنُوا وَهَاجَرُوا وَجَاهَدُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالَّذِينَ آَوَوْا وَنَصَرُوا أُولَئِكَ هُمُ الْمُؤْمِنُونَ حَقًّا لَهُمْ مَغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيمٌ ﴿74﴾ ) الأنفال :৭৪

‘আর যারা ঈমান এনেছে, নিজেদের ঘর-বাড়ী ছেড়েছে এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছে এবং যারা তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে, সাহায্য-সহায়তা করেছে। তাঁরাই হল সত্যিকার মুমিন। তাঁদের জন্যে রয়েছে ক্ষমা ও সম্মানজনক রুযী।’ [সূরা আনফাল : ৭৪]

(৩) মহান আল্লাহ তা’আলা বলেন :

إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ آَمَنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ ثُمَّ لَمْ يَرْتَابُوا وَجَاهَدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أُولَئِكَ هُمُ الصَّادِقُونَ ﴿15﴾ ( الحجرات :১৫)

‘তারাই মুমিন, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনার পর সন্দেহ পোষণ করে না এবং আল্লাহর পথে জীবন-প্রাণ ও ধন-সম্পদ দ্বারা জিহাদ করে। তারাই সত্যনিষ্ঠ।’ [সূরা হুজুরাত: ১৫]

কোন ব্যক্তি সম্পর্কে ঈমানের হাকীকত তথা প্রকৃত অবস্থায় পৌঁছেছে বলে বিবেচনা করা হবে না যতক্ষণ না সে এ বিশ্বাস করবে যে, যে বিপদ তার উপর আপতিত হয়েছে তা রদ হওয়ার ছিল না, আর যা তার পর্যন্ত পৌঁছেনি সেটি পৌঁছার ছিল না, অর্থাৎ যা হওয়ার তা হবেই সেটি কেউ রদ করতে পরবে না, আর যা হয়নি তা কেউ জোর করে বাস্তবায়ন করতে পারবে না।

৩৭
ঈমানের পূর্ণতা :
পূর্নাঙ্গ ঈমানের প্রকৃত মানদন্ড হল আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে পরিপূর্ণ রূপে মুহাববত করা-ভালবাসা। যে মুহাববত ও ভালবাসা তাঁদের পছন্দনীয় বিষয়াবলীকে পছন্দ ও বাস্তবায়ন করাকে অনিবার্য করে। সুতরাং যখন বান্দার ভালবাসা হবে আল্লাহর জন্যে, ঘৃণা করাও হবে আল্লাহর জন্যে। (এ দু’টি বান্দার অন্তরের আমল) এবং তার দান করা এবং বিরত থাকাও হবে আল্লাহর জন্যে (এ দু’টি তার শারীরিক আমল)। তখন তার ঈমানের পূর্ণতা ও আল্লাহকে পরিপূর্ণরূপে ভালবেসেছে বলে প্রমাণিত হবে।

عن أبي أمامة رضي الله عنه عن رسول الله صلى الله عليه وسلم أنه قال :(( من أحب لله، وأبغض لله، وأعطى لله، ومنع لله ، فقد استكمل الإيمان )) أخرجه أبوداود

‘সাহাবাী আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে আল্লাহর জন্য ভালবাসল। আল্লাহর জন্য ঘৃণা করল। আললাহর জন্য দান করল। আল্লাহর জন্য নিষেধ করল। সে-ই মূলত: ঈমানকে পরিপূর্ণ করল।’ [হাদীসটি হাসান সনদে বণিৃত হয়েছে, বর্ণনায় আবু দাউদ হাদীস নং ৪৬৮১। দেখুন আস সিলসিলাতুস সহীহাহ ক্রমিক-৩৮০।]

৩৮
৯- ঈমানের কিছু বৈশিষ্ট্য ও নিদর্শন
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালবাসা:

عن أنس رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم :(( لا يؤمن أحدكم حتى أكون أحب إليه من والده وولده والناس أجمعين )) متفق عليه

‘বিশিষ্ট সাহাবী আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমাদের কেউ মুমিন বলে স্বীকৃত হবে না, যতক্ষন না আমি তার নিকট তার পিতা, সন্তান ও অপরাপর সকল মানুষ অপেক্ষা অধিক প্রিয় হব।’ [বুখারী-মুসলিম । বুখারী হাদীস নং ১৫, এবং মুসলিম হাদীস নং ১৪]

আনসারদের ভালবাসা:

عن أنس رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال : أية الإيمان حب الأنصار وآية النفاق بغض الأنصار . متفق عليه

‘সাহাবী আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ঈমানের নিদর্শন হচ্ছে, আনসারদেরকে ভালবাসা আর নিফাকের (কপটতা) আলামত হচ্ছে তাদেরকে ঘৃণা করা।’ [বুখারী-মুসলিম। বুখারী হাদীস নং ১৭, এবং মুসলিম হাদীস নং ৭৪]

সকল মুমিন বান্দাদেরকে ভালবাসা :

عن أبى هريرة رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم :(( لا تدخلوا الجنة حتى تؤمنوا , ولا تؤمنوا حتى تحابوا , أولا أدلّكم على شيئ إذا فعلتموه تحاببتم أفشوا السّلام بينكم )) أخرجه مسلم

‘প্রখ্যাত সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা মুমিন না হলে জান্নাতে যেতে পারবে না। আর পারস্পরিক ভালবাসা ও মুহাববতে আবদ্ধ না হলে মুমিন বলে বিবেচিত হবে না। আমি কি তোমাদের এমন আমলের কথা বলবনা? যা বাস্তবায়ন করলে তোমরা পারস্পরিক ভালবাসায় আবদ্ধ হতে পারবে? নিজেদের মাঝে সালামের ব্যাপক প্রসার ঘটাও।’ [মুসলিম। হাদীস নং ৫৪]

স্বীয় মুসলিম ভাইকে ভালবাসা :

عن أنس رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال : لا يؤمن أحدكم حتى يحب لأخيه، أو قال لجاره، ما يحب لنفسه . متفق عليه

‘সাহাবী আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন , তোমাদের কেউ মুমিন বলে বিবেচিত হবে না যতক্ষন না অপর মুসলিম ভাইয়ের জন্যে অথবা বলেছেন প্রতিবেশীর জন্যে- সে বস্ত্ত পছন্দ করবে যা নিজের জন্যে (পছন্দ) করে।’ [বুখারী ও মুসলিম। বুখারী হাদীস নং ১৩, মুসলিম হাদীস নং ৪৫]

মেহমান, প্রতিবেশীর সম্মান করা ও কল্যাণমূলক কথা ব্যতীত নীরব থাকা :

عن أبى هريرة رضي الله عنه عن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال :(( من كان يؤمن بالله واليوم الأخر فليقل خيرا أو ليصمت , ومن كان يؤمن بالله واليوم الآخر فليكرم جاره , ومن كان يؤمن بالله و اليوم الآخر فليكرم ضيفه )) متفق عليه

‘প্রখ্যাত সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ তা’আলা ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন কল্যাণমূলক কথা বলে অথবা নীরব থাকে। যে ব্যক্তি আল্লাহ তা’আলা ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন স্বীয় প্রতিবেশীর প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে। যে ব্যক্তি আল্লাহ আ’আলা ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন স্বীয় মেহমানকে সম্মান করে।’ [বুখারী ও মুসলিম। বুখারী হাদীস নং ৬০১৮ এবং মুসলিম ৪৭]

সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজে বাধা প্রদান করা :

عن أبى سعيد الخدري رضي الله عنه قال : سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول :(( من رأي منكم منكرا فليغيره بيده , فإن لم يستطع فبلسانه , فإن لم يستطع فبقلبه وذلك أضعف الإيمان )) أخرجه مسلم

‘সাহাবী আবু সায়ীদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ইরশাদ করতে শুনেছি, তোমাদের কেউ অন্যায়-অসৎকাজ সংঘটিত হতে দেখলে শক্তি দ্বারা প্রতিহত করবে। না পারলে মুখ দ্বারা প্রতিবাদ করবে এরও সামর্থ না থাকলে মনে-প্রাণে ঘৃণা করবে। আর এটিই হচ্ছে সবচে দুর্বল ঈমান।’ [বর্ণনায় মুসলিম, হাদীস নং ৪৯।]

কল্যাণ কামনা ও সদুপদেশ প্রদান:

عن تميم الداري رضي الله عنه أن النبي صلى الله عليه وسلم قال :(( الدين النصيحة )) قلنا لمن؟ قال (( لله ولكتابه ولرسوله ولأئمة المسلمين و عامتهم )) ( أخرجه مسلم )

‘সাহাবী তামীম আদ-দারী রা. বর্ণনা করছেন, নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কল্যাণকামনাই হল দ্বীন, আমরা বললাম, কার জন্যে? নবীজী বললেন, আল্লাহর জন্যে, তাঁর রাসূল ও তাঁর কিতাবের জন্যে এবং সাধারণ মুসলমান ও তাদের নেতৃবর্গের জন্যে।’ [বর্ণনায় মুসলিম, হাদীস নং ৫৫।]

৩৯
ঈমান সর্বোত্তম আমল :
عن أبى هريرة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم سئل : أي العمل أفضل؟ قال :(( إيمان بالله ورسوله )) قيل ثم ماذا؟ قال : (( الجهاد في سبيل الله )) قيل : ثم ماذا؟ قال : (( حج مبرور )) متفق عليه

‘বিশিষ্ট সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট জানতে চাওয়া হল, সর্বাধিক উত্তম আমল কোনটি? উত্তরে তিনি বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান। বলা হল তারপর কী? বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদ, বলা হল এর পর কোনটি? তিনি বললেন-মাবরুর হজ।’ [বুখারী ও মুসলিম । বুখারী হাদীস নং ২৬ এবং মুসলিম ৮৩।]

৪০
ইবাদত ও আনুগত্যের মাধ্যমে ঈমান বৃদ্ধি পায়-দৃঢ় হয়, পাপ ও অবাধ্যতার কারনে হ্রাস পায়- দুর্বল হয়।
(১) আল্লাহ তা’আলা বলেন :

هُوَ الَّذِي أَنْزَلَ السَّكِينَةَ فِي قُلُوبِ الْمُؤْمِنِينَ لِيَزْدَادُوا إِيمَانًا مَعَ إِيمَانِهِمْ وَلِلَّهِ جُنُودُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَكَانَ اللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمًا ﴿4﴾ الفتح /৪

‘তিনি মুমিনদের অন্তরে সাকীনা-প্রশান্তি নাযিল করেন। যাতে তাদের ঈমানের সাথে আরও ঈমান বেড়ে যায়। নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডলের বাহিনীসমূহ আল্লাহরই এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ [সূরা আল-ফাতহ:৪]

(২) আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন :

وَإِذَا مَا أُنْزِلَتْ سُورَةٌ فَمِنْهُمْ مَنْ يَقُولُ أَيُّكُمْ زَادَتْهُ هَذِهِ إِيمَانًا فَأَمَّا الَّذِينَ آَمَنُوا فَزَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَهُمْ يَسْتَبْشِرُونَ ﴿124﴾ التوبة / ১২৪

‘আর যখন কোন সূরা অবতীর্ণ হয়, তখন তাদের কেউ কেউ বলে, এ সূরা তোমাদের মধ্যে কার ঈমান (কতটা) বৃদ্ধি করল? অতএব যারা ঈমানদার, এ সূরা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করেছে এবং তারা আনন্দিত হয়েছে।’ [সূরা তাওবাহ: ১২৪]

(৩)

وعن أبي هريرة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال :(( لا يزني الزاني حين يزني وهو مؤمن، و لا يسرق السارق حين يسرق و هو مؤمن، ولا يشرب الخمر حين يشربها و هو مؤمن )) متفق عليه

‘আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ব্যভিচারী মুমিন অবস্থায় ব্যভিচার করতে পারে না, চোর চুরি করার সময় মুমিন থাকে না। অনুরূপভাবে মদ্যপানকারী মুমিন অবস্থায় মদ্যপান করতে পারে না।’ [বুখারী মুসলিম । বুখারী হাদীস নং ২৪৭৫ এবং মুসলিম ৫৭।]

(৪)

وعن أنس رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال :(( يخرج من النار من قال : لا إله إلا الله وفي قلبه وزن شعيرة من خير، ويخرج من النار من قال : لا إله إلا الله وفي قلبه وزن برة من خير، و يخرج من النار من قال : لا إله إلا الله و في قلبه وزن ذرة من خير )) و في رواية : (( من إيمان )) مكان (( من خير )) متفق عليه

‘আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ তা’আলা ব্যতীত সত্যিকার কোন উপাস্য নেই মর্মে স্বীকৃতি দেবে এবং তার অন্তরে একটি যবের দানার ওজন পরিমান কল্যাণও (তথা ঈমান) বিদ্যমান থাকবে সে কোন না কোন পর্যায়ে জাহান্নাম থেকে বের হয়ে আসবে। যে ব্যক্তি আল্লাহ তা’আলা ব্যতীত আর কোন সত্যিকার উপাস্য নেই মর্মে সাক্ষ্য দেবে এবং তার অন্তরে একটি গমের দানার ওজন পরিমান কল্যাণ (ঈমান)-ও বিদ্যমান থাকবে সে জাহান্নাম থেকে বের হয়ে আসবে। এবং যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলা ব্যতীত কোন হক উপাস্য নেই মর্মে সাক্ষ্য দেবে এবং তার অন্তরে অনু পরিমান কল্যাণ (তথা ঈমান) বিদ্যমান থাকবে সে-ও জাহান্নাম থেকে বের হয়ে আসবে।

অন্য রেওয়ায়েত ( خير )-এর স্থলে ( إيمان ) বর্ণিত হয়েছে। (অর্থাৎ তার অন্তরে এক যব/ গম / অনু পরিমান ঈমান অবশিষ্ট আছে)। [বুখারী ও মুসলিম । বুখারী হাদীস নং ৪৪, এবং মুসলিম ১৯৩।]

৪১
কাফেরদের ইসলাম গ্রহণ করার পূর্বে সম্পাদিত নেক আমলের বিধান:
(১) অমুসলিম ব্যক্তিবর্গ ইসলাম গ্রহণ করার পর যদি নিয়মিত নেক আমল সম্পাদন করে যায়, তাহলে পূর্বেকৃত অপরাধসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। কারণ আল্লাহ তা’আলা বলেন :

قُلْ لِلَّذِينَ كَفَرُوا إِنْ يَنْتَهُوا يُغْفَرْ لَهُمْ مَا قَدْ سَلَفَ وَإِنْ يَعُودُوا فَقَدْ مَضَتْ سُنَّةُ الْأَوَّلِينَ ﴿38﴾ الأنفال /৩৮

‘হে নবী আপনি অমুসলিমদের বলে দিন যে, তারা যদি বিরত হয়ে যায়, তাহলে পূর্বে সংঘটিত সব ক্ষমা করে দেয়া হবে। পক্ষান্তরে আবারও যদি তাই করে তাহলে পূর্ববর্তীদের পথ নির্ধারিত হয়ে গেছে।’ [সূরা আনফাল : ৩৮]

(২) পূর্বেকৃত নেক আমলের জন্যে ছাওয়াব প্রাপ্ত হবে। কেননা হাকিম বিন হিযাম রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন :

أرأيت أمورا كنت أتحنث بها فى الجاهلية هل لى فيها من شيئ؟ فقال له رسول الله صلى الله عليه وسلم : (( أسلمت على ما أسلفت من خير )). متفق عليه

‘আমি জাহেলীযুগে যে সকল পূণ্যকর্ম সম্পাদন করেছিলাম সেগুলো সম্পর্কে আপনার অভিমত কী ? সেগুলোর বিনিময়ে আমি কি কিছু পাব? তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : তুমি পূর্বে সম্পাদিত সকল নেক আমল নিয়েই ইসলাম গ্রহণ করেছ।’ [বুখারী মুসলিম। বুখারী হাদীস নং ১৪৩৬ এবং মুসলিম হাদীস নং ১২৩]

(৩) আর যে ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করার পর মন্দকাজ করবে সে পূর্বাপর উভয় সময়ের মন্দ কাজের জন্যে শাস্তির সম্মুখীন হবে। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :

(( من أحسن فى الإسلام لم يؤاخذ بما عمل فى الجاهلية ومن أساء في الإسلام أخذ بالأول والآخر )) متفق عليه

‘যে ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করার পর নেক আমল সম্পাদন করবে, সে জাহেলীযুগে সঙ্ঘটিত বদআমলের জন্যে শাস্তির সম্মুখীন হবে না। আর যে লোক (ইসলাম গ্রহণ করার পর) মন্দকাজ করবে তাকে পূর্বাপর-উভয় সময়ের পাপের শাস্তি দেয়া হবে। [বুখারী ও মুসলিম। বুখারী হাদীস নং ৬৯২১ এবং মুসলিম হাদীস নং ১২০।]

৪২
১০- ঈমানের রুকনসমূহ
ঈমানের রুকন ছয়টি, যেগুলো হাদীসে জিবরাঈলে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিবরাঈল আলাইহিসসালাম ঈমান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে রাসূলুল্লাহ উত্তরে বলেন:

أن تؤمن بالله وملائكته وكتبه ورسله واليوم الآخر وتؤمن بالقدر خيره وشره . متفق عليه .

‘আল্লাহ তাআলা, তাঁর ফেরেশতাকুল, কিতাবসমূহ, রাসূলবৃন্দ এবং কিয়ামত দিবসের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। আরও বিশ্বাস স্থাপন করা তাকদীরের ভাল-মন্দের প্রতি। [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং বুখারী (৫০) এবং মুসলিম (৮)। হাদীসের ভাষ্য ইমাম মুসলিমের।]

৪৩
১-আল্লাহ তাআলার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন
আল্লাহ তাআলার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন, চারটি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে।

৪৪
(এক) আল্লাহ তাআলার অস্তিত্বের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা।
মহান আল্লাহ প্রত্যেক মাখলূককে নিজ সৃষ্টিকর্তার প্রতি ঈমানের প্রকৃতি ও মানসিকতা দিয়েই সৃষ্টি করেছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ নিজেই বলছেন :-

فَأَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفًا فِطْرَةَ اللَّهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا لَا تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللَّهِ ( سورة الروم : 30)

‘তুমি একনিষ্ঠভাবে নিজেকে ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখ। এটাই আল্লাহ তাআলার প্রকৃতি। যার উপর তিনি মানব সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই।’ [সূরা রূম : ৩০]

প্রত্যেক সুস্থ বিবেক এ বিশ্বাসের প্রতি সমর্থন ও পথনির্দেশ করে যে, এ নিখিল বিশ্বের একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন। কারণ এ পৃথিবীর পূর্বাপর সকল সৃষ্টির ক্ষেত্রে আবশ্যিক যে তাদের একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন যিনি তাদেরকে অস্তিত্বে এনেছেন। এগুলোর পক্ষে নিজে নিজেই অস্তিত্ব লাভকরা সম্ভব নয় এবং আকস্মিকভাবে অস্তিত্বে চলে আসাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। সুতরাং এদের অস্তিত্বই প্রমাণ করে যে, এদের একজন অস্তিত্ব দানকারী আছেন। আর তিনি হচ্ছেন এ বিশ্বজগতের প্রতিপালক মহামহীম আল্লাহ।

ইরশাদ হচ্ছে,

أَمْ خُلِقُوا مِنْ غَيْرِ شَيْءٍ أَمْ هُمُ الْخَالِقُونَ ﴿35﴾ أَمْ خَلَقُوا السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ بَل لَا يُوقِنُونَ ﴿36﴾ سورة الطور : 35-36)

‘তারা কি আপনা-আপনিই সৃজিত হয়ে গেছে, না তারা নিজেরাই স্রষ্টা। না তারা নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছে? বরং তারা বিশ্বাস করে না।’ [সূরা তুর : ৩৫-৩৬।]

সুস্থ অনুভূতিও আল্লাহ তা’আলার অস্তিত্বের প্রতি সমর্থন করে। কারণ আমরা প্রতিনিয়ত দিবা-রাত্রির পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করছি। মানুষ ও অন্যান্য জীব-জন্তুর রিযিকের বিষয়টিও আমাদের সম্মুখে। দেখছি পুরো বিশ্ব জগতের সকল বিষয়কে; কত সুশৃংখল ভাবে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হচ্ছে। এ সকল বিষয় সন্দেহাতীতভাবে আল্লাহ তাআলার অস্তিত্বকে প্রমাণ করে।

يُقَلِّبُ اللَّهُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَعِبْرَةً لِأُولِي الْأَبْصَارِ . ( سورة النور : 44)

‘আল্লাহ দিন ও রাত্রির পরিবর্তন ঘটান। এতে অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তিগণের জন্যে চিন্তার উপকরণ রয়েছে।’ [সূরা নূর : ৪৪।]

আল্লাহ তাআলা তাঁর নবী-রাসূলদের বিভিন্ন মু'জেযা ও নিদর্শনাবলীর মাধ্যমে সাহায্য করেছেন-সমর্থন যুগিয়েছেন। সেগুলো যুগে যুগে মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে, বা নির্ভরযোগ্য সূত্রে শুনেছে, বিষয়গুলো ছিল সম্পূর্ণরূপে মানবীয় ক্ষমতার উর্ধ্বে। এর মাধ্যমে আল্লাহ নবী-রাসূলদের সাহায্য করেছেন। তাঁদের অবস্থান মজবুত করেছেন। মনুষ্য ক্ষমতার উর্ধ্বের বিষয়, সেই মানুষ দ্বারা সঙ্ঘটিত হওয়াই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে যে তাঁদের একজন প্রেরণকারী আছেন। আর সে প্রেরণকারীই হচ্ছেন আল্লাহ তাআলা। যেমন আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম আলাইহিস সালামের ক্ষেত্রে জলন্ত অগ্নিকে শান্তিদায়ক শীতল করে দিয়েছেন। মূসা আলাইহিস সালাম-এর জন্যে সমুদ্র চিড়ে রাস্তা বের করেছিলেন। ঈসা আলাইহিস সালামের জন্যে মৃত-কে জীবিত করেছিলেন এবং মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহর জন্যে চন্দ্র দ্বি-খন্ডিত করেছেন।

আল্লাহ তাআলা কত দোয়াকারীর দোয়া কবুল করছেন, কত প্রার্থনাকারীর প্রার্থনা মঞ্জুর করছেন, বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি সাহায্য চেয়ে অব্যর্থ হচ্ছে প্রতিনিয়ত আল্লাহর কৃপায়। আল্লাহর অস্তিত্ব, ক্ষমতা ও ইলম যদি না-ই থাকবে তাহালে এসব সংঘটিত করল কে? জবাব দিল কে? সুতরাং নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হল, আল্লাহ আছেন তাঁর কুদরত ও ক্ষমতা অসীম।

(১) আল্লাহ তা’আলা বলেন-

وَأَيُّوبَ إِذْ نَادَى رَبَّهُ أَنِّي مَسَّنِيَ الضُّرُّ وَأَنْتَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ ﴿83﴾ فَاسْتَجَبْنَا لَهُ فَكَشَفْنَا مَا بِهِ مِنْ ضُرٍّ وَآَتَيْنَاهُ أَهْلَهُ وَمِثْلَهُمْ مَعَهُمْ رَحْمَةً مِنْ عِنْدِنَا وَذِكْرَى لِلْعَابِدِينَ ﴿84﴾ ( سورة الأنبياء : 83-84)

‘এবং স্মরণ করুন আইয়ূবের কথা, যখন তিনি তাঁর পালনকর্তাকে আহবান করেছিলেন, আমি দু:খে কষ্টে পতিত হয়েছি এবং আপনি সকল দয়াবান অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ দয়াবান। অত:পর আমি তার আহবানে সাড়া দিলাম এবং তার দুঃখ কষ্ট দূর করে দিলাম এবং তার পরিবারবর্গ ফিরেয়ে দিলাম। আর তাদের সাথে তাদের সমপরিমাণ আরও দিলাম আমার পক্ষ থেকে কৃপাবশত: আর এটি ইবাদতকারীদের জন্যে উপদেশ স্বরূপ।’ [সূরা আম্বিয়া : ৮৪-৮৪]

ইসলামী শরীয়ত ও এর সুন্দর সুন্দর-সামঞ্জস্যশীল বিধি-বিধান। আল্লাহ তা’আলার অস্তিত্বকে প্রমাণ করে। কিসে মানুষের কল্যাণ এবং কিসে অকল্যাণ। কী করলে তার উন্নতি হবে এবং কী কারণে অবণতি। ইসলামকে পরিপূর্ণরূপে অনুসরণ করলে উপরোক্ত বিষয়গুলো সুন্দরভাবে অনুধাবন করা যায়। মানব জীবনে শৃংখলা, অগ্রগতি, উন্নতি সব কিছুই নিহিত আছে ইসলামী বিধি-বিধানের অনুশীলনের ভিতর, যা আল্লাহ তাআলা নিজ গ্রন্থাদিতে নবী-রাসূলগণের উপর নাযিল করেছেন। এত সুন্দর, ভারসাম্যপূর্ণ, মানুষের সমস্যা সমাধানে পারঙ্গম নীতিই প্রমাণ করে যে এটি প্রজ্ঞবান-বিচক্ষণ, ক্ষমতাবান প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যিনি বান্দাদের কল্যাণ ও উন্নতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত।

৪৫
(দুই) এ বিশ্বাস রাখা যে, আল্লাহ তাআলাই হচ্ছেন রব-প্রতিপালক, এতে তাঁর কোন শরীক নেই।
রব তিনিই- সৃষ্টি, রাজত্ব এবং হুকুম করার ক্ষমতা যার জন্য সংরক্ষিত। অতএব আল্লাহ ব্যতীত কোন সৃষ্টিকর্তা নেই, আল্লাহ ব্যতীত আর কোন মালিক কিংবা রাজত্বের অধিকারী নেই, সকল ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব একমাত্র তাঁর।

তাঁর সৃষ্টিই সৃষ্টি, রাজত্ব-আধিপত্য বলতে একমাত্র তাঁর রাজত্ব-আধিপত্য, কর্তৃত্ব বলতেও তাঁর কর্তৃত্ব-ক্ষমতা। পরাক্রমশালী-দয়াময়, অমুখাপেক্ষী প্রশংসিত। অনুগ্রহ প্রার্থনা করা হলে অনুগ্রহ করেন। ক্ষমা চাওয়া হলে ক্ষমা করেন। প্রার্থনা করা হলে দান করেন, ডাকা হলে সাড়া দেন। চিরঞ্জীব, অবিনশ্বর, যাকে নিদ্রা-তন্দ্রা স্পর্শ করে না।

(১) আল্লাহ তাআলা বলেন-

أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ تَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ ﴿54﴾ ( سورة الأعراف : 54)

‘শুনে রাখ! সৃষ্টি এবং আদেশ তারই, আল্লাহ বরকতময় যিনি বিশ্বজগতের প্রতিপালক।’ [সূরা আরাফ : ৫৪]

(২) আরোও ইরশাদ হচ্ছে,

لِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا فِيهِنَّ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ ﴿120﴾ ( سورة المائدة : 120)

‘নভোমন্ডল, ভূ-মন্ডল এবং এতদুভয়ে অবস্থিত সবকিছুর আধিপত্য আল্লাহরই। তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান। [সূরা মায়েদা : ১২০]

আমরা জানি এবং বিশ্বাস করি আল্লাহ তা’আলা সমগ্র সৃষ্টিকুল সৃজন করেছেন। নিখিল বিশ্বের দৃশ্যমান সবকিছু অস্তিত্বে এনেছেন। এ বিশ্ব-ভূমন্ডল তৈরী করেছেন, সৃষ্টি করেছেন নভোমন্ডল-ভূ-মন্ডল, চন্দ্র-সূর্য, দিন-রাত্রি, পানি, তৃণ, মানব, দানব, জন্তু জানোয়ার পাহাড় সমুদ্র।

وَخَلَقَ كُلَّ شَيْءٍ فَقَدَّرَهُ تَقْدِيرًا ﴿الفرقان :2﴾

‘তিনি প্রত্যেক বস্ত্ত সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তা নিরূপণ করেছেন নিপুণভাবে ।’ [সূরা আল-ফুরকান : ২]

আল্লাহ তা’আলা সবকিছু সৃষ্টি করেছেন নিজ ক্ষমতায়, তাঁর কোন মন্ত্রী-উজির, পরামর্শক কিংবা সাহায্যকারী নেই, এসবের প্রয়োজনও নেই। তিনি এসব থেকে পূত-পবিত্র, তিনি একক মহা পরাক্রমশালী, আরশে সমাসীন হয়েছেন নিজ ক্ষমতায়, ভূমি বিছিয়েছেন নিজ ইচ্ছায়, সৃষ্টিকুল সৃজন করেছেন নিজ ইরাদায়, বান্দাদের বশীভূত করেছেন নিজ শক্তিবলে। উদয়স্থল ও অস্তস্থলের মালিক। তিনি ভিন্ন কোন মা’বূদ নেই। চিরঞ্জীব অবিনশ্বর।

আমরা জানি ও বিশ্বাস করি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান। প্রত্যেক বস্ত্তর নিয়ন্ত্রণকারী। প্রত্যেক বস্ত্তর মালিক-কর্তৃত্বকারী। সব বিষয়ে তিনি সম্যক জ্ঞাত। সকল কিছুর উপর প্রবল-পরাক্রমশালী, সকল প্রভাবশালী তাঁর বড়ত্বের কাছে অবনত। সকল আওয়াজ তাঁর প্রভাবের কাছে বিনম্র, সকল শক্তিশালী তাঁর শক্তির নিকট হীন-অপদস্ত। কোন দৃষ্টি-চক্ষু তাঁকে পরিপূর্ণরূপে উপলব্ধি করতে পারে না। তিনি সকল দৃষ্টি-চক্ষুকে পরিপূর্ণ রূপে বুঝেন-উপলব্ধি করেন। তিনি সুক্ষ্মদর্শী পরিজ্ঞাত। যা ইচ্ছা করেন। ইচ্ছেমত হুকুম করেন।

إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَنْ يَقُولَ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ ﴿82﴾ ( سورة يـس : 82)

‘তিনি যখন কিছু করতে ইচ্ছা করেন, তখন কেবল বলে দেন ‘হও’ তখনই সে হয়ে যায়।’ [সূরা ইয়াসীন : ৮২]

নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডলে অবস্থিত সকল কিছু সম্পর্কে জানেন। দৃশ্য-অদৃশ্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ পরিজ্ঞাত। সুমহান, সুউচ্চ মর্যাদাবান। পর্বত-গিরির ওজন-পরিমাপ, সাগর-সমুদ্রের পরিধি-পরিমাপ সবই তাঁর অসীম জ্ঞানের আওতাধীন। পৃথিবীর সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম কোন কিছুই তাঁর জ্ঞানের বাইরে নেই। এমনকি কত ফোটা বৃষ্টি ঝরল, বৃক্ষ রাজীর পাতা-পল্লবের পরিমাণ কি, ধুলিকনার সংখ্যা কত, যেসব বস্ত্তকে রাতের আাঁধার অন্ধকারচ্ছন্ন এবং দিনের রোশনী আলোকোদ্ভাসিত করে সবই তাঁর জ্ঞানের আওতার মধ্যে।

وَعِنْدَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لَا يَعْلَمُهَا إِلَّا هُوَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَمَا تَسْقُطُ مِنْ وَرَقَةٍ إِلَّا يَعْلَمُهَا وَلَا حَبَّةٍ فِي ظُلُمَاتِ الْأَرْضِ وَلَا رَطْبٍ وَلَا يَابِسٍ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُبِينٍ ﴿59﴾ ( سورة الأنعام : 59)

‘ আর তাঁর কাছে রয়েছে গায়েবের চাবিসমূহ, তিনি ছাড়া এ বিষয়ে কেউ জানে না এবং তিনি অবগত রয়েছেন স্থলে ও সমুদ্রে যা কিছু আছে। আর কোন পাতা ঝরে না, কিন্তু তিনি তা জানেন এবং যমীনের অন্ধকারে কোন দানা পড়ে না, না কোন ভেজা এবং না কোন শুষ্ক কিছু; কিন্তু রয়েছে সুস্পষ্ট কিতাবে।’ [সূরা আনআম : ৫৯]

এবং আমরা জানি ও বিশ্বাস করি। নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা প্রতিনিয়ত কোন না কোন কাজে রত আছেন। পৃথিবী ও আকাশের কোন কিছুই তাঁর নিকট গোপন নেই। সকল কাজ পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রন করেন। বাতাস প্রবাহিত করেন। বৃষ্টি বর্ষণ করেন। মৃত যমীন আবার জীবিত করেন। যাকে ইচ্ছা মর্যাদাবান করেন আবার যাকে ইচ্ছা বেইজ্জত করেন। জীবন-মৃত্য তাঁরই দান। তিনিই দয়া করে দান করেন আবার নিষেধ তিনিই করেন। তিনিই মর্যাদার আসন থেকে নামিয়ে আনেন।

هُوَ الْأَوَّلُ وَالْآَخِرُ وَالظَّاهِرُ وَالْبَاطِنُ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ ﴿3﴾ ( سورة الحديد : 3)

‘তিনিই প্রথম, তিনিই সর্বশেষ, তিনিই প্রকাশমান ও অপ্রকাশমান এবং তিনি সববিষয়ে সম্যক পরিজ্ঞাত।’ [সূরা হাদীদ:৩।]

আমরা জানি ও বিশ্বাস করি, আকাশ-যমীন বরং নিখিল বিশ্বের সকল বস্ত্তর ভান্ডার আল্লাহর নিকট। পানির ভান্ডার, তৃণ শস্যের ভান্ডার, হাওয়া-বাতাসের ভান্ডার, ধন-ভান্ডার, সুস্থতার ভান্ডার, নিরাপত্তার ভান্ডার, নিয়ামতের ভান্ডার, আযাবের ভান্ডার, রহমতের ভান্ডার, হিদায়াতের ভান্ডার, শক্তি-সামর্থের ভান্ডার, ইজ্জত-সম্মানের ভান্ডার বরং জল-স্থলের সকল ভান্ডার আল্লাহর কাছে-তাঁরই হাতে।

وَإِنْ مِنْ شَيْءٍ إِلَّا عِنْدَنَا خَزَائِنُهُ وَمَا نُنَزِّلُهُ إِلَّا بِقَدَرٍ مَعْلُومٍ ﴿21﴾ ( سورة الحجر : 21)

‘আর প্রতিটি বস্ত্তরই ভান্ডারসমূহ রয়েছে আমার কাছে এবং আমি তা অবতীর্ণ করি কেবল নির্দিষ্ট পরিমাণে।’ [সূরা হিজর : ২১]

আমরা যখন এগুলো জানলাম এবং মহান আল্লাহ তা’আলার কুদরত, তাঁর মহত্ব, তাঁর শক্তি-সামর্থ, তাঁর বড়ত্ব, তাঁর জ্ঞান, তাঁর ভান্ডারসমূহ, তাঁর রহমত ও তাঁর একত্ববাদের উপর বিশ্বাস স্থাপন করলাম। তাহলে অন্তরাত্মা তাঁর দিকে অগ্রসর হবে। মন-মানসিকতা তাঁর ইবাদতের জন্যে প্রস্ত্তত থাকবে। অঙ্গ-প্রতঙ্গ তাঁর আনুগত্যের জন্যে আত্মসমর্পন করবে। তাঁর বড়ত্ব, মহত্ব, পবিত্রতা ও প্রশংসা বর্ণনায় জিহবাসমূহ নিবেদিত থাকবে। সুতরাং একমাত্র তাঁর কাছেই প্রার্থনা করবে। তাঁর নিকটই সাহায্য চাইবে। তাঁর উপরই ভরসা করবে। তাঁকেই ভয় করবে এবং কেবলমাত্র তাঁরই ইবাদত করবে।

ذَلِكُمُ اللَّهُ رَبُّكُمْ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ فَاعْبُدُوهُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ وَكِيلٌ ﴿102﴾ ( سورة الأنعام : 102)

‘তিনিই আল্লাহ তোমাদের রব। তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। তিনি প্রতিটি জিনিসের স্রষ্টা। সুতরাং তোমরা তারই ইবাদত কর। আর তিনি প্রতিটি বস্ত্তর উরপ তত্ত্বাবধায়ক।’ [সূরা আনআম : ১০২]

৪৬
(তিন) আল্লাহ তাআলার উলূহিয়্যাতের (উপাস্যত্ব) প্রতি বিশ্বাস স্থাপন :
আমরা জানি ও বিশ্বাস করি যে, আল্লাহ তাআলাই এককভাবে সত্যিকার ইলাহ, এতে তাঁর কোন শরীক নেই। তিনিই এককভাবে ইবাদতের উপযুক্ত-হকদার। তিনি নিখিল বিশ্বের পালনকর্তা, নিখিল বিশ্বের ইলাহ। আমরা তাঁর অনুমোদনকৃত ইবাদত পূর্ণ আনুগত্য-হীনতা, পরিপূর্ণ মুহববত-ভালবাসা এবং পূর্ণ ভক্তি শ্রদ্ধা সহকারে সম্পাদন করি।

আমরা আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে জানি ও বিশ্বাস করি, যেমনি করে তিনি তাঁর রুববিয়্যাত (প্রভূত্ব)-এর ক্ষেত্রে এক-অদ্বিতীয়, এতে তাঁর কোন শরীক নেই। অনুরূপভাবে উলুহিয়্যাত (উপাস্যত্ব)-এর ক্ষেত্রেও তিনি এক-অদ্বিতীয়, এতেও তাঁর কোন শরীক নেই। সুতরাং আমরা একমাত্র তাঁর ইবাদত করি এবং তিনি ভিন্ন সকল মা’বুদের ইবাদত পরিহার করি।

আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَإِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الرَّحْمَنُ الرَّحِيمُ ﴿163﴾ ( سورة البقرة : 163)

‘আর তোমাদের ইলাহ এক ইলাহ। তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনি অতি দয়াময়, পরম দয়ালু।’ [সূরা বাকারা : ১৬৩]

আল্লাহ তাআলা ব্যতীত সকল মা’বুদের উলুহিয়্যাত (উপাসনা) বাতিল, তাই তাদের ইবাদতও বাতিল।

ذَلِكَ بِأَنَّ اللَّهَ هُوَ الْحَقُّ وَأَنَّ مَا يَدْعُونَ مِنْ دُونِهِ هُوَ الْبَاطِلُ وَأَنَّ اللَّهَ هُوَ الْعَلِيُّ الْكَبِيرُ ﴿62﴾ ( سورة الحج : 62)

‘আর এটা এজন্য যে, নিশ্চয় আল্লাহই সত্য এবং তারা তাঁর পরিবর্তে যাকে আহবান করে অবশ্যই তা বাতিল। আর নিশ্চয় আল্লাহ তো সমুচ্চ, সুমহান।’ [সূরা হাজ্জ: ৬২।]

৪৭
(চার) আল্লাহ তাআলার নাম ও সিফাতের প্রতি বিশবাস স্থাপন :
আসমা ও সিফাতের প্রতি ঈমানের অর্থ হচ্ছে,

আল্লাহর তাআলার নির্ধারিত নাম ও সিফাতগুলোকে বুঝা-অনুধাবন করা, হিফজ করা, সাথে সাথে এগুলো একমাত্র আল্লাহ তাআলার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য মর্মে স্বীকৃতি প্রদান করা। এসবের মাধ্যমে তাঁর দাসত্ব প্রকাশ করা এবং তাদের চাহিদা মুতাবেক আমল করা। এতে করে আল্লাহ তাআলাকে বুঝা সম্ভব হবে। তাঁর প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি হবে, এবং তাঁর ইবাদতের প্রতি আগ্রহ জন্মাবে....

যেমন, তাঁর মহত্ব, বড়ত্ব, মহিমা, মর্যাদার গুণাবলি সম্পর্কে ধারণা থাকলে তাঁর সম্মান ও তার প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধায় মন ভরে যাবে।

তাঁর শক্তিমত্তা, ক্ষমতা ও প্রতাপের গুণাবলী সম্পর্কে জানা থাকলে অন্তরাত্মা বিনয়, নম্রতা ও স্বীয় পালনকর্তার সামনে হীনতায় পরিপূর্ণ হয়ে যাবে।

দয়া, বদান্যতা, উদারতা এবং দানশীলতার গুনাবলি সম্পর্কে জানা থাকলে আল্লাহর অনুগ্রহ-ইহসান, দান-দক্ষিনার প্রতি হৃদয়-মন আগ্রহান্বিত হবে।

জ্ঞান ও পরিবেষ্টন সম্পর্কীয় গুণাবলি সম্পর্কে ধারণা বান্দাকে তার নড়া-চড়া, চলা ফেরা বরং সকল কাজে স্বীয় রবের নজরদারি (মুরাকাবা)-কে আবশ্যিক করে। অর্থাৎ বান্দা যখন সকল কিছুকে পরিবেষ্টনকারী আল্লাহ তাআলার জ্ঞান সম্পর্কে ধারণা লাভ করবে তখন যে কোন কাজ করার পূর্বে তার মনে জেগে উঠবে যে আল্লাহ তাআলা দেখছেন, ফলে মন্দকাজ হলে বিরত থাকবে। আর ভাল কাজ হলে পূর্ণ আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে সম্পাদন করবে।

এ সকল গুণাবলি (সম্পর্কীয় জ্ঞান) বান্দাকে নিজ পালনকর্তাকে ভালবাসা, তাঁর প্রতি উৎসাহ, তাঁর সাথে সম্পর্ক স্থাপন, তার উপর তাওয়াক্কুল, এবং একমাত্র তাঁরই ইবাদতের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য অর্জন করতে বাধ্য করে।

যে সকল নাম ও গুণাবলি আল্লাহ তাআলা নিজের জন্যে অথবা তাঁর রাসূল তাঁর জন্যে প্রতিষ্ঠিত করেছেন আমরাও সেগুলো প্রতিষ্ঠিত করি। সেসবের উপর ঈমান রাখি, সেগুলো যে অর্থ ও নিদর্শনকে প্রমাণ করে সবগুলোর উপরও ঈমান রাখি-হৃদয় মন থেকে বিশ্বাস করি। যেমন আমরা বিশ্বাস করি যে আল্লাহ ‘‘রাহীম’’। এর অর্থ হচ্ছে তিনি দয়াশীল। আর এর প্রতিক্রিয়া হচ্ছে ‘তিনি যাকে ইচ্ছা, দয়া করেন’। অবশিষ্ট সকল নামের ক্ষেত্রেও একই বক্তব্য প্রযোজ্য। আমরা এগুলো বিকৃত, ক্রিয়াশূণ্য, (রূপক অর্থে গ্রহণ, এবং উপমা স্থির করি না। বরং তাঁর বক্তব্য-

ليسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ ﴿11﴾

‘‘কোন কিছুই তাঁর অনুরূপ নয়, তিনি দেখেন ও শুনেন।’’ (সূরা : শুরা- ১১) এর আলোকে তাঁর শানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করে প্রমাণ করি।

আমরা জানি ও বিশ্বাস করি আল্লাহ তাআলার অনেক সুন্দর সুন্দর নাম ও অনেক সুমহান সিফাত আছে। এ গুলোর সাহায্যে আমরা তাঁকে ডেকে থাকি।

১। আল্লাহ বলেন ,

وَلِلَّهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا وَذَرُوا الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي أَسْمَائِهِ سَيُجْزَوْنَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ ﴿180﴾ ( سورة الأعراف : 180)

‘আর আল্লাহর জন্যই রয়েছে সুন্দরতম নামসমূহ। সুতরাং তোমরা তাঁকে সেসব নামেই ডাক। আর তাদেরকে বর্জন কর যার তাঁর নামে বিকৃতি ঘটায়। তারা যা করত অচিরেই তাদেরকে তার প্রতিফল দেয়া হবে।’ [সূরা-আরাফ : ১৮০]

২।

وعن أبى هريرة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : إن لله تسعة وتسعين اسما مائة إلا واحدا من أحصاها دخل الجنة . متفق عليه

‘আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেন,। নিশ্চয় আল্লাহ তাআলার নিরানববই -এক কম একশত- নাম আছে। যে ব্যক্তি এগুলো সংরক্ষন করবে (অর্থাৎ এগুলো সম্পর্কে জানবে, বুঝবে, বিশ্বাস করবে এবং এর চাহিদানুযায়ী আমল করবে) সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। [(১) হাদীস বুখারী এবং মুসলিম উভয়ে বর্ণনা করেছেন। বুখারী হাদীস নং ৭৩৯২, মুসলিম হাদীস নং ২৬৭৭।]

৪৮
আসমাউল হুসনার বিবরণ
আল্লাহ তাআলার নামসমূহ তাঁর গুণাবলির উৎকর্ষতার প্রমাণ বহন করে। এগুলো সিফাত থেকে উৎকলিত। সুতরাং এগুলো একদিকে নাম আবার সিফাতও। আর এভাবেই হয়েছে সুন্দরতম। আল্লাহ তাআলার নাম ও গুণাবলি বিষয়ক জ্ঞানই সর্বাপেক্ষা মর্যাদাসম্পন্ন ও জরুরী জ্ঞান।

আল্লাহ তাআলার অনেক নাম, যার সঠিক সংখ্যা একমাত্র আল্লাহ তাআলাই জানেন। তার মধ্য হতে কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত কিছু নাম আমরা এখানে উল্লেখ করার প্রয়াস পাব-

الله (আল্লাহ): আর তিনি হচ্ছেন মাবূদ-উপাস্য, সমস্ত মাখলুকাত যাকে মা’বূদ হিসেবে গ্রহণ করেছে। সকলেই যাকে মহববত করে, সম্মান ও শ্রদ্ধা করে, অনুগত হয়, নিজেদের নানা প্রয়োজনে তাঁর শরণাপন্ন হয়।

الرحمن الرحيم (রহমান, রাহীম): যার রহমত ও অনুগ্রহ সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে আছে। الملك (মালিক): যিনি কুলমাখলূকাতের মালিক- বাদশাহ। المالك (মালেক) যিনি রাজা-প্রজাসহ পূর্ণ রাজত্বের মালিক। المليك (মালীক) স্বীয় রাজত্বে নিজ নির্দেশ বাস্তবায়নকারী। তাঁর হাতেই রাজত্ব। যাকে ইচ্ছাব দান করেন। আবার যার থেকে ইচ্ছা ছিনিয়ে নেন।

القدوس (কুদ্দুস): দোষ-ত্রুটি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র। পূর্ণতার গুণে গুণান্বিত।

الســلام (সালাম): যিনি সকল প্রকার দোষ-ত্রুটি ও বিপদাপদ থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ ও মুক্ত।

المؤمن (মু’মিন): যিনি সৃষ্টিকুলের উপর অন্যায়-অবিচার করবেন না মর্মে সৃষ্টিকুল নিরাপত্তা বোধ করে। শান্তি ও নিরাপত্তা সৃষ্টি করেছেন এবং স্বীয় বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা এর মাধ্যমে অনুগ্রহ করেন।

المهيمن (মুহাইমিন/ তত্ত্বাবধায়ক): স্বীয় সৃষ্টিকুল কর্তৃক সংঘটিত সকল বিষয় প্রত্যক্ষকারী। কোন কিছুই তাঁর কাছে লুকায়িত থাকে না।

العزيز (আযীয/ প্রবল পরাক্রান্ত) এমন সত্ত্বা যে, সকল প্রভাব, শক্তি ও মর্যাদা তাঁরই। এমন পরাক্রমশালী যিনি কখনো পরাভূত হন না, এমন শক্তিশালী যে, সকল সৃষ্টি তাঁর অনুগত্য মেনে নিয়েছে।

الجبار (জাববার/ প্রতাপশালী): স্বীয় সৃষ্টির উপর প্রাধান্য বিস্তারকারী। নিজ ইচ্ছা বাস্তবায়নে তাদের পরাস্ত-পরাভূতকারী। মহা প্রতাপশালী, মর্যাদা ও বড়ত্বের অধিকারী, যিনি সর্বাবস্থায় নিজ বান্দাদের পর্যবেক্ষন করেন এবং তাদের অবস্থা ও অবস্থানকে সংশোধন ও উন্নত করেন।

المتكبر (মুতাকাবিবর/ পরম মহিমান্বিত): যিনি সৃষ্টির গুণাবলির উর্দ্ধে। মহান-কোন কিছুই তাঁর মত নয়। যিনি সকল প্রকার অন্যায়-অবিচার মুক্ত।

الكبير (কাবীর/ বড়ত্বের অধিকারী-মহান): যিনি ব্যতীত সকল কিছু ছোট। নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডলে বড়ত্ব ও মহিমা একমাত্র তারই। গর্ব-অহঙ্কার করা একমাত্র তাঁকেই মানায়।

الخالق (খালেক/ সৃষ্টিকর্তা): পূর্ব দৃষ্টান্ত ব্যতীত যিনি সকল সৃষ্টির সৃষ্টিকর্তা।

الخلاق (খাল্লাক) যিনি সৃষ্টি করেছেন, এবং আপন ক্ষমতায় সবকিছু সৃষ্টি করেন।

البارئ (বারী/ উদ্ভাবক): যিনি সৃষ্টিকুল- সৃষ্টি করেছেন। নিজ ক্ষমতায় তাদের অস্তিত্বে এনেছেন। এক সৃষ্টি থেকে অপর সৃষ্টিকে স্বাতন্ত্র দিয়েছেন। এবং প্রত্যেককে অপর থেকে আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছেন।

المصور (মুসাওবির/ রূপদাতা): যিনি নিজ সৃষ্টিকে ছোট-বড়, দীর্ঘ-খর্বসহ বিভিন্ন আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন।

الوهاب (ওয়াহ্হাব/ মহানদাতা): যিনি সার্বক্ষনিকভাবে বিভিন্ন নিয়ামত ও দান-দক্ষিনা চালিয়ে যান।

الرزاق (রায্যাক/ রিযিকদাতা): যার প্রদত্ত রিযিক কুল মাখলুকাতকে পরিবেষ্টন করে আছে।

الرازق (রাযিক/ জীবনোপকরণ ব্যবস্থাকারী): যিনি জীবনোপকরণ সৃষ্টি করেছেন এবং নিজ সৃষ্টি পর্যন্ত তা পৌঁছিয়ে থাকেন।

الغفور الغفار (গাফুর গাফ্ফার/ মহা ক্ষমাশীল): যিনি ক্ষমা, মার্জনা ও মাফ করায় প্রসিদ্ধ।

الغافر (গাফের/ পাপ গোপনকারী): নিজ বান্দার পাপারাজী গোপনকারী।

القاهر (কাহের/ পরাক্রমশালী): মহান, স্বীয় বান্দাদের উপর প্রবল-পরাক্রান্ত। সকল মাথা যার সামনে অবনত, সকল প্রভাবশালী যেখানে হীন-অপদস্থ।

القهار (কাহহার/ প্রবল পরাক্রান্ত): নিজ ইচ্ছার কাছে যিনি সকল মাখলূককে বশীভূত করে আছেন। তিনি পরাক্রান্ত আর তিনি ব্যতীত সবকিছু পরাভূত।

الفتاح (ফাত্তাহ/ কল্যাণের দ্বার উন্মুক্তকারী): যিনি স্বীয় বান্দাদের মাঝে হক ও ইনসাফপূর্ণ বিচার করেন। তাদের নিমিত্তে রহমত ও জীবনোপকরণের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত করেন। মুমিন বান্দাদের সাহায্যকারী। গায়েব ও অদৃশ্যের (চাবি কাঠির) জ্ঞানের ক্ষেত্রে যিনি এক ও অদ্বিতীয়।

العليم (আলীম/ মহাজ্ঞানী-সর্বজ্ঞাত): যার নিকট কোন কিছুই অস্পষ্ট বা লুকায়িত নয়। যিনি গোপন, অস্পষ্ট, বাহির, ভিতর, কথা, কাজ, দৃশ্য-অদৃশ্য সবকিছু সম্পর্কে জ্ঞাত। গায়েব সম্পর্কে একমাত্র ও সর্বাধিক পরিজ্ঞাত।

المجيد (মাজিদ/ মহামহিম): স্বীয় কর্মে যিনি মহিমান্বিত হয়েছেন। তাঁর সৃষ্টিকুল তাঁকে তাঁর বড়ত্ব ও মর্যাদার কারণে মহিমান্বিত করেছে। সুতরাং তিনি আপন মর্যাদা, বড়ত্ব ও অনুগ্রহের কারণে প্রশংসিত।

الرب (রব/প্রতিপালক): একচ্ছত্র অধিপতি, কর্তৃত্বকারী, অভিভাবকদের প্রতিপালক, সৃষ্টিকুলের অধিপতি, যিনি নিজ সৃষ্টিকে প্রতিপালন করেন। দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের যাবতীয় প্রয়োজন পূর্ণ করেন, তিনি ভিন্ন সত্যিকার উপাস্য নেই এবং তিনি ব্যতীত প্রকৃত অর্থে কোন প্রতিপালক নেই।

العظيم (আজীম/ মহামহিম-মর্যাদাশীল): স্বীয় রাজত্ব ও ক্ষমতায় বড়ত্ব ও মর্যাদার অধিকারী।

الواسع (ওয়াসে’ / সর্বব্যাপী): যার রহমত- অনুগ্রহ সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে আছে, এবং তাঁর রিযিক সকল সৃষ্টিকুল পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত। সীমাহীন দীর্ঘপরিধি বিশিষ্ট, বিস্তৃত রাজত্ব- কর্তৃত্ব ও মর্যাদার অধিকারী। ব্যাপক অনুগ্রহ-ইহসানের মালিক।

الكريم (কারীম/ দয়াময়- পরমদাতা): মহা মর্যাদার অধিকারী, অবিরাম- নিরবচ্ছিন্ন অধিক কল্যাণময়। যাবতীয় দোষ-ত্রুটি মুক্ত।

الأكرم (আল-আকরাম): যার দান ও অনুগ্রহ সকলকে শামিল করে আছে।

الودود (আল ওয়াদুদু/পরম স্নেহ পরায়ণ): যিনি ভালবাসেন যারা তাঁর আনুগত্য করে এবং তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করে। তাদের প্রশংসা করেন। তাদের ও অন্যদের প্রতি অনুগ্রহ করেন।

المقيت (আল্ মুক্বীত/ মহান খাদ্যদাতা): সকল বস্ত্ত সংরক্ষণকারী, সকল বস্ত্ত পর্যবেক্ষনকারী, সৃষ্টি কুলের খাদ্য-খোরাক দানকারী।

الشكور (শাকূর) যিনি নেক কাজ বহু গুনে বৃদ্ধি করে দেন, আর বদ কাজ মিটিয়ে দেন।

الشاكر (শাকের): যিনি সামান্য ইবাদতেই সন্তুষ্ট হয়ে যান। নেক কাজের পুরস্কার অনেক বড় করে দান করেন। বেশি বেশি নেয়ামত দান করেন এবং সামান্য শুকরগোযারিতেই খুশী হয়ে যান।

اللطيف (লতীফ/ সুক্ষ্ম দর্শী-দয়ালু): যার নিকট কোন কিছুই গোপন থাকে না। নিজ বান্দাদের প্রতি অধিক দানশীল-দয়ালু। এমনভাবে অনুগ্রহ করেন যে, তারা নিজেরাও জানে না। এমন সুক্ষ্ম, যাকে কোন চক্ষু নাগাল পায় না।

الحليم (হালীম/ মহা ধৈর্যশীল-অতি সহিষ্ণু): যিনি স্বীয় বান্দাদের গুনাহর কারণে খুব তাড়াহুড়া করে শাস্তি প্রয়োগ করেন না। বরং সুযোগ দান করেন যাতে তারা তাওবা করে সংশোধন হয়ে যেতে পারে।

الخبير (খাবীর/ মহাবিজ্ঞ, সর্বজ্ঞ): যার নিকট স্বীয় সৃষ্টিকুলের ছোট-বড়, দৃশ্য-অদৃশ্য, স্থীর-চলমান, সবাক-নির্বাক সবকিছুই পরিস্কার কোন কিছুই গোপন ও অস্পষ্ট নয়।

الحفيظ (হাফীয/ মহা সংরক্ষণকারী): যিনি আপন সৃষ্টিকৃত সবকিছুকে সংরক্ষণ করেন। যার জ্ঞান সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে আছে।

الحافظ (হাফিয/ হিফাযত কারী) যিনি বান্দাদের আমল সংরক্ষণ করেন এবং নিজ ওলীদের পাপ-পঙ্কিলতায় পতিত হওয়া থেকে রক্ষা করেন।

الرقيب (রাক্বীব): মহা পর্যবেক্ষনকারী যিনি নিজ বান্দাদের সর্বাবস্থা পর্যবেক্ষন করেন। এবং সংরক্ষণকারী, যা সংরক্ষণ করেন তা থেকে অদৃশ্য হন না।

السميع (সামী’/ সর্বশ্রোতা): যিনি সব আওয়াজ শুনেন। যার শ্রবন সকল আওয়াজকে পরিবেষ্টন করে আছে। ভাষা, স্বর, আঙ্গিক, ধরণ ইত্যাদির বিভিন্নতা সত্ত্বেও তাঁর শ্রবনে হেরফের হয় না এবং বিরতও করা যায় না। তাঁর নিকট গোপন- প্রকাশ্য, দূর-নিকটবর্তী সবই বরাবর। নিকট থেকে যে রূপ শুনেন দূর থেকেও সেরূপই শুনে।

البصير (বাসীর/ সর্বদ্রষ্টা): যিনি সব কিছু দেখেন। বান্দার প্রয়োজন ও কর্ম, কে হেদায়াত পাওয়ার উপযুক্ত আর কে গোমরাহীর উপযুক্ত সব কিছু সম্পর্কে সম্যকজ্ঞাত। কোন কিছুই তার অগোচরে নয়। কোন কিছুই তাঁর দৃষ্টি ও ধারণার বাইরে যেতে পারে না।

العلي الأعلى المتعال (আল আলিয়ুল আ’লা আল মুতাআল/ সর্বোচ্চ, মহত্তম, মহিয়ান): উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন, মহত্তের অধিকারী। জল, স্থল, আকাশ-যমীন বরং সমগ্র পৃথিবীর যাবতীয় বস্ত্ত তাঁর কর্তৃত্ব ও রাজত্বের অধীন। তিনি মহান, তাঁর চেয়ে বড় কেউ নেই। উচ্চতর, তাঁর উপরে কেউ নেই। অতিমর্যাদা সম্পন্ন, তাঁর চেয়ে মর্যাদাবান আর কেউ নেই।

الحكيم (হাকীম/ প্রজ্ঞাময়, মহাজ্ঞানী): যিনি প্রতিটি জিনিস প্রজ্ঞা ও ইনসাফের সাথে যথাস্থানে প্রয়োগ করেন। নিজ কর্ম-কথায় প্রজ্ঞাবান-বিচক্ষণ।

الحكم الحاكم (আল-হাকাম আল হাকিম/ শাসন কর্তা): ন্যায় ভিত্তিক শাসন কর্তা- যার নিকট ন্যায় পরায়ণতা নিরাপদ। সুতরাং তিনি অন্যায়- অবিচার করেন না। কারো প্রতি যুলুম করেন না।

القيــوم (আল কায়ূম/ অবিনশ্বর সত্তা): স্বয়ংসম্পূর্ণ, কারো মুখাপেক্ষী নন। অপরকে প্রতিষ্ঠা ও অস্তিত্বে আনয়নকারী, সকল সৃষ্টিকুলের পরিচালনা, পর্যবেক্ষন ও ব্যবস্থাপনায় অবিরত। তাঁকে নিদ্রা ও তন্দ্রা আচ্ছন্ন স্পর্শ করতে পারে না।

الواحد الأحد (আল ওয়াহেদ আল আহাদ/ একক সত্ত্বা): যিনি সার্বিক উৎকর্ষ ও পরিপূর্ণতায় এক ও অদ্বিতীয়, এতে তাঁর কোন শরীক নেই।

الحي (আল হাই/ চিরঞ্জীব): অবিনশ্বর-চিরঞ্জীব, ক্ষয়-বিনাশ-মৃত্যু যাকে স্পর্শ ও অতিক্রম করতে পারে না।

الحاسب الحسيب (হাসেব, হাসীব/ পরম পর্যাপ্ত): নিজ বান্দাদের জন্যে যথেষ্ট, উপযুক্ত। তিনি ব্যতীত তাদের উপায়-অবলম্বন নেই। বান্দাদের তত্ত্বাবধায়ক।

الشهيد (শাহীদ/ সর্বত্র উপস্থিত, মহাসাক্ষী): যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে অবগত। যাঁর জ্ঞান সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে আছে। যিনি বান্দাদের কর্মানুযায়ী পক্ষে-বিপক্ষে সাক্ষ্য দেবেন।

القوي المتين (আল কাভিয়্যূ আল মাতীন/ সর্বশক্তিমান): পরিপূর্ণ শক্তিধর, যাকে অনেক শক্তিশালী বিজয়ীও পরাজিত করতে পারে না। পলায়নকারী তাঁকে এড়িয়ে যেতে পারে না। মহা শক্তিমান, যার শক্তি বিচ্ছিন্ন ও নিঃশেষ হয় না।

الولي (আল-ওয়ালী/ সর্বময় কর্তা): পরিচালনাকারী।

المولى (আল-মাওলা/ মহা প্রভু): মুমিন বান্দাদের মুহাববতকারী, সাহায্য-সহায়তা দানকারী।

الحميد (আল-হামীদ/ প্রশংসিত): যিনি প্রশংসা পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন, এবং যিনি নিজ নাম, সিফাত, কর্ম, কথা, অনুগ্রহ, সিদ্ধান্ত, শরীয়ত প্রবর্তন ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রশংসিত।

الصمد (সামাদ/ অমুখাপেক্ষী) যিনি বড়ত্ব, নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব ও বদান্যতায় উৎকর্ষে পৌঁছে আছেন এবং যাবতীয় প্রয়োজনে যার আশ্রয় নেয়া হয়।

القدير القادر المقتدر (আল ক্বাদীর, কাদের, মুক্বতাদির/ মহাশক্তিধর ও সর্বশক্তিমান): পরিপূর্ণ শক্তির অধিকারী, যাকে কেউ পরাভূত করতে পারে না, এবং যাকে কোন কিছু এড়িয়ে যেতে পারে না এবং যার শক্তি ও ক্ষমতা পরিপূর্ণ চিরন্তন ও সর্বব্যাপী।

الوكيل (ওয়াকীল/ দায়িত্বশীল): সমগ্র সৃষ্টিকুলের সার্বিক বিষয়াবলীর পরিচালনা ও পর্যবেক্ষনকারী-কার্য নির্বাহী।

الكفيل (আল কাফীল/ জিম্মাদার- অভিভাবক): সকল বস্ত্তর সংরক্ষণকারী, প্রত্যেক ব্যক্তির রক্ষনাবেক্ষণ ও পর্যবেক্ষণকারী, সমস্ত সৃষ্টি কুলের রিযিক ও তাদের সার্থ রক্ষার জিম্মাদার।

الغني (আল গনী/ বেনিয়ায, অমুখাপেক্ষী): যিনি সৃষ্টিকুল থেকে সম্পূর্ণরূপে অমুখাপেক্ষী, কারো নিকট কোনভাবেই তার কোন প্রয়োজন হয় না।

الحق المبين (আল হক্ব আল মুবীন/ সত্য-সুস্পষ্টকারী): যার অস্তিত্ব ও বিদ্যমানতায় বিন্দু পরিমান সন্দেহ-সংশয় নেই। যিনি সৃষ্টিকুলের নিকট অস্পষ্ট নন।

المبين যিনি সৃষ্টিকুলের নিকট দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতে মুক্তি ও পরিত্রাণের পথ পরিস্কার করে দিয়েছেন।

النور (আল-নূর/ আলো): যিনি আকাশ-যমীন আলোকিত করেছেন এবং মুমিনদের অন্তরাত্মা স্বীয় মারেফাত ও ঈমান দ্বারা আলোকোজ্জল করেছেন।

ذوالجلال والإكرام (যুল জালালি ওয়াল ইকরাম/ সম্মান ও মহত্বের অধিকারী): যিনি এ অধিকার রাখেন যে, তাঁকে ভক্তি-শ্রদ্ধা ও ভয় করা হবে এবং এককভাবে তাঁরই প্রশংসা করা হবে। বড়ত্ব ও সম্মানের অধিকারী, দয়া ও অনুগ্রহশীল।

البر (আল-বারর/ ন্যায়পরায়ণ- দানশীল): নিজ বান্দাদের প্রতি দয়া ও সহানুভূতিশীল। তাদের অকাতরে দয়া-দক্ষিণা করেন।

التواب (আততাওয়াবু/ তওবা কবুলকারী-ক্ষমাশীল): যিনি তওবাকারীদের তওবা কবুল করেন। পাপীদের গুনাহ মার্জনা করেন, যিনি তাওবা সৃষ্টি করেছেন এবং নিজ বান্দাদের থেকে তা কবুলও করেছেন।

العفو (আল-আফুভু/ মার্জনাকারী): যার ক্ষমা ও মার্জনা বান্দা কর্তৃক সংঘটিত যাবতীয় গুনাহকে পরিবেষ্টন করে। বিশেষ করে বান্দা যদি তওবা ও ইস্তিগফার করে।

الرؤوف (আল-রউফ/ অতীব দয়ালু- অনুগ্রহশীল): অনুগ্রহ ও করুনাশীল, সর্বোচ্চ পর্যায়ের রহমত ও দয়াশীলকে রউফ বলা হয়।

الأول (আল-আউয়ালু/ আদি): অনাদি যার পূর্বে কিছু নেই। الآخر (আল-আখের) অনন্ত যার পরে কিছু নেই। الظاهر (আল-যাহের) যার উপর কিছু নেই। الباطن (আল-বাতেন) যাকে বাদ দিয়ে কিছু নেই।

الوارث (আল-ওয়ারেছ) : সৃষ্টিকুল ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে যাওয়ার পরও যিনি অবশিষ্ট থাকবেন। প্রত্যেক বস্ত্তর গন্তব্য ও প্রত্যাবর্তনস্থল তিনিই। চিরঞ্জীব যার মৃত্যু নেই।

المحيط (আল-মুহীতু/ পূর্নাঙ্গরূপে অবহিত-নিয়ন্ত্রণকারী) যার শক্তি-সামর্থ সমগ্র সৃষ্টিকুলকে পরিবেষ্টন করে আছে। তাঁকে এড়িয়ে চলা বা তাঁর থেকে ভেগে যাওয়ার শক্তি বা সুযোগ কারো নেই। তিনি জ্ঞানের দিক থেকে সবকিছু পরিবেষ্টন করে আছেন। এবং গুনে গুনে সবকিছু সংরক্ষণ করেছেন।

القريب (আল কারীব/ অতি নিকটবর্তী): যিনি সকলের নিকটবর্তী। নিকটবর্তী তাঁকে আহবান কারীর এবং সকল প্রকার ইবাদত-আনুগত্যের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য প্রত্যাশীর।

الهادي (আল-হাদী/ পথ প্রদর্শক): যিনি সৃষ্টিকুলকে তাদের কল্যাণের দিকে পথ প্রদর্শন করেন। স্বীয় বান্দাদের হেদায়াত (সঠিক পথ প্রদর্শন): কারী। তাদের জন্যে বাতিল- অসত্য থেকে হক্ব ও সত্যের পথ সুস্পষ্টকারী।

البديع (আল-বাদী/ নব আবিস্কর্তা- প্রবর্তক): যার কোন সদৃশ ও সমকক্ষ নেই, যিনি সকল সৃষ্টি পূর্ব দৃষ্টান্ত ব্যতীতই সৃজন করেছেন।

الفاطر (আল-ফাতির/ মহান সৃষ্টিকর্তা): যিনি সমগ্র সৃষ্টিকুল সৃজন করেছেন। নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডলকে অস্তিত্বহীন থেকে অস্তিত্বে এনেছেন। এদেরকে সৃষ্টি করেছেন।

الكافي (আল-কাফী/ যথেষ্ট ও প্রয়োজনমুক্ত): যিনি বান্দাদের সকল প্রয়োজন যথেষ্ট করে দিয়েছেন। সকল প্রয়োজন পর্যাপ্ত পরিমাণে মিটিয়ে দিয়েছেন।

الغالب (আল-গালিব/ মহা প্রভাবশালী-বিজয়ী): চিরন্তন অপ্রতিরোধ্য-পরাক্রমশালী। প্রত্যেক তালিবের ক্ষেত্রে বিজয়ী- প্রাধান্য বিস্তারকারী। তাঁর সিদ্ধান্ত রদ করার ক্ষমতা কারো নেই। তিনি যা কার্যকর করেছেন তা বাধা দেয়ার কেউ নেই। তাঁর ফয়সালা ও সিদ্ধান্ত খন্ডনকারী কেউ নেই। এবং তাঁর বিচার অগ্রাহ্যকারী কেউ নেই।

الناصر النصير (আল-নাসের আল নাসীর/ সাহয্য কারী, মহারক্ষক): যিনি নিজ রাসূলবৃন্দ ও তাদের অনুসারীদেরকে শত্রুর বিরুদ্ধে সাহায্য করেন। সাহায্য-সহায়তা একমাত্র তাঁর হাতেই। এতে তাঁর কোন শরীক নেই।

المستعان (আল-মুসতা‘আন/ সাহায্য প্রার্থনাস্থল): যিনি কখনো কারো নিকট সাহায্য-সহযোগিতা চান না। বরং তাঁর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা হয়। তাঁর নিকট শত্রু-মিত্র উভয়ই প্রার্থনা করে-সাহায্য চায়। এরা-ওরা সকলেই হাত বাড়ায়।

ذوالمعارج (যুলমাআরিজ/ সমুন্নত মর্তবার অধিকারী): যার দিকে রূহুল আমীন- জিবরাঈলসহ সকল ফেরেশতা উর্ধ্বগামী হয়। এবং যার দিকে উৎকৃষ্ট কথা ও নেক কর্মসমূহ উঠে।

ذوالطول (যুত তাওল/ মহা অনুগ্রহশীল, অতীব দানবীর): যিনি অনুগ্রহ, নিয়ামত, দান- দক্ষিণা স্বীয় সৃষ্টিকুলের নিমিত্তে ছড়িয়ে দেন। এগুলোর দার উন্মুক্ত কর দেন।

ذوالفضل (যুল ফাদলি/ সুউচ্চ মর্যাদার অধিকারী): যিনি সকল কিছুর মালিক ও কর্তৃত্বশীল, নানাবিধ নিয়ামাতরাজী দ্বারা বান্দাদের অনুগ্রহ করেন।

الرفيق (রাফীক/ সহানুভূতিশীল বন্ধু): যিনি দয়া, সহানুভূতি এবং সহানুভূতিশীলদের পছন্দ করেন, ভালবাসেন। বান্দাদের প্রতি অতি দয়ালু, অতিশয় মেহেরবান।

الجميل (আল-জামীল/ খুব সুন্দর): তিনি স্বীয় সত্তা, নাম, গুণাবলি ও কর্ম- সর্বক্ষেত্রে খুব সুন্দর এবং চমৎকার।

الطيب (আত্-তাইয়্যিবু/ ভাল-উৎকৃষ্ট): যাবতীয় দোষ-ত্রুটি হতে মুক্ত পবিত্র।

الشافي (আশ-শাফী/ আরোগ্য ও পরিত্রাণ দানকারী): সকল বিপদ-মুসীবত, রোগ-ব্যাধি হতে তিনিই আরোগ্য দান কারী, এতে তাঁর কোন শরীক নেই।

السبوح (আস-সুববুহ/ মহিমাময়): যিনি সকল প্রকার দোষ-ত্রুটি মুক্ত। সাত আকাশ, সাত যমীন ও এতদ্ভোয়ের মধ্যে যা কিছু আছে সকলেই তাঁর গুণ-কীর্তন এবং মহিমা বর্ণনা করে। প্রত্যেক বস্ত্ত তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করে তাঁর প্রশংসা করে।

الوتر (আল-ভিতরু/ বেজোড়-একক): যার কোন শরীক, সমকক্ষ ও প্রতিপক্ষ নেই। তিনি বেজোড়। বেজোড় সংখ্যক আমল ও ইবাদত পছন্দ করেন।

الديان (আদ্-দাইয়ান/ মহা বিচারক): যিনি বান্দাদের হিসাব নিয়ে প্রতিদান প্রদান করেন। কিয়ামতের দিন যিনি বান্দাদের মাঝে বিচার-পরিচালনা করবেন।

المقدم والمؤخر (আল-মুকাদ্দিম-আল-মুআখখির/ অগ্রসর ও পিছনে আনয়নকারী) : যাকে ইচ্ছা অগ্রসর করেন আবার যাকে ইচ্ছা পিছিয়ে দেন। যাকে ইচ্ছা উঠিয়ে দেন (সম্মানিত করেন) আবার যাকে ইচ্ছা নিচে নামিয়ে দেন। (অপমানিত করেন)

الحنان (আল-হান্নান/ অধিক দয়ালু): বান্দাদের প্রতি অতি দয়ালু, মহাঅনুগ্রহশীল। সৎকর্মশীলদের সম্মানিত করেন। পাপীদের ক্ষমা করেন।

المنان (আল-মান্নান/ অধিক উপকারী, পরম করুনাময়) : প্রার্থনা করার পূর্বেই যিনি অনুগ্রহ শুরু করে দেন। অধিক দাতা- যার দানের সীমা-পরিসীমা নেই। নিজ বান্দাদের সকল প্রকার দান ও অনুগ্রহ করেন। নানাবিধ নিয়ামত ও রিযিক প্রদান করার মাধ্যমে করুনা করেন।

القابض (আল-ক্বাবেয/ কবজাকারী): যিনি স্বীয় ইহসান-অনুগ্রহ, দান-দয়া কারো কারো কাছ থেকে ইচ্ছানুযায়ী গুটিয়ে নেন।

الباسط (আল-বাসেত/ বিস্তৃতকারী): যিনি স্বীয় অনুগ্রহ ছড়িয়ে দেন। নিজ বান্দাদের মাঝে যাকে ইচ্ছা প্রদত্ব রিযিক আরোও বিস্তৃত করে দেন। অর্থাৎ বাড়িয়ে দেন।

الحيي الستير (আল হায়িয়্যূ-আল সিত্তীরু/ পরম লজ্জাশীল-বান্দার দোষ গোপনকারী):

যিনি বান্দাদের মধ্যে লজ্জাবান ও পরদোষ গোপনকারীদের পছন্দ করেন-ভালবাসেন। তাদের দোষ-ত্রুটি ও অন্যায়-অপরাধ গোপন করে রাখেন।

الســيد (আস-সাইয়্যিদ/ মহান নেতা): যিনি নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব, মর্যাদা, শক্তি-সামর্থ, বরং সকল গুণাবলিতে উৎকর্ষ সাধন করেছেন। সর্বোচ্চ পর্যায়ে আরোহন করেছেন।

المحــسن (আল-মুহসিন/ মহান দাতা): যিনি সমগ্র সৃষ্টিকে দয়া-অনুগ্রহ ও দানের মাঝে ডুবিয়ে রেখেছেন।

৪৯
ঈমান বৃদ্ধি
মহান আল্লাহর উপর ঈমান, দ্বীনের মূলভিত্তি। তাঁর উপর, তাঁর নাম ও গুণাবলি, কর্মাবলি, ভান্ডারাদি, প্রতিশ্রুতি এবং তাঁর হুমকি ও ভীতিপ্রদর্শনের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা। যাবতীয় নেকআমল ও সর্ব প্রকার ইবাদত ভিত্তিশীল ও কবুল হওয়া নির্ভর করে উক্ত মূলভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার উপর। আর যদি উক্ত ঈমান ও বিশ্বাস দুর্বল ও ত্রুটিযুক্ত হয়, তাহলে আমল ও ইবাদতও দুর্বল-নড়বড়ে হবে। ফলশ্রুতিতে পরিস্থিতি মারাত্মক খারাপ হয়ে যাবে।

৫০
আমাদের জীবনে উক্ত ঈমান প্রতিষ্ঠিত ও ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে হলে, নিম্নোক্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে গভীর ধারণা রাখতে হবে।
(এক) আমাদের জানা ও বিশ্বাস রাখা যে, পৃথিবীর দৃশ্যমান বা লুকায়িত, ছোট কিংবা বড় সকলকিছুর স্রষ্টা হচ্ছেন আল্লাহ তাআলা। আকাশসমূহের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ। যমীন সমূহের সৃষ্টিকর্তা সে আল্লাহ তাআলাই। আরশে আজীমের সৃষ্টিকর্তাও আল্লাহ গ্রহ-নক্ষত্রের সৃষ্টিকর্তাও তিনিই। পাহাড়, সমুদ্রের স্রষ্টাও তিনিই। মানুষ, জীব-জন্তু, উদ্ভিত-তরুলতার স্রষ্টাও মহান আল্লাহ। জান্নাতের সৃষ্টিকর্তাও সে আল্লাহ তাআলাই। জাহান্নামের সৃষ্টিকর্তাও তিনিই।

اللَّهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ وَكِيلٌ ﴿62﴾ ( الزمر : 62)

আল্লাহ সব কিছুর স্রষ্টা এবং তিনিই সব কিছুর তত্ত্বাবধায়ক। [সূরা যুমার : ৬২।]

আমরা এ বিষয়গুলো সম্পর্কে বলব-আলোচনা করব, শুনব, এগুলো নিয়ে গবেষণা করব এবং জাগতিক ও কুরআনী নিদর্শনাবলির দিকে চিন্তা ও শিক্ষাগ্রহণের দৃষ্টিতে লক্ষ্য করব। এতে আমাদের হৃদয়ে ঈমান প্রগাঢ় হয়ে বসবে, মজবুত হবে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা আমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন।

(১) আল্লাহ বলেন:

قُلِ انْظُرُوا مَاذَا فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا تُغْنِي الْآَيَاتُ وَالنُّذُرُ عَنْ قَوْمٍ لَا يُؤْمِنُونَ . سورة يونــس : 101)

বল, ‘আসমানসমূহ ও যমীনে কী আছে তা তাকিয়ে দেখ। আর নির্দশনসমূহ ও সতর্ককারীগণ এমন কওমের কাজে আসে না, যারা ঈমান আনে না’। [সূরা ইউনুস : ১০১।]

(২) আল্লাহ তাআলা আরও বলেন :

أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآَنَ أَمْ عَلَى قُلُوبٍ أَقْفَالُهَا . سورة محمد : 24)

তবে কি তারা কোরআন সম্বন্ধে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে না? নাকি তাদের অন্তরসমূহে তালা রয়েছে? [সূরা মুহাম্মদ: ২৪।]

(৩) অন্যত্র ইরশাদ করেন:

وَإِذَا مَا أُنْزِلَتْ سُورَةٌ فَمِنْهُمْ مَنْ يَقُولُ أَيُّكُمْ زَادَتْهُ هَذِهِ إِيمَانًا فَأَمَّا الَّذِينَ آَمَنُوا فَزَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَهُمْ يَسْتَبْشِرُونَ ﴿124﴾ ( سورة التوبة : 124)

আর যখনই কোন সূরা নাযিল করা হয়, তখন তাদের কেউ কেউ বলে, ‘এটি তোমাদের কার ঈমান বৃদ্ধি করল’? অতএব যারা মুমিন নিশ্চয় তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করেছে এবং তারা আনন্দিত হয়। [সূরা তাওবা:১২৪।]

(দুই) আমাদের জানা ও বিশ্বাস করা প্রয়োজন যে, মহান স্রষ্টা আললাহ তাআলা এ বিশ্বজগত ও সৃষ্টিকুল সৃজন করেছেন এবং তাতে নিদর্শন ও প্রভাব রেখে দিয়েছেন। তিনি চক্ষু সৃষ্টি করেছেন এবং তাতে রেখে দিয়েছেন নিদর্শন, আর তা হচ্ছে দৃষ্টি শক্তি। কান সৃষ্টি করেছেন এবং তাতে সৃজন করেছেন নিদর্শন, আর তা হচ্ছে শ্রুতি বা শ্রবন শক্তি। জিহবা সৃষ্টি করেছেন আর তাতে সৃষ্টি করেছেন নিদর্শন, আর সেটি হচ্ছে, কথা। সূর্য সৃষ্টি করেছেন এবং তাতে সৃষ্টি করেছেন নিদর্শন, আর সেটি হচ্ছে আলো। অগ্নি সৃষ্টি করেছেন আর তাতে সৃজন করেছেন নিদর্শন, আর তা হচ্ছে দাহন। বৃক্ষ সৃষ্টি করেছেন, সাথে সৃষ্টি করেছেন নিদর্শন। সেটি হচ্ছে ফল। এরূপ সকল সৃষ্টিতেই কোন না কোন নিদর্শন রেখেছেন।

(তিন) আমাদের জানা ও বিশ্বাস করা যে, যিনি সমগ্র সৃষ্টিকুলের উপর কর্তৃত্ব করেন এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করেন, তিনি হচ্ছেন একক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ। যার কোন সমকক্ষ ও অংশীদার নেই। আকাশসমূহ ও যমীনে যত সৃষ্টি আছে। ছোট কিংবা বড় প্রত্যেকেই আল্লাহর গোলাম ও তাঁর মুখাপেক্ষী। তারা নিজেরা নিজেদের উপকার, ক্ষতি কিংবা সাহায্যের ক্ষমতা রাখে না। নিজেদের জীবন, মরণ ও পুনরুত্থানের ক্ষমতাও রাখে না। আল্লাহ তাআলাই তাদের মালিক ও তাদের উপর কর্তৃত্বশীল। তারা সকলেই তাঁর মুখোপেক্ষী, তিনি তাদের থেকে সম্পূর্ণরূপে প্রয়োজন মুক্ত। আল্লাহ তাআলা সমগ্র বিশ্বজগত পরিচালনা করেন এবং সৃষ্টিকুলের যাবতীয় বিষয়াদি পর্যবেক্ষন ও নিয়ন্ত্রণ করেন। সুতরাং যিনি আকাশ ও যমীনে কর্তৃত্ব করেন। কর্তৃত্ব করেন পানি ও সমুদ্রে, অগ্নি ও বাতাসে, জীব ও উদ্ভিদে, গ্রহ-নক্ষত্র ও জড় পদার্থে, শাসক ও শাসিতের মাঝে, নেতা ও মন্ত্রীবর্গের মাঝে, ধনী ও দরিদ্রদের মধ্যে, দুর্বল ও শক্তিশালীদের মাঝে , তিনি হচ্ছেন এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ তাআলা।

আল্লাহ তাআলা স্বীয় শক্তি, প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দ্বারা স্বাধীনভাবে কর্তৃত্ব ও পরিচালনা করেন।

কখনো কখনো এমনও হয় যে, কিছু সৃষ্টি করেন আর নিজ ক্ষমতায় তার নিদর্শন উঠিয়ে নেন। যেমন বহু চক্ষু পাওয়া যায় যা দেখে না, অনেক কান দেখা যায় যা শুনেনা, অনেক জিহবা আছে যা কথা বলতে পারে না, অনেক সমুদ্র আছে যা ডুবায় না, অনেক আগুন আছে যা দগ্ধ করে না। এসব (ব্যতিক্রম) আল্লাহ তাআলাই করেছেন। কারণ তিনিই সে সত্তা যিনি স্বীয় সৃষ্টিকুলে নিজ ইচ্ছানুযায়ী কর্তৃত্ব ও পরিচালনা করেন। তিনি ছাড়া আর কোন মা’বুদ নেই, তিনি অদ্বিতীয় মহা পরাক্রমশালী। সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।

এমন অনেক হৃদয় আছে যেগুলো বস্ত্ত বিশেষ দ্বারা ঐ বস্ত্তর স্রষ্টা থেকেও অধিক পরিমাণে প্রভাবিত হয়। তাই বস্ত্তর স্রষ্টাকে ভুলে গিয়ে বস্ত্তর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে। অথচ দায়িত্বশীলতার পরিচয় হচ্ছে, এ জ্ঞান ও অন্তরদৃষ্টির মাধ্যমে মাখলুক ছেড়ে খালেক কে মূল্যায়ন করা, তাঁর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা। যিনি একে সৃষ্টি করেছেন এবং আকৃতি দান করেছেন। অতএব আমরা একমাত্র তাঁরই ইবাদত করব, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করব না।

আল্লাহ তাআলা বলেন :

قُلْ مَنْ يَرْزُقُكُمْ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أَمَّنْ يَمْلِكُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَمَنْ يُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَيُخْرِجُ الْمَيِّتَ مِنَ الْحَيِّ وَمَنْ يُدَبِّرُ الْأَمْرَ فَسَيَقُولُونَ اللَّهُ فَقُلْ أَفَلَا تَتَّقُونَ ﴿31﴾ فَذَلِكُمُ اللَّهُ رَبُّكُمُ الْحَقُّ فَمَاذَا بَعْدَ الْحَقِّ إِلَّا الضَّلَالُ فَأَنَّى تُصْرَفُونَ ﴿32﴾ ( سورة يونس : 31-32)

বল, আসমান ও যমীন হতে কে তোমাদের রিযক দেন? অথবা কে (তোমাদের) শ্রবণ ও দৃষ্টিসমূহের মালিক? আর কে মৃত থেকে জীবিতকে বের করেন আর জীবিত থেকে মৃতকে বের করেন? কে সব বিষয় পরিচালনা করেন? তখন তারা অবশ্যই বলবে, ‘আল্লাহ’। সুতরাং তুমি বল, ‘তারপরও কি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করবে না?’ অতএব তিনিই আল্লাহ, তোমাদের প্রকৃত রব। অত:পর সত্যের পর ভ্রষ্টতা ছাড়া কী থাকে? অতএব কোথায় তোমাদেরকে ফেরানো হচ্ছে? [সূরা ইউনুস : ৩১-৩২। সূরা আল-হিজর: ২১]

(চার) আমাদেরকে জানা ও বিশ্বাস করা যে, পৃথিবীতে যা কিছু আছে সকল বস্ত্তর ভান্ডার একমাত্র আল্লাহ তাআলার কাছে, তিনি ব্যতীত অন্য কারো নিকট নয়। খাবার, পানীয়, শষ্য-দানা, ফল-ফলাদি, পানি, বাতাস, পণ্য সামগ্রী, সমুদ্র, পাহাড়সহ যাবতীয় বস্ত্তর ভান্ডার আল্লাহর নিকট। সুতরাং আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় যাবতীয় জিনিষপত্র আল্লাহর নিকটই তালাশ করব। তাঁর নিকটই প্রার্থনা করব। এবং অধিক পরিমাণে তাঁর ইবাদত-আনুগত্য করব। তিনিই সকল প্রয়োজন সম্পন্নকারী, প্রার্থনা মঞ্জুরকারী। তিনিই শ্রেষ্ঠ প্রার্থনার স্থল- সর্বোত্তম দাতা, তিনি যা দান করেন তা প্রতিরোধকারী কেউ নেই, যা নিষেধ করেন তা প্রদানকারী কেউ নেই।

(১) আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন :

وَإِنْ مِنْ شَيْءٍ إِلَّا عِنْدَنَا خَزَائِنُهُ وَمَا نُنَزِّلُهُ إِلَّا بِقَدَرٍ مَعْلُومٍ . ( سورة الحجر : 21)

আর প্রতিটি বস্ত্তরই ভান্ডারসমূহ রয়েছে আমার কাছে এবং আমি তা অবতীর্ণ করি কেবল নির্দিষ্ট পরিমাণে। []

(২) আল্লাহ তাআলা আরও বলেন :

وَلِلَّهِ خَزَائِنُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَلَكِنَّ الْمُنَافِقِينَ لَا يَفْقَهُونَ . ( سورة المنافقون : 7)

আর আসমানসমূহ ও যমীনের ধন-ভান্ডার তো আল্লাহরই, কিন্তু মুনাফিকরা তা বুঝে না। [সূরা মুনাফিকূন : ৭।]

৫১
আল্লাহ তাআলার কুদরত ও ক্ষমতা :
আল্লাহ তাআলা নিরংকুশ ক্ষমতার অধিকারী। কখনো কখনো রিযিক প্রদান করেন আসবাব-উপকরনের মাধ্যমে, যেমন পানিকে ফসল-উদ্ভিদ উৎপন্নের কার্যকারণ বানিয়েছেন। স্ত্রী সঙ্গমকে বানিয়েছেন সন্তান জন্মদানের উপকরণ। আমরা বসবাস করছি দারুল আসবাবে তাই অনুমোদিত আসবাব গ্রহণ করব এবং আল্লাহ ভিন্ন অন্য কারো উপর ভরসা করব না।

আবার কখনো কখনো উপকরণ ছাড়াই রিযিক পৌঁছিয়ে থাকেন। কোন বস্ত্তকে উদ্দেশ্য করে বলেন, হয়ে যাও, সে হয়ে যায়। যেমন মারইয়াম-কে বৃক্ষ বিহীন খাবার এবং পুরুষ (এর মিলন) বিহীন সন্তান দান করেছেন।

আবার অনেক সময় স্বীয় ক্ষমতাকে আসবাব-উপকরণের বিপরীতে ব্যবহার করেন। যেমন নবী ইবরাহীম আলাইহিস সালামের জন্যে আগুনকে শান্তি প্রদায়ক শীতল করে দিয়েছিলেন এবং নবী মূসা আলাইহিস সালামকে সমুদ্রে নিমজ্জিত হওয়া থেকে বাঁচিয়ে ফেরআউন ও তার সম্প্রদায়কে ডুবিয়ে দিয়েছেন এবং নবী ইউনুস আলাইহিস সালামকে মহা সমুদ্রের অভ্যন্তরে মাছের পেটের ভিতর বাঁচিয়ে রেখেছেন।

ইরশাদ হচ্ছে:

إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَنْ يَقُولَ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ . ( سورة يــس : 82)

তাঁর ব্যাপার শুধু এই যে, কোন কিছুকে তিনি যদি ‘হও’ বলতে চান, তখনই তা হয়ে যায়। [সূরা ইয়াসীন: ৮২।]

বর্ণিত অবস্থা সৃষ্টিকুলের দিক বিবেচনা করে আর অবস্থা ও পরিস্থিতির বিবেচনায় :



১। আমরা জানি ও বিশ্বাস করি যে, মানব জীবনের সকল অবস্থা যেমন ধনাঢ্যতা ও দারিদ্র, সুস্থতা ও রোগ, প্রফুল্লতা ও বিষাদ, হাসি ও কান্না, সম্মান ও অবমাননা, জীবন ও মৃত্যু, নিরাপত্তা ও ভয়, শীত ও গরম, হিদায়াত ও গোমরাহী, সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য বরং যাবতীয় অবস্থার স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ তাআলা তিনিই এসব সৃষ্টি করেছেন।

২। আমরা জানি ও বিশ্বাস করি যে, এ সকল অবস্থা ও যাবতীয় বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা যিনি করেন তিনি হচ্ছেন মহা ক্ষমতাধর আল্লাহ তাআলা। তিনি এসব অবস্থা ও পরিস্থিতি পরিবর্তন-পর্যবেক্ষন করেন। সুতরাং দারিদ্র, প্রাচুর্যে রূপান্তরিত হয় কেবলমাত্র আল্লাহ তাআলার নির্দেশেই। তাঁর নির্দেশেই কেবল রোগ-ব্যাধি, সুস্থতায় পরিবর্তিত হয়। তাঁর হুকুমেই কেবল অসম্মান সম্মানে, অবমাননা ইজ্জতে পরিবর্তিত হয়। তাঁর নির্দেশ ছাড়া হাসি, কান্নায় রূপান্তরিত হয় না। কোন জীবিত মৃত্যু বরণ করে না তাঁর অনুমোদন ব্যতীত। তাঁর নির্দেশ ব্যতীত শীত, গরমে রূপান্তরিত হয় না । গোমরাহী হিদায়াতে রূপান্তরিত হয় কেবলমাত্র তাঁর নির্দেশই। এবং এভাবেই... সুতরাং বিভিন্ন অবস্থার আগমন ঘটে তাঁর নির্দেশে, হ্রাস-বৃদ্ধি পায় তাঁরই নির্দেশে। স্থায়ী হয় তাঁর নির্দেশে এবং নিঃশেষও হয় তাঁরই নির্দেশে। সুতরাং আমাদের উচিত অবস্থার পরিবর্তন ও রূপান্তর তাঁর নিকট প্রার্থনা করা যিনি এর ক্ষমতা রাখেন। তবে অবশ্যই অনুমোদিত পন্থায় তাঁর নৈকট্য অর্জনের মাধ্যমে।

قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَنْ تَشَاءُ وَتَنْزِعُ الْمُلْكَ مِمَّنْ تَشَاءُ وَتُعِزُّ مَنْ تَشَاءُ وَتُذِلُّ مَنْ تَشَاءُ بِيَدِكَ الْخَيْرُ إِنَّكَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ . ( سورة آل عمران : 26)

বল, হে আল্লাহ, রাজত্বের মালিক, আপনি যাকে চান রাজত্ব দান করেন, আর যার থেকে চান রাজত্ব কেড়ে নেন এবং আপনি যাকে চান সম্মান দান করেন। আর যাকে চান অপমানিত করেন, আপনার হাতেই কল্যাণ। নিশ্চয় আপনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান। [সূরা আলে ইমরান: ২৬।]

৩। আমরা জানি ও বিশ্বাস করি, ইত:পূর্বে আলোচিত সকল অবস্থা এবং এগুলো ছাড়াও যা আছে সব কিছুর ভান্ডার একমাত্র অদ্বিতীয় আল্লাহর কাছে, আল্লাহ তাআলা যদি সুস্থতা, প্রচুর্যসহ যাবতীয় নিয়ামত সকল মানুষকে তাদের চাহিদানুযায়ী সরবরাহ করেন তাহলে আল্লাহর ভান্ডার থেকে বিন্দু পরিমাণও কমবে না। মহাসমুদ্রে একটি সুঁই প্রবেশ করালে সুঁই যতটুকু পানি হ্রাস করে (আল্লাহর ভান্ডার থেকে সকল মানুষের চাহিদা পুরণ করলে) ঐ পরিমাণ কমতে পারে। তিনি ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই, তিনি অমুখাপেক্ষী, সর্বাধিক প্রশংসিত।

عن أبي ذر رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم فيما روى عن الله تبارك وتعالى أنه قال :

সাহাবী আবু যর রা. নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ আল্লাহ তাআলা থেকে বর্ণনা করেছেন, আল্লাহ বলেন :

يا عبادي ! إني حرمت الظلم على نفسي وجعلته بينكم محرما فلا تظالموا .

يا عبادي ! كلكم ضال إلا من هديته فاستهدوني أهدكم .

يا عبادي ! كلكم جائع إلا من أطعمته . فاستطعموني أطعمكم .

يا عبادي ! كلكم عار إلا من كسوته فاستكسوني أكسكم .

يا عبادي ! إنكم تخطئون بالليـل والنهار وأنا أغفر الذنوب جميعا، فاستغفروني أغفرلكم .

يا عبادي ! إنكم لن تبلغوا ضري فتضروني، ولن تبلغوا نفعي فتنفعوني .

يا عبادي ! لو ان أولكم وآخركم وإنسكم وجنكم كانوأ على أتقى قلب رجل واحد منكم . مازاد ذلك فى ملكي شيئا .

يا عبادي ! لو أن أولكم وآخركم وإنسكم وجنكم كانوأ على أفجر قلب رجل واحد . ما نقص ذلك من ملكي شيئا .

يا عبادي ! لو أن أولكم وآخركم وإنسكم وجنكم قاموا في صعيد واحد فسألوني، فأعطيت كل إنســان مسألته ما نقص ذالك مما عندي إلا كما ينقص المخيط إذا أدخل البحر .

يا عبادي ! إنما هي أعمالكم أحصيها لكم ثم أوفيكم إياها . فمن وجد خيرا فليحمد الله ومن وجد غير ذلك فلا يلومن إلا نفسه . أخرجه مسلم .

হে আমার বান্দাগণ, আমি আমার নিজের উপর অন্যায় ও যুলুমকে হারাম করেছি এবং তোমাদের মাঝেও তাকে হারাম বলে সাব্যস্ত করেছি। সুতরাং তোমরা পরস্পর যুলুম করোনা।

হে আমার বান্দা সকল, আমি যাকে হেদায়াত দিয়েছি সে ব্যতীত তোমরা সকলেই পথভ্রষ্ট। তাই আমার নিকট হেদায়াত প্রার্থনা করো আমি হেদায়াত দান করব।

হে বান্দা সকল, আমি যাকে খাবার দিয়েছি সে ব্যতীত তোমরা সকলেই অভুক্ত-ক্ষুধার্ত। সুতরাং আমার নিকট খাবার চাও আমি খাবার (খাওয়াবো) দান করব।

হে বান্দা সকল, আমি যাকে বস্ত্র দান করেছি (পরিধান করিয়েছি) সে ব্যতীত তোমরা সকলেই বিবস্ত্র-উলঙ্গ। আমার নিকট পরিধেয় প্রার্থনা কর আমি বস্ত্র প্রদান করব।

হে আমার বান্দা সকল, তোমরা দিবা-রাত্রি অপরাধ কর আর আমি সকল পাপ মার্জনা করি। আমার নিকট ক্ষমা চাও আমি ক্ষমা করে দেব।

হে আমার বান্দা সকল, তোমরা কস্মিন কালেও আমার ক্ষতি পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না যে আমার ক্ষতি করবে, অনুরূপভাবে কস্মিন কালেও আমার উপকার পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না যে আমার উপকার করবে।

হে আমার বান্দা সকল, যদি তোমাদের বিগত ও অনাগত, তোমাদের মানব ও জিন সকলেই তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক আল্লাহ ভীরু ব্যক্তির ন্যায় হয়ে যাও, (এটি) আমার রাজত্বে বিন্দু পরিমাণও বৃদ্ধি করবে না।

হে আমার বান্দা সকল, যদি তোমাদের বিগত ও অনাগত, তোমাদের মানব ও জিন সকলেই তোমাদের সর্বাধিক পাপী ব্যক্তির ন্যায় হয়ে যাও। এটি আমার রাজত্ব থেকে বিন্দু পরিমাণও কমাতে পারবে না।

হে আমার বান্দা সকল, যদি তোমাদের (পৃথিবীর শুরু থেকে অদ্যাবধি) আগত এবং (কিয়ামত পর্যন্ত যারা আসবে) অনাগত, তোমাদের মানব ও জিন সকলে এক ময়দানে মিলিত হয়ে প্রত্যেকেই (নিজ নিজ চাহিদা মত) আমার নিকট প্রার্থনা করে, আর আমি প্রত্যেকেরই প্রার্থিত বস্ত্ত প্রদান করি। তাহলে এটি আমার ভান্ডারে যা আছে তার থেকে একটুও কমাবে না। হ্যাঁ (যদি কমায় তাহলে) মহা সমুদ্রে সুঁই প্রবেশ করালে ঐ সুঁই যতটুকু পানি হ্রাস করে এতটুকু কমাতে পারে।

হে আমার বান্দা সকল, নিশ্চয়ই এটি তোমাদের আমল বৈ নয়, যা আমি তোমাদের উপকারার্থে সংরক্ষণ করে রেখেছি। অতঃপর এর বিনিময় আমি তোমাদের পরিপূর্ণরূপে প্রদান করব। সুতরাং যে কল্যাণ পেল সে যেন আল্লাহর প্রশংসা করে আর যে এর বিপরীত পেল সে যেন শুধুমাত্র নিজেকেই ধিককার দেয়- তিরস্কার করে। [বর্ণনায় : সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৫৭৭]

যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ঈমান আনবে এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ অনুযায়ী আল্লাহ তাআলার নির্দেশাবলি বাস্তবায়ন করবে। সে ব্যক্তি ধনী হোক বা দরিদ্র আল্লাহ তাআলা তার প্রতি সন্তুষ্ট হবেন এবং নিজ ভান্ডার হতে দান করবেন। তার পৃষ্ঠপোষকতা ও সাহায্য করবেন। তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। হিফাযত করবেন এবং ঈমানের বদৌলতে তাকে সম্মানিত করবেন। চাই তার নিকট সম্মানের আসবাব-উপকরণ থাকুক যেমন আবু বকর, ওমর ও উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুম বা না থাকুক যেমন বেলাল, আম্মার ও সালমান রাদিয়াল্লাহু আনহুম প্রমুখ।

আর যারা ঈমান আনবে না আল্লাহ তাআলা তাদেরকে ইজ্জত-সম্মানের উপকরণ

-রাজত্ব, ক্ষমতা, প্রাচুর্য ইত্যাদি- থাকা সত্ত্বেও অপমান-অপদস্ত করবেন।

যেমন অপমানিত করেছেন, ফিরআউন, কারূন, হামান প্রমুখকে।

আর যদি তাদের নিকট অপমান-অপদস্থের উপকরণ থাকে তাহলে আল্লাহ তাআলা এর মাধ্যমে তাদের অপমানিত করবেন। যেমন দরিদ্র মুশরিকগণ-কে করে থাকেন।

আল্লাহ তাআলা মানব জাতিকে ঈমান, নেক আমাল এবং একমাত্র পালনকর্তা আল্লাহ তাআলার ইবাদত করার উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি করেছেন। অধিক সম্পদ উপার্জন, সমৃদ্ধি অর্জন এবং প্রবৃত্তির চাহিদা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেননি। মানুষ যদি নিজেকে রবের ইবাদত বাদ দিয়ে এসব কাজে ব্যস্ত রাখে তাহলে আল্লাহ তাআলা এসব তাদের উপর চাপিয়ে দেবেন (অর্থাৎ এসকল কাজ তার উপর এমনভাবে চেপে বসবে যে, অন্য কাজ করার আর ফুরসত পাবে না আর নানা পেরেশানীরও অন্ত থাকবে না। এক পর্যায়ে এগুলোকে আযাব মনে হবে) এবং দুনিয়া ও আখেরাতে তার দুঃখ-কষ্ট, ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণ বানিয়ে দেবেন।

আল্লাহ তাআলা বলেন :

فَلَا تُعْجِبْكَ أَمْوَالُهُمْ وَلَا أَوْلَادُهُمْ إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُعَذِّبَهُمْ بِهَا فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَتَزْهَقَ أَنْفُسُهُمْ وَهُمْ كَافِرُونَ ﴿55﴾ ( سورة التوبة : 55)

সুতরাং তোমাকে যেন তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তানাদি বিস্মিত না করে, আল্লাহ এর দ্বারা কেবল তাদের আযাব দিতে চান দুনিয়ার জীবনে এবং তাদের জান বের হবে কাফের অবস্থায়। [সূরা আত্-তাওবা: ৫৫।]

৫২
সফলতা, কল্যাণ ও উন্নতির উপকরণ ও মাধ্যম :
মহান আল্লাহ কল্যাণ ও উন্নতির চাবি-কাঠি ও উপায়-উপকরণ ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকল মানুষকেই দান করেছেন। আর যাতে কল্যাণ ও সফলতা নেই যেমন ধন-সম্পদ, ক্ষমতা- প্রভাব-খ্যাতি ইত্যাদি (এসব বস্ত্ত) কাউকে দিয়েছেন, কাউকে দেননি। ঈমান ও নেকআমলই হচ্ছে দুনিয়া-আখিরাতে সফল ও কামিয়াব হওয়ার একমাত্র মাধ্যম। এ অধিকার ও সুযোগ সকলকেই দান করা হয়েছে। অনুরূপভাবে ঈমানের স্থান অন্তর সকলের ভেতরই বিদ্যমান। তদ্রুপ নেকআমলের জায়গা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও সকলের অধীন। সুতরাং যে ব্যক্তির অন্তরে ঈমান আছে এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে নেক আমল প্রকাশ পেয়েছে সে ইহকাল-পরকাল উভয় জগতে সফল ও কামিয়াব হয়ে গিয়েছে। এছাড়া সকলেই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভূক্ত।

ইহকাল ও পরকাল উভয় জগতে কল্যাণ ও সফলতা একমাত্র ঈমান ও নেকআমলের মাধ্যমেই অর্জিত হয়। আল্লাহ তাআলার নিকট মানুষের মূল্য ও মর্যাদা তার ঈমান ও নেকআমলের পরিমাণের উপর ভিত্তি করে নিরুপিত হয়। (যার ঈমান মজবুত নেকআমল বেশি তার মূল্য-মর্যাদা বেশি। যার ঈমান দুর্বল নেকআমলের সংখ্যাও কম তার মূল্যও তুলনা মূলক কম) এ মূল্য ও মর্যাদার ভিত্তি হচ্ছে ঈমান ও নেক আমল। ধন-সম্পদ, ক্ষমতা-প্রভাব, ও পদমর্যাদা নয়।

পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক জাতি অতিবাহিত হয়েছে যারা মান-মর্যাদা ও মূল্যায়নের সঠিক মাধ্যম ঈমান ও নেকআমলকে গ্রহণ না করে অন্যান্য বস্ত্তকে মূল্যায়ন ও মর্যাদার মাধ্যম বলে বিশ্বাস করেছে। তাদের কেউ কেউ কল্যাণ ও কামিয়াবী কর্তৃত্ব ও রাজত্বের মধ্যে নিহিত বলে বিশ্বাস করেছে। যেমন নমরূদ ও ফিরআউন।

আবার কেউ বিশ্বাস করেছে এগুলো শক্তির মধ্যে নিহিত, যেমন আদ জাতি।

আবার কেউ মনে করেছে ব্যবসার মধ্যে, যেমন শুআইব আলাইহিস সালামের জাতি।

কেউ ধারণা করেছে কৃষি কাজের মধ্যে, যেমন কওমে সাবা আবার কেউ বিশ্বাস করেছে শিল্প ও কারিগরির মধ্যে, যেমন সামূদ জাতি আর কেউ কেউ ধারণা করেছে ধন-সম্পদ ও ঐশ্বর্যের মধ্যে যেমন কারূন।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সেসব জাতির নিকট পর্যাপ্ত পরিমাণে নবী-রাসূলপ্রেরণ করেছেন তাদেরকে এক আল্লাহর ইবাদতের প্রতি আহবান করার জন্য। এবং এ বিষয়ে বুঝানোর জন্য যে, কল্যাণ ও সফলতা এসব কিছুতে নেই। কল্যাণ আছে একমাত্র ঈমান ও নেক আমলের মধ্যে।

(১) আল্লাহ তাআলা বলেন :-

وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَخْشَ اللَّهَ وَيَتَّقْهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَائِزُونَ ﴿52﴾ ( سورة النور : 52)

আর যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহকে ভয় করে এবং তাঁর তাকওয়া অবলম্বন করে, তারাই সফলকাম। [সূরা নূর : ৫২।]

(২) আরো এরশাদ হচ্ছে :

الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ ﴿3﴾ وَالَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ وَبِالْآَخِرَةِ هُمْ يُوقِنُونَ ﴿4﴾ أُولَئِكَ عَلَى هُدًى مِنْ رَبِّهِمْ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ ﴿5﴾ ( سورة البقرة : 3-5)

যারা গায়েবের প্রতি ঈমান আনে, সালাত কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে। আর যারা ঈমান আনে তাতে, যা তোমার প্রতি নাযিল করা হযেছে এবং যা তোমার পূর্বে নাযিল করা হয়েছে। আর আখেরাতের প্রতি তারা দৃঢ় বিশ্বাস রাখে। তারা তাদের রবের পক্ষ হতে হিদায়াতের উপর রয়েছে এবং তারাই সফলকাম। [সূরা বাকারা : ৩-৫।]

তারা (সেসব জাতি) যখন রাসূলদের মিথ্যা প্রতিপন্ন করল ও স্বীয় কুফরীর উপর অটল রইল আর নিজেদের কাছে থাকা জিনিস দ্বারা প্রতারিত হল। আল্লাহ তাদের ধ্বংস করে দিলেন। আর নবী রাসূল ও তাঁদের অনুসারীদের রক্ষা করলেন। শত্রুর বিরুদ্ধে তাদের সাহায্য করলেন।

(১) আল্লাহ তাআলা বলেন :

فَكُلًّا أَخَذْنَا بِذَنْبِهِ فَمِنْهُمْ مَنْ أَرْسَلْنَا عَلَيْهِ حَاصِبًا وَمِنْهُمْ مَنْ أَخَذَتْهُ الصَّيْحَةُ وَمِنْهُمْ مَنْ خَسَفْنَا بِهِ الْأَرْضَ وَمِنْهُمْ مَنْ أَغْرَقْنَا وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيَظْلِمَهُمْ وَلَكِنْ كَانُوا أَنْفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ ﴿40﴾ ( سورة العنكبوت : 40)

অত:পর এদের প্রত্যেককে নিজ নিজ পাপের কারণে আমি পাকড়াও করেছিলাম; তাদের কারো উপর আমি পাথরকুচির ঝড় পাঠিয়েছি, কাউকে পাকড়াও করেছে বিকট আওয়াজ, কাউকে আবার মাটিতে দাবিয়ে দিয়েছি আর কাউকে পানিতে ডুবিয়ে দিয়েছি। আল্লাহ এমন নন যে তাদের উপর যুলুম করবেন বরং তারা নিজেরা নিজেদের উপর যুলুম করত। [সূরা আনকাবুত : ৪০।]

(২) আল্লাহ তাআলা আরও বলেন :-

فَلَمَّا جَاءَ أَمْرُنَا نَجَّيْنَا صَالِحًا وَالَّذِينَ آَمَنُوا مَعَهُ بِرَحْمَةٍ مِنَّا وَمِنْ خِزْيِ يَوْمِئِذٍ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ الْقَوِيُّ الْعَزِيزُ ﴿66﴾ وَأَخَذَ الَّذِينَ ظَلَمُوا الصَّيْحَةُ فَأَصْبَحُوا فِي دِيَارِهِمْ جَاثِمِينَ ﴿67﴾ ( سورة هود : 66-67)

অতঃপর যখন আমার আদেশ এল, তখন সালেহ ও তার সাথে যারা ঈমান এনেছিল তাদেরকে আমার পক্ষ থেকে রহমত দ্বারা নাজাত দিলাম এবং (নাজাত দিলাম) সেই দিনের লাঞ্ছনা থেকে। নিশ্চয় তোমার রবই শক্তিশালী, পরাক্রমশালী। আর যারা যুলুম করেছিল, বিকট আওয়াজ তাদেরকে পাকড়াও করল, ফলে তারা নিজেদের গৃহে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকল। [সূরা হুদ : ৬৬-৬৭।]

৫৩
ঈমানদারদের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদায় শ্রেণী ভিন্নতা:
সৃষ্টিকুলের ঈমান বিভিন্ন স্তর বিশিষ্ট।

১- ফেরেশতাকুলের ঈমান স্থির-অবিচল। বৃদ্ধিও পায় না আবার হ্রাসও পায় না। তারা মহান আল্লাহ তাআলার কোন নির্দেশই অমান্য করে না। তাদের যা বলা হয় তাই তারা বাস্তবায়ন করে। তারা সকলে একই শ্রেণীভুক্ত নয় বরং তাঁদের মধ্যে স্তর ও মর্যাদায় বিভিন্নতা রয়েছে।

২-নবী ও রাসূলগণের (আলাইহিস সালাম) ঈমান শুধু বৃদ্ধিই পায়- হ্রাস পায় না। কারণ আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে তাঁদের ধারণা ও জ্ঞান পরিপূর্ণ ও পরিস্কার। তারাও পরস্পর বিভিন্ন স্তর বিশিষ্ট, সকলে একই স্তরের নন।

৩-সাধারণ মুসলমানদের ঈমান, ইবাদত-আনুগত্যের মাধ্যমে বৃদ্ধি পায় আর পাপ ও অবাধ্যতার কারণে হ্রাস পায়। ঈমানের ক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন স্তর ও শ্রেণীভুক্ত। আর ঈমানও বিভিন্ন স্তর বিশিষ্ট।

প্রথম শ্রেণীর ঈমান একজন মুসলমানকে এমনভাবে তৈরী করে এবং এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছে দেয় যে, সে সদা-সর্বদা আল্লাহ তাআলার ইবাদত আদায়ে সচেষ্ট থাকে। আন্তরিকতাপূর্ণ তৎপরতার সাথে সব সময় আনুগত্য প্রকাশ করে। ইবাদতের মাধ্যমে মজা পায় এবং সর্ব প্রকার ইবাদত সর্বাত্মক সংরক্ষণ করে। তার সমপর্যায় বা উপরস্থ লোকদের সাথে উন্নত আচরণ অব্যহত রাখার জন্যে আরো মজবুত ঈমানের প্রয়োজন যা তাকে নিজ ও অন্যের উপর অন্যায়-অবিচার থেকে বিরত রাখবে। আর নিজ থেকে নিম্ন পর্যায়ের লোকদের সাথে যেমন রাজা- প্রজাদের সাথে, পরিবারের প্রধান- তার অধীনস্থদের সাথে, স্বামী- স্ত্রীর সাথে সু-সম্পর্ক বজায় রাখার জন্যেও আরো মজবুত ঈমানের প্রয়োজন যা তাকে নিম্নশ্রেণীর লোকদের উপর যুলুম থেকে বাধা প্রদান করবে। যখনই ঈমান বৃদ্ধি পাবে ইয়াক্বীন ও নেকআমলও বৃদ্ধি পাবে। আর বান্দা আল্লাহর হক ও অপরাপর বান্দাদের হক আদায়ে যারপরনাই যত্নবান থাকবে। সে হবে সৃষ্টি ও স্রষ্টার সাথে সদাচরণ ও উত্তম আখলাক প্রদর্শনে অনুকরণীয় নমুনা। এ পর্যায়ের ঈমানবিশিষ্ট ব্যক্তিরা হচ্ছেন দুনিয়া ও আখিরাতে সর্বোচ্চ পর্যায়ের মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি। এটিই হচ্ছে ইহকাল ও পরকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ের মর্যাদা।

(২) প্রতিটি মানুষই চলমান, কেউই থেমে নেই। হয়ত উর্ধ্বপানে অথবা নীচের দিকে, হয়ত সম্মুখপানে কিংবা পেছনের দিকে। মানব প্রকৃতি ও শরীয়ত; কোনটিতেই থেমে থাকার কোন বিধান নেই। অতএব মানুষ বলতেই, সে সার্বক্ষনিক কোন না কোন পর্যায় দ্রুততার সাথে অতিক্রম করছে। অগ্রসর হচ্ছে হয়ত জান্নাত পানে অথবা জাহান্নামের দিকে। কেউ দ্রুতগামী, কেউ ধীর গতিতে। কেউ অগ্রসরমান কেউ পিছনে পড়েছে। চলার রাস্তায় কেউ দাঁড়িয়ে নেই; সবাই চলমান। বিভিন্নতা ও ব্যতিক্রম শুধুমাত্র চলার দিক এবং গতির দ্রুততা ও মন্থরতার ক্ষেত্রে।

সুতরাং যে ব্যক্তি ঈমান ও নেক আমলের মাধ্যমে জান্নাত পানে অগ্রসর হচ্ছে না, অবশ্যই সে কুফর ও বদআমলের কারণে জাহান্নামের দিকে পশ্চাদ্বর্তী হচ্ছে।

আল্লাহ তাআলা বলেন :-

نَذِيرًا لِلْبَشَرِ ﴿36﴾ لِمَنْ شَاءَ مِنْكُمْ أَنْ يَتَقَدَّمَ أَوْ يَتَأَخَّرَ ﴿37﴾ ( سورة المدثر : 36-37)

মানুষের জন্য সতর্ককারীস্বরূপ। তোমাদের মধ্যে যে চায় অগ্রসর হতে অথবা পিছিয়ে থাকতে, তার জন্য। [সূরা আল-মুদ্দাসসির : ৩৬-৩৭।]

(৩) ঈমানের অবস্থার ভিত্তিতে ঈমানদারদের মাঝে বড় ধরনের তারতম্য আছে। সুতরাং নবী ও রাসূলগণের ঈমান অন্যদের ঈমানের মত নয়। সাহাবাদের ঈমান অন্যদের ঈমানের মত নয়। নেককার মুমিনদের ঈমান, ফাসেক-পাপিষ্ঠদের ঈমানের মত নয়। এ তারতম্য ও ব্যবধান নির্ণিত হয় অন্তরে আল্লাহ তাআলা, তাঁর নাম ও গুণাবলি, তাঁর কর্ম, এবং বান্দাদের জন্যে তাঁর বিধিত বিষয়াদি সম্পর্কে ধারনা এবং তাঁর ভয় ও তাকওয়ার পরিমাণ অনুপাতে।

(যার অন্তরে এসব বিষয়ে ধারণা ও আল্লাহর তাকওয়া বেশি তার ঈমানের মানও সে অনুপাতে বেশি আর যার ধারণা কম তার ঈমানের মানও সে অনুপাতে কম এবং এভাবে...)

لا إله إلا الله ধারনকারীদের অন্তরে لا إله إلا الله - এর নূরের ব্যবধান একমাত্র আল্লাহ তাআলাই পরিমাপ করতে পারেন। তিনি ব্যতীত এ হিসাব আর কেউ জানে না, জানতে পারে না।

(৪) সৃষ্টিকুলের মধ্যে আল্লাহ সম্পর্কে যাদের ধারনা সবচে বেশি তারাই তাঁকে সর্বাধিক মুহাববত করেন। এ কারণেই নবী- রাসূলগণ মানুষের মধ্যে আল্লাহ তাআলাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন এবং সম্মান করতেন। (সম্মান প্রদর্শন ও ভালবাসার ক্ষেত্রে তাঁরাই ছিলেন মানবশ্রেষ্ঠ। কারণ আল্লাহ সম্পর্কে তাঁদের জ্ঞান ছিল সবদিক থেকে পরিপূর্ণ)

আল্লাহ তাআলাকে তাঁর সত্ত্বা, অনুগ্রহ, সৌন্দর্য ও মহত্বের কারণে ভালবাসা হচ্ছে ইবাদতের মূল উৎস। যখনই ভালবাসা প্রগাঢ় ও শক্তিশালী হবে ইবাদত-আনুগত্যও পরিপূর্ণ হবে। সম্মান প্রদর্শন হবে পূর্ণতাসম্পন্ন আর আল্লাহর সাথে ঘনিষ্ঠতা ও বন্ধুত্ব হবে পূর্ণাঙ্গতর।

৫৪
ঈমানের উপর আল্লাহ তাআলার প্রতিশ্রুতি
আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে ইহকাল ও পরকালে বিভিন্ন পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

৫৫
(ক) ইহকালীন জীবনের কতিপয় প্রতিশ্রুতি:
(১) সফলতা।

যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,

قَدْ أَفلَحَ الْمؤْمِنُوْنْ . ( سورة المؤمنون : 1)

মুমিনগণ সফলকাম হয়েছে। [সূরা মুমিনুন : ১।]

হেদায়াত বা সৎপথ প্রাপ্তি।

আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَإِنَّ اللَّهَ لَهَادِ الَّذِينَ آَمَنُوا إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ ﴿54﴾. ( سورة الحج : 54)

আর যারা ঈমান এনেছে, নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে সরল পথ প্রদর্শনকারী। [সূরা : আল-হজ: ৫৪।]

সাহায্য।

ইরশাদ হচ্ছে,

وَكَانَ حَقًّا عَلَيْنَا نَصْرُ الْمُؤْمِنِينَ ﴿47﴾ ( سورة الروم : 47)

আর মুমিনদেরকে সাহায্য করাতো আমার কর্তব্য। [সূরা আর-রূম : ৪৭।]

(৪) ইজ্জত ও মর্যাদা ।

আল্লাহ বলেন,

وَلِلَّهِ الْعِزَّةُ وَلِرَسُولِهِ وَلِلْمُؤْمِنِينَ ( سورة المنافقون : 8)

ইজ্জত তো আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মুমিনদেরই। [সূরা মুনাফিকুন : ৮।]

(৫)পৃথিবীতে খেলাফত দান তথা শাসন কর্তৃত্ব প্রদান ও প্রতিষ্ঠিত করণ।

আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَى لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُمْ مِنْ بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا يَعْبُدُونَنِي لَا يُشْرِكُونَ بِي شَيْئًا ( سورة النور : 55)

তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম সম্পাদন করে, আল্লাহ তাদেরকে এ মর্মে ওয়াদা দিয়েছেন যে, তিনি নিশ্চিতভাবে তাদেরকে যমীনে শাসন কর্তৃত্ব (খেলাফত) প্রদান করবেন। যেমন তিনি শাসন কর্তৃত্ব দান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি অবশ্যই তাদের জন্য শক্তিশালী ও সুপ্রতিষ্ঠিত করবেন তাদের দীনকে, যা তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তিনি তাদের ভয়-ভীতি শান্তি-নিরাপত্তায় পরিবর্তিত করে দেবেন। তারা আমারই ইবাদাত করবে, আমার সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না। আর এরপর যারা কুফরী করবে তারাই ফাসিক। [সূরা আন নূর : ৫৫।]

(৬) তাদের পক্ষ থেকে (শত্রুদেরকে) প্রতিরোধ করে তাদের রক্ষা করা।

আল্লাহ তাআলা বলেন।

إِنَّ اللَّهَ يُدَافِعُ عَنِ الَّذِينَ آَمَنُوا ( سورة الحج : 38)

নিশ্চয় আল্লাহ মুমিনদের পক্ষে প্রতিরোধ করেন। [সূরা আল হজ্ব: ৩৮।]

(৭) শান্তি ও নিরাপত্তা।

আল্লাহ বলেন :

الَّذِينَ آَمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُمْ بِظُلْمٍ أُولَئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُمْ مُهْتَدُونَ ﴿82﴾ ( سورة الأنعام : 82)

যারা ঈমান এনেছে এবং নিজ ঈমানকে যুলমের সাথে সংমিশ্রণ করেনিম তাদের জন্যই নিরাপত্তা এবং তারাই হিদায়াতপ্রাপ্ত। [সূরা আনআম : ৮২।]

(৮) মুক্তি।

আল্লাহ বলেন :

ثُمَّ نُنَجِّي رُسُلَنَا وَالَّذِينَ آَمَنُوا كَذَلِكَ حَقًّا عَلَيْنَا نُنْجِ الْمُؤْمِنِينَ ﴿103﴾ ( سورة يونس : 103)

তারপর আমি নাজাত (মুক্তি) দেই আমার রাসূলদেরকে এবং তাদেরকেও যারা ঈমান এনেছে। এটা আমার দায়িত্ব যে, মুমিনদের নাজাত দেই। [সূরা ইউনুস : ১০৩।]

উত্তম জীবন।

আল্লাহ বলেন :

مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُمْ بِأَحْسَنِ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ ﴿97﴾ ( سورة النحل : 97)

যে মুমিন অবস্থায় নেক আমল করবে, পুরুষ হোক বা নারী, আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং তারা যা করত তার তুলনায় অবশ্যই আমি তাদেরকে উত্তম প্রতিদান দেব। [সূরা নাহল : ৯৭।]

(১০) তাদের উপর কাফেরদের চাপিয়ে না দেয়া কিংবা তাদের বিরুদ্ধে কাফেরদের কর্তৃত্ব প্রদান না করার অঙ্গীকার।

আল্লাহ তাআলা বলেন :

وَلَنْ يَجْعَلَ اللَّهُ لِلْكَافِرِينَ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ سَبِيلًا ﴿141﴾ ( سورة النساء : 141)

আর আল্লাহ কখনো মুমিনদের বিপক্ষে কাফিরদের জন্য পথ (কর্তৃত্ব) রাখবেন না। [সূরা নিসা : ১৪১।]

(১১) অনেক কল্যাণ ও বরকত অর্জন হওয়া।

আল্লাহ তাআলা বলেন :

وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَى آَمَنُوا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ وَلَكِنْ كَذَّبُوا فَأَخَذْنَاهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ ﴿96﴾ ( سورة الأعراف : 96)

আর যদি জনপদসমূহের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং তাকওয়া অবলম্বন করত তাহলে আমি অবশ্যই আসমান ও যমীন থেকে বরকতসমূহ তাদের উপর খুলে দিতাম; কিন্তু তারা অস্বীকার করল। অত:পর তারা যা অর্জন করত তার কারণে আমি তাদেরকে পাকড়াও করলাম। [সূরা আ’রাফ : ৯৬।]

(১২) আল্লাহ তাআলার বিশেষ সাহচর্য লাভ।

আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَأَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُؤْمِنِينَ ﴿19﴾ ( سورة ألأنفال : 19)

আর নিশ্চয় আল্লাহ মুমিনদের সাথে আছেন। [সূরা আনফাল: ১৯।]

৫৬
(খ) পরকালীন জীবনের সাথে সম্পৃক্ত কিছু প্রতিশ্রুতি।
(১) মুমিনদের জান্নাতে প্রবেশ, সেখানে অনন্তকাল থাকা এবং আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে সন্তুষ্টির প্রতিশ্রুতি। আল্লাহ তাআলা বলেন :

وَعَدَ اللَّهُ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِي جَنَّاتِ عَدْنٍ وَرِضْوَانٌ مِنَ اللَّهِ أَكْبَرُ ذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ ﴿72﴾ ( سورة التوبة : 72)

আল্লাহ মু’মিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হবে নহরসমূহ, তাতে তারা চিরদিন থাকবে এবং (ওয়াদা দিয়েছেন) স্থায়ী জান্নাতসমূহে পবিত্র বাসস্থানসমূহের। আর আল্লাহর পক্ষ থেকে সন্তুষ্টি সবচেয়ে বড়। এটাই মহাসফলতা। [সূরা তাওবা : ৭২।]

(২) আল্লাহ তাআলাকে দর্শনের প্রতিশ্রুতি।

আল্লাহ বলেন :

وُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ نَاضِرَةٌ ﴿22﴾ إِلَى رَبِّهَا نَاظِرَةٌ ﴿23﴾ ( سورة القيامة : 22-23)

সেদিন কতক মুখমন্ডল হবে হাস্যোজ্জ্বল। তাদের রবের প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপকারী। [সূরা কিয়ামাহ : ২২-২৩।]

মুমিনদের জন্য ইহকালীন জীবনে আল্লাহর দেয়া প্রতিশ্রুতিসমূহের অধিকাংশই বর্তমানে বেশিরভাগ মুসলমানদের জীবনে অনুপস্থিত। এটি তাদের ঈমানের দুর্বলতার কথাই প্রমাণ করছে। সুতরাং প্রতিশ্রুত নিয়ামতের উপস্থিতি কাম্য হলে বর্তমান ঈমানকে আরো মজবুত করে কাংক্ষিত পর্যায়ে উন্নীত করা ছাড়া বিকল্প রাস্তা নেই। তাতেই আমরা ঈমানের উপর দেয়া অঙ্গীকারাবলি আমাদের পার্থিক জীবনে দেখতে পাব। আর তার সহজ উপায় হচ্ছে আমাদের ঈমান ও আমলসমূহকে নবী ও সাহাবাদের ঈমান ও আমলসমূহের সদৃশ করে তোলা।

(১) আল্লাহ তাআলা বলেন :

فَإِنْ آَمَنُوا بِمِثْلِ مَا آَمَنْتُمْ بِهِ فَقَدِ اهْتَدَوْا وَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا هُمْ فِي شِقَاقٍ فَسَيَكْفِيكَهُمُ اللَّهُ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ ﴿137﴾ ( سورة البقرة : 137)

অতএব যদি তারা ঈমান আনে, তোমরা যেরূপে তার প্রতি ঈমান এনেছ, তবে অবশ্যই তারা হিদায়াতপ্রাপ্ত হবে। আর যদি তারা বিমুখ হয় তাহলে তারা রয়েছে কেবল বিরোধিতায়, তাই তাদের বিপক্ষে তোমার জন্য আল্লাহ যথেষ্ট। আর তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। [সূরা- আল-বাকারা : ১৩৭।]

(২) আল্লাহ আরও বলেন :

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا آَمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَالْكِتَابِ الَّذِي نَزَّلَ عَلَى رَسُولِهِ وَالْكِتَابِ الَّذِي أَنْزَلَ مِنْ قَبْلُ وَمَنْ يَكْفُرْ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا بَعِيدًا ﴿136﴾ ( سورة النساء : 136)

হে মুমনিগণ, তোমরা ঈমান আন আল্লাহর প্রতি, তাঁর রাসূলের প্রতি এবং সে কিতাবের প্রতি যা তিনি তাঁর রাসূলের উপর নাযিল করেছেন এবং সে কিতাবের প্রতি যা তিনি পূর্বে নাযিল করেছেন। আর যে আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, তাঁর কিতাবসমূহ, তার রাসূলগণ এবং শেষ দিনকে অস্বীকার করবে, সে ঘোর বিভ্রান্তিতে বিভ্রান্ত হবে। [সূরা নিসা : ১৩৬।]

(৩) আল্লাহ তাআলা আরও বলেছেন :

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّةً وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ ﴿208﴾ ( سورة البقرة : 208)

হে মুমিনগণ, তোমরা ইসলামে পূর্ণরূপে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কর না, নিশ্চয় সে তোমাদের জন্য প্রকাশ্য শত্রু। [সূরা আল-বাকারা : ২০৮।]

৫৭
ইবাদত বিধিত করণের তৎপর্য
মহান আল্লাহর নির্দেশাবলি বাস্তবায়ন এবং নিষেধাবলি বর্জন দুটি বিষয়ের উপর ভিত্তিশীল।

(এক) আল্লাহ তাআলার উপর পরিপূর্ণ ঈমান।

(দুই) অন্তরে সার্বক্ষনিক রাজাধিরাজ মহান স্রষ্টার মর্যাদা ও বড়ত্বের চিন্তা ক্রিয়াশীল রাখা। আর এ ভাবনা অধিক পরিমাণে আল্লাহর যিকিরের মাধ্যমেই মনে উদয় হয়।

মহান আল্লাহ মানবান্তরে এ চিন্তা-ভাবনাকে অব্যাহত রাখা এবং এ বিশ্বাসকে সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যেই নিজ বান্দাদের জন্য পূন:পুনিকভাবে উপদেশ দানকারী একটি স্মারকের প্রবর্তন করেছেন আর সে স্মারকটিই হচ্ছে ‘‘ইবাদত’’। যা বার বার সংঘটিত হবে এবং প্রতিবারই মহান স্রষ্টার বড়ত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে।

যখন ঈমান বৃদ্ধি পাবে ও শক্তিশালী হবে তখন আমলও বাড়বে এবং শক্তিশালী হবে।

অতঃপর ইহকাল-পরকাল-উভয় জগত-এর কল্যাণ লাভের মাধ্যমে সফল হওয়ার সাথে সাথে যাবতীয় পরিস্থিতি কল্যাণময় হবে। আর এর অন্যথা হলে ফলাফল ও বিপরীত হবে।

(১) আল্লাহ তাআলা বলেন :

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اذْكُرُوا اللَّهَ ذِكْرًا كَثِيرًا ﴿41﴾ وَسَبِّحُوهُ بُكْرَةً وَأَصِيلًا ﴿42﴾ ( سورة الأحزاب : 41-42)

হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণ স্মরণ কর। আর সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা বর্ণনা কর। [সূরা আহযাব : ৪১-৪২।]

(২) আল্লাহ আরও বলেন :

وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَى آَمَنُوا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ وَلَكِنْ كَذَّبُوا فَأَخَذْنَاهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ ﴿96﴾ ( سورة الأعراف : 96)

আর যদি জনপদসমূহের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং তাকওয়া অবলম্বন করত তাহলে আমি অবশ্যই আসমান ও যমীন থেকে বরকতসমূহ তাদের উপর খুলে দিতাম; কিন্তু তারা অস্বীকার করল। অত:পর তারা যা অর্জন করত তার কারণে আমি তাদেরকে পাকড়াও করলাম। [সূরা আরাফ: ৯৬।]

৫৮
২- ফেরেশতাকুলের প্রতি ঈমান ঈমান বিল মালাইকার অর্থ হচ্ছে:
অন্তরে এমন দৃঢ়বিশ্বাস রাখা যে, মহান আল্লাহর অনেক ফেরেশতা রয়েছেন। তাঁদের সবার প্রতি আমরা বিশ্বাস স্থাপন করি, যাদের নাম আল্লাহ তাআলা উল্লেখ করেছেন, যেমন জিবরীল প্রমুখ তাদের প্রতি নির্দিষ্টভাবে। আর যাদের নাম উল্লেখ করেননি তাদের প্রতি সামগ্রিকভাবে। এবং এ সকল ফেরেশতাদের কর্ম ও গুণাবলি সম্বন্ধে আমরা যতটুকু জেনেছি সবই বিশ্বাস করি।

৫৯
পদ মর্যাদর দিক থেকে তাঁদের অবস্থান :
তাঁরা বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ ও সম্মানিত বান্দা, সর্বোতভাবে আল্লাহ তাআলার ইবাদত-আনুগত্য সম্পাদনকারী, অবাধ্যতার চি‎হ্নমাত্র নেই তাদের মাঝে। তাদের ভেতর রুবুবিয়্যাত (প্রভুত্ব) বা উলুহিয়্যাত (উপাস্যত্ব) এর কোন বিশেষত্ব নেই। তাঁদের জগত সম্পূর্ণ ভিন্ন ও অদৃশ্য। আল্লাহ তাআলা তাঁদের নূর থেকে সৃষ্টি করেছেন।

৬০
কর্ম ও দায়িত্ব সম্পাদনের দিক থেকে তাঁদের অবস্থা হচ্ছে,
তারা সার্বক্ষনিক আল্লাহ তাআলার ইবাদত করেন। দিবা-রাত্রি তাঁর প্রশংসা, পবিত্রতা ও মহিমা বর্ণনায় ব্যস্ত থাকেন।

وَلَهُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَنْ عِنْدَهُ لَا يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِهِ وَلَا يَسْتَحْسِرُونَ ﴿19﴾ يُسَبِّحُونَ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ لَا يَفْتُرُونَ ﴿20﴾ ( سورة الأنبياء : 19-20)

আর আসমান-যমীনে যারা আছে তারা সবাই তাঁর; আর তাঁর কাছে যারা আছে তারা অহঙ্কার বশত: তাঁর ইবাদত হতে বিমুখ হয় না এবং ক্লান্তিও বোধ করে না। তারা দিন-রাত তাঁর তাসবীহ (পবিত্রতা ও মহিমা) পাঠ করে, তারা শিথিলতা দেখায় না। [সূরা আম্বিয়া-১৯-২০।]

৬১
আনুগত্য ও মান্য করার দিক থেকে তাঁদের অবস্থা :
আল্লাহ তাআলা তাদেরকে তাঁর নির্দেশ পালন করার জন্য পরিপূর্ণ আনুগত্য, এবং তা বাস্তবায়ন করার শক্তি দান করেছেন। তারা সৃষ্টিগতভাবে বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য, কারণ বশ্যতা স্বীকারের প্রকৃতি দিয়ে তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে।

لَا يَعْصُونَ اللَّهَ مَا أَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ ﴿6﴾

তারা আল্লাহ তাআলা যা আদেশ করেন, তা অমান্য করে না এবং যা করতে আদেশ করা হয়, তা-ই করে। [সূরা আত্-তাহরীম : ৬।]

৬২
ফেরেশতাদের সংখ্যা :
ফেরেশতাদের সংখ্যা অনেক; তার সঠিক সংখ্যা আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ জানে না। তাদের মধ্যে আছে আল্লাহর আরশ বহনকারী। জান্নাতের প্রহরী, জাহান্নামের প্রহরী, হেফাজত ও নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনকারী। নেক ও পাপ লেখার কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত ইত্যাদি। তাদের মধ্যে প্রতিদিন সত্তর হাজার করে বাইতুল মা’মুরে সালাত আদায় করার সুযোগ পায় । যারা একবার সালাত আদায় করে তারা দ্বিতীয়বার আর এ সুযোগ পায় না।

মিরাজের ঘটনায় বর্ণিত হয়েছে, নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সপ্তম আকাশে আগমন করলেন : তিনি বলেন-

فرفع لي البيت المعمور فسألت جبريل فقال : هذا البيت المعمور يصلي فيه كل يوم سبعون ألف ملك، إذا خرجوا لم يعودوا إليه آخر ما عليهم . متفق عليه .

আমার সামনে বাইতুল মা’মুর কে তুলে ধরা হল আমি জিবরাঈলকে এ সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন। ‘‘এটি বাইতুল মা’মুর’’। এতে প্রতিদিন সত্তর হাজার ফেরেশতা সালাত আদায় করে। সালাত আদায়ান্তে যখন বের হয় এ উদ্দেশ্যে আর ফিরে আসার সুযোগ হয়না। [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম, বুখারী হাদীস নং ৩২০৭, মুসলিম-১৬২।]

৬৩
ফেরেশতাদের নাম ও কর্ম :
ফেরেশতা আল্লাহ তাআলার এক বিশেষ সম্মানিত বান্দা, তিনি তাদের স্বীয় আনুগত্য ও ইবাদত সম্পাদনের উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন। তাদের সংখ্যা তিনি ব্যতীত আর কেউ জানে না। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাদের কারো কারো নাম ও কর্ম সম্পর্কে জানিয়েছেন আর অবশিষ্টদের সম্পর্কে কেবল তিনিই জানেন। আল্লাহ ফেরেশতাদের দায়িত্বে বিভিন্ন কর্ম অর্পণ করেছেন। একেক দলকে একেক কাজে নিয়োজিত করেছেন। যেমন :

জিবরীল আলাইহিস সালাম: তিনি নবী-রাসূল গণের নিকট ওহী (প্রত্যাদেশ) নিয়ে আসার ব্যাপারে দায়িত্বশীল।

মীকাঈল আলাইহিস সালাম তিনি বৃষ্টি ও উদ্ভিত সংক্রান্ত বিষয়াদির দায়িত্বে নিয়োজিত।

ইসরাফীল আলাইহিস সালাম তিনি শিঙ্গায় ফুঁ দেয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত।

এরা ফেরেশতাদের মাঝে অধিক মর্যাদাসম্পন্ন ও অতি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা জীবন সংক্রান্ত উপায়-উপকরণ বিষয়ক দায়িত্বে নিয়োজিত। যেমন জিবরীল ওহী বিষয়ক দায়িত্বে নিয়োজিত যে ওহীর মাধ্যমে অন্তর জীবন্ত হয়। মীকাঈল বৃষ্টির দায়িত্বে নিয়োজিত যার মাধ্যমে ভূমি নির্জীব হয়ে যাওয়ার পর নতুন জীবন লাভ করে সজীব হয়। ইসরাফীল শিঙ্গায় ফুৎকারের দায়িত্বে নিয়োজিত। যার মাধ্যমে শরীর প্রাণহীন হওয়ার পর পুনরায় জীবন লাভ করবে।

মালেক, জাহান্নাম প্রহরী : তিনি জাহান্নামের দায়িত্বে নিয়োজিত।

রিদওয়ান, জান্নাত রক্ষী : তিনি জান্নাতের দায়িত্বে নিয়োজিত।

মালাকুল মওত : মৃত্যুর সময় রূহ কবজ করার দায়িত্বে নিয়োজিত।

তাঁদের মধ্যে কিছু আছেন যাদের হামালাতুল আরশ বলা হয়। তাঁরা আরশ বহন করে আছেন।

কিছু আছে যাদের খাযানাতুল জান্নাত বলা হয়। যারা জান্নাতের প্রহরায় নিয়োজিত। একদলকে বলা হয় খাযানাতুন্নার। তাঁরা জাহান্নাম প্রহরা দানে নিয়োজিত। কিছু আছে যাদের দায়িত্ব হচ্ছে বনী আদম ও তাদের আমল সংরক্ষণ করা এবং প্রত্যেক ব্যক্তির আমলসমূহ লিপিবদ্ধ করা।

তাঁদের মধ্যে কিছু আছেন যারা সার্বক্ষনিক বান্দার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন। কিছু আছেন যারা পারস্পরিক দিবা-রাত্রি যাওয়া আসা করেন।

কিছু আছেন, যারা ওয়াজ-নসীহত, আলোচনা ও যিকিরের মজলিস খুঁজে ফেরেন।

কিছু আছেন, যারা জড়ায়ূতে ভ্রূনের দায়িত্বে নিয়োজিত। তাঁরা আল্লাহর নির্দেশে তাদের রিযিক, আমল নির্ধারিত হায়াত এবং নেককার হবে না বদকার, ভাগ্যবান হবে না দুর্ভাগা ইত্যাদি লিখার দায়িত্ব সম্পাদন করেন।

কিছু আছেন, যাদের দায়িত্ব হচ্ছে, কবরে, রব, দ্বীন ও নবী সম্বন্ধে প্রশ্ন করা।

এরা ছাড়াও অসংখ্য ফেরেশতা রয়েছেন, যাদের প্রকৃত সংখ্যা আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ জানে না। তিনি প্রত্যেক বস্ত্তর হিসাব ও গণনা সম্পর্কে পরিপূর্ণরূপে অবহিত।

৬৪
লেখার কাজে নিয়োজিত সম্মানিত ফেরেশতাবৃন্দ (কিরামুন কাতিবীন)-এর দায়িত্ব :
আল্লাহ তাআলা লিখার দায়িত্ব পালনকারী কিছু সম্মানিত ফেরেশতা সৃষ্টিা করেছেন। এবং তাঁদেরকে আমাদের উপর তত্ত্বাবধায়ক স্থির করেছেন। তাঁরা কথা, আমল ও নিয়তসমূহ লিখে সংরক্ষণ করেন। প্রতিটি মানুষের সাথে দুজন করে ফেরেশতা থাকেন। ডানপার্শ্বস্থজন তার নেককাজসমূহ লিপিবদ্ধ করেন আর বামপার্শ্বস্থজন লিখেন বদকাজসমূহ।

আরো দুজন আছেন যারা তাকে হিফাজত ও রক্ষাণাবেক্ষণ করেন। এদের একজন থাকেন তার সামনে অন্যজন পেছনে।

১। মহান আল্লাহ বলেন:

وَإِنَّ عَلَيْكُمْ لَحَافِظِينَ ﴿10﴾ كِرَامًا كَاتِبِينَ ﴿11﴾ يَعْلَمُونَ مَا تَفْعَلُونَ ﴿12﴾ ( سورة الإنفطار : 10-12)

আর অবশ্যই তোমাদের উপর সংরক্ষকগণ রয়েছে। সম্মানিত লেখকবৃন্দ। তারা জানে যা তোমরা কর। [সূরা ইনফিতার: ১০-১২।]

২। আল্লাহ আরও বলেন:-

إِذْ يَتَلَقَّى الْمُتَلَقِّيَانِ عَنِ الْيَمِينِ وَعَنِ الشِّمَالِ قَعِيدٌ ﴿17﴾ مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ ﴿18﴾ ( سورة ق : 17-18)

যখন ডানে ও বামে বসা দু’জন লিপিবদ্ধকারী পরস্পর গ্রহণ করবে। সে যে কথাই উচ্চারণ করে তার কাছে সদা উপস্থিত সংরক্ষণকারী আছে। [সূরা ক্বাফ : ১৭-১৮।]

৩। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে :

لَهُ مُعَقِّبَاتٌ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِهِ يَحْفَظُونَهُ مِنْ أَمْرِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا مَا بِأَنْفُسِهِمْ وَإِذَا أَرَادَ اللَّهُ بِقَوْمٍ سُوءًا فَلَا مَرَدَّ لَهُ وَمَا لَهُمْ مِنْ دُونِهِ مِنْ وَالٍ ﴿11﴾ ( سورة الرعد : 11)

মানুষের জন্য রয়েছে, সামনে ও পেছনে, একের পর এক আগমনকারী প্রহরী, যারা আল্লাহর নির্দেশে তাকে হিফাযত করে। নিশ্চয় আল্লাহ কোন কওমের অবস্থা ততক্ষণ পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে। আর যখন আল্লাহ কোন জাতির মন্দ চান, তখন তা প্রতিহত করা যায় না এবং তাদের জন্য তিনি ছাড়া কোন অভিভাবক নেই। [সূরা রা’দ : ১১]

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَأَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ يَقُولُ اللَّهُ إِذَا أَرَادَ عَبْدِي أَنْ يَعْمَلَ سَيِّئَةً فَلَا تَكْتُبُوهَا عَلَيْهِ حَتَّى يَعْمَلَهَا فَإِنْ عَمِلَهَا فَاكْتُبُوهَا بِمِثْلِهَا وَإِنْ تَرَكَهَا مِنْ أَجْلِي فَاكْتُبُوهَا لَهُ حَسَنَةً وَإِذَا أَرَادَ أَنْ يَعْمَلَ حَسَنَةً فَلَمْ يَعْمَلْهَا فَاكْتُبُوهَا لَهُ حَسَنَةً فَإِنْ عَمِلَهَا فَاكْتُبُوهَا لَهُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا إِلَى سَبْعِ مِائَةِ ضِعْفٍ . متفق عليه .

বিশিষ্ট সাহাবী আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, আমার বান্দা যদি পাপকর্ম করার সংকল্প করে তাহলে তোমরা ঐ কর্ম সম্পাদন করার পূর্ব পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে সেটি লিখবে না। যদি সংকল্পকৃত কাজটি সম্পাদন করে ফেলে তাহলে কাজের অনুরূপ একটি পাপ তার আমল নামায় লিখবে। আর যদি আমার সম্মানে উক্ত পাপ কাজ পরিহার করে সংকল্প পরিবর্তন করে তাহলে সেটিকে একটি পরিপূর্ণ হাসানাহ তথা নেককাজ হিসাবে তার আমল নামায় লিখে নাও। আর যদি সে কোন নেককাজ করার সংকল্প করে কাজে রূপান্তরিত করল না তাহলে এর বিনিময়ে তার আমলনামায় একটি পরিপূর্ণ হাসানাহ লেখ। আর যদি উক্ত কাজ সম্পাদন করে তাহলে ঐ এক কাজের বিনিময়ে অনুরূপ দশ থেকে সাতশতগুণ আমলের ছাওয়াব তার আমলনামায় লিপিবদ্ধ কর। [বুখারী ও মুসলিম, বুখারী হাদীস নং ৭৫০১ এবং মুসলিম হাদীস নং ১২৮।]

৬৫
ফেরেশতাদের আকৃতির বিশালতা :-
عن جابر بن عبد الله رضي الله عنهما عن النبي صلى الله عليه وسلم . قال : أذن لي أن أحدث عن ملك من ملائكة الله من حملة العرش . أن ما بين شحمة أذنه إلى عاتقه مسيرة سبعمائة عام . أخرجه ابوداود .

জাবের বিন আব্দুল্লাহ রা. নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমাকে আরশ বহনকারী একজন ফেরেশতা সম্পর্কে বর্ণনা করতে বলা হল যে, তার কানের লতি থেকে কাঁদের দূরত্ব হচ্ছে সাতশত বছরের ভ্রমণ পথ। [ইমাম আবু দাউদ তাঁর কিতাবে হাদীসটি বিশুদ্ধ সনদে বর্ণনা করেছেন। হাদীস নং ৪৭২৭, দেখুন, আস সিলসিলাতুস সহীহা- ক্রমিক নং ১৫১।]

عن عبد الله بن مسعود رضي الله عنه أن محمدا صلى الله عليه وسلم رأى جبريل له ستمائة جناح . متفق عليه .

আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফেরেশতা জিবরীল আলাইহিস সালাম কে দেখেছেন যে, তাঁর ছয়শত পাখা আছে। [বুখারী ও মুসলিম। বুখারী হাদীস নং ৪৮৫৭, মুসলিম হাদীস নং ১৭৪।]

৬৬
ঈমান বিল মালাইকার উপকারিতা :
১। ফেরেশতাকুলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করার মাধ্যমে মহান রাববুল আলামীন আল্লাহ তাআলার বড়ত্ব, মহত্ব, ক্ষমতা, শক্তি, সামর্থ ও প্রজ্ঞা-কৌশল সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। তিনি ফেরেশতা সৃষ্টি করেছেন যাদের সংখ্যা তিনি ব্যতীত আর কেউ জানে না। তাদের মধ্যে হতে আরশ বহনকারী নিযুক্ত করেছেন যাদের একজনের আকৃতি হচ্ছে ‘‘তার কানের লতি হতে কাঁধের দূরত্ব সাতশত বৎসরের ভ্রমণ পথ’’ তাহলে আরশের বিশালতা কিরূপ? আর আরশের উপর যিনি আছেন তাঁর অবস্থা কি? তাঁর বড়ত্ব ও বিশালতা কেমন? সে আল্লাহর মহিমা ও পবিত্রতা বর্ণনা করছি সকল রাজত্ব ও কর্তৃত্ব যার।

وَلَهُ الْكِبْرِيَاءُ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ ﴿37﴾ ( سورة الجاثية : 37)

আর আসমানসমূহ ও যমীনের সকল অহঙ্কার তাঁর; তিনি মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। [সূরা জাছিয়া-৩৭।]

২। আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদেরকে মানবজাতির রক্ষণাবেক্ষণ, সাহায্য ও আমল লেখার কাজে নিয়োজিত করার মাধ্যমে তাদের উপর যে অনুগ্রহ করেছেন তার উপর আল্লাহর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগ পাওয়া যায় এবং এর জন্য মনে তাগিদ অনুভূত হয়।

৩। ফেরেশতাকুলের প্রতি মুহাববত সৃষ্টি হয় কারণ তাঁরা আল্লাহ তাআলার ইবাদত সম্পাদন করে, আল্লাহর নিকট দুআ করে এবং মুমিনদের জন্য গুনাহ মার্জনার প্রার্থনা করে। যেমন আল্লাহ তাআলা আরশ বহনকারী ফেরেশতাদের সম্বন্ধে বলেছেন।

الَّذِينَ يَحْمِلُونَ الْعَرْشَ وَمَنْ حَوْلَهُ يُسَبِّحُونَ بِحَمْدِ رَبِّهِمْ وَيُؤْمِنُونَ بِهِ وَيَسْتَغْفِرُونَ لِلَّذِينَ آَمَنُوا رَبَّنَا وَسِعْتَ كُلَّ شَيْءٍ رَحْمَةً وَعِلْمًا فَاغْفِرْ لِلَّذِينَ تَابُوا وَاتَّبَعُوا سَبِيلَكَ وَقِهِمْ عَذَابَ الْجَحِيمِ ﴿7﴾ رَبَّنَا وَأَدْخِلْهُمْ جَنَّاتِ عَدْنٍ الَّتِي وَعَدْتَهُمْ وَمَنْ صَلَحَ مِنْ آَبَائِهِمْ وَأَزْوَاجِهِمْ وَذُرِّيَّاتِهِمْ إِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ ﴿8﴾ وَقِهِمُ السَّيِّئَاتِ وَمَنْ تَقِ السَّيِّئَاتِ يَوْمَئِذٍ فَقَدْ رَحِمْتَهُ وَذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ ﴿9﴾ ( سورة غافر : 7-9)

যারা আরশকে ধারণ করে এবং যারা এর চার পাশে রয়েছে, তারা তাদের রবের প্রশংসাসহ তাসবীহ পাঠ করে এবং তাঁর প্রতি ঈমান রাখে। আর মুমিনদের জন্য ক্ষমা চেয়ে বলে, ‘হে আমাদের রব, আপনি রহমত ও জ্ঞান দ্বারা সব কিছুকে পরিব্যপ্ত করে রয়েছেন। অতএব যারা তাওবা করে এবং আপনার পথ অনুসরণ করে আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিন। আর জাহান্নামের আযাব থেকে আপনি তাদেরকে রক্ষা করুন। হে আমাদের রব, আর আপনি তাদেরকে স্থায়ী জান্নাতে প্রবেশ করান, যার ওয়াদা আপনি তাদেরকে দিয়েছেন। আর তাদের পিতা-মাতা, পতি-পত্নি ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে যারা সৎকর্ম সম্পাদন করেছে তাদেরকেও। নিশ্চয় আপনি মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। আর আপনি তাদের অপরাধের আযাব হতে রক্ষা করুন এবং সেদিন আপনি যাকে অপরাধের আযাব হতে রক্ষা করবেন, অবশ্যই তাকে অনুগ্রহ করবেন। আর এটিই মহাসাফল্য। [সূরা গাফের : ৭-৯।]

৬৭
৩- কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান
‘ঈমান বিল কুতুব’-এর অর্থ হচ্ছে, এমন দৃঢ় ও অটল বিশ্বাস রাখা যে, আল্লাহ তাআলা স্বীয় নবী-রাসূলগণের উপর নিজ বান্দাদের হেদায়াতের উদ্দেশ্যে অসংখ্য কিতাব অবতীর্ণ করেছেন। এ সকল কিতাব তাঁর কালাম বিশেষ। এসব কিতাব যেসকল বিষয়বস্ত্ত ধারণ করেছে, সবই হক ও সত্য তাতে কোন সন্দেহ নেই। এর কিছু কিছু আল্লাহ তাআলা স্বীয় কিতাবে নামসহ উল্লেখ করেছেন। এছাড়াও আরো অনেক আছে যার সংখ্যা ও নাম আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ জানে না।

৬৮
কুরআনে উল্লেখকৃত ঐশী গ্রন্থসমূহের সংখ্যা :
আল্লাহ তাআলা মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি নিম্নোক্ত গ্রন্থাদি অবতীর্ণ করেছেন।

১। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর সহীফা সমগ্র।

২। তাওরাত, এটি আল্লাহ তাআলা মূসা আলাইহিস সালামের উপর অবতীর্ণ করেছেন।

৩। যাবুর, এটি আল্লাহ তাআলা দাউদ আলাইহিস সালামের উপর অবতীর্ণ করেছেন।

৪। ইঞ্জীল এটি আল্লাহ তাআলা ঈসা আলাইহিস সালামের উপর অবতীর্ণ করেছেন।

৫। আল কুরআন এ মহগ্রন্থ আল্লাহ তাআলা সমগ্র মানুষের কল্যাণের জন্য নবীশ্রেষ্ঠ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর অবতীর্ণ করেছেন।

পূর্ববর্তী ঐশী গ্রন্থাদির উপর ঈমান ও তদানুযায়ী আমল করার বিধান :

আমরা বিশ্বাস করি যে, আল্লাহ তাআলা এসব গ্রন্থাদি অবতীর্ণ করেছেন। এসব গ্রন্থে বর্ণিত সকল সংবাদ ও তথ্যাবলিকে আমরা স্বীকৃতি প্রদান করি। যেমন কুরআনের তথ্যাবলি এবং পূর্ববর্তী গ্রন্থাবলিতে বর্ণিত অবিকৃত তথ্যাবলি। সেসব গ্রন্থে বর্ণিত বিধানাবলির যেগুলো রহিত হয়নি সেগুলোর উপর পূর্ণ সম্মতি ও সন্তুষ্টির সাথে আমরা আমল করি। আর যেসব গ্রন্থের নাম আমরা জানতে পারিনি সেসবের উপর সামগ্রিকভাবে ঈমান রাখি।

৬৯
পূর্ববর্তী সকল গ্রন্থ যেমন তাওরাত, যাবুর, ইঞ্জীল ইত্যাদি কুরআনুল কারীমের কারণে রহিত হয়ে গিয়েছে।
যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ الْكِتَابِ وَمُهَيْمِنًا عَلَيْهِ فَاحْكُمْ بَيْنَهُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ عَمَّا جَاءَكَ مِنَ الْحَقِّ لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ لَجَعَلَكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَلَكِنْ لِيَبْلُوَكُمْ فِي مَا آَتَاكُمْ فَاسْتَبِقُوا الْخَيْرَاتِ إِلَى اللَّهِ مَرْجِعُكُمْ جَمِيعًا فَيُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ فِيهِ تَخْتَلِفُونَ ﴿48﴾ ( سورة المائدة : 48)

আর আমি তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি যথাযথভাবে, এর পূর্বের কিতাবের সত্যায়নকারী ও এর উপর তদারককারীরূপে। সুতরাং আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তুমি তার মাধ্যমে ফয়সালা কর এবং তোমার নিকট যে সত্য এসেছে, তা ত্যাগ করে তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ কর না। তোমাদের প্রত্যেকের জন্য আমি নির্ধারণ করেছি শরিয়ত ও স্পষ্ট পন্থা এবং আল্লাহ যদি চাইতেন, তবে তোমাদেরকে এক উম্মত বানাতেন। কিন্তু তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন, তাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে চান। সুতরাং তোমরা ভাল কাজে প্রতিযোগিতা কর। আল্লাহর দিকেই তোমাদের সবার প্রত্যাবর্তনস্থল। অত:পর তিনি তোমাদেরকে অবহিত করবেন, যা নিয়ে তোমরা মতবিরোধ করতে। [সূরা মায়েদা: ৪৮।]

৭০
আহলে কিতাবদের নিকট বিদ্যমান গ্রন্থাদির হুকুম :
বর্তমান সময়ে আহলে কিতাব তথা ইয়াহুদী ও খৃষ্টানদের নিকট তাওরাত ও ইঞ্জীল নামে যে কিতাব রয়েছে, এর ভেতর বর্ণিত সকল বিষয়কে নবী ও রাসূলগণের দিকে সম্বন্ধযুক্ত করা ঠিক নয়। কারণ এগুলোতে অনেক বিকৃতি ও পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। যেমন মহান আল্লাহ তাআলার দিকে সন্তানাদিকে সম্বন্ধযুক্ত করে তারা বলে যে, ঈসা ও ওযায়ের আল্লাহর পুত্র (নাউযুবিল্লাহ) এবং এ ধরণের অসার ও বাতিল কথাবার্তা। খৃষ্টানরা নবী ঈসা বিন মারইয়ামকে উপাস্য স্থির করেছে, মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলাকে এমনগুণে গুণান্বিত করেছে যা কোনভাবেই তাঁর শান ও বড়ত্বের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়নি এবং নবীদের বিরুদ্ধে অপবাদ-দুর্নাম রটনা করেছে ইত্যাদি এগুলো সবই তাদের বানানো, নবীগণ এসন কিছুই বলেননি। সুতরাং এসকল বাতুলতাকে খন্ডন ও প্রত্যাখ্যান করা এবং কুরআন-সুন্নাহ যেসব বিষয় সমর্থন করেছে সেগুলো ব্যতীত অন্য সবকিছুকে অবিশ্বাস করা অপরিহার্যভাবে জরুরি।

আহলে কিতাব আমাদেরকে কোন কিছু বর্ণনা করলে আমরা সেগুলোর সত্যায়নও করবনা এবং মিথ্যাও প্রতিপন্ন করব না। আমরা বলব : أمنا بالله وكتبه ورسله (আমরা আল্লাহ, তাঁর নাযিলকৃত গ্রন্থাদি ও প্রেরিত রাসূলগণের উপর ঈমান এনেছি।)

তাদের বর্ণনাকৃত বিষয় যদি সত্য হয় আমরা তা মিথ্যা বলব না আর তারা যা বলে সেগুলো যদি অসত্য হয় আমরা তা সত্য বলব না।

৭১
কুরআনুল কারীমের উপর ঈমান আনা এবং তদানুযায়ী আমল করার বিধান
‘আল-কুরআনুল কারীম’ আল্লাহ তাআলার নাযিলকৃত সর্বশেষ কিতাব। মহান আল্লাহ এটি সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ-নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর নাযিল করেছেন।

এটি নাযিলকৃত আসমানি গ্রন্থাবলির মধ্যে সর্বশেষ মর্যাদা ও গুরুত্বের দিক থেকে সবচেয়ে বড়, তথ্যাবলির বিচারে সর্বাধিক পরিপূর্ণ এবং দলীল প্রমাণের দিক থেকে সর্বাপেক্ষা মজবুত গ্রন্থ।

মহান আল্লাহ একে প্রত্যেক বস্ত্তর সুস্পষ্ট বর্ণনাকারী, বিশ্ব জগতের জন্য রহমত ও হেদায়াত (সৎপথ প্রদর্শক) করে নাযিল করেছেন।

এটি সর্বাপেক্ষা মর্যাদাপূর্ণ কিতাব। একে নিয়ে অবতরণ করেছেন সর্বশ্রেষ্ঠ ফেরেশতা জিবরীল আলাইহিস সালাম সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর। এবং তার মাধ্যমে সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত মুসলমানদের উপর, যাদের বের করা হয়েছে মানবতার কল্যাণের জন্য। যা হল সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বাধিক বিশুদ্ধ ও সুস্পষ্ট আরবী ভাষায়।

তাই প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য একে বিশ্বাস করা, এর উপর ঈমান আনা, এর বিধি-বিধান অনুযায়ী আমল করা এবং এর শিক্ষা ও সভ্যতায় শিক্ষিত ও সভ্য হওয়া একান্ত জরুরী। এ গ্রন্থ অবতীর্ণ হওয়ার পর একে বাদ দিয়ে অন্য গ্রন্থানুযায়ী আমল করলে আল্লাহ গ্রহণ করবেন না। মহান আল্লাহ তাআলা এর সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন এবং পরিবর্তন-বিকৃতি ও হ্রাস-বৃদ্ধি সাধন থেকে রক্ষা করেছেন ও নিরাপদ রেখেছেন।

১। আল্লাহ তাআলা বলেন,

إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ ﴿9﴾ ( سورة الحجر : 9)

নিশ্চয় আমিই এ উপদেশ গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষণকারী। [সূরা হিজর-৯।]

২। অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে :

وَإِنَّهُ لَتَنْزِيلُ رَبِّ الْعَالَمِينَ ﴿192﴾ نَزَلَ بِهِ الرُّوحُ الْأَمِينُ ﴿193﴾ عَلَى قَلْبِكَ لِتَكُونَ مِنَ الْمُنْذِرِينَ ﴿194﴾ بِلِسَانٍ عَرَبِيٍّ مُبِينٍ ﴿195﴾ ( سورة الشعراء : 192-195)

আর নিশ্চয় এ কুরআন সৃষ্টিকুলের রবেরই নাযিলকৃত। বিশ্বস্ত আত্মা (জিবরীল) এটা নিয়ে অবতরণ করেছে। তোমার হৃদয়ে, যাতে তুমি সতর্ককারীদের অন্তর্ভুক্ত হও। সুস্পষ্ট আরবী ভাষায়। [সূরা আশ-শোআরা : ১৯২-১৯৫।]

৭২
কুরআনের আয়াতসমূহের নির্দেশনা :
কুরআনের আয়াত যাতে রয়েছে সকল বিষয়ের সুস্পষ্ট বিবরণ। এগুলো হয়ত খবর অর্থাৎ তথ্য প্রদান বিষয়ক অথবা তলব তথা দাবি ও আবেদন বিষয়ক।

৭৩
খবর দুই প্রকার :
১। হয়ত সৃষ্টিকর্তা, তাঁর নাম, গুণাবলি, কর্ম ও বাণী বিষয়ক তথ্য প্রদান করা হয়েছে। অর্থাৎ মহান আল্লাহ তাআলা সম্পর্কীত তথ্য।

২। অথবা সৃষ্টিকুল যেমন আকাশ, পৃথিবী, আরশ, কুরসী মানুষ, জীবজন্তু, উদ্ভিদ-তৃণ, জান্নাত ও জাহান্নাম বিষয়ক তথ্য। অনুরূপভাবে নবী-রাসূল, তাঁদের অনুসারী ও বিরুদ্ধবাদী এবং উভয় দলের প্রতিদান-প্রতিফল এবং এজাতীয় তথ্য প্রদান করা হয়েছে।

৭৪
তলব (আহবান-দাবী) দুই প্রকার :
(১) হয়ত এককভাবে আল্লাহ তাআলার ইবাদত, তিনিও তাঁর রাসূলের আনুগত্য বিষয়ক নির্দেশ ও আহবান, অনুরূপভাবে আল্লাহ তাআলার নির্দেশ যথা সালাত, সিয়াম, ইত্যাদির বাস্তবায়নের নির্দেশ।

(২) অথবা আল্লাহর সাথে শিরক করা থেকে নিষেধ এবং আল্লাহ কর্তৃক হারামকৃত বিষয় যথা সুদ, অশ্লীল কার্যাবলি ইত্যাদি নিষিদ্ধকাজ থেকে সতর্ক করণ।

আল্লাহ তাআলার শত কোটি প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা, আর শত সহস্র দয়া ও অনুগ্রহ তাঁরই, কারণ তিনি আমাদের নিকট সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল প্রেরণ করেছেন। সর্বাপেক্ষা উত্তম ও সম্মানিত কিতাব নাযিল করেছেন এবং আমাদেরকে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম উম্মত বানিয়েছেন, যাদেরকে মানবতার কল্যাণ ও উন্নতি সাধনের উদ্দেশ্যে বের করা হয়েছে।

(১) আল্লাহ তাআলা বলেন

اللَّهُ نَزَّلَ أَحْسَنَ الْحَدِيثِ كِتَابًا مُتَشَابِهًا مَثَانِيَ تَقْشَعِرُّ مِنْهُ جُلُودُ الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ ثُمَّ تَلِينُ جُلُودُهُمْ وَقُلُوبُهُمْ إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ ذَلِكَ هُدَى اللَّهِ يَهْدِي بِهِ مَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُضْلِلِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِنْ هَادٍ ﴿23﴾ ( سورة الزمر : 23)

আল্লাহ নাযিল করেছেন উত্তম বাণী, সাদৃশ্যপূর্ণ একটি কিতাব (আর-কুরআন), যা বারবার আবৃত্তি করা হয়। যারা তাদের রবকে ভয় করে, তাদের গা এতে শিহরিত হয়, তারপর তাদের দেহ ও মন আল্লাহর স্মরণে বিনম্র হয়ে যায়। এটা আল্লাহর হিদায়াত, তিনি যাকে চান তাকে এর দ্বারা হেদায়াত করেন। আর আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তার জন্য কোন হেদায়াতকারী নেই। [সূরা আল যুমার : ২৩। সূরা আলে ইমরান : ১৬৪।]

(২) আল্লাহ তাআলা আরও বলেন:

لَقَدْ مَنَّ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِنْ أَنْفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آَيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُبِينٍ ﴿164﴾ ( سورة آل عمران : 164)

অবশ্যই আল্লাহ মুমিনদের উপর অনুগ্রহ করেছেন, যখন তিনি তাদের মধ্য থেকে তাদের প্রতি একজন রাসূল পাঠিয়েছেন, যে তাদের কাছে তাঁর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে আর তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয়। যদিও তারা ইত:পূর্বে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে ছিল। []

৭৫
৪- রাসূলগণের প্রতি ঈমান
ঈমান বিররুসুলের অর্থ হচ্ছে, এ দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করা যে, আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক জাতির নিকট -তাদের এক আল্লাহর ইবাদত এবং তিনি ছাড়া সকল উপাস্যদের অস্বীকার করার প্রতি আহবান করার জন্য- রাসূলদের প্রেরণ করেছেন। এবং এ বিশ্বাসপোষণ করা যে, তাঁরা প্রত্যেকেই আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত এবং সকলেই সত্যবাদী। আল্লাহ যে দায়িত্ব ও প্রত্যাদেশ দিয়ে তাদের প্রেরণ করেছেন তাঁরা প্রত্যেকেই তা মানুষের নিকট পৌঁছে দিয়েছেন অত্যন্ত নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও পূর্ন আমানতদারিতার সাথে। তাদের মধ্যে কিছু আছেন, যাদের নাম আল্লাহ আমাদের জানিয়েছেন। আবার অনেক আছেন যাদের নাম শুধুমাত্র আল্লাহ তাআলাই জানেন।

৭৬
আম্বিয়া ও তাঁদের অনুসারীদের প্রশিক্ষণ দান :
আল্লাহ তাআলা আম্বিয়া ও তাঁদের অনুসারীদের নিজ তত্ত্বাবধানে রেখে এভাবে গড়ে তুলেছেন যে, তারা প্রথমে নিজ নিজ নফসের উপর মুজাহাদা ও পরিশ্রম করবে। যাতে করে ইবাদত, তাযকিয়া (আত্মশুদ্ধি), চিন্তা-গবেষণা, দ্বীনের খাতিরে ত্যাগ ও ধৈর্য্যশীলতা এবং আল্লাহর কালিমা বুলন্দ করার উদ্দেশ্যে ব্যয় ও বর্জন- বিষয়ে ঈমান অর্জিত হয়। এতে প্রথমে তাদের জীবনে ঈমান পূর্ণতা পাবে এবং অন্তরে এ বিশ্বাস সুদৃঢ় হবে যে, আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক বস্ত্তর সৃষ্টিকর্তা, সবকিছুর কর্তৃত্ব তাঁরই হাতে এবং তিনিই এককভাবে সকল ইবাদতের উপযুক্ত। অতঃপর উপযুক্ত পরিবেশের মাধ্যমে ঈমান সংরক্ষণের ব্যাপারে পরিশ্রম করবে যেমন ঈমান ও নেক আমল দ্বারা আবাদকৃত মসজিদসমূহ।

এরপর দ্বীন ও নিজেদের প্রয়োজন মিটানোর নিমিত্তে ঈমান থেকে উপকৃত হওয়ার ব্যাপারে চেষ্টা করবে এবং এ বিশ্বাস মনে বদ্ধমূল করবে যে, তারা যেখানেই থাকুক না কেন আল্লাহ তাদের সাথেই আছেন। তাদের সাহায্য করেন। রিযিক দান করেন এবং শক্তি যোগান, সমর্থন করেন যেমন বদর, মক্কা বিজয়, হুনায়ন ইত্যাদি যুদ্ধে মুসলমানদের সাহায্য করেছিলেন। এবং আল্লাহর উপরই ভরসা করবে। তিনি ব্যতীত আর কারো উপর ভরসা করবে না। অতঃপর স্বীয় জাতি ও যাদের নিকট তাঁরা প্রেরিত হয়েছেন তাঁদের মধ্যে ঈমান প্রচার ও প্রসারে আত্মনিয়োগ করবে যাতে তারা একমাত্র আল্লাহ তাআলার ইবাদত করে। তাদেরকে দ্বীনের আহকাম ও বিধি-বিধান শিক্ষা দিবে এবং স্বীয় প্রতিপালকের নিদর্শনাবলি তেলাওয়াত করে শুনাবে।

আল্লাহ তাআলা বলেন :

هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آَيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُبِينٍ ﴿2﴾ وَآَخَرِينَ مِنْهُمْ لَمَّا يَلْحَقُوا بِهِمْ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ ﴿3﴾ ذَلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ ﴿4﴾ ( سورة الجمعة : 2-4)

তিনিই (নিরক্ষর অর্থাৎ আরব জাতি) উম্মীদের মাঝে একজন রাসূল পাঠিয়েছেন তাদের মধ্য থেকে, যে তাদের কাছে তেলাওয়াত করে তাঁর আয়াতসমূহ, তাদেরকে পবিত্র করে এবং তাদেরকে শিক্ষা দেয় কিতাব ও হিকমত। যদিও ইত:পূর্বে তারা স্পষ্ট গোমরাহীতে ছিল। এবং তাদের মধ্য হতে অন্যান্যদের জন্যও, (এ রাসূলকেই পাঠানো হয়েছে) যারা এখনো তাদের সাথে মিলিত হয়নি। আর তিনিই মহা প্ররাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা তিনি তা দান করেন। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহের অধিকারী। [সূরা জুমুআহ : ২-৪।]

الرسول : রাসূল হচ্ছেন, যাকে আল্লাহ তাআলা নতুন শরিয়ত দিয়ে প্রেরণ করেছেন এবং এ শরিয়ত সম্পর্কে যারা জানে না কিংবা জেনেও বিরোধিতা করে তাদের নিকট প্রচার করার নির্দেশ দিয়েছেন।

النبي : নবী বলা হয়, যাকে আল্লাহ তাআলা পূর্ববর্তী শরিয়ত দিয়েই প্রেরণ করেছেন। তাঁর দায়িত্ব হচেছ তিনি তাঁর চার পাশে অবস্থানরত উক্ত শরিয়তাবলম্বীদেরকে সে শরিয়ত শিক্ষা দেবেন এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করবেন। উল্লেখিত সংজ্ঞা থেকে পরিস্কার হল যে, প্রত্যেক রাসূল নবী তবে প্রত্যেক নবী রাসূল নন।

৭৭
নবী-রাসূল প্রেরণ :
পৃথিবীতে যত জাতির আবির্ভাবই ঘটেছে কোন জাতিই কখনো নবী-রাসূল শূন্য ছিল না, সকল জাতির নিকটই আল্লাহ তাআলা হয়ত স্বতন্ত্র শরিয়ত দিয়ে স্বতন্ত্র একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন অথবা পূর্ববর্তী শরিয়ত প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধনের ক্ষমতাদিয়ে (পুনরাম্ভের জন্য) একজন নবী পাঠিয়েছেন।

আল্লাহ তাআলা বলেন :

وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ ﴿36﴾ ( سورة النحل : 36)

আমি প্রত্যেক জাতির নিকটই রাসূল প্রেরণ করেছি এ মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাগুত বর্জন কর। [সূরা আন-নাহল:৩৬।]

আল্লাহ আরো বলেন,

إِنَّا أَنْزَلْنَا التَّوْرَاةَ فِيهَا هُدًى وَنُورٌ يَحْكُمُ بِهَا النَّبِيُّونَ الَّذِينَ أَسْلَمُوا لِلَّذِينَ هَادُوا وَالرَّبَّانِيُّونَ وَالْأَحْبَارُ ﴿44﴾ ( سورة المائدة : 44)

নিশ্চয় আমি তাওরাত নাযিল করেছি, তাতে ছিল হিদায়াত ও আলো, এর মাধ্যমে ইয়াহূদীদের জন্য ফয়সালা প্রদান করত অনুগত নবীগণ এবং রববানী ও ধর্মবিদগণ। [সূরা আল- মায়েদা : ৪৪।]

৭৮
নবী ও রাসূলগণের সংখ্যা :
নবী ও রাসূলদের (আলাইহিমুস সালাতু ওয়াসসালাম) সংখ্যা অনেক।

১। তাঁদের মধ্যে কিছু আছেন, পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাদের নাম ও ঘটনাবলি সম্পর্কে বলেছেন। তাঁদের সংখ্যা মোট পঁচিশ।

আদম আলাইহিস সালাম ।

وَلَقَدْ عَهِدْنَا إِلَى آَدَمَ مِنْ قَبْلُ فَنَسِيَ وَلَمْ نَجِدْ لَهُ عَزْمًا ﴿115﴾ ( سورة طه : 115)

আর আমি ইতিপূর্বে আদমের প্রতি নির্দেশ দিয়েছিলাম; কিন্তু সে তা ভুলে গিয়েছিল এবং আমি তার মধ্যে সংকল্পে দৃঢ়তা পাইনি। [সূরা ত্বা-হা: ১১৫।]

নিম্নোক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা কয়েকজন নবীর নাম উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে :

وَتِلْكَ حُجَّتُنَا آَتَيْنَاهَا إِبْرَاهِيمَ عَلَى قَوْمِهِ نَرْفَعُ دَرَجَاتٍ مَنْ نَشَاءُ إِنَّ رَبَّكَ حَكِيمٌ عَلِيمٌ ﴿83﴾ وَوَهَبْنَا لَهُ إِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ كُلًّا هَدَيْنَا وَنُوحًا هَدَيْنَا مِنْ قَبْلُ وَمِنْ ذُرِّيَّتِهِ دَاوُودَ وَسُلَيْمَانَ وَأَيُّوبَ وَيُوسُفَ وَمُوسَى وَهَارُونَ وَكَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ ﴿84﴾ وَزَكَرِيَّا وَيَحْيَى وَعِيسَى وَإِلْيَاسَ كُلٌّ مِنَ الصَّالِحِينَ ﴿85﴾ وَإِسْمَاعِيلَ وَالْيَسَعَ وَيُونُسَ وَلُوطًا وَكُلًّا فَضَّلْنَا عَلَى الْعَالَمِينَ ﴿86﴾ وَمِنْ آَبَائِهِمْ وَذُرِّيَّاتِهِمْ وَإِخْوَانِهِمْ وَاجْتَبَيْنَاهُمْ وَهَدَيْنَاهُمْ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ ﴿87﴾ ذَلِكَ هُدَى اللَّهِ يَهْدِي بِهِ مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ وَلَوْ أَشْرَكُوا لَحَبِطَ عَنْهُمْ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ ﴿88﴾ أُولَئِكَ الَّذِينَ آَتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ وَالْحُكْمَ وَالنُّبُوَّةَ فَإِنْ يَكْفُرْ بِهَا هَؤُلَاءِ فَقَدْ وَكَّلْنَا بِهَا قَوْمًا لَيْسُوا بِهَا بِكَافِرِينَ ﴿89﴾ ( سورة الأنعام : 83-89)

আর এ হচ্ছে আমার দলীল, আমি তা ইবরাহীমকে তার কওমের উপর দান করেছি। আমি যাকে চাই, তাকে মর্যাদায় উঁচু করি। নিশ্চয় তোমার রব প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ। আর আমি তাকে দান করেছি ইসহাক ও ইয়াকূবকে। প্রত্যেককে আমি হিদায়াত দিয়েছি এবং নূহকে পূর্বে হিদায়াত দিয়েছি। আর তার সন্তানদের মধ্য থেকে দাঊদ, সুলাইমান, আইয়ূব, ইউসুফ, মূসা ও হারূনকে। আর আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদেরকে প্রতিদান দেই। আর যাকারিয়্যা, ইয়াহইয়া, ঈসা ও ইলয়াসকে। প্রত্যেকেই নেককারদের অন্তর্ভুক্ত। আর ইসমাঈল, আল ইয়াসা’, ইউনুস ও লূতকে। প্রত্যেককে আমি সৃষ্টিকুলের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি। আর (আমি হিদায়াত দান করেছি) তাদের পিতৃপুরুষ, বংশধর ও ভাইদের মধ্য থেকে, আর তাদেরকে আমি বাছাই করেছি এবং তাদেরকে সরল পথের দিকে পরিচালিত করেছি। এ হচ্ছে আল্লাহর হিদায়াত, এ দ্বারা তিনি নিজ বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা হিদায়াত করেন। আর যদি তারা শিরক করত, তবে তারা যা আমল করছিল তা অবশ্যই বরবাদ হয়ে যেত। এরাই তারা, যাদেরকে আমি দান করেছি কিতাব, হুকুম ও নবুওয়ত। অতএব যদি তারা এর সাথে কুফরী করে, তবে আমি এগুলোর তত্ত্বাবধায়ক এমন কওমকে করেছি, যারা এর ব্যাপারে কাফির নয়। [সূরা আনআম : ৮৩-৮৯।]

ইদরীস আলাইহিস সালাম।

وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ إِدْرِيسَ إِنَّهُ كَانَ صِدِّيقًا نَبِيًّا ﴿56﴾ ( سورة مريم : 56)

আর স্মরণ কর এই কিতাবে ইদরীসকে। সে ছিল পরম সত্যনিষ্ঠ নবী। [সূরা মারয়াম : ৫৬।]

৪। হুদ আলাইহিস সালাম।

كَذَّبَتْ عَادٌ الْمُرْسَلِينَ ﴿123﴾ إِذْ قَالَ لَهُمْ أَخُوهُمْ هُودٌ أَلَا تَتَّقُونَ ﴿124﴾ إِنِّي لَكُمْ رَسُولٌ أَمِينٌ ﴿125﴾

আ’দ জাতি রাসূলগণকে অস্বীকার করেছিল, যখন তাদের ভাই হূদ তাদেরকে বলেছিল, তোমরা কি তাকওয়া অবলম্বন করবে না? নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য একজন বিশ্বস্ত রাসূল। [সূরা শুআরা : ১২৩-১২৫।]

৫। সালেহ আলাইহিস সালাম।

كَذَّبَتْ ثَمُودُ الْمُرْسَلِينَ ﴿141﴾ إِذْ قَالَ لَهُمْ أَخُوهُمْ صَالِحٌ أَلَا تَتَّقُونَ ﴿142﴾ إِنِّي لَكُمْ رَسُولٌ أَمِينٌ ﴿143﴾ ( سورة الشعراء : 141-143)

সামূদ জাতি রাসূলদেরকে অস্বীকার করেছিল, যখন তাদের ভাই সালেহ তাদেরকে বলেছিল, তোমরা কি তাকওয়া অবলম্বন করবে না? নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য এক বিশবস্ত রাসূল। [সূরা শু’আরা : ১৪১-১৪৩।]

৬। শুআইব আলাইহিস সালাম।

كَذَّبَ أَصْحَابُ الْأَيْكَةِ الْمُرْسَلِينَ ﴿176﴾ إِذْ قَالَ لَهُمْ شُعَيْبٌ أَلَا تَتَّقُونَ ﴿177﴾ إِنِّي لَكُمْ رَسُولٌ أَمِينٌ ﴿178﴾ ( سورة الشعراء : 176-178)

আইকার অধিবাসীরা রাসূলদেরকে অস্বীকার করেছিল। যখন শুআইব তাদেরকে বলল, তোমরা কি তাকওয়া অবলম্বন করবে না? নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য এক বিশ্বস্ত রাসূল। [সূরা শু’আরা : ১৭৬-১৭৮।]

৭। যুলকিফল আলাইহিস সালাম।

وَاذْكُرْ إِسْمَاعِيلَ وَالْيَسَعَ وَذَا الْكِفْلِ وَكُلٌّ مِنَ الْأَخْيَارِ ﴿48﴾ ( سورة ص : 48)

আরো স্মরণ কর, ইসমাইল, ইয়াসা’আ ও যুল-কিফলের কথা। এরা প্রত্যেকেই ছিল সর্বোত্তমদের অন্তর্ভুক্ত। [সূরা সোয়াদ : ৪৮।]

৮। নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

আল্লাহ বলেন,

مَا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِنْ رِجَالِكُمْ وَلَكِنْ رَسُولَ اللَّهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ وَكَانَ اللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًا ﴿40﴾ ( سورة الأحزاب : 40)

মুহাম্মদ তোমাদের কোন পুরুষের পিতা নয়; তবে আল্লাহর রাসূল ও সর্বশেষ নবী। আর আল্লাহ সকল বিষয়ে সর্বজ্ঞ। [সূরা আহযাব : ৪০।]

(২) নবী ও রাসূলগণের মধ্যে অনেক আছেন যাদের নাম-পরিচয় আমরা জানি না। এঁদের ঘটনাবলি সম্পর্কে আল্লাহ আমাদের কিছুই জানাননি। আমরা তাঁদের প্রতি সাধারণভাবে ঈমান আনি।

১। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلًا مِنْ قَبْلِكَ مِنْهُمْ مَنْ قَصَصْنَا عَلَيْكَ وَمِنْهُمْ مَنْ لَمْ نَقْصُصْ عَلَيْكَ وَمَا كَانَ لِرَسُولٍ أَنْ يَأْتِيَ بِآَيَةٍ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ فَإِذَا جَاءَ أَمْرُ اللَّهِ قُضِيَ بِالْحَقِّ وَخَسِرَ هُنَالِكَ الْمُبْطِلُونَ ﴿78﴾ ( سورة غافر : 78)

আর অবশ্যই আমি তোমার পূর্বে অনেক রাসূল পাঠিয়েছি। তাদের মধ্যে কারো কারো কাহিনী আমি তোমার কাছে বর্ণনা করেছি আর কারো কারো কাহিনী আমি তোমার কাছে বর্ণন করিনি। আর আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোন নিদর্শন নিয়ে আসা কোন রাসূলের উচিৎ নয়। তারপর যখন আল্লাহর নির্দেশ আসবে, তখন ন্যায়সঙ্গতভাবে ফয়সালা করা হবে। আর তখনই বাতিলপন্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। [সূরা গাফের : ৭৮।]

عن أبي أمامة رضي الله عنه قال : قال أبوذر رضي الله عنه قلت : يا رسول الله كم وفى عدة الأنبياء ؟ قال : مائة ألف وأربعة وعشرون ألفا، الرسل من ذلك ثلاث مائة وخمسة عشر جما غفيرا . اخرجه أحمد والطبرانى .

আবু উমামাহ রা. বর্ণনা করেছেন, আবু যর রা. বলেন আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললাম! ইয়া রাসূলাল্লাহ, নবীগণের সংখ্যা কততে এসে পূর্ণতা পেয়েছে ? অর্থাৎ নবীদের মোট সংখ্যা কত? নবীজী বললেন! একলক্ষ চবিবশ হাজার। এদের মধ্যে একটি বিশাল দল হচ্ছেন রাসূল যাঁদের সংখ্যা তিনশত পনের। [হাদীসের সনদ সহীহ লিগাইরিহী। বর্ণনায় আহমদ হাদীস নং ২২৬৪৪ এবং ত্ববরানী হাদীস নং ৮ / ২১৭। দেখুন সিলসিলাতুস সহীহাহ : ২৬৬৮]

৭৯
দৃঢ় প্রতিজ্ঞ-সাহসী রাসূলবৃন্দ : أولو العزم من الرسل
উলূল আযম তথা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ-সাহসী রাসূল হচ্ছে পাঁচজন। তাঁরা হলেন নবী নূহ, ইবরাহীম, মূসা এবং মুহাম্মদ আলাইহিমুস সালাতু ওয়াস সালাম। নিম্নোক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাঁদের আলোচনা করেছেন।

شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ كَبُرَ عَلَى الْمُشْرِكِينَ مَا تَدْعُوهُمْ إِلَيْهِ اللَّهُ يَجْتَبِي إِلَيْهِ مَنْ يَشَاءُ وَيَهْدِي إِلَيْهِ مَنْ يُنِيبُ ﴿13﴾ ( سورة الشورى : 13)

তিনি তোমাদের জন্য দ্বীন বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন; যে বিষয়ে তিনি নূহকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, আর আমি তোমার কাছে যে ওহী পাঠিয়েছি এবং ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে যে নির্দেশ দিয়েছিলাম তা হল, তোমরা দ্বীন কায়েম করবে এবং এতে বিচ্ছিন্ন হবে না। তুমি মুশরিকদেরকে যে দিকে আহবান করছ তা তাদের কাছে কঠিন মনে হয়; আল্লাহ যাকে চান তার দিকে নিয়ে আসেন। আর যে তাঁর অভিমুখী হয় তাকে তিনি হেদায়াত দান করেন। [সূরা শুরা : ১৩।]

৮০
সর্ব প্রথম রাসূল :
পৃথিবীতে আগমনকারী সকল নবী-রাসূলের দ্বীন ছিল এক ও অভিন্ন, তবে (তাঁদের) শরিয়ত ছিল বিভিন্ন। পূর্বে আগমনকারী নবী ; পরে আগমনকারী সম্পর্কে সুসংবাদ দিতেন ও তাঁর প্রতি ঈমান আনতেন। আর পরে আগমনকারী; পূর্বে আগমনকারীকে স্বীকৃতি দিতেন এবং তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতেন। এদের মাঝে সর্বপ্রথম রাসূল হচ্ছেন নূহ আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম।

আল্লাহ তাআলা বলেন:

وَإِذْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ النَّبِيِّينَ لَمَا آَتَيْتُكُمْ مِنْ كِتَابٍ وَحِكْمَةٍ ثُمَّ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مُصَدِّقٌ لِمَا مَعَكُمْ لَتُؤْمِنُنَّ بِهِ وَلَتَنْصُرُنَّهُ قَالَ أَأَقْرَرْتُمْ وَأَخَذْتُمْ عَلَى ذَلِكُمْ إِصْرِي قَالُوا أَقْرَرْنَا قَالَ فَاشْهَدُوا وَأَنَا مَعَكُمْ مِنَ الشَّاهِدِينَ ﴿81﴾ ( سورة آل عمران : 81)

আর স্মরণ কর, যখন আল্লাহ নবীদের অঙ্গীকার নিয়েছেন- আমি তোমাদেরকে যে কিতাব ও হিকমত দিয়েছি, অত:পর তোমার সাথে যা আছে তা সত্যায়নকারীরূপে একজন রাসূল তোমাদের কাছে আসবে- তখন অবশ্যই তোমরা তার প্রতি ঈমান আনবে এবং তাকে সাহায্য করবে। তিনি বললেন, তোমরা কি স্বীকার করেছ এবং এর উপর আমার প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছ? তার বলল, আমরা স্বীকার করলাম। আল্লাহ বললেন, তবে তোমরা সাক্ষী থাক এবং আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী রইলাম। [সূরা আলে ইমরান : ৮১।]

আল্লাহ আরও বলেন :

إِنَّا أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ كَمَا أَوْحَيْنَا إِلَى نُوحٍ وَالنَّبِيِّينَ مِنْ بَعْدِهِ وَأَوْحَيْنَا إِلَى إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ وَالْأَسْبَاطِ وَعِيسَى وَأَيُّوبَ وَيُونُسَ وَهَارُونَ وَسُلَيْمَانَ وَآَتَيْنَا دَاوُودَ زَبُورًا ﴿163﴾ ( سورة النساء : 163)

নিশ্চয়ই আমি তোমার নিকট ওহী প্রেরণ করেছি যেমনি ওহী প্রেরণ করেছি নূহ ও তাঁর পরবর্তী নবীগণের নিকট এবং আমি ওহী পাঠিয়েছি ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক,ইয়াকুব, তার বংশধরগণ, ঈসা, আইয়ূব, ইউনুস, হারূন ও সুলাইমানের নিকট এবং দাঊদকে প্রদান করেছি যাবুর। [সূরা নিসা : ১৬৩।]

(৩) হাদীসে এসেছে

وعن أبى هريرة رضي الله عنه فى حديث الشفاعة وفيه أن النبي صلى الله عليه وسلم قال لا اذهبوا إلى نوح فيأتون نوحا فيقولون : يا نوح أنت أول الرسول إلى أهل الأرض . ( متفق عليه )

আবু হুরায়রা রা. কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে শাফা‘আতে আছে যে, নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আগত লোকদের বলবেন, তোমরা নূহ’ এর নিকট যাও। তাঁরা নবী নূহ’ এর নিকট এসে বলবে! হে নূহ, আপনি পৃথিবীবাসীর নিকট প্রেরিত সর্ব প্রথম রাসূল। [বুখারী মুসলিম বুখারী হাদীস নং ৩৩৪০ মুসলিম নং ১৯৪]

৮১
সর্বশেষ রাসূল :
সর্বশেষ রাসূল হচ্ছেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

আল্লাহ তাআলা বলেন:

مَا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِنْ رِجَالِكُمْ وَلَكِنْ رَسُولَ اللَّهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ وَكَانَ اللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًا ﴿40﴾ ( سورة الأحزاب : 40)

মুহাম্মাদ তোমাদের কোন পুরুষের পিতা নয়; তবে আল্লাহর রাসূল ও সর্বশেষ নবী। আর আল্লাহ সকল বিষয়ে সর্বজ্ঞ। [সূরা আহযাব : ৪০।]

৮২
আল্লাহ তাআলা নবী-রাসূলদের কাদের নিকট প্রেরণ করেছেন :
আল্লাহ তাআলা সকল নবী-রাসূলদের বিশেষকরে নিজ নিজ সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরণ করেছেন :

মহান আল্লাহ বলেন:

وَلِكُلِّ قَوْمٍ هَادٍ ﴿7﴾ ( سورة الرعد : 7)

আর প্রত্যেক কওমের জন্য রয়েছে হিদায়াতকারী । [সূরা রা’দ : ৭।]

(২) আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করেছেন সমগ্র মানুষের নিকট। তিনি হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী। আদম সন্তানের নেতা। কিয়ামত দিবসে প্রশংসার নিশান বরদার। আল্লাহ তাআলা তাঁকে উভয় জগতের রহমত করে প্রেরণ করেছেন।

(১) আল্লাহ বলেন,

وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ ﴿28﴾ ( سورة سبأ : 28)

আর আমি তো কেবল তোমাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসাবে প্রেরণ করেছি; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না। [সূরা সাবা: ২৮।]

(২) আল্লাহ তাআলা আরো বলেন :-

وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ ﴿107﴾ ( سورة الأنبياء : 107)

আর আমি তো তোমাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসাবেই প্রেরণ করেছি। [সূরা আম্বিয়া : ১০৭।]

৮৩
নবী-রাসূল প্রেরণের তাৎপর্য :
নবী-রাসূল প্রেরণের অনেক হিকমত ও তাৎপর্য রয়েছে, এখানে আমরা প্রধান প্রধান কয়েকটি নিয়ে আলোচনা করব।

১। বিশ্বমানবতাকে এক আল্লাহর ইবাদতের প্রতি আহবান করা এবং তিনি ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত করা থেকে নিষেধ করা।

আল্লাহ তাআলা বলেন:

وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ ﴿36﴾ ( سورة النحل : 36)

আর আমি অবশ্যই প্রত্যেক জাতির নিকট একজন রাসূল প্রেরণ করেছি যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং পরিহার কর তাগূতকে। [সূরা নাহল : ৩৬।]

২। মহান স্রষ্টা আল্লাহ তাআলার সাথে বান্দার সংযোগ স্থাপন এবং যে রাস্তা তিনি পর্যন্তপৌঁছাতে সাহায্য করে সে রাস্তা বর্ণনা করা।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آَيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُبِينٍ ﴿2﴾ ( سورة الجمعة : 2)

তিনিই উম্মীদের মাঝে একজন রাসূল পাঠিয়েছেন তাদের মধ্য থেকে, যে তাদের কাছে তিলাওয়াত করে তাঁর আয়াতসমূহ, তাদেরকে পবিত্র করে এবং তাদেরকে শিক্ষা দেয় কিতাব ও হিকমত। যদিও ইত:পূর্বে তারা স্পষ্ট গোমরাহীতে ছিল। [সূরা জুমুআ-২।]

৩। কিয়ামত দিবসে আল্লাহর নিকট পৌঁছার পর মানুষের অবস্থা কেমন হবে সে সম্পর্কে বর্ণনা করা।

আল্লাহ বলেন,

قُلْ يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّمَا أَنَا لَكُمْ نَذِيرٌ مُبِينٌ ﴿49﴾ فَالَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَهُمْ مَغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيمٌ ﴿50﴾ وَالَّذِينَ سَعَوْا فِي آَيَاتِنَا مُعَاجِزِينَ أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ ﴿51﴾ ( سورة الحج : 49-51)

বল, হে মানুষ, আমি তো কেবল তোমাদের জন্য সুস্পষ্ট সতর্ককারী। সুতরাং যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও সম্মানজনক রিযক। আর যারা আমার আয়াতসমূহকে ব্যর্থ করে দেয়ার চেষ্টা করে, তারা জাহান্নামের অধিবাসী। [সূরা : আল হজ্ব : ৪৯-৫১।]

৪। মানুষের বিপক্ষে হুজ্জত (প্রমাণ) প্রতিষ্ঠিত করা।

যেমন আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

رُسُلًا مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ لِئَلَّا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى اللَّهِ حُجَّةٌ بَعْدَ الرُّسُلِ وَكَانَ اللَّهُ عَزِيزًا حَكِيمًا ﴿165﴾ ( سورة النساء : 165)

আর (পাঠিয়েছি) রাসূলগণকে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে, যাতে আল্লাহর বিপক্ষে রাসূলদের পর মানুষের জন্য কোন অজুহাত না থাকে। আর আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। [সূরা আন নিসা : ১৬৫।]

৫। রহমত ও অনুগ্রহ স্বরূপ।

আল্লাহ তাআলা বলেন :

وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ ﴿107﴾ ( سورة الأنبياء : 107)

আর আমি তো তোমাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসাবেই প্রেরণ করেছি। [সূরা আম্বিয়া : ১০৭।]

৮৪
নবী-রাসূলগণের গুণাগুণ:
(১) প্রজ্ঞাময় মহাপ্রভু মানুষদের মধ্য হতে নির্বাচন করে তাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নবী-রাসূল হিসাবে মনোনীত করেছেন। নবুওয়ত ও রিসালাতের গুরু দায়িত্ব অর্পণ করে তাদের মর্যাদা আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন। বিভিন্ন মু'জেযার মাধ্যমে তাদের সাহায্য করেছেন, শক্তি যুগিয়েছেন এবং তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছেন। উক্ত রিাসালাত মানুষের নিকট প্রচার করার নির্দেশ দিয়েছেন। যাতে মানুষ কেবলমাত্র আল্লাহর ইবাদত করে এবং তিনি ভিন্ন সকল উপাস্যের ইবাদত পরিহার করে। এর উপর তিনি তাদের জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাঁরা আল্লাহ প্রদত্ত এ দায়িত্ব গুরুত্বের সাথে পালন করেছেন এবং মানুষের নিকট পরিপূর্ণ আন্তরিকতার সাথে তা প্রচার করেছেন। তাঁদের উপর শত- কোটি দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক।

১। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ إِلَّا رِجَالًا نُوحِي إِلَيْهِمْ فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ ﴿43﴾ ( سورة النحل : 43)

আর আমি তোমার পূর্বে কেবল পুরুষদেরকেই রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছি, যাদের প্রতি আমি ওহী পাঠিয়েছি। সুতরাং জ্ঞানীদের জিজ্ঞাসা কর, যদি তোমরা না জান। [সূরা নাহল : ৪৩।]

২। আল্লাহ আরও বলেন,

إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَى آَدَمَ وَنُوحًا وَآَلَ إِبْرَاهِيمَ وَآَلَ عِمْرَانَ عَلَى الْعَالَمِينَ ﴿33﴾ ( سورة آل عمران : 33)

নিশ্চয় আল্লাহ আদম, নূহ ও ইবরাহীমের পরিবারকে এবং ইমরানের পরিবারকে সৃষ্টিজগতের উপর মনোনীত করেছেন। [সূরা আলে ইমরান : ৩৩।]

৩। অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে :

وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ ﴿36﴾ ( سورة النحل : 36)

আর আমি অবশ্যই প্রত্যেক জাতির নিকট একজন রাসূল প্রেরণ করেছি যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং পরিহার কর তাগূতকে। [সূরা নাহল : ৩৬।]

(২) আল্লাহ তাআলা সকল নবী-রাসূলকে তাঁর বান্দাদের আল্লাহর দিকে দাওয়াত এবং কেবলমাত্র তাঁর ইবাদতের প্রতি আহবান করার নির্দেশ দিয়েছেন। আর প্রত্যেক জাতির জন্য তাদের অবস্থার সাথে সঙ্গতি রেখে শরিয়ত ও আইন প্রবর্তন করেছেন।

যেমন আল্লাহ বলেন,

لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا ﴿48﴾ ( سورة المائدة : 48)

তোমাদের প্রত্যেকের জন্য আমি নির্ধারণ করেছি শরিয়ত ও স্পষ্ট পন্থা। [সূরা মায়েদা : ৪৮।]

(৩) মহান আল্লাহ নবী-রাসূলদেরকে নির্বাচিত করার পর, যখনই তাদের কোন উচ্চ মাকাম বর্ণনা করেছেন তখন তাঁর তরে তাদের উবুদিয়্যতের গুণটি উল্লেখ করে বর্ণনা করেছেন। যেমন তানযীল তথা কুরআন অবতারণের মাকাম বর্ণনা করার ক্ষেত্রে মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে বলেছেন।

تَبَارَكَ الَّذِي نَزَّلَ الْفُرْقَانَ عَلَى عَبْدِهِ لِيَكُونَ لِلْعَالَمِينَ نَذِيرًا ﴿1﴾ ( سورة الفرقان : 1)

পরম বরকতময় তিনি, যিনি তাঁর বান্দার উপর ফুরকান নাযিল করেছেন যেন সে জগতবাসীর জন্য সতর্ককারী হতে পারে। [সূরা আল-ফোরকান : ১।]

এখানে রাসূলের ক্ষেত্রে عبد শব্দটি ব্যবহার করার মাধ্যমে তার উবুদিয়্যতের গুণটি উল্লেখ করেছেন।

ঈসা বিন মারইয়াম আ. সম্পর্কে বলেছেন।

إِنْ هُوَ إِلَّا عَبْدٌ أَنْعَمْنَا عَلَيْهِ وَجَعَلْنَاهُ مَثَلًا لِبَنِي إِسْرَائِيلَ ﴿59﴾ ( سورة الزخرف : 59)

সে কেবল আমার এক বান্দা। আমি তার উপর অনুগ্রহ করেছিলাম এবং বনী ইসরাঈলের জন্য তাকে দৃষ্টান্ত বানিয়েছিলাম। [সূরা যুখরুফ : ৫৯।]

(৪) সকল নবী-রাসূলই সৃষ্ট-মানুষ। অন্যান্য সকল মানব প্রকৃতির ন্যায় তাঁরা পানাহার করেন। বি:স্মৃত হয়, ঘুমান-অচেতন হন, অসুস্থ হন, মৃত্যু বরণ করেন। আকৃতি-প্রকৃতি সকল দিক থেকে অন্যান্য মানুষের মত। প্রভুত্ব-উপাস্যত্ব ইত্যাদি যা একমাত্র আল্লাহর সাথে সংশিষ্ট এসব ক্ষেত্রে তাঁদের কোন দখল নেই। সুতরাং তাঁরা আল্লাহ তাআলার অনুমোদন ব্যতীত কারো উপকার-ক্ষতির ক্ষমতা রাখেন না। অনুরূপভাবে তাঁরা আল্লাহর কোন ভান্ডারেরও মালিক নন এবং আল্লাহ যা জানিয়েছেন তা ব্যতীত অদৃশ্যের কোন বিষয় সম্পর্কেও তাঁদের কোন ধারণা নেই। অর্থাৎ তাঁরা ইলমে গায়েব জানেন না।

আল্লাহ স্বীয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে বলছেন,

قُلْ لَا أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ وَلَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ إِنْ أَنَا إِلَّا نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ ﴿188﴾ ( سورة الأعراف : 188)

বল, আমি আমার নিজের কোন উপকার ও ক্ষাতির ক্ষমতা রাখি না, তবে আল্লাহ যা চান। আর আমি যদি গায়েব জানতাম তাহলে অধিক কল্যাণ লাভ করতাম এবং আমাকে কোন ক্ষতি স্পর্শ করত না। আমি তো একজন সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা এমন কওমের জন্য, যারা বিশ্বাস করে। [সূরা আরাফ : ১৮৮]

৮৫
নবী-রাসূলদের বৈশিষ্ট্যাবলি :
মানবকুলের মধ্যে মন-মানসিকতার দিক থেকে নবী ও রাসূলগণ হচ্ছেন সর্বাপেক্ষা পবিত্র, বুদ্ধি-বিবেচনার ক্ষেত্রে সবচে মেধাবী, ঈমানের দিক থেকে সর্বাপেক্ষা সত্যবাদি, চরিত্র ও ব্যবহারের দিক থেকে সর্বোত্তম, দ্বীন-ধর্মের ক্ষেত্রে সর্বাধিক পরিপূর্ণ। উবুদিয়্যত-দাসত্বের ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী, শারীরিকভাবে পূর্ণাঙ্গতর। আকৃতিগতভাবে সুন্দরতম। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে অনেক বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি দ্বারা গুণান্বিত করেছেন। প্রধান প্রধান কিছু নিম্নে প্রদত্ত্ব হল।

(১) আল্লাহ তাআলা তাঁদেরকে ওহী ও রিসালাতের জন্য মনোনীত করেছেন।

اللَّهُ يَصْطَفِي مِنَ الْمَلَائِكَةِ رُسُلًا وَمِنَ النَّاسِ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ بَصِيرٌ ﴿75﴾ ( سورة الحج : 75)

আল্লাহ ফেরেশতা ও মানুষের মধ্য হতে রাসূল মনোনীত করেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা। [সূরা হজ্ব : ৭৫।]

অন্যত্র বলেন :

قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ ﴿110﴾ ( سورة الكهف : 110)

বল, আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ। আমার নিকট ওহী প্রেরণ করা হয় যে, তোমাদের ইলাহই এক ইলাহ। [সূরা কাহফ : ১১০।]

(২) তাঁরা সকলে আল্লাহ প্রদত্ত্ব দায়িত্ব ; আকীদা ও আহকাম মানুষের নিকট প্রচার ও পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নির্দোষ ও নিষ্পাপ। যদি কোন ভুল করেও থাকেন আল্লাহ তাআলা সাথে সাথে সঠিক ও সত্যের দিকে ফিরিয়ে দিতেন।

আল্লাহ বলেন,

وَالنَّجْمِ إِذَا هَوَى ﴿1﴾ مَا ضَلَّ صَاحِبُكُمْ وَمَا غَوَى ﴿2﴾ وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى ﴿3﴾ إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى ﴿4﴾ عَلَّمَهُ شَدِيدُ الْقُوَى ﴿5﴾ ( سورة النجم : 1-5)

কসম নক্ষত্রের, যখন তা অস্ত যায়। তোমাদের সঙ্গী পথভ্রষ্ট হয়নি এবং বিপথগামীও হয়নি। আর সে মনগড়া কথা বলে না। তাতো কেবল ওহী, যা তার প্রতি ওহীরূপে প্রেরণ করা হয়। তাকে শিক্ষা দিয়েছে প্রবল শক্তিধর। [সূরা নাজম : ১-৫।]

(৩) তাঁদের মৃত্যুর পর কাউকে (সম্পদের) উত্তরাধিকারী করেন না এবং কোন উত্তরাধিকার রেখেও যান না।

عن عائشة رضي الله عنها قالت : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : لا نورث، ما تركنا صدقة . ( متفق عليه )

উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমাদের (সম্পদের) উত্তরাধিকার হয় না। আমরা কাউকে (সম্পদের) উত্তরাধিকারী করি না। আমরা যা কিছু (সম্পদ) রেখে যাই তা সবই সদকা। [বুখারী-মুসলিম। বুখারী হাদীস নং ৬৭৩০ আর মুসলিম - ১৭৫৭]

(৪) তাঁরা নিদ্রা যান তবে তাঁদের চক্ষুঘুমায়, অন্তর থাকে জাগ্রত-ঘুমায় না।

عن أنــس رضي الله عنه فى قصة الإســراء . وفيه والنبي صلى الله عليه وسلم نائمة عيناه ولا ينام قلبه وكذالك الأنبياء تنام أعينهم ولا تنام قلوبهم . أخرجه البخاري .

আনাস রা. কর্তৃক বর্ণিত ইসরার ঘটনা সম্বলিত হাদীসে আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চক্ষুদ্বয় ঘুমায় কিন্তু অন্তর ঘুমায় না। অনুরূপভাবে আম্বিয়া আ. (তাঁরা নিদ্রায় যান তবে) তাঁদের চক্ষু ঘুমায় কিন্তু অন্তর ঘুমায় না। [বর্ণনায় বুখারী : হাদীস নং ৩৫৭০]

(৫) মৃত্যুর সময় তাঁদেরকে দুনিয়া কিংবা আখিরাতের যে কোন একটি বেছে নেয়ার স্বাধীনতা দেয়া হয়।

عن عائــشة رضي الله عنها قالت : سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول : ما من نبي يمرض إلا خير بين الدنيا والآخرة . ( متفق عليه )

উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রা. বলেন আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যখনই কোন নবী অসুস্থ হয়েছেন তখনই তাঁকে দুনিয়া কিংবা আখেরাত- এর যে কোন একটি বেছে নেয়ার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। [বর্ণনায় বুখারী- মুসলিম : বুখারী হাদীস নং ৪৫৮৬ আর মুসলিম হাদীস নং ২৪৪৪]

(৬) তাঁদের মৃত্যু বরণের স্থানেই তাঁদের সমাহিত করা হয়।

عن أبي بكر رضي الله عنه قال : سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول : لن يقبر نبي إلا حيث يموت . أخرجه أحمد

আবু বকর রা. বলেন : আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি। প্রত্যেক নবীকে তাঁর মৃত্যু বরণ করার স্থানেই সমাহিত করা হয়েছে। [হাদীসটি বিশুদ্ধ সনদে ইমাম আহমদ রহ. তাঁর মুসনাদে বর্ণনা করেছেন। হাদীস নম্বর : ২৭)]

(৭) মাটি তাদের শরীর খায় না।

عن أوس بن أوس رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : إن من أفضل أيامكم يوم الجمعة .. وفيه قالوا : يا رسول الله وكيف تعرض صلاتنا عليك وقد أرمت؟ يقولون بليت، فقال : إن الله عز وجل حرم على الأرض أجساد الأنباء . أخرجه أبوداود .

বিশিষ্ট সাহাবী আওস বিন আওস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ দিন হচ্ছে জুমুআর দিন... এবং তাতে আছে, লোকেরা বলল: ইয়া রাসূলাল্লাহ আমাদের দরূদ ও সালাত আপনার নিকট কিভাবে পেশ করা হবে? অথচ আপনিতো ফুলে যাবেন। অর্থাৎ (তারা বলতে চাচ্ছেন,) ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে যাবেন। রাসূলুল্লাহ বললেন : আল্লাহ তাআলা নবীদের শরীরকে মাটির উপর হারাম করে দিয়েছেন। [আবু দাউদ বিশুদ্ধ সনদে এ হাদীস বর্ণনা করেছেন : হাদীস নং ১০৪৭]

(৮) তাঁরা নিজ নিজ কবরে জীবিত থেকে সালাত আদায় করেন।

عن أنس رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال : الأنبياء أحياء فى قبورهم يصلون . أخرجه أبو يعلى

সাহাবী আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন : নবীগণ নিজ নিজ কবরে জীবিত থেকে সালাত আদায় করে যাচ্ছেন। [বর্ণনায় আবু ইয়ালা, হাদীস নং (৩৪২৫)। হাদীসের সনদ, জাইয়িদ। সিলসিলাতুস সহীহা। ক্রমিক (৬২১)।]

عن أنس رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : مررت على موسى ليلة أسري بي عند الكثيب الأحمر وهو قائم يصلى في قبره . أخرجه مسلم

আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : যে রাতে আমার ইসরা হয়েছিল, আমি লাল বালির টিলার নিকটে নবী মূসা আলাইসি সালামের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন তিনি স্বীয় কবরে নামায রত ছিলেন। [মুসলিম : ২৩৭৫]

(৯) তাঁদের ওফাতের পর তাঁদের সহধর্মিনীদের বিবাহ করা অবৈধ।

আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَمَا كَانَ لَكُمْ أَنْ تُؤْذُوا رَسُولَ اللَّهِ وَلَا أَنْ تَنْكِحُوا أَزْوَاجَهُ مِنْ بَعْدِهِ أَبَدًا إِنَّ ذَلِكُمْ كَانَ عِنْدَ اللَّهِ عَظِيمًا ﴿53﴾ ( سورة الأحزاب : 53)

আর আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দেয়া এবং তাঁর (ওফাতের) পর তাঁর পত্নীগণকে বিয়ে করা তোমাদের জন্য কখনও সঙ্গত নয়। নিশ্চয় এটি আল্লাহর কাছে গুরুতর পাপ। [সূরা আহযাব : ৫৩।]

৮৬
নবী-রাসূলগণের প্রতি ঈমানের বিধান:
সকল নবী ও রাসূলের প্রতি ঈমান আনা প্রতিটি মুসলমানের উপর ওয়াজিব। তাঁদের যে কোন একজনকে অস্বীকার করা, সকলকে অস্বীকার করার নামান্তর। যে একজনকে অস্বীকার করল প্রকারান্তরে সে সকলকেই অস্বীকার করল। তাঁদের সম্পর্কিত সকল বিশুদ্ধ সংবাদাদি বিশ্বাস ও সত্যায়ন করা ফরজ। উত্তম আখলাক, তাওহীদের উৎকর্ষ ও ঈমানের সত্যতার ক্ষেত্রে তাঁদের অনুসরণ করাও ফরজ। অনুরূপভাবে নবী-রাসূলের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ, রিসালাতের পরম্পরা সমাপ্তকারী, সকল মানুষ এবং সমগ্র পৃথিবীর নিকট প্রেরিত আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরিয়তানুযায়ী আমল করাও কিয়ামত পর্যন্ত আগত সকল মানুষের উপর ফরজ।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا آَمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَالْكِتَابِ الَّذِي نَزَّلَ عَلَى رَسُولِهِ وَالْكِتَابِ الَّذِي أَنْزَلَ مِنْ قَبْلُ وَمَنْ يَكْفُرْ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا بَعِيدًا ﴿136﴾ ( سورة النساء : 136)

হে মুমিনগণ, তোমরা ঈমান আন আল্লাহর প্রতি, তাঁর রাসূলের প্রতি এবং সে কিতাবের প্রতি যা তিনি তাঁর রাসূলের উপর নাযিল করেছেন এবং সে কিতাবের প্রতি যা তিনি পূর্বে নাযিল করেছেন। আর যে আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রাসূলগণ এবং শেষ দিনকে অস্বীকার করবে, সে ঘোর বিভ্রান্তিতে বিভ্রান্ত হবে। [সূরা নিসা : ১৩৬।]

৮৭
নবী-রাসূলগণের প্রতি ঈমানের উপকারিতা ও ফলাফল :
-নবী-রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের ফলে স্বীয় বান্দাদের প্রতি মহান আল্লাহ তাআলার অপরিসীম রহমত, অপার দয়া ও মহিমা সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায় যে, তিনি তাঁদের নিকট অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। তাঁরা এসে তাদেরকে স্বীয় রব ও মালিকের ইবাদতের প্রতি পথ প্রদর্শন করেছেন এবং ইবাদত পালনের নিয়ম-পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন।

-এ নেয়ামত প্রাপ্তির ফলস্বরূপ আল্লাহর প্রশংসা ও তাঁর কৃতজ্ঞতা আদায় করার অনুভূতি সৃষ্টি হয়।

-নবী-রাসূলদের ভালবাসা ও কোনরূপ অতিরঞ্জন-বাড়াবাড়ি ব্যতীত তাঁদের প্রশংসা করা। কেননা তাঁরা হচ্ছেন আল্লাহর রাসূল। তাঁর ইবাদত-আনুগত্য প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর বান্দাদের নিকট তাঁর বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন এবং তাদের কল্যাণ কামনা করেছেন।

৮৮
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বংশ পরিচয় ও বেড়ে উঠা:
নামঃ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল মুত্তালিব বিন হাশিম।

মাতাঃ আমিনা বিনতে ওহাব।

৫৭০ ঈসাই সনে -হাতির ঘটনা সঙ্ঘটিত হওয়ার বছর- পবিত্র মক্কায় জন্মগ্রহন করেন। মাতৃগর্ভে থাকাবস্থায়ই পিতা আব্দুল্লাহ ইহলোক ত্যাগ করেন। পিতার ইন্তেকালের পর দাদা আব্দুল মুত্তালিব দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ছয় বছর বয়সে মাতা আমিনাও পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নেন। আর দাদার ইন্তেকালের পর দায়িত্ব নেন চাচা আবু তালিব ।

জীবনভর সদাচরণ ও উত্তম আখলাক নিয়ে মানুষের মাঝে বসবাস করেছেন । তাঁর মাধুর্যপূর্ণ ব্যবহার ও অনুপম চারিত্রিক গুণাবলির ছোঁয়ায় মুগ্ধ হয়ে লোকেরা তাঁকে আল আমীন ( বিশ্বস্ত ) উপাধিতে ভূষিত করেছিল।

চল্লিশ বছর বয়সের মাথায় নবুওয়ত প্রাপ্ত হন। ওহী নিয়ে ফেরেশ্তা জিবরীল যখন উপস্থিত হন, তখন তিনি হেরা গুহায় গভীর ধ্যানমগ্ন অবস্থায় ছিলেন।

অত:পর লোকদেরকে আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমান এবং এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহবান করতে লাগলেন। ফলে বিভিন্ন কষ্ট ও প্রতিরোধের সম্মুখীন হলেন। কিন্তু ধৈর্য্য ও সবরের সাথে নিজ দায়িত্ব পালনে অবিচল থেকেছেন। এক পর্যায়ে আল্লাহ তাআলা তাঁর দ্বীনকে জয়ী করেন। এরপর মদিনায় হিজরত করে চলে আসেন আর আল্লাহর পক্ষ থেকে বিভিন্ন বিধি-বিধান আসতে শুরু করে। ইসলাম মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং দ্বীন পূর্ণতা পায় ।

অত:পর একাদশ হিজরির রবিউল আউয়াল মাসে সোমবার দিন পৃথিবী ত্যাগ করে পরম বন্ধুর সান্নিধ্যে প্রস্থান করেন। তখন বয়স হয়েছিল তেষট্টি বছর । সুস্পষ্টভাবে দ্বীন প্রচার , উম্মতকে কল্যাণের সব রাস্তা প্রদর্শন এবং সর্ব প্রকার মন্দ ও অকল্যাণ থেকে সর্তক করার পর উচ্চতর বন্ধুর সাথে মিলিত হয়েছেন। তাঁর প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে শান্তি ও রহমত নাযিল হোক।

৮৯
বৈশিষ্ট্যাবলি .
তাঁর বৈশিষ্ট্যাবলির অন্যতম হচেছ, তিনি সর্বশেষ নবী, সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল, মুত্তাকীদের ইমাম। তাঁর রিসালাত আম (ব্যাপক), জিন-ইনসান উভয়কে শামিল করেছে। আল্লাহ তাআলা তাঁকে সারা বিশ্বের জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছেন। বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত রাতে ভ্রমন করিয়েছেন অত:পর আকাশ পানে উঠিয়ে উর্ধ্ব জগত ভ্রমণ করিয়েছেন অর্থাৎ ইসরা ও মিরাজ করিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে নবুওয়ত ও রিসালাতের সম্মানসূচক বিশেষণ যুক্ত করে; ইয়া আইয়্যুহান্নাবিয়্যু - ইয়া আইয়্যুহাররাসূলু বলে সম্বোধন করেছেন।

عن جابر بن عبد الله رضي الله عنهما أن النبي صلى الله عليه و سلم قال : (( أعطيت خمسا لم يعطهن أحد قبلي : نصرت بالرعب مسيرة شهر , وجعلت لي الأرض مسجدا وطهورا , فأيما رجل من أمتي أدركته الصلاة فليصلّ , و أحلت لي المغانم و لم تحل لأحد قبلي , وأعطيت الشفاعة , وكان النبي يبعث إلى قومه خاصة وبعثت إلى الناس عامة )) متفق عليه

বিশিষ্ট সাহাবী জাবের বিন আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমাকে এমন পাঁচটি বৈশিষ্ট্য দান করা হয়েছে যা আমার পূর্বে আর কাউকে দেয়া হয়নি, আমাকে রু’ব (বিশেষ প্রভাব) দ্বারা সাহায্য করা হয়েছে; এক মাস ভ্রমণপথের দূরত্ব থেকেও লোকেরা প্রভাবিত হয়ে যায়, সমগ্র ভূমিকে আমার জন্য পবিত্র ও মসজিদ করা হয়েছে, সুতরাং আমার উম্মতের যে কারো যেখানেই সালাতের ওয়াক্ত হবে সে সেখানেই তা তা আদায় করবে। গনিমতের মাল (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) আমার জন্য হালাল করা হয়েছে, আমার পূর্বে তা কারো জন্যই হালাল ছিল না, আমাকে শাফাআতের অধিকার দেয়া হয়েছে, পূর্ববর্তী নবীগণ নির্দিষ্ট করে নিজ সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরিত হতেন আর আমাকে ব্যাপকভাবে সমগ্র মানুষের জন্য নবী করে প্রেরণ করা হয়েছে। [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম। বুখারী হাদীস নং (৩৩৫) আর মুসলিম (৫২১)।]

কতিপয় বৈশিষ্ট্য যা কেবলমাত্র তাঁর জন্য নির্দিষ্ট ছিল, যেমন সওমে বেসাল তথা ইফতার ও সাহ্রি বিহীন লাগাতার রোযা রাখা, মোহর বিহীন বিবাহ, চারজনের অধিক নারী বিবাহ করা ও একই সাথে সংসার করা, (এগুলো শুধুমাত্র তাঁর জন্য বৈধ ছিল অন্য কারো জন্য নয়) যাকাত-সদকা আহার না করা, লোকেরা যা শুনতে পেত না তিনি তা শুনতেন। লোকেরা যা দেখতে পেত না তিনি তা দেখতে পেতেন। যেমন তিনি ফেরেশতা জিবরাীলকে আল্লাহর সৃষ্টিকৃত তাঁর নিজস্ব আকৃতিতে দেখতে পেয়েছিলেন। নবীজীর আরো একটি বৈশিষ্ট্য হল, তিনি কাউকে উত্তরাধিকারী করে যাননি এটি তাঁর জন্য জরুরিও ছিল না ।

৯০
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ওহীর সূচনা:
عن عائشة أم المؤمنين رضي الله عنها أنها قالت : أول ما بدئ به رسول الله صلى الله عليه و سلم من الوحي الرؤيا الصالحة في النوم فكان لا يرى رؤيا إلا جاءت مثل فلق الصبح ثم حبب إليه الخلاء وكان يخلو بغار حراء فيتحنث فيه - وهو التعبد- الليالي ذوات العدد قبل أن ينزع إلى أهله ويتزود لذلك ثم يرجع إلى خديجة فيتزود لمثلها حتى جاءه الحق وهو في غار حراء فجاءه الملك فقال : اقرأ قال : ما أنا بقارئ

قال : فأخذني فغطني حتى بلغ مني الجهد ثم أرسلني فقال : اقرأ قلت : ما أنا بقارئ . فأخذني فغطني الثانية حتى بلغ مني الجهد , ثم أرسلني فقال : اقرأ فقلت : ما أنا بقارئ فأخذني فغطني الثالثة ثم أرسلني فقال : اقرأ باسم ربك الذي خلق , خلق الإنسان من علق , اقرأ و ربك الأكرم

فرجع بها رسول الله صلى الله عليه وسلم يرجف فؤاده , فدخل على خديجة بنت خويلد رضي الله عنها فقال : زملوني زملوني , فزملوه حتى ذهب عنه الروع , فقال لخديجة و أخبرها الخبر : لقد خشيت على نفسي , فقالت خديجة : كلا والله ما يخزيك الله أبدا . إنك لتصل الرحم و تحمل الكل و تكسب المعدوم و تقري الضيف و تعين على نوائب الحق .

فانطلقت به خديجة حتى أتت به ورقة بن نوفل بن أسد ابن عبد العزى ابن عم خديجة . و كان امرءا تنصر في الجاهلية و كان يكتب الكتاب العبراني فيكتب من الإنجيل بالعبرانية ما شاء الله أن يكتب , وكان شيخ كبيرا قد عمي , فقالت له خديجة : يا ابن عم , اسمع من ابن أخيك . فقال له ورقة : يا ابن أخي ماذا ترى ؟ فأخبره رسول الله صلى الله عليه وسلم خبر ما رأى . فقال له ورقة : هذا الناموس الذي نزل على موسى , يا ليتني فيها جذعا , ليتني أكون حيا إذ يخرجك قومك , فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم : أو مخرجي هم . قال : نعم , لم يأت رجل قط بمثل ما جئت به إلا عودي , وإن يدركني يومك أنصرك نصرا مؤزرا . ثم لم ينشب ورقة أن توفي و فتر الوحي . متفق عليه

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ওহীর সূচনা হয়েছিল ঘুমন্ত অবস্থায় ভাল ভাল স্বপ্নের মাধ্যমে, তখন তিনি যে স্বপ্নই দেখতেন প্রত্যূষের আলোর ন্যায় বাস্তব হয়ে যেত। অত:পর তাঁর নিকট নির্জনতাকে প্রিয় করে দেয়া হল; নির্জনতা তাঁর নিকট ভাল লাগতো, তিনি হেরা গুহায় গিয়ে একাকী সময় কাটাতেন । সেখানে তিনি নিজ পরিবারের নিকট ফিরে আসা পর্যন্ত কয়েক রাত ইবাদাত-বন্দেগি করে কাটাতেন। যাওয়ার পূর্বেই সেদিনগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় খবার ও সামান-পত্র নিয়ে যেতেন। অত:পর খাদিজার নিকট ফিরে আসতেন এবং সে পরিমাণ আসবাব-পত্র নিয়ে আবারো চলে যেতেন। এক সময় হেরা গুহায় থাকা অবস্থায়ই তাঁর নিকট সত্য (ওহী) এসে পৌঁছল। ফেরেশতা এসে বললেন, পড়ুন; তিনি বললেন: আমি পড়তে জানি না।

তিনি বলেন, তখন তিনি আমাকে ধরলেন এবং বুকের সাথে লাগিয়ে প্রচন্ড জোরে চাপ দিলেন যে, আমার যার পর নাই কষ্ট অনুভব হল। অত:পর আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, পড়ুন, আমি বললাম: আমি পড়তে জানি না।

তিনি আমাকে আবারো ধরলেন এবং বুকের সাথে লাগিয়ে প্রচন্ড জোরে চাপ দিলেন যে, আমার যার পর নাই কষ্ট হল। এরপর আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, পড়ুন, আমি বললাম: আমি পড়তে জানি না।

তিনি আমাকে তৃতীয় বারের মত (বুকের সাথে লাগিয়ে প্রচন্ড জোরে) চাপ লাগিয়ে ছেড়ে দিয়ে বললেন:

اقرأ باسم ربك الذي خلق , خلق الإنسان من علق , اقرأ و ربك الأكرم

পড় তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে আলাক (রক্তপিন্ড) থেকে। পড়, আর তোমার রব মহামহিম।

এসব নিয়ে রাসূলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফিরে আসলেন তখন তাঁর হৃদযন্ত্র খুব করে কাঁপছিল। তিনি খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ রাদিয়াল্লাহু আনহার গৃহে প্রবেশ করে বললেন, আমাকে কম্বলাবৃত কর ; আমাকে কম্বলাবৃত কর। তারা তাঁকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দিলে এক সময় ভীতি চলে গেল। তখন তিনি পত্নি খাদিজার কাছে পূর্ণ ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে বললেন: আমি আমার জীবনের আশঙ্কা করছি। খাদিজা সব শুনে বললেন, অসম্ভব ; আল্লাহর কসম , আল্লাহ আপনাকে কখনো অপমানিত-লজ্জিত করবেন না। কারণ, আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখেন-তাদের খোঁজ-খবর নিয়ে থাকেন, মানুষের বোঝা বহন করেন, নিঃস্ব-অসহায়কে অধিক দান করেন, মেহমানের মেহমানদারী করেন এবং বিপদাপদে মানুষের সাহায্য করেন।

অত:পর খাদিজা রা. তাঁকে চাচাত ভাই ওরাকাহ বিন নওফেল বিন আসাদ বিন আব্দুল উয্যার নিকট নিয়ে গেলেন। ওরাকাহ জাহেলি যুগে খৃষ্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। তিনি ইবরানী (হিব্রু) ভাষায় লিখিত কিতাব লিখতেন এবং ইঞ্জীল থেকে হিব্রু ভাষায় লিখতেন। অতি বৃদ্ধ ও অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন । খাদিজা রা. বললেন : হে ভাই! আপনার ভ্রাতুষ্পূত্র থেকে একটু শুনুন। ওরাকাহ তাঁকে বললেন: ভাতিজা কী খবর! আপনি কি কি দেখতে পান? রাসূলুল্লাহ সা. যা যা দেখেছেন সবই তাকে স্ববিস্তারে বলেছেন। তখন ওরাকাহ বললেন: ইনিতো সে ফেরেশতাই যাকে আল্লাহ নবী মূসা আ. এর নিকট নাযিল করতেন। আহ! যখন আপনার সম্প্রদায় আপনাকে বের করে দেবে তখন যদি আমার যৌবন ফিরিয়ে দেয়া হত, আমি যদি সে সময় জীবিত থাকতাম। রাসূলুল্লাহ বললেন : তারা কি আমাকে বের করে দেবে? তিনি বললেন : হ্যাঁ , আপনি যা নিয়ে এসেছেন আপনার পূর্বে এরকম যারাই নিয়ে এসেছিলেন সকলেই শত্রুতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। সে দিন পর্যন্ত যদি আমি বেঁচে থাকি তাহলে আপনাকে মজবুত ও কার্যকরী সহযোগিতা করব। এর কিছুদিন পরই ওরাকাহ মৃত্যুবরণ করেন আর ওহীর অবতারণ কিছু দিন বন্ধ থাকে।

৯১
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহধর্মিণীবৃন্দ:
‘উম্মাহাতুল মুমিনীন’ তাঁরাই হচ্ছেন দুনিয়া-আখিরাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহধর্মিণীবৃন্দ। তাঁরা প্রত্যেকেই মুসলমান, পূত-পবিত্র, সতি-সাধ্বী, নির্মল চরিত্রের অধিকারী এবং মান-সম্মানে আঘাত আসতে পারে এমন সব রকমের খারাবি ও দোষ-ত্রুটি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। তাঁরা হচ্ছেন,

খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ, আয়েশা বিনতে আবু বকর, সাওদা বিনতে যুম’আহ, হাফসা বিনতে ওমর, যয়নাব বিনতে খুযাইমা, উম্মে সালামা, যয়নাব বিনতে জাহাশ, জুয়াইরিয়া বিনতে হারেছ, উম্মে হাবিবা বিনতে আবু সুফয়ান, সাফিয়্যা বিনতে হুয়াইয় এবং মায়মূনা বিনতে হারেছ রাদিয়াল্লাহু আনহুন্না আজমাঈন।

এদের মধ্যে খাদিজা ও যয়নাব বিনতে খুযাইমা রাদিয়াল্লাহু আনহুমা রাসূলুল্লাহর পূর্বেই ইন্তেকাল করেছেন অবশিষ্ট সকলেই তাঁর পরে।

তাদের মধ্যে মর্যাদায় সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছেন: খাদিজা ও আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহুমা ।

৯২
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সন্তান-সন্ততি:
(১) রাসূলুল্লাহর মোট তিনজন ছেলে সন্তান জন্মগ্রহন করেন । কাসেম ও আব্দুল্লাহ এরা দুইজন খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে আর তৃতীয় ছেলে ইবরাহীম তাঁর উপপত্নী মারিয়া ক্বিবতিয়া থেকে । এরা সকলেই শিশু অবস্থায় মারা যান।

(২) মেয়ে সন্তান ছিলেন মোট চারজন। যয়নব, রুকাইয়া, উম্মে কুলছূম ও ফাতেমা। তাঁরা সকলেই খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে জন্ম গ্রহণ করেন। প্রত্যেকেরই বিয়ে হয় এবং ফাতেমা ব্যতীত সকলেই রাসূলুল্লাহর পূর্বে ইন্তেকাল করেন। একমাত্র ফাতেমা তাঁর পর ইন্তেকাল করেন। তাঁরা সকলেই ছিলেন মুসলমান, সচ্চরিত্র ও পূণ্যবান রাদিয়াল্লাহু আনহুন্না আজমাঈন।

৯৩
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীবৃন্দ:
রাসূলুল্লাহর সহচরবৃন্দ, সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবসন্তান। সকল উম্মতের ভেতর তাঁদের মর্যাদা সবার উপরে। মহান আল্লাহ স্বীয় নবীর সাহচর্যের জন্য তাদের মনোনীত করেছেন। তাঁরা আল্লাহ ও রাসূলের উপর ঈমান এনেছেন। আল্লাহ ও রাসূলের সাহায্য করেছেন। দ্বীনের খাতিরে বাড়ী-ঘর ছেড়ে হিজরত করেছেন। দ্বীনের জন্য (মুমিনদেরকে) আশ্রয় দিয়েছেন; সাহয্য-সহযোগিতা করেছেন। নিজ জীবন ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করেছেন। এক পর্যায়ে আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট মর্মে ঘোষণা দিয়েছেন এবং তাঁরাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট বলে প্রমাণ করেছেন। তাঁদের নিজেদের মাঝে মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ হচ্ছেন মুহাজিরগণ অত:পর আনসারগণ।

عن عبد الله بن مسعود رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال : خير الناس قرني ثم الذين يلونهم ثم الذين يلونهم ثم يجيء أقوام تسبق شهادة أحدهم يمينه و يمينه شهادته . متفق عليه

আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সর্বোত্তম মানুষ হচ্ছে আমার যুগের মানুষ, অত:পর এর পরবর্তী যুগের মানুষ তারপর এর পরবর্তী যুগের মানুষ। এরপর এমন লোকদের আর্বিভাব ঘটবে যাদের সাক্ষ্য প্রদান শপথকে এবং শপথ সাক্ষ্য প্রদানকে অতিক্রম করবে। [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং বুখারী (২৬৫২) ও মুসলিম (২৫৩৩)।]

৯৪
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের ভালবাসা:
উন্নত গুণাবলি, শ্রেষ্ঠতর মর্যাদা, অসংখ্য নেককাজ, উম্মতের প্রতি ইহসান-অনুগ্রহ, ইবাদত-আনুগত্য, জিহাদের মাধ্যমে আল্লাহ ও রাসূলের সহযোগিতা, আল্লাহর দিকে আহবান, হিজরত ও নুসরত এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে তাঁর রাস্তায় জীবন-মাল উৎসর্গ করা ইত্যাদি কারণে সাহাবায়ে কেরাম (রিদ্ওয়ানুল্লাহি তাআলা আলাইহিম আজমাঈন)-কে মহববত করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ওয়াজিব। তাদেরকে অন্তর দিয়ে ভালবাসা, কথা ও ভাষার মাধ্যমে তাদের প্রশংসা করা, তাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা, তাদের গুনাহ মাফের দোয়া করা, তাদের নিজেদের মাঝে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলি সম্পর্কে কোনরূপ মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকা, তাদের গালমন্দ না করা এক কথায় বোধ-বিশ্বাস, কথা-আচরণ ইত্যাদি মাধ্যমে তাদের মর্যাদা সমুন্নত রাখা প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য।

মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন,

وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ ﴿100﴾ ( التوبة : ১০০)

আর মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রগামী এবং যারা তাদেরকে অনুসরণ করেছে সুন্দরভাবে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন আর তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। আর তিনি তাদের জন্য প্রস্ত্তত করেছেন জান্নাতসমূহ, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত, তারা সেখানে চিরস্থায়ী হবে। এটাই মহা সাফল্য। [সূরা তাওবা: ১০০।]

(২) আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,

وَالَّذِينَ آَمَنُوا وَهَاجَرُوا وَجَاهَدُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالَّذِينَ آَوَوْا وَنَصَرُوا أُولَئِكَ هُمُ الْمُؤْمِنُونَ حَقًّا لَهُمْ مَغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيمٌ ﴿74﴾ ( الأنفال : ৭৪)

আর যারা ঈমান এনেছে, হিজরত করেছে এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে আর যারা আশ্রয় দিয়েছে ও সাহায্য করেছে, তারাই প্রকৃত মুমিন, তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও সম্মানজনক রিযিক। [সুরা আনফাল: ৭৪।]

وعن أبي هريرة رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه و سلم : لا تسبوا أصحابي ، لا تسبوا أصحابي، فوالذي نفسي بيده ، لو أن أحدكم أنفق مثل أحد ذهبا ما أدرك مد أحدهم و لا نصيفه . متفق عليه

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আল্লাহইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা আমার সাহাবীদের গালমন্দ করো না, তোমরা আমার সহাবীদের গালমন্দ করো না, শপথ সে সত্তার যার হাতে আমার জীবন, যদি তোমাদের কেউ উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ খরচ করে তাদের এক মুদ্দ ( দুই অঞ্জলী ) পরিমাণ বা এর অর্ধেকের সমানও হবে না। [বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং যথাক্রমে (৩৬৭৩) ও (২৫৪০)।]

৯৫
৫-কিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান আল ইয়াওমুল আখের দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে:
কিয়ামত দিবস, যে দিন মহান আল্লাহ সকল সৃষ্টজীবকে হিসাব ও প্রতিদান দেয়ার উদ্দেশ্যে পুনরুত্থিত করবেন। একে ইয়াওমুল আখের বলার কারণ হল এর পর আর কোন দিন নেই। সেখান থেকেই জান্নাতীরা জান্নাতে এবং জহান্নামীরা জাহান্নামে অবস্থান নেবে।

৯৬
আল ইয়াওমুল আখেরের অনেকগুলো নাম আছে , প্রসিদ্ধ কয়েকটি যেমন
ইয়াওমুল ক্বিয়ামাহ- কিয়ামত দিবস, ইয়াওমুল বা’ছ-পুনরুত্থান দিবস, ইয়াওমুল ফাস্ল-চুড়ান্ত ফায়সালা বা বিচার দিবস, ইয়াওমুল খুরূজ- (কবর থেকে মৃতদের) বের হবার দিবস, ইয়াওমুদ্দীন-প্রতিদান দিবস, ইয়াওমুল খুলূদ- অনন্ত জীবনের দিন, ইয়াওমুল হিসাব-হিসাব দিবস, ইয়াওমুল ওয়ীদ-ভীতি প্রদর্শন দিবস, ইয়াওমুল জাম’- সমাবেশ দিবস, ইয়াওমুত তাগাবুন বা হার-জিত দিবস, ইয়াওমুত তালাক-সাক্ষাত দিবস, ইয়াওমুত তানাদ-প্রচন্ড হাঁক-ডাক ও ফরিয়াদ দিবস, ইয়ামুল হাসরাতি-পরিতাপ দিবস, আসসাখ্খাহ-কর্ণবিদারক ধ্বনি, আতত্বাম্মাতুল কুবরা-মহাসংকট, আল গাশিয়াহ-আচ্ছন্নকারী, আল ওয়াকিআহ-মহা ঘটনা, আল হাক্কাহ-অবশ্যম্ভাবী ঘটনা, আল কারি‘আহ-প্রচন্ড আঘাতকারী।

একটি বস্ত্তর একাধিক নাম হলে তা সে বস্ত্তর গুরত্ব ও বড়ত্ব প্রমাণ করে।

ঈমান বিল ইয়াওমিল আখের-এর অর্থ হচ্ছে , মহান আল্লাহ ও রাসূলুল্লাহ কর্তৃক

বর্ণনাকৃত পুনরুত্থান, সমবেত করণ, হিসাব, সিরাত, মীযান, জান্নাত এবং জাহান্নামসহ সে মহা দিবসে যাবতীয় সঙ্ঘটিতব্য বিষয়াবলির উপর দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করা। এবং তার সাথে সাথে মৃত্যু পূর্বাপর সঙ্ঘটিতব্য বিষয়াবলি যেমন কিয়ামতের আলামত, কবরের সাওয়াল-জাওয়াব ও আযাব ইত্যাদিকেও বিশ্বাস করা ।

৯৭
আল ইয়াওমুল আখেরের গুরত্ব ও মর্যাদা
আল্লাহ তাআলা ও কিয়ামত দিবসের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন, ঈমানের রুকনসমূহের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ রুকন। দুনিয়া ও আখেরাতে মানুষের শান্তি, সফলতা ও কল্যাণ এ রুকনদ্বয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনসহ ঈমানের অপরাপর রুকনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের উপর ভিত্তিশীল। এ রুকনদ্বয়ের গুরুত্বের কারণেই আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনের বহু আয়াতে এ দু’টোক একত্রে বর্ণনা করেছেন।

১। আল্লাহ তাআলা বলেন :

ذَلِكُمْ يُوعَظُ بِهِ مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ ( الطلاق -২ )

তোমাদের মধ্যে যে আল্লাহ ও আখেরাত দিবসের প্রতি ঈমান আনে এটি দ্বারা তাকে উপদেশ দেয়া হচ্ছে। [সূরা তালাক : ২।]

২। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন :

اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ لَيَجْمَعَنَّكُمْ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ لَا رَيْبَ فِيهِ ﴿87﴾ –( النساء – ৮৭)

আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। অবশ্যই তিনি তোমাদের একত্রিত করবেন কিয়ামতের দিনে। এতে কোন সন্দেহ নেই। [সূরা নিসা: ৮৭।]

৩। আল্লাহ অন্যত্র বলছেন:

فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ ﴿59﴾ ( النساء - ৫৯)

অত:পর কোন বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ কর তাহলে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে প্রত্যার্পণ করাও- যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি ঈমান রাখ। [সূরা নিসা; ৫৯।]

৯৮
কবরের পরীক্ষা
عن البراء بن عازب رضي الله عنه قال : خرجنا مع رسول الله صلى الله عليه وسلم في جنازة .. ـ وفيه ـ قال النبي صلى الله عليه وسلم (( ويأتيه ملكان فيجلسانه فيقولان له : من ربك ؟ فيقول : ربي الله ، فيقولان له : ما دينك؟ فيقول : ديني الإسلام ، فيقولان له : ما هذا الرجل الذي بعث فيكم؟ قال : فيقول هو رسول الله صلى الله عليه وسلم )) أخرجه أحمد و أبو داود

বারা বিন আযিব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে একটি জানাযায় অংশ গ্রহণ করেছি ... -এতে আছে- নবী আকরাম সা. বলেন: এবং তার নিকট দু’জন ফেরেশতা আসবে, তারা তাকে বসিয়ে বলবে: তোমার রব কে? সে বলবে আমার রব, ‘আল্লাহ’। তারা বলবে: তোমার দ্বীন কি? সে বলবে: আমার দ্বীন হচ্ছে ‘ইসলাম’। তারা বলবে: এযে ইনি! তোমাদের নিকট পাঠানো হয়েছিল, তাঁর পরিচয় কি? সে বলবে: ইনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। [বর্ণনায় আহমদ ও আবু দাউদ। হাদীস নং আহমদ (১৮৭৩৩) ও আবু দাঊদ (৪৭৫৩)।]

وعن أنس بن مالك رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه و سلم قال : (( العبد إذا وضع في قبره و تولي وذهب أصحابه حتى إنه ليسمع قرع نعالهم ، أتاه ملكان فأقعداه فيقولان له : ما كنت تقول في هذا الرجل محمد صلى الله عليه وسلم ؟ فيقول : أشهد أنه عبد الله ورسوله . فيقال : انظر إلى مقعدك من النار أبدلك الله به مقعدا من الجنة )) قال النبي صلى الله عليه وسلم : فيراهما جميعا .

و أما الكافر أو المنافق فيقول : لا أدري كنت أقول ما يقول الناس . فيقال : لا دريت و لا تليت، ثم يضرب بمطرقة من حديد ضربة بين أذنيه فيصيح صيحة يسمعها من يليه إلا الثقلين )) متفق عليه

আনাস বিন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: মুমিন বান্দাকে যখন কবরে রাখা হয় এবং লোকেরা তাকে রেখে চলে আসে এক পর্যায়ে সে তাদের জুতার আওয়াজ শুনতে পায়, তখন তার নিকট দু’জন ফেরেশতা এসে তাকে বসিয়ে জিজ্ঞেস করে, এ ব্যক্তি অর্থাৎ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম সম্পর্কে কি বলতে তুমি? তখন সে বলে: আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি তিনি আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসূল। তখন তাকে বলা হয় : তাকিয়ে দেখ জাহান্নামে তোমার অবস্থানের দিকে, আল্লাহ তাআলা এর পরিবর্তে তোমাকে জান্নাতের ঐ স্থানটি দান করেছেন। নবীজী বলেন : তখন সে উভয় স্থানের দিকে তাকিয়ে দেখে।

আর সে যদি কাফের বা মুনাফিক হয়, তাহলে বলে : আমি কিছু জানি না, লোকেরা যা বলত আমিও তাই বলতাম। তখন বলা হয়, তুমি জানতে চেষ্টা করনি এবং পাঠ করনি, অত:পর লোহার প্রকান্ড এক হাতুড়ী দিয়ে তার দুই কানের মাঝে সজোরে আঘাত করা হয়, যার কারণে বিকট এক চিৎকার দেয় সে, মানুষ ও জিন ব্যতীত তার কাছে থাকা সকলেই সে চিৎকার শুনতে পায়। [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম , বুখারী হাদীস নং (১৩৩৮) এবং মুসলিম (২৮৭০)।]

৯৯
কবরের আযাব দু ধরনের:
১-স্থায়ী আযাব যা কিয়ামত পর্যন্ত অবিরাম চলতে থাকবে, কখনো বন্ধ হবে না, আর সেটি প্রয়োগ হবে কাফের ও মুনাফিকদের উপর । যেমন আল্লাহ তাআলা ফিরআউন সম্প্রদায় সম্পর্কে বলছেন:

النَّارُ يُعْرَضُونَ عَلَيْهَا غُدُوًّا وَعَشِيًّا وَيَوْمَ تَقُومُ السَّاعَةُ أَدْخِلُوا آَلَ فِرْعَوْنَ أَشَدَّ الْعَذَابِ ﴿46﴾ ( غافر : ৪৬)

আগুন, তাদেরকে সকাল-সন্ধ্যায় তার সামনে উপস্থিত করা হয়, আর যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে (সেদিন ঘোষণা করা হবে), ‘ফিরআউনের অনুসারীদেরকে কঠোরতর আযাবে প্রবেশ করাও। [সূরা গাফির : ৪৬।]

২- বিভিন্ন মেয়াদী আযাব যা মেয়াদান্তে বন্ধ হয়ে যায়, আর এ ধরনের আযাব প্রয়োগ করা হয় একত্ববাদে বিশ্বাসী গুনাহগার মুসলমানদের উপর। অপরাধ অনুপাতে নির্ধারিত শাস্তি ভোগ করতে থাকে, অত:পর আল্লাহর রহমত-অনুগ্রহ বা রেখে যাওয়া সদকায়ে জারিয়া, উপকারী ইলম বা নেক সন্তান যে তার জন্য দোআ করে ইত্যাদি, গুনাহ মোচনকারী আমলের কারণে শাস্তি হালকা বা একেবারে বন্ধ করে দেয়া হয়।

عن ابن عمر رضي الله عنهما أن رسول الله صلي الله عليه وسلم قال : إن أحدكم إذا مات عرض عليه مقعده بالغداة و العشي ، إن كان من أهل الجنة فمن أهل الجنة و إن كان من أهل النار فمن أهل النار يقال هذا مقعدك حتى يبعثك الله إليه يوم القيامة . متفق عليه

বিশিষ্ট সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমাদের কেউ মারা গেলে প্রত্যহ সকাল-সন্ধ্যায় তার কাছে তার অবস্থান উপস্থাপন করা হয়। যদি জান্নাতের অধিবাসী হয় তাহলে জান্নাত থেকে আর জাহান্নামী হলে জহান্নাম থেকে, এবং বলা হয় মহান আল্লাহ কিয়ামতের দিন তোমাকে তাঁর নিকট পুনরুত্থিত করা পর্যন্ত, এটি তোমার ঠিকানা। [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং বুখারী (১৩৭৯) ও মুসলিম (২৮৬৬)।]

১০০
কবরের নেয়ামতরাজি :
কবরের সর্বপ্রকার নেয়ামত ও সুখ-সমৃদ্ধি নেককার মুমিনদের জন্য সংরক্ষিত।

১- আল্লাহ তাআলা বলেন:

إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلَائِكَةُ أَلَّا تَخَافُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَبْشِرُوا بِالْجَنَّةِ الَّتِي كُنْتُمْ تُوعَدُونَ ﴿30﴾ { فصلت : ৩০}

নিশ্চয় যারা বলে, আল্লাহই আমাদের রব, অত:পর অবিচল থাকে, ফেরেশতারা তাদের কাছে নাযিল হয় (এবং বলে) তোমরা ভয় পেয়ো না, দুশ্চিন্তা করো না এবং সেই জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ কর তোমাদেরকে যার ওয়াদা দেয়া হয়েছিল। [সূরা ফুসসিলাত: ৩০।]

২-হাদীসে এসেছে

وعن البراء بن عازب رضي الله عنه أن النبي صلى الله عليه وسلم قال في المؤمن إذا أجاب الملكين في قبره : ((... فينادي مناد من السماء ، أن صدق عبدي ، فافرشوه من الجنة و ألبسوه من الجنة وافتحوا له بابا إلى الجنة ، قال فيأتيه من روحها و طيبها و يفسح له في قبره مد بصره )) أخرجه أحمد و أبو داود

সাহাবী বারা বিন আযিব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবরে ফেরেশতাদ্বয়ের প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্পন্নকারী মুমিন সম্পর্কে বলছেন : (... তখন আকাশে জনৈক ঘোষণাকারী ঘোষণা দেয়, আমার বান্দা সত্য বলেছে সুতরাং জান্নাত থেকে তার বিছানা বিছিয়ে দাও, জান্নাতী পোশাক তাকে পরিয়ে দাও এবং জান্নাতের দিকে তার জন্য একটি দরজা খুলে দাও। বর্ণনাকারী বলেন : তখন তার নিকট জান্নাতের বাতাস ও সুঘ্রাণ আসতে থাকে। এবং তার কবরকে দৃষ্টি সীমা পর্যন্ত বিস্তৃত করে দেয়া হয়। [হাদীসটি বিশুদ্ধ সনদে ইমাম আহমাদ ও আবু দাউদ বর্ণনা করেছেন। আহমাদ হাদীস নম্বর : (১৮৭৩৩) আর আবু দাউদ : (৪৭৫৩)।]

মুমিনদেরকে কবরের ভয়, পরীক্ষা ও আযাব থেকে কতিপয় আমলের কারণে মুক্তি দিয়ে দেয়া হয়। সে আমলগুলো যেমন, আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হওয়া, আল্লাহর রাস্তায় পাহারা দেয়া, অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি পেটের পীড়ায় মারা যায় ইত্যাদি।

১০১
মৃত্যুর পর থেকে কিয়ামত পর্যন্ত রূহ (আত্মা)-এর অবস্থানস্থল:
বরযখের মধ্যে অবস্থানের দিক থেকে রূহদের মধ্যে বড় ধরনের ব্যবধান রয়েছে:

-কিছু রূহ আছে যাদের অবস্থান; মালায়ে আ’লা তথা সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ সমাবেশ- ইল্লিয়্যীনের সর্বোচ্চ শিখরে। সেখানে অবস্থান করছে আম্বিয়া আলাইহিমুস্সালামের রূহসমূহ। অবস্থানগত দিয়ে তাদের নিজেদের মাঝে আবার পার্থক্য রয়েছে।

-কিছু রূহ পাখির আকৃতিতে জান্নাতের বৃক্ষরাজিতে ঝুলে আছে, সেগুলো সাধারণ মুমিনদের রূহ ।

-কিছু আছে যারা সবুজ রংয়ের বিশেষ পাখির পেটে করে জান্নাতে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে, সেগুলো আল্লাহর রাস্তায় জীবন উৎসর্গকারী মহৎপ্রাণ শহীদবৃন্দের রূহ ।

-কিছু আছে যারা নিজ কবরে বন্দী, যেমন যুদ্ধলব্ধ মাল আত্মসাৎকারী ।

-কিছু আছে ঋনের কারণে জান্নাতের প্রবেশদারে আটককৃত।

-কিছু রূহ নিজ নিকৃষ্টতার কারণে পৃথিবীতেই বন্দী থাকে।

-কিছু রূহ ব্যভিচারী নারী-পুরুষদের জন্য নির্মিত অগ্নিচুল্লিতে (শাস্তিরত) আছে।

-কিছু আছে যারা রক্তনদীতে সাতরাচ্ছে আর তাদের পাথর গিলানো হচ্ছে। তারা হচ্ছে সুদখোর...।

১০২
কিয়ামতের আলামত কিয়ামত সম্পর্কিত জ্ঞান:
কিয়ামত কখন সঙ্ঘঠিত হবে এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ ব্যতীত আর কারো জানা নেই । যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন:

يَسْأَلُكَ النَّاسُ عَنِ السَّاعَةِ قُلْ إِنَّمَا عِلْمُهَا عِنْدَ اللَّهِ وَمَا يُدْرِيكَ لَعَلَّ السَّاعَةَ تَكُونُ قَرِيبًا ﴿63﴾ ( الأحزاب : ৬৩)

লোকেরা তোমাকে কিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, বল, এ বিষয়ের জ্ঞান কেবল আল্লাহরই আছে, আর তোমার কি জানা আছে, কিয়ামত হয়ত খুব নিকটে। [সূরা আহযাব: ৬৩।]

কিয়ামতের নিদর্শনসমূহ:

নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিয়ামতের পূর্বে সংঘঠিতব্য কতিপয় আলামত ও নিদর্শনাবলী সম্পর্কে আমাদের বলেছেন, যেগুলো কিয়ামত অতি নিকটে মর্মে প্রমাণ করে। বর্ণিত নিদর্শনাবলী দু’ ধরণের ; আলামতে সুগরা তথা ছোট ছোট নিদর্শন , আলামতে কুবরা বা বড় বড় নিদর্শন।

১০৩
কিয়ামতের ছোট ছোট নিদর্শনাবলী কিয়ামতের ছোট ছোট নিদর্শনাবলী তিন ধরণের: ১-এমন এমন নিদর্শনাবলী যা সঙ্ঘঠিত হয়েছে এবং শেষও হয়ে গিয়েছে :
যেমন, নবীজীর আগমণ এবং প্রস্থান, তাঁর সত্যতার নিদর্শন স্বরূপ চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হওয়া , বাইতুল মুকাদ্দাসের বিজয় সূচিত হওয়া এবং হিজাযে অগ্নোৎপাতের ঘটনা ঘটা ।

عن عوف بن مالك رضي الله عنه قال : سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول : اعدد ستا بين يدي الساعة , موتي , ثم فتح بيت المقدس ... أخرجه البخاري (১)

সাহাবী আউফ বিন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলছেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছি , তুমি কিয়ামতের পূর্বে সঙ্ঘঠিতব্য ছয়টি বিষয় গননা কর; আমার মৃত্যু, অত:পর বাইতুল মুকাদ্দাসের বিজয়... ।

বোখারী: ৩১৭৬

وعن أبي هريرة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال :(( لا تقوم الساعة حتى تخرج نار من أرض الحجاز تضيء أعناق الإبل ببصرى )) متفق عليه

বিশিষ্ট সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন: হেজায থেকে একটি অগ্নোৎপাতের ঘটনা ঘটবে, ঐ আগুন বসরায় থাকা উঁটের গ্রীবা আলোকিত করে দেবে। অগ্নোৎপাতের উল্লেখিত ঘটনা ঘটার পূর্বে কিয়ামত সঙ্ঘঠিত হবে না ।

বর্ণনায়: বোখারী:৭১১৮ ও মুসলিম : ২৯০২ ।

১০৪
২-এমন আলামত যা প্রকাশ পেয়ে এখনও বিদ্যমান আছে :
যেমন: বিভিন্ন ফেতনার আবির্ভাব.. নবওয়্যতের মিথ্যা দাবিদারের আত্মপ্রকাশ ..

শরয়ী ইলম উঠিয়ে নেয়া.. অজ্ঞতার ব্যাপক উপস্থিতি.. নিরাপত্তা কর্মী ও অপরাধীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া.. বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র প্রকাশ পাওয়া ও একে হালাল মনে করা.. যিনা-ব্যভিচার ব্যাপক হয়ে যাওয়া..ব্যাপকহারে মদ্য পান ও একে হালাল মনে করা.. নাঙ্গা পা, নাঙ্গা বদন ও বকরীর রাখালদের বড় বড় অট্টালিকা নির্মাণ অর্থাৎ সমাজের নিম্ন শ্রেণীর লোকদের সম্পদের দিক থেকে ব্যাপক উত্থান.. মসজিদ ও তার কারুকার্য নিয়ে লোকদের গর্ববোধ ও প্রতিযোগিতা..হত্যাকান্ড বৃদ্ধি পাওয়া .. সময় খাটো ও সঙ্কুচিত হয়ে যাওয়া..অনুপযুক্ত লোকের নিকট দায়িত্ব অর্পণ করা.. মন্দ লোকদের ক্ষমতায়ন ও সম্মান দান.. ভাল লোকদের অপসারণ ও অপদস্ত করণ.. চাকচিক্যময় বালখিল্যতার আধিক্য.. কর্মের ঘাটতি ও অনুপস্থিতি.. অতি কাছাকাছি বাজার-ঘাটের উপস্থিতি..

এ উম্মতের মাঝে শিরকের আবির্ভাব..লোভ-লালসা ও কৃপণতার আধিক্য.. মিথ্যার আধিক্য.. সম্পদের আধিক্য.. ব্যবসা-বানিজ্যের ব্যাপক প্রসারতা লাভ.. অধিক পরিমাণে ভূমি কম্পণ.. আমানতদার-বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের খিয়ানত তথা বিশ্বাস ভঙ্গের অভিযোগে অভিযুক্ত করণ এবং বিশ্বাসঘাতক-গাদ্দারদের আমানতদার জ্ঞানকরণ.. অশ্লীলতার ব্যাপক উপস্থিতি.. আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করণ, নিকৃষ্টশ্রেণীর লোকদের ব্যাপক উত্থান ও উন্নতি সাধন, বিচারের রায় বেচা-কেনা, ছোট ও নিম্নতর লোকদের নিকট ইলম অন্বেষণ করণ..ব্যাপক হারে কলমের আবির্ভাব, বসনাবৃত উলঙ্গ নারীর আবির্ভাব, মিথ্যা সাক্ষ্যদানের আধিক্য, আকস্মিক মৃত্যুর প্রাদুর্ভাব, হালাল রিযিক অন্বেষনে অনীহা, আরব ভূমি নদী-নালায় পরিণত হওয়া।

হিংস্র জন্তুর মানুষের সাথে কথা বলা, লাঠি ও জুতার ফিতা কর্তৃক মালিকের সাথে কথা বলা , স্বীয় স্ত্রী তার অনুপস্থিতিতে কি কি বলেছে সে বিষয়ে তার নিকট বলে দেয়া, ইরাক অবরুদ্ধ হওয়া এবং তাতে টাকা-পয়সা ও খাদ্য-খাবার পৌছতে বাধা দেয়া, অত:পর সিরিয়া-কে অবরোধ করা, এবং খানা-খাদ্য ও টাকা-পয়সার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা, অত:পর মুসলমান ও রোমানদের সাথে যুদ্ধবিরতি ও শান্তি চুক্তি হবে এরপর রোমানরা মুসলমানদের সাথে গাদ্দারি করবে ইত্যাদি।

عن ابن عمر رضي الله عنهما أنه سمع رسول الله صلى الله عليه وسلم و هو مستقبل المشرق يقول : ألا إن الفتنة ها هنا , ألا إن الفتنة ها هنا , من حيث يطلع قرن الشيطان . متفق عليه (১)

সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত , তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পূর্বদিক তাকিয়ে বলতে শুনেছেন: আল্লাহর রাসূল সা. বলেন: মনযোগ দিয়ে শোন, নিশ্চয়ই ফিতনার উৎপত্তি ঐ স্থান থেকে , ফিতনার উৎপত্তি ঐ স্থান থেকে যেখান থেকে শয়তানের সিং উদিত হয়। ( বুখারী , মুসলিম ) বুখারী-৭০৯৩ মুসলিম-২৯০৫

১০৫
৩-এমন সব নিদর্শন যা এখনো প্রকাশ পায়নি তবে নি:সন্দেহে রাসূলুল্লাহর বর্ণনানুযায়ী অচিরেই প্রকাশ পাবে :
যেমন ফোরাত নদী থেকে স্বর্ণের পাহাড় প্রকাশ পাওয়া, যুদ্ধ ও অস্ত্র ব্যতীতই কন্স্টানটিনোপ্ল (ইস্তাম্বুল) জয় করা, তুরস্কের সাথে যুদ্ধ, ইহুদীদের সাথে যুদ্ধ এবং তাদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের সাহায্য প্রাপ্ত হওয়া, কাহতান নামক স্থান থেকে এক ব্যক্তির আত্মপ্রকাশ ঘটবে যে লোকদের নিজ লাঠি দ্বারা তাড়িয়ে বেড়াবে এবং লোকেরা আনুগত্যের মাধ্যমে তার কাছে নতি স্বীকার করবে, পুরুষের সংখ্যা কমে যাওয়া এবং নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া এমনকি পঞ্চাশ জন নারীর জন্য মাত্র একজন নিয়ন্ত্রক হবে। আরোও একটি নিদর্শন হচ্ছে , মাহদীর আগমন - তিনি নবী পরিবার থেকে আগত একজন বিশেষ ব্যক্তি - আল্লাহ তাআলা তাঁর মাধ্যমে দ্বীনের সাহায্য করবেন। তাঁর আবির্ভাবের পর পৃথিবী ন্যায় ও ইনসাফে ভরে যাবে যেমনিভাবে অন্যায় ও জুলুমে ভরে গিয়েছিল । তিনি সাত বৎসর রাজত্ব করবেন। তাঁর রাজত্বকালে উম্মত এত সুখ ও সাচ্ছন্দে জীবন যাপন করবে যা তারা ইতিপূর্বে আর কখনও করতে পারেনি। তিনি পূর্ব হতে আত্মপ্রকাশ করবেন এবং বায়তুল্লাহর নিকট বাইআত গ্রহণ করবেন।

কিয়ামতের পূর্বে সঙ্ঘটিতব্য আরো একটি আলামত হচ্ছে, যুস সুওয়াইক্বাতাইন নামক জনৈক হাবশীর হাতে পবিত্র কাবা ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়া এরপর কাবা শরীফ আর নির্মিত হবে না। এটি একেবারে সর্বশেষ যুগের ঘটনা। আল্লাহ তাআলা ভাল জানেন।

উপরিউক্ত নিদর্শনাবলী যা আমরা বর্ণনা করেছি সবগুলোই সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।

১০৬
কিয়ামতের বড় বড় নিদর্শনাবলী
عن حذيفة بن أسيد الغفاري رضي الله عنه قال : اطلع النبي صلى الله عليه وسلم علينا و نحن نتذاكر فقال : ما تذكرون؟ قالوا : نذكر الساعة . قال : إنها لن تقوم حتى ترون قبلها عشر آيات فذكر الدخان , والدجال , والدابة , وطلوع الشمس من مغربها , ونزول عيسى بن مريم عليه السلام , ويأجوج ومأجوج , وثلاثة خسوف , خسف بالمشرق وخسف بالمغرب و خسف بجزيرة العرب , وآخر ذلك نار تخرج من اليمن تطرد الناس إلى محشرهم . أخرجه مسلم (১)

সাহাবী হুযায়ফা বিন উসায়দ আল গিফারী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমরা একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলাম আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিকট এসে বললেন: তোমরা কি নিয়ে আলোচনা করছ? লোকেরা বলল: কিয়ামত নিয়ে। রাসূলুল্লাহ বললেন : দশটি আলামত প্রত্যক্ষ করার পূর্বে কিয়ামত কখনো সাঙ্ঘটিত হবে না। এর পর তিনি নিম্নোক্ত বিষয়গুলো উল্লেখ করলেন: ধুঁয়া, দাজ্জাল, বিশেষ ধরণের জন্তু, পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত হওয়া, ঈসা বিন মারয়াম আলাইহিস সালামের অবতরণ, ইয়াজুজ-মাজুজের আবির্ভাব, তিনটি ভূমিধস, একটি প্রাচ্যে, একটি পাশ্চাত্যে এবং তৃতীয়টি আরব ভূ-খন্ডে,এবং সবার শেষে এক প্রকারের আগুন যা ইয়েমেন থেকে বের হয়ে লোকদের হাশরের ময়দানে তাড়িয়ে নিয়ে যাবে। [মুসলিম(২৯০১)]

১০৭
১- দাজ্জালের আবির্ভাব:
দাজ্জাল - একজন আদম সন্তান- একজন মানুষ। শেষ যুগে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়ে প্রভূত্বের দাবি করবে। প্রাচ্যের খোরাসান নগরী থেকে তার আত্মপ্রকাশ ঘটবে। অত:পর পৃথিবী ব্যাপী ভ্রমন করবে এবং মক্কা, মদিনা, তুর এবং বাইতুল মুকাদ্দাস ব্যতীত পৃথিবীর প্রত্যেক শহরেই প্রবেশ করবে। ফেরেশতাদের বিশেষ পাহারার কারণে উল্লেখিত চার শহরে প্রবেশ করতে পারবে না। নিম্ন ও জলাভূমি দিয়ে শহরে প্রবেশ করবে। তার অবতরনের ফলে শহর তিন বার ঝাঁকুনি দিয়ে প্রকম্পিত হবে তখন ঐ শহরে থাকা সকল মুনাফিক ও কাফের এসে তার কাছে জড় হবে।

১০৮
দাজ্জালের ফেতনা:
দাজ্জালের আবির্ভাব একটি বড় ফেতনা। এর কারণ হচ্ছে আল্লাহ তাআলা তার সাথে অতিপ্রাকৃত-অলৌকিক এমন কিছু জিনিষ দেবেন যা অতি সচেতন - বুদ্ধিদীপ্ত মানুষদেরও হতবুদ্ধি করে দেবে। হাদীসে এসেছে , তার সাথে জান্নাত ও জাহান্নাম থাকবে। তার জান্নাত প্রকৃত অর্থে জাহান্নাম এবং তার জাহান্নাম মূলত জান্নাত। এবং তার সাথে রুটির পাহাড় ও পানির নহর থাকবে । আকাশকে নির্দেশ দিলে আকাশ বৃষ্টি বর্ষণ করবে । ভূমিকে হুকুম করলে ভূমি শষ্য-উদ্ভিদ উৎপন্ন করবে। ভূমি অভ্যন্তরের যাবতীয় ধনভান্ডার তার পিছনে পিছনে চলবে। প্রবল বাতাস যেভাবে মেঘমালা কে খুব দ্রুততার সাথে তাড়িয়ে নিয়ে যায় অনুরূপ দ্রুততার সাথে সে রাস্তা অতিক্রম করবে।

পৃথিবীতে মোট চল্লিশ দিন অবস্থান করবে, প্রথম দিন হবে এক বৎসর সমান, দ্বিতীয় দিন এক মাসের সমান, তৃতীয় দিন এক সাপ্তাহের সমান, অবশিষ্ট দিনগুলো আমাদের দিনের মতই। অত:পর নবী ঈসা আলাইহিস সালাম ফিলিস্তীনের ‘বাবে লুদ্দ’ নামক স্থানে তাকে হত্যা করবেন।

১০৯
দাজ্জালের বিবরণ:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে দাজ্জাল সম্পর্কে সতর্ক করে তার অনুসরণ ও তাকে সত্য বলে স্বীকৃতি দিতে নিষেধ করেছেন। তার অবস্থা ও ধরণ-প্রকৃতি সম্পর্কে বিশদ বিবরণ দিয়েছেন, যাতে আমরা তার থেকে সতর্ক থাকতে পারি। তিনি বলেছেন: সে বয়সে হবে যুবক, গায়ের রং রক্তিমবর্ণ, এক চক্ষু বিশিষ্ট-কানা, তার কোন সন্তানাদি হবে না, দু'চোখের মাঝে লেখা থাকবে ‘‘কাফের’’ প্রত্যেক মুসলমান তা পড়তে পারবে।

عن عبادة بن الصامت رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم :(( إن مسيح الدجال رجل قصير , أفحج , جعد , أعور , مطموس العين , ليس بناتئة ولا جحراء , فإن ألبس عليكم فاعلموا أن ربكم تبارك وتعالى ليس بأعور )). أخرجه أحمد و أبو داود .

সাহাবী উবাদা বিন সামেত রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন , রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: দাজ্জাল হচ্ছে খাটোকায়-বেটে, দু’পায়ের নলা ঈসৎ ফাঁকা, কোঁকড়া চুল বিশিষ্ট, এক চক্ষুহীন-কানা, চক্ষু লেপ্টানো, একেবারে উপরে উঠানো-ভাসা ভাসাও নয় আবার একেবারে গর্তের ভিতর ঢুকানোও নয়। তার বিষয়টি যদি তোমাদের নিকট অস্পষ্ট মনে হয় এবং তোমরা ধাঁধাঁয় পড়ে যাও তাহলে জেনে নাও তোমাদের পালনকর্তা কানা নন।

বর্ণনায় আহমদ (২৩১৪৪) ও আবু দাউদ(৪৩২০) , হাদীসের সনদ সহীহ।

১১০
দাজ্জালের আবির্ভাবের স্থান:
عن النواس بن سمعان رضي الله عنه قال : ذكر رسول الله صلى الله عليه وسلم الدجال و فيه : ((... إنه خارج خلة بين الشام و العراق فعاث يمينا و عاث شمالا )) أخرجه مسلم

সাহাবী নাওয়াস বিন সামআন রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাজ্জালের আলোচনা করেছেন, তাতে আছে ((... সে ইরাক ও সিরিয়ার মধ্যবর্তীস্থান ‘‘ খিল্লাহ ’’ নামক স্থানে আবির্ভূত হবে অত:পর ডানে ও বামে খুব দ্রুত বি:শৃংখলা সৃষ্টি করবে।

বর্ণনায় মুসলিম হাদীস নং২৯৩৭

যে সব স্থানে দাজ্জাল প্রবেশ করতে পারবে না:

(১) عن أنس رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : (( ليس من بلد إلا سيطؤه الدجال إلا مكة و المدينة )). متفق عليه

বিশিষ্ট সাহাবী আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: মক্কা ও মদিনা ব্যতীত পৃথিবীর সকল শহরেই দাজ্জাল প্রবেশ করবে। বুখারী (১৮৮১) ও মুসলিম(২৯৪৩)

وعن رجل من أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم أن النبي صلى الله عليه وسلم ذكر الدجال وفيه- قال : (( ولا يقرب أربعة مساجد , مسجد الحرام , و مسجد المدينة , و مسجد الطور , و مسجد الأقصى )) أخرجه أحمد

নবীজীর একজন সাহাবী থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাজ্জাল সম্পর্কে আলোচনা করেছেন -তাতে আছে- নবীজী বলেন:সে চারটি মসজিদের কাছেযেতেপারবেনা,মসজিদুল হারাম , মসজিদুন নববী, মসজিদুত তূর এবং মসজিদুল আকসা।

হাদীসটি সহীহ সনদে ইমাম আহমদ বর্ণনা করেছেন। হাদীস নং২৪০৮৫ , দেখুন: আসসিলসিলাতুস সহীহা ক্রমিক:২৯৩৪

১১১
দাজ্জালের অনুসারী:
দাজ্জালের অধিকাংশ অনুসারীদের মধ্যে থাকবে ইহুদী, ইস্পাহানের অনেক লোক।

عن أنس بن مالك رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال :(( يتبع الدجال من يهود أصبهان سبعون ألفا عليهم الطيالسة )). أخرجه مسلم

আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করছেন,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: দাজ্জালেন অনুসরন করবে ইস্পাহানের কতিপয় ইহুদী, এদের সত্তর হাজার হবে এমন, যাদের গায়ে এক রকমের বিশেষ চাদর থাকবে।

বর্ণনায় মুসলিম হাদীস নং:(২৯৪৪)

১১২
দাজ্জালের ফেৎনা থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়:
নবীজী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাজ্জালের ফেৎনা থেকে বাঁচার অনেকগুলো উপায় বাতলেছেন যেগুলো হাদীসের বিভিন্ন কিতাবে পাওয়া যায়। আমরা এখানে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি তুলে ধরছি।

আল্লাহ তাআলার উপর পরিপূর্ণ ঈমান, সর্বদা বিশেষ করে সালাতে আল্লাহ তাআলার নিকট দাজ্জালের ফেৎনা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা এবং তার থেকে ভেগে থাকা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

(( من حفظ عشر آيات من أول سورة الكهف عصم من الدجال )) وفي لفظ (( فمن أدركه منكم فليقرأ عليه فواتتح سورة الكهف )) أخرجه مسلم .

যে ব্যক্তি সূরা কাহফের প্রথম দশ আয়াত সংরক্ষণ করবে তাকে দাজ্জালের ফেৎনা থেকে নিরাপদ রাখা হবে। অন্য রেওয়াতে এসেছে: তোমাদের কাউকে যদি সে পেয়ে বসে তাহলে সে যেন তার উপর সূরা কাহফের প্রথম কয়েকটি আয়াত পড়ে।

(বর্ণনায় মুসলিম হাদীস নং ৮০৯ এবং ২৯৩৭)

১১৩
২- ঈসা বিন মারইয়াম আলাইহিস সালামের অবতরণ:
দাজ্জালের আবির্ভাব ও পৃথিবীতে তার বিশৃংখলা-ফ্যাসাদ সৃষ্টির পর আল্লাহ তাআলা ঈসা বিন মারইয়াম আলাইহিস সালামকে প্রেরণ করবেন। তিনি পূর্ব দামেস্কের সাদা মিনারের নিকট দু’জন ফেরেশতার পাখায় ভর করে পৃথিবীতে অবতরণ করবেন এবং দাজ্জালকে হত্যা করবেন। এরপর পৃথিবীতে ইসলামী হুকুমত কায়েম করে পবিত্র কুরআন অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করবেন। খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় প্রতীক-ক্রুশ ভেঙ্গে ফেলবেন, শুকর নিধন করবেন এবং জিযিয়া-কর মওকূফ করে দেবেন, ধন-সম্পদ প্রচুর পরিমাণে বেড়ে যাবে, পারস্পরিক শত্রুতা-বিদ্বেষ উঠে যাবে, পৃথিবীতে সাত বছর অবস্থান করবেন এমনভাবে যে দু’জন ব্যক্তির মাঝে পারস্পরিক কোন শত্রুতা নেই। অত:পর মৃত্যুবরণ করবেন এবং মুসলমানেরা তার জানাযা পড়বেন।

অত:পর আল্লাহ তাআলা সিরিয়ার দিক থেকে এক প্রকার পবিত্র (সুরভিত) ঠান্ডা বায়ূ প্রেরণ করবেন। ফলে পৃথিবীর বুকে জীবনধারণকারী - যার হৃদয়ে অনু পরিমাণ কল্যাণ বা ঈমানও অবশিষ্ট আছে- সকলেই মৃত্যুমুখে পতিত হবে। বেচে থাকবে শুধু পাখির চঞ্চলতা ও হিংস্র জন্তুর চতুরতা নিয়ে নিকৃষ্টতর মানুষ সকল, তারা গাধার ন্যায় অস্থির ও ভারসাম্যহীন আচরণ করবে। অত:পর শয়তান তাদেরকে মুর্তিপূজার নির্দেশ দেবে আর তাদের উপরই কায়েম হবে কেয়ামত।

عن أبي هريرة رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : والذي نفسي بيده ليوشكن أن ينزل فيكم ابن مريم حكما و عدلا , فيكسر الصليب , ويقتل الخنزير ويضع الجزية , و يفيض المال حتى لا يقبله أحد , حتى تكون السجدة الواحدة خيرا من الدنيا و ما فيها . ثم يقول أبو هريرة رضي الله عنه : واقرؤا إن شئتم : ( وإن من أهل الكتاب إلا ليؤمنن به قبل موته و يوم القيامة يكون عليهم شهيدا { النساء : ১৫৯} متفق عليه

বিশিষ্ট সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বণির্ত: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: কসম সে সত্ত্বার যার হাতে আমার জীবন, অচিরেই তোমাদের নিকট ঈসা বিন মারইয়াম আলাইহিস সালাম ন্যায়পরায়ণ শাসক হয়ে আবির্ভূত হবেন। তিনি এসে ক্রুশ ভেঙ্গে ফেলবেন, শুকর নিধন করবেন এবং জিযিয়া-কর মওকূফ করে দেবেন। ধন-সম্পদ প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে এক পর্যায়ে গ্রহণ করার মত কাউকে পাওয়া যাবে না। এমন কি মানুষের নিকট তখন একটি মাত্র সেজদা দুনিয়া এবং দুনিয়াস্থিত সকল কিছুর থেকে উত্তম মনে হবে। অত:পর আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন: যদি তোমাদের মনে চায় তাহলে পড়:

: ( وإن من أهل الكتاب إلا ليؤمنن به قبل موته و يوم القيامة يكون عليهم شهيدا { النساء : ১৫৯}

আর আহলে কিতাবদের মধ্যে যত শ্রেণী রয়েছে তারা সকলেই ঈসার উপর ঈমান আনবে তার মৃত্যুর পূর্বে। আর কেয়ামতের দিন তাদের জন্য সাক্ষীর উপর সাক্ষী উপস্থিত হবে। (সূরা নিসা:১৫৯)

বর্ণনায় বুখারী (৩৪৪৮) ও মুসলিম (১৫৫)

১১৪
৩- ইয়াজুজ মাজুজের আবির্ভাব:
ইয়াজুজ মাজুজ বনী আদমের দু’টি বিশাল জাতি। তারা খুবই শক্তিধর মানুষ, তাদের মোকাবেলা ও তাদেন সাথে যুদ্ধ করার ক্ষমতা কারো নেই। তাদের আবির্ভাব কেয়ামতের বড় বড় নিদর্শনের অন্যতম। পৃথিবীতে এসে তারা অনর্থ ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করবে। অত:পর নবীঈসা আলাইহিস সালাম তাদের বিরুদ্ধে বদ্ দোআ করবেন ফলে সকলেই মরে যাবে।

(১) মহান আল্লাহ তাআলা বলেন:

حتى إذا فتحت يأجوج و مأجوج و هم من كل حدب ينسلون ( الأنبياء : ৯৬)

এমন কি যখন ইয়াজুজ ও মা’জুজকে মুক্তি দেয়া হবে এবং তারা প্রত্যেক উঁচু ভূমি হতে ছুটে আসবে। ( সূরা আম্বিয়া:৯৬)

(২) وعن النواس بن سمعان رضي الله عنه قال : ذكر رسول الله صلى الله عليه وسلم الدجّال و أن عيسى يقتله بباب لدّ ... – فيه – (( إذ أوحى الله إلى عيسى : إني قد أخرجت عبادا لي لا يدان لأحد بقتالهم , فحرّز عبادي إلى الطور , و يبعث الله يأجوج و مأجوج و هم من كل حدب ينسلون , فيمرّ أوائلهم على بحيرة طبرية فيشربون ما فيها , و يمر آخرهم فيقولون : لقد كان بهذه مرة ماء , و يحصر نبي الله عيسى و أصحابه حتى يكون رأس الثور لأحدهم خيرا من مائة دينار لأحدكم اليوم , فيرغب نبي الله عيسى و أصحابه فيرسل الله عليهم النغف في رقابهم فيصبحون فرسى كموت نفس واحدة , ثم يهبط نبي الله عيسى و أصحابه إلى الأرض ...)) أخرجه مسلم

সাহাবী নাওয়্যাস বিন সাম‘আন রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার আলোচনা করছিলেন যে, দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে এবং নবী ঈসা আলাইহিস সালাম তাকে বাবে লুদ্দ নামক স্থানে হত্যা করবেন...-এবং তাতে আছে- (তখন আল্লাহ তাআলা ঈসার নিকট প্রত্যাদেশ প্রেরণ করবেন যে, আমি আমার এক বিশেষ বান্দাদের বের করেছি যাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা কারো নেই। আপনি আমার বান্দাদের তুর পাহাড়ে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করুন তাদের সেখানে যেতে বলুন। এরপর আল্লাহ তা‘আলা ইয়াজুজ মা’জুজ পাঠাবেন, তারা প্রত্যেক উঁচু ভূমি হতে ছুটে আসবে। তাদের প্রথম দল তাবারী হ্রদ অতিক্রম করবে এবং তাতে যা আছে সব পান করে ফেলবে। এর পর শেষ দল এসে বলবে ,এতে কোন এক সময় পানি ছিল। এক সময় আল্লাহর নবী ঈসা ও তার সঙ্গীরা অবরুদ্ধ হয়ে যাবেন। এক পর্যায়ে তাদের নিকট একটি গুরুর মাথা আজকে তোমাদের কাছে একশত দীনারের চেয়েও উত্তম মনে হবে।অত:পর নবী ঈসা আলাইহিস সালাম ও তাঁর সহচরবৃন্দ আল্লাহর নিকট দোআ করবেন, আল্লাহ তাআলা তাদের গ্রীবাদেশে ‘‘নাগাফ’’ নামক এক প্রকার বিষাক্ত পোকা (যা মূলত উট ও বকরীর নাকে থাকে) পাঠাবেন। ফলে তারা এক ব্যক্তির মৃত্যুর ন্যায় সকলে এক সাথে মরে যাবে। পরে আল্লাহর নবী ঈসা ও তাঁর সাথীবৃন্দ যমীনে নেমে আসবেন...). বর্ণনায় মুসলিম:(২৯৩৭)

নবী ঈসা আলাইহিস সালাম ও তাঁর সহচরবৃন্দের ভূমিতে অবতরনের পর তাঁরা আল্লাহ তাআলার নিকট দোআ করবেন। আল্লাহ তাআলা তাঁদের দোআ কবুল করে এক প্রকার বিশেষ পাখি প্রেরণ করবেন তারা ইয়াজুজ মাজুজকে তুলে নিয়ে আল্লাহ যেখানে নিক্ষেপ করতে বলবেন সেখানে নিক্ষেপ করবে।অত:পর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বৃষ্টি বর্ষণ করে ভূমিকে ধুয়ে দেবেন।এরপর পৃথিবীতে অধিক পরিমানে বরকত নাযিল হবে ,তরি-তরকারি, শাক-সবজি, ফল-মূল প্রচুর পরিমানে উৎপন্ন হবে। উদ্ভিদ-তৃণ ও পশুর ক্ষেত্রেও উক্ত বরকত পরিলক্ষিত হবে।

১১৫
৪-৫-৬- তিনটি ভুমিধস:
কেয়ামতের পূর্বক্ষণে তিনটি ভূমিধস ঘটবে। ঐ ভূমিধস কেয়ামতের বড় বড় নিদর্শনের অন্যতম। তিনটির একটি ঘটবে প্রাচ্যে দ্বিতীয়টি পাশ্চাত্যে এবং তৃতীয়টি আরব ভূ-খন্ডে। এগুলো এখনো সংঘটিত হয়নি।

১১৬
৭- ধুম্র:
শেষ যুগে ধোঁয়ার আবির্ভাব কেয়ামতের একটি বড় আলামত।

(১) মহান আল্লাহ তাআলা বলেন:

فارتقب يوم تأتي السماء بدخان مبين , يغشى الناس هذا عذاب أليم . { الدخان : ১০-১১)

অতএব আপনি অপেক্ষা করুন সে দিনের যে দিন স্পষ্ট ধুম্রাচ্ছন্ন হবে আকাশ, এবং তা আবৃত করে ফেলবে মানব জাতিকে। এটি হবে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। ( সূরা দোখান:১০-১১)

(২) وعن أبي هريرة رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال : بادروا بالأعمال ستا : طلوع الشمس من مغربها أو الدخان أوالدجال أو الدابة أو خاصة أحدكم أو أمر العامة . أخرجه مسلم .

(২) বিশিষ্ট সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: ব্যক্তিগতভাবে হোক অথবা সাধারনভাবে হোক, তোমরা ছয়টি বস্ত্তর অভ্যূদয়ের পূর্বেই নেক আমল বেশি পরিমাণে সম্পাদন কর। বস্ত্ত ছয়টি হচ্ছে, পশ্চিম থেকে সূর্যোদয়, ধুম্র, দাজ্জাল, জন্তু।

১১৭
৮- অস্তাচল থেকে সূর্যোদয়:
পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয়ের ঘটনা কেয়ামতের বড় বড় নিদর্শনের অন্তর্ভূক্ত। এটিই হচ্ছে উর্দ্ধজগতের পরিবর্তন সংক্রান্ত বিষয়ে অবহিতকারী সর্ব প্রথম বড় নিদর্শন। এ ব্যাপারে কোরআন ও হাদীসে অনেক তথ-প্রমাণ বিদ্যমান। আমরা এখানে অল্পকিছু তুলে ধরছি:

(১) মহান আল্লাহ তাআলা বলেন:

يوم يأتي بعض آيات ربك لا ينفع نفسا إيمانها لم ...{ الأنعام : ১৫৮)

যেদিন আপনার প্রতিপালকের কতক নিদর্শন প্রকাশ হয়ে পড়বে, (পশ্চিম দিক থেকে যেদিন সূযোদয় ঘটবে) সেই দিনের পূর্বে যারা ঈমান আনেনি, তাদের ঈমান তখন কোন উপকারে আসবে না, অথবা যারা নিজেদের ঈমান দ্বারা কোন নেক কাজ করেনি (তখন নেক কাজ দ্বারা কোন ফলোদয় হবে না)। (সূরা আল আন‘আম: ১৫৮)

(২) وعن أبي هريرة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال :(( لا تقوم الساعة حتى تطلع الشمس من مغربها , فإذا طلعت من مغربها آمن الناس كلهم أجمعون , فيومئذ : ( لا ينفع نفسا إيمانها لم تكن آمنت من قبل أو كسبت في إيمانها خيرا ) متفق عليه

বিশিষ্ট সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেবে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উদিত হওয়ার পূর্বে কেয়ামত সংঘটিত হবে না। যখন সেদিক থেকে উদিত হবে তখন পৃথিবীস্থিত সকল মানুষ ইসলাম গ্রহণ করবে। তবে সেদিন, এ দিনের দিনের পূর্বে যারা ঈমান আনেনি, তাদের ঈমান কোন উপকারে আসবে না, অথবা যারা নিজেদের ঈমান দ্বারা কোন নেক কাজ করেনি (তখন নেক কাজ দ্বারা কোন ফলোদয় হবে না (( বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম । বুখারী হাদীস নং (৪৬৩৫) আর মুসলিম হাদীস নং (১৫৭)

(৩) وعن عبد الله بن عمرو رضي الله عنهما قال : سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم سقول : (( إن أول الآيات خروجا طلوع الشمس من مغربها , وخروج الدابة على الناس ضحى , وأيهما ما كانت قبل صاحبتها فالأخرى على إثرها قريبا )) أخرجه مسلم

সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ইরশাদ করতে শুনেছি, রাসূলুল্লাহ বলেন: কেয়ামতের বড় বড় নিদর্শনাবলির মধ্যে সর্ব প্রথম যেটির আবির্ভাব ঘটবে তা হচ্ছে, পশ্চিম দিক হতে সূর্যোদয় এবং পূর্বা ‎‎ হ্নর সময় বিশেষ জন্তুর অভ্যূদয়। এদের যেটিই প্রথমে আবির্ভূত হোক দ্বিতীয়টি এর পরপরই আবির্ভূত হবে। বর্ণনায় মুসলিম: (২৯৪১)

১১৮
৯- বিশেষ জন্তুর আত্মপ্রকাশ:
শেষ যুগে একটি বিশেষ শ্রেণীর জন্তুর আত্মপ্রকাশ ঘটবে আর এটির প্রকাশ পাওয়াই হচ্ছে কেয়ামত অতি নিকটে এসে যাওয়ার আলামত। তারা বের হওয়ার পর লোকেরা তাদের শুঁড়ে বিষ ঢেলে দেবে, কাফেরদের নাকে লাগাম লাগানো হবে আর মুমিনবান্দাদের চেহারা আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠবে।

উক্ত জন্তুর প্রকাশ প্রসঙ্গে আমরা কিছু দলীল পেশ করছি :

(১) মহান আল্লাহ তাআলা বলেন:

وإذا وقع القول عليهم أخرجنا لهم دابة من الأرض تكلمهم أن الناس كانوا بآياتنا لا يوقنون .{ النمل : ৮২}

যখন প্রতিশ্রুতি (কেয়ামত) সমাগত হবে, তখন আমি তাদের সামনে ভূগর্ভ থেকে একটি জীব নির্গত করব। তারা মানুষের সাথে কথা বলবে। এ কারণে যে, মানুষ আমার নিদর্শনসমূহে বিশ্বাস করত না। ( সূরা আন্ নামল: ৮২ )

(২) وعن أبي هريرة رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : (( ثلاث إذا خرجن لا ينفع نفسا إيمانها لم تكن آمنت من قبل أو كسبت في إيمانها خيرا : طلوع الشمس من مغربها , والدجال , ودابة الأرض )). أخرجه مسلم

সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: (কেয়ামতের পূর্বে) যখন তিনটি নিদর্শন প্রকাশ পাবে তখন আর সেই দিনের পূর্বে যারা ঈমান আনেনি, তাদের ঈমান কোন উপকারে আসবে না, অথবা যারা নিজেদের ঈমান দ্বারা কোন নেক কাজ করেনি তখন নেক কাজ দ্বারা কোন ফলোদয় হবে না) নদর্শন তিনটি হচ্ছে পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয়, দাজ্জাল এবং ভূ-নির্গত জন্তু। বর্ণনায় সহীহ মুসলিম: (১৫৮)

১১৯
১০- মানুষদের সমবেত কারী আগুনের আবির্ভাব:
এটি একটি বড় ধরণের আগুন যা প্রাচ্যের ইয়েমেনের এডেনের ভূগর্ভ থেকে বের হবে। এটি কেয়ামতের বড় নিদর্শনাবলির সর্বশেষ নিদর্শন। এবং কেয়ামত সংঘটিত হওয়ার ঘোষণা কারী সর্ব প্রথম আলামত। ইয়েমেন থেকে বের হয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং মানুষদের সিরিয়ার সমবেত হওয়ার স্থলে তাড়িয়ে নিয়ে যাবে ।

আগুন লোকদের কি ভাবে সমবেত করবে:

عن أبي هريرة رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال :(( يحشر الناس على ثلاث طرائق : راغبين , وراهبين , واثنان على بعير , ثلاثة على بعير , أربعة على بعير , عشرة على بعير , يحشر بقيتهم النار , تقيل معهم حيث قالوا , وتبيت معهم حيث باتوا , وتصبح معهم حيث أصبحوا , وتمسي معهم حيث أمسوا )). متفق عليه

বিশিষ্ট সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: লোকদের সমবেত করা হবে তিন পদ্ধতিতে: ভীত ও আগ্রহী অবস্থায়, দু’জন এক উটে সাওয়ার হয়ে, তিনজন এক উটে সাওয়ার হয়ে, চারজন এক উটে সাওয়ার হয়ে, দশজন এক উটে সাওয়ার হয়ে এবং অবশিষ্টদের আগুন সমবেত করবে। তারা যেখানে দ্বি-প্রহরে বিশ্রাম নেবে আগুনও তাদের সাথে সেখানে বিশ্রাম নেবে, তারা যেখানে রাত্রি যাপন করবে আগুনও সেখানে রাত্রি যাপন করবে, তারা সকালে যেখানে থাকবে আগুনও সেখানে তাদের সাথে থাকবে, তারা সন্ধ্যা বেলায় যেখানে অবস্থান করবে আগুনও তাদের সাথে সেখানে অবস্থান করবে। (অর্থাৎ আগুন সর্বাবস্থায় তাদের পেছনে লেগেই থাকবে).

বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম, বুখারী হাদীস নং ৬৫২২ এবং মুসলিম হাদীস নং ২৮৬১

কেয়ামতের সর্ব প্রথম আলামত:

عن أنس رضي الله عنه أن عبد الله بن سلام لما أسلم سأل النبي صلى الله عليه وسلم عن مسائل , ومنها : ما أول أشراط الساعة ؟ فقال النبي صلى الله عليه وسلم : (( أما أول أشراط الساعة فنار تحشر الناس من المشرق إلى المغرب )). أخرجه البخاري

প্রখ্যাত সাহাবী আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করছেন, সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন সালাম রাদিয়াল্লাহু আনহু ইসলাম গ্রহণ করে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট কয়েকটি বিষয়ে জানতে চাইলেন, তন্মধ্যে একটি বিষয় ছিল : কেয়ামতের সর্বপ্রথম আলামত কি? নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন: কেয়ামতের সর্ব প্রথম আলামত হচ্ছে, এক প্রকার আগুন, যা মানুষদের মাশরিক (প্রাচ্য) থেকে তাড়িয়ে মাগরিবে (পাশ্চাত্যে) জড় করবে। বর্ণনায় বুখারী , হাদীস নং ৩৩২৭

নিদর্শনাবলীর পর্যায়ক্রমিক আত্মপ্রকাশ ও অবস্থার পরিবর্তন:

১- কেয়ামতের বড় নিদর্শনাবলির প্রথমটি প্রকাশ পাওয়ার পর একের পর এক নিদর্শনাবলির আত্মপ্রকাশ ঘটতে থাকবে। যেমন নবীজী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

(( الأمارات خرزات منظومات بسلك , فإذا انقطع السلك تبع بعضه بعضا )). أخرجه الحاكم

কেয়ামত পূ্র্ব সংঘটিতব্য নিদর্শনগুলো পুঁতির দানার (মালার) মত এক সূতায় আবদ্ধ, যখন সূতাটি ছিঁড়ে যাবে তখন নিদর্শনাবলী একের পর এক প্রকাশিত হতে থাকবে।

বর্ণনায় হাকেম, হাদীস নং(৮৬৩৯) দেখুন আসসিলসিলাতুস সহীহা (১৭৬২)

২-হাদীসে এসেছে

وعن أنس رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : (( لا تقوم الساعة حتى لا يقال في الأرض الله الله )). أخرجه مسلم

সাহাবী আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করছেন:

পৃথিবীতে ‘‘আল্লাহ আল্লাহ’’ শব্দের উচ্চারণ বিদ্যমান থাকা অবস্থায় কেয়ামত সংঘটিত হবে না।

বর্ণনায় মুসলিম । হাদীস নং(১৪৮)

৩-হাদীসে

وعن حذيفة بن اليمان رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى عليه وسلم :(( لا تقوم الساعة حتى يكون أسعد الناس بالدنيا لكع بن لكع )). أخرجه الترمذي

বিশিষ্ট সাহাবী হুযাইফা ইবনুল য়ামান রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: লুকা’ বিন লুকা’ (তথা বংশীয়ভাবে নিকৃষ্ট মানুষেরা) পৃথিবীর সর্বপেক্ষা ভাগ্যবান ব্যক্তি না হওয়া অবধি কেয়ামত সংঘটিত হবে না।

হাদীসটি সহীহ বর্ণনায় তিরমিযী হাদীস নং(২২০৯)

শিঙ্গায় ফুৎকার:

শিঙ্গা হচ্ছে হর্ন বা বিউগল সদৃশ এক প্রকার শিং। কেয়ামতের পূর্বক্ষণে মহান আল্লাহ তাআলা ফেরেশতা ইসরাফীল আলাইহিস সালামকে শিঙ্গায় ‘প্রথম ফুৎকার’ দেয়ার নির্দেশ দেবেন। আর এটি হচ্ছে ‘‘নফখাতুস সা’ইক’’ বা বেহুঁশ করার ফুৎকার। ফলে নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডলে অবস্থিত সকল প্রাণী বেহুঁশ হয়ে পড়ে যাবে তবে আল্লাহ যদি কাউকে সুস্থ রাখতে চান তার কথা ভিন্ন। অত:পর আল্লাহ তাআলা দ্বিতীয় ফুৎকার দেয়ার নির্দেশ দেবেন আর এটি হচ্ছে ‘‘নফখাতুল বা’ছ’’ তথা উত্থিত করণের ফুৎকার।

শিঙ্গায় ফুৎকার দেয়ার সময় সৃষ্টজীবের অবস্থা:

১- আল্লাহ তাআলা বলেন:

فتول عنهم يوم يدع الداع إلى شيئ نكر ... { القمر :৬-৮}

অতএব আপনি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিন। যেদিন আহবানকারী আহবান করবে এক অপ্রিয় পরিণামের দিকে, তারা তখন অবনত নেত্রে কবর থেকে বের হবে বিক্ষিপ্ত পঙ্গপাল সদৃশ। তারা আহবানকারীর দিকে দৌড়াতে থাকবে । কাফেররা বলবে: এটা কঠিন দিন।

(সূরা আল-ক্বামার:৬-৮)

২- আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলছেন:

ونفخ في الصور فصعق من في السماوات ومن في الأرض إلا من شاء الله , ثم نفخ فيه أخرى فإذا هم قيام ينظرون . { الزمر : ৬৮}

শিঙ্গায় ফুৎকার দেয়া হবে, ফলে আসমান ও যমীনে যারা আছে আল্লাহ যাদেরকে ইচ্ছা করেন তারা ব্যতীত সবাই বেহুঁশ হয়ে যাবে। অত:পর আবার শিঙ্গায় ফুৎকার দেয়া হবে, তৎক্ষণাৎ তারা দন্ডায়মান হয়ে তাকাতে থাকবে। (সূরা যুমার: ৬৮)

৩- আল্লাহ তাআলা আরো বলেন:

ويوم ينفخ في الصور ففزع من في السماوات ومن في الأرض إلا من شاء الله وكل أتوه داخرين .{ النمل : ৮৭}

যেদিন শিঙ্গায় ফুৎকার দেয়া হবে, অত:পর আল্লাহ যাদের-কে ইচ্ছা করবেন, তারা ব্যতীত নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডলে যারা আছে, তারা সবাই ভীত-বিহবল হয়ে পড়বে এবং সকলেই তাঁর কাছে আসবে বিনীত অবস্থায়। (সূরা আন-নমল:৮৭)

দুই ফুৎকারের মধ্যবর্তী সময়ের ব্যবদান:

عن أبي هريرة رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم :(( ما بين النفختين أربعون )) قالوا : يا أبا هريرة أربعون يوما؟ قال : أبيت , قالوا : أربعون شهرا ؟ قال : أبيت , قالوا : أربعون سنة ؟ قال : أبيت . متفق عليه

বিশিষ্ট সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: দুই ফুৎকারের মধ্যবর্তী সময়ের ব্যবদান হচ্ছে চল্লিশ। লোকেরা জিজ্ঞেস করল: হে আবু হুরায়রা চল্লিশ দিন? তিনি বললেন: আমি (জবাব দিতে) অস্বীকার করলাম. তারা বলল: তাহলে কি চল্লিশ মাস? তিনি বললেন : আমি অস্বীকার করেছি. লোকেরা আবারো জিজ্ঞেস করল : তাহলে কি চল্লিশ বছর? তিনি বললেন : আমি অস্বীকার করলাম। [বুখারী ও মুসলিম : হাদীস নং বুখারী (৪৯৩৫) এবং মুসলিম (২৯৫৫)]

১২০
কেয়ামত কখন সঙ্ঘটিত হবে:
১-হাদীসে আসার

عن أبي هريرة رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : (( إن طرف صاحب الصور منذ وكّل به مستعد ينظر نحو العرش , مخافة أن يؤمر قبل أن يرتد إليه طرفه , كأن عينيه كوكبان دريان )). أخرجه الحاكم

সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: (( নিশ্চয় শিঙ্গায় ফুৎকারের দায়িত্ব প্রাপ্ত ফেরেশ্তা ইসরাফীল আলাইহিস সালামের চক্ষু দায়িত্ব প্রাপ্তির পর থেকেই প্রস্ত্তত হয়ে আরশের পানে অপলক তাকিয়ে আছে এ আশংকায় যে পলক ফেলার পূর্বেই যদি ফুৎকার দেয়ার নির্দেশ এসে যায়। তার চক্ষুদ্বয় যেন দুটি আলোকোজ্জ্বল নক্ষত্র। [হাদীসটি সহীহ সনদে ইমাম হাকেম তার মুসতাদরাকে বর্ণনা করেছেন। হাদীস নং (৮৬৭৬) দেখুন আসসিলসিলাতুস সহীহা । ক্রমিক :(১০৭৮)]

২- হাদীসে এসেছে

وعن ابي هريرة رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : خير يوم طلعت عليه الشمس يوم الجمعة , فيه خلق آدم , وفيه أدخل الجنة , وفيه أخرج منها , ولا تقوم الساعة إلا في يوم الجمعة )). أخرجه مسلم

বিশিষ্ট সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: সূর্য উদিত হয় এমন দিনগুলোর মাঝে সর্বাপেক্ষা উত্তম দিন হচ্ছে জুমুআর দিন, এদিন নবী আদম আলাইহিস সালাম-কে সৃষ্টি করা হয়েছে, এবং এদিনই তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে আবার এদিনই সেখান থেকে বের করা হয়েছে, আর কেয়ামতও জুমুআর দিনেই সঙ্ঘটিত হবে। [বর্ণনায় মুসলিম: হাদীস নং (৮৫৪)]

১২১
বা’ছ (পুনরুত্থান) এবং হাশর (সমবেত করণ) একজন মানুষকে যে পর্বগুলো অতিক্রম করতে হবে:
মানুষের জীবনের মোট তিনটি পর্ব আছে। দুনিয়ার জীবন, বরযখ তথা কবর জীবন, অত:পর জান্নাত বা জাহান্নামের স্থায়ী জীবন। মহান আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক জীবনের জন্য উপযোগী করে আলাদা আলাদা জীবন ব্যবস্থা ও বিধি-বিধান প্রদান করেছেন। তিনি এ মানুষকে শরীর ও আত্মার সমন্বয়ে গঠন করেছেন। দুনিয়ার জীবনের বিধি-ব্যবস্থা শরীরকে কেন্দ্র করে প্রদান করেছেন, আত্মা এখানে শরীরের অধীন। বরযখের বিধি-বিধান দিয়েছেন আত্মাকে কেন্দ্র করে শরীর এখানে আত্মার অধীন। আর কেয়ামত দিবসের বিধান -নেয়ামত ও আযাব- দিয়েছেন শরীর ও আত্মা উভয়টিকে কেন্দ্র করে।

১২২
আল বা’ছ (পুনরুত্থান):
বা’ছ হচ্ছে: শিঙ্গায় দ্বিতীয় ফুৎকার দেয়ার পর সকল মৃতদেরকে জীবিত করা, তখন সকল মানুষ খালী পা, বিবস্ত্র ও খতনা-বিহীন অবস্থায় আল্লাহ রাববুল আলামীনের নিমিত্তে দন্ডায়মান হবে। এবং প্রত্যেক বাক্তি যে আক্বীদা ও বিশ্বাসের উপর মৃত্যু বরণ করেছে তার উপর উত্থিত হবে।

১- আল্লাহ তাআলা বলেন:

ونفخ في الصور فإذا هم من الأجداث إلى ربهم ينسلون ... { يس : ৫১-৫২}

শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে, তখনই তারা কবর থেকে তাদের পালনকর্তার দিকে ছুটে চলবে। তারা বলবে হায় আমাদের দুর্ভোগ! কে আমাদেরকে নিদ্রাস্থল থেকে উত্থিত করল? রহমান আল্লাহতো এরই ওয়াদা দিয়েছিলেন এবং রাসূলগণ সত্য বলেছিলেন। (সূরা ইয়াসীন: ৫১-৫২)

২- আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলছেন:

ثم إنكم بعد ذلك لميتون , ثم إنكم يوم القيامة تبعثون . { المؤمنون : ১৫-১৬)

এরপর তোমরা মৃত্যুবরণ করবে। অত:পর কেয়ামতের দিন তোমরা পুনরুত্থিত হবে। ( সূরা আল- মুমিনূন:১৫-১৬)

১২৩
পুনরুত্থানের বিবরণ:
আল্লাহ তাআলা আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করবেন। অত:পর শষ্য-সবজি যে ভাবে উৎপন্ন হয় মানুষ সে ভাবে মাটির নিচ থেকে বের হয়ে আসবে।

১- আল্লাহ তাআলা বলছেন:

وهو الذي يرسل الرياح بشرا بين يدي رحمته ... { الأعراف : ৫৭}

তিনিই বৃষ্টির পূর্বে সুসংবাদবাহী বায়ূ পাঠিয়ে দেন। এমনকি যখন বায়ূরাশি পানিপূর্ণ মেঘমালা বয়ে আনে, তখন আমি এ মেঘমালাকে একটি মৃত শহরের দিকে হাঁকিয়ে দেই। অত:পর এ মেঘ থেকে বৃষ্টিধারা বর্ষণ করি। অত:পর পানি দ্বারা সব রকমের ফল উৎপনণ করি। এমনিভাবে মৃতদেরকে বের করব যাতে তোমরা চিন্তা কর। ( সূরা আল আ’রাফ: ৫৭)

২- হাদীসে এসেছে

وعن أبي هريرة رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم :(( ما بين النفختين أربعون )) قالوا : يا أبا هريرة أربعون يوما؟ قال : أبيت , قالوا : أربعون شهرا ؟ قال : أبيت , قالوا : أربعون سنة ؟ قال : أبيت (( ثم ينزل الله من السماء ماء , فينبتون كما ينبت البقل , و ليس من الإنسان شيئ إلا يبلى إلا عظما واحدا وهو عجب الذنب , ومنه يركب الخلق يوم القيامة )). متفق عليه

বিশিষ্ট সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করছেন: দুই ফুৎকারের মধ্যবর্তী সময়ের ব্যবধান হচ্ছে চল্লিশ। লোকেরা জিজ্ঞেস করল: হে আবু হুরায়রা চল্লিশ কি, দিন? তিনি বলেন: আমি (জবাব দিতে) অস্বীকার করলাম। লোকেরা বলল: তাহলে কি , চল্লিশ মাস? তিনি বলেন: আমি অস্বীকার করলাম। এরপর লোকেরা আবারো জিজ্ঞেস করল? তাহলে কি চল্লিশ বছর? তিনি বলেন: আমি অস্বীকার করলাম। অত:পর আল্লাহ তাআলা আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। ফলে তারা (মানুষ) শষ্য- সবজি উৎপন্ন হওয়ার ন্যায় ভূমি অভ্যন্তর থেকে এমতাবস্থায় বের হয়ে আসবে যে, শুধুমাত্র একটি হাড় ব্যতীত মানুষের সবকিছু ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে যাবে। অক্ষত থাকা হাড়কে বলা হয় ‘‘আজবুয যানাব’’ কেয়ামত দিবসে তার থেকেই মানুষকে গঠন করা হবে। [বর্ণনায় বুখারী মুসলিম। বুখারী হাদীস নং (৪৯৩৫) আর মুসলিম (২৯৫৫)]

১২৪
কবর থেকে সর্ব প্রথম কাকে বের করা হবে:
عن أبي هريرة رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : (( أنا سيّد ولد آدم يوم القيامة , وأول من ينشق عنه القبر , وأول شافع وأول مشفع )). أخرجه مسلم

বিশিষ্ট সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: আমি কেয়ামতের দিন আদম সন্তানের নেতা, আমাকেই সর্ব প্রথম কবর থেকে বের করা হবে, আমিই সর্ব প্রথম সুপারিশকারী এবং আমার সুপারিশই সর্ব প্রথম গ্রহণ করা হবে। [সহীহ মুসলিম: হাদীস নং(২২৭৮)]

১২৫
কেয়ামত দিবসে কাদের সমবেত করা হবে:
১-মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

قل إن الأولين والآخرين , لمجموعون إلى ميقات يوم معلوم .{ الواقعة : ৪৯-৫০}

বলুন:পূর্ববর্তী ও পরবর্তীগণ। সবাই একত্রিত হবে এক নির্দিষ্ট দিনের নির্দিষ্ট সময়ে। (সূরা ওয়াকিয়া: ৪৯-৫০)

২-আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলছেন:

إن كل من في السماوات و الأرض إلا ءاتي الرحمن عبدا ... { مريم : ৯৩-৯৫}

নভোমন্ডল ও ভূ- মন্ডলে কেউ নেই যে, দয়াময় আল্লাহর কাছে দাস হয়ে উপস্থিত হবে না। তাঁর কাছে তাদের পরিসংখ্যান রয়েছে এবং তিনি তাদের গণনা করে রেখেছেন। কেয়ামতের দিন তাদের সবাই তাঁর কাছে একাকী অবস্থায় আসবে। (সূরা মারইয়াম: ৯৩-৯৫)

৩-মহান আল্লাহ তাআলা আরো বলছেন:

ويوم نسير الجبال و ترى الأرض بارزة وتحشرناهم ... { الكهف : ৪৭)

যেদিন আমি পর্বতসমূহকে পরিচালনা করব এবং আপনি পৃথিবীকে দেখবেন একটি উন্মুক্ত প্রান্তর এবং আমি মানুষকে একত্রিত করব অত:পর তাদের কাউকে ছাড়ব না। {সূরা কাহফ:৪৭}

১২৬
হাশরের ময়দানের বিবরণ:
১-মহান আল্লাহ তাআলা বলেন:

يوم تبدل الأرض غير الأرض و السماوات , وبرزوا لله الواحد القهار . { إبراهيم : ৪৮}

যে দিন পরিবর্তিত করা হবে এ পৃথিবীকে অন্য পৃথিবীতে এবং পরিবর্তিত করা হবে আকাশসমূহকে এবং লোকেরা পরাক্রমশালী এক আল্লাহর সামনে পেশ হবে।{ইবরাহীম: ৪৮}

২- হাদীসে এসেছে

وعن سهل بن سعد رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : (( يحشر الناس يوم القيامة على أرض بيضاء عفراء , كقرصة النقي , ليس فيها علم لأحد )). متفق عليه

সাহাবী সাহল বিন সা‘আদ রাদিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন: কেয়ামতের দিন সকল মানুষকে একটি চেপটা গোলাকার স্বচ্ছ রুটির ন্যায় (লালাভ) শুভ্র ভূমিতে একত্রিত করা হবে, সে ভূমি হবে সম্পূর্ণ সমতল, কারো জন্য কোন নিদর্শন থাকবে না। [সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম । হাদীস নং যথাক্রমে (৬৫২১) ও (২৭৯০)]

১২৭
কেয়ামত দিবসে সৃষ্টজীবদের সমবেত করণের বিবরণ:
১- হাদীসে এসেছে

عن عائشة رضي الله عنها قالت : سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول : (( يحشر الناس يوم القيامة حفاة عراة غرلا )) قلت : يا رسول الله النساء و الرجال جميعا , ينظر بعضهم إلى بعض؟ قال صلى الله عليه وسلم : (( يا عائشة الأمر أشد من أن ينظر بعضهم إلى بعض )) متفق عليه

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ইরশাদ করতে শুনেছি, রাসূলুল্লাহ বলেন: কেয়ামত দিবসে লোকদের নগ্নপদ, বিবস্ত্র ও খৎনা বিহীন অবস্থায় সমবেত করা হবে। আমি বললাম : ইয়া রাসূলাল্লাহ ! নারী পুরুষ সকলে একসাথে-একে অপরের দিকে তাকাবে? বললেন: আয়েশা... বিষয়টি তাকা-তাকির চেয়েও ভয়াবহ। [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং যথাক্রমে (৬৫২৭) ও (২৮৫৯)]

২- মুমিনবান্দাদের সমবেত করা হবে সম্মানিত অতিথি রূপে। যেমন মহান আল্লাহ তাআলা বলেন:

يوم نحشر المتقين إلى الرحمن وفدا . { مريم : ৮৫}

সেদিন আল্লাহভীরুদের দয়াময়-রহমানের কাছে সমবেত করব অতিথিরূপে।{সূরা মারইয়াম:৮৫}

৩-আর কাফেরদের সমবেত করা হবে অন্ধ, মুক,বধির, পপাসার্ত, নীল চক্ষু ও মুখে ভরদিয়ে চলা অবস্থায়। তাদের প্রথম দলকে শেষ দল আসা পর্যন্ত আটকে রাখা হবে অত:পর সকলকে একসাথে জাহান্নামের দিকে তাড়িয়ে নেয়া হবে।

১-আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

وَنَحْشُرُهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَى وُجُوهِهِمْ عُمْيًا وَبُكْمًا وَصُمًّا مَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ كُلَّمَا خَبَتْ زِدْنَاهُمْ سَعِيرًا ﴿97﴾ ذَلِكَ جَزَاؤُهُمْ بِأَنَّهُمْ كَفَرُوا بِآَيَاتِنَا

আমি কেয়ামতের দিন তাদের সমবেত করব তাদের মুখে ভর দিয়ে চলা অবস্থায়, অন্ধ, মুক ও বধির অবস্থায়। তাদের আবাসস্থল জাহান্নাম। যখনই নির্বাপিত হওয়ার উপক্রম হবে আমি তখন তাদের জন্য অগ্নি আরো বৃদ্ধি করে দেব। এটাই তাদের শাস্তি। কারণ তারা আমার নিদর্শনসমূহ অস্বীকার করেছে।{সূরা ইসরা: ৯৭-৯৮}

২-আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন:

ونسوق المجرمين إلى جهنم وردا . { مريم : ৮৬}

এবং অপরাধীদেরকে পিপাসার্ত অবস্থায় জাহান্নামের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাব।{মারইয়াম:৮৬}

৩-অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

يوم ينفخ في الصور و نحشر المجرمين يومئذ زرقا . { طه : ১০২}

যেদিন শিঙ্গায় ফুৎকার দেয়া হবে, সে দিন আমি অপরাধীদেরকে সমবেত করব নীল চক্ষু অবস্থায়।

{সূরা ত্বাহা: ৮৬}

৪-মহান আল্লাহ তাআলা আরো বলেন:

ويوم يحشر أعداء الله إلى النار فهم يوزعون . { فصلت : ১৯}

যেদিন আল্লাহর শত্রুদেরকে অগ্নিকুন্ডের দিকে ঠেলে নেয়া হবে। এবং ওদের বিন্যস্ত করা হবে বিভিন্ন দলে। {সূরা ফুসসিলাত : ১৯}

৫- অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

احشروا الذين ظلموا و أزواجهم و ما كانوا يعبدون . من دون الله فاهدوهم إلى صراط الجحيم . { الصافات : ২২-২৩}

(ফেরেশতাদেরকে বলা হবে) একত্রিত কর যালেম ও তাদের দোসরদেরকে এবং তাদেরকে, যাদের তারা ইবাদত করত। আল্লাহর পরিবর্তে এবং তাদেরকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাও জাহান্নামের পথে। {সূরা সাফফাত: ২২-২৩}

৬- হাদীসে এসেছে

وعن أنس رضي الله عنه أن رجلا قال : يا رسول الله ! كيف يحشر الكافر على وجهه يوم القيامة ؟ قال : (( أليس الذّي أمشاه على رجليه في الدنيا قادر على أن يمشيه على وجهه يوم القيامة؟ )) متفق عليه .

বিশিষ্ট সাহাবী আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল: ইয়া রাসূলুল্লাহ! কেয়ামতের দিন কাফেরদেরকে চেহারার উপর ভর করে চলা অবস্থায় কি ভাবে সমবেত করা হবে? নবীজী বললেন: যিনি তাকে পৃথিবীতে দু’পায়ের উপর ভর করে চালিয়েছেন তিনি কি কেয়ামতের দিন চেহারার উপর ভর করে চালাতে সক্ষম নন? [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম: হাদীস নং যথাক্রমে (৪৭৬০) ও (২৮০৬)]

৪- কেয়ামত দিবসে মহান আল্লাহ তাআলা হিংস্র, গৃহপালিত, জংলী, ভারবাহী মোটকথা সকল প্রকার জন্তু এবং সর্ব প্রকার পাখীদের একত্রিত করবেন। অত:পর পশুদের মাঝে কিসাস ভিত্তিক বিচার সঙ্ঘটিত হবে। শিংযুক্ত যে বকরী শিংবিহীন বকরীকে গুঁতো মেরেছিল তার থেকে কিসাস নেয়া হবে। আল্লাহ তাআলা জন্তুদের মাঝে কেসাস বাস্তবায়ন করে তাদের বলবেন: তোমরা মাটি হয়ে যাও।

আল্লাহ বলছেন:

وَمَا مِنْ دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا طَائِرٍ يَطِيرُ بِجَنَاحَيْهِ إِلَّا أُمَمٌ أَمْثَالُكُمْ مَا فَرَّطْنَا فِي الْكِتَابِ مِنْ شَيْءٍ ثُمَّ إِلَى رَبِّهِمْ يُحْشَرُونَ الأنعام :৩৮

আর যত প্রকার প্রাণী পৃথিবীতে বিচরণশীল রয়েছে আর যত প্রকার পাখী দ’ডানাযোগে উড়ে বেড়ায় তারা সবাই তোমাদের মতই একেকটি শ্রেণী। আমি কোন কিছুই লিখতে ছাড়িনি।অত:পর সবাই স্বীয় প্রতিপালকের নিকট সমবেত হবে।(সূরা আনআম: ৩৮)

১২৮
কেয়ামত দিবসের ভয়াবহতা
কেয়ামত দিবস: খুবই ভয়াবহ ও বিরাট গুরুত্বপূর্ণ দিন। সেদিন মানুষ মারাত্মক ভাবে আতংক গ্রস্থ ও ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে। চক্ষুসমূহ হবে বিস্ফোরিত।মহান আল্লাহ তাআলা সেদিনটি মুমিনদের জন্য করেছেন যোহর ও আসর নামাযের মধ্যবর্তী সময়ের সমান। আর অবিশ্বাসী-কাফেরদের জন্য করেছেন পঞ্চাশ হাজার বছেরের সমান।

আমরা এখানে সেদিনের কিছু ভয়াবহতার দৃশ্য তুলে ধরছি।

১- কোরআন হাকীমে মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন।

فَإِذَا نُفِخَ فِي الصُّورِ نَفْخَةٌ وَاحِدَةٌ ﴿13﴾ وَحُمِلَتِ الْأَرْضُ وَالْجِبَالُ فَدُكَّتَا دَكَّةً وَاحِدَةً ﴿14﴾ فَيَوْمَئِذٍ وَقَعَتِ الْوَاقِعَةُ ﴿15﴾ وَانْشَقَّتِ السَّمَاءُ فَهِيَ يَوْمَئِذٍ وَاهِيَةٌ ﴿16﴾

যখন শিঙ্গায় ফুৎকার দেয়া হবে- একটি মাত্র ফুৎকার। আর যমীন ও পর্বত মালাকে উত্তোলন করা হবে এবং একই ধাক্কায় চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়া হবে। সেদিন যা সঙ্ঘটিত হওয়ার (কেয়ামত) সঙ্ঘটিত হয়ে যাবে। আকাশ বিদীর্ণ হয়ে শক্তিহীন ও বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়বে।{সূরা আল-হাক্কাহ:১৩-১৬}

২-আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা অন্যত্র বলছেন:

إِذَا الشَّمْسُ كُوِّرَتْ ﴿1﴾ وَإِذَا النُّجُومُ انْكَدَرَتْ ﴿2﴾ وَإِذَا الْجِبَالُ سُيِّرَتْ ﴿3﴾ وَإِذَا الْعِشَارُ عُطِّلَتْ ﴿4﴾ وَإِذَا الْوُحُوشُ حُشِرَتْ ﴿5﴾ وَإِذَا الْبِحَارُ سُجِّرَتْ ﴿6﴾ التكوير : ১-৬

সূর্যকে যখন দীপ্তিহীন করা হবে, যখন নক্ষত্ররাজি খসে পড়ে মলিন হয়ে যাবে, পর্বতমালা যখন অপসারিত হবে, যখন পূর্ণ-গর্ভা (দশ মাসের গর্ভবতী) উষ্ট্রী উপেক্ষিত হবে, যখন বন্য পশুগুলিকে একত্রিত করা হবে এবং সমুদ্রগুলিকে যখন উত্তাল-উদ্বেলিত করা হবে। {সূরা আত্ তাকভীর:১-৬}

৩-আল্লাহ তাআলা আরো বলেন:

إِذَا السَّمَاءُ انْفَطَرَتْ ﴿1﴾ وَإِذَا الْكَوَاكِبُ انْتَثَرَتْ ﴿2﴾ وَإِذَا الْبِحَارُ فُجِّرَتْ ﴿3﴾ وَإِذَا الْقُبُورُ بُعْثِرَتْ ﴿4﴾ { الانفطار :১-৪}

যখন আকাশ ফেটে যাবে,যখন তারকারাজি বিক্ষিপ্তভাবে ঝরে পড়বে,যখন সমুদ্রগুলিকে উত্তাল-উদ্বেলিত করে তোলা হবে।যখন কবরসমূহ উন্মোচিত হবে। {সূরা ইনফিতার:১-৪}

৪- আল্লাহ তাআলা আরো বলছেন:

إِذَا السَّمَاءُ انْشَقَّتْ ﴿1﴾ وَأَذِنَتْ لِرَبِّهَا وَحُقَّتْ ﴿2﴾ وَإِذَا الْأَرْضُ مُدَّتْ ﴿3﴾ وَأَلْقَتْ مَا فِيهَا وَتَخَلَّتْ ﴿4﴾ وَأَذِنَتْ لِرَبِّهَا وَحُقَّتْ ﴿5﴾ { الانشقاق : ১-৫}

যখন আকাশ ফেটে যাবে এবং স্বীয় প্রতিপালকের আদেশ পালন করবে এবং এটিই তার উপযুক্ত করণীয়। এবং পৃথিবীকে যখন সম্প্রসারিত করা হবে। এবং পৃথিবী তার গর্ভস্থিত সবকিছু বাইরে নিক্ষেপ করবে ও গর্ভশূন্য হয়ে যাবে। এবং সে তার প্রতিপালকের আদেশ পালন করবে এবং এটিই তার উপযুক্ত করণীয়। {সূরা আল-ইনশিকাক:১-৫}

৫-মহান প্রতিপালক আল্লাহ তাআলা অন্যত্র ইরশাদ করছেন:

إِذَا وَقَعَتِ الْوَاقِعَةُ ﴿1﴾ لَيْسَ لِوَقْعَتِهَا كَاذِبَةٌ ﴿2﴾ خَافِضَةٌ رَافِعَةٌ ﴿3﴾ إِذَا رُجَّتِ الْأَرْضُ رَجًّا ﴿4﴾ وَبُسَّتِ الْجِبَالُ بَسًّا ﴿5﴾ فَكَانَتْ هَبَاءً مُنْبَثًّا ﴿6﴾ { الواقعة : ১-৬}

যখন কেয়ামত সঙ্ঘটিত হবে, যার বাস্তবতায় কোন সংশয় নেই, এটা কাউকে করবে নীচ, কাউকেও করবে সমুন্নত, যখন প্রবল ভাবে প্রকম্পিত হবে পৃথিবী এবং পর্বতমাল ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে তখন সেটি পরিণত হবে উৎক্ষিপ্ত ধূলিকনায়।{সূরা আল-ওয়াকিয়া: ১-৬}

৬- হাদীসে এসেছে

وعن ابن عمر رضي الله عنهما قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : (( من سره أن ينظر إلى يوم القيامة كأنه رأي عين فليقرأ : ( إذا الشمس كورت ) و ( إذا السماء انفطرت ) و ( إذا السماء انشقت ). أخرجه أحمد و الترمذي

বিশিষ্ট সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন : কেয়ামত দিবসের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে যে ব্যক্তি নিজ চোখে দেখার মত করে জানতে চায় সে যেন এ সূরা তিনটি পড়ে নেয়। সূরাগুলো হচ্ছে: তাকভীর, ইনফিতার এবং ইনশিকাক। [হাদীসটি সহীহ সনদে ইমাম আহমদ ও ইমাম তিরমিযী স্বীয় কিতাবে কর্ণনা করেছেন। হাদীসের ক্রমিক নং যথাক্রমে( ৪৮০৬) ও (৩৩৩৩)]

১২৯
কেয়ামত দিবসে আকাশ ও পৃথিবীকে পরিবর্তন করণ:
১-মহান আল্লাহ তাআলা বলেন:

يوم تبدل الأرض غير الأرض و السماوات , وبرزوا لله الواحد القهار . { إبراهيم : ৪৮}

যে দিন পরিবর্তিত করা হবে এ পৃথিবীকে অন্য পৃথিবীতে এবং পরিবর্তিত করা হবে আকাশসমূহকে এবং লোকেরা পরাক্রমশালী এক আল্লাহর সামনে বের হয়ে আসবে।{ইবরাহীম: ৪৮}

২- আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলছেন:

يوم نطوي السماء كطي السجل للكتب كما بدأنا أول خلق نعيده وعدا علينا إنا كنا فاعلين . { الأنبياء : ১০৪}

সেদিন আমি আকাশকে গুটিয়ে নেব, যেমন গুটানো হয় লিখিত কাগজপত্র। যেভাবে আমি প্রথম বার সৃষ্টি করেছিলাম, সেভাবে পুনরায় সৃষ্টি করব। আমার ওয়াদা নিশ্চিত, আমাকে তা পূর্ণ করতেই হবে। {সূরা আম্বিয়া: ১০৪}

১৩০
আকাশ ও পৃথিবীর পরিবর্তনের দিন লোকদের অবস্থান হবে কোথায়:
عن ثوبان رضي الله عنه مولى رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : كنت عند رسول الله صلى الله عليه و سلم فجاء حبر من أحبار اليهود ... ـــ فيه ـــ فقال اليهودي : أين يكون الناس يوم تبدل الأرض غير الأرض و السماوات ؟فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم : (( هم في الظلمة دون الجسر )), وفي رواية : (( على الصراط )). أخرجه مسلم .

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাওলা ( মুক্ত দাস) ছাওবান রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ছিলাম, এরই মধ্যে তাঁর কাছে একজন ইহুদী পন্ডিত আসল... - তাতে আছে - ইহুদী বলল : যে দিন এ পৃথিবীকে অন্য পৃথিবীতে এবং আকাশসমূহকে পরিবর্তন করা হবে সে দিন লোকেরা কোথায় থাকবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন:তারা পুলসিরাতের নিচে একটি অন্ধকারে থাকবে, অন্য রেওয়ায়াতে আছে: পুলসিরাতের উপরে থাকবে। [বর্ণনায় মুসলিম।হাদীস নং (৩১৫) ও (২৭৯১)]

১৩১
অবস্থানস্থলে গরমের তীব্রতা ও ভয়াবহতা:
আল্লাহ তাআলা লোকদের উত্থিত করার পর কেয়ামতের প্রাঙ্গনসমূহের একটিতে বিচারকার্য সমাপ্ত করণার্থে নগ্ন পদ, বিবস্ত্র ও খৎনা বিহীন অবস্থায় একত্রিত করবেন। সেদিন সূর্য মানুষের অতি নিকটে এসে যাবে। মানুষের শরীর নি:সৃত ঘাম সত্তর হাত পর্যন্ত পৌছে যাবে।তারা নিজ নিজ আমল অনুপাতে ঘর্মাক্ত হবে।

১- হাদীসে এসেছে

عن المقداد بن الأسود رضي الله عنه قال : سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول : (( تدنى الشمس يوم القيامة من الخلق , حتى تكون منهم كمقدار ميل , فيكون الناس على قدر أعمالهم في العرق فمنهم من يكون إلى كعبيه , ومنهم من يكون إلى ركبتيه , و منهم من يكون إلى حقويه , ومنهم من يلجمه العرق إلجاما )) قال : وأشار رسول الله صلى الله عليه وسلم بيده إلى فيه . أخرجه مسلم .

বিশিষ্ট সাহাবী মিকদাদ বিন আসওয়াদ রাদিয়ল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, কেয়ামত দিবসে সূর্য মানুষের অতি নিকটে করে দেয়া হবে। এমনকি সূর্য আর তাদের মাঝে দূরত্ব হবে মাত্র এক মাইল। লোকেরা স্বীয় আমল অনুপাতে নিজ শরীর নি:সৃত ঘামের মাঝে অবস্থান করবে। তাদের কারো কারো ঘাম টাখনু পর্যন্ত পৌছবে, কারো ঘাম হাটু পর্যন্ত পৌছবে, কারো কারো কোমর পর্যন্ত, আবার ঘাম কাউকে কাউকে লাগাম পড়াবে। বর্ণনাকারী বলেন: এটি বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম নিজ মুখের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। [বর্ণনায় মুসলিম হাদীস নং:(২৮৬৪)]

২- হাদীসে এসেছে

وعن أبي هريرة رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال :(( يقبض الله الأرض يوم القيامة , ويطوي السماء بيمينه ثم يقول : أنا الملك , أين ملوك الأرض .؟)) متفق عليه

প্রখ্যাত সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লম থেকে বর্ণনা করছেন, রাসূলুল্লাহ বলেন: কেয়ামত দিবসে আল্লাহ তাআলা যমীনকে মুষ্টিবদ্ধ করবেন, এবং আকাশকে ডানহাত দ্বারা গুটিয়ে নেবেন. অত:পর স্বগর্বে বলবেন: আমিই বাদশা, পৃথিবীর বাদশারা সব কোথায় ? [বুখারী ও মুসলিম: হাদীস নং যথাক্রমে: (৭৩৮২) ও (২৭৮৭)]

১৩২
অবস্থানস্থলে আল্লাহ কাদের ছায়া দান করবেন:
১- হাদীসে এসেছে

عن أبي هريرة رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال : (( سبعة يظلهم الله في ظله يوم لا ظل إلا ظله : الإمام العادل , وشاب نشأ في عبادة ربه , ورجل قلبه معلق في المساجد , ورجلان تحابا في الله اجتمعا عليه و تفرقا عليه , ورجل طلبته امرأة ذات منصب و جمال , فقال : إني أخاف الله , ورجل تصدق أخفى حتى لا تعلم شماله ما تنفق يمينه , ورجل ذكر الله خاليا ففاضت عيناه )). متفق عليه .

বিশিষ্ট সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করছেন, নবীজী বলেন: সাত শ্রেণীর লোকদের মহান আল্লাহ তাআলা স্বীয় ছায়াতে ছায়া দান করবেন যেদিন তাঁর ছায়া ব্যতীত আরা কোন ছায়া থাকবে না, ন্যায় পরায়ণ বাদশা, এমন যুবক যে স্বীয় পালনকর্তার ইবাদতের ভিতর দিয়ে বেড়ে উঠেছে, এমন ব্যক্তি যার হৃদয় মসজিদের মধ্যে ঝুলে থাকে, এমন দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহর কারণে পারস্পরিক ভালবাসায় আবদ্ধ হয়, আল্লার জন্যই একত্রিত হয় আবার আল্লাহর জন্যই বিচ্ছিন্ন হয়, এমন ব্যক্তি যাকে মর্যাদা সম্পন্ন সুন্দরী রমণী পেতে আগ্রহ প্রকাশ করল আর সে প্রত্যাখ্যান করে বলল, আমি আল্লাহকে ভয় করে, এমন ব্যক্তি যে এত গোপনে দান-সদকা করে যে ডান হাত হাত কি সদকা করে বাম হাত তা জানে না, এমন ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণকরে অত:পর তার চক্ষুদ্বয় অশ্রুসিক্ত হয়। [বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং যথাক্রমে: (৬৬০) ও (১০৩১)]

২- হাদীসে এসেছে

وعن عقبة بن عامر رضي الله عنه قال : سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول : (( كل امرئ في ظل صدقته حتى يفصل بين الناس )) أخرجه أحمد و ابن خزيمة

সাহাবী উকবা বিন আমের রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি নবীজী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, লোকদের মাঝে বিচারকার্য সম্পন্ন করা অবধি প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ নিজ দান-সদকার ছায়াতলে অবস্থান করবে। [হাদীসটি সহীহ সনদে ইমাম আহমাদ ও ইমাম ইবনে খোযাইমা বর্ণনা করেছেন। হাদীস নং যথা ক্রমে (১৭৩৩৩) ও (২৪৩১)]

১৩৩
বিচার কার্য সম্পন্ন করার নিমিত্তে মহান আল্লাহ তাআলার আগমন:
কেয়ামত দিবসে মহান আল্লাহ তাআলা বিচার কার্য পরিচালনা করার নিমিত্তে আগমন করবেন। ফলে পৃথিবী তাঁর নূরে আলোকোজ্জ্বল হয়ে যাবে এবং সমস্ত সৃষ্টি তার বড়ত্ব ও মহত্বের কারণে ভয়ে বেহুঁশ হয়ে যাবে।

১- মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :

كلا إذا دكت الأرض دكا دكا و جاء ربك و الملك صفا صفا . { الفجر : ২১-২২}

না, এটা সঙ্গত নয়। যখন পৃথিবীকে ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হবে। এবং যখন আপনার প্রতিপালক আগমন করবেন, আর ফেরেশতাগন সারিবদ্ধভাবে (থাকবে) । { সূরা আল- ফাজর: ২১-২২}

২- হাদীসে এসেছে

وعن أبي هريرة رضي الله عنه أن النبي صلى الله عليه وسلم قال : (( لا تخيروني على موسى , فإن الناس يصعقون يوم القيامة فأصعق معهم , فأكون أول من يفيق فإذا موسى باطش جانب العرش , فلا أدري أكان فيمن صعق فأفاق قبلي , أو كان ممن استثنى الله )). متفق عليه

বিশিষ্ট সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবীজী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: তোমরা আমাকে নবী মূসার চেয়ে উত্তম বলোনা, কারণ কেয়ামত দিবসে সকল মানুষ বেহুঁশ হয়ে যাবে আমিও তাদের সাথে বেহুঁশ হব। তবে আমিই সর্বপ্রথন চৈতন্য ফিরে পাব। হঠাৎ দেখব নবী মূসা আরশের পার্শ্বদেশ ধরে আছেন, আমি জানি না তিনিও অচেতনদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন যে আমার পূর্বেই চেতনা ফিরে পেয়েছেন, না আল্লাহ তাআলা যাদের বাদ রেখেছেন তাদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন? )) [বুখারী ও মুসলিম । হাদীস নং যথা ক্রমে (২৪১১) ও (২৩৭৩)]

১৩৪
বিচার কার্য পরিচালনা
কেয়ামত দিবসে লোকেরা স্বীয় পালনকর্তার নিকট জড় হবে এবং তীব্র ভয় ও অবস্থানগত কষ্টের কারণে ক্লান্তি ও পেরেশানী যখন সহ্যসীমার শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছবে, আপন প্রতিপালকের নিকট হিসাব ও বিচার কার্য শুরু করার প্রত্যাশা করবে । এক পর্যায়ে অপেক্ষা ও অবস্থান যখন অতিদীর্ঘ হবে আর পেরেশানী সহ্যসীমা অতিক্রম করবে তখন তারা আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের নিকট আল্লাহ তাআলার কাছে হিসাব ও বিচারকার্য শুরু করার সুপারিশ করার নিমিত্তে একত্রিত হবে।

১- মহান আল্লাহ তাআলা বলেন:

هَذَا يَوْمُ لَا يَنْطِقُونَ ﴿35﴾ وَلَا يُؤْذَنُ لَهُمْ فَيَعْتَذِرُونَ ﴿36﴾ وَيْلٌ يَوْمَئِذٍ لِلْمُكَذِّبِينَ ﴿37﴾ هَذَا يَوْمُ الْفَصْلِ جَمَعْنَاكُمْ وَالْأَوَّلِينَ ﴿38﴾ فَإِنْ كَانَ لَكُمْ كَيْدٌ فَكِيدُونِ ﴿39﴾ { المرسلات : ৩৫-৩৯}

এটা এমন দিন যেদিন কেউ কথা বলবে না। এবং কাউকে ওজর পেশ (তাওবা) করার অনুমতি দেয়া হবে না। সেদিন মিথ্যা আরোপকারীদের দুর্ভোগ হবে। এটা চুড়ান্ত বিচারের দিন, আমি তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে একত্রিত করেছি। অতএব. তোমাদের কোন অপকৌশল থাকলে প্রয়োগ কর আমার বিরুদ্ধে। {সূরা আল-মুরসালাত: ৩৫-৩৯}

২- হাদীসে এসেছে

وعن أبي هريرة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : (( أنا سيّد الناس يوم القيامة و هل تدرون بم ذاك؟ يجمع الله يوم القيامة الأولين و الآخرين في صعيد واحد , فيسمعهم الداعي , وينفذهم البصر , وتدنو الشمس , فيبلغ الناس من الغم و الكرب ما لا يطيقون , وما لا يحتملون , فيقول بعض الناس لبعض : ألا ترون ما أنتم فيه؟ ألا ترون ما قد بلغكم ؟ ألا تنظرون من يشفع لكم إلى ربكم ؟

فيقول بعض الناس لبعض : ائتوا آدم , فيأتون آدم , فيقولون : يا آدم أنت أبو البشر , خلقك الله بيده , ونفخ فيك من روحه , وأمر الملائكة فسجدوا لك , اشفع لنا إلى ربك , ألا ترى إلى ما نحن فيه , ألا ترى إلى ما قد بلغنا ؟

فيقول آدم : إن ربي غضب اليوم غضبا لم يغضب قبله مثله , ولن يغضب بعده مثله , وإنه نهاني عن الشجرة فعصيته , نفسي نفسي , اذهبوا إلى غيري , فيأتون نوحا , فإبراهيم , فموسى , فعيسى , فيعتذر كل واتحد , وكلهم يقولون : إن ربي قد غضب اليوم غضبا لم يغضب قبله مثله , ولن يغضب بعده مثله ... نفسي نفسي .

ثم يقول عيسى : اذهبوا إلى غيري , إدهبوا إلى محمد صلى الله عليه وسلم فيأتوني فيقولون : يا محمد أنت رسول الله , وخاتم الأنبياء , وغفر الله لك ما تقدم من ذنبك و ما تأخر , اشفع لنا إلى ربك , ألا ترى ما نحن فيه ؟ ألا تري ما قد بلغنا ؟

فأنطلق فآتي تحت العرش , فأقع ساجدا لربي , ثم يفتح الله عليّ ويلهمني من محامده , وحسن الثناء عليه شيئا لم يفتحه لأحد قبلي , ثم يقال : يا محمد ارفع رأسك , سل تعطه , اشفع تشفّع , فأرفع رأسي , فأقول : يا ربّ أمتي أمتي .

فيقال : يا محمد أدخل الجنة من أمتك من لا حساب عليه من الباب الأيمن من أبواب الجنة , وهم شركاء الناس فيما سوى ذلك من الأبواب , والذي نفس محمد بيده إن ما بين المصراعين من مصاريع الجنة لكما بين مكة و هجر , أو كما بين مكة وبصرى . متفق عليه

সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: কেয়ামতের দিন আমি সকল মানুষের নেতা। তোমরা কি জান সেটি কিভাবে হবে? আল্লাহ তাআলা সেদিন পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সকলকে এক ময়দানে সমবেত করবেন। এমন ভাবে যে তাদেরকে একজন আহবানকারীই শুনাতে পারবে এবং একটি চক্ষুই পর্যবেক্ষণ করতে পারবে। আকাশের সূর্য খুব নিকটবর্তী হবে। মানুষের চিন্তা ও পেরেশানী সহ্যেরসীমা ছাড়িয়ে যাবে। তখন একজন অপরজনকে বলবে। তোমরা কি দেখছনা তোমরা কি অবস্থায় আছ? তোমরা কি অনুধাবন করতে পারছনা কি কঠিন পরিসিহতি তোমাদের উপর এসে পড়েছে? তোমরা কেন খুজে বের করছ না, যে তোমাদের জন্য তোমাদের পালনকর্তার নিকট সুপারিশ করবে?

তখন একে অপরকে বলবে: তোমরা আদমের নিকট যাও। অত:পর সকলে আদম আলাইহিসসালামের নিকট যাবে এবং বলবে : হে আদম আপনি মানবজাতির পিতা, মহান আল্লাহ তাআলা নিজ হাতে আপনাকে বানিয়েছেন। তারঁ রূহ থেকে আপনার মধ্যে ফুঁকে দিয়েছেন, এবং ফেরেশতাদের নির্দেশ দিয়েছেন তারা সকলে আপনার তরে সেজদায় লুটিয়ে পড়েছিল। আপনি আমাদের জন্য স্বীয় পালনকর্তার নিকট সুপারিশ করুন। আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন না কি কঠিন অবস্থার মধ্যে পড়েছি আমরা। আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন না কি বিপদ এসে পড়েছে আমাদের উপর?

আদম আলাইহিস সালাম বলবেন: আমার প্রতিপালক আজ ক্রোধান্বিত হয়েছেন, এমন রাগান্বিত ইতিপূর্বে আর কখনো হননি, ভবিষ্যতে আর কখনো হবেনও না । তিনি আমাকে একটি গাছের কাছে যেতে নিষেধ করেছিলেন, আমি সে নিষেধাজ্ঞা রক্ষা করতে পারিনি। নফসী নফসী; হায় আমার কি হবে, হায় আমার কি হবে। তোমরা অন্য কারো কাছে যাও। এরপর লোকেরা নবী নূহ আত:পর ইবরাহীম তারপর মূসা এরপর ঈসা আলাইহিমুস সালামের নিকট আসবে, তাঁরা প্রত্যেকেই অপারগতা প্রকাশ করবেন। প্রত্যেকেই বলবেন: আমার প্রতিপালক আজ খুবই ক্রুদ্ধ হয়েছেন, এমন রাগান্বিত অতীতে তিনি আর কখনো হননি এবং ভবিষ্যতেও হবেন না... নফসী নফসী ; হায় আমার কি হবে, হায় আমার কি হবে।

অত:পর ঈসা আলাইহিস সালাম বলবেন: তোমরা আমি ভিন্ন অন্য কারো কাছে যাও, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যাও। তারা তাই করবে, সকলে আমার নিকট আসবে এবং বলবে: হে মুহাম্মাদ ! আপনি আল্লাহর রাসূল, নবীদের পরম্পরা সমাপ্তকারী-সর্বশেন নবী। আল্লাহ তাআলা আপনার পূর্বাপর সকল অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছেন। আপনি আমাদের তরে স্বীয় প্রতিপালকের নিকট সুপারিশ করুন। আপনি কি দেখছেন না কি পরিস্থিতির মধ্যে আছি আমরা? কি কঠিন বিপদ আমাদের স্পর্শ করেছে তা আপনি দেখতে পাচ্ছেন না?

এরপর আমি আরশের নিচে এসে পৌঁছব এবং আমার রব সমীপে সেজদায় লুটিয়ে পড়ব। অত:পর আল্লাহ তাআলা তাঁর এমন কিছু সুন্দর ও প্রশংসা যোগ্য গুণ আমার কাছে এলহামের মাধ্যমে উন্মোক্ত করবেন যা ইতোপূর্বে আর কারো কাছে করেননি। অত:পর বলা হবে: হে মুহাম্মাদ ! মাথা উত্তলন করুন, প্রার্থনা করুন আপনাকে প্রার্থিত বস্ত্ত দেয়া হবে, সুপারিশ করুন আপনার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। আমি মাথা উঠিয়ে বলব: উম্মাতী উম্মাতী ! হায় আমার উম্মতের কি হবে ! আমার উম্মতের কি হবে।

বলা হবে: হে মুহাম্মাদ! আপনার উম্মতের যাদের কোন হিসাব নেই তাদেরকে আপনি জান্নাতের দারসমূহের ডান পার্শ্বস্থ দরজা দিয়ে প্রবেশ করান। অবশ্য তারা অন্যান্য মানুষের সঙ্গে জান্নাতের অপরাপর দরজা দিয়ে প্রবেশ করার অধিকারও রাখে। মুহাম্মাদের জীবন যার হাতে সে সত্ত্বার শপথ করে বলছি: জান্নাতের দরজার দুই কপাটের মাঝের দূরত্ব মক্কা ও হাজার অথবা মক্কা ও বুসরার মধ্যবর্তী স্থানের দূরত্বের সমান। [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম । হাদীস নং যথাক্রমে (৪৭১২) ও (১৯৪)।]

অত:পর আল্লাহ তাআলা মানুষের মাঝে হিসাব কার্য শুরু করবেন। কিতাব তথা আমল নামা প্রদান করা হবে, মীযান তথা দাড়িপাল্লা রাখা হবে এবং লোকদের হিসাব নেয়া হবে। স্বীয় কিতাব ডান হাতে গ্রহণকারী জান্নাতে যাবে আর বাম হাতে গ্রহণকারী যাবে জাহান্নামে।

১- আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

وترى الملائكة حافين من حول العرش يسبحون بحمد ربهم وقضي بينهم بالحق وقيل الحمد لله رب العالمين { الزمر :৭৫}

এবং আপনি ফেরেশতাদের দেখতে পাবেন যে তারা আরশের চার পাশ ঘিরে তাদের প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছে। তাদের সবার মাঝে ন্যায় বিচার করা হবে। বলা হবে, সমস্ত প্রশংসা জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ তাআলার।{সূরা যুমার: ৭৫}

২-হাদীসে এসেছে

وعن أبي سعيد الخدري رضي الله عنه قال : قلنا : يا رسول الله ,, هل نرى ربنا يوم القيامة؟ قال : (( هل تضارون في رؤية الشمس و القمر إذا كانت صحوا )). قلنا : لا . قال : (( فإنكم لا تضارون في رؤية ربكم يومئذ إلا كما تضارون في رؤيتهما )). ثم قال : (( ينادي مناد : ليذهب كل قوم إلى ما كانوا يعبدون , فيذهب أصحاب الصليب مع صليبهم , وأصحاب الأوثان مع أوثانهم , وأصحاب كل آلهة مع آلهتهم , حتى يبقى من كان يعبد الله , من برّ أو فاجر , وغبرات من أهل الكتاب ,

ثم يؤتى بجهنم تعرض كأنها سراب , فيقال لليهود : ما كنتم تعبدون ؟ قالوا : كنا نعبد عزير بن الله ,, فيقال : كذبتم , لم يكن صاحبة و لا ولد , فما تريدون؟ قالوا : نريد أن تسقينا , فيقال : اشربوا , فيتساقطون في جهنم . ثم يقال للنصارى : ما كنتم تعبدون ؟ فيقولون : كنا نعبد المسيح بن الله ,, فيقال : كذبتم , لم يكن , صاحبة و لا ولد , فما تريدون؟ فيقولون : نريد أن تسقينا , فيقال : اشربوا , فيتساقطون .

حتى يبقى من كان يعبد الله , من بر أو فاجر , فيقال لهم : ما يحبسكم وقد ذهب الناس؟ فيقولون : فارقناهم ونحن أحوج منا إليه اليوم , وإنا سمعنا مناديا ينادي : ليلحق كل قوم بما كانوا يعبدون , و إنا ننتظر ربنا . قال : فيأتيهم الجبار في صورة غير صورته التي رأوه فيها أول مرة . فيقول : أنا ربكم , فيقولون : أنت ربنا , فلا يكلمه إلا الأنبياء .

فيقول : هل بينكم و بينه آية تعرفونه , فيقولون : الساق , فيكشف عن ساقه , فيسجد كل مؤمن , ويبقى من كان يسجد رياء و سمعة , فيذهب كيما يسجد فيعود ظهره طبقا واحدا . ثم يؤتى بالجسر فيجعل بين ظهري جهنم )) . قلنا : يا رسول الله ,, وما الجسر؟

قال : (( مدحضة مزلة , عليه خطاطيف و كلاليب , وحسكة مفلطحة لها شوكة عقيفة , تكون بنجد , يقال لها : السعدان , المؤمن عليها كالطرف و كالبرق وكالريح , وكأجاويد الخيل و الركاب , فناج مسلم و ناج مخدوش , ومكدوس في نار جهنم , حتى يمر آخرهم يسحب سحبا , فما أنتم بأشدّ لي مناشدة في الحق , قد تبين لكم من المؤمن يومئذ للجبار .

وإذا رأوا أنهم قد نجوا في إخوانهم , يقولون : ربنا إخواننا , كانوا يصلون معنا , ويصومون معنا , ويعملون معنا , فيقول الله تعالى : اذهبوا فمن وجدتم في قلبه مثقال دينار من إيمان فأخرجوه , ويحرم الله صورهم على النار .

فياتونهم وبعضهم قد غاب في النار إلى قدمه , وإلى أنصاف ساقيه , فيخرجون من عرفوا .

ثم يعودون , فيقول : اذهبوا فمن وجدتم في قلبه مثقال نصف دينار فأخرجوه , فيخرجون من عرفوا .

ثم يعودون , فيقول : اذهبوا فمن وجدتم في قلبه مثقال ذرة من إيمان فأخرجوه , فيخرجون من عرفوا )).

قال أبو سعيد : فإن لم تصدقوني فاقرؤوا : {{ إن الله لا يظلم مثقال ذرة وإن تك حسنة يضاعفها }}

(( فيشفع النبيون و الملائكة و المؤمنون , فيقول الجبار : بقيت شفاعتي , فيقبض قبضة من النار , فيخرج أقواما قد امتحشوا , فيلقون في نهر بأفواه الجنة يقال له : ماء الحياة , فينبتون في حافتيه كما تنبت الحبة في حميل السيل , قد رأيتموها إلى جانب الصخرة , وإلى جانب الشجرة , فما كان إلى الشمس منها كان أخضر , و ما كان منها إلى الظل كان أبيض . فيخرجون كأنهم اللؤلؤ , فيجعل في رقابهم الخواتيم , فيدخلون الجنة , فيقول أهل الجنة : هؤلاء عتقاء الرحمن , أدخلهم الجنة بغير عمل عملوه , ولا خير قدموه , فيقال لهم : لكم ما رأيتم و مثله معه )). متفق عليه .

সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করছেন: আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট জানতে চেয়ে বললাম: ইয়া রাসূলাল্লাহ : কেয়ামত দিবসে আমরা কি আমাদের প্রভূ আল্লাহ তাআলাকে দেখতে পাব? নবীজী বললেন: মেঘশূন্য আকাশে সূর্য ও চন্দ্রকে দেখতে তোমাদের কি কোন অসুবিধা হয়? আমরা বললাম : না । রাসূলুল্লাহ বললেন: সে দিন তোমাদেরও স্বীয় পালনকর্তাকে দেখতে কোন অসুবিধা হবে না তবে চন্দ্র - সূর্য দেখতে যতটুকু হয় হলে ততটুকু হবে। অত:পর বললেন: একজন ঘোষক ঘোষণা দেবে: প্রত্যেক জাতিকে নিজ নিজ উপাস্যদের নিকট যেতে বলা হচ্ছে। ঘোষণার পর সলীব তথা ক্রুশপন্থীরা ক্রুশের সাথে যেয়ে একত্রিত হবে। আর মূর্তি পূজাকরা মূর্তির সাথে গিয়ে মিশবে। এবং ভিন্ন ভিন্ন উপাস্যের উপাসকরা নিজ নিজ উপাস্যের সাথে গিয়ে জড় হবে। শেষ পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকবে আল্লাহর ইবাদতকারী পুন্যবান ও পাপী বান্দারা। এবং আহলে কিতাব (ইহুদী ও খৃষ্ট ধর্মানুসারী) দের অবশিষ্টাংশ।

অত:পর জাহান্নামকে প্রদর্শনের জন্য নিয়ে আসা হবে সেটি যেন মরিচিকা। অত:পর ইহুদীদের জিজ্ঞেস করা হবে যে তোমরা কার ইবাদত করতে? তারা উত্তরে বলবে: আল্লাহর পুত্র উযায়েরের। বলা হবে তোমরা মিথ্যা বলছ। আল্লাহ তাআলার কোন সন্তান ও সঙ্গিনী নেই। এখন তোমরা কি চাও? বলবে: আমাদের আশা আপনি আমাদের পান করিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করাবেন। বলা হবে : পান কর। এবং তারা জাহান্নামে ঝরে পড়বে। অত:পর খৃষ্টানদের জিজ্ঞেস করা হবে: তোমরা কার ইবাদত করতে? তারা বলবে: আল্লাহর পুত্র ঈসার। বলা হবে: তোমরা মিথ্যা বলছ, আল্লাহ তাআলার কোন সন্তান ও সঙ্গিনী নেই। এখন তোমরা কি চাও? বলবে: আমাদের কামনা যে আপনি আমাদের পানি পান করিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করাবেন। বলা হবে: পান কর। এবং তারা জাহান্নামে পড়ে যাবে।

এক পর্যায়ে এসে শুধুমাত্র আল্লাহ তাআলার ইবাদতকারী পুন্যবান ও পাপীবান্দারা অবশিষ্ট থাকবে। তখন তাদের বলা হবে: সকল মানুষ চলে গেল তোমাদের কিসে আটকে রেখেছে? তারা বলবে : আমরা তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছি এমতাবস্থায় যে আজ আমরা তার নিকট অতি মুখাপেক্ষী। আর আমরা একজন ঘোষকের ঘোষণা শুনতে পেয়েছি যে, প্রত্যেক ইবাদতকারী যেন নিজ নিজ মা’বুদের নিকট গিয়ে মিলিত হয়। তাই আমরা আমাদের পালনকর্তার অপেক্ষা করছি। রাসূলুল্লাহ বলেন: অত:পর মহান প্রতাপশালী তাদের ইতোপূর্বে দেখা আকৃতি ভিন্ন এক পরিবর্তিত আকৃতিতে আভির্ভূত হবেন। বলবেন: আমি তোমাদের প্রতিপালক। তারা বলবে: আপনি আমাদের পালনকর্তা। এরপর শুধুমাত্র নবীরাই তাঁর সাথে কথা বলতে পারবেন।

বলবেন: তোমাদের ও তার মাঝে কোন বিশেষ নিদর্শন আছে কি যার মাধ্যমে তোমরা তাঁকে চিনতে পারবে? তারা বলবে: হ্যাঁ আর তা হচ্ছে পায়ের গোছা। অত:পর তিনি স্বীয় গোছা উন্মোক্ত করবেন। প্রত্যেক মুমিন সেজদায় লুটিয়ে পড়বে। আর যারা (পৃথিবীতে) সুনাম কুড়ানোর উদ্দেশ্যে ও লোক দেখানো সেজদা করত তারা বাকী থাকবে। সেজদা করার চেষ্টা করবে কিন্তু যখনই সেজদায় যাবে পিঠ সাথে সাথে সস্থানে ফিরে আসবে।

অত:পর পুলসিরাত উপস্থিত করা হবে এবং জাহান্নামের উপর স্থাপন করা হবে। আমরা জানতে চাইলাম: ইয়া রাসূলাল্লাহ পুলসিরাত কি?

নবীজী বললেন: একটি অতি পিচ্ছিল জায়গা যার উপর রয়েছে বক্র হুক ও বড়শী এবং নজদে উৎপন্ন সা’দান নামক বাঁকা কাঁটার মত চওড়া চেপটা কাঁটা। মুমিন বান্দা তার উপর দিয়ে চোখের পলক, বিজলী, বাতাস এবং দ্রুতগামী উন্নত জাতের অশ্ব ও অন্যান্য দ্রুতগামী জন্তুর ন্যায় পার হয়ে যাবে। কেউ সহীহ সালামতে মুক্তি পাবে কেউ কাটার আঘাত খেয়ে আবার কেউ জাহান্নামের আগুনের ছোঁয়া পেয়ে। এক পর্যায়ে তাদের সর্বশেষজন অতিক্রম করবে তাকে টেনে নেয়া হবে। হক প্রার্থনা করার ব্যাপারে তোমরা আমার চেয়ে বেশি মিনতিকারী নও। অবশ্য তোমাদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে যে, সেদিন মহা প্রতাপশালী আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারী মুমিন কারা।

যখন তারা লক্ষ্য করবে যে, তারা তাদের অন্যান্য ভাইদের মাঝে মুক্তি পেয়েছে, তখন বলবে : হে আমাদের প্রতিপালক আমাদের ভাইদের কি সমাচার, তারা আমাদের সাথে সালাত আদায় করত, আমাদের সাথে সিয়াম পালন করত এবং আমাদের সাথে অন্যান্য আমল করত। আল্লাহ তাআলা বলবেন: তোমরা যাও, যার অন্তরে এক দিনার পরিমাণ ঈমানও বিদ্যমান পাবে তাকে বের করে নিয়ে আসবে। আল্লাহ তাআলা তাদের আকৃতি-প্রতিকৃতি কে জাহান্নামের উপর হারাম করেছেন।

তারা তাদের নিকট আসবে। এসে দেখতে পাবে কারো কারো পায়ের পাতা পর্যন্ত জাহান্নামে দেবে গেছে, কারো কারো অর্ধ গোছা পর্যন্ত। তারা যাদের চিনতে পাবে তাদেরকে বের করে নিয়ে আসবে।

অত:পর তারা ফিরে আসবে, আল্লাহ তাআলা বলবেন: যাও, যার অন্তরে অর্ধ দিনার পরিমাণ ঈমান বিদ্যমান পাবে তাকে বের করে নিয়ে আসবে। তখন তারা যাদের চিনতে পারবে তাদের বের করে নিয়ে আসবে।

এরপর তারা আবারো ফিরে আসবে। আল্লাহ তাআলা বলবেন: যাও, যার অন্তরে অনু পরিমাণ ঈমানও বিদ্যমান পাবে তাকে বের করে নিয়ে আসবে। তখন তারা যাদের চিনতে পাবে তাদের বের করে নিয়ে আসবে।

হাদীসের বর্ণনাকারী আবু সাঈদ বলেন: তোমাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হলে আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণী পড়:

(( إن الله لا يظلم مثقال ذرة وإن تك حسنة يضاعفها ))

নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা বিন্দুমাত্র অন্যায় করেন না আর যদি কোন সৎকর্ম থাকে তাহলে তা দ্বিগুন করে দেন।

এভাবে নবীগন সুপারিশ করবেন, সুপারিশ করবেন ফেরেশতাবৃন্দ ও মুমিনগন। এরপর মহামহিম প্রতাপশালী আল্লাহ তাআলা বলবেন : বাকি রইল আমার সুপারিশ, অত:পর আল্লাহ তাআলা জাহান্নাম থেকে ঝলসে যাওয়া এক সম্প্রদায়কে মুষ্ঠিবদ্ধ করে একমুষ্ঠি বের করে আনবেন। অত:পর জান্নাতের মুখে অবস্থিত এক নহরে যাকে আবে হায়াত বলা হয়, সেখানে তাদেরকে নিক্ষেপ করা হবে। তারা ঐ নহরের দুই তীরে উৎপন্ন হবে যেমনি করে স্রোতের সাথে ভেসে আসা খড়কুটুর উপর তৃণবীজ উৎপন্ন হয়। তোমরা সেগুলো প্রকান্ড পাথরের কিনারে অনুরূপ ভাবে বড় বড় গাছের পাশ্বে দেখেছ। এরমধ্যে যেগুলো সূর্যের দিকে থাকে সেগুলো হয় সবুজ আর যেগুলো ছায়ার দিকে থাকে সেগুলো হয় সাদা।

তারা ঐ নহর থেকে ঝকঝকে তকতকে হয়ে বের হবে যেমন মুক্তোদানা। তাদের গ্রীবাদেশে সীলমোহর এঁটে দেয়া হবে। অত:পর তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। জান্নাতবাসীরা বলবে: তারা হচ্ছে মহা দয়ালু আল্লাহ তাআলার মুক্তকৃত। আল্লাহ তাদেরকে কোন আমল ও নেক কাজ করা ছাড়াই জান্নাতে প্রবেশ করিয়েছেন। তখন তাদের বলা হবে: তোমাদের জন্য যা দেখছ এবং তার সাথে এর সমপরিমাণ বরাদ্দ রয়েছে। [বর্ণনায় বুখারী ও মুষলিম। হাদীস নং বুখারী (৭৪৩৯) এবং মুসলিম (১৮৩)]

১৩৫
হিসাব ও মিযান হিসাব:
মহান আল্লাহ তাআলা স্বীয় বান্দাদেরকে তাঁর সামনে দাঁড় করাবেন এবং তাদের কৃত আমল সম্পর্কে অবহিত করবেন। অত:পর তাদের আমল অনুপাতে প্রতিদান দান করবেন। নেক কাজের বিনিময়ে দশ থেকে সাতশত গুণ বরং আরোও বর্ধিত করে, আর বদকাজের বিনিময়ে সমপরিমাণ প্রতিদান দেবেন।

১৩৬
কিতাব তথা আমলনামা গ্রহণ:
প্রত্যেক অবস্থানকারীকে তার আমলনামা প্রদান করা হবে। সে জীবনে ভাল-মন্দ যা কিছুই করেছে তাতে সব লেখা আছে। তাদের কতেককে আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে তারা হচ্ছে নেককার ভাগ্যবান আর কতেককে দেয়া হবে বাম হাতে তারা হচ্ছে বদকার-দুর্ভাগা।

১- আল্লাহ তাআলা বলেন:

يَا أَيُّهَا الْإِنْسَانُ إِنَّكَ كَادِحٌ إِلَى رَبِّكَ كَدْحًا فَمُلَاقِيهِ ﴿6﴾ فَأَمَّا مَنْ أُوتِيَ كِتَابَهُ بِيَمِينِهِ ﴿7﴾ فَسَوْفَ يُحَاسَبُ حِسَابًا يَسِيرًا ﴿8﴾ وَيَنْقَلِبُ إِلَى أَهْلِهِ مَسْرُورًا ﴿9﴾ وَأَمَّا مَنْ أُوتِيَ كِتَابَهُ وَرَاءَ ظَهْرِهِ ﴿10﴾ فَسَوْفَ يَدْعُو ثُبُورًا ﴿11﴾ وَيَصْلَى سَعِيرًا ﴿12﴾ { الإنشقاق :৬-১২}

হে মানুষ, তোমাকে তোমার পালনকর্তা পর্যন্ত পৌঁছতে কষ্ট স্বীকার করতে হবে। অত:পর তার সাক্ষাৎ ঘটবে। যাকে তার আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে, তার হিসাব-নিকাশ সহজে হয়ে যাবে এবং সে তার পরিবার-পরিজনের নিকট হৃষ্টচিত্তে ফিরে যাবে। এবং যাকে তার আমলনামা পিঠের পশ্চাদ্দিক থেকে দেয়া হবে, সে মৃত্যুকে আহবান করবে এবং জাহান্নামে প্রবেশ করবে।

{সূরা ইনশিকাক: ৬-১২}

২-মহান আল্লাহ তাআলা আরো বলেন:

وَأَمَّا مَنْ أُوتِيَ كِتَابَهُ بِشِمَالِهِ فَيَقُولُ يَا لَيْتَنِي لَمْ أُوتَ كِتَابِيَهْ ﴿25﴾ وَلَمْ أَدْرِ مَا حِسَابِيَهْ ﴿26﴾ يَا ‎لَيْتَهَا كَانَتِ الْقَاضِيَةَ ﴿27﴾ الحاقة :২৫-২৭}

আর যার আমলনামা বাম হাতে দেয়া হবে, সে বলবে হায়! আমায় যদি আমার আমলনামা না দেয়া হতো। আমি যদি না জানতাম আমার হিসাব। হায়! আমার মৃত্যুই যদি শেষ হতো।

{ সূরা আল-হা-ক্কাহ: ২৫-২৭}

১৩৭
দাড়ি পাল্লা স্থাপন:
সৃষ্টিকুলের হিসাব নেয়ার উদ্দেশ্যে দাড়িপাল্লা স্থাপন করা হবে। মানুষ হিসাব প্রদানের জন্য একজন একজন করে সামনে অগ্রসর হবে, তাদের প্রতিপালক হিসাব নেবেন এবং আমল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। হিসাব শেষ হওয়ার পর আমল ওজন করা হবে। সেটি আসল দাড়িপাল্লাই হবে যার দু’টি পাল্লা থাকবে।

১- মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

وَنَضَعُ الْمَوَازِينَ الْقِسْطَ لِيَوْمِ الْقِيَامَةِ فَلَا تُظْلَمُ نَفْسٌ شَيْئًا وَإِنْ كَانَ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِنْ خَرْدَلٍ أَتَيْنَا بِهَا وَكَفَى بِنَا حَاسِبِينَ { الأنبياء : ৪৭}

আমি কেয়ামতের দিন ন্যায়বিচারের মানদন্ড স্থাপন করব।সুতরাং কারও প্রতি যুলুম হবে না। যদি কোন আমল সরিষার দানা পরিমাণও হয়, আমি তা উপস্থিত করব এবং হিসাব গ্রহণের জন্য আমিই যথেষ্ট। {সূরা আম্বিয়া: ৪৭}

২- আল্লাহ তাআলা আরও বলেন:

فَأَمَّا مَنْ ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ ﴿6﴾ فَهُوَ فِي عِيشَةٍ رَاضِيَةٍ ﴿7﴾ وَأَمَّا مَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ ﴿8﴾ فَأُمُّهُ هَاوِيَةٌ ﴿9﴾ وَمَا أَدْرَاكَ مَا هِيَهْ ﴿10﴾ نَارٌ حَامِيَةٌ ﴿11﴾ { القارعة : ৬-১১}

অতএব যার পাল্লা ভারী হবে, সে সুখীজীবন যাপন করবে, আর যার পাল্লা হালকা হবে, তার ঠিকানা হবে হাবিয়া, আপনি জানেন তা কি? প্রজ্জ্বলিতঅগ্নি। {সূরা কারেয়া: ৬-১১}

৩-হাদীসে এসেছে

وعن ابن عمر رضي الله عنهما قال : سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول : (( يدنى المؤمن يوم القيامة من ربه عز وجلّ حتى يضع عليه كنفه , فيقرره بذنوبه , فيقول : هل تعرف؟ فيقول : أي رب أعرف قال : فإني قد سترتها عليك في الدنيا , وإني أغفرها لك اليوم , فيعطى صحيفة حسناته , وأما الكفار و المنافقون فينادي بهم على رؤوس الخلائق هؤلاء الذين كذبوا على الله ,)) متفق عليه

বিশিষ্ট সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ইরশাদ করতে শুনেছি : কেয়ামত দিবসে মুমিন বান্দাকে স্বীয় পালনকর্তা আল্লাহ তাআলার নিকটবর্তী করা হবে, এমনকি আল্লাহ তাআলা তাঁর রহমতের পর্দা সে বান্দার উপর রাখবেন। অত:পর তার থেকে তার কৃতপাপ ও অন্যায়ের স্বীকারোক্তি আদায় করবেন। বলবেন: তুমি কি জান? তখন সে বলবে: হ্যাঁ প্রভু, আমার জানা আছে। আল্লাহ বলবেন: আমি সেসব গুনাহ পৃথিবীতে গোপন করে রেখেছিলাম আজ সব ক্ষমা করে দিলাম। অত:পর তার নেককাজের আমলনামা প্রদান করা হবে। আর মুনাফিক ও কাফের সম্প্রদায়কে সকল মানুষের সম্মুখে ডেকে বলা হবে। এরাই সেসব লোক যারা আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করেছিল। [বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং যথাক্রমে (২৪৪১) (২৭৬৮)]

১৩৮
কেয়ামতের দিন কি বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে:
১-আল্লাহ তাআলা বলেন:

وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا { الإسراء :৩৬)

যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই তার পিছনে পড়োনা। নিশ্চয়ই কান, চক্ষু ও অন্ত:করণ এদের প্রত্যেকটিই জিজ্ঞেসিত হবে।{সূরা ইসরা:৩৬}

২-আল্লাহ তাআলা আরোও বলেন:

ويوم يناديهم فيقول أين شركاءي الذين كنتم تزعمون . { القصص :৬২}

যেদিন আল্লাহ তাদের ডাক দিয়ে বলবেন: তোমরা যাদের কে আমার শরীক দাবী করতে তারা কোথায় ?। {সূরা কাসাস:৬২}

৩-আল্লাহ অন্যত্র বলছেন:

ويوم يناديهم فيقول ماذا أجبتم المرسلين . { القصص :৬৫}

যে আল্লাহ তাদেরকে ডেকে বলবেন, তোমরা রাসূলগনকে কি জবাব দিয়েছিলে।{সূরা কাসাস:৬৫}

৪-আল্লাহ তাআলা আরো বলেন:

فوربك لنسئلنهم أجمعين عما كانوا يعملون .{ الحجر :৯২-৯৩}

অতএব আপনার পালনকর্তার কসম , আমি অবশ্যই ওদের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করব। ওদের কাজকর্ম সম্পর্কে।{সূরা হিজর:৯২-৯৩}

৫-আল্লাহ তাআলা অন্যত্র ইরশাদ করছেন:

وأوفوا بالعهد إن العهد كان مسئولا . { الإسراء : ৩৪}

আর অঙ্গীকার পূর্ণ কর। নিশ্চয়ই অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।{সূরা ইসরা :৩৪}

৬-আরো ইরশাদ হচ্ছে:

ثم لتسئلن يومئذ عن النعيم . { التكاثر :৮}

এরপর অবশ্যই সেদিন তোমরা নেয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। { সূরা তাকাসুর:৮}

৭-মহান আল্লাহ তাআলা অন্যস্থানে বলছেন:

فَلَنَسْأَلَنَّ الَّذِينَ أُرْسِلَ إِلَيْهِمْ وَلَنَسْأَلَنَّ الْمُرْسَلِينَ ﴿6﴾ فَلَنَقُصَّنَّ عَلَيْهِمْ بِعِلْمٍ وَمَا كُنَّا غَائِبِينَ ﴿7﴾ وَالْوَزْنُ يَوْمَئِذٍ الْحَقُّ فَمَنْ ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ ﴿8﴾ { الأعراف :৬-৭}

অতএব, আমি অবশ্যই তাদেরকে জিজ্ঞেস করব যাদের কাছে রাসূল প্রেরিত হয়েছিল এবং আমি অবশ্যই জিজ্ঞেস করব রাসূলগণকে। অত:পর আমি স্বজ্ঞানে তাদের কাছে অবস্থা বর্ণনা করব বস্ত্তত: আমিতো অনুপস্থিত ছিলাম না। {সূরা আরাফ:৬-৭}

৮- হাদীসে এসেছে

وعن أبي برزة الأسلمي رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم :(( لا تزول قدما عبد يوم القيامة حتى يسأل عن عمره فيما أفناه , وعن علمه فيما فعل , وعن ماله من أين اكتسبه و فيما أنفقه , وعن جسمه فيما أبلاه )). أخرجه الترمذي و الدارمي .

সাহাবী আবু বারযাহ আসলামী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: কেয়ামতের দিন প্রত্যেক ব্যক্তির দু’পা নিম্নোক্ত বিষয়ে জিজ্ঞেসিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত নিজ জায়গায় স্থির থাকবে। তার বয়স সম্পর্কে কি কাজে সে সেটি নিঃশেষ করেছে , জ্ঞান সম্পর্কে এর মাধ্যমে সে কি করেছে, সম্পদ সম্পর্কে কোথায় হতে উপার্জন করেছে আর কোন কাজে ব্যয় করেছে আর তার শরীর সম্পর্কে কি কাজে সেটি জীর্ণ ও ক্ষয় করেছে। [হাদীসটি বিশুদ্ধ সনদে তিরমিযী ও দারামীতে বর্ণিত হয়েছে। হাদীস নং তিরমিযী (২৪১৭) আর দারামী (৫৪৩) । দেখুন আস্সিলসিলাতুস সহীহা (৯৪৬)]

১৩৯
হিসাবের ধরন: কেয়ামতের দিন যাদের হিসাব নেয়া হবে তারা মূলত দুইশ্রেণীতে বিভক্ত:
১- যাদের হিসাব খুব সহজ হবে আর সেটি হচ্ছে শুধু আমল নামা প্রদর্শন করা

عن عائشة رضي الله عنها أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : (( ليس أحد يحاسب يوم القيامة إلا هلك )) فقلت : يا رسول الله أ ليس قد قال الله تعالى : فأما من أوتي كتابه بيمينه , فسوف يحاسب حسابا يسيرا , فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم : (( إنما ذلك العرض , وليس أحد يناقش الحساب يوم القيامة إلا عذب )). متفق عليه

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:কেয়ামতের দিন যারই হিসাব নেয়া হবে সে ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি জানতে চাইলাম: ইয়া রাসূলাল্লাহ আল্লাহ তাআলা কি বলেননি: যার আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে তার হিসাব সহজ করে নেয়া হবে। রাসূলুল্লাহ বললেন: এটি হচ্ছে শুধু দেখানোর জন্য। আর কেয়ামতের দিন যার হিসাব জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে নেয়া হবে তাকে অবশ্যই শাস্তি দেয়া হবে। [মুত্তাফাক আলাইহ। হাদীস নং বুখারী (৬৫৩৭) আর মুসলিম (২৮৭৬)]

২-যাদের হিসাব খুব কঠিন করে নেয়া হবে। ছোট বড় প্রত্যেক বিষয়েই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। যদি সত্যি বলে তাহলে খুবই ভাল। আর যদি মিথ্যা বলে অথবা গোপন করার চেষ্টা করে তাহলে মুখে সীলমোহর এঁটে দেয়া হবে এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কথা বলবে । যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন:

اليوم نختم على أفواههم وتكلمنا أيديهم وتشهد أرجلهم بما كانوا يكسبون { يس :৬৫}

অর্থাৎ: আজ আমি তাদের মুখে মোহর এঁটে দেব, তাদের হাত আমার সাথে কথা বলবে এবং তাদের পা তাদের কৃতকর্মের সাক্ষ্য দেবে। {সূরা ইয়াসীন:৬৫}

উম্মতের মাঝে যাদের হিসাব নেয়া হবে:

১- কেয়ামত দিবসের হিসাব ব্যাপক হারে সকলের জন্য প্রযোজ্য। তবে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাদের বাদ দিয়েছেন তাদের কথা ভিন্ন। তাঁরা হচ্ছেন এ উম্মতের সত্তর হাজার লোক যারা বিনা হিসাব ও বিনা আযাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে ।

২-কাফেরদেরকে হিসাবের আওতায় আনা হবে। এবং তিরস্কার ও হেয় করার উদ্দেশ্যে তাদের সামনে তাদের কৃত আমল পেশকরা হবে। শাস্তি ও আযাব ভোগ করার দিক থেকে তারা বিভিন্ন শ্রেণীভূক্ত হবে। যাদের পাপ ও কুকর্ম তুলনামূলক বেশি তাদের শাস্তি যাদের পাপ কম তাদের থেকে কঠিন হবে। আর যারা সৎকর্ম সম্পাদন করেছে তাদের শাস্তিও তুলনা মূলক লঘু হবে তবে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।

৩-কেয়ামতের দিন উম্মতদের মধ্যে সর্ব প্রথম উম্মতে মুহাম্মাদিয়ার হিসাব নেয়া হবে। আর মুসলমানদের আমলের মধ্যে সর্ব প্রথম সালাতের হিসাব নেয়া হবে। সালাত যদি সব সঠিক প্রমাণিত হয় তাহলে তার সব আমলই সঠিক বের হয়ে আসবে। আর সালাতের মধ্যে অসুবিধা পরিলক্ষিত হলে সব আমলেই অসুবিধা দেখা দেবে। আর মানুষের হকের মধ্যে সর্ব প্রথম রক্তপাতের হিসাব নেয়া হবে।

১৪০
আমল পরিমাপ করার পদ্ধতি:
কেয়ামতের দিন বান্দার নেক-বদ সব আমলই পরিমাপ করা হবে। যার নেক আমল বেশি হবে সে কৃতকার্য বলে বিবেচিত হবে। আর যার বদ আমল বেশি হবে সে নিশ্চিত ধ্বংস হয়ে যাবে। সকল বান্দাদের মাঝে আল্লাহ তাআলার ইনসাফ প্রকাশার্থে কর্মসম্পাদন কারী, কৃত আমল এবং আমলনামা সব পরিমাপ করা হবে। কেয়ামতের দিন বান্দার দাড়িপাল্লাতে সর্বাধিক ওজনদার আমল হবে উত্তম চরিত্র।

১-আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা ইরশাদ করেন:

وَالْوَزْنُ يَوْمَئِذٍ الْحَقُّ فَمَنْ ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ ﴿8﴾ وَمَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ الَّذِينَ خَسِرُوا أَنْفُسَهُمْ بِمَا كَانُوا بِآَيَاتِنَا يَظْلِمُونَ ﴿9﴾ { الأعراف : ৮-৯}

আর সেদিন যথার্থই ওজন হবে। অত:পর যাদের পাল্লা ভারী হবে, তারাই সফলকাম হবে। এবং যাদের পাল্লা হাল্কা হবে, তারা হবে সেসব লোক যারা নিজেদের ক্ষতি নিজেরাই করেছে। কেননা তারা আমার আয়াতসমূহ অস্বীকার করতো। {সূরা আ’রাফ:৮-৯}

২- হাদীসে এসেছে

وعن أبي هريرة رضي الله عنه عن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال :(( إنه يأتي الرجل العظيم السمين يوم القيامة لا يزن عند الله جناح بعوضة , وقال : اقرؤوا إن شئتم (( فلا نقيم لهم يوم القيامة وزنا )). متفق عليه

বিশিষ্ট সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করছেন, নবীজী বলেন: কেয়ামতের দিন বিশাল আকৃতির-স্থুলদেহ বিশিষ্ট এমন এমন কিছু লোক উপস্থিত হবে আল্লাহ তাআলার নিকট যাদের ওজন মশার ডানা পরিমাণও নেই। নবীজী আরো বলেন: তোমাদের মন চাইলে পড়ে দেখতে পার (সুতরাং কেয়ামতের দিন আমি তাদের জন্য কোন ওজন স্থির করব না। অর্থাৎ তাদের কোন প্রকার মূল্য ও গুরুত্ব থাকবে না। [বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং যথাক্রমে (৪৭২৯) ও (২৭৮৫)।]

১৪১
কাফেরদের নেক আমলের বিধান:
কাফের ও মুনাফিকদের কোন প্রকার ইবাদত ও নেক আমল কবুল করা হয় না। কারণ ইবাদত কবুল হওয়ার প্রধান শর্ত ঈমান এদের ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। তাদের নেকআমলসমূহ ছাইভষ্ম সদৃশ যার উপর দিয়ে প্রবল বাতাস বয়ে যায় ধুলিঝড়ের দিন। কেয়ামতের দিন সকল মানুষের সামনে তাদের সম্পর্কে ঘোষণা দেয়া হবে যে, এরাই সেসব লোক যারা স্বীয় প্রতিপালকের উপর মিথ্যা আরোপ করেছিল।

১-আল্লাহ তাআলা বলেন:

وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللَّهِ كَذِبًا أُولَئِكَ يُعْرَضُونَ عَلَى رَبِّهِمْ وَيَقُولُ الْأَشْهَادُ هَؤُلَاءِ الَّذِينَ كَذَبُوا عَلَى رَبِّهِمْ أَلَا لَعْنَةُ اللَّهِ عَلَى الظَّالِمِينَ { هود :১৮}

আর তাদের চেয়ে বড় যালেম কে? যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করে। এসব লোককে তাদের পালনকর্তার সাক্ষাত সম্মুখীন করা হবে আর সাক্ষীগন বলতে থাকবে, এরাই ঐসব লোক, যারা স্বীয় পালনকর্তার প্রতি মিথ্যারোপ করেছিল। শুনে রাখ! যালেমদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত রয়েছে। {সূরা হুদ:১৮)

২-অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

مَثَلُ الَّذِينَ كَفَرُوا بِرَبِّهِمْ أَعْمَالُهُمْ كَرَمَادٍ اشْتَدَّتْ بِهِ الرِّيحُ فِي يَوْمٍ عَاصِفٍ لَا يَقْدِرُونَ مِمَّا كَسَبُوا عَلَى شَيْءٍ ذَلِكَ هُوَ الضَّلَالُ الْبَعِيدُ { إبراهيم :১৮}

যারা স্বীয় পালনকর্তার সত্তায় অবিশ্বাসী, তাদের অবস্থা এইযে, তাদের নেকআমলসমূহ ছাইভষ্মের মত যার উপর দিয়ে প্রবল বাতাস বয়ে যায় ধুলিঝড়ের দিন। তাদের উপার্জনের কোন অংশই তাদের করতলগত হবে না । এটাই দূরবর্তী পথভ্রষ্টতা। {সূরা ইবরাহীম:১৮}

৩-আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা আরও বলেন:

يَوْمَ يَرَوْنَ الْمَلَائِكَةَ لَا بُشْرَى يَوْمَئِذٍ لِلْمُجْرِمِينَ وَيَقُولُونَ حِجْرًا مَحْجُورًا ﴿22﴾ وَقَدِمْنَا إِلَى مَا عَمِلُوا مِنْ عَمَلٍ فَجَعَلْنَاهُ هَبَاءً مَنْثُورًا ﴿23﴾ { الفرقان :২২-২৩}

যেদিন তারা ফেরেশতাদেরকে দেখবে, সেদিন অপরাধীদের জন্য কোন সুসংবাদ থাকবে না এবং তারা বলবে, কোন বাধা যদি তা আটকে রাখতো। আমি তাদের কৃতকর্মের প্রতি মনোনিবেশ করব অত:পর সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধুলিকনারূপ করে দেব। {সূরা ফুরকান:২২-২৩}

১৪২
আমল দর্শন:
কেয়ামতের দিন বান্দাদের সম্মুখে তাদের কৃত সমূদয় আমল তুলে ধরা হবে। প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ নিজ সম্পাদিত আমল- ছোট কিংবা বড় নেক কিংবা বদ- স্ব চোক্ষে দেখতে পাবে। যেমন মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

يومئذ يصدر الناس أشتاتا ليروا أعمالهم , فمن يعمل مثقال ذرة خيرا يره ومن يعمل مثقال ذرة شرا يره . { الزلزلة :৬-৮}

সেদিন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন দলে প্রকাশ পাবে, যাতে তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম দেখানো হয়। কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা দেখতে পাবে। আবার কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও দেখতে পাবে।

{সূরা যিলযাল:৬-৮}

১৪৩
দুনিয় ও আখেরাতে আমলের প্রতিদান:
عن أنس رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم :(( إن الله لا يظلم مؤمنا حسنة , يعطى بها في الدنيا , و يجزى بها في الآخرة , وأما الكافر فيطعم بحسنات ما عمل بها في الدنيا , حتى إذا أفضى إلى الآخرة لم يكن له حسنة يجزى بها )). أخرجه مسلم

বিশিষ্ট সাহাবী আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন: মহান আল্লাহ তাআলা কোন মুমিন বান্দার উপরই একটি নেক আমলের ক্ষেত্রেও কোনরূপ অন্যায় করেন না। ঐ নেক আমলের বিনিময়ে দুনিয়াতে (রিযিক) দান করেন আর পরকালে উপযুক্ত প্রতিদান দান করবেন। আর কাফেরগণ কৃত নেকআমলের বিনিময়ে দুনিয়াতে জীবনোপকরণ লাভ করে। এক পর্যায়ে যখন সে আখেরাত পানে যাত্রা করে , আমলনামায় কোন আমলই আর অবশিষ্ট থাকে না যে প্রতিদান দেয়া হবে। [বর্ণনায় মুসলিম। হাদীস নং:(২৮০৮)]

১৪৪
কেয়ামত দিবসে অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের হুকুম:
মুমিনদের শিশু সন্তানরা বয়স্কদের ন্যায় স্বীয় পিতা আদম আলাইহিস সালামের আকৃতিতে জান্নাতে প্রবেশ করবে। অনুরূপভাবে মুশরিকদের শিশু সন্তানরাও। এবং তারা বয়স্কদের ন্যায় বিবাহ শাদীও করবে। যে সকল নারী-পুরুষ অবিবাহিত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে তারা আখেরাতে বিবাহ করবে। জান্নাতে কোন অবিবাহিত নারী-পুরুষ থাকবে না।

১৪৫
হাউজ
মহান আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক নবীর জন্য একটিকরে হাউজ সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্যে আমাদের নবীজীর হাউজটি হলো আয়তনের দিক থেকে সর্ববৃহৎ, স্বাদের দিক থেকে সবচেয়ে মিষ্টি এবং কেয়ামতের দিন তাতেই সর্বাধিক সংখ্যক আগমনকারীর আগমন ঘটবে।

১৪৬
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাউজের বিবরণ:
১-হাদীস

عن عبد الله بن عمرو رضي الله عنهما قال : قال النبي صلى الله عليه وسلم :(( حوضي مسيرة شهر , ماؤه أبيض من اللبن , وريحه أطيب من المسك , وكيزانه كنجوم السماء , من شرب منها فلا يظمأ أبدا )). متفق عليه

সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: আমার হাউজের আয়তন হচ্ছে এক মাসের দূরত্ব, তার পানি দুধের চেয়েও সাদা, ঘ্রাণ মিশকের চেয়েও অধিক সুগন্ধময়, পানপাত্র আকাশের নক্ষত্র সদৃশ, যে ব্যক্তি তার থেকে পান করবে সে আর কখনো পিপাসার্ত হবে না। [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং বুখারী (৬৫৭৯) এবং মুসলিম (২২৯২)।]

অন্য এক রেওয়াতে আছে:

(( عرضه مثل طوله ما بين عمان إلى أيلة ، ماؤه أشد بياضا من اللبن و أحلى من العسل )). أخرجه مسلم .

তার প্রস্থ আম্মান থেকে আইলা নামক স্থানের দৈর্ঘের সমান। পানি দুধের থেকেও অধিক সাদা এবং মধুর চেয়েও বেশি মিষ্টি। [মুসলিম (২৩০০)।]

২- হাদীস

وعن أنس بن مالك رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : (( إن قدر حوضي كما بين أيلة و صنعاء من اليمن , وإن فيه من الأباريق كعدد نجوم السماء )). متفق عليه

বিশিষ্ট সাহাবী আনাস বিন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করছন: আমার হাউজের আয়তন হচ্ছে আইলা (জর্দানের একটি এলাকার নাম) থেকে ইয়েমেনের সানআ নামক স্থানের দূরত্বের সমান। তাতে আকাশের নক্ষত্ররাজি সমসংখ্যক পানপাত্র ও কুঁজা রয়েছে। [বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং বুখারী (৬৫৮০) এবং মুসলিম (২৩০৩)।]

১৪৭
হাউজ থেকে কাদের তাড়িয়ে দেয়া হবে:
عن أبي هريرة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال :(( يرد علي يوم القيامة رهط من أصحابي , فيجلون عن الحوض , فأقول : يا رب أصحابي , فيقول : إنك لا علم لك بما أحدثوا بعدك , إنهم ارتدوا على أدبارهم القهقرى )). متفق عليه .

প্রখ্যাত সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:কেয়ামতের দিন আমাদের উম্মতের একটি ছোট দল আমার নিকট আসবে, তাদেরকে সেখান থেকে ফিরিয়ে দেয়া হবে। আমি বলব: হে রব, এরা আমার সাহাবী! আল্লাহ বলবেন: আপনার জানা নেই আপনার পর এরা কি কি বেদআতের জন্ম দিয়েছে। তারা তাদের পিছন পানে হেঁটে পূর্বাবস্থায় ফিরে গিয়েছে। [বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং বুখারী (৬৫৮৫) এবং মুসলিম (২২৯১)।]

১৪৮
পুলসিরাত
পুলসিরাত বলতে সেই ব্রীজকে বুঝানো হচ্ছে, যেটি জাহান্নামের উপরে স্থাপন করা হয়েছে যার উপরদিয়ে মুসলমানরা জান্নাতে যাবে।

১৪৯
পুলসিরাত অতিক্রম করবে কারা:
একমাত্র মুসলমানরাই পুলসিরাত অতিক্রম করবে। আর কাফের ও মুশরিকদের প্রত্যেক উপদল তারা পৃথিবীতে যে সকল প্রতিমা, শয়তান ও এ জাতীয় বাতিল উপাস্যদের উপাসনা করত তাদের পিছনে পিছনে চলবে অত:পর স্বীয় মা’বূদসহ প্রথমে জাহান্নামে পতিত হবে।

এরপর অবশিষ্ট থাকবে যারা বাহ্যত: আল্লাহ তাআলার ইবাদত করত। খাঁটি মনে হোক কিংবা কপটতা তথা নেফাকীর সাথে। তাদের জন্য পুলসিরাত স্থির করা হবে। এরপর বিশেষ নূর যা শুধুমাত্র মুমিনদেরকে শামিল করবে এবং সেজদা দেয়া অসম্ভব হওয়ার মাধ্যমে মুনাফিকরা মুমিনদের থেকে পৃথক হয়ে যাবে। পরে তারা পিছনে জাহান্নামের দিকে ফিরে আসবে। আর মুমিনবৃন্দ পুলসিরাত অতিক্রম করে জান্নাতে পৌঁছে যাবে।

পুলসিরাত অতিক্রম কর্মটি শুরুহবে হিসাব ও আমল পরিমাপকর্ম শেষ হওয়ার পর। অত:পর মানুষ পুলসিরাত অতিক্রম করার জন্য বাধ্য হবে। যেমন আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করছেন:

وإن منكم إلا واردها , كان على ربك حتما مقضيا . ثم ننجي الذين اتقوا ونذر الظالمين فيها جثيا .{ مريم : ৭১-৭২}

তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই , যে তথায় পৌঁছবে না। এটা আপনার পালনকর্তার অনিবার্য ফয়সালা। অত:পর আমি মুত্তাকীদের উদ্ধার করব এবং জালেমদেরকে সেখানে নতজানু অবস্থায় ছেড়ে দেব। {সূরা মারইয়াম:৭১-৭২}

১৫০
পুলসিরাত ও সেটি অতিক্রম করার বিবরণ:
عن أبي سعيد الخدري رضي الله عنه في حديث الرؤية و صفة الصراط ... ــ فيه ــ قيل يا رسول الله : وما الجسر؟ قال :(( دحض مزلة , فيه خطاطيف , وكلاليب , و حسك تكون بنجد , فيها شويكة يقال لها السعدان , فيمر المؤمنون كطرف العين , و كالبرق , و كالريح , وكالطير , و كأجاويد الخيل والركاب , فناج مسلم , ومخدوش مرسل , ومكدوس في نار جهنم )). متفق عليه

সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে পুলসিরাতের বিবরণ সম্বলিত বর্ণিত হাদীস। -যাতে আছে- বলা হল : ইয়া রাসূলাল্লাহ : পুলসিরাত কি? বললেন: অত্যন্ত পিচ্ছিল একটি জায়গা, যেখানে আছে বড়শী ও বাঁকা হুক এবং নজদে উৎপন্ন ছোট ছোট কাঁটা বিশিষ্ট সা’দান নামক এক প্রকার কাঁটা। ঈমানদাররা চোখের পলক, বিজলী, বাতাস, পাখী ও উন্নত জাতের দ্রুতগামী অশ্ব এবং অন্যান্য জন্তুর ন্যায় দ্রুতবেগে পার হয়ে যাবে। কতেক সহী-সালামতে পার হবে, কাঁটার আঘাত প্রাপ্ত থাকবে ঝুলন্ত আর কেউ কেউ জাহান্নামের আগুনে জ্বলসে যাবে। [বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং যথাক্রমে (৭৪৩৯) ও (১৮৩)]

১৫১
পুলসিরাত সর্বপ্রথম কে অতিক্রম করবে
পুলসিরাত সর্ব প্রথম অতিক্রম করবেন নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর উম্মতবৃন্দ। পুলসিরাত একমাত্র মুমিনরাই অতিক্রম করতে পারবে। তাদেরকে তাদের ঈমান ও আমল অনুপাতে তাদের নূর প্রদান করা হবে। অত:পর তার ভিত্তিতে তারা পুলসিরাত অতিক্রম করবে। আমানত ও রেহেমকে ছেড়ে দেয়া হবে তারা এসে পুলসিরাতের ডান ও বাম পাশে দাড়িয়ে যাবে। সেদিন রাসূলগনের দোআ হবে : হে আল্লাহ শান্তি ও নিরাপত্তা দান করুন।

عن أبي هريرة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال في حديث الرؤية : (( ويضرب الصراط بين ظهري جهنم , فأكون أنا و أمتي أول من يجيز , ولا يتكلم يومئذ إلا الرسل , و دعوى الرسل يومئذ : اللهم سلم سلم )). متفق عليه

বিশিষ্ট সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণেত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বপ্নের বর্ণনা সম্বলিত হাদীসে বলেছেন: এবং জাহান্নামের উপর পুলসিরাত স্থাপন করা হবে, আমি ও আমারা উম্মত সর্বপ্রথম তা অতিক্রম করব। সেদিন রাসূলগন ব্যতীত আর কেউ কথা বলবে না, রাসূলগনের দোআ হবে : হে আল্লাহ শান্তি ও নিরাপত্তা দান করুন। [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং যথাক্রমে (৮০৬) ও (১৮২)]

১৫২
পুলসিরাত পার হওয়ার পর ঈমানদারদের অবস্থা কি হবে:
عن أبي سعيد الخدري رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : (( يخلص المؤمنون من النار فيحبسون على قنطرة بين الجنة و النار , فيقتص لبعضهم من بعض مظالم كانت بينهم في الدنيا , حتى إذا هذبوا و نقوا أذن لهم في دخول الجنة , فوالذي نفس محمد بيده لأحدهم أهدى بمنزله في الجنة منه بمنزله كان في الدنيا )). أخرجه البخاري

সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন: মুমিনগন জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে অত:পর তাদেরকে জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত একটি পুলের নিকট আটক করা হবে এবং পৃথিবীতে যারা অন্যায়ের শিকার হয়েছিল তাদের পক্ষ থেকে কিসাস (প্রতিশোধ) নেয়া হবে। অত:পর তাদেরকে পরিস্কার ও নিষ্কলুস করার পর জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হবে। কসম সে সত্ত্বার যার হাতে আমার জীবন তাদের প্রত্যেকেই জান্নাতে তার আবাসস্থল পৃথিবীর আবাসস্থল থেকেও ভাল করে চিনতে পারবে। [বর্ণনায় বুখারী। হাদীস নং (৬৫৩৫)]

১৫৩
শাফা‘আত
শাফাআতের অর্থ হচ্ছে : অপরের জন্য কল্যাণের প্রার্থনা করা। শাফাআত এর বাংলা প্রতিশব্দ হল শুপারিশ।

শাফাআতের প্রকার: কেয়ামত দিবসে শাফাআত দুই প্রকার।

১৫৪
১- একমাত্র নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সংশ্লিষ্ট শাফাআত, এটি আবার কয়েক প্রকার
(ক) এর মধ্যে সবচে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে হাশরের ময়দানে উপস্থিত সকল মানুষের তরে বিচারকার্য শুরু করার জন্য তাঁর শাফাআতে উযমা। তিনি তাদের তরে আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবেন। আল্লাহ তাআলা তাদের মাঝে বিচারকার্য শুরু করবেন। আর এটিই হচ্ছে তাঁর মাকামে মাহমূদ।

(খ)তাঁর উম্মতের বিশেষ শ্রেণীর কিছু লোকের ক্ষেত্রে তাঁর শাফাআত। যার ফলে তারা বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর তারা হচ্ছে সেই সত্তর হাজার লোক। যখন আল্লাহ তাআলা বলবেন: আপনি আপনার উম্মতের মধ্যে যাদের কোন হিসাব নেই তাদেরকে জান্নাতের ডান দরজা দিয়ে প্রবেশ করান।

(গ) যাদের নেক আমল ও বদ আমল এক সমান হয়ে যাবে তাদের ক্ষেত্রে তাঁর শাফাআত। তিনি তাদের জন্য জান্নাতে প্রবেশ করার সুপারিশ করবেন।

(ঘ)জান্নাতে প্রবেশকারী লোকদের জন্য তাদের সম্পাদিত আমলের দাবী ও চাহিদার থেকে আরো উচ্চ মাকাম দানের জন্য তাঁর শাফাআত।

(ঙ) স্বীয় চাচা আবু তালেবের আযাব লঘূ করার জন্য তাঁর শাফাআত।

(চ)সকল মুমিনদের জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি প্রদান করার জন্য তাঁর শাফাআত।

১৫৫
২-নবীসহ অন্য সকল নবী, ফেরেশতা ও মুমিন- সকলের জন্য উন্মোক্ত শাফাআত:
আর এ শাফাআতটি প্রযোজ্য হবে সেসব লোকদের ক্ষেত্রে যারা জাহান্নামের উপযুক্ত হয়ে যাবে তাদের প্রবেশ না করানোর জন্য এবং যারা প্রবেশ করবে তাদের বের করে আনার জন্য।

১-হাদীস

عن أبي هريرة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : (( لكل نبي دعوة مستجابة , فتعجل كل نبي دعوته , وأني اختبأت دعوتي شفاعة لأمتي يوم القيامة فهي نائلة إن شاء الله من مات من أمتي لا يشرك بالله شيئا )). متفق عليه

সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: প্রত্যেক নবীকেই একটি গ্রহণযোগ্য দোআর প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে, তাঁরা প্রত্যেকেই তাঁদের সেই দোআ পৃথিবীতেই সম্পন্ন করে ফেলেছেন। তবে আমি আমার দোআটি কেয়ামতের দিন আমার উম্মতের শাফাআতের জন্য ধরে রেখেছি। আমার উম্মতের যারা আল্লাহর সাথে কোন শরীক-সমকক্ষ স্থির না করে মারা যা,, আল্লাহ চাহেতো সে দোআ তাদের সকলকে স্পর্শ করবে। অর্থাৎ সে দোআর ভাগ তারা সকলেই পাবে। [বর্ণনায় বুখারী (৬৩০৪) ও মুসলিম (১৯৯)।]

২- আল্লাহ তাআলা ফেরেশতা সম্পর্কে বলছেন:

وكم من ملك في السماوات لا تغني شفاعتهم شيئا إلا من بعد أن يأذن الله لمن يشاء ويرضى . { النجم :২৬}

আকাশে অনেক ফেরেশতা রয়েছে। তাদের কোন সুপারিশ ফলপ্রসূ হয় না যতক্ষণ আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছা ও যাকে পছন্দ করেন, অনুমতি না দেন। {সূরা নাজম:২৬}

৩- হাদীসে এসেছে

وعن أبي الدرداء رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : (( يشفع الشهيد في سبعين من أهل بيته )). أخرجه أبو داود .

সাহাবী আবুদ্দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহর রাস্তায় শাহাদত বরণকারী শহীদদের নিজ পরিবারস্থ সত্তর লোকের পক্ষে করা সুপারিশ কবুল করা হবে। [হাদীসটি সহীহ সনদে আবু দাউদে বর্ণিত হয়েছে। হাদীস নং (২৫২২)]

১৫৬
এ শাফাআতের জন্য দু’টি শর্ত আবশ্যক করা হয়েছে:
(১)আল্লাহর পক্ষ থেকে শাফাআত করার অনুমতি। যেমন আল্লাহ বলেন:

من ذا الذي يشفع عنده إلا بإذنه . { البقرة :২৫৫}

কে আছ এমন, যে তাঁর কাছে তাঁর অনুমতি ছাড়া সুপারিশ করবে।{সূরা বাকারা:২৫৫}

(২) শাফাআতকারী এবং যার জন্য শাফাআত করা হবে উভয়ের প্রতি আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করছেন:

وكم من ملك في السماوات لا تغني شفاعتهم شيئا إلا من بعد أن يأذن الله لمن يشاء ويرضى . { النجم :২৬}

আকাশে অনেক ফেরেশতা রয়েছে। তাদের কোন সুপারিশ ফলপ্রসূ হয় না যতক্ষণ আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছা ও যাকে পছন্দ করেন, অনুমতি না দেন। {সূরা নাজম:২৬}

কাফেরের পক্ষে কোন সুপারিশ হবে না। সে চিরস্থায়ী ভাবে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। তার পক্ষে কেউ সুপারিশ করলেও সেটি ফলপ্রসূ হবে না। এসব অপরাধী সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন:

فما تنفعهم شفاعة الشافعين .{ المدثر :৪৮}

অতএব সুপারিশকারীদের সুপারিশ তাদের কোন উপকারে আসবে না।

{সূরা মুদ্দাস্সির:৪৮}

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাফাআত প্রার্থনা করার বিধান:

নবীজীর শাফাআত কামনাকারী ব্যক্তির জন্য নিম্নোক্ত কাজগুলো সম্পন্ন করা জরুরী। আল্লাহ তাআলার নিকট নবীজীর শাফাআত প্রার্থনা করা। যেমন এভাবে বলতে পারে: হে আল্লাহ তুমি আমাকে তোমার নবীর শাফাআত নসীব কর। পাশাপাশি শাফাআত আবশ্যককারী নেক কাজ অধিক পরিমাণে সম্পাদন করে যাওয়া। যেমন একমাত্র আল্লাহ তাআলর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইবাদত করতে থাকা, নবীজীর উপর বেশি বেশি দরূদ পড়া এবং তাঁর জন্য আল্লাহর নিকট ওসীলা প্রার্থনা করা।

عن أبي هريرة رضي الله عنه أن النبي صلى الله عليه وسلم قال : (( أسعد الناس بشفاعتي يوم القيامة من قال لا إله إلا الله خالصا من قلبه أو نفسه )). أخرجه البخاري

বিশিষ্ট সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: কেয়ামতের দিন আমার সুপারিশ পেয়ে সবচে ভাগ্যবান ব্যক্তি হচ্ছে, যারা খাঁটি মনে এ স্বীকৃতি প্রদান করেছে যে, আল্লাহ তাআলা ব্যতীত আর কোন সত্যিকার উপাস্য নেই))। [বুখারী (৯৯)।]

১৫৭
প্রতিদান স্থান:
দুনিয়া হচ্ছে আমল তথা কর্মশালা আর আখেরাত হচ্ছে প্রতিদান (প্রদান ও প্রাপ্তির) আবাস। তবে স্থায়ী আবাস তথা জান্নাত কিংবা জাহান্নামে প্রবেশের পূর্বে আমল ও প্রশ্নের সমাপ্তি হবে না। বরং চলতে থাকবে। সেটি কবরের বরযখী জীবনে হোক বা কেয়ামতের ময়দানে। যেমন কবরে মাইয়্যেতকে মুনকার নকীর-ফেরেশতাদ্বয়ের প্রশ্ন, কেয়ামত দিবসে সকল মানুষকে সেজদা করার নির্দেশ, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও যারা নবী আগমনের পূর্বে মারা গেছে তাদের পরীক্ষা ইত্যাদি। অত:পর আল্লাহ তাআলা বান্দাদের মাঝে তাদের ঈমান ও আমল অনুপাতে ফায়সালা করবেন। একদল যাবে জান্নাতে অপরটি জাহান্নামে।

১-মহান আল্লাহ তাআলা বলেন:

وَكَذَلِكَ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ قُرْآَنًا عَرَبِيًّا لِتُنْذِرَ أُمَّ الْقُرَى وَمَنْ حَوْلَهَا وَتُنْذِرَ يَوْمَ الْجَمْعِ لَا رَيْبَ فِيهِ فَرِيقٌ فِي الْجَنَّةِ وَفَرِيقٌ فِي السَّعِيرِ الشورى :৭}

এমনিভাবে আমি আপনার প্রতি আরবী ভাষায় কোরআন নাযিল করেছি, যাতে আপনি মক্কা ও তার আশ-পাশের লোকদের সতর্ক করেন এবং সতর্ক করেন সমাবেশের দিন সম্পর্কে, যাতে কোন সন্দেহ নেই। একদল যাবে জান্নাতে এবং অপর একদল জাহান্নামে। {সূরা শূরা:৭}

২-অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

الْمُلْكُ يَوْمَئِذٍ لِلَّهِ يَحْكُمُ بَيْنَهُمْ فَالَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ فِي جَنَّاتِ النَّعِيمِ ﴿56﴾ وَالَّذِينَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا بِآَيَاتِنَا فَأُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُهِينٌ ﴿57﴾ { الحج :৫৬-৫৭}

রাজত্ব সেদিন আল্লাহরই, তিনিই তাদের বিচার করবেন। অতএব যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম সম্পাদন করে তারা নেয়ামতপূর্ন জান্নাতে থাকবে। আর যারা কুফরী করে এবং আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যা বলে তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর শাস্তি।

{সূরা হজ্ব:৫৬-৫৭}

৩-আল্লাহ তাআলা আরও বলেন:

وَيَوْمَ تَقُومُ السَّاعَةُ يَوْمَئِذٍ يَتَفَرَّقُونَ ﴿14﴾ فَأَمَّا الَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ فَهُمْ فِي رَوْضَةٍ يُحْبَرُونَ ﴿15﴾ وَأَمَّا الَّذِينَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا بِآَيَاتِنَا وَلِقَاءِ الْآَخِرَةِ فَأُولَئِكَ فِي الْعَذَابِ مُحْضَرُونَ ﴿16﴾ { الروم :১৪-১৬}

যেদিন কেয়ামত সঙ্ঘটিত হবে, সেদিন মানুষ বিভক্ত হয়ে পড়বে। যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম সম্পাদন করেছে তারা জান্নাতে সমাদৃত হবে। আর যারা কাফের এবং আমার আয়াতসমূহ ও পরকালের সাক্ষাতকারকে মিথ্যা বলছে, তাদেরকেই আযাবের মধ্যে উপস্থিত করা হবে।{সূরা রূম:১৪-১৬}

১৫৮
জান্নাতের বিবরণ
জান্নাত হচ্ছে শান্তির আবাস, সুখের ঠিকানা যা মহান আল্লাহ পরকালীন জীবনে মুমিন নর-নারীদের থাকার জন্য প্রস্ত্তত করেছেন।

জান্নাত সম্পর্কিত আমাদের এ আলোচনায় মূলত: এ বিষয়ে বর্ণিত কুরআনের আয়াত ও সহীহ হাদীসের আলোকে একটু বিন্যস্ত করে বলার চেষ্টা করা হয়েছে মাত্র। যেমন, এ জান্নাত ও তার নেয়ামতসমূহের সৃষ্টি কর্তা কে? আর তিনি হচ্ছেন সেই মহান রাববুল আলামীন আল্লাহ, যার রহমতের উপর ভিত্তি করে টিকে আছে এ বিশ্ব। আরো আলোচনা করা হয়েছে: সর্ব প্রথম জান্নাতে কে প্রবেশ করবেন? কার পায়ের পবিত্র স্পর্শে জান্নাত ধন্য হয়েছে? আর তিনি হচ্ছে সৃষ্টি সেরা মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

১৫৯
জান্নাতের কতিপয় প্রসিদ্ধ নাম:
মৌলিকত্বের দিক থেকে জান্নাত একটিই তবে বৈশিষ্ট ও গুণাগুণের দিক থেকে সেটি একাধিক। আর এ বিভিন্নতার কারণে তার নামও হয়েছে একাধিক। এ পর্যায়ে আমরা জান্নাতের কিছু প্রসিদ্ধ নাম উল্লেখ করব।

১- জান্নাত:

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করছেন:

وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ { النساء : ১৩}

যারা আল্লাহ ও রাসূলের আদেশ মত চলবে, তিনি তাদেরকে এমন জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যেগুলোর তলদেশ দিয়ে স্রোতাস্বিনী প্রবাহিত হবে। তারা সেখানে চিরকাল থাকবে। সেটি বিরাট সাফল্য। {সূরা নিসা:১৩}

২- জান্নাতুল ফেরদাউস:

আল্লাহ তাআলা বলেন:

إن الذين آمنوا وعملوا الصالحات كانت لهم جنات الفردوس نزلا . { الكهف :১০৭}

নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম সম্পাদন করেছে তাদের অভ্যর্থনার জন্য রয়েছে জান্নাতুল ফেরদাউস। {সূরা কাহফ:১০৭}

৩- জান্নাতু আদন:

ইরশাদ হচ্ছে:

هَذَا ذِكْرٌ وَإِنَّ لِلْمُتَّقِينَ لَحُسْنَ مَآَبٍ ﴿49﴾ جَنَّاتِ عَدْنٍ مُفَتَّحَةً لَهُمُ الْأَبْوَابُ ﴿50﴾ {ص: ৪৯-৫}

এ এক মহা আলোচনা। তাকওয়া অবলম্বনকারীদের জন্য রয়েছে উত্তম ঠিকানা-জান্নাতু আদন তথা স্থায়ী বসবাসের জান্নাত; তাদের জন্য তার দরজাসমূহ রয়েছে উন্মুক্ত। {সূরা স্বদ:৪৯-৫০}

৪- জান্নাতুল খুলদ:

ইরশাদ হচ্ছে:

قُلْ أَذَلِكَ خَيْرٌ أَمْ جَنَّةُ الْخُلْدِ الَّتِي وُعِدَ الْمُتَّقُونَ كَانَتْ لَهُمْ جَزَاءً وَمَصِيرًا { الفرقان :১৫}

বল, এটা উত্তম না জান্নাতুল খুলদ-চিরকাল বসবাসের জান্নাত। যার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে মুত্তাকীদের? সেটা হবে তাদের প্রতিদান ও প্রত্যাবর্তন স্থল। {সূরা ফুরকান:১৫}

৫- জান্নাতুন না‘য়ীম:

আল্লাহ তাআলা বলেন:

إن الذين آمنوا و عملوا الصالحات لهم جنت النعيم . { لقمان :৮}

যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল সম্পাদন করে তাদের জন্য রয়েছে জান্নাতুন না‘য়ীম তথা নিয়ামতপূর্ণ জান্নাত। { সূরা লোকমান:৮}

৬- জান্নাতুল মাওয়া:

ইরশাদ হচ্ছে:

أما الذين آمنوا و عملوا الصالحات فلهم جنات المأوى نزلا بما كانوا يعملون .{ السجدة :১৯}

যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম সম্পাদন করে তাদের জন্য রয়েছে তাদের কৃতকর্মের প্রতিদান স্বরূপ জান্নাতুল মাওয়া।এটি আতিথীয়তার আঙ্গিকে তাদের প্রদান করা হবে।

{সূরা সাজদাহ: ১৯}

৭- দারুস সালাম:

আল্লাহ বলেন:

لَهُمْ دَارُ السَّلَامِ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَهُوَ وَلِيُّهُمْ بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ { الأنعام :১২৭}

তাদের জন্য রয়েছে তাদের প্রতিপালকের নিকট দারুস সালাম তথা শান্তি নিকেতন। আর তাদের কর্মের কারণে তিনিই হচ্ছেণ তাদের অভিভাবক। {সূরা আনআম:১২৭}

১৬০
জান্নাতের অবস্থান
(১)আল্লাহ তাআলা বলেন:

و في السماء رزفكم و ما توعدون . { الذاريات :২২}

আর আকাশে রয়েছে তোমাদের রিযিক এবং যা কিছুর প্রতিশ্রুতি তোমাদের দেয়া হয়েছে। { সূরা যারিয়াত:২২}

(২) আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলছেন:

ولقد رآه نزلة أخرى عند سدرة المنتهى عندها جنة المأوى . { النجم :১৩-১৫}

নিশ্চয় তিনি তাকে আরেকবার দেখেছিলেন, সিদরাতুল মুনতাহার নিকট, যার নিকট অবস্থিত জান্নাতুল মা’ওয়া। { সূরা নাজম:১৩-১৫}

(৩) হাদীসে এসেছে

عن أبي هريرة رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال : من آمن بالله و رسوله و أقام الصلاة وصام رمضان , كان حقا على الله أن يدخله الجنة هاجر في سبيل الله أو جلس في أرضه التي ولد فيها , قالوا يا رسول الله : أفلا ننبئ الناس بذلك؟ قال : إن في الجنة مائة درجة , أعدها الله للمجاهدين في سبيله , كل درجتين ما بينهما كما بين السماء و الأرض , فإذا سألتم الله فسلوه الفردوس , فإنه أوسط الجنة , و أعلى الجنة , وفوقه عرش الرحمن , ومنه تفجر أنهار الجنة . أخرجه البخاري

সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী করীম সাললাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করছেন, রাসূলুল্লাহ বলেন: যে ব্যক্তি আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমান আনবে, সালাত কায়েম করবে, রমযানের সিয়াম পালন করবে, তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো আল্লাহর দায়িত্ব হয়ে যাবে। সে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় হিজরত করুক বা নিজ জন্মভূমিতে অবস্থান করুক। লোকেরা বলল: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা কি এ বিষয়ে অন্যান্য লোকদের সংবাদ দেব না? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: নিশ্চয় জান্নাতে একশত স্তর রয়েছে, যেগুলো আল্লাহ তাআলা তাঁর রাস্তায় জিহাদকারী -মুজাহিদদের জন্য তৈরী করেছেন। দুই স্তরের মাঝে দূরত্ব হচ্ছে আকাশ-যমীনের মাঝের দূরত্বের সমান। সুতরাং তোমরা যখন আল্লাহর নিকট জান্নাত প্রার্থনা করবে তখন ফিরদাউস প্রার্থনা করবে। কেননা এটি সর্বোচ্চ স্তরের জান্নাত যা জান্নাতের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। তার উপর রয়েছে দয়াময় মহান আল্লাহর আরশ। এবং জান্নাতের স্রোতস্বিনীসমূহ তার থেকেই প্রবাহিত হয়েছে। [বর্ণনায় সহীহ বুখারী হদেীস নং (৭৪২৩)]

(৪)হাদীসে আরো এসেছে

وعن أبي هريرة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : إن المؤمن إذا حضره الموت حضرته ملائكة الرحمة , فإذا قبضت نفسه جعلت في حريرة بيضاء فينطلق بها إلى باب السماء فيقولون ما وجدنا ريحا أطيب من هذه ... أخرجه الحاكم و ابن حبان .

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:মুমিনের মৃত্যু সময় উপস্থিত হলে রহমতের ফেরেশতাবৃন্দ উপস্থিত হয়। অত:পর তার জান কবজ করা হলে তাকে শুভ্র রেশমী কাপড়ে রাখা হয় এবং আকাশের দরজাপানে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন তারা বলাবলি করে , আমরা এর চেয়ে উন্নত সুঘ্রাণ আর কখনো পাইনি...। [হাদীসটি সহীহ , বর্ণনায় হাকেম (১৩০৪) এবং ইবনে হিববান (৩০১৩)।মুহাদ্দিস আরনাউত বলেন: এ হাদীসের সনদ সহীহ।]

১৬১
জান্নাতের প্রবেশদারসমূহের নাম:
عن أبي هريرة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : من أنفق زوجين في سبيل الله , نودي من أبواب الجنة . يا عبد الله , هذا خير , فمن كان من أهل الصلاة دعي من باب الصلاة و من كان من أهل الجهاد ععي من باب الجهاد , ومن كان من أهل الصيام دعي من باب الريان ومن كان من أهل الصدقة دعي من باب الصدقة . فقال أبو بكر رضي الله عنه : بأبي أنت و أمي يا رسول الله , ما على من دعي من تلك الأبواب من ضرورة , فهل يدعى أحد من تلك الأبواب كلها؟ قال : نعم , وأرجو أن تكون منهم . متفق عليه

বিশিষ্ট সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: যে ব্যক্তি দুটি প্রিয় বস্ত্ত আল্লাহর রাস্তায় খরচ করবে, জান্নাতের প্রবেশদার সমূহ থেকে আহবান করা হবে, হে আল্লাহর বান্দা! এটি উত্তম-কল্যাণকর। সুতরাং যে নামাযী হবে, তাকে নামাযের দরজা থেকে আহবান করা হবে। জিহাদে অংশগ্রহণকারী মুজাহিদ কে ডাকা হবে জিহাদের দরজা দিয়ে। সিয়াম পালনকারীকে রাইয়ান নামক দরজা থেকে আহবান করা হবে। দান-সদকাকারী দানবীরকে সদকার দরজা থেকে ডাকা হবে।

আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার পিতা মাতা আপনার তরে উৎসর্গ হোক। উপরোক্ত সকল দরজা দিয়ে একজনকে ডাকা আবশ্যক নয়। তবুও এমন কেউকি আছে? যাকে প্রত্যেক দরজা দিয়ে ডাকা হবে? নবীজী বললেন: হ্যাঁ, আর আমি আশা করছি তুমিও হবে তাদের একজন। [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং যথাক্রমে (১৮৯৭) ও (১০২৭)।]

১৬২
জান্নাতের দরজাসমূহের প্রশস্ততা:
(১) হাদীসে এসেছে

عن عتبة بن غزوان رضي الله عنه قال : ذكر لنا أن ما بين مصراعين من مصاريع الجنة مسيرة أربعين سنة , وليأتين عليها يوم و هو كظيظ من الزحام . أخرجه مسلم

উতবা বিন গযওয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমাদের বলা হল যে, জান্নাতের দরজার দুই পাল্লার মাঝের দূরত্ব চল্লিশ বছর ভ্রমনপথের দূরত্বের সমান। আর এমন একদিন আসবে যে, ভিড়ের কারণে (মনে হবে)সেটি অতিভোজন করা পেট। [সহীহ মুসলিম। হাদীস নং (২৯৬৭)।]

(২) হাদীসে আরো এসেছে

وعن أبي هريرة رضي الله عنه قال : أتي رسول الله صلى الله عليه وسلم بلحم ... و في آخره قال : والذي نفس محمد بيده إن ما بين المصراعين من مصاريع الجنة لكما بين مكة و هجر أو كما بين مكة و بصرى . متفق عليه

সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট গোশত হাদিয়া আসল... হাদীসের শেষাংশে আছে। রাসূলুল্লাহ বলেন: সে সত্তার শপথ যার হাতে আমার জীবন, নিশ্চয় জান্নাতের দরজার দুই পাল্লার মাঝের দূরত্ব মক্কা ও হাজার অথবা মক্কা ও বসরার মাঝের দূরত্বের সমান। [বর্ণনায় কুখারী (৪৭১২) ও মুসলিম (১৯৪)।]

১৬৩
জান্নাতের প্রবেশদারের সংখ্যা
১- আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করছেন:

وَسِيقَ الَّذِينَ اتَّقَوْا رَبَّهُمْ إِلَى الْجَنَّةِ زُمَرًا حَتَّى إِذَا جَاءُوهَا وَفُتِحَتْ أَبْوَابُهَا وَقَالَ لَهُمْ خَزَنَتُهَا سَلَامٌ عَلَيْكُمْ طِبْتُمْ فَادْخُلُوهَا خَالِدِينَ ﴿73﴾ { الزمر :৭৩}

আর যারা স্বীয় পালনকর্তাকে ভয় করে চলত, তাদেরক দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। যখন তারা জান্নাতের নিকট উপস্থিত হবে ও এব দ্বারসমূহ খুলে দেয়া হবে এবং জান্নাতের রক্ষীরা তাদেরকে বলবে: তোমাদের প্রতি সালাম, তোমরা সুখে থাক, অত:পর সদা সর্বদা বসবাসের জন্য জান্নাতে প্রবেশ কর। {সূরা যুমার :৭৩}

(২) হাদীসে এসেছে

وعن سهل بن سعد رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال : في الجنة ثمانية أبواب , فيها باب يسمى الريان لا يدخله إلا الصائمون . متفق عليه

সাহাবী সাহল বিন সা’দ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: জান্নাতে আটটি দরজা রয়েছে, এর একটির নাম হচ্ছে রাইয়ান। রোযাদাররা ব্যতীত অন্য কেউ এটি দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং যথাক্রমে (৩২৫৭) ও (১১৫২)।]

১৬৪
জান্নাতের দরজাসমূহ জান্নাতবাসীদের জন্য উন্মুক্ত
আল্লাহ তাআলা বলেন:

هَذَا ذِكْرٌ وَإِنَّ لِلْمُتَّقِينَ لَحُسْنَ مَآَبٍ ﴿49﴾ جَنَّاتِ عَدْنٍ مُفَتَّحَةً لَهُمُ الْأَبْوَابُ ﴿50﴾ { ص :৪৯-৫০}

এ এক মহৎ আলোচনা। আর নিশ্চয় আল্লাহভীরুদের জন্য রয়েছে উত্তম ঠিকানা-স্থায়ী বসবাসের জান্নাত, তাদের জন্য তার দ্বার উন্মুক্ত রয়েছে। {সূরা সাদ:৪৯-৫০}

পৃথিবীতে যে সময়গুলোয় জান্নাতের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করা হয় তার বিবরণ:

পৃথিবীতে বিভিন্ন সময় নানা উপলক্ষে জান্নাতের দরজাসমূহ খোলা হয়।এ প্রসঙ্গে আমরা কিছু হাদীস তুলে ধরছি।

عن أبي هريرة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : تفتح أبواب الجنة يوم الإثينين و يوم الخميس فيغفر لكل عبد لا يشرك بالله شيئا إلا رجلا كانت بينه و بين أخيه شحناء , فيقال أنظروا هذين حتى يصطلحا ثلاثا- أخرجه مسلم .

বিশিষ্ট সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: প্রত্যেক সোম ও বৃহ:পতিবার দিন জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয় এবং শিরকমুক্ত সকল বান্দাদের ক্ষমা করে দেয়া হয়। তবে ঐ ব্যক্তি ব্যতীত যার মাঝে ও তার মুসলিম ভাইয়ের মাঝে হিংসা ও শত্রুতা রয়েছে। তাদের সম্পর্কে বলা হয়, এদের আপোস হওয়া পর্যন্ত অবকাশ দাও। এদের আপোস হওয়া পর্যন্ত অবকাশ দাও। এদের আপোস হওয়া পর্যন্ত অবকাশ দাও। [বর্ণনায় মুসলিম। হাদীস নং (২৫৬৫)।]

وعن أبي هريرة رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : إذا دخل رمضان فتحت أبواب الجنة , وغلقت أبواب جهنم , وسلسلت الشياطين . متفق عليه

সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: রমযান মাস উপস্থিত হলে জান্নাতের সব কটি প্রবেশদ্বার উন্মুক্ত করে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের সবকটি দরজা বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং বুখারী (৩২৭৭) ও মুসলিম (১০৭৯)।]

(৩)

وعن عمر بن الخطاب رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : ما منكم من أحد يتوضأ فيبلغ ( أو فيسبغ ) الوضوء , ثم يقول أشهد أن لا إله إلا الله وأن محمد عبد الله و رسوله إلا فتحت له أبواب الجنة الثمانية يدخل من أيها شاء . أخرجه مسلم

আমীরুল মুমিনীন উমর বিন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: তোমাদের যে কেউ খুব ভালভাবে ওযু করে এ দুআটি পড়বে যে, أشهد أن لا إله إلا الله وأن محمد عبد الله و رسوله জান্নাতের আটটি দরজাই তার জন্য উন্মুক্ত হয়ে যাবে। যে দরজা দিয়েই সে চাইবে প্রবেশ করতে পারবে। [বর্ণনায় সহীহ মুসলিম । হাদীস নং (২৩৪)।]

১৬৫
জান্নাতে প্রবেশকারী সর্বপ্রথম ব্যক্তি:
عن أنس رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : آتي باب الجنة يوم القيامة فأستفتح , فيقول الخازن : من أنت؟ فأقول : محمد , فيقول : بك أمرت لا أفتح لأحد قبلك . أخرجه مسلم

বিশিষ্ট সাহাবী আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: কিয়ামতের দিন আমি জান্নাতের প্রবেশদ্বারে এসে দরজা খুলতে বলব। রক্ষী বলবেন: কে আপনি? আমি বলব: মুহাম্মাদ। তখন তিনি বলবেন: আপনার ব্যাপারেই আমি আদিষ্ট হয়েছি যে, আপনার পূর্বে কারো জন্য খুলব না। [বর্ণনায় সহীহ মুসলিম । হাদীস নং (১৯৭)।]

জান্নাতে প্রবেশকারী সর্বপ্রথম উম্মত:

عن أبي هريرة رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : نحن الآخرون الأولون يوم القيامة , ونحن أول من يدخل الجنة . متفق عليه

প্রখ্যাত সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: আমরা সর্বশেষ আগমনকারী কিয়ামতের দিন সর্বাগ্রে উত্থিত হব। এবং আমরাই সর্বাগ্রে জান্নাতে প্রবেশ করব। [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং যথাক্রমে (৮৭৬) ও (৮৫৫)।]

১৬৬
জান্নাতে প্রবেশকারী সর্বপ্রথম দল:
عن أبي هريرة رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : إن أول زمرة يدخلون الجنة على صورة القمر ليلة البدر , ثم الذين يلونهم على أشد كوكب دري في السماء إضاءة , لا يبولون , ولا يتغوطون , ولا يتفلون , ولا يمتخطون , أمشاطهم الذهب , ورشحهم المسك , ومجامرهم الألوة , وأزواجهم الحور العين , على خلق رجل واحد , على صورة أبيهم آدم ستون ذراعا في السماء . متفق عليه

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: সর্বপ্রথম যে দলটি জান্নাতে প্রবেশ করবে তাদের আকৃতি হবে পূর্ণিমা রাতের আলোকোজ্জ্বল চাঁদ সদৃশ। তাদের পরপরই যারা প্রবেশ করবে তাদের অবস্থা হবে আকাশস্থ আলোকোজ্জ্বল নক্ষত্র থেকেও অধিকতর আলোকময়। তারা সেথায় মল-মূত্র ত্যাগ করবে না। থুথু-নাকের শ্লেষা ফেলবে না।(চুল বিন্যস্ত করার) চিরুনী হবে স্বর্ণের। শরীর নির্গত ঘাম হবে মেশক সদৃশ। শরীর নি:সৃত ঘ্রাণ হবে উলুওয়াহ তথা সুতীব্র ঘ্রাণ বিশিষ্ট কাঠ বিশেষ। সঙ্গী হবে কৃষ্ণ ও শুভ্র বর্ণের-ডাগর নয়নাধিকারী হুরবৃন্দ। এক ব্যক্তির আকৃতিতে- তাদের পিতা আদমের আকৃতিতে- আকাশ পানে ষাট গজ। [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম।হাদীস নং বুখারী (৩৩২৭) ও মুসলিম (২৮৩৪)।]

(অর্থাৎ তারা আদম আলাইহিস সালামের মত ষাট গজ বিশিষ্ট লম্বাকৃতির হবে)

وعن سهل بن سعد رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : ليدخلن الجنة من أمتي سبعون ألفا أو سبعمائة ألف متماسكون آخذ بعضهم بعضا , لا يدخل أولهم حتى يدخل آخرهم , وجوههم على صورة القمر ليلة البدر . متفق عليه

সাহাবী সাহল বিন সা’দ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: আমার উম্মতের সত্তর হাজার বা সাত লক্ষ একে অপরকে ধরাধরি করে সমান্তরালভাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। সর্বশেষ জন প্রবেশ করার পূর্বে প্রথমজন প্রবেশ করবে না। এদের চেহারা হবে পূর্ণিমা রাতের ভরা চন্দ্র সদৃশ। [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম।হাদীস নং বুখারী (৬৫৪৩) ও মুসলিম (২১৯)।]

وعن عبد الله بن عمرو رضي الله عنهما قال : سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول : إن فقراء المهاجرين يسبقون الأغنياء يوم القيامة إلى الجنة بأربعين خريفا . أخرجه مسلم .

আব্দুল্লাহ বিন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ইরশাদ করতে শুনেছি, আল্লাহর রাসূল বলেন: নিশ্চয় দরিদ্র মুহাজিরবৃন্দ কিয়ামতের দিন ধনীদের চল্লিশ বছর পূর্বে জান্নাতে প্রবেশ করবে। [বর্ণনায় মুসলিম। হাদীস নং (২৯৭৯)।]

১৬৭
জান্নাতিদের বয়স:
عن معاذ بن جبل رضي الله عنه أن النبي صلى الله عليه وسلم قال : يدخل أهل الجنة الجنة جردا مردا مكحلين أبناء ثلاثين , أو ثلاث و ثلاثين سنة . أخرجه أحمد و الترمذي .

সাহাবী মুআয বিন জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: জান্নাতবাসীরা জান্নাতে প্রবেশ করবে শ্মশ্রুবিহীন, সুরমাবিশিষ্ট নেত্র, ত্রিশ বা তেত্রিশ বছর বয়সের যৌবন অবস্থায়। [হাদীসটি হাসান সনদে বর্ণিত হয়েছে । বর্ণনায় আহমাদ (৭৯২০) ও তিরমিযী (২৫৪৫)।]

১৬৮
জান্নাতবাসীদের মুখাবয়বের বিবরণ:
(১) আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

إِنَّ الْأَبْرَارَ لَفِي نَعِيمٍ ﴿22﴾ عَلَى الْأَرَائِكِ يَنْظُرُونَ ﴿23﴾ تَعْرِفُ فِي وُجُوهِهِمْ نَضْرَةَ النَّعِيمِ ﴿24﴾ { المطففين :22-24}

নিশ্চয় সৎকর্মশীল নেকবান্দাগন থাকবে পরম আরামে। সিংহাসনে বসে অবলোকন করবে। তুমি তাদের মুখাবয়বে স্বাচ্ছন্দের সজীবতা দেখতে পাবে। {সূরা আল মুতাফফিফীন:২২-২৪}

(২) আল্লাহ তাআলা আরো বলেন:

وُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ نَاضِرَةٌ ﴿22﴾ إِلَى رَبِّهَا نَاظِرَةٌ ﴿23﴾ { القيامة :২২-২৩}

সে দিন অনেক মুখমন্ডল উজ্জ্বল হবে, তারা তাদের পালনকর্তার দিকে তাকিয়ে থাকবে।{সূরা কিয়ামাহ:২২-২৩}

(৩) আরো ইরশাদ হচ্ছে:

وُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ نَاعِمَةٌ ﴿8﴾ لِسَعْيِهَا رَاضِيَةٌ ﴿9﴾ فِي جَنَّةٍ عَالِيَةٍ ﴿10﴾ { الغاشية :৮-১০}

অনেক মুখমন্ডল সেদিন হবে সজীব, তাদের কর্মের কারণে সন্তুষ্ট। তারা থাকবে সুউচ্চ জান্নাতে। {সূরা গাশিয়াহ:৮-১০}

(৪) অনত্র ইরশাদ হচ্ছে:

وُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ مُسْفِرَةٌ ﴿38﴾ ضَاحِكَةٌ مُسْتَبْشِرَةٌ ﴿39﴾ { عبس :৩৮-৩৯}

অনেক মুখমন্ডল সেদিন হবে উজ্জ্বল, সহাস্য ও প্রফুল্ল। {সূরা আবাসা:৩৮-৩৯}

(৫) আরো ইরশাদ হচ্ছে:

وَأَمَّا الَّذِينَ ابْيَضَّتْ وُجُوهُهُمْ فَفِي رَحْمَةِ اللَّهِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ ﴿107﴾ { آل عمران :107}

আর যাদের মুখ উজ্জ্বল হবে, তারা থাকবে রহমতের মাঝে, তাতে তারা অনন্তকাল অবস্থান করবে।{সূরা আলে ইমরান:১০৭}

وعن أبي هريرة رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم : أول زمرة تدخل الجنة على صورة القمر ليلة البدر , والذين على آثارهم كأحسن كوكب دري في السماء إضاءة قلوبهم على قلب رجل واحد , لا تباغض بينهم و لا تحاسد . متفق عليه

সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:জান্নাতে প্রবেশকারী প্রথম দলটি পূর্ণিমা রাতের আলোকদ্ভাসিত চাঁদের আকৃতি নিয়ে প্রবেশ করবে। এর পরপরই যারা প্রবেশ করবে তারা হবে আকাশস্থ আলোকজ্জ্বল নক্ষত্র থেকেও অধিক আলোকময়।( হৃদ্যতা ও ভালবাসায়) তারা হবে অভিন্ন হৃদয় সম্পন্ন। তাদের মাঝে কোন বিদ্বেষ ও শত্রুতা থাকবে না। [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং যথাক্রমে (৩২৫৪) ও (২৮৩৪)।]

১৬৯
জান্নাতীদের অভ্যর্থনার বিবরণ:
(১) আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

وَسِيقَ الَّذِينَ اتَّقَوْا رَبَّهُمْ إِلَى الْجَنَّةِ زُمَرًا حَتَّى إِذَا جَاءُوهَا وَفُتِحَتْ أَبْوَابُهَا وَقَالَ لَهُمْ خَزَنَتُهَا سَلَامٌ عَلَيْكُمْ طِبْتُمْ فَادْخُلُوهَا خَالِدِينَ ﴿73﴾ { الزمر :৭৩}

যারা স্বীয় পালনকর্তাকে ভয় করে চলত তাদেরকে দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। যখন তারা উন্মুক্ত দরজা দিয়ে জান্নাতে পৌঁছাবে এবং জান্নাতের রক্ষীরা বলবে, তোমাদের প্রতি সালাম, তোমরা সুখে থাক, অত:পর সর্বদা বসবাসের জন্য জান্নাতে প্রবেশ কর। {সূরা যুমার:৭৩}

(২) আরো ইরশাদ হচ্ছে:

وَالْمَلَائِكَةُ يَدْخُلُونَ عَلَيْهِمْ مِنْ كُلِّ بَابٍ ﴿23﴾ سَلَامٌ عَلَيْكُمْ بِمَا صَبَرْتُمْ فَنِعْمَ عُقْبَى الدَّارِ ﴿24﴾ { الرعد :২৩-২৪}

ফেরেশতারা তাদের কাছে আসবে প্রত্যেক দরজা দিয়ে। বলবে: তোমাদের ধৈর্যের কারণে তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। আর তোমাদের এ পরিণাম গৃহ কতইনা চমৎকার। {সূরা রা’দ:২৩-২৪}

(৩) অন্যত্র ইরশাদ হচেছ:

لَا يَحْزُنُهُمُ الْفَزَعُ الْأَكْبَرُ وَتَتَلَقَّاهُمُ الْمَلَائِكَةُ هَذَا يَوْمُكُمُ الَّذِي كُنْتُمْ تُوعَدُونَ ﴿103﴾{ الأنبياء :১০৩}

মহাত্রাস তাদেরকে চিন্তান্বিত করবে না এবং ফেরেশতারা তাদেরকে অভ্যর্থনা জানাবে। বলবে: আজ তোমাদের দিন, যে দিনের প্রতিশ্রুতি তোমাদের দেয়া হয়েছিল। {সূরা আম্বিয়া:১০৩}

১৭০
যারা কোনরূপ হিসাব ও শাস্তি ব্যতীতই জান্নাতে প্রবেশ করবে:
عن ابن عباس رضي الله عنهما قال : قال النبي صلى الله عليه وسلم : عرضت على الأمم , فأجد النبي يمر معه الأمة , والنبي يمر معه النفر , والنبي يمر معه العشرة , والنبي يمر معه الخمسة , والنبي يمر وحده , فنظرت فإذا سواد كثير , قلت : يا جبريل , هؤلاء أمتي؟ قال : لا , ولكن انظر إلى الأفق , فنظرت فإذا سواد كثير , قال : هؤلاء أمتك , و هؤلاء سبعون ألفا قدامهم لا حساب عليهم و لا عذاب , قلت : ولم؟ قال : كانوا لا يكتون , ولا يسترقون , ولا يتطيرون , وعلى ربهم يتوكلون . متفق عليه

বিশিষ্ট সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: সকল উম্মতকে আমার সামনে পেশ করা হল, আমি একজন নবীকে (দেখতে) পেলাম তাঁর সাথে সাথে একটি দল চলছে। অন্য একজনকে দেখলাম তাঁর সাথে একটি ছোট দল। আরেকজনকে দেখলাম তাঁর সাথে দশজনের একটি দল। অন্য একজনকে দেখলাম তাঁর সাথে পাঁচ জনের একটি দল। একজনকে দেখলাম তাঁর সাথে কেউ নেই তিনি একাকী চলেছেন। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি বিপুল সংখ্যক লোকের একটি দল। আমি বললাম: জিবরীল! এরা কি আমার উম্মত? তিনি বললেন: না। তবে উপরে তাকিয়ে দেখুন। দেখলাম, তার চেয়ে বহু লোকের একটি বিশাল জামাত। জিবরীল বললেন: এরাই আপনার উম্মত। আর তাদের সামনে যে সত্তর হাজারের দলটি; তাদের কোন হিসাব হবে না এবং কোনরূপ শাস্তি ও না। আমি জানতে চাইলাম: কেন? এর কারণ কি? উত্তরে বললেন: তারা সেঁকের মাধ্যমে শরীর দগ্ধ করত না। ঝাঁড়-ফুকের দ্বারস্থ হতো না। তিয়ারা তথা পাখির মাধ্যমে শুভাশুভ নির্ধারণ করত না এবং একমাত্র স্বীয় পালনকর্তা আল্লাহর উপরই ভরসা করত। [বর্ণনায় বৃখারী হাদীস নং (৬৫৪১) ও মুসলিম হাদীস নং (২২০)।]

وعن أبي أمامة رضي الله عنه قال : سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول : وعدني ربي سبحانه أن يدخل الجنة من أمتي سبعون ألفا لا حساب عليهم , ولا عذاب , مع كل ألف سبعون ألفا , وثلاث حثيات من حثيات ربي عز وجل . أخرجه الترمذي و ابن ماجة .

আবু উমামাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি: আমার পালনকর্তা আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, আমার উম্মতের সত্তর হাজার লোককে হিসাব ও আযাব ছাড়াই জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। এদের প্রত্যেক হাজারের সাথে আরো সত্তর হাজার থাকবে। এবং আমার পালনকর্তার নিজ আঁজলার তিন আঁজলা। [হাদীসটি সহীহ সনদে ইমাম তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ বর্ণনা করেছেন। হাদীস নং তিরমিযী (২৪৩৭) ও ইবনে মাজাহ (৪২৮৬)।]

১৭১
জান্নাতের ভূমি ও প্রাসাদের বিবরণ:
عن أنس رضي الله عنه أن النبي صلى الله عليه وسلم لما عرج به إلى السماء قال : (( ... ثم انطلق حتى أتى بي السدرة المنتهى , فغشيها ألوان لا أدري ما هي , ثم أدخلت الجنة , فإذا فيها جنابد الؤلؤ , وإذا ترابها المسك )). متفق عليه

আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে যখন মি’রাজের সময় আকাশে উঠিয়ে নেয়া হল, সে প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন: ... অত:পর তিনি সামনে অগ্রসর হলেন। এক পর্যায়ে আমাকে সিদরাতুল মুনতাহাতে নিয়ে আসা হল। আসামাত্র তাকে কিছু রং আচ্ছাদিত করে নিল। সেগুলো কি জিনিস সে সম্পর্কে মূলত: আমার জানা নেই। এর পর আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হল, জান্নাতে এসে আমি মণি-মুক্তা দ্বারা নির্মিত অনেক গম্বুজ দেখতে পেলাম। আর জান্নাতের মাটিকে দেখলাম যে, সেটি মিশক। [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম। বুখারী হাদীস নং (৩৩৪২) ও মুসলিম (১৬৩)।]

وعن أبي هريرة رضي الله عنه قال : قلنا يا رسول الله ... الجنة ما بناؤها؟ قال : لبنة من فضة , ولبنة من ذهب , وملاطها المسك الأذفر , وحصباؤها اللؤلؤ و الياقوت , وتربتها الزعفران , من دخلها ينعم ولا يبأس , ويخلد ولا يموت , لا تبلى ثيابهم ولا يفنى شبابهم . أخرجه الترمذي و الدارمي .

সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : আমরা বললাম: ইয়া রাসূলাল্লাহ ... জান্নাতের অট্টালিকা ও প্রাসাদ কেমন? রাসূলুল্লাহ বললেন: একটি ইট রূপার, অপরটি স্বর্ণের, সিমেন্ট ও প্লাষ্টার হচ্ছে মেশক, কঙ্কর হচ্ছে মণি-মুক্তা ও ইয়াকুত এবং মাটি হচ্ছে জাফরান। যে তাতে প্রবেশ করবে সুখী জীবন যাপন করবে কখনো দূর্দশাগ্রস্ত হবে না। চিরঞ্জীব ও শ্বাশত জীবন লাভ করবে কখনো মৃত্যু হবে না। তাদের পোশাক কখনো পুরাতন হবে না এবং যৌবন শেষ হবে না। [বর্ণনায় তিরমিযী (২৫২৬)ও দারামী (২৭১৭)। হাদীসের সনদ সহীহ।]

وعن أبي سعيد رضي الله عنه أن ابن صياد سأل النبي صلى الله عليه عن تربة الجنة؟ فقال : درمكة بيضاء , مسك خالص . أخرجه مسلم .

সাহাবী আবু সাঈদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করছেন: ইবনে সাইয়াদ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জান্নাতের মাটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল: তিনি বললেন: অতি শুভ্র নিখুত মেশক। [বর্ণনায় সহীহ মুসলিম । হাদীস নং ( ২৯২৮)।]

১৭২
জান্নাতবাসীদের তাঁবুর বিবরণ:
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

حُورٌ مَقْصُورَاتٌ فِي الْخِيَامِ ﴿72﴾ { الرحمن :৭২}

তাঁবুতে অবস্থানকারী হুরবৃন্দ। {সূরা আর রাহমান:৭২}

হাদীসে এসেছে

وعن عبد الله بن قيس رضي الله عنه أن النبي صلى الله عليه وسلم قال : إن للمؤمن في الجنة لخيمة من لؤلؤ واحدة مجوفة , طولها ستون ميلا , للمؤمن فيها أهلون , يطوف عليهم المؤمن , فلا يرى بعضهم بعضا . متفق عليه

সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন কায়স রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, নিশ্চয় জান্নাতে মুমিনের জন্য খালী ও প্রশস্ত পেট বিশিষ্ট একটি মুক্তা দ্বারা নির্মিত তাঁবু হবে, তার দৈর্ঘ হবে ষাট মাইল। সেখানে মুমিনের পরিজনরা থাকবে, মুমিনরা তাদের কাছে আসা-যাওয়া করবে, তাদের একে অপরকে দেখবে না। [বর্ণনায় বুখারী (৪৮৭৯) ও মুসলিম (২৮৩৮)।]

১৭৩
জান্নাতের মেলা ও বাজার:
عن أنس بن مالك رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : إن في الجنة لسوقا يأتونها كل جمعة , فتهب ريح الشمال , فتحثو في وجوههم وثيابهم فيزدادون حسنا وجمالا , فيرجعون إلى أهليهم وقد ازدادوا حسنا وجمالا , فيقولون لهم أهلوهم : والله , لقد ازددتم بعدنا حسنا وجمالا , فيقولون : وأنتم والله , لقد ازددتم بعدنا حسنا وجمالا . أخرجه مسلم .

আনাস বিন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: নিশ্চয় জান্নাতে একটি বাজার রয়েছে, প্রত্যেক জুমুআর দিন জান্নাতবাসীরা তাতে সমবেত হবেন। তখন এক প্রকার উত্তরে বায়ূ প্রবাহিত হয়ে তাদের চেহারা ও পোশাকে ছড়িয়ে পড়বে। এতে তাদের রূপ-সৌন্দর্য বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। এরপর উক্ত সৌন্দর্য নিয়ে স্বীয় স্ত্রী ও পরিজনদের নিকট ফিরে গেলে তারা বলবে: আল্লাহর শপথ: তোমরা আমাদের কাছ থেকে যাওয়ার পর তোমাদের রূপ-সৌন্দর্য অনেকগুণে বেড়ে গিয়েছে। তখন তারা বলবে: তোমাদের -আল্লাহর কসম- রূপ-সৌন্দর্যও বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। [বর্ণনায় মুসলিম। হাদীস নং (২৮৩৩)।]

১৭৪
জান্নাতের অট্টালিকা:
মহান আল্লাহ তাআলা জান্নাতাভ্যন্তরে চিত্তাকর্ষক ও দৃষ্টি নন্দন অনেক প্রাসাদ ও বালাখানা প্রস্ত্তত করে রেখেছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন:

وَعَدَ اللَّهُ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِي جَنَّاتِ عَدْنٍ وَرِضْوَانٌ مِنَ اللَّهِ أَكْبَرُ ذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ ﴿72﴾ { التوبة :72}

আল্লাহ তাআলা ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জান্নাতের যার তলদেশে প্রবাহিত হবে প্রসবন। তারা সেগুলোর মাঝে থাকবে চিরকাল। আর এসব জান্নাতে থাকবে উত্তম-পরিচ্ছন্ন থাকার ঘর। বস্ত্তত এ সমুদয়ের মাঝে সবচেয়ে বড় হল আল্লাহর সন্তুষ্টি । এটিই হল মহান কৃতকার্যতা। {সূরা তাওবা:৭২}

১৭৫
অট্টালিকার দিক থেকে জান্নাতবাসীদের মর্যাদাগত তারতম্য:
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

وَإِذَا رَأَيْتَ ثَمَّ رَأَيْتَ نَعِيمًا وَمُلْكًا كَبِيرًا { الإنسان : ২০}

তুমি যখন সেখানে দেখবে, তখন নেয়ামতরাজি ও বিশাল রাজ্য দেখতে পাবে। {সূরা ইনসান:২০}

وعن أبي سعيد الخدري رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : إن أهل الجنة ليتراءون أهل الغرف من فوقهم , كما تتراءون الكوكب الدري الغابر من الأفق من المشرق أو المغرب لتفاضل ما بينهم , قالوا يا رسول الله : تلك منازل الأنبياء لا يبلغها غيرهم قال : بلى , والذي نفسي بيده , رجال آمنوا بالله وصدقوا المرسلين . متفق عليه

সহাবী আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: নিশ্চয় জান্নাত বাসীরা তাদের উপরে কিছু বিশেষ কামরা বাসীদের দেখতে পাবে যেমন তোমরা পূর্ব বা পশ্চিম দিগন্তে অস্তগামী উজ্জ্বল নক্ষত্রকে দেখতে পাও। এরূপ ব্যবধান তাদের মাঝে মর্যাদাগত তারতম্যের কারণে হবে। উপস্থিত সাহাবারা বললেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! সেগুলোতো নবীদের ঘর যাতে অন্যরা পৌছতে পারবে না। নবীজী বললেন: হ্যাঁ, কসম সে সত্তার, যার হাতে আমার প্রাণ, তাঁরা হচ্ছেন সে সকল লোক যারা মহান আল্লাহ তাআলার প্রতি ঈমান এনেছে এবং নবী-রাসূলদের সত্যবলে স্বীকৃতি দিয়েছে। [বর্ণনায় বুখারী (৩২৫৬) ও মুসলিম (২৮৩১)।]

১৭৬
জান্নাতবাসীদের ঘরের বিবরণ:
মহান আল্লাহ তাআলা জান্নাতবাসীদের জন্য বিশেষ নির্মাণ শৈলীতে নির্মিত বিভিন্ন ধরণের ঘর তৈরী করে রেখেছেন। মর্যাদার উচ্চ শিখরে উন্নীত মুমিনবান্দাদের পুরস্কার স্বরূপ তা বরাদ্দ দেবেন। সে সব ঘর সম্বন্ধে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন:

وَالَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَنُبَوِّئَنَّهُمْ مِنَ الْجَنَّةِ غُرَفًا تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا نِعْمَ أَجْرُ الْعَامِلِينَ ﴿58﴾ { العنكبوت :৫৮}

যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম সম্পাদন করে , আমি অবশ্যই তাদেরকে জান্নাতের সুউচ্চ প্রাসাদে স্থান দেব। যার তলদেশে প্রস্রবনসমূহ প্রবাহিত।সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। কতইনা উত্তম পুরস্কার সৎকর্মশীলদের।{ সূরা আল আনকাবূত: ৫৮}

لَكِنِ الَّذِينَ اتَّقَوْا رَبَّهُمْ لَهُمْ غُرَفٌ مِنْ فَوْقِهَا غُرَفٌ مَبْنِيَّةٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ وَعْدَ اللَّهِ لَا يُخْلِفُ اللَّهُ الْمِيعَادَ ﴿20﴾ { الزمر :২০}

কিন্তু যারা স্বীয় পালনকর্তাকে ভয় করে চলে তাদের জন্য নির্মিত রয়েছে প্রাসাদের উপর প্রাসাদ, এগুলোর তলদেশে নদী প্রবাহিত।এটি আল্লাহর প্রতিশ্রুতি , আল্লাহ প্রতিশ্রুতির ব্যতিক্রম করেন না। {সূরা যুমার:২০}

وعن علي رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : إن في الجنة غرفا ترى ظهورها من بطونها , و بطونها من ظهورها , فقام أعرابي فقال : لمن هي يا رسول الله ؟ قال : لمن أطاب الكلام , وأطعم الطعام , وأدام الصيام , وصلى بالليل والناس نيام . أخرجه أحمد و الترمذي .

আমীরুল মুমিনীন আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন: নিশ্চয়ই জান্নাতে এমনকিছু ঘর আছে যেগুলোর বাহির থেকে ভেতর এবং ভেতর থেকে বাহির দেখা যাবে। সেখানে উপস্থিত জনৈক বেদুঈন সাহাবী দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ! ঐ ঘরগুলো কাদের জন্য নির্মিত? নবীজী বললেন: যারা ভাল ভাল কথা বলে, অপরকে অন্নদান করে, সব সময় রোযা রাখে এবং রাতে মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন সালাত আদায় করে। [হাদীসটি হাসান সূত্রে ইমাম আহমাদ ও তিরমিযী বর্ণনা করেছেন। হাদীস নং আহমাদ (১৩৩৮) ও তিরমিযী (১৯৮৪)।]

১৭৭
জান্নাত বাসীদের বিছানার বিবরণ:
মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

مُتَّكِئِينَ عَلَى فُرُشٍ بَطَائِنُهَا مِنْ إِسْتَبْرَقٍ ﴿54﴾ { الرحمن :৫৪}

তারা সেখানে রেশমের আস্তর বিশিষ্ট বিছানায় হেলান দিয়ে বসবে।{সূরা আর রাহমান:৫৪}

১৭৮
গালিচা ও তাকিয়ার বিবরণ:
(১)মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করছেন:

وَنَمَارِقُ مَصْفُوفَةٌ ﴿15﴾ وَزَرَابِيُّ مَبْثُوثَةٌ ﴿16﴾ { الغاشية :১৫-১৬}

এবং সারিসারি তাকিয়া। আর বিস্তৃত বিছানো মখমলের গালিচা।{সূরা গাশিয়া:১৫-১৬}

(২) আরো ইরশাদ হচ্ছে:

مُتَّكِئِينَ عَلَى رَفْرَفٍ خُضْرٍ وَعَبْقَرِيٍّ حِسَانٍ ﴿76﴾ { الرحمن :৭৬}

তারা সবুজ মসনদে এবং মূল্যবান উৎকৃষ্ট বিছানায় হেলান দিয়ে বসবে।{সূরা আর রাহমান:৭৬}

১৭৯
জান্নাতের সিংহাসন:
أرائك (আরাইক) অর্থ: তাকিয়া বিশিষ্ট সিংহাসন।

(১)মহান তাআলা বলেন:

إِنَّ الْأَبْرَارَ لَفِي نَعِيمٍ ﴿22﴾ عَلَى الْأَرَائِكِ يَنْظُرُونَ ﴿23﴾ { المطففين :২২-২৩}

নিশ্চয় সৎ লোকগন থাকবে পরম আরামে। সিংহাসনে বসে অবলোকন করবে। (সূরা তাতফীফ:২২-২৩)

(২) আরো ইরশাদ হচ্ছে:

مُتَّكِئِينَ فِيهَا عَلَى الْأَرَائِكِ لَا يَرَوْنَ فِيهَا شَمْسًا وَلَا زَمْهَرِيرًا ﴿13﴾ { الإنسان :13}

তারা সেখানে সিংহাসনে হেলান দিয়ে বসবে। সেখানে তারা রৌদ্র ও শৈত্য অনুভব করবে না। {সূরা ইনসান:১৩}

(৩) অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

إِنَّ أَصْحَابَ الْجَنَّةِ الْيَوْمَ فِي شُغُلٍ فَاكِهُونَ ﴿55﴾ هُمْ وَأَزْوَاجُهُمْ فِي ظِلَالٍ عَلَى الْأَرَائِكِ مُتَّكِئُونَ ﴿56﴾ { يس :৫৫-৫৬}

নিশ্চয় জান্নাতে অধিবাসীরা এদিন আনন্দে মশগুল থাকবে। তারা এবং তাদের সঙ্গীরা ছায়াময় পরিবেশে সিংহাসনে হেলান দিয়ে উপবিষ্ট থাকবে। { সূরা ইয়াসীন:৫৫-৫৬}

১৮০
জান্নাতবাসীদের খাট ও সিংহাসনের বিবরণ:
(১) মহান আল্লাহ তাআলা বলেন:

وَنَزَعْنَا مَا فِي صُدُورِهِمْ مِنْ غِلٍّ إِخْوَانًا عَلَى سُرُرٍ مُتَقَابِلِينَ ﴿47﴾ { الحجر :৪৭}

তাদের অন্তরে যে ক্রোধ ও বিদ্বেষ ছিল, আমি তা দূর করে দেব।তারা ভাই ভাইয়ের মত সামনা-সামনি আসনে বসবে। {সূরা হিজর:৪৭}

(২) অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

مُتَّكِئِينَ عَلَى سُرُرٍ مَصْفُوفَةٍ وَزَوَّجْنَاهُمْ بِحُورٍ عِينٍ ﴿20﴾ { الطور :২০}

তারা শ্রেণীবদ্ধ সিংহাসনে হেলান দিয়ে বসবে। আমি তাদেরকে আয়তনেত্র বিশিষ্ট হুরদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে দেব। {সূরা আত তূর: ২০}

(৩) আরো ইরশাদ হচ্ছে:

عَلَى سُرُرٍ مَوْضُونَةٍ ﴿15﴾ مُتَّكِئِينَ عَلَيْهَا مُتَقَابِلِينَ ﴿16﴾ { الواقعة :১৫-১৬}

স্বর্ণ খচিত সিংহাসনে। তারা তাতে হেলান দিয়ে বসবে পরস্পর মুখোমুখি হয়ে। {সূরা ওয়াকিয়া:১৫-১৬}

(৪) আরো ইরশাদ হচ্ছে:

فِيهَا سُرُرٌ مَرْفُوعَةٌ ﴿13﴾ { الغاشية :১৩}

তথায় থাকবে উন্নত সুসজ্জিত আসন। {সূরা গাশিয়া:১৩}

১৮১
জান্নাতীদের বাসন-পত্রের বিবরণ:
(১)আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

يَطُوفُ عَلَيْهِمْ وِلْدَانٌ مُخَلَّدُونَ ﴿17﴾ بِأَكْوَابٍ وَأَبَارِيقَ وَكَأْسٍ مِنْ مَعِينٍ ﴿18﴾ { الواقعة :১৭-১৮}

তাদের কাছে ঘুরাফেরা করবে চির কিশোররা। পান পাত্র কুঁজা ও খাঁটি সূরাপূর্ণ পেয়ালা হাতে নিয়ে। {সূরা ওয়াকিয়া:১৭-১৮}

(২) আরো ইরশাদ হচ্ছে:

يُطَافُ عَلَيْهِمْ بِصِحَافٍ مِنْ ذَهَبٍ وَأَكْوَابٍ وَفِيهَا مَا تَشْتَهِيهِ الْأَنْفُسُ وَتَلَذُّ الْأَعْيُنُ وَأَنْتُمْ فِيهَا خَالِدُونَ { الزخرف :৭১}

তাদের কাছে পরিবেশন করা হবে স্বর্ণের থালা ও পানপাত্র এবং তথায় রয়েছে মনে যা চায় এবং নয়ন যাতে তৃপ্ত হয়। তোমরা সেথায় চিরকাল থাকবে। {সূরা যুখরুফ:৭১}

(৩) অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

وَيُطَافُ عَلَيْهِمْ بِآَنِيَةٍ مِنْ فِضَّةٍ وَأَكْوَابٍ كَانَتْ قَوَارِيرَ ﴿15﴾ قَوَارِيرَ مِنْ فِضَّةٍ قَدَّرُوهَا تَقْدِيرًا ﴿16﴾ { الإنسان :১৫-১৬}

তাদেরকে পরিবেশন করা হবে রূপার পাত্রে এবং স্ফটিকের মত পানপাত্রে। রূপালী স্ফটিকের পাত্রে পরিবেশনকারীরা তা পরিমাপ করে পূর্ণ করবে। {সূরা ইনসান:১৫-১৬}

(৪) হাদীসে এসেছে

وعن عبد الله بن قيس رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : جنتان من فضة آنيتهما و ما فيهما , وجنتان من ذهب آنيتهما و ما فيهما , وما بين القوم و بين أن ينظروا إلى ربهم إلا رداء الكبرياء على وجهه في جنة عدن . متفق عليه

সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন কায়স রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: দু’টি জান্নাত এমন যে , তাদের বাসন-পাত্র এবং উভয়ের মাঝে যাকিছু আছে সবই রূপার। আবার অন্য দু’টি জান্নাত আছে, যাদের বাসন- পাত্র এবং তাদের মাঝে যা কিছু আছে সবই স্বর্ণের। জান্নাতে আদন তথা চিরস্থায়ী জান্নাতে বসবাসকারী ও তাদের পালনকর্তাকে দেখার মাঝে পর্দা শুধুমাত্র কিবরিয়া বা বড়ত্বের চাদর যা তাঁর চেহারায় বিদ্যমান। [বর্ণনায় বুখারী ( ৭৪৪৪) ও মুসলিম (১৮০)।]

১৮২
জান্নাতবাসীদের অলঙ্কার ও পোশাকের বিবরণ:
(১) মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করছেন:

إِنَّ اللَّهَ يُدْخِلُ الَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ يُحَلَّوْنَ فِيهَا مِنْ أَسَاوِرَ مِنْ ذَهَبٍ وَلُؤْلُؤًا وَلِبَاسُهُمْ فِيهَا حَرِيرٌ ﴿23﴾ { الحج :২৩}

নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম সম্পাদন করে আল্লাহ তাদেরকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতে যার পাদদেশে প্রবাহিত নির্ঝরিণীসমূহ। তথায় তাদেরকে অলংকৃত করা হবে স্বর্ণ-কংকন ও মুক্তা দ্বারা। এবং সেথায় তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ হবে রেশমের। {সূরা আল হজ্জ:২৩}

(২) অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

يُحَلَّوْنَ فِيهَا مِنْ أَسَاوِرَ مِنْ ذَهَبٍ وَيَلْبَسُونَ ثِيَابًا خُضْرًا مِنْ سُنْدُسٍ وَإِسْتَبْرَقٍ مُتَّكِئِينَ فِيهَا عَلَى الْأَرَائِكِ نِعْمَ الثَّوَابُ وَحَسُنَتْ مُرْتَفَقًا ﴿31﴾ { الكهف :৩১}

তাদের তথায় স্বর্ণ-কঙ্কনে অলংকৃত করা হবে এবং তারা পাতলা ও মোটা রেশমের সবুজ বস্ত্র পরিধান করবে এমতাবস্থায় যে, তারা সুসজ্জিত সিংহাসনে সমাসীন হবে হেলান দিয়ে। কতইনা চমৎকার প্রতিদান এবং কতইনা উত্তম আশ্রয়স্থল। (সূরা কাহফ:৩১}

(৩) আরো ইরশাদ হচ্ছে:

عَالِيَهُمْ ثِيَابُ سُنْدُسٍ خُضْرٌ وَإِسْتَبْرَقٌ وَحُلُّوا أَسَاوِرَ مِنْ فِضَّةٍ وَسَقَاهُمْ رَبُّهُمْ شَرَابًا طَهُورًا ﴿21﴾ { الإنسان :২১}

তাদের পরিধানে থাকবে চিকন মিহি রেশমের সবুজ পোশাক এবং মোটা সবুজ রেশমের পোশাক আরা তারা রৌপ্য নির্মিত কংকন দ্বারা অলংকৃত হবে এবং তাদের প্রতিপালক তাদেরকে পান করাবেন -শরাবান তহুরা- পবিত্র বিশুদ্ধ পানীয়। {সূরা ইনসান:২১}

যাকে জান্নাতে সর্বপ্রথম পোশাক পরানো হবে

عن ابن عباس رضي الله عنهما عن النبي صلى الله عليه وسلم قال :(... وإن أول الخلائق يكسى يوم القيامة إبراهيم الخليل ). أخرجه البخاري .

প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: ... কিয়ামতের দিন সর্ব প্রথম যাকে পোশাক পরিধান করানো হবে তিনি হচ্ছেন ইবরাহীম খলীল আলাইহিস সালাম। [বর্ণনায় সহীহ বুখারী , হাদীস নং (৬৫২৬)।]

১৮৩
জান্নাত অধিবাসীদের পরিচারকবৃন্দের বিবরণ:
(১)মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

يَطُوفُ عَلَيْهِمْ وِلْدَانٌ مُخَلَّدُونَ ﴿17﴾ بِأَكْوَابٍ وَأَبَارِيقَ وَكَأْسٍ مِنْ مَعِينٍ ﴿18﴾ { الواقعة :১৭-১৮ }

তাদের কাছে ঘুরাফেরা করবে চির কিশোররা। পানপাত্র কুঁজা ও খাটি সুরাপূর্ণ পেয়ালা হাতে নিয়ে। {সূরা ওয়াকিয়া:১৭-১৮}

(২) অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

وَيَطُوفُ عَلَيْهِمْ وِلْدَانٌ مُخَلَّدُونَ إِذَا رَأَيْتَهُمْ حَسِبْتَهُمْ لُؤْلُؤًا مَنْثُورًا ﴿19﴾ { الإنسان :১৯}

তাদের কাছে ঘুরাফেরা করবে চির কিশোরবৃন্দ। তুমি তাদেরকে দেখে মনে করবে যেন বিক্ষিপ্ত মণি- মুক্তা। {সূরা ইনসান:১৯}

(৩) আরো ইরশাদ হচ্ছে:

وَيَطُوفُ عَلَيْهِمْ غِلْمَانٌ لَهُمْ كَأَنَّهُمْ لُؤْلُؤٌ مَكْنُونٌ ﴿24﴾ { الطور :২৪}

সুরক্ষিত মোতি সদৃশ কিশোররা তাদের সেবায় ঘুরা ফেরা করবে। {সূরা তূর:২৪}

১৮৪
জান্নাতবাসীদের সর্বপ্রথম খাবার:
عن أنس بن مالك رضي الله عنه أن عبد الله بن سلام رضي الله عنه سأل النبي صلى الله عليه وسلم ما أول طعام يأكله أهل الجنة؟ فقال : زيادة كبد حوت . أخرجه البخاري .

সাহাবী আনাস বিন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করছেন: আব্দুল্লাহ বিন সালাম রাদিয়াল্লাহু নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট জানতে চাইলেন: জান্নাত বাসীরা সর্ব প্রথম যে খাবার খাবে সেটি কি? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: মাছের কলিজার অতিরিক্ত অংশ। [বর্ণনায় সহীহ বূখারী। হাদীস নং (৩৩২৯)]

وعن ثوبان رضي الله عنه قال : كنت قائما عند رسول الله صلى الله عليه وسلم فجاء حبر من أحبار اليهود ... ــ وفيه ــ : فقال اليهودي : فمن أول الناس إجازة؟ قال : فقراء المهاجرين . قال اليهودي : فما تحفتهم حين يدخلون الجنة؟ قال : زيادة كبد النون . فقال فما غذاؤهم على إثرها؟ قال : ينحر لهم ثور الجنة الذي كان يأكل من أطرافها , قال : فما شرابهم عليه قال : من عين فيها تسمى سلسبيلا . أخرجه مسلم .

সাওবান রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট দাড়ানো ছিলাম, এরই মাঝে জনৈক ইয়াহুদী পন্ডিত তার নিকট আসল... - তাতে আছে- এরপর ইয়াহুদী জানতে চাইল: জান্নাতে প্রবেশের সর্বপ্রথম অনুমতি প্রাপ্ত লোক কারা? রাসূলুল্লাহ বললেন: দরিদ্র মুহাজিরবৃন্দ। ইয়াহুদী জিজ্ঞেস করল: জান্নাতে প্রবেশের পর তাদের তোহফা কি? নবীজী বললেন: মাছের কলিজার অতিরিক্ত অংশ। সে বলল: এরপর তাদের খাবার কি হবে? রাসূলুল্লাহ বললেন: তাদের জন্য জান্নাতের ষাঢ় জবাই করা হবে যে ষাঢ় জান্নাতের পার্শ্বদেশে চরে বেড়াত। ইয়াহুদী জিজ্ঞেস করল: খাবারের পর তাদের পানীয় কি হবে? রাসূলুল্লাহ বললেন: জান্নাতে অবস্থিত ‘‘সালসাবীল’’ নামক ঝর্ণা থেকে। [বর্ণনায় সহীহ মুসলিম। হাদীস নং (৩১৫)]

১৮৫
জান্নাতবাসীদের খাদ্য-খাবারের বিবরণ:
(১) আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

ادْخُلُوا الْجَنَّةَ أَنْتُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ تُحْبَرُونَ ﴿70﴾ يُطَافُ عَلَيْهِمْ بِصِحَافٍ مِنْ ذَهَبٍ وَأَكْوَابٍ وَفِيهَا مَا تَشْتَهِيهِ الْأَنْفُسُ وَتَلَذُّ الْأَعْيُنُ وَأَنْتُمْ فِيهَا خَالِدُونَ ﴿71﴾{ الزخرف :৭০-৭১}

জান্নাতে প্রবেশ কর তোমরা এবং তোমাদের স্ত্রীগন সানন্দে। তাদের কাছে পরিবেশন করা হবে স্বর্ণের থালা ও পানপাত্র। আর তথায় রয়েছে মনে যা চায় এবং নয়ন যাতে তৃপ্ত হয়। তোমরা সেথায় চিরকাল থাকবে।{সূরা যুখরুফ:৭০-৭১}

(২) আরো ইরশাদ হচ্ছে:

مَثَلُ الْجَنَّةِ الَّتِي وُعِدَ الْمُتَّقُونَ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ أُكُلُهَا دَائِمٌ وَظِلُّهَا ﴿35﴾ { الرعد :৩৫}

মুত্তাকীনদের জন্য প্রতিশ্রুত জান্নাতের অবস্থা এইযে, তার তলদেশ দিয়ে নির্ঝরিণীসমূহ প্রবাহিত হয়, তার ফল-ফলাদি চিরস্থায়ী এবং ছায়াও। { সূরা রা’দ:৩৫}

(৩) অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

وَفَاكِهَةٍ مِمَّا يَتَخَيَّرُونَ ﴿20﴾ وَلَحْمِ طَيْرٍ مِمَّا يَشْتَهُونَ ﴿21﴾{ الواقعة :২০-২১}

এবং তাদের পছন্দমত ফল-মূল নিয়ে। রুচিমত পাখির গোশত নিয়ে। {সূরা ওয়াকিয়া:২০-২১}

(৪) আরো ইরশাদ হচ্ছে:

كُلُوا وَاشْرَبُوا هَنِيئًا بِمَا أَسْلَفْتُمْ فِي الْأَيَّامِ الْخَالِيَةِ ﴿24﴾{ الحاقة :২৪}

বিগত দিনে তোমরা যা প্রেরণ করেছিলে তার প্রতিদানে তোমরা খাও এবং পান কর পরিতৃপ্তি সহকারে। {সূরা আল হাক্কাহ:২৪}

(৫) হাদীসে এসেছে

وعن أبي سعيد الخدري رضي الله عنه قال : قال النبي صلى الله عليه وسلم : تكون الأرض يوم القيامة خبزة واحدة , يتكفؤها الجبار بيده , كما يكفؤ أحدكم خبزته في السفر نزلا لأهل الجنة . ـ و فيه ـ فأتى رجل من اليهود ... فقال : ألا أخبرك بإدامهم؟ قال : إدامهم بالام و نون , قالوا : وما هذا؟ قال : ثور و نون يأكل من زائدة كبدهما سبعون ألفا . متفق عليه

সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করছেন, নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: কিয়ামতের দিন পৃথিবী একটি রুটিতে পরিণত হবে। মহা প্রতাপন্বিত আল্লাহ জান্নাত বাসীদের মেহমানদারীর নিমিত্তে নিজ হাতে তাকে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে উপযোগী করবেন। যেমন তোমাদের কেউ সফরে স্বীয় রুটিকে হাতে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে উপযোগী করে। - আর তাতে আছে - অত:পর জনৈক ইয়াহুদী এসে বলল: আমি কি তোমাকে তাদের তরকারী সম্বন্ধে বলব না? তাদের তরকারী হচ্ছে বালাম ও নূন। লোকেরা জিজ্ঞেস করল: সেটি কি? বলল: ষাঁঢ় ও মাছ, যাদের কলিজার অতিরিক্ত অংশ থেকে খাবে সত্তর হাজার লোক। [বর্ণনায় সহীহ বুখারী (৬৫২০) ও সহীহ মুসলিম (২৭৯২)।]

(৬) হাদীসে আরো এসেছে

وعن جابر رضي الله عنه قال : سمعت النبي صلى الله عليه وسلم يقول : إن أهل الجنة يأكلون فيها , ويشربون , ولا يتفلون , ولا يبولون , ولا يتغوطون , ولايمتخطون , قالوا : فما بال الطعام؟ قال : جشاء و رشح كرشح المسك يلهمون التسبيح و التحميد كما يلهمون النفس . أخرجه مسلم .

বিশিষ্ট সাহাবী জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ইরশাদ করতে শুনেছি, রাসূলুল্লাহ বলেন: নিশ্চয় জান্নাত বাসীরা (জান্নাতে) খাবে ও পান করবে। তবে তারা থুথু ফেলবে না, প্রস্রাব ও পায়খানা করবে না এবং নাকের শ্লেষ্মা ফেলবে না। লোকেরা জিজ্ঞেস করল? তাহলে খানা খাদ্য যা খাবে তার কি হবে? বললেন: ঢেকুর ও মেশক ফোটার ন্যায় ঘাম, শ্বাস-প্রশ্বাস বের হওয়ার ন্যায় তাদের ভেতর হতে (স্বত:স্ফুর্ত ভাবে) সুবহানাল্লাহ ও আল্ হামদুলিল্লাহ বের হতে থাকবে। [সহীহ মুসলিম। হাদীস নং ( ২৮৩৫)।]

(৭) হাদীসে আরো এসেছে

وعن عتبة بن عبد السلمي رضي الله عنه قال : كنت جالسا مع رسول الله صلى الله عليه وسلم فجاء أعرابي فقال : يا رسول الله أسمعك تذكر شجرة في الجنة لا أعلم في الدنيا أكثر شوكا منها ـ يعني الطلح ـ فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم : فإن الله يجعل مكان كل شوكة مثل خصية التيس الملبود ـ يعني المخصي ـ فيها سبعون لونا من الطعام لا يشبه لونه لون الآخر . أخرجه الطبراني في الكبير و في مسند الشاميين

উতবা বিন আব্দুস ছুলামী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বসা ছিলাম। এর মাঝে একজন বেদুঈন সাহাবী এসে জিজ্ঞেস করল: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আপনাকে জান্নাতের একটি গাছ সম্পর্কে আলোচনা করতে শুনেছি, আমি পৃথিবীতে এরচেয়ে অধিক কাঁটা বিশিষ্ট গাছ আছে বলে জানিনা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক কাঁটার স্থলে খাসী কৃত ছাগলের লেপ্টানো অন্ডকোষ সদৃশ করে দেব। তাতে সত্তর রং এর খাবার থাকবে এক রং অন্য রং এর সাথে মেশবে না। [হাদীসের সনদ সহীহ। বর্ণনায় তবরাণী আল কাবীর (৭/১৩০) ও মুসনাদ শামীইয়াইন (১/২৮২)। দেখুন আল সিলসিলাতুস সহীহাহ (২৭৩৪) ।]

১৮৬
জান্নাতবাসীদের পানীয় এর বিবরণ:
(১) মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

إِنَّ الْأَبْرَارَ يَشْرَبُونَ مِنْ كَأْسٍ كَانَ مِزَاجُهَا كَافُورًا ﴿5﴾( الإنسان :৫)

নিশ্চয় সৎকর্মশীলরা পান করবে কাফূর মিশ্রিত পানপাত্র। (সূরা ইনসান:৫)

(২) আল্লাহ তাআলা আরো বলেন:

وَيُسْقَوْنَ فِيهَا كَأْسًا كَانَ مِزَاجُهَا زَنْجَبِيلًا ﴿17﴾ ( الإنسان :১৭)

সেখানে তাদেরকে পান করানো হবে ‘‘যানজাবীল’’ মিশ্রিত পানপাত্র। (সূরা ইনসান:১৭)

(৩) অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

يُسْقَوْنَ مِنْ رَحِيقٍ مَخْتُومٍ ﴿25﴾ خِتَامُهُ مِسْكٌ وَفِي ذَلِكَ فَلْيَتَنَافَسِ الْمُتَنَافِسُونَ ﴿26﴾ وَمِزَاجُهُ مِنْ تَسْنِيمٍ ﴿27﴾ عَيْنًا يَشْرَبُ بِهَا الْمُقَرَّبُونَ ﴿28﴾ { الإنسان :২৫-২৮}

তাদেরকে পান করানো হবে মোহর করা বিশুদ্ধ পানীয়। তার মোহর হবে কস্তরী। এ বিষয়ে প্রতিযোগীদের প্রতিযোগিতা করা উচিত। তার মিশ্রণ হবে তাসনীমের পানি। এটি একটি ঝর্ণা, যার পানি পান করবে নৈকট্যশীলগন।{সূরা তাতফীফ:২৫-২৮}

(৪) হাদীসে এসেছে

وعن ابن عمر رضي الله عنهما قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : الكوثر نهر في الجنة , حافتاه من ذهب , و مجراه على الدر و الياقوت , تربته أطيب من المسك , و ماؤه أحلى من العسل , و أبيض من الثلج . أخرجه الترمذي وابن ماجة .

প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন ওমর রাদিয়াল্লাহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: ‘‘কাউসার’’ জান্নাতের একটি নহর। তার দুই তীর স্বর্ণদ্বারা নির্মিত। তার গতিপথ ও প্রবাহ হচ্ছে মূল্যবান মণিমুক্তা ও ইয়াকূতের উপর দিয়ে। এর মাঠি মেশক অপেক্ষা উত্তম, পানি মধুর চেয়েও অধিক মিষ্টি এবং বরফের চেয়ে অধিক সাদা। [হাদীসের সনদ সহীহ , বর্ণনায় তিরমিযী (৩৩৬১) ও ইবনে মাজাহ (৪৩৩৪)।]

১৮৭
জান্নাতের বৃক্ষরাজি ও ফল-ফলাদির বিবরণ:
(১) মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

وَدَانِيَةً عَلَيْهِمْ ظِلَالُهَا وَذُلِّلَتْ قُطُوفُهَا تَذْلِيلًا ﴿14﴾ { الإنسان :১৪}

তার বৃক্ষছায়া তাদের উপর ঝুঁকে থাকবে এবং তার ফলসমূহ তাদের আওতাধীন রাখা হবে। {সূরা ইনসান:১৪}

(২) আরো ইরশাদ হচ্ছে:

إِنَّ الْمُتَّقِينَ فِي ظِلَالٍ وَعُيُونٍ ﴿41﴾ وَفَوَاكِهَ مِمَّا يَشْتَهُونَ ﴿42﴾ { المرسلات :৪১-৪২}

নিশ্চয় আল্লাহভীরুরা থাকবে বৃক্ষ ছায়া ও প্রস্রবণসমূহে এবং তাদের বাঞ্ছিত ফল-মূলের মধ্যে। {সূরা আল মুরসালাত:৪১-৪২}

(৩)আল্লাহ তাআরা অন্যত্র বলছেন:

مُتَّكِئِينَ فِيهَا يَدْعُونَ فِيهَا بِفَاكِهَةٍ كَثِيرَةٍ وَشَرَابٍ ﴿51﴾ {ص:৫১}

সেখানে তারা হেলান দিয়ে বসবে। তারা সেখানে চাইবে অনেক ফল-মূল ও পানীয়। {সূরা স্বদ:৫১}

(৪)অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

وَلَهُمْ فِيهَا مِنْ كُلِّ الثَّمَرَاتِ { محمد :১৫}

তথায় তাদের জন্য রয়েছে রকমারী ফল-মূল। {সূরা মুহাম্মাদ:১৫}

(৫) আরো ইরশাদ হচ্ছে:

إِنَّ لِلْمُتَّقِينَ مَفَازًا ﴿31﴾ حَدَائِقَ وَأَعْنَابًا ﴿32﴾ { النبا :৩১-৩২}

আল্লাহভীরুদের জন্য রয়েছে সাফল্য । উদ্যান ও আঙ্গুর। {সূরা নাবা:৩১-৩২}

(৬) আরো ইরশাদ হচ্ছে:

فِيهِمَا مِنْ كُلِّ فَاكِهَةٍ زَوْجَانِ ﴿52﴾ { الرحمن :52}

উভয়ের মধ্যে প্রত্যেক ফল বিভিন্ন রকমের হবে। {সূরা আর রহমান:৫২}

فِيهِمَا فَاكِهَةٌ وَنَخْلٌ وَرُمَّانٌ ﴿68﴾ { الرحمن :68}

সেখানে আছে ফল-মূল, খেজুর ও আনার। { সূরা আর রহমান:৬৮}

(৭) আরো ইরশাদ হচ্ছে:

يَدْعُونَ فِيهَا بِكُلِّ فَاكِهَةٍ آَمِنِينَ ﴿55﴾ { الدخان :৫৫}

তারা সেখানে শান্ত মনে বিভিন্ন ফল-মূল আনতে বলবে। { সূরা দোখান:৫৫}

(৮)আরো ইরশাদ হচ্ছে:

وَأَصْحَابُ الْيَمِينِ مَا أَصْحَابُ الْيَمِينِ ﴿27﴾ فِي سِدْرٍ مَخْضُودٍ ﴿28﴾ وَطَلْحٍ مَنْضُودٍ ﴿29﴾ وَظِلٍّ مَمْدُودٍ ﴿30﴾ وَمَاءٍ مَسْكُوبٍ ﴿31﴾ وَفَاكِهَةٍ كَثِيرَةٍ ﴿32﴾ لَا مَقْطُوعَةٍ وَلَا مَمْنُوعَةٍ ﴿33﴾ { الواقعة :২৭-৩৩}

যারা ডান দিকে থাকবে, তারা কতইনা ভাগ্যবান। তারা থাকবে কাঁটা বিহীন বদরিকা বৃক্ষে। এবং কাঁদি কাঁদি কলায়। দীর্ঘ ছায়ায় এবং প্রবাহিত পানিতে ও প্রচুর ফল-মূলে। যা শেষ হবার নয় এবং নিষিদ্ধও নয়। (সূরা ওয়াকিয়া:২৭-৩৩)

(৯) অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

فِي جَنَّةٍ عَالِيَةٍ ﴿22﴾ قُطُوفُهَا دَانِيَةٌ ﴿23﴾ كُلُوا وَاشْرَبُوا هَنِيئًا بِمَا أَسْلَفْتُمْ فِي الْأَيَّامِ الْخَالِيَةِ ﴿24﴾ { الحاقة : ২২-২৪}

সুউচ্চ জান্নাতে, তার ফল-মূলসমূহ অবনমিত থাকবে। বিগত দিনে তোমরা যা প্রেরণ করেছিলে, তার প্রতিদানে তোমরা খাও এবং পান কর তৃপ্তি সহকারে। {সূরা আল হাক্কাহ:২২-২৪}

(১০) হাদীসে এসেছে

وعن مالك بن صعصعة رضي الله عنهما في قصة المعراج ـ وفيه ـ أن النبي صلى الله عليه وسلم قال : ورفعت لي سدرة المنتهى فإذا نبقها كأنه قلال هجر , وورقها كأنه آذان الفيول , في أصلها أربعة أنهار : نهران باطنان , ونهران ظاهران , فسألت جبريل , فقال : أما الباطنان ففي الجنة , وأما الظاهران النيل و الفرات . متفق عليه

সাহাবী মালেক বিন সা’সা‘আহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে মে’রাজের ঘটনা সম্বলিত হাদীসে বর্ণিত, - তাতে আছে - নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: আমারা সামনে সিদরাতুল মুন্তাহাকে তুলে ধরা হল, দেখলাম তার ফলগুলো যেন হাজারের বিশাল বিশাল মটকা। এবং তার পাতাগুলো যেন হাতির কান। তার গোড়া থেকে চারটি নদী প্রবাহমান। দু'টো অপ্রকাশ্য অপর দু'টো প্রকাশ্য। আমি জিবরীলকে এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন: অপ্রকাশ্য নদীদ্বয় জান্নাতে আর প্রকাশ্য দু'টো হচ্ছে: নীল ও ফোরাত [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং যথাক্রমে (৩২০৭) ও (১৬২)।]

(১১) হাদীসে আরো এসেছে

وعن أبي سعيد رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال : إن في الجنة لشجرة يسير الراكب الجواد أو المضمر السريع مائة عام ما يقطعها . متفق عليه .

আবু সাঈদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন: নিশ্চয়ই জান্নাতে এমন একটি বিশাল বৃক্ষ আছে একজন দক্ষ সওয়ারী খুব দ্রুতগামী অশ্ব বা ঘোড়দৌড়ে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত দ্রুতগামী অশ্বকে একশত বছর পর্যন্ত ছুটালেও ঐ বৃক্ষকে অতিক্রম করতে পারবে না। [বর্ণনায় বুখারী (৬৫৫৩) এবং মুসলিম (২৮২৮)।]

(১২) হাদীসে আরো এসেছে

وعن أبي هريرة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : ما في الجنة شجرة إلا وساقها من ذهب . أخرجه الترمذي

বিশিষ্ট সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন: জান্নাতে অবস্থিত প্রত্যেক বৃক্ষের কান্ডই হবে স্বর্ণের। [হাদীসের সনদ সহীহ, বর্ণনায় তিরমিযী। হাদীস নং (২৫২৫) দেখুন সহীহ জামে ( ৫৬৪৭)]

১৮৮
জান্নাতের নহরসমূহের বিবরণ:
(১)মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

إِنَّ الَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَهُمْ جَنَّاتٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ ذَلِكَ الْفَوْزُ الْكَبِيرُ ﴿11﴾ { البروج :১১}

অর্থাৎ যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম সম্পাদন করে তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত, যার তলদেশে প্রবাহিত হয় নির্ঝরিণীসমূহ। এটাই মহা সাফল্য। {সূরা বুরূজ:১১}

(২) আরো ইরশাদ হচ্ছে:

مَثَلُ الْجَنَّةِ الَّتِي وُعِدَ الْمُتَّقُونَ فِيهَا أَنْهَارٌ مِنْ مَاءٍ غَيْرِ آَسِنٍ وَأَنْهَارٌ مِنْ لَبَنٍ لَمْ يَتَغَيَّرْ طَعْمُهُ وَأَنْهَارٌ مِنْ خَمْرٍ لَذَّةٍ لِلشَّارِبِينَ وَأَنْهَارٌ مِنْ عَسَلٍ مُصَفًّى وَلَهُمْ فِيهَا مِنْ كُلِّ الثَّمَرَاتِ وَمَغْفِرَةٌ مِنْ رَبِّهِمْ كَمَنْ هُوَ خَالِدٌ فِي النَّارِ وَسُقُوا مَاءً حَمِيمًا فَقَطَّعَ أَمْعَاءَهُمْ ﴿15﴾ { محمد :১৫}

আল্লাহ ভীরু মুত্তাকীদের যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তার অবস্থা নিম্নরূপ, তাতে আছে নির্মল পানির নহর, দুধের নহর যার স্বাদ অপরিবর্তনীয়, পানকারীদের জন্য সুস্বাদু শরাবের নহর এবং পরিশোধিত মধুর নহর। আরো আছে রকমারি ফল-মূল ও তাদের পালনকর্তার ক্ষমা। {সূরা মুহাম্মাদ:১৫}

(৩) আরো ইরশাদ হচ্ছে:

إِنَّ الْمُتَّقِينَ فِي جَنَّاتٍ وَنَهَرٍ ﴿54﴾ فِي مَقْعَدِ صِدْقٍ عِنْدَ مَلِيكٍ مُقْتَدِرٍ ﴿55﴾ { القمر :৫৪-৫৫}

আল্লাহভীরুরা থাকবে জান্নাতে ও নির্ঝরিণীতে। যোগ্য আসনে সর্বাধিপতি সম্রাটের সান্নিধ্যে। {সূরা কামার:৫৪-৫৫}

(৪) হাদীসে এসেছে

وعن أنس بي مالك رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال : بينما أنا أسير في الجنة إذا أنا بنهر حافتاه قباب الدر المجوف , قلت ما هذا يا جبريل؟ قال : هذا الكوثر الذي أعطاك ربك , فإذا طيبه أو طينه مسك أذفر . أخرجه البخاري .

সাহাবী আনাস বিন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করছেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: আমি জান্নাতে বিচরণ করছিলাম, হঠাৎ নিজেকে একটি নহরের কাছে আবিষ্কার করলাম। ঐ নহরের দুই তীর মধ্যখান ফাঁকা বিশিষ্ট মণি-মুক্তা বিশেষের গম্বুজ। আমি বললাম: জিবরীল! এইটি কি? বললেন: এইটি কাউসার, যা আপনার প্রতিপালক আপনাকে দান করেছেন। দেখলাম, এর সৌরভ বা মাটি মেশক সদৃশ। [বর্ণনায় বুখারী, হাদীস নং ( ৬৫৮১)।]

(৫) হাদীসে আরো এসেছে

وعن أبي هريرة رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : سيحان و جيحان والفرات والنيل كل من أنهار الجنة . أخرجه مسلم .

সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: সাইহান, জাইহান, ফোরাত ও নীল প্রত্যেকটিই জান্নাতের নহর। [বর্ণনায় মুসলিম, হাদীস নং (২৮৩৯)।]

১৮৯
জান্নাতের ঝর্ণার বিবরণ:
(১) মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

إِنَّ الْمُتَّقِينَ فِي جَنَّاتٍ وَعُيُونٍ ﴿45﴾

নিশ্চয় আল্লাহ ভীরু - মুত্তাকীরা থাকবে বাগান ও নির্ঝরিণী সমূহে। {সূরা হিজর:৪৫}

(২) অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

إِنَّ الْأَبْرَارَ يَشْرَبُونَ مِنْ كَأْسٍ كَانَ مِزَاجُهَا كَافُورًا ﴿5﴾ عَيْنًا يَشْرَبُ بِهَا عِبَادُ اللَّهِ يُفَجِّرُونَهَا تَفْجِيرًا ﴿6﴾ { الإنسان :5-6}

নিশ্চয় সৎকর্মশীলরা পান করবে কাফুর মিশ্রিত পানপাত্র। এটি একটি ঝরণা, যা থেকে আল্লাহর বান্দাগন পান করবে-তারা একে প্রবাহিত করবে। {সূরা ইনসান:৫-৬}

(৩) আরও ইরশাদ হচ্ছে:

وَمِزَاجُهُ مِنْ تَسْنِيمٍ ﴿27﴾ عَيْنًا يَشْرَبُ بِهَا الْمُقَرَّبُونَ ﴿28﴾ { المطففين :২৭-২৮}

তার মিশ্রণ হবে তাসনীমের পানি। এটি একটি ঝরণা যার পানি পান করবে নৈকট্যশীল গন। {সূরা আল মুতাফফি ফীন:২৭-২৮}

(৪) আরও ইরশাদ হচ্ছে:

فِيهِمَا عَيْنَانِ تَجْرِيَانِ ﴿50﴾ / فِيهِمَا عَيْنَانِ نَضَّاخَتَانِ ﴿66﴾ { الرحمن :50/66}

উভয় উদ্যানে আছে বহমান দুই প্রস্রবণ। / তথায় আছে উদ্বেলিত দুই প্রস্রবণ। {সূরা আর রাহমান:৫০/৬৬}

(৫) আরও ইরশাদ হচ্ছে:

وَيُسْقَوْنَ فِيهَا كَأْسًا كَانَ مِزَاجُهَا زَنْجَبِيلًا ﴿17﴾ عَيْنًا فِيهَا تُسَمَّى سَلْسَبِيلًا ﴿18﴾ { الإنسان :১৭-১৮}

তাদেরকে সেখানে পান করানো হবে ‘‘ যনজাবীল’’ মিশ্রিত পান পাত্র। এটি জান্নাতস্থিত ‘‘সালসাবীল’’ নামক একটি ঝরণা। {সূরা ইনসান:১৭-১৮}

১৯০
জান্নাতবাসীদের স্ত্রীদের বিবরণ:
(১) আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

لِلَّذِينَ اتَّقَوْا عِنْدَ رَبِّهِمْ جَنَّاتٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَأَزْوَاجٌ مُطَهَّرَةٌ وَرِضْوَانٌ مِنَ اللَّهِ وَاللَّهُ بَصِيرٌ بِالْعِبَادِ ﴿15﴾ { آل عمران :১৫}

যারা তাকওয়া অবলম্বনকারী, আল্লাহর নিকট তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত যার তলদেশে প্রস্রবণ প্রবাহিত। তারা সেখানে থাকবে অনন্তকাল। আর রয়েছে পরিচ্ছন্ন সঙ্গিগন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি সুদৃষ্টি রাখেন। { সূরা আলে ইমরান:১৫}

(২) অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

إِنَّا أَنْشَأْنَاهُنَّ إِنْشَاءً ﴿35﴾ فَجَعَلْنَاهُنَّ أَبْكَارًا ﴿36﴾ عُرُبًا أَتْرَابًا ﴿37﴾ لِأَصْحَابِ الْيَمِينِ ﴿38﴾ ثُلَّةٌ مِنَ الْأَوَّلِينَ ﴿39﴾ وَثُلَّةٌ مِنَ الْآَخِرِينَ ﴿40﴾ { الواقعة :৩৫-৪০}

আমি জান্নাতি রমণীগনকে বিশেষরূপে সৃষ্টি করেছি। অত:পর তাদেরকে করেছি চির কুমারী। কামিনী, সমবয়স্কা। ডানদিকের লোকদের জন্য। তাদের একদল হবে পূর্ববর্তীদের মধ্য হতে। এবং একদল পরবর্তীদের মধ্য হতে। {সূরা ওয়াকিয়া:৩৫-৪০}

(৩) আরও ইরশাদ হচ্ছে:

وَعِنْدَهُمْ قَاصِرَاتُ الطَّرْفِ عِينٌ ﴿48﴾ كَأَنَّهُنَّ بَيْضٌ مَكْنُونٌ ﴿49﴾ { الصافات :48-49}

তাদের সঙ্গে থাকবে আনত নয়না, আয়তলোচনা তরুণীকূল। যেন তারা সুরক্ষিত ডিম। {সূরা সাফফাত:৪৮-৪৯}

(৪) আরও ইরশাদ হচ্ছে:

وَحُورٌ عِينٌ ﴿22﴾ كَأَمْثَالِ اللُّؤْلُؤِ الْمَكْنُونِ ﴿23﴾ جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ ﴿24﴾ { الواقعة :২২-২৪}

আর সেখানে থাকবে আনত নয়না হুরগন, আবরণে রক্ষিত মুক্তা সদৃশ। তাদের কৃত আমলের পুরস্কার স্বরূপ। {সূরা ওয়াকিয়া:২২-২৪}

(৫) আরও ইরশাদ হচ্ছে:

فِيهِنَّ قَاصِرَاتُ الطَّرْفِ لَمْ يَطْمِثْهُنَّ إِنْسٌ قَبْلَهُمْ وَلَا جَانٌّ ﴿56﴾ فَبِأَيِّ آَلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ ﴿57﴾ كَأَنَّهُنَّ الْيَاقُوتُ وَالْمَرْجَانُ ﴿58﴾ { الرحمن : ৫৬-৫৮}

সে সকলের মাঝে থাকবে বহু আয়তনয়না রমণীকূল। যাদেরকে পূর্বে কোন মানুষ ও জিন স্পর্শ করেনি। সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের প্রতিপালকের কোন কোন অনুগ্রহ-অবদানকে অস্বীকার করবে? তারা যেন পদ্মরাগ ও প্রবাল।{সূরা আর রহমান:৫৬-৫৮}

(৬) আরও ইরশাদ হচ্ছে:

فِيهِنَّ خَيْرَاتٌ حِسَانٌ ﴿70﴾ فَبِأَيِّ آَلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ ﴿71﴾ حُورٌ مَقْصُورَاتٌ فِي الْخِيَامِ ﴿72﴾ { الرحمن :70-72}

সেখানে থাকবে সচ্চরিত্রা-সুশীলা, সুন্দরী রমণীকুল। সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন কোন অনুগ্রহ - অবদান অস্বীকার করবে? তার তাঁবুতে অবস্থান কারিনী-সুরক্ষিতা হুর। {সূরা আর রহমান:৭০-৭২}

(৭) হাদীসে এসেছে

وعن أنس رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال : لروحة في سبيل الله أو غدوة خير من الدنيا و ما فيها , ولقاب قوس أحدكم من الجنة أو موضع قيد ـ يعني سوطه ـ خير من الدنيا و ما فيها , ولو أن امرأة من أهل الجنة اطلعت إلى أهل الأرض لأضاءت ما بينهما , ولملأته ريحا , ولنصيفها على رأسها خير من الدنيا و ما فيها . متفق عليه

সাহাবী আনাস বিন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করছেন, নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: এক সন্ধ্যা অথবা এক বিকাল আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করা পৃথিবী ও পৃথিবীস্থিত সকলকিছু অপেক্ষা উত্তম। জান্নাতে তোমাদের কারো ধনুকের দূরত্ব সমান জায়গা অথবা ছড়ি রাখার স্থান পরিমাণ জায়গা পৃথিবী ও পৃথিবীস্থিত সকল কিছু অপেক্ষা উত্তম। জান্নাতের কোন নারী যদি জগতবাসীর দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করত তাহলে এতদ্ভোয়ের {জান্নাত ও পৃথিবী} মধ্যবর্তীস্থান আলোয় ও সুগন্ধিতে ভরে দিত। আর জান্নাতবাসী রমণীর মাথার উড়নাটুকু পৃথিবী ও পৃথিবীস্থিত সবকিছু থেকে উত্তম। [বর্ণনায় কুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং বুখারী (২৭৯৬) ও মুসলিম (১৮৮০)।]

(৮) হাদীসে আরো এসেছে

وعن أبي هريرة رضي الله عنه عن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : إن أول زمرة تدخل الجنة على صورة القمر ليلة البدر , والتي تليها على أضوأ كوكب دري في السماء , لكل امرئ منهم زوجتان اثنتان , يرى مخ سوقهما من وراء اللحم وما في الجنة أعزب . متفق عليه

সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, জান্নাতে প্রবেশকারী প্রথম দলটি পূর্ণিমা রাতের আলোকোদ্ভাসিত চাঁদের আকৃতি নিয়ে প্রবেশ করবে। এর পরেই যারা প্রবেশ করবে তারা হবে আকাশস্থ আলোকোজ্জ্বল নক্ষত্র থেকেও অধিক আলোকময়। তাদের প্রত্যেকের জন্য দু’জন করে স্ত্রী থাকবে যাদের পায়ের গোছার মগজ গোশত ভেদ করে দেখা যাবে। জান্নাতে কোন অবিবাহিত থাকবে না। [বর্ণনায় কুখারী ও মুসলিম , হাদীস নং বুখারী (৩২৪৬) ও মুসলিম (২৮৩৪)।]

১৯১
জান্নাতের সৌরভ ও সুঘ্রাণ:
জান্নাতে বিভিন্ন রকমের মনমুগ্ধকর আতর (সুগন্ধিদ্রব্য) ও সৌরভ আছে। জান্নাতীদের মর্যদাগত তারতম্যের কারণে সে সৌরভ ও দ্রব্যাদিতেও তারতম্য রয়েছে।

(১) হাদীসে এসেছে

عن أبي هريرة رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : إن أول زمرة يدخلون الجنة على صورة القمر ليلة البدر , ثم الذين يلونهم على أشد كوكب دري في السماء إضاءة , لا يبولون , ولا يتغوطون , ولا يتفلون , ولا يمتخطون , أمشاطهم الذهب , ورشحهم المسك , ومجامرهم الألوة , وأزواجهم الحور العين , على خلق رجل واحد , على صورة أبيهم آدم ستون ذراعا في السماء . متفق عليه

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: সর্ব প্রথম যে দলটি জান্নাতে প্রবেশ করবে তাদের আকৃতি হবে পূর্ণিমা রাতের আলোকোজ্জ্বল চাঁদ সদৃশ। তাদের পরপরই যারা প্রবেশ করবে তাদের অবস্থা হবে আকাশস্থ আলোকোজ্জ্বল নক্ষত্র থেকেও অধিকতর আলোকময়। তারা সেথায় মল-মূত্র ত্যাগ করবে না। থুথু-নাকের শ্লেষা ফেলবে না।(চুল বিন্যস্ত করার) চিরুনী হবে স্বর্ণের। শরীর নির্গত ঘাম হবে মেশক সদৃশ। শরীর নি:সৃত ঘ্রাণ হবে উলুওয়াহ তথা সুতীব্র ঘ্রাণ বিশিষ্ট কাঠ বিশেষ। স্ত্রী হবে কালো ও শুভ্র বর্ণের-ডাগর নয়না হুরবৃন্দ। এক ব্যক্তির আকৃতিতে- তাদের পিতা আদমের আকৃতিতে- আকাশপানে ষাট গজ। [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম।হাদীস নং বুখারী (৩৩২৭) ও মুসলিম (২৮৩৪)।]

(অর্থাৎ তারা আদম আলাইহিস সালামের মত ষাট গজ বিশিষ্ট লম্বাকৃতির হবে)

(২) হাদীসে আরো এসেছে

وعن عبد الله بن عمرو رضي الله عنهما أن النبي صلى الله عليه وسلم قال : من قتل معاهدا لم يرح رائحة الجنة , وإن ريحها يوجد من مسيرة أربعين عاما . أخرجه البخاري .

সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করছেন, নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি সন্ধিভুক্ত অমুসলিম লোককে হত্যা করবে সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না, অথচ তার সুঘ্রাণ চল্লিশ বছর সফরের দূরত্ব হতেও অনুভব করা যায়। [বর্ণনায় কুখারী হাদীস নং (৩১৬৬)।]

(৩) হাদীসে আরো এসেছে

وفي لفظ : وإن ريحها ليوجد من مسيرة سبعين خريفا . أخرجه الترمذي و ابن ماجة .

অন্য রেওয়ায়াতে আছে: অথচ জান্নাতের সুরভী সত্তর বছর সফরের দূরত্ব থেকেও পাওয়া যায়। [বর্ণনায় তিরমিযী হাদীস নং (১৪০৩) ও ইবনে মাজাহ হাদীস নং (২৬৮৭) ।]

১৯২
জান্নাতঅধিবাসীদের স্ত্রীদের গীত-সঙ্গীত:
عن ابن عمر رضي الله عنهما أن النبي صلى الله عليه وسلم قال : إن أزواج أهل الجنة ليغنين أزواجهن بأحسن أصوات سمعها أحد قط , إن مما يغنين به : نحن خير الحسان , أزواج قوم كرام , ينظرن بقرة أعيان .

وإن مما يغنين به : نحن الخالدات فلا يمتنه , نحن الآمنات فلا يخفنه , نحن المقيمات فلا يظعنه . أخرجه الطبراني في الأوسط .

বিশিষ্ট সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: জান্নাতীদের জন্য তাদের স্ত্রীরা এত সুন্দর আওয়াজে সঙ্গীত পরিবেশন করবে যা ইতিপূর্বে আর কেউ শুনেনি।

তাদের সঙ্গীতের মধ্যে যেমন: আমরা সচ্চরিত্রা-সুশীলা, সুন্দরী রমণীকুল, মহানুভব-সম্মানিত লোকদের স্ত্রী, যারা (তাদের প্রতি) তাকিয়ে থাকবে নয়নের প্রশান্তি নিয়ে।

তাদের সঙ্গীতের আরো কিছু নমূনা:

আমরা অমর যারা কখনো মরবে না, আমরা চির নিরাপদ যারা শঙ্কিত হয় না, আমরা অবস্থান কারিনী যারা সফর করবে না। [বর্ননায় তবরাণী আল মু‘জামুল আওসাত, হাদীসের সনদ সহীহ, হাদীস নং (৪৯১৭) দেখুন সহীহ আল জামে (১৫৬১)।]

১৯৩
জান্নাতীদের যৌন-মিলন:
(১) আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

إِنَّ أَصْحَابَ الْجَنَّةِ الْيَوْمَ فِي شُغُلٍ فَاكِهُونَ ﴿55﴾ هُمْ وَأَزْوَاجُهُمْ فِي ظِلَالٍ عَلَى الْأَرَائِكِ مُتَّكِئُونَ ﴿56﴾ { يس :৫৫-৫৬}

এ দিন জান্নাতবাসীরা আনন্দে মশগুল থাকবে। তারা এবং তাদের সঙ্গিগণ উপবিষ্ট থাকবে ছায়াময় পরিবেশে আসনে হেলান দিয়ে। {সূরা ইয়াসীন:৫৫-৫৬}

(২) হাদীসে এসেছে

عن زيد بن أرقم رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : إن الرجل من أهل الجنة ليعطى قوة مائة رجل في الأكل و الشرب و الشهوة و الجماع , فقال رجل من اليهود : فإن الذي يأكل و يشرب تكون له الحاجة , فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم : حاجة أحدهم عرق يفيض من جلده , فإذا بطنه ضمر . أخرجه الطبراني و الدارمي .

সাহাবী যায়দ বিন আরকাম রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: জান্নাতী প্রতিটি ব্যক্তিকে পানাহার, প্রবৃত্তিগত চাহিদা ও যৌন মিলনে একশত পুরুষের শক্তি প্রদান করা হবে। এটি শুনে জনৈক ইয়াহুদী প্রশ্ন করল: যে ব্যক্তি পানাহার করে তার প্রাকৃতিক কর্ম-প্রস্রাব পায়খানা-সম্পাদনের প্রয়োজন হয়। উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তাদের এ প্রয়োজনের পরিবর্তে শরীর থেকে ঘাম বের হবে আর এরই কারণে পেট খালী হয়ে যাবে। [হাদীসটি সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে। বর্ণনায় তবরাণী , আল মু‘জামুল কাবীর (৫/১৭৮) ও দারামী (২৭২১) দেখুন: সহীহ আল জামে (১৬২৭)]

(৩) হাদীসে আরো এসেছে

وعن أبي هريرة رضي الله عنه قال : قيل يا رسول الله : هل نصل إلى نسائنا في الجنة؟ فقال : إن الرجل ليصل في اليوم إلى مائة عذراء . أخرجه الطبراني في الأوسط و أبو نعيم في صفة الجنة .

সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করা হল: ইয়া রাসূলাল্লাহ: আমরা কি জান্নাতে আমাদের স্ত্রীদের কাছে পৌঁছাতে পারব? উত্তরে রাসূলুল্লাহ বললেন: একজন ব্যক্তি একদিনে একশত কুমারীর কাছে যাবে (অর্থাৎ মিলিত হবে)। [হাদীসটি বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত হয়েছে। বর্ণনায় তবরাণী ,আল মু‘জামুল আওসাত এবং আবু নাঈম , সিফাতুল জান্নাহ।]

১৯৪
জান্নাতে সন্তান লাভ:
عن أبي سعيد الخدري رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : المؤمن إذا اشتهى الولد في الجنة كان حمله و وضعه و سنه في ساعة كما يشتهي . أخرجه أحمد و الترمذي .

সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: মুমিন যখন জান্নাতে সন্তান কামনা করবে, তখনই সামান্য সময়ের মধ্যে তার চাহিদামতে তার গর্ভ, প্রসব ও বয়স্ক হয়ে যাওয়া সম্পন্ন হয়ে যাবে। [হাদীসের সনদ বিশুদ্ধ। বর্ণনায় আহমদ (১১০৭৯) ও তিরমিযী ( ২৫৬৩)।]

১৯৫
জান্নাতবাসীদের নিয়ামতের চলমানতা:
জান্নাতীরা জান্নাতে প্রবেশের পর ফেরেশ্তারা এসে তাদের সাথে সাক্ষাত করে এ সুসংবাদ প্রদান করবে যে, তোমরা এখানে চিরস্থায়ী ভাবে থাকবে এবং এমন নিয়ামতের সুসংবাদ শুনাবে যা তারা ইতিপূর্বে আর শুনেনি।

(১) মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

مَثَلُ الْجَنَّةِ الَّتِي وُعِدَ الْمُتَّقُونَ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ أُكُلُهَا دَائِمٌ وَظِلُّهَا تِلْكَ عُقْبَى الَّذِينَ اتَّقَوْا وَعُقْبَى الْكَافِرِينَ النَّارُ ﴿35﴾ { الرعد :৩৫}

মুত্তাকীদিগকে যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে, তার উপমা এরূপ: এর পাদদেশে নদী প্রবাহিত, তার ফলসমূহ ও ছায়া চিরস্থায়ী। যারা মুত্তাকী এটি তাদের কর্মফল আর কাফেরদের কর্মফল অগ্নি। {সূরা রা’দ:৩৫}

(২) হাদীসে এসেছে

وعن أبي هريرة رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال : ينادي مناد : إن لكم أن تصحوا فلا تسقموا أبدا , وإن لكم أن تحيوا فلا تموتوا أبدا , وإن لكم أن تشبوا فلا تهرموا أبدا , وإن لكم أن تنعموا فلا تبأسوا أبدا . فذلك قوله عز وجل :{ وَنُودُوا أَنْ تِلْكُمُ الْجَنَّةُ أُورِثْتُمُوهَا بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ } أخرجه مسلم .

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: জান্নাতীগন জান্নাতে প্রবেশ করার পর এক ঘোষণাকারী ঘোষণা করবে, তোমাদের জন্য এ সিদ্ধান্ত স্থির করা হয়েছে যে, তোমরা সর্বদা সুস্থ থাকবে কখনো অসুস্থ হবে না, সর্বদা জীবিত থাকবে কখনো মৃত্যুবরণ করবে না। সর্বদা যুবক থাকবে কখনো বৃদ্ধ হবে না। সর্বদা সচ্ছন্দ ও সুখে থাকবে কখনো অনটনক্লিষ্ট ও দূ:খিত হবে না। তাইতো মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন: ‘‘ এবং তাদের সম্বোধন করে বলা হবে, তোমরা যা করতে তারই জন্য তোমাদেরকে এ জান্নাতের উত্তরাধিকারী করা হয়েছে’’। [বর্ণনায় সহীহ মুসলিম (২৮৩৭)]

(৩) হাদীসে এসেছে

وعن جابر رضي الله عنه قال : قيل يا رسول الله : هل ينام أهل الجنة؟ قال : لا , النوم أخو الموت . أخرجه البزار

সাহাবী জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করছেন, জিজ্ঞেস করা হল: ইয়া রাসূলাল্লাহ! জান্নাতবাসীরা কি নিদ্রা যাবে? নবীজী উত্তরে বললেন: না, নিদ্রা মৃত্যু সদৃশ। [মুসনাদ আল বায্যার। হাদীসের সনদ সহীহ। কাশফুল আসতার (৩৫১৭) আলা সিলসিলাতুস সহীহা (১০৮৭)]

১৯৬
জান্নাতবাসীদের স্তর বিন্যাস:
(১) মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

انْظُرْ كَيْفَ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ وَلَلْآَخِرَةُ أَكْبَرُ دَرَجَاتٍ وَأَكْبَرُ تَفْضِيلًا ﴿21﴾ { الإسراء :২১}

লক্ষ্য কর, আমি কি ভাবে তাদের এক দলকে অপর দলের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি, আখিরাততো নিশ্চয়ই মর্যাদায় মহত্তর ও গুণে শ্রেষ্ঠতর। {সূরা ইসরা: ২১}

(২) আল্লাহ তাআলা আরো বলেন:

وَمَنْ يَأْتِهِ مُؤْمِنًا قَدْ عَمِلَ الصَّالِحَاتِ فَأُولَئِكَ لَهُمُ الدَّرَجَاتُ الْعُلَا ﴿75﴾ جَنَّاتُ عَدْنٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَذَلِكَ جَزَاءُ مَنْ تَزَكَّى ﴿76﴾ { طه :৭৫-৭৬}

এবং যারা তাঁর নিকট উপস্থিত হবে মুমিন অবস্থায় সৎকর্ম করে, তাদের জন্য রয়েছে সমুচ্চ মর্যাদা- স্থায়ী জান্নাত, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, সেখানে তারা স্থায়ী হবে এবং এ পুরস্কার তাদেরই যারা পবিত্র। {সূরা ত্ব-হা : ৭৫-৭৬}

(৩) আরও ইরশাদ হচ্ছে:

وَالسَّابِقُونَ السَّابِقُونَ ﴿10﴾ أُولَئِكَ الْمُقَرَّبُونَ ﴿11﴾ فِي جَنَّاتِ النَّعِيمِ ﴿12﴾ ثُلَّةٌ مِنَ الْأَوَّلِينَ ﴿13﴾ وَقَلِيلٌ مِنَ الْآَخِرِينَ ﴿14﴾ { الواقعة : ১০ر১৪}

আর অগ্রবর্তিগণই তো অগ্রবর্তী, তারাই নৈকট্যপ্রাপ্ত- নিয়ামতপূর্ণ উদ্যানে, বহু সংখ্যক হবে পূর্ববর্তীদের মধ্যহতে। এবং অল্প সংখ্যক হবে পরবর্তীদের মধ্য হতে। { ওয়াকিয়া:১০-১৪}

(৪) হাদীসে এসেছে

وعن أبي هريرة رضي الله عنه قال : قال النبي صلى الله عليه وسلم : من آمن بالله وبرسوله , وأقام الصلاة , وصام رمضان , كان حقا على الله , أن يدخله الجنة , جاهد في سبيل الله , أو جلس في أرضه التي ولد فيها , فقالوا يا رسول الله : أفلا نبشر الناس؟ قال : إن في الجنة مائة درجة أعدها الله للمجاهدين في سبيل الله , ما بين الدرجتين كما بين السماء و الأرض فإذا سألتم الله فاسألوه الفردوس فإنه أوسط الجنة , و أعلى الجنة , أراه قال : و فوقه عرش الرحمن , ومنه تفجر أنهار الجنة . أخرج البخاري .

সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনল, আরো ঈমান আনল তাঁর রাসূলের প্রতি, সালাত কায়েম করল, রমযানের সিয়াম পালন করল, তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো আল্লাহর দায়িত্ব হয়ে যায়। সে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করুক বা নিজ জন্মভূমিতে বসে থাকুক। লোকেরা বললেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা লোকদের সুসংবাদ দেব না? নবীজী বললেন: জান্নাতে একশত স্তর রয়েছে, আল্লাহ তাআলা সেগুলো তাঁর রাস্তায় জিহাদকারী মুজাহিদদের জন্য তৈরি করেছেন। দুই স্তরের মাঝে দূরত্ব হচ্ছে আকাশ ও যমীনের মাঝের দূরত্বের সমান। তোমরা আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করলে, ফেরদাউস প্রার্থন করবে। কেননা সেটি জান্নাতের মধ্যবর্তী স্থানে- সর্বোচ্চ মানের জান্নাত। বর্ণনাকারী বলেন: আমার ধারণা তিনি বলেছেন: তার উপর রয়েছে মহামহীম আল্লাহর আরশ।এেবং তার থেকেই জান্নাতের নির্ঝরিণীসমূহ প্রবাহিত হবে। [বর্ণনায় বুখারী , হাদীস নং (২৭৯০)]

১৯৭
আমলের ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা সত্ত্বেও মুমিনদের সন্তান-সন্ততিদের তাদের স্তরে উঠিয়ে দেয়া:
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

وَالَّذِينَ آَمَنُوا وَاتَّبَعَتْهُمْ ذُرِّيَّتُهُمْ بِإِيمَانٍ أَلْحَقْنَا بِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَمَا أَلَتْنَاهُمْ مِنْ عَمَلِهِمْ مِنْ شَيْءٍ كُلُّ امْرِئٍ بِمَا كَسَبَ رَهِينٌ ﴿21﴾ { الطور :২১}

এবং যারা ঈমান আনে আর তাদের সন্তান-সন্ততি ঈমানে তাদের অনুগামী হয়, তাদের সাথে মিলিত করব তাদের সন্তান-সন্ততিকে এবং তাদের কর্মফল আমি কিছুমাত্র হ্রাস করবনা, প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ কৃতকর্মের জন্য দায়ী। ( সূরা তুর:২১)

১৯৮
জান্নাতের ছায়ানীড়ের বিবরণ:
(১) মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

وَالَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ سَنُدْخِلُهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا لَهُمْ فِيهَا أَزْوَاجٌ مُطَهَّرَةٌ وَنُدْخِلُهُمْ ظِلًّا ظَلِيلًا ﴿57﴾ { النساء :৫৭}

যারা ঈমান আনে ও নেক কাজ করে তাদেরকে দাখিল করব জান্নাতে যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে, সেখানে তাদের জন্য পবিত্র সঙ্গি থাকবে এবং তাদেরকে চির স্নিগ্ধ ছায়ায় দাখিল করব। {সূরা নিসা :৫৭}

(২) মহান আল্লাহ তাআলা আরো বলেন:

وَأَصْحَابُ الْيَمِينِ مَا أَصْحَابُ الْيَمِينِ ﴿27﴾ فِي سِدْرٍ مَخْضُودٍ ﴿28﴾ وَطَلْحٍ مَنْضُودٍ ﴿29﴾ وَظِلٍّ مَمْدُودٍ ﴿30﴾ { الواقعة : ২৭ ــ ৩০}

আর ডান দিকের দল, কত ভাগ্যবান ডানদিকের দল! তারা থাকবে এমন উদ্যানে, সেখানে আছে কণ্টকহীন কূলবৃক্ষ, কাঁদি ভরা কদলী বৃক্ষ, সম্প্রসারিত ছায়া।{সূরা ওয়াকিয়া:২৭-৩০}

(৩) অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

مُتَّكِئِينَ فِيهَا عَلَى الْأَرَائِكِ لَا يَرَوْنَ فِيهَا شَمْسًا وَلَا زَمْهَرِيرًا ﴿13﴾ وَدَانِيَةً عَلَيْهِمْ ظِلَالُهَا وَذُلِّلَتْ قُطُوفُهَا تَذْلِيلًا ﴿14﴾ { الإنسان :১৩ ــ ১৪}

সেখানে তারা সমাসীন হবে সুসজ্জিত আসনে, তারা সেখানে অতিশয় গরম অথবা অতিশয় শীত বোধ করবে না। সন্নিহিত বৃক্ষছায়া তাদের উপর থাকবে এবং তার ফলমূল সম্পূর্ণরূপে তাদের আয়ত্তাধীন করা হবে। { সূরা ইনসান:১৩-১৪}

(৪) আরও ইরশাদ হচ্ছে:

مَثَلُ الْجَنَّةِ الَّتِي وُعِدَ الْمُتَّقُونَ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ أُكُلُهَا دَائِمٌ وَظِلُّهَا تِلْكَ عُقْبَى الَّذِينَ اتَّقَوْا وَعُقْبَى الْكَافِرِينَ النَّارُ ﴿35﴾ { الرعد : ৩৫}

মুত্তাকীগণকে যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তার উপমা এরূপ: তার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, তার ফলসমূহ ও ছায়া চিরস্থায়ী। যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এটি তাদের কর্মফল এবং কাফেরদের কর্মফল অগ্নি। {সূরা রা’দ:৩৫}

১৯৯
জান্নাতের উচ্চতা ও প্রশস্ততা:
(১) মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করা:

وُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ نَاعِمَةٌ ﴿8﴾ لِسَعْيِهَا رَاضِيَةٌ ﴿9﴾ فِي جَنَّةٍ عَالِيَةٍ ﴿10﴾ لَا تَسْمَعُ فِيهَا لَاغِيَةً ﴿11﴾

{ الغاشية : 8 ـ 11}

অনেক মুখমন্ডল সেদিন হবে আনন্দোজ্জ্বোল, নিজেদের কর্ম-সাফল্যে পরিতৃপ্ত, সুমহান জান্নাতে- সেখানে তারা অসার বাক্য শুনবে না। { সূরা গাশিয়া:৮ - ১১}

(২) আরও ইরশাদ হয়েছে:

وَسَارِعُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ ﴿133﴾ { آل عمران :১৩৩}

তোমরা ধাবমান হও স্বীয় প্রতিপালকের ক্ষমার দিকে এবং সেই জান্নাতের দিকে যার বিস্তৃতি আসমান ও যমীনের ন্যায়, যা প্রস্ত্তত রাখা হয়েছে মুত্তাকীদের জন্য।

{সূরা আলে ইমরান:১৩৩}

(৩) অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

سَابِقُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا كَعَرْضِ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أُعِدَّتْ لِلَّذِينَ آَمَنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ ذَلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ ﴿21﴾ { الحديد : ২১}

তোমরা অগ্রণী হও তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমা ও সেই জান্নাত লাভের প্রয়াসে যা প্রশস্ততায় আকাশ ও পৃথিবীর ন্যায়, যা প্রস্ত্তত করা হয়েছে তাদের জন্য যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের প্রতি ঈমান আনে। এটি আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা তিনি তা দান করেন; আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল। {সূরা আল হাদীদ:২১}

২০০
জান্নাতের সর্বোচ্চ সম্মানিত স্থান:
عن عبد الله بن عمرو بن العاص رضي الله عنهما أنه سمع النبي صلى الله عليه وسلم يقول : إذا سمعتم المؤذن فقولوا مثل ما يقول , ثم صلوا علي , فإنه من صلى علي صلاة صلى الله عليه بها عشرا , ثم سلوا الله لي الوسيلة , فإنها منزلة في الجنة لا تنبغي إلا لعبد من عباد الله , و أرجو أن أكون أنا هو , فمن سأل لي الوسيلة حلت له الشفاعة . أخرجه مسلم .

সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ইরশাদ করতে শুনেছেন: মুয়াযযিনের আযান শুনলে সে যা বলে তোমরা তার অনুরূপ বলবে, অত:পর আমার উপর দরূদ পড়বে, কেননা যে আমার উপর একবার দরূদ পড়ে মহান আল্লাহ এর পরিবর্তে তার উপর দশটি রহমত নাযিল করে। অত:পর আল্লাহর কাছে আমার জন্য ওসীলা প্রার্থনা করবে, এটি জান্নাতের (বিশেষ) একটি স্থান যা আল্লাহর (বিশেষ) বান্দা ভিন্ন অন্য কারো জন্য প্রযোজ্য নয়। আর আমার বাসনা সে বিশেষ ব্যক্তিটি আমিই হই। সুতরাং যে আমার জন্য ওসীলার প্রার্থনা করবে তার জন্য (আমার) শাফাআত বৈধ হয়ে যাবে [বর্ণনায় সহীহ মুসলিম। হাদীস নং (৩৮৪)]।

২০১
জান্নাতের সর্বোচ্চস্তর ও সর্বনিম্নস্তরের অধিকারীগণ:
عن المغيرة بن شعبة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : سأل موسى ربه : ما أدنى أهل الجنة منزلة؟ قال : هو رجل يجيء بعد ما أدخل أهل الجنة الجنة فيقال له : ادخل الجنة , فيقول : أي رب كيف وقد نزل الناس منازلهم و أخذوا أخذاتهم؟

فيقال له : أ ترضى أن يكون لك مثل ملك ملك من ملوك الدنيا؟ فيقول : رضيت رب , فيقول : لك ذلك ومثله , ومثله , ومثله , ومثله , فقال في الخامسة رضيت رب , فيقول : هذا لك و عشرة أمثاله , ولك ما اشتهت نفسك , ولذت عينك , فيقول : رضيت رب .

قال : رب فأعلاهم منزلة؟ قال : أولئك الذين أردت , غرست كرامتهم بيدي , وختمت عليها , فلم تر عين , ولم تسمع أذن , ولم يخطر على قلب بشر , قال : ومصداقه في كتاب الله عز وجل : ﴿ فَلَا تَعْلَمُ نَفْسٌ مَا أُخْفِيَ لَهُمْ مِنْ قُرَّةِ أَعْيُنٍ ﴾ . أخرجه مسلم .

وفي لفظ في بيان أدنى أهل الجنة : فإن لك مثل الدنيا و عشرة أمثالها . متفق عليه

বিশিষ্ট সাহাবী মুগীরা বিন শো’বা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: মূসা (আলাইহিস সালাম) স্বীয় রবকে জিজ্ঞেস করলেন: অবস্থানের দিক থেকে সর্ব নিম্নস্তরের জান্নাতী কে? বললেন: সে এমন এক ব্যক্তি যে জান্নাতীদের জান্নাতে প্রবেশ করার সময় এসে উপস্থিত হবে, তখন তাকে বলা হবে: তুমিও জান্নাতে প্রবেশ কর, সে বলবে: হে রব! কি ভাবে প্রবেশ করব। অথচ লোকেরা তাদের নিজ নিজ স্থানে অবতরণ করেছ এবং যা নেয়ার নিয়ে নিয়েছে ?

তখন তাকে বলা হবে: তোমাকে যদি পৃথিবীর একজন রাজার রাজত্বের সমপরিমাণ দেয়া হয় তুমি কি তাতে সন্তুষ্ট? সে বলবে: আমি সন্তুষ্ট প্রভু। বলা হবে: তোমাকে সেটি দেয়া হল এবং তার সাথে এর সমপরিমাণ, এবং এর সমপরিমাণ এবং এর সমপরিমাণ, এবং এর সমপরিমাণ পঞ্চমবারে সে বলবে: আমি সন্তুষ্ট প্রভু। তখন বলবে: তোমাকে সেগুলো দেয়া হল এবং তার সাথে আরো দশগুন। সেথায় তোমার জন্য রয়েছে যা তোমার মন চাইবে এবং যাতে দৃষ্টি তৃপ্ত ও শীতল হবে। সে বলবে: আমি সন্তুষ্ট হে প্রভু।

মূসা (আলাইহিস সালাম) বললেন: তাহলে তাদের সর্বোচ্চ স্তরের অধিকারী কে? ওরা হচ্ছে, যাদের আমি নিজেই কামনা করেছি, নিজের হাতে তাদের সম্মান-মর্যাদা বপন করেছি, এবং তার উপর মহর এঁটে দিয়েছি। সুতরাং কোন চক্ষু দেখেনি, কোন কান শোনেনি এবং কোন হৃদয় কল্পনা করতে পারেনি। বলেন: এর সত্যায়ন কুরআনুল কারীমে এভাবে হয়েছে: কেউই জানে না তাদের জন্য নয়নপ্রীতিকর কী লুক্কায়িত রাখা হয়েছে। [সহীহ মুসলিম। (১৮৯)]

অন্য এক বর্ণনায় জান্নাতের সর্ব নিম্নস্তরের বিবরণ এভাবে বিবৃত হয়েছে যে,

فإن لك مثل الدنيا و عشرة أمثالها . متفق عليه .

তোমার জন্য রয়েছে দুনিয়া সমপরিমাণ ও তার দশগুন। [বর্ণনায় বুখারী (৬৫৭১) ও মুসলিম (১৮৬)।]

২০২
জান্নাতবাসীদের সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত:
(১) মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন:

وَعَدَ اللَّهُ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِي جَنَّاتِ عَدْنٍ وَرِضْوَانٌ مِنَ اللَّهِ أَكْبَرُ ذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ ﴿72﴾ { التوبة : ৭২}

আল্লাহ তাআলা মুমিন নর ও মুমিন নারীদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জান্নাতের- যার তলদেশে নদী প্রবাহিত, যেথায় তার স্থায়ী হবে এবং স্থায়ী জান্নাতে উত্তম বাসস্থানের। আর আল্লাহর সন্তুষ্টিই সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সেটিই মহাসাফল্য।

(২) মহান আল্লাহ আরো বলেন:

وُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ نَاضِرَةٌ ﴿22﴾ إِلَى رَبِّهَا نَاظِرَةٌ ﴿23﴾ { القيامة :২২ـ ২৩}

সেদিন কোন কোন মুখমন্ডল হবে উজ্জ্বল। তারা তাদের প্রতিপালকের দিকে তাকিয়ে থাকবে। { কিয়ামাহ:২২-২৩}

(৩) হাদীসে এসেছে

وعن أبي هريرة رضي الله عنه أن ناسا قالوا لرسول الله صلى الله عليه وسلم : يا رسول الله هل نرى ربنا يوم القيامة؟ فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم : هل تضارون في رؤية القمر ليلة البدر؟ قالوا : لا يا رسول الله , قال : هل تضارون في الشمس ليس دونها سحاب؟ قالوا : لا يا رسول الله , قال : فإنكم ترونه كذلك . متفق عليه .

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, কতিপয় ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাকে জিজ্ঞেস করল: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা কি কিয়ামত দিবসে আমাদের রব-আল্লাহ তাআলাকে দেখতে পাব? রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন: পূর্ণিমা রাত্রিতে চাঁদ দেখতে তোমরাকি কোন অসুবিধা বোধ কর? তারা বলল: না, হে আল্লাহর রাসূল। বললেন: মেঘহীন আকাশে সূর্য দেখতে তোমাদের কোন অসুবিধা হয়? তারা বলল: না, হে আল্লাহর রাসূল। রাসূলুল্লাহ বললেন: তোমরা অবশ্যই তাঁকে এভাবে দেখতে পাবে। [বর্ণনায় বুখারী (৮০৬) ও মুসলিম (১৮২) ।]

(৪) হাদীসে আরো এসেছে

وعن صهيب رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال : إذا دخل أهل الجنة الجنة , قال : يقول الله تبارك وتعالى , تريدون شيئا أزيدكم؟ فيقولون : ألم تبيض وجوهنا؟ ألم تدخلنا الجنة , وتنجنا من النار؟ قال : فيكشف الحجاب , فما أعطوا شيئا أحب إليهم من النظر إلى ربهم عز وجل . أخرجه مسلم .

সুহায়ব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন: যখন জান্নাতীরা জান্নাতে প্রবেশ করবে। আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তাআলা বলবেন: তোমরা কি কিছু চাও আমি বাড়িয়ে দেব? তারা বলবে: আপনি কি আমাদের চেহারা শুভ্র উজ্জ্বল করেননি ? আপনি কি আমাদের জান্নাতে প্রবেশ করাননি এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেননি? তিনি বলেন: এরপর আল্লাহ পর্দা উন্মোচন করবেন। স্বীয় প্রতিপালক পানে দৃষ্টিপাত অপেক্ষা অধিক প্রিয় কোন নিয়ামত তাদের ইত:পূর্বে আর দেয়া হয়নি। [সহীহ মুসলিম (১৮১)]

২০৩
জান্নাতের নিয়ামতরাজির বিবরণ
জান্নাত ও তার বহুবিধ নিয়ামতের কিছু সংক্ষিপ্ত বিবরণ এখানে উপস্থাপন করা হল। আল্লাহ আমি-আপনি সহ বিশ্বের বিগত-আগত সকল মুসলিমদের উক্ত জান্নাতের অধিকারী হওয়ারাতওফিক দিন। তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ দাতা পরম দয়ালু।

(১) আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

الَّذِينَ آَمَنُوا بِآَيَاتِنَا وَكَانُوا مُسْلِمِينَ ﴿69﴾ ادْخُلُوا الْجَنَّةَ أَنْتُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ تُحْبَرُونَ ﴿70﴾ يُطَافُ عَلَيْهِمْ بِصِحَافٍ مِنْ ذَهَبٍ وَأَكْوَابٍ وَفِيهَا مَا تَشْتَهِيهِ الْأَنْفُسُ وَتَلَذُّ الْأَعْيُنُ وَأَنْتُمْ فِيهَا خَالِدُونَ ﴿71﴾ وَتِلْكَ الْجَنَّةُ الَّتِي أُورِثْتُمُوهَا بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ ﴿72﴾ لَكُمْ فِيهَا فَاكِهَةٌ كَثِيرَةٌ مِنْهَا تَأْكُلُونَ ﴿73﴾ { الزخرف : ৬৯ـ ৭৩}

যারা আমার আয়াতে বিশ্বাস স্থাপন করেছিল এবং তারা ছিল (আত্মসমর্পণকারী) মুসলমান। (তাদের বলা হবে) জান্নাতে প্রবেশ কর তোমরা এবং তোমাদের সহধর্মিণিগণ সানন্দে। স্বর্ণের থালা ও পানপাত্র নিয়ে তাহাদিগকে প্রদক্ষিণ করা হবে, সেখানে রয়েছে সমস্ত কিছু, যা অন্তর চায় এবং যাতে নয়ন তৃপ্ত হয়। সেখানে তোমরা স্থায়ী হবে। এটিই জান্নাত, তোমাদেরকে যার অধিকারী করা হয়েছে, তোমাদের কর্মের ফলস্বরূপ। সেখানে তোমাদের জন্য রয়েছে প্রচুর ফলমূল, যা হতে তোমরা আহার করবে।

{সূরা যুখরুফ:৬৯-৭৩}

(২) আরও ইরশাদ হচ্ছে:

إِنَّ الْمُتَّقِينَ فِي مَقَامٍ أَمِينٍ ﴿51﴾ فِي جَنَّاتٍ وَعُيُونٍ ﴿52﴾ يَلْبَسُونَ مِنْ سُنْدُسٍ وَإِسْتَبْرَقٍ مُتَقَابِلِينَ ﴿53﴾ كَذَلِكَ وَزَوَّجْنَاهُمْ بِحُورٍ عِينٍ ﴿54﴾ يَدْعُونَ فِيهَا بِكُلِّ فَاكِهَةٍ آَمِنِينَ ﴿55﴾ لَا يَذُوقُونَ فِيهَا الْمَوْتَ إِلَّا الْمَوْتَةَ الْأُولَى وَوَقَاهُمْ عَذَابَ الْجَحِيمِ ﴿56﴾ { الدخان :৫১ ــ ৫৬}

মুত্তাকীরা থাকবে নিরাপদ স্থানে- উদ্যান ও ঝর্ণার মাঝে, তারা পরিধান করবে মিহি ও পুরু রেশমী বস্ত্র এবং মুখামুখি হয়ে বসবে। এরূপই ঘটবে; আমি তাদেরকে সঙ্গি দান করবে আয়তলোচনা হূর, সেখানে তারা প্রশান্ত চিত্তে বিবিধ ফলমূল আনতে বলবে। প্রথম মৃত্যুর পর তারা সেখানে আর মৃত্যু আস্বাদন করবে না। আর তাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি হতে রক্ষা করবেন। {সূরা দুখান:৫১-৫৬}

(৩) আরও ইরশাদ হচ্ছে:

وَجَزَاهُمْ بِمَا صَبَرُوا جَنَّةً وَحَرِيرًا ﴿12﴾ مُتَّكِئِينَ فِيهَا عَلَى الْأَرَائِكِ لَا يَرَوْنَ فِيهَا شَمْسًا وَلَا زَمْهَرِيرًا ﴿13﴾ وَدَانِيَةً عَلَيْهِمْ ظِلَالُهَا وَذُلِّلَتْ قُطُوفُهَا تَذْلِيلًا ﴿14﴾ وَيُطَافُ عَلَيْهِمْ بِآَنِيَةٍ مِنْ فِضَّةٍ وَأَكْوَابٍ كَانَتْ قَوَارِيرَ ﴿15﴾ قَوَارِيرَ مِنْ فِضَّةٍ قَدَّرُوهَا تَقْدِيرًا ﴿16﴾ وَيُسْقَوْنَ فِيهَا كَأْسًا كَانَ مِزَاجُهَا زَنْجَبِيلًا ﴿17﴾ عَيْنًا فِيهَا تُسَمَّى سَلْسَبِيلًا ﴿18﴾ وَيَطُوفُ عَلَيْهِمْ وِلْدَانٌ مُخَلَّدُونَ إِذَا رَأَيْتَهُمْ حَسِبْتَهُمْ لُؤْلُؤًا مَنْثُورًا ﴿19﴾ وَإِذَا رَأَيْتَ ثَمَّ رَأَيْتَ نَعِيمًا وَمُلْكًا كَبِيرًا ﴿20﴾ عَالِيَهُمْ ثِيَابُ سُنْدُسٍ خُضْرٌ وَإِسْتَبْرَقٌ وَحُلُّوا أَسَاوِرَ مِنْ فِضَّةٍ وَسَقَاهُمْ رَبُّهُمْ شَرَابًا طَهُورًا ﴿21﴾ إِنَّ هَذَا كَانَ لَكُمْ جَزَاءً وَكَانَ سَعْيُكُمْ مَشْكُورًا ﴿22﴾{ الإنسان :১২ ــ ২২}

আর তাদের ধৈর্যশীলতার পুরস্কারস্বরূপ তাদেরকে দেবেন উদ্যান ও রেশমী বস্ত্র। সেখানে তারা সমাসীন হবে সুসজ্জিত আসনে, তারা সেখানে অতিশয় গরম অথবা অতিশয় শীত অনুভব করবে না। সন্নিহিত বৃক্ষছায়া তাদের উপর থাকবে এবং তার ফলমূল সম্পূর্ণরূপে তাদের আয়ত্তাধীন করা হবে। তাদেরকে পরিবেশন করা হবে রৌপ্যপাত্রে এবং স্ফটিকের মত স্বচ্ছ পানপাত্রে- রজতশুভ্র স্ফটিক পাত্রে, পরিবেশন কারীরা যথাযথ পরিমাণে তা পূর্ণ করবে। সেথায় তাদেরকে পান করতে দেয়া হবে যানজাবীল (আদ্রক) মিশ্রিত পানীয়, জান্নাতের এমন এক প্রস্রবণের যার নাম সালসাবীল। তাদেরকে পরিবেশন করবে চিরকিশোরগণ, যখন তুমি তাদেরকে দেখবে তখন মনে করবে তারা যেন বিক্ষিপ্ত মুক্তা। তুমি যখন সেখানে দেখবে, দেখতে পাবে ভোগ-বিলাসের উপকরণ এবং বিশাল রাজ্য। তাদের আবরণ হবে সূক্ষ্ম সবুজ রেশম ও স্থুল রেশম, তারা অলংকৃত হবে রৌপ্য নির্মিত কংকনে, আর তাদের প্রতিপালক তাদেরকে পান করাবেন বিশুদ্ধ পানীয়। অবশ্য, ইটিই তোমাদের পুরস্কার এবং তোমাদের কর্মপ্রচেষ্টা স্বীকৃত। {সূরা ইনসান:১২-২২}

(৪) অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

وَالسَّابِقُونَ السَّابِقُونَ ﴿10﴾ أُولَئِكَ الْمُقَرَّبُونَ ﴿11﴾ فِي جَنَّاتِ النَّعِيمِ ﴿12﴾ ثُلَّةٌ مِنَ الْأَوَّلِينَ ﴿13﴾ وَقَلِيلٌ مِنَ الْآَخِرِينَ ﴿14﴾ عَلَى سُرُرٍ مَوْضُونَةٍ ﴿15﴾ مُتَّكِئِينَ عَلَيْهَا مُتَقَابِلِينَ ﴿16﴾ يَطُوفُ عَلَيْهِمْ وِلْدَانٌ مُخَلَّدُونَ ﴿17﴾ بِأَكْوَابٍ وَأَبَارِيقَ وَكَأْسٍ مِنْ مَعِينٍ ﴿18﴾ لَا يُصَدَّعُونَ عَنْهَا وَلَا يُنْزِفُونَ ﴿19﴾ وَفَاكِهَةٍ مِمَّا يَتَخَيَّرُونَ ﴿20﴾ وَلَحْمِ طَيْرٍ مِمَّا يَشْتَهُونَ ﴿21﴾ وَحُورٌ عِينٌ ﴿22﴾ كَأَمْثَالِ اللُّؤْلُؤِ الْمَكْنُونِ ﴿23﴾ جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ ﴿24﴾ لَا يَسْمَعُونَ فِيهَا لَغْوًا وَلَا تَأْثِيمًا ﴿25﴾ إِلَّا قِيلًا سَلَامًا سَلَامًا ﴿26﴾ { الواقعة :১০ ــ ২৬}

আর অগ্রবর্তীগণই তো অগ্রবর্তী, তারাই নৈকট্যপ্রাপ্ত-নিয়ামতপূর্ণ উদ্যানে; বহু সংখ্যক হবে পূর্ববর্তীদের মধ্য হতে; এবং অল্প সংখ্যক হবে পরবর্তীদের মধ্য হতে। স্বর্ণ-খচিত আসনে। তারা হেলান দিয়ে বসবে, পরস্পর মুখামুখি হয়ে। তাদের সেবায় ঘোরাফিরা করবে চির-কিশোরেরা। পানপাত্র , কুঁজা ও প্রস্রবণ নিঃসৃত সুরাপূর্ণ পেয়ালা নিয়ে। সে সুরা পানে তাদের শিরঃপীড়া হবে না এবং তারা জ্ঞানহারাও হবে না। এবং তাদের পছন্দমত ফলমূল, আর তাদের ঈপ্সিত পাখীর গোশত নিয়ে, আর (তাদের জন্য থাকবে) আয়তলোচনা হূর, সুরক্ষিত মুক্তাসদৃশ, তাদের কর্মের পুরস্কারস্বরূপ। সেখানে তারা শুনবে না কোন অসার ও পাপবাক্য, সালাম আর সালাম বাণী ব্যতীত।

{সূরা ওয়াকিয়া :১০-২৬}

(৫) আরও ইরশাদ হচ্ছে:

وَأَصْحَابُ الْيَمِينِ مَا أَصْحَابُ الْيَمِينِ ﴿27﴾ فِي سِدْرٍ مَخْضُودٍ ﴿28﴾ وَطَلْحٍ مَنْضُودٍ ﴿29﴾ وَظِلٍّ مَمْدُودٍ ﴿30﴾ وَمَاءٍ مَسْكُوبٍ ﴿31﴾ وَفَاكِهَةٍ كَثِيرَةٍ ﴿32﴾ لَا مَقْطُوعَةٍ وَلَا مَمْنُوعَةٍ ﴿33﴾ وَفُرُشٍ مَرْفُوعَةٍ ﴿34﴾ إِنَّا أَنْشَأْنَاهُنَّ إِنْشَاءً ﴿35﴾ فَجَعَلْنَاهُنَّ أَبْكَارًا ﴿36﴾ عُرُبًا أَتْرَابًا ﴿37﴾ لِأَصْحَابِ الْيَمِينِ ﴿38﴾ ثُلَّةٌ مِنَ الْأَوَّلِينَ ﴿39﴾ وَثُلَّةٌ مِنَ الْآَخِرِينَ ﴿40﴾ { الواقعة :২৭ ــ ৪০}

আর ডান দিকের দল, কত ভাগ্যবান ডান দিকের দল। তারা থাকবে এমন উদ্যানে, সেখানে আছে কণ্টকহীন কুলবৃক্ষ। কাঁদি ভরা কদলী বৃক্ষ, সম্প্রসারিত ছায়া, সদা প্রবহমান পানি, ও প্রচুর ফলমূল। যা শেষ হবে না এবং যা নিষিদ্ধও হবে না। আর সমুচ্চ শয্যাসমূহ; ওদেরকে (হূর) আমি সৃষ্টি করেছি বিশেষরূপে। তাদেরকে করেছি কুমারী, সোহাগিনী ও সমবয়স্কা, ডানদিকের লোকদের জন্য। তাদের অনেকে হবে পূর্ববর্তীদের মধ্য হতে। এবং অনেকে হবে পরবর্তীদের মধ্য হতে। {সূরা ওয়াকিয়া: ২৭-৪০}

(৬) হাদীসে এসেছে

وعن أبي هريرة رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال : قال الله عز و جل : أعددت لعبادي الصالحين ما لا عين رأت , ولا أذن سمعت , ولا خطر على قلب بشر . مصداق في كتاب الله﴿ فَلَا تَعْلَمُ نَفْسٌ مَا أُخْفِيَ لَهُمْ مِنْ قُرَّةِ أَعْيُنٍ جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ ﴿17﴾ متفق عليه

সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করছেন, আল্লাহ তাআলা বলেন: আমি আমার নেক বান্দাদের জন্য এমন (সুন্দর নেয়ামতরাজি) তৈরী করে রেখেছি, যা কখনো কোন চক্ষু দেখেনি, কোন কান শুনেনি এবং কোন মানুষের হৃদয় কল্পনাও করেনি। আল-কুরআনে এর সত্যায়ন হয়েছে এভাবে: ‘কেউই জানেনা তাদের জন্য নয়ন প্রীতিকর কী লুক্কায়িত রাখা হয়েছে, তাদের কৃতকর্মের পুরস্কারস্বরূপ [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং বুখারী (৩২৪৪) মুসলিম ( ২৮২৪)।]।

২০৪
জান্নাতবাসীদের কথাবার্তা ও যিকির:
(১) মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করছেন:

وَقَالُوا الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي صَدَقَنَا وَعْدَهُ وَأَوْرَثَنَا الْأَرْضَ نَتَبَوَّأُ مِنَ الْجَنَّةِ حَيْثُ نَشَاءُ فَنِعْمَ أَجْرُ الْعَامِلِينَ ﴿74﴾ { الزمر :৭৪}

তারা প্রবেশ করে বলবে, প্রশংসা আল্লাহর যিনি আমাদের প্রতি তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছেন এবং আমাদেরকে অধিকারী করেছেন এ ভূমির ; আমরা জান্নাতে যেখানে ইচ্ছা বসবাস করব। সদাচারীদের পুরস্কার কত উত্তম। { যুমার :৭৪}

(২) আল্লাহ আরও বলেন:

دَعْوَاهُمْ فِيهَا سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَتَحِيَّتُهُمْ فِيهَا سَلَامٌ وَآَخِرُ دَعْوَاهُمْ أَنِ الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ ﴿10﴾ { يونس :10}

সেখানে তাদের ধ্বনি হবে: হে আল্লাহ তুমি মহান পবিত্র! এবং সেখানে তাদের অভিবাদন হবে, সালাম এবং তাদের শেষ ধ্বনি হবে এই : সকল প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর প্রাপ্য। {সূরা ইউনুস:১০}

(৩) অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

لَا يَسْمَعُونَ فِيهَا لَغْوًا وَلَا تَأْثِيمًا ﴿25﴾ إِلَّا قِيلًا سَلَامًا سَلَامًا ﴿26﴾ { الواقعة :২৫ ــ ২৬}

সেখানে তারা কোন অসার ও পাপবাক্য শুনবে না। সালাম আর সালাম বাণী ব্যতীত। {সূরা ওয়াকিয়া:২৫-২৬}

২০৫
জান্নাতবাসীদের প্রতি মহান রবের সালাম:
(১) মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করছেন:

تَحِيَّتُهُمْ يَوْمَ يَلْقَوْنَهُ سَلَامٌ وَأَعَدَّ لَهُمْ أَجْرًا كَرِيمًا ﴿44﴾ { الأحزاب :৪৪}

যেদিন তারা আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবে, সেদিন তাদের প্রতি অভিবাদন হবে ‘সালাম’। তিনি তাদের জন্য প্রস্ত্তত রেখেছেন উত্তম প্রতিদান। {সূরা আহযাব:৪৪}

(২) আরও ইরশাদ হয়েছে:

سَلَامٌ قَوْلًا مِنْ رَبٍّ رَحِيمٍ ﴿58﴾ { يس :৫৮}

‘সালাম’ পরম দয়ালু প্রতিপালকের পক্ষ হতে সম্ভাষণ। {সূরা ইয়াসীন:৫৮}

মহান আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি প্রকাশ:

عن أبي سعيد الخدري رضي الله عنه أن النبي صلى الله عليه وسلم قال : إن الله يقول لأهل الجنة , يا أهل الجنة , فيقولون : لبيك ربنا و سعديك , و الخير في يديك , فيقول : هل رضيتم؟ فيقولون : وما لنا لا نرضى يا رب وقد أعطيتنا ما لم تعط أحدا من خلقك , فيقول : ألا أعطيك أفضل من ذلك؟ فيقولون : يا رب و أي شيء أفضل من ذلك؟ فيقول : أحل عليكم رضواني , فلا أسخط عليكم بعده أبدا . متفق عليه

সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: আল্লাহ তাআলা জান্নাতীদের ডেকে বলবেন: হে জান্নাতবাসীরা, তারা বলে উঠবে: হে আমাদের প্রতিপালক আমরা উপস্থিত, সকল সৌভাগ্য আপনার পক্ষ হতেই, সকল কল্যাণের উৎসও আপনিই। তখন আল্লাহ বলবেন: তোমরা কি সন্তুষ্ট? উত্তরে তারা বলবে: কেন নয়; হে প্রতিপালক, আমাদের সন্তুষ্ট না হওয়ার কি আছে? অথচ আপনি আমাদের এমন সব জিনিস দিয়েছেন যা আপনার অন্য কোন সৃষ্টি দান করেননি। আল্লাহ বলবেন: আমি কি তোমাদের এরচেয়েও উত্তম জিনিস দেব? তারা বলবে: এর চেয়েও উত্তম জিনিস আর কি হতে পারে? আল্লাহ বলবেন: আমার সন্তুষ্টি তোমাদের জন্য অবধারিত করে নিলাম। আজকের পর থেকে আমি আর কোখনো তোমাদের উপর অসন্তুষ্ট হব না [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং বুখারী (৬৫৪৯) ও মুসলিম (২৮২৯)।]।

হে আল্লাহ তুমি আমাদের উপর সন্তুষ্ট হয়ে যাও আরো সন্তুষ্ট হও আমাদের পিতা-মাতা, স্ত্রী-পরিজন, ও সকল মুসলমানদের প্রতি। এবং তোমার অনুগ্রহে আমাদেরকে নেয়ামতপূর্ণ জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে নাও।

২০৬
জান্নাতে উম্মতে মুহাম্মাদীর পরিমাণ:
মহান আল্লাহ তাআলা এ উম্মতকে বিশাল সম্মানে সম্মানিত করেছেন। তিনি জান্নাতের মোট অধিবাসীদের মধ্যে অর্ধেক এ উম্মত থেকে নির্বাচিত করেছেন। অত:পর এ সম্মান আরো বৃদ্ধি করে এ সংখ্যা দুই তৃতীয়াংশ পর্যন্ত উন্নীত করেছেন।

হাদীসে এসেছে

عن عبد الله بن مسعود رضي الله عنه قال : كنا مع النبي صلى الله عليه وسلم في قبة فقال : أترضون أن تكونوا ربع أهل الجنة؟ قلنا نعم , قال : أترضون أن تكونوا ثلث أهل الجنة؟ قلنا نعم , قال : أترضون أن تكونوا شطر أهل الجنة؟ قلنا : نعم , قال : إني لأرجو أن تكونوا شطر أهل الجنة , و ذلك أن الجنة لا يدخلها إلا نفس مسلمة , وما أنتم في أهل الشرك إلا كالشعرة البيضاء في جلد الثور الأسود , أو كالشعرة السوداء في جلد الثور الأحمر . متفق عليه

সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমরা একটি তাঁবুতে নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে অবস্থান করছিলাম, এক সময় নবীজী আমাদের লক্ষ্য করে বললেন: ‘‘তোমরা জান্নাত অধিবাসীদের এক চতুর্থাংশ হবে, এতে কি তোমরা সন্তুষ্ট? আমরা বললাম: হ্যাঁ। তিনি বললেন: তোমরা জান্নাত অধিবাসীদের এক তৃতীয়াংশ হবে, এতে কি তোমরা সন্তুষ্ট? আমরা বললাম: হ্যাঁ। তিনি বললেন: তোমরা জান্নাত অধিবাসীদের অর্ধেক হবে এতে কি তোমরা রাজি? আমরা বললাম:হ্যাঁ। [এরপর নবীজী ] বললেন: আমি চাই তোমরা জান্নাত অধিবাসীদের অর্ধেক হবে। আর এটি এ কারণে যে, জান্নাতে শুধুমাত্র মুসলিম সত্ত্বাই প্রবেশ করতে পারবে। আর শিরক কারীদের মধ্যে তোমাদের অবস্থান হচ্ছে, কালো [রং বিশিষ্ট] বলদের চামড়ায় সাদা পশম সদৃশ। অথবা লাল বলদের চামড়ায় কালো পশম সদৃশ। [বর্ণনায় বৃখারী ও মুসলিম। হাদীস নং যথাক্রমে (৬৫২৮) ও (২২১)]

২০৭
জান্নাতবাসীদের কাতার:
عن بريدة رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : أهل الجنة عشرون و مائة صف , ثمانون منها من هذة الأمة , و أربعون من سائر الأمم . أخرجه الترمذي و ابن ماجة .

সাহাবী বুরাইদা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: জান্নাত অধিবাসীরা মোট একশত বিশ কাতার হবে, তার মাঝে আশি কাতার হবে এ উম্মত থেকে, আর অবশিষ্ট চল্লিশ কাতার হবে অন্য সকল উম্মত থেকে। [হাদীসের সনদ সহীহ । বর্ণনায় তিরমিযী (২৫৪৬) ও ইবনে মাজাহ (৪২৮৯)।]

২০৮
জান্নাত অধিবাসী:
(১) মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

وَالَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ ﴿82﴾ { البقرة :৮২}

আর যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে, তারাই হচ্ছে জান্নাত অধিবাসী, সেথায় তারা চিরদিন থাকবে। [সূরা বাকারা:৮২]

(২) হাদীসে এসেছে

وعن عياض بن حمار رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال :... وأهل الجنة ثلاثة : ذو سلطان مقسط متصدق موفق , ورجل رحيم رقيق القلب لكل ذي قربى و مسلم , وعفيف متعفف ذو عيال ... . أخرجه مسلم .

সাহাবী ইয়ায বিন হিমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: ... আর জান্নাত অধিবাসী হচ্ছে তিন শ্রেণীর লোক: রাজত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী ন্যায় পরায়ণ দানশীল তাওফীক প্রাপ্ত, দয়ালু ব্যক্তি-সকল আত্মীয় পরিজন ও মুসলমানের জন্য যার অন্তর সদা সদয় এবং সচ্চরিত্র সংযমশীল (অনেক) সন্তান-সন্ততির মালিক...। [সহীহ মুসলিম , হাদীস নং (২৮৬৫)।]

(৩) হাদীসে এসেছে

وعن حارثة بن وهب رضي الله عنه أنه سمع النبي صلى الله عليه وسلم قال : ألا أخبركم بأهل الجنة؟ قالوا : بلى , قال صلى الله عليه وسلم : كل ضعيف متضعف لو أقسم على الله لأبره ... متفق عليه

হারিসা বিন ওহাব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ইরশাদ করতে শুনেছেন, আল্লাহর রাসূল বলেন: আমি কি তোমাদের জান্নাতবাসী সম্মর্কে সংবাদ দেব না? লোকরা বলল: হ্যাঁ। তিনি বললেন: প্রত্যেক নিরিহ-নিরহঙ্কার দুর্বল ব্যক্তি, যদি আল্লাহর নামে শপথ করে আল্লাহ তার শপথ পূর্ণ করার ব্যবস্থা করে দেন। [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং যথাক্রমে (৪৯১৮) ও (২৮৫৩)।]

২০৯
অধিকাংশ জান্নাতবাসী:
عن عمران بن حصين رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال : اطلعت في الجنة فرأيت أكثر أهلها الفقراء , واطلعت في النار فرأيت أكثر أهلها النساء . متفق عليه

সাহাবী ইমরান বিন হুসায়ন রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করছেন, নবীজী বলেন: আমি জান্নাতে দৃষ্টি দিয়েছি, দেখেছি তার অধিকাংশ অধিবাসী হচ্ছে দরিদ্র ব্যক্তিবর্গ, এবং জাহান্নামে দৃষ্টি দিয়েছে, সেখানে দেখেছি তার অধিকাংশ অধিবাসী হচ্ছে নারী। [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং যথাক্রমে (৩২৪১) ও (২৭৩৭)।]

২১০
সর্বশেষ যিনি জান্নাতে প্রবেশ করবেন:
عن عبد الله بن مسعود رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : إن آخر أهل الجنة دخولا الجنة , وآخر أهل النار خروجا من النار : رجل يخرج حبوا , فيقول له ربه : ادخل الجنة , فيقول : رب , الجنة ملأى , فيقول له ذلك ثلاث مرات , فكل ذلك يعيد عليه : الجنة ملأى , فيقول : إن لك مثل الدنيا عشر مرار . متفق عليه

বিশিষ্ট সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: ‘‘জাহান্নাম থেকে বের হয়ে জান্নাতে প্রবেশকারী সর্বশেষ ব্যক্তি, যে (জাহান্নাম থেকে) হামাগুড়ি দিয়ে বের হয়ে আসবে। তখন তার রব তাকে বলবেন: তুমি জান্নাতে প্রবেশ কর। সে বলবে: প্রভু, জান্নাততো পরিপূর্ণ। (তার রব) তাকে এভাবে তিন বার বলবেন: প্রতিবারই সে বলবে: জান্নাততো পরিপূর্ণ। অত:পর মহান রব বলবেন: তোমার জন্য দুনিয়াসম দশগুন বরাদ্দ দেয়া হল’’। [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং যথাক্রমে (৭৫১১) ও (১৮৬)।]

২১১
জাহান্নামের বিবরণ
জাহান্নাম হচ্ছে আযাবের আবাস যেটি মহান আল্লাহ তাআলা পরকালে কাফের, মুনাফেক এবং বদকার মুমিনদের জন্য তৈরী করেছেন।

এখানে আমরা আল্লাহ চাহেতো ধ্বংসের আবাস জাহান্নাম ও তার নানাবিধ শাস্তি সম্পর্কে আলোচনা করব। যাতে জাহান্নাম সম্পর্কে মনে ভীতির সঞ্চার হয় এবং তা থেকে বেঁচে থাকার তাড়না সৃষ্টি হয়। জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাত প্রাপ্তির নিশ্চয়তার জন্য অতি জরুরী হচ্ছে ঈমান ও সৎকর্ম সম্পাদন এবং শিরক সহ যাবতীয় অন্যায় অপরাধ পরিহার করণ। মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করছি হে আল্লাহ তুমি আমাদের জান্নাত দান কর এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি প্রদান কর। জাহান্নাম সম্পর্কিত আমাদের আলোচনা কোরআন ও সহীহ হাদীসে বর্ণিত বিষয়াবলীর মাঝেই সীমিত থাকবে।

২১২
জাহান্নামের প্রসিদ্ধ কিছু নামঃ
সত্ত্বাগত ভাবে জাহান্নাম মূলত একটিই তবে প্রকৃতি ও বৈশিষ্টের দিক থেকে এর মধ্যে বিভিন্নতা রয়েছে। নিম্নে তার কিছু প্রসিদ্ধ নাম উল্লেখ করা হল।

১-আন্ নার: আল্লাহ তাআলা বলেন:

و من يعص الله و رسوله ويتعد حدوده يدخله نارا خالدا فيها و له عذاب مهين . { النساء :১৪}

যে কেউ আল্লাহ ও রাসূলের অবাধ্যতা করে এবং তার সীমা অতিক্রম করে তিনি তাকে নার তথা আগুনে প্রবেশ করাবেন। সে সেখানে চিরকাল থাকবে।তার জন্য রয়েছে অপমান জনক শাস্তি। {সূরা নিসা:১৪}

২- জাহান্নাম: আল্লাহ তাআলা বলেন:

إن الله جامع المنافقين و الكافرين في جهنم جميعا . { النساء :১৪০}

আল্লাহ তাআলা জাহান্নামের মাঝে মুনাফেক ও কাফেরদেরকে একই জায়গায় সমবেত করবেন।{সূরা নিসা:১৪০}

৩-আল-জা‘হীম: আল্লাহ ইরশাদ করছেন:

والذين كفروا وكذبوا بآياتنا أولئك أصحاب الجحيم . { المائدة :১০}

যারা অবিশ্বাস করে এবং আমার নিদর্শনাবলীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে তারা জাহীম তথা জাহান্নামের অধিবাসী।{সূরা মায়েদা:১০}

৪-আস-সা‘ঈর: আল্লাহ তাআলা বলছেন:

إن الله لعن الكافرين و أعد لهم سعيرا . { الأحزاب :৬৪}

নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরদেরকে অভিসম্পাত করেছেন এবং তাদের জন্য সা‘ঈর তথা জ্বলন্ত অগ্নি (জাহান্নাম) প্রস্ত্তত রেখেছেন। {সূরা আহযাব:৬৪}

৫-সাক্বার: ইরশাদ হচ্ছে:

يوم يسحبون في النار على وجوههم ذوقوا مس سقر . { القمر :৪৮}

যেদিন তাদেরকে মুখ হিঁচড়ে টেনে নেয়া হবে জাহান্নামে, বলা হবেঃ সাক্বার তথা অগ্নির খাদ্য আস্বাদন কর। {সূর কামার:৪৮}

৬-আল্ হোত্বামাহ:আল্লাহ তাআলা বলছেন:

كلا لينبذن في الحطمة وما أدراك ما الحطمة نار الله الموقدة .{ الهمزة :৪-৬}

কখনও না, সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে হোতামাহ তথা পিষ্টকারীর মধ্যে। আপনি কি জানেন পিষ্টকারী কি? এটি আল্লাহর প্রজ্জ্বলিত অগ্নি।{সূরা হুমাযাহ:৪-৬}

৭-লাযা: আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করছেন:

كلا إنها لظى نزاعة للشوى تدعوا من أدبر وتولى . { المعارج :১৫-১৭}

কখনই নয়। নিশ্চয় এটি লাযা তথা লেলিহান অগ্নি। যা মাথা হতে চামড়া তুলে দেবে। সেই ব্যক্তিকে ডাকবে যে সত্যের প্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেছিল ও বিমুখ হয়েছিল।

{সূরা মাআরিজ:১৫-১৭}

৮-দারুল বাওয়ার:আল্লাহ তাআলা বলেন:

أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ بَدَّلُوا نِعْمَةَ اللَّهِ كُفْرًا وَأَحَلُّوا قَوْمَهُمْ دَارَ الْبَوَارِ ﴿28﴾ جَهَنَّمَ يَصْلَوْنَهَا وَبِئْسَ الْقَرَارُ ﴿29﴾ { إبراهيم : ২৮-২৯}

আপনি কি তাদের দেখেননি, যারা আল্লাহর নেয়ামতকে কুফরে পরিণত করেছে এবং স্বজাতিকে সম্মুখীন করেছে দারুল বাওয়ার তথা ধ্বংসের আলয়ে- জাহান্নামের, তারা তাতে প্রবেশ করবে। সেটা কতইনা মন্দ আবাস। {সূরা ইবরাহীম:২৮-২৯}

২১৩
জাহান্নামের অবস্থান:
১-মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করছেন:

كلا إن كتاب الفجار لفي سجين . { المطففين :৭}

কখনই না,নিশ্চয় পাপাচারীদের আমলনামা সিজ্জীনে আছে।{সূরা আত্ তাতফীফ:৭}

২- হাদীসে এসেছে

وعن أبي هريرة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال :((... وأما الكافر فإذا قبضت نفسه وذهب بها إلى باب الأرض يقول خزنة الأرض : ما وجدنا ريحا أنتن من هذه , فتبلغ بها إلى الأرض السفلى )). أخرجه الحاكم وابن حبان .

সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:(( ... আর কাফের! যখন তার জান কবজ করা হয় ও ভূ-মন্ডলের দরজায় নিয়ে যাওয়া হয় তখন দরজার দায়িত্বে নিয়োজিত রক্ষীরা বলে: এর চেয়ে দূর্গন্ধময় বাতাস আমরা আর কখনো পাইনি। অত:পর তাকে ভূ-তলের সর্ব নিম্নস্তরে পৌঁছে দেয়া হবে। [হাদীসটি সহীহ ।বর্ণনায় হাকেম (১৩০৪) ও ইবনু হিববান (৩০১৩)]

২১৪
জাহান্নামবাসীদের স্থায়িত্ব:
কাফের , মুশরিক ও মুনাফিকরা চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামে থাকবে। সেখান থেকে তাদের বের হওয়ার কোন সুযোগ নেই। আর অপরাধী তাওহীদবাদীরা আল্লাহ তাআলার ইচ্ছাধীন থাকবে। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদের ক্ষমা করবেন আর চাইলে অপরাধ অনুপাতে শাস্তি দেবেন।

১-আল্লাহ তাআলা বলেন:

وَعَدَ اللَّهُ الْمُنَافِقِينَ وَالْمُنَافِقَاتِ وَالْكُفَّارَ نَارَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا هِيَ حَسْبُهُمْ وَلَعَنَهُمُ اللَّهُ وَلَهُمْ عَذَابٌ مُقِيمٌ { التوبة :৬৮}

আল্লাহ তাআলা মুনফেক পুরুষ ও মুনফেক নারী এবং কাফেরদের জন্য জাহান্নামের আগুনের ওয়াদা করেছেন। তাতে তারা চিরকাল পড়ে থাকবে। সেটিই তাদের জন্য যথেষ্ট । আল্লাহ তাদের প্রতি অভিসম্পাত করেছেন এবং তাদের জন্য রয়েছে স্থায়ী আযাব। {সূরা তাওবা:৬৮}

২-অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

إن الله لا يغفر أن يشرك به و يغفر ما دون ذلك لمن يشاء . { النساء :৪৮}

নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা তার সাথে শরীক স্থির করার অপরাধ ক্ষমা করেন না তিনি ক্ষমা করেন এরচেয়ে নিম্ন পর্যায়ের অপরাধ যাকে ইচ্ছা ।{সূরা নিসা:৪৮}

২১৫
জাহান্নামীদের চেহারার বিবরণ:
১-আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

ويوم القيامة ترى الذين كذبوا على الله وجوههم مسودة , أليس في جهنم مثوى للمتكبرين . { الزمر :৬০}

যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে, কেয়ামতের দিন আপনি তাদের মুখ কাল দেখবেন। অহংকারীদের আবাসস্থল জাহান্নাম নয় কি? {সূরা যুমার:৬০}

২-অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

وَوُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ عَلَيْهَا غَبَرَةٌ ﴿40﴾ تَرْهَقُهَا قَتَرَةٌ ﴿41﴾ أُولَئِكَ هُمُ الْكَفَرَةُ الْفَجَرَةُ ﴿42﴾

{ عبس :৪০-৪২}

এবং অনেক মুখ মন্ডল সেদিন হবে ধূলি ধূসরিত। তাদেরকে কালিমা আচ্ছন্ন করে রাখবে। তারাই কাফের পাপিষ্ঠের দল।{সূরা আবাসা:৪০-৪২}

৩-আল্লাহ তাআলা আরো বলেন:

وَوُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ بَاسِرَةٌ ﴿24﴾ تَظُنُّ أَنْ يُفْعَلَ بِهَا فَاقِرَةٌ ﴿25﴾

{ القيامة :২৪-২৫}

আর অনেক মুখমন্ডল সেদিন বিবর্ণ হয়ে পড়বে। তারা আশংকা করবে যে তাদের সাথে কোমর ভাঙ্গা আচরণ করা হবে। { সূরা ক্বেয়ামাহ:২৪-২৫}

৪-অন্যত্র বলা হচ্ছে:

وجوه يومئذ خاشعة , عاملة ناصبة , تصلى نارا حامية . { الغاشية :২-৪

অনেক মুখমন্ডল সেদিন হবে ভীত-সন্ত্রস্ত।ক্লিষ্ট,ক্লান্ত।তারা জ্বলন্ত আগুনে পতিত হবে।{সূরা গাশিয়াহ :২-৪}

৫-আরো ইরশাদ হচ্ছে:

تلفح وجوههم النار وهم فيها كالحون .{ المؤمنون :১০৪}

আগুন তাদের মুখমন্ডল দগ্ধ করবে এবং তারা তাতে বীভৎস আকার ধারণ করবে।{সূরা মুমিনূন:১০৪}

২১৬
জাহান্নামের প্রবেশদারের সংখ্যা:
মহান আল্লাহ তাআলা বলছেনঃ

وإن جهنم لموعدهم أجمعين , لها سبعة أبواب لكل باب منهم جزء مقسوم . { الحجر :৪৩-৪৪}

তাদের সবার নির্ধারিত স্থান হচ্ছে জাহান্নাম। এর সাতটি দরজা আছে, প্রত্যেক দরজার জন্য এক-একটি পৃথক দল আছে। {সূরা হিজর:৪৩-৪৪}

২১৭
জাহান্নামের প্রবেশদার নিজ অধিবাসীদের উপর রুদ্ধ:
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেনঃ

إنها عليهم مؤصدة في عمد ممددة .{ الهمزة :৮-৯}

নিশ্চয় তা (আগুন) তাদের উপর দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হবে। উঁচু উঁচু স্তম্ভসমূহে।{সূরা হুমাযাহ:৮-৯}

২১৮
কেয়ামতের ময়দানে জাহান্নামের আগমন:
১-আল্লাহ তাআলা বলেন:

وبرزت الجحيم للغاوين .{ الشعراء :৯১}

এবং বিপথগামীদের সামনে উম্মোচিত করা হবে জাহান্নাম।{সূরা শু‘আরা:৯১}

২-আল্লাহ তাআলা অন্যত্র ইরশাদ করছেন:

كَلَّا إِذَا دُكَّتِ الْأَرْضُ دَكًّا دَكًّا ﴿21﴾ وَجَاءَ رَبُّكَ وَالْمَلَكُ صَفًّا صَفًّا ﴿22﴾ وَجِيءَ يَوْمَئِذٍ بِجَهَنَّمَ يَوْمَئِذٍ يَتَذَكَّرُ الْإِنْسَانُ وَأَنَّى لَهُ الذِّكْرَى ﴿23﴾ { الفجر :২১-২৩}

এটা সঙ্গত নয়, যখন পৃথিবী চূর্ণ-বিচূর্ণ হবে। এবং আপনার পালনকর্তা ও ফেরেশতাগণ সারিবদ্ধভাবে উপস্থিত হবেন। এবং সেদিন জাহান্নামকে আনা হবে, সেদিন মানুষ স্মরণ করবে,কিন্তু এ স্মরণ তার কি কাজে আসবে? {সূরা আল-ফজর: ২১-২৩}

৩- হাদীসে এসেছে

وعن عبد الله بن مسعود رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : (( يؤتى بجهنم يومئذ لها سبعون ألف زمام , مع كل زمام سبعون ألف ملك يجرونها )). أخرجه مسلم

প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কেয়ামতের দিন জাহান্নামকে উপস্থিত করা হবে। তার সত্তর হাজার রশি থাকবে, প্রত্যেক রশির সাথে সত্তর হাজার ফেরেশতা থাকবে যারা তাকে টেনে আনবে। [সহীহ মুসলিম । হাদীস নং (২৮৪২)।]

২১৯
জাহান্নামে পতিত হওয়া ও সর্ব প্রথম পুলসিরাত অতিক্রমকারী:
১-মহান আল্লাহ তাআলা বলছেন:

وَإِنْ مِنْكُمْ إِلَّا وَارِدُهَا كَانَ عَلَى رَبِّكَ حَتْمًا مَقْضِيًّا ﴿71﴾ ثُمَّ نُنَجِّي الَّذِينَ اتَّقَوْا وَنَذَرُ الظَّالِمِينَ فِيهَا جِثِيًّا ﴿72﴾

{ مريم :৭১-৭২}

তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে তথায় পৌছবে না। এটা আপনার পালনকর্তার অনিবার্য ফায়সালা। অত:পর আমি তাকওয়া অবলম্বনকারীদের উদ্ধার করব আর জালেমদেরকে নতজানু অবস্থায় ছেড়ে দেব। {সূরা মারইয়াম:৭১-৭২}

২- হাদীসে এসেছে

وعن أبي هريرة رضي الله عنه أن أن ناسا قالوا : يا رسول الله هل نرى ربنا يوم القيامة ... – وفيه- ويضرب الصراط بين ظهري جهنم فأكون أنا و أمتي أول من يجيز . متفق عليه

বিশিষ্ট সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, কিছু লোক জানতে চাইলো : ইয়া রাসূলাল্লাহ, কেয়ামতের দিন আমরা কি আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ তাআলাকে দেখতে পাব... -তাতে আছে- জাহান্নামের উপর পুলসিরাত স্থাপন করা হবে। আমি এবং আমার উম্মত সর্বপ্রথম সেটি অতিক্রম করব। [বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং যথাক্রমে (৮০৬) ও (১৮২)।]

২২০
জাহান্নামের গভীরতা:
১- হাদীসে এসেছে

وعن أبي هريرة رضي الله عنه قال : كنا مع رسول الله صلى الله عليه وسلم إذ سمع وجبة , فقال النبي صلى الله عليه وسلم : تدرون ما هذا؟ قلنا : الله ورسوله أعلم , قال : هذا حجر رمي به في النار منذ سبعين خريفا فهو يهوي في النار الآن حتى انتهى إلى قعرها . أخرجه مسلم

সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করছেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বসা ছিলাম, হঠাৎ তিনি শিলাখন্ড পতিত হওয়ার বিকট একটি আওয়াজ শুনতে পেলেন। নবীজী আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন : তোমরা কি জান এটি কি? বর্ণনাকারী বলেন: আমরা বললাম : আল্লাহ ও তদিয় রাসূল ভাল জানেন। তখন রাসূলুল্লাহ বললেন: এটি একটি পাথর খন্ড, সত্তর বছর পূর্বে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হয়েছে এবং এ সত্তর বছর যাবত ক্রমাগত নিচের দিকে পতিত হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত এখন গিয়ে তার তলদেশে পৌছেছে। [সহীহ মুসলিম। হাদীস নং (২৮৪৪)।]

২- হাদীসে এসেছে

وعن سمرة بن جندب رضي الله عنه أنه سمع نبي الله صلى الله عليه وسلم يقول : إن منهم من تأخذه النار إلى كعبيه , ومنهم من تأخذه إلى حجزته , ومنهم من تأخذه إلى عنقه . أخرجه مسلم

সাহাবী সামুরা বিন জুনদুব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছেন, নবীজী বলেন, কোন কোন জাহান্নামীকে আগুন তার টাখনু পর্যন্ত পাকড়াও করবে। কারো কারো কোমর পর্যন্ত এবং কারো কারো গ্রীবাদেশ পর্যন্ত। [সহীহ মুসলিম। হাদীস নং (২৮৪৫)।]

২২১
জাহান্নামবাসীদের আকৃতির বিশালতা:
১- হাদীসে এসেছে

عن أبي هريرة رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم :(( ضرس الكافر أو ناب الكافر مثل أحد , وغلظ جلده مسيرة ثلاث )). أخرجه مسلم .

বিশিষ্ট সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: কাফেরের (মাড়ির) দাঁত উহুদ পাহাড় সদৃশ, এবং তাদের চামড়ার পুরুত্ব তিন দিনের ভ্রমনপথের দূরত্ব সমান। [সহীহ মুসলিম। হাদীস নং (২৮৫১)।]

২- হাদীসে এসেছে

وعن أبي هريرة رضي الله عنه أن النبي صلى الله عليه وسلم قال :(( ما بين منكبي الكافر في النار مسيرة ثلاثة أيام للراكب المسرع )). متفق عليه

সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: জাহান্নামে কাফেরের দুই কাঁধের মাঝের দূরত্ব অতি দ্রুতগামী আরোহীর তিন দিনের ভ্রমনপথের দূরত্ব সমান। [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং যথাক্রমে (৬৫৫১) এবং (৫২)।]

৩- হাদীসে এসেছে

وعن أبي هريرة رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال :(( ضرس الكافر يوم القيامة مثل أحد , وعرض جلده سبعون ذراعا , وعضده مثل البيضاء , وفخذه مثل ورقان , ومقعده من النار ما بيني وبين الربذة )). أخرجه أحمد والحاكم .

প্রখ্যাত সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: কেয়ামতের দিন কাফেরের দাঁত হবে উহুদ পাহাড় সদৃশ, তাদের চামড়ার প্রস্থ (পুরুত্ব) হবে সত্তর হাত, তাদের বাহু হবে বায়যা নামক স্থান সদৃশ, তাদের উরু হবে ওরকান নামক স্থান সদৃশ, আর জাহান্নামে তাদের বসার স্থানটি হবে আমি এবং রাবযাহ নামক স্থানের দূরত্ব সমান। [হাদীসটি সহীহ। বর্ণনায় আহমাদ (৮৩২৭) এবং হাকেম (৮৭৫৯)। দেখুন আসসিলসিলাতুস সহীহাহ । ক্রমিক(১১০৫)।]

২২২
জাহান্নামের উত্তাপের তীব্রতা:
১- মহান আল্লাহ তাআলা বলেন:

وَنَحْشُرُهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَى وُجُوهِهِمْ عُمْيًا وَبُكْمًا وَصُمًّا مَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ كُلَّمَا خَبَتْ زِدْنَاهُمْ سَعِيرًا ﴿97﴾ ذَلِكَ جَزَاؤُهُمْ بِأَنَّهُمْ كَفَرُوا بِآَيَاتِنَا { الإسراء :৯৭-৯৮}

আমি কেয়ামতের দিন তাদের সমবেত করব তাদের মুখে ভর দিয়ে চলা অবস্থায়, অন্ধ, মুক ও বধির অবস্থায়। তাদের আবাসস্থল জাহান্নাম। যখনই নির্বাপিত হওয়ার উপক্রম হবে আমি তখন তাদের জন্য অগ্নি আরো বৃদ্ধি করে দেব। এটাই তাদের শাস্তি। কারণ তারা আমার নিদর্শনসমূহ অস্বীকার করেছে।{সূরা ইসরা: ৯৭-৯৮}

২- হাদীসে এসেছে

وعن أبي هريرة رضي الله عنه أن النبي صلى الله عليه وسلم قال :(( ناركم هذه التي يوقد ابن آدم جزء من سبعين جزءا من حر جهنم )) قالوا : والله إن كانت لكافية يا رسول الله , قال :(( فإنها فضلت عليها بتسعة وستين جزءا كلها مثل حرها )). متفق عليه

বিখ্যাত সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবীজী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন: তোমাদের এ আগুন যা আদম সন্তান প্রজ্জ্বলিত করে জাহান্নামের (আগুনের) উষ্ণতার সত্তর ভাগের এক ভাগ। লোকেরা বলল: ইয়া রাসূলাল্লাহ যদি এটিই (দুনিয়ার আগুন) হতো তাহলেইতো যথেষ্ট ছিল। নবীজী বললেন: একে আরো উনসত্তরগুন বৃদ্ধি করা হয়েছে , প্রত্যেকটি এর উষ্ণতার অনুরূপ। [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং যথাক্রমে (৩২৬৫) ও (২৮৪৩)।]

৩- হাদীসে এসেছে

وعن أبي هريرة رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم :(( اشتكت النار إلى ربي فقالت : رب أكل بعضي بعضا , فأذن لها بنفسين , نفس في الشتاء و نفس في الصيف , فأشد ما تجدون من الحر , وأشد ما تجدون من الزمهرير )). متفق عليه

সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: জাহান্নাম তার প্রতিপালক আল্লাহর নিকট অনুযোগ করে বলেছে: হে রব! আমার এক অংশ অন্য অংশকে খেয়ে ফেলছে। তখন আল্লাহ তাআলা তাকে দু’টো নি:শ্বাস ছাড়ার অনুমতি প্রদান করেন। একটি শীতের সময় অপরটি গ্রীষ্মে। অত:এব তোমরা যে তীব্র গরম অনুভব কর। এবং তোমরা যে তীব্র শীত অনুভব কর। (তা সেই নিশ্বাসের প্রতিক্রিয়া)। [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং যথাক্রমে (৩২৬০) ও (৬১৭)।]

২২৩
জাহান্নামের জ্বালানী:
১- আল্লাহ তাআলা বলেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ عَلَيْهَا مَلَائِكَةٌ غِلَاظٌ شِدَادٌ لَا يَعْصُونَ اللَّهَ مَا أَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ ﴿6﴾ { التحريم :৬}

হে মুমিনগন, তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে সেই অগ্নি থেকে রক্ষা কর , যার জ্বালানী ও ইন্ধন হবে মানুষ ও প্রস্তর। যাতে নিয়োজিত আছে পাষাণ হৃদয়, কঠোর স্বভাব ফেরেশতাগন। তারা আল্লাহ তাআলা যা আদেশ করেন, তা অমান্য করে না এবং যা করতে আদেশ করা হয়, তাই করে। {সূরা তাহরীম:৬}

২-আল্লাহ তাআলা আরো বলেন:

فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِي وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ أُعِدَّتْ لِلْكَافِرِينَ { البقرة :২৪}

তাহলে সে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা কর যার জ্বালানী হবে মানুষ ও পাথর। যা প্রস্ত্তত করা হয়েছে কাফেরদের জন্য। {সূরা বাকারা:২৪}

৩-অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

إنكم و ما تعبدون من دون الله حصب جهنم أنتم لها واردون .{ الأنبياء :৯৮}

তোমরা এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাদের উপাসনা করছ , সকলেই জাহান্নামের ইন্ধন। তোমরাই তাতে প্রবেশ করবে।{সূরা আম্বিয়া:৯৮}

২২৪
জাহান্নামের বিভিন্ন স্তর:
জাহান্নাম সম্পূর্ণটাই কিন্তু একই স্তর বিশিষ্ট নয়। তার কিছু স্তর অন্য স্তর অপেক্ষা নিম্ন।

এর সর্বনিম্নস্তরে থাকবে মুনাফিকরা। কারণ তাদের কুফরী ছিল অন্যদের তুলনায় খুবই মারাত্মক। এবং তারাই মূলত মুমিনদের বেশি কষ্ট দিয়েছে এবং অপরদেরকে নির্যাতন করার সুযোগ তৈরী করে দিয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন:

إن المنافقين في الدرك الأسفل من النارولن تجد لهم نصيرا . { النساء :১৪৫}

নি:সন্দেহে মুনাফেকরা থাকবে জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তলে। আর আপনি কখনো তাদের কোন সাহায্যকারী পাবেন না। {সূরা নিসা:১৪৫}

২২৫
জাহান্নামের ছায়ার বিবরণ:
১-আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করছেন:

وَأَصْحَابُ الشِّمَالِ مَا أَصْحَابُ الشِّمَالِ ﴿41﴾ فِي سَمُومٍ وَحَمِيمٍ ﴿42﴾ وَظِلٍّ مِنْ يَحْمُومٍ ﴿43﴾ الواقعة :৪১-৪৩}

বামপার্শ্বস্থ লোক, কত না হতভাগ্য তারা, তারা থাকবে প্রখর বাষ্পে এবং উত্তপ্ত পানিতে, এবং ধুম্রকুঞ্জের ছায়ায়।{সূরা ওয়াক্বিয়া:৪১-৪৩}

২-অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

لَهُمْ مِنْ فَوْقِهِمْ ظُلَلٌ مِنَ النَّارِ وَمِنْ تَحْتِهِمْ ظُلَلٌ ذَلِكَ يُخَوِّفُ اللَّهُ بِهِ عِبَادَهُ يَا عِبَادِ فَاتَّقُونِ { الزمر :১৬}

তাদের জন্য উপর দিক থেকে এবং নীচের দিক থেকে আগুনের মেঘমালা (আচ্ছাদন) থাকবে। এ শাস্তি দ্বারা আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে সতর্ক করেন যে, হে আমার বান্দাগণ, আমাকে ভয় কর। {সূরা যুমার:১৬}

৩-আল্লাহ তাআলা আরো বলেন:

انْطَلِقُوا إِلَى ظِلٍّ ذِي ثَلَاثِ شُعَبٍ ﴿30﴾ لَا ظَلِيلٍ وَلَا يُغْنِي مِنَ اللَّهَبِ ﴿31﴾ { المرسلات :৩০-৩১}

চল তোমরা তিন কুন্ডলীবিশিষ্ট ছায়ার দিকে, যে ছায়া সুনিবিড় নয় এবং অগ্নির উত্তাপ থেকে রক্ষা করে না। {সূরা আল মুরসালাত:৩০-৩১}

২২৬
জাহান্নামের রক্ষীবৃন্দ:
১-মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করছেন:

سَأُصْلِيهِ سَقَرَ ﴿26﴾ وَمَا أَدْرَاكَ مَا سَقَرُ ﴿27﴾ لَا تُبْقِي وَلَا تَذَرُ ﴿28﴾ لَوَّاحَةٌ لِلْبَشَرِ ﴿29﴾ عَلَيْهَا تِسْعَةَ عَشَرَ ﴿30﴾ وَمَا جَعَلْنَا أَصْحَابَ النَّارِ إِلَّا مَلَائِكَةً وَمَا جَعَلْنَا عِدَّتَهُمْ إِلَّا فِتْنَةً لِلَّذِينَ كَفَرُوا

{ المدثر :২৬-৩১}

আমি তাকে দাখিল করব অগ্নিতে। আপনি কি বুঝলেন অগ্নি কি? এটা অক্ষত রাখবে না এবং ছাড়বেও না। মানুষকে দগ্ধ করবে। এর উপর নিয়োজিত আছে উনিশজন ফেরেশতা। আমি জাহান্নমের তত্ত্বাবধায়ক ফেরেশতাই রেখেছি। আমি কাফেরদেরকে পরীক্ষা করার জন্যই তার এই সংখ্যা করেছি। {সূরা আল-মুদ্দাসসির:২৬-৩১}

২-জাহান্নামের রক্ষী মালেক, আল্লাহ বলেন:

ونادوا يا مالك ليقض علينا ربك قال إنكم ماكثون . { الزخرف :৭৭}

তারা ডেকে বলবে, হে মালেক, তোমার প্রতিপালক যেন আমাদেরকে নি:শেষ করে দিন। সে বলবে: তোমরা তো এখানেই অবস্থান করবে। {সূরা যুখরুফ:৭৭}

২২৭
জাহান্নামের দল:
عن أبي سعيد الخدري رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال :( يقول الله تعالى : يا آدم , فيقول : لبيك و سعديك , والخير في يديك , فيقول : أخرج بعث النار , قال : وما بعث النار؟ قال : من كل ألف تسعمائة و تسعة وتسعين , فعنده يشيب الصغير { وتضع كل ذات حمل حملها وترى الناس سكارى وماهم بسكارى ولكن عذاب الله شديد } الحج :২}

قالوا : يا رسول الله ,, وأينا ذلك الواحد ؟ قال : ( أبشروا فإن منكم رجلا , ومن يأجوج و مأجوج ألف ) متفق عليه

সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত,নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:আল্লাহ তাআলা বলবেন:হে আদম।আদম আলাইহিস সালাম বলবেন: লাববাইক (আমি হাজির)।আল্লাহ বলবেন: জাহান্নামের দল বের করুন। আদম আলাইহিস সালাম বলবেন: জাহান্নামের দল কি? আল্লাহ বলবেন: প্রত্যেক হাজার থেকে নয়শত নিরানববই জন। তখন ছোটরা বৃদ্ধ হয়ে যাবে।{এবং প্রত্যেক গর্ভবতী তার গর্ভপাত করবে এবং মানুষকে তুমি দেখবে মাতাল; অথচ তারা মাতাল নয় বস্ত্তত: আল্লাহর আযাব সুকঠিন।(সূরা হজ্জ্ব:২) ।

সাহাবারা বললেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ,, আমাদের সে একজন কে? নবীজী বললেন:তোমরা সুসংবাদ গ্রহন কর! কারণ তোমাদের মধ্যহতে একজন আর ইয়াজুজ মাজুজ থেকে একহাজার । [বর্ণনায় বুখারী মুসলিম। হাদীস নং যথাক্রমে (৩৩৪৮) এবং (২২২)।]

২২৮
জাহান্নামীদের জাহান্নামে প্রবেশ পদ্ধতি:
১-মহান আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন:

وَسِيقَ الَّذِينَ كَفَرُوا إِلَى جَهَنَّمَ زُمَرًا حَتَّى إِذَا جَاءُوهَا فُتِحَتْ أَبْوَابُهَا وَقَالَ لَهُمْ خَزَنَتُهَا أَلَمْ يَأْتِكُمْ رُسُلٌ مِنْكُمْ يَتْلُونَ عَلَيْكُمْ آَيَاتِ رَبِّكُمْ وَيُنْذِرُونَكُمْ لِقَاءَ يَوْمِكُمْ هَذَا قَالُوا بَلَى وَلَكِنْ حَقَّتْ كَلِمَةُ الْعَذَابِ عَلَى الْكَافِرِينَ ﴿71﴾ قِيلَ ادْخُلُوا أَبْوَابَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا فَبِئْسَ مَثْوَى الْمُتَكَبِّرِينَ ﴿72﴾ { الزمر :৭১-৭২}

কাফেরদেরকে জাহান্নামের দিকে দলে দলে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। তারা যখন সেখানে পৌঁছবে, তখন তার দরজাসমূহ খুলে দেয়া হবে এবং জাহান্নামের রক্ষীরা তাদেরকে বলবে, তোমাদের কাছে কি তোমাদের মধ্য থেকে রাসূলগন আসেননি, যারা তোমাদের নিকট তোমাদের পালনকর্তার আয়াতসমূহ আবৃত্তি করতেন এবং এ দিনের সাক্ষাতের ব্যাপারে সতর্ক করতেন? তারা বলবে: হ্যাঁ, কিন্তু কাফেরদের প্রতি শাস্তির হুকুমই বাস্তবায়িত হয়েছে। বলা হবে, তোমরা জাহান্নামের দরজা দিয়ে প্রবেশ কর, সেখানে চিরকাল অবস্থানের জন্য। কত নিকৃষ্ট অহংকারীদের আবাসস্থল। {সূরা যুমার:৭১-৭২}

২-অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

بَلْ كَذَّبُوا بِالسَّاعَةِ وَأَعْتَدْنَا لِمَنْ كَذَّبَ بِالسَّاعَةِ سَعِيرًا ﴿11﴾ إِذَا رَأَتْهُمْ مِنْ مَكَانٍ بَعِيدٍ سَمِعُوا لَهَا تَغَيُّظًا وَزَفِيرًا ﴿12﴾ وَإِذَا أُلْقُوا مِنْهَا مَكَانًا ضَيِّقًا مُقَرَّنِينَ دَعَوْا هُنَالِكَ ثُبُورًا ﴿13﴾ لَا تَدْعُوا الْيَوْمَ ثُبُورًا وَاحِدًا وَادْعُوا ثُبُورًا كَثِيرًا ﴿14﴾ { الفرقان :১১-১৪}

যারা কেয়ামতকে অস্বীকার করে তাদের জন্য আমি প্রস্ত্তত রেখেছি জ্বলন্ত অগ্নি। অগ্নি যখন দূর হতে তাদেরকে দেখবে তখন তারা শুনতে পাবে তার ক্রুদ্ধ গর্জন ও হুঙ্কার। এবং যখন তাদেরকে শৃঙ্খলিত অবস্থায় জাহান্নামের কোন এক সংকীর্ণ স্থানে নিক্ষেপ করা হবে, তখন তারা সেখানে ধ্বংস তথা মৃত্যুকে আহবান করবে। বলা হবে আজ তোমরা এক মৃত্যুকে ডেকো না-অনেক মৃত্যুকে ডাক।

{সূরা আল-ফোরক্বান:১১-১৪}

৩-আল্লাহ তাআলা আরও বলেন:

يَوْمَ يُدَعُّونَ إِلَى نَارِ جَهَنَّمَ دَعًّا ﴿13﴾ هَذِهِ النَّارُ الَّتِي كُنْتُمْ بِهَا تُكَذِّبُونَ ﴿14﴾ { الطور :১৩-১৪}

যেদিন তাদেরকে জাহান্নামের অগ্নির দিকে ধাক্কা মেরে মেরে নিয়ে যাওয়া হবে। এবং বলা হবে এই সেই অগ্নি , যাকে তোমরা মিথ্যা বলতে। {সূরা আত্ব-তুর:১৩-১৪}

৪-আরও ইরশাদ হচ্ছে:

وَتَرَى الْمُجْرِمِينَ يَوْمَئِذٍ مُقَرَّنِينَ فِي الْأَصْفَادِ ﴿49﴾ سَرَابِيلُهُمْ مِنْ قَطِرَانٍ وَتَغْشَى وُجُوهَهُمُ النَّارُ ﴿50﴾ { إبراهيم :৪৯-৫০}

সেদিন তুমি অপরাধিদেরকে পরস্পরে শৃঙ্খলিত অবস্থায় দেখবে। তাদের জামা হবে দাহ্য আলকাতরার এবং তাদের মুখমন্ডলকে আগুন আচ্ছন্ন করে ফেলবে।{সূরা ইবরাহীম:৪৯-৫০}

৫- হাদীসে এসেছে

وعن أبي هريرة رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم :(( تخرج عنق من النار يوم القيامة , لها عينان تبصران , وأذنان تسمعان , ولسان ينطق يقول : إني وكلت بثلاثة : بكل جبار عنيد , وبكل من دعا مع الله إلها آخر , وبالمصورين )). أخرجه أحمد والترمذي .

বিশিষ্ট সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: কেয়ামতের দিন জাহান্নাম থেকে একটি গ্রীবা (সদৃশ বস্ত্ত) বের হয়ে আসবে। তার দু’টো চক্ষু থাকবে যার দ্বারা দেখবে, দু'টো কান থাকবে যার মাধ্যমে শুনবে, এবং যিহবা থাকবে যার মাধ্যমে কথা বলবে। সে বলবে: আমি তিন শ্রেণীর লোকের (শাস্তির) প্রতি দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছি, প্রত্যেক অবাধ্য অহংকারীর প্রতি, যারা আল্লাহর সাথে অন্য ইলাহ-উপাস্যদের ডাকে এবং জীবন্ত প্রাণীর চিত্রাংকন কারীর প্রতি। [হাদীসটি বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত হয়েছে। বর্ণনায় আহমাদ (৮৪১১) এবং তিরমিযী (২৫৭৪)।]

২২৯
সর্বপ্রথম যাদের মাধ্যমে জাহান্নামকে প্রজ্জ্বলিত করা হবে:
عن أبي هريرة رضي الله عنه قال : سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول : (( إن أول الناس يقضى يوم القيامة عليه رجل استشهد , فأتي به فعرفه نعمه فعرفها , قال : فما عملت فيها؟ قال : قاتلت فيك حتى استشهدت , قال : كذبت , ولكنك قاتلت لأن يقال جريء فقد قيل , ثم أمر به فسحب على وجهه حتى ألقي في النار .

ورجل تعلم العلم و علمه و قرأ القرآن , فأتي به فعرفه نعمه فعرفها , قال : فما عملت فيها؟ قال : تعلمت العلم وعلمته , وقرأت فيك القرآن , قال : كذبت ولكنك تعلمت العلم ليقال عالم , وقرأت القرآن ليقال هو قارئ فقد قيل , ثم أمر به فسحب على وجهه حتى ألقي في النار .

ورجل وسع الله عليه , وأعطاه من أصناف المال كله , فأتي به فعرفه نعمه فعرفها , قال : فما عملت فيها؟ قال : ما تركت من سبيل تحب أن ينفق فيها إلا أنفقت فيها لك , قال : كذبت , ولكنك فعلت ليقال هو جواد , فقد قيل , ثم أمر به فسحب على وجهه , ثم ألقي في النار )). أخرجه مسلم .

প্রখ্যাত সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ইরশাদ করতে শুনেছি, নবীজী বলেন:কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যাদের বিচার করা হবে, শাহাদত বরণকারী একজন লোক ,তাকে উপস্থিত করা হবে এবং আল্লাহ প্রদত্ত্ব যাবতীয় নেয়ামত সম্পর্কে জ্ঞাত করা হবে সে সব নেয়ামতকে চেনে নেবে। তখন তাকে বলা হবে: এসব নেয়ামতের পরিপ্রেক্ষিতে তুমি কি কি আমল করেছ ? বলবে:আপনার তরে লড়াই-জিহাদ করেছি এবং শহীদ হয়ে গিয়েছি। বলা হবে: তুমি মিথ্যা বলছ। বরং তুমি লড়াই করেছ এজন্য যে, লোকেরা তোমাকে বীর-বাহাদুর বলবে। তাতো বলা হয়েছে। অত:পর তার ব্যাপারে রায় ঘোষণা হবে এবং তাকে চেহারার উপর ভর দিয়ে টেনে নিয়ে (যাওয়া হবে এবং) জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

(দ্বিতীয় পর্যায়ে)আলেম ব্যক্তি যে নিজে দ্বীনী এলম শিক্ষা গ্রহণ করেছে, অপর শিক্ষা দিয়েছে। এবং কোরআন পড়েছে। তাকে উপস্থিত করা হবে এবং প্রদত্ত নেয়ামত সম্পর্কে জ্ঞাত করা হবে। সে সব নেয়ামতই চেনে ফেলবে। তখন বলা হবে এ সকল নেয়ামতের প্রতিকর্ম স্বরূপ তুমি কি করেছ? বলবে : আমি এলম শিখেছি ও অপরকে শিক্ষা দিয়েছি। এবং তোমার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোরআন পড়েছি। বলা হবে : তুমি মিথ্যা বলছ, বরং তুমি এলম শিখেছ যাতে লোকেরা তোমাকে আলেম বলে, আর কোরআন পড়েছ যাতে ক্বারী বলে। তাতো বলা হয়েছে। অত:পর তার ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া হবে, ফলে চেহারার উপর ভর দিয়ে টেনে নিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

তৃতীয় পর্যায়ে সে ব্যক্তি যাকে আল্লাহ প্রচুর প্রাচুর্য দিয়েছেন এবং সর্ব প্রকার সম্পদ তাকে দেয়া হয়েছে । তাকে উপস্থিত করা হবে: এবং সকল নেয়ামত চেনানো হবে। সে সবগুলো চেনে নেবে। তখন জিজ্ঞেস করা হবে : এসব নেয়ামতের প্রতিকর্ম হিসেবে তুমি কি করেছ ? সে বলবে: যে সব পথে খরচ করা তোমার পছন্দ ছিল, সে সকল পথেই আমি খরচ করেছি তোমার সন্তুষ্টির জন্য। বলা হবে, তুমি মিথ্যা বলছ। তুমি খরচ করেছ ঠিকই কিন্তু উদ্দেশ্য ছিল লোকেরা তোমারে দানবীর বলবে। তাতো বলা হয়ে গেছে। অত:পর তার রায় ঘোষণা হবে। ফলে তাকে মুখের উপর ভর দিয়ে টেনে নিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। [বর্ণনায় সহীহ মুসলিম (১৯০৫)।]

২৩০
জাহান্নামের অধিবাসী:
১-পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে:

والذين كفروا وكذبوا بآياتنا أولئك أصحاب النار هم فيها خالدون . { البقرة :৩৯}

আর যারা অস্বীকার করবে এবং আমার আয়াতগুলোকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে তারাই হবে জাহান্নামবাসী । অনন্তকাল সেখানে অবস্থান করবে। {সূরা বাকারা:৩৯}

২- হাদীসে এসেছে

وعن عياض بن حمار رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال :((... وأهل النار خمسة : الضعيف الذي لا زبر له , الذين هم فيكم تبعا لا يتبعون أهلا و لا مالا , والخائن الذي لا يخفى له طمع وإن دق إلا خانه , ورجل لا يصبح ولا يمسي إلا وهو يخادعك عن أهلك ومالك )) وذكر البخل أو الكذب (( والشنظير الفحاش )). أخرجه مسلم .

সাহাবী ইয়ায বিন হিমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ... এবং জাহান্নামের অধিবাসী হচ্ছে পাঁচ শ্রেণীর লোক, দুর্বল যার কোন ( সুস্থ ) বিবেক ও সম্পদ নেই, যারা তোমাদের মাঝে অনুগত হয়ে থাকে এবং যাদের পরিবার ও সম্পদের প্রতি কোন মোহ নেই। বিশ্বাসঘাতক ও দুর্নীতিবাজ যার লোভ-লালসা অপ্রকাশ্য নয়-ছোট খাটো বিষয়েও খেয়ানত করে। এমন লোক যে সকাল বিকাল ( সার্বক্ষণিক ) তোমার পরিবার ও সম্পদের ব্যাপারে তোমার সাথে প্রতারণা করে। এবং তিনি কৃপণতা বা মিথ্যার কথা উল্লেখ করেছেন। (অর্থাৎ যারা এসবের সাথে সংশ্লিষ্ট ) এবং অতি অশ্লীল ও নোংরা স্বভাবের লোক। [সহীহ মুসলিম ( ২৮৬৫ )।]

২৩১
জাহান্নামের অধিকাংশ অধিবাসী:
عن ابن عباس رضي الله عنه قال : قال النبي صلى الله عليه وسلم ((... ورأيت النار , فإذا أكثر أهلها النساء يكفرن )) قيل أ يكفرن بالله؟ قال :(( يكفرن العشير ويكفرن الإحسان , لو أحسنت إلى إحداهن الدهر ثم رأت منك شيئا , قالت : ما رأيت منك خيرا قط )). متفق عليه

প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করছেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: ... এবং আমি জাহান্নাম প্রত্যক্ষ করলাম, দেখলাম তার অধিকাংশ অধিবাসী হচ্ছে নারী যারা অকৃতজ্ঞতা করে। প্রশ্ন করা হল, তারা কি আল্লাহর সাথে অকৃতজ্ঞতা করে? নবীজী বললেন: তারা স্বামীর অকৃতজ্ঞতা করে এবং এহসান-অনুগ্রহের কথা ভুলে যায়, তাদের কারো প্রতি যদি তুমি যুগ যুগ ধরে অনুগ্রহ কর অত:পর তোমার মধ্যে (অপছন্দনীয়) কিছু দেখতে পায় তখন সাথে সাথে বলে ফেলে, তোমার থেকে আমি কখনো ভাল কিছু দেখতে পাইনি। [বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং যথা ক্রমে (২৯) এবং (৯০৭)।]

২৩২
জাহান্নামীদের মধ্যে সবচে কঠিন শাস্তি ভোগকারী দল :
১-মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করছেন:

أَلْقِيَا فِي جَهَنَّمَ كُلَّ كَفَّارٍ عَنِيدٍ ﴿24﴾ مَنَّاعٍ لِلْخَيْرِ مُعْتَدٍ مُرِيبٍ ﴿25﴾ الَّذِي جَعَلَ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آَخَرَ فَأَلْقِيَاهُ فِي الْعَذَابِ الشَّدِيدِ ﴿26﴾

{ق:২৪-২৬}

তোমরা উভয়েই নিক্ষেপ কর জাহান্নামে প্রত্যেক অকৃতজ্ঞ বিরুদ্ধবাদীকে। যে বাধা দিত মঙ্গল জনক কাজে, সীমালঙ্ঘনকারী, সন্দেহ পোষণকারীকে। যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে উপাস্য গ্রহণ করত, তাকে তোমরা কঠিন শাস্তিতে নিক্ষেপ কর।{সূরা ক্বাফ:২৪-২৬}

২-আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা আরো বলেন:

فَوَقَاهُ اللَّهُ سَيِّئَاتِ مَا مَكَرُوا وَحَاقَ بِآَلِ فِرْعَوْنَ سُوءُ الْعَذَابِ ﴿45﴾ النَّارُ يُعْرَضُونَ عَلَيْهَا غُدُوًّا وَعَشِيًّا وَيَوْمَ تَقُومُ السَّاعَةُ أَدْخِلُوا آَلَ فِرْعَوْنَ أَشَدَّ الْعَذَابِ ﴿46﴾ { غافر :৪৫-৪৬}

এবং ফেরআউন গোত্রকে শোচনীয় আযাব গ্রাস করল। সকাল ও সন্ধ্যায় তাদেরকে আগুনের সামনে পেশ করা হয় এবং যে কেয়ামত সঙ্ঘটিত হবে, সেদিন আদেশ করা হবে, ফেরআউন গোত্রকে কঠিনতর আযাবে দাখিল কর।{সূরা গাফের:৪৫-৪৬}

৩-অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

الَّذِينَ كَفَرُوا وَصَدُّوا عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ زِدْنَاهُمْ عَذَابًا فَوْقَ الْعَذَابِ بِمَا كَانُوا يُفْسِدُونَ { النحل :৮৮}

যারা কাফের হয়েছে এবং আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করেছে, আমি তাদেরকে আযাবের পর আযাব বাড়িয়ে দেব। কারণ, তারা অনর্থ - অশান্তি সৃষ্টি করত।{সূরা নাহল:৮৮}

৪-আরও ইরশাদ হচ্ছে:

إِنَّ الْمُنَافِقِينَ فِي الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ وَلَنْ تَجِدَ لَهُمْ نَصِيرًا ..{ النساء :145}

নি:সন্দেহে মুনাফেকরা রয়েছে জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে, আর তোমরা কখনো তাদের কোন সাহায্যকারী পাবে না। {সূরা আননিসা:১৪৫}

৫-আল্লাহ তাআলা আরোও বলছেন:

فَوَرَبِّكَ لَنَحْشُرَنَّهُمْ وَالشَّيَاطِينَ ثُمَّ لَنُحْضِرَنَّهُمْ حَوْلَ جَهَنَّمَ جِثِيًّا ﴿68﴾ ثُمَّ لَنَنْزِعَنَّ مِنْ كُلِّ شِيعَةٍ أَيُّهُمْ أَشَدُّ عَلَى الرَّحْمَنِ عِتِيًّا ﴿69﴾ ثُمَّ لَنَحْنُ أَعْلَمُ بِالَّذِينَ هُمْ أَوْلَى بِهَا صِلِيًّا ﴿70﴾ { مريم :৬৮-৭০}

সুতরাং আপনার পালনকর্তার কসম, আমি অবশ্যই তাদেরকে এবং শয়তানদেরকে একত্রে সমবেত করব, অত:পর অবশ্যই তাদেরকে নতজানু অবস্থায় জাহান্নামের চারপাশে উপস্থিত করব। অত:পর তাদের মধ্যে যারা জাহান্নামে প্রবেশের অধিক যোগ্য, আমি তাদের বিষয়ে ভালভাবে জ্ঞাত আছি। {সূরা মারইয়াম:৬৮-৭০}

৬-হাদীসে এসেছে

وعن أبي هريرة رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم :(( تخرج عنق من النار يوم القيامة , لها عينان تبصران , وأذنان تسمعان , ولسان ينطق يقول : إني وكلت بثلاثة : بكل جبار عنيد , وبكل من دعا مع الله إلها آخر , وبالمصورين )). أخرجه أحمد والترمذي .

বিশিষ্ট সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: কেয়ামতের দিন জাহান্নাম থেকে একটি গ্রীবা (সদৃশ বস্ত্ত) বের হয়ে আসবে। তার দু’টো চক্ষু থাকবে যার দ্বারা দেখবে, দু'টো কান থাকবে যার মাধ্যমে শুনবে, এবং যিহবা থাকবে যার মাধ্যমে কথা বলবে। সে বলবে: আমি তিন শ্রেণীর লোকের (শাস্তির) প্রতি দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছি: প্রত্যেক অবাধ্য অহংকারীর প্রতি, যারা আল্লাহর সাথে অন্য ইলাহ-উপাস্যেদের ডাকে এবং জীবন্ত প্রাণীর চিত্রাংকন কারীর প্রতি। [হাদীসটি বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত হয়েছে। বর্ণনায় আহমাদ (৮৪১১) এবং তিরমিযী (২৫৭৪)।]

৭- হাদীসে এসেছে

وعن عبد الله بن مسعود رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم :(( إن أشد الناس عذابا يوم القيامة المصورون )). متفق عليه .

বিশিষ্ট সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু

আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: কেয়ামতের দিন সবচে কঠিন শাস্তি হবে (জীবন্ত প্রাণীর) চিত্রাংকন কারীর। [বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং যথাক্রমে (৫৯৫০) ও (২১০৯)।]

৮- হাদীসে এসেছে

وعن عبد الله بن مسعود رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال :(( أشد الناس عذابا يوم القيامة رجل قتله نبي , أو قتل نبيا , وإمام ضلالة , وممثل من الممثلين )). أخرجه أحمد و الطبراني .

বিশিষ্ট সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন : কেয়ামত দিবসে সর্বাপেক্ষা কঠিন শাস্তি হবে যাদের, তারা হচ্ছে, এমন ব্যক্তি যাকে আল্লাহর কোন নবী হত্যা করেছেন অথবা যে ব্যক্তি কোন নবীকে হত্যা করেছে। পথ ভ্রষ্টতা ও গোমরাহীর ইমাম (নেতা-পথ প্রদর্শক) এবং ভাস্কর । [হাদীসের সনদ যাইয়েদ, বর্ণনায় আহমাদ (৩৮৬৮) এবং তবরানী আল কাবীরে ( ১০/২৬০)।]

২৩৩
জাহান্নামীদের মাঝে সবচে হালকা শাস্তি ভোগকারী ব্যক্তি:
১- হাদীসে এসেছে

عن النعمان بن بشير رضي الله عنه قال : سمعت النبي صلى الله عليه وسلم يقول :(( إن أهون أهل النار عذابا يوم القيامة رجل على أخمص قدميه جمرتان يغلي منهما دماغه كما يغلي المرجل بالقمقم )). متفق عليه

সাহাবী নুমান বিন বশীর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে ইরশাদ করতে শুনেছি : কেয়ামতের দিন জাহান্নামীদের মাঝে সবচে সহজ ও হালকা শাস্তি হবে যে ব্যক্তির, সে হল তার পায়ের তলাতে দু'টো জ্বলন্ত অঙ্গার থাকবে যার কারণে তার মগজ ছোট মুখ বিশিষ্ট হাড়ির ন্যায় ঊথলাতে থাকবে। [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং যথাক্রমে (৬৫৬২) এবং (২১৩)।]

২- হাদীসে এসেছে

وعن ابن عباس رضي الله عنهما أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : (( أهون أهل النار عذابا أبو طالب و هو منتعل بنعلين يغلي منهما دماغه )). أخرجه مسلم .

সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: জাহান্নামে সবচে হালকা শাস্তি ভোগ করবে আবু তালেব,সে (আগুনের) দুটো জুতা পরিহিত থাকবে যার ফলে তার মাথার মগজ টগবগ করে উথলাতে থাকবে। [বর্ণনায় সহীহ মুসলিম: হাদীস নং (২১২)।]

৩- হাদীসে এসেছে

وعن أبي سعيد الخدري رضي الله عنه أنه سمع النبي صلى الله عليه وسلم وذكر عنده عمه أبو طالب فقال - : لعله تنفعه شفاعتي يوم القيامة , فيجعل في ضحضاح من النار يبلغ كعبيه يغلي منه أم دماغه )). متفق عليه

সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনেছেন, - তাঁর নিকট স্বীয় চাচা আবু তালেবের আলোচনা হচ্ছিল তখন নবীজী বলেছেন - সম্ভবত কেয়ামত দিবসে আমার শাফাআত তার উপকারে আসবে, তাকে অগভীর আগুনে রাখা হবে যে আগুন তার পায়ের টাখনু পর্যন্ত পৌঁছবে এবং তার কারণে মাথার মগজ উথলাতে থাকবে। [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম । হাদীস নং যথাক্রমে (৬৫৬৪) এবং (২১০)।]

২৩৪
সবচে সহজশাস্তি ভোগকারী জাহান্নামীকে কি বলা হবে:
১- আল্লাহ তাআলা বলছেন:

إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوْ أَنَّ لَهُمْ مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا وَمِثْلَهُ مَعَهُ لِيَفْتَدُوا بِهِ مِنْ عَذَابِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ مَا تُقُبِّلَ مِنْهُمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ { المائدة :৩৬}

যারা কাফের, যদি তাদের কাছে পৃথিবীর সমুদয় সম্পদ এবং তৎসহ আরও তদনুরূপ সম্পদ থাকে আর এগুলো বিনিময়ে দিয়ে কেয়ামতের শাস্তি থেকে পরিত্রাণ পেতে চায়, তবুও তাদের কাছ থেকে তা কবুল করা হবে না । তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।{সূরা মায়েদা:৩৬}

২- হাদীসে এসেছে

وعن أنس بن مالك رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال : يقول الله تعالى لأهون أهل النار عذابا يوم القيامة : لو أن لك ما في الأرض من شيئ أ كنت تفتدي به؟ فيقول : نعم , فيقول : أردت منك أهون من هذا و أنت في صلب آدم : أن لا تشرك بي شيئا , فأبيت إلا أن تشرك بي )). متفق عليه .

বিশিষ্ট সাহাবী আনাস বিন মালেক রাদিয়াল্লাহ আনহু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করছেন, নবীজী বলেন, মহান আল্লাহ তাআলা সবচে সহজ শাস্তি ভোগকারী জাহান্নামীকে জিজ্ঞেস করবেন: পৃথিবীস্থিত সমস্ত কিছু যদি তোমার হতো তুমি কি এ শাস্তির মুক্তিপণ হিসাবে সেগুলো দান করতে? সে বলবে, হ্যাঁ। তখন আল্লাহ তাআলা বলবেন: তুমি যখন আদমের ওরসে ছিলে আমি তোমার নিকট এরচেয়ে সহজ জিনিষ কামনা করেছিলাম যে তুমি কাউকে আমার সমকক্ষ - শরীক স্থির করবে না। অথচ তুমি তা অস্বীকার করেছ এবং শরীক স্থির করেছ। [বর্ণনায় বুখারী মুসলিম। হাদীস নং যথাক্রমে (৬৫৫৭) এবং (২৮০৫)।]

২৩৫
জাহান্নামের শিকল ও বেড়ি:
১-আল্লাহ তাআলা বলেন:

إنا أعتدنا للكافرين سلاسل وأغلالا و سعيرا . { الإنسان :৪}

আমি অবিশ্বাসি কাফেরদের জন্য প্রস্ত্তত রেখেছি শিকল, বেড়ি ও প্রজ্বলিত অগ্নি। {সূরা ইনসান:৪}

২-অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

الَّذِينَ كَذَّبُوا بِالْكِتَابِ وَبِمَا أَرْسَلْنَا بِهِ رُسُلَنَا فَسَوْفَ يَعْلَمُونَ ﴿70﴾ إِذِ الْأَغْلَالُ فِي أَعْنَاقِهِمْ وَالسَّلَاسِلُ يُسْحَبُونَ ﴿71﴾ فِي الْحَمِيمِ ثُمَّ فِي النَّارِ يُسْجَرُونَ ﴿72﴾ { غافر :৭0- 72}

যারা কিতাবের প্রতি এবং যে বিষয় দিয়ে আমি নবীগণকে প্রেরণ করেছি, সে বিষয়ের প্রতি মিথ্যারোপ করে। অতএব সত্বরই তারা জানতে পারবে, যখন বেড়ি ও শৃঙ্খল তাদের গলদেশে পড়বে তাদের-কে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে ফুটন্ত পানিতে। অত:পর তাদেরকে আগুনে জ্বালানো হবে। { সূরা গাফের :৭০-৭২}

৩- আল্লাহ তাআলা আরোও ইরশাদ করেন:

إِنَّ لَدَيْنَا أَنْكَالًا وَجَحِيمًا ﴿12﴾ وَطَعَامًا ذَا غُصَّةٍ وَعَذَابًا أَلِيمًا ﴿13﴾ { المزمل :১২-১৩}

নিশ্চয় আমার কাছে আছে শিকল ও অগ্নিকুন্ড। গলগ্রহ হয়ে যায় এমন খাদ্য এবং যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।{ সূরা মুয্যাম্মিল:১২-১৩}৪-অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

خُذُوهُ فَغُلُّوهُ ﴿30﴾ ثُمَّ الْجَحِيمَ صَلُّوهُ ﴿31﴾ ثُمَّ فِي سِلْسِلَةٍ ذَرْعُهَا سَبْعُونَ ذِرَاعًا فَاسْلُكُوهُ ﴿32﴾ إِنّهُ كَانَ لَا يُؤْمِنُ بِاللَّهِ الْعَظِيمِ ﴿33﴾ وَلَا يَحُضُّ عَلَى طَعَامِ الْمِسْكِينِ ﴿34﴾ { الحاقة :৩০-৩৪}

ফেরেশতাদের-কে বলা হবে, ধর একে, গলায় বেড়ি পরিয়ে দাও, অত:পর নিক্ষেপ কর জাহান্নামে। অত:পর তাকে শৃঙ্খলিত কর সত্তর গজ দীর্ঘ এক শিকলে। নিশ্চয় সে মহান আল্লাহতে বিশ্বাসী ছিল না। এবং মিসকীনকে আহার্য দিতে উৎসাহিত করত না। {সূরা আল- হাক্কাহ:৩০-৩৪}

২৩৬
জাহান্নামীদের খানা-খাদ্যের বিবরণ:
১-আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করছেন:

إِنَّ شَجَرَةَ الزَّقُّومِ ﴿43﴾ طَعَامُ الْأَثِيمِ ﴿44﴾ كَالْمُهْلِ يَغْلِي فِي الْبُطُونِ ﴿45﴾ كَغَلْيِ الْحَمِيمِ ﴿46﴾

{ الدخان :৪৩-৪৬}

নিশ্চয়ই যাক্কুম বৃক্ষ, পাপীর খাদ্য হবে। গলিত তাম্রের মত পেটে ফুটতে থাকবে। যেমন ফুটে পানি। {সূরা আদ-দোখান:৪৩-৪৬}

২-আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলছেন:

أَذَلِكَ خَيْرٌ نُزُلًا أَمْ شَجَرَةُ الزَّقُّومِ ﴿62﴾ إِنَّا جَعَلْنَاهَا فِتْنَةً لِلظَّالِمِينَ ﴿63﴾ إِنَّهَا شَجَرَةٌ تَخْرُجُ فِي أَصْلِ الْجَحِيمِ ﴿64﴾ طَلْعُهَا كَأَنَّهُ رُءُوسُ الشَّيَاطِينِ ﴿65﴾ فَإِنَّهُمْ لَآَكِلُونَ مِنْهَا فَمَالِئُونَ مِنْهَا الْبُطُونَ ﴿66﴾ ثُمَّ إِنَّ لَهُمْ عَلَيْهَا لَشَوْبًا مِنْ حَمِيمٍ ﴿67﴾ ثُمَّ إِنَّ مَرْجِعَهُمْ لَإِلَى الْجَحِيمِ ﴿68﴾ { الصافات :৬২-৬৮}

এই কি উত্তম আপ্যায়ন না যাক্কুম বৃক্ষ? আমি যালেমদের জন্য একে তৈরী করেছি পরীক্ষা স্বরূপ। এটি একটি বৃক্ষ, যা উদগত হয় জাহান্নামের মূলে। এর গুচ্ছ শয়তানের মস্তকের মত। কাফেররা একে ভক্ষণ করবে এবং এর দ্বারা উদর পূর্ণ করবে। তদুপরি তাদেরকে দেয়া হবে ফুটন্ত পানির মিশ্রন। অত:পর তাদের প্রত্যাবর্তনস্থল হবে জাহান্নাম। {সূরা আস- সাফ্ফাত:৬২-৬৮}

৩-আরও ইরশাদ হচ্ছে:

لَيْسَ لَهُمْ طَعَامٌ إِلَّا مِنْ ضَرِيعٍ ﴿6﴾ لَا يُسْمِنُ وَلَا يُغْنِي مِنْ جُوعٍ ﴿7﴾ { الغاشية :৬-৭}

তাদের জন্য বিষাক্ত কাঁটাযুক্ত ব্যতীত কোন খাদ্য নেই।তা তাদেরকে পুষ্ট করবে না এবং তাদের ক্ষুদাও মেটাবে না।{সূরা আল গাশিয়া:৬-৭}

৪- আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলছেন:

فَلَيْسَ لَهُ الْيَوْمَ هَاهُنَا حَمِيمٌ ﴿35﴾ وَلَا طَعَامٌ إِلَّا مِنْ غِسْلِينٍ ﴿36﴾ لَا يَأْكُلُهُ إِلَّا الْخَاطِئُونَ ﴿37﴾ { الحاقة :৩৫-৩৭}

অতএব, আজকের দিন এখানে তার কোন সুহৃদ নেই। এবং কোন খাদ্য নেই ক্ষত-নি:সৃত পুঁজ ব্যতীত। {সূরা আল হাক্কাহ:৩৬-৩৭}

২৩৭
জাহান্নামীদের পানীয় এর বিবরণ:
১-আল্লাহ তাআলা বলেন:

وَاسْتَفْتَحُوا وَخَابَ كُلُّ جَبَّارٍ عَنِيدٍ ﴿15﴾ مِنْ وَرَائِهِ جَهَنَّمُ وَيُسْقَى مِنْ مَاءٍ صَدِيدٍ ﴿16﴾ يَتَجَرَّعُهُ وَلَا يَكَادُ يُسِيغُهُ وَيَأْتِيهِ الْمَوْتُ مِنْ كُلِّ مَكَانٍ وَمَا هُوَ بِمَيِّتٍ وَمِنْ وَرَائِهِ عَذَابٌ غَلِيظٌ ﴿17﴾ { إبراهيم :১৫ـ১৭}

তারা বিজয় কামনা করলো এবং প্রত্যেক উদ্ধত স্বৈরাচারী ব্যর্থকাম হলো। তাদের প্রত্যেকের জন্য পরিণামে জাহান্নাম রয়েছে এবং প্রত্যেককে পান করানো হবে গলিত পূঁজ। যা সে অতি কষ্টে গলধ:করণ করবে এবং তা গলধ:করণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে; সর্বদিক হতে তার নিকট আসবে মৃত্যু যন্ত্রনা;কিন্তু তার মৃত্যু ঘটবে না এবং সে কঠোর শাস্তি ভোগ করতেই থাকবে।{সূরা ইবরাহীম:১৫-১৭}

২-অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

وسقوا ماء حميما فقطع أمعاءهم . { محمد :১৫}

এবং তাদের পান করানো হবে ফুটন্ত পানি অত:পর তা তাদের নাড়িভূঁড়ি ছিন্ন বিছিন্ন করে দিবে। {সূরা মুহাম্মাদ:১৫}

৩- আরো ইরশাদ হচ্ছে:

إِنَّا أَعْتَدْنَا لِلظَّالِمِينَ نَارًا أَحَاطَ بِهِمْ سُرَادِقُهَا وَإِنْ يَسْتَغِيثُوا يُغَاثُوا بِمَاءٍ كَالْمُهْلِ يَشْوِي الْوُجُوهَ بِئْسَ الشَّرَابُ وَسَاءَتْ مُرْتَفَقًا

{ الكهف :২৯}

আমি যালেমদের জন্য অগ্নি প্রস্ত্তত করে রেখেছি, যার বেষ্টনী তাদেরকে পরিবেষ্টন করে থাকবে। যদি তারা পানীয় প্রার্থনা করে, তবে পূঁজের ন্যায় পানীয় দেয়া হবে, যা তাদের মুখমন্ডল দগ্ধ করবে। কত নিকৃষ্ট পানীয় এবং খুবই মন্দ আশ্রয়। {সূরা কাহাফ:২৯}

৪- আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলছেন:

هَذَا وَإِنَّ لِلطَّاغِينَ لَشَرَّ مَآَبٍ ﴿55﴾ جَهَنَّمَ يَصْلَوْنَهَا فَبِئْسَ الْمِهَادُ ﴿56﴾ هَذَا فَلْيَذُوقُوهُ حَمِيمٌ وَغَسَّاقٌ ﴿57﴾ وَآَخَرُ مِنْ شَكْلِهِ أَزْوَاجٌ ﴿58﴾

{ص:৫৫ـ৫৮}

এটাই (মুত্তাকীদের পরিণাম), আর সীমালঙ্ঘনকারীদের জন্য রয়েছে নিকৃষ্টতম ঠিকানা। তথা জাহান্নাম। তারা সেখানে প্রবেশ করবে। অতএব, কত নিকৃষ্ট সেই আবাসস্থল। এটা উত্তপ্ত পানি ও পূঁজ ;সুতরাং তারা একে আস্বাদন করুক। আরো আছে এরূপ বিভিন্ন ধরনের শাস্তি।{সূরা সোয়াদ:৫৫-৫৮}

২৩৮
জাহান্নামবাসীদের পোষাকের বিবরণ:
১-আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করছেন:

فَالَّذِينَ كَفَرُوا قُطِّعَتْ لَهُمْ ثِيَابٌ مِنْ نَارٍ يُصَبُّ مِنْ فَوْقِ رُءُوسِهِمُ الْحَمِيمُ

{ الحج : ১৯}

অত:এব যারা কাফের তাদের জন্য আগুনের পোষাক তৈরী করা হয়েছে। তাদের মাথার উপর ফুটন্ত পানি ঢেলে দেয়া হবে।{সূরা হজ্ব:১৯}

২-অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

وَتَرَى الْمُجْرِمِينَ يَوْمَئِذٍ مُقَرَّنِينَ فِي الْأَصْفَادِ ﴿49﴾ سَرَابِيلُهُمْ مِنْ قَطِرَانٍ وَتَغْشَى وُجُوهَهُمُ النَّارُ ﴿50﴾

{ إبراهيم :৪৯-৫০}

সে দিন তুমি অপরাধীদেরকে দেখবে শৃঙ্খলিত অবস্থায়। তাদের জামা হবে আলকাতরার এবং অগ্নি আছন্ন করবে তাদের মুখমন্ডল। {সূরা ইবরাহীম:৪৯-৫০}

২৩৯
জাহান্নামীদের বিছানা:
মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করছেন:

لَهُمْ مِنْ جَهَنَّمَ مِهَادٌ وَمِنْ فَوْقِهِمْ غَوَاشٍ وَكَذَلِكَ نَجْزِي الظَّالِمِينَ

{ الأعراف :৪১}

তাদের জন্য নরকাগ্নির শয্যা রয়েছে এবং উপর থেকে চাদর। আমি এমনিভাবে জালেমদের শাস্তি প্রদান করে থাকি।{সূরা আরাফ:৪১}

২৪০
জাহান্নামবাসীদের অনুতাপ:
১- আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করছেন:

كَذَلِكَ يُرِيهِمُ اللَّهُ أَعْمَالَهُمْ حَسَرَاتٍ عَلَيْهِمْ وَمَا هُمْ بِخَارِجِينَ مِنَ النَّارِ

{ البقرة :১৬৭}

এভাবেই আল্লাহ তাআলা তাদের কে দেখাবেন তাদের কৃতকর্ম তাদের অনুতপ্ত করার জন্য। তারা কস্মিনকালেও আগুন (জাহান্নাম) থেকে বের হতে পারবে না। {সূরা বাকারাহ: ১৬৭}

২- হাদীসে এসেছে

وعن أبي هريرة رضي الله عنه قال : قال النبي صلى الله عليه وسلم : ( لا يدخل أحد الجنة إلا أري مقعده من النار لو أساء ليزداد شكرا , ولا يدخل النار أحد إلا أري مقعده من الجنة لو أحسن , ليكون عليه حسرة ). أخرجه البخاري

সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করছেন: কোন ব্যক্তিই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না যতক্ষণ না জাহান্নামে তার অবস্থান দেখানো হয় যদি পাপ কর্ম করে থাকে। যাতে অধিক পরিমাণে শুকরিয়া ও কৃতজ্ঞতা আদায় করতে পারে। অনুরূপভাবে কোন ব্যক্তিই জাহান্নামে প্রবেশ করতে পারবে না, যতক্ষণ না জান্নাতে তার অবস্থান দেখানো হয় যদি পূণ্যকর্ম করে থাকে, যাতে বেশী করে অনুতাপ হয়। [বর্ণনায় বুখারী হাদীস নং (৬৫২৯)।]

وعن أنس رضي الله عنه أن النبي صلى الله عليه وسلم قال : إن الله يقول لأهون أهل النار عذابا : لو أن لك ما في الأرض من شيئ أ كنت تفتدي به؟قال : نعم , قال : فقد سألتك ما هو أهون من هذا و أنت في صلب آدم : أن لا تشرك بي , فأبيت إلا الشرك )). متفق عليه .

বিশিষ্ট সাহাবী আনাস বিন মালেক রাদিয়াল্লাহ আনহু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করছেন, নবীজী বলেন, মহান আল্লাহ তাআলা সবচে সহজ শাস্তি ভোগকারী জাহান্নামীকে জিজ্ঞেস করবেন: পৃথিবীস্থিত সমস্ত কিছু যদি তোমার হতো তুমি কি এ শাস্তির মুক্তিপণ হিসাবে সেগুলো দান করতে? সে বলবে, হ্যাঁ। তখন আল্লাহ তাআলা বলবেন: তুমি যখন আদমের ওরসে ছিলে আমি তোমার নিকট এরচেয়ে সহজ জিনিষ কামনা করেছিলাম যে তুমি কাউকে আমার সমকক্ষ - শরীক স্থির করবে না। অথচ তুমি তা অস্বীকার করেছ এবং শরীক স্থির করেছ। [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং যথাক্রমে (৩৩৩৪) এবং (২৮০৫)।]

২৪১
জাহান্নামীদের কথপোকথন:
১-আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা বলেন:

قَالَ ادْخُلُوا فِي أُمَمٍ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِكُمْ مِنَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ فِي النَّارِ كُلَّمَا دَخَلَتْ أُمَّةٌ لَعَنَتْ أُخْتَهَا حَتَّى إِذَا ادَّارَكُوا فِيهَا جَمِيعًا قَالَتْ أُخْرَاهُمْ لِأُولَاهُمْ رَبَّنَا هَؤُلَاءِ أَضَلُّونَا فَآَتِهِمْ عَذَابًا ضِعْفًا مِنَ النَّارِ قَالَ لِكُلٍّ ضِعْفٌ وَلَكِنْ لَا تَعْلَمُونَ ﴿38﴾ وَقَالَتْ أُولَاهُمْ لِأُخْرَاهُمْ فَمَا كَانَ لَكُمْ عَلَيْنَا مِنْ فَضْلٍ فَذُوقُوا الْعَذَابَ بِمَا كُنْتُمْ تَكْسِبُونَ ﴿39﴾

{ الأعراف :৩৮-৩৯}

আল্লাহ বলবেন: তোমাদের পূর্বে জিন ও মানবের যেসব সম্প্রদায় চলে গেছে, তাদের সাথে তোমরা ও জাহান্নামে প্রবেশ কর। যখন এক সম্প্রদায় প্রবেশ করবে; তখন অন্য সম্প্রদায়কে অভিসম্পাত করবে। এমনকি, যখন তাতে সবাই পতিত হবে, তখন পরবর্তীরা পূর্ববর্তীদের সম্পর্কে বলবে: হে আমাদের প্রতিপালক! এরাই আমাদের বিপদগামী করেছিল। অতএব আপনি তাদের দ্বিগুন শাস্তি দিন। আল্লাহ বলবেন: প্রত্যেকেরই দ্বিগুণ, তোমরা জান না। পূর্ববর্তী পরবর্তীদেরকে বলবে: তাহলে আমাদের উপর তোমাদের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। অতএব শাস্তি আস্বাদন কর স্বীয় কর্মের কারণে।

{সূরা আ’রাফ:৩৮-৩৯}

২- আল্লাহ তাআলা আরোও বলছেন:

ثُمَّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَكْفُرُ بَعْضُكُمْ بِبَعْضٍ وَيَلْعَنُ بَعْضُكُمْ بَعْضًا وَمَأْوَاكُمُ النَّارُ وَمَا لَكُمْ مِنْ نَاصِرِينَ

{ العنكبوت :২৫}

এরপর কেয়ামতের দিন তোমরা একে অপরকে অস্বীকার করবে এবং এক অপরকে লা’নত করবে। তোমাদের ঠিকানা জাহান্নাম এবং তোমাদের কোন সাহায্যকারী নেই।{সূরা আল আনকাবূত:২৫}

৩-অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

لا تدعوا اليوم ثبورا واحدا و ادعوا ثبورا كثيرا . { الفرقان :১৪}

বলা হবে, তোমরা আজ এক মৃত্যুকে ডেকোনা-অনেক মৃত্যুকে ডাকো। {সূরা আল ফোরকান:১৪}

২৪২
জাহান্নামে শাস্তিভোগকারী লোকদের কিছু নমুনা
১- কাফের ও মুনাফেক:

আল্লাহ তাআলা বলেন:

وَعَدَ اللَّهُ الْمُنَافِقِينَ وَالْمُنَافِقَاتِ وَالْكُفَّارَ نَارَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا هِيَ حَسْبُهُمْ وَلَعَنَهُمُ اللَّهُ وَلَهُمْ عَذَابٌ مُقِيمٌ

{ التوبة :৬৮}

আল্লাহ তাআলা মুনাফেক পুরুষ ও মুনাফেক নারীদের এবং কাফেরদের জন্য জাহান্নামের আগুনের ওয়াদা করেছেন, তাতে তারা সর্বদা পড়ে থাকবে। সেটাই তাদের জন্য যথেষ্ট। আর আল্লাহ তাদের প্রতি অভিসম্পাত করেছেন এবং তাদের জন্য রয়েছে স্থায়ী আযাব।

{সূরা তাওবা:৬৮}

২-ইচ্ছাকৃত ভাবে নিরপরাধ লোকদের হত্যাকারী:

১-পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে:

وَمَنْ يَقْتُلْ مُؤْمِنًا مُتَعَمِّدًا فَجَزَاؤُهُ جَهَنَّمُ خَالِدًا فِيهَا وَغَضِبَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَلَعَنَهُ وَأَعَدَّ لَهُ عَذَابًا عَظِيمًا

{ النساء :৯৩}

যে ব্যক্তি স্বেচ্ছাক্রমে মুসলমানকে হত্যা করে, তার শাস্তি হচ্ছে জাহান্নাম, তাতেই সে চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন, তাকে অভিসম্পাত করেছেন এবং তার জন্য ভীষণ শাস্তি প্রস্ত্তত রেখেছেন। {সূরা নিসা:৯৩}

২- হাদীসে এসেছে

وعن عبد الله عمرو رضي الله عنهما عن النبي صلى الله عليه وسلم قال : من قتل معاهدا لم يرح رائحة الجنة وإن ريحها يوجد من مسيرة أربعين عاما . أخرجه البخاري

সহাবী আব্দুল্লাহ বিন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লালালহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: যে ব্যাক্তি কোন মুআহাদ (ইসলামী রাষ্ট্রে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি প্রাপ্ত অমুসলিম ব্যাক্তি) কে হত্যা করবে সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। যদিও জান্নাতের সুঘ্রাণ চল্লিশ বৎসর ভ্রমন পথের দূরত্ব থেকেও পাওয়া যায়। [বর্ণনায় বুখারী , হাদীস নং (৩১৬৬)।]

৩-যিনকার নারী ও পুরুষ:

عن سمرة بن جندب رضي الله عنه قال : كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يعني مما يكثر أن يقول لأصحابه : هل رأى أحد منكم من رؤيا؟ ـ وفيه ـ أنه قال ذات غداة : إنه أتاني الليلة آتيان , وإنهما ابتعثاني وإنهما قالا لي انطلق ... فانطلقنا فأتينا على مثل التنور , فإذا فيه لغط و أصوات , قال : فاطلعنا فيه , فإذا فيه رجال و نساء عراة , وإذاهم يأتيهم لهب من أسفل منهم فإذا أتاهم ذلك اللهب ضوضوا , قال : قلت لهما ما هؤلاء؟ ... ـ وفيه ـ فقالا : وأما الرجال و النساء العراة الذين في مثل بناء التنور فهم الزناة والزواني ... . أخرجه البخاري

প্রসিদ্ধ সাহাবী সামুরা বিন জুন্দুব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলছেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রায়ই তাঁর সাহাবীদের বলতেন: তোমাদের কেউ কি কোন সপ্ন দেখেছ? - সে হাদীসে আছে - তিনি একদিন সকালে বললেন: গত রাত (সপ্নে দেখি) দু’জন আগন্তক আমার নিকট আসল, তারা আমাকে জাগিয়ে তুলল এবং বলল আমাদের সাথে চলুন... আমরা চলছিলাম এক পর্যায়ে একটি তন্দুরী সদৃশ গর্তের নিকট এসে পৌঁছালাম, দেখি খুব শোরগোল ও চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে, এরপর আমরা তার ভিতরে কি আছে জানার জন্য তাকিয়ে দেখি, বিবস্ত্র অনেক নারী পুরুষ এবং তাদের নিম্ন দিক থেকে অগ্নিশিখা এসে তাদের উপর আছড়ে পড়ছে। যখন সেই অগ্নিশিখা আছড়ে পড়ে তখন তারা আওয়াজ করে চেচিয়ে উঠে। আমি সাথীদ্বয়ের নিকট জিজ্ঞেস করলাম এরা কারা?...- তাতে আছে - তারা জবাবে বললেন : ঐ বিবস্ত্র নারী পুরুষ যারা তন্দুরী সদৃশ ঘরে অবস্থান করছে তারা হচ্ছে যিনাকার নারী এবং যিনাকার পুরুষ...। [বুখারী হাদীস নং (৭০৪৭)]

৪- সুদখোর:

في حديث سمرة بن جندب رضي الله عنه السابق قال النبي صلى الله عليه وسلم : فانطلقنا حتى أتينا على نهر من دم فيه رجل قائم على وسط النهر , وعلى شط النهر رجل بين يديه حجارة , فأقبل الرجل الذي في النهر , فإذا أراد أن يخرج رمى الرجل بحجر في فيه فرده حيث كان , فجعل كلما جاء ليخرج رمى في فيه بحجر فيرجع كما كان فقلت ما هذا؟ ... قال والذي رأيته في النهر آكلوا الربا . أخرجه البخاري

সাহাবী সামুরা বিন জুন্দুব কর্তৃক বর্ণিত পূর্বের হাদীসে আছে, নবীজী বলেন: আমরা চলছিলাম এক পর্যায়ে একটি রক্তের নদীতে এসে পৌঁছালাম, দেখি একজন লোক নদীর মধ্যখানে দাড়িয়ে আছে আর অন্য একজন নদীর পাড়ে তার সামনে কিছু পাথর পড়ে আছে। নদীতে অবস্থানরত লোকটি এদিকে আসতে চাচ্ছে যখন বের হওয়ার ইচ্ছা করে তখনই দাড়ানো লোকটি তার মুখে একটি পাথর নিক্ষেপ করে এবং পূর্বে অবস্থানে ফেরত পাঠায়। এমনি করে যখনই সে বের হতে চায়, তখনই পাড়ের লোক পাথর নিক্ষেপ করে এবং পূর্বের অবস্থানে ফেরত যায়। আমি জিজ্ঞেস করলাম এ কে?... তারা বললেন : ঐযে নদীতে যাকে দেখেছেন সে হচ্ছে ‘‘সুদখোর’’। [বর্ণনায় বুখারী হাদীস নং (১৩৮৬ )]

৫-চিত্রাংকন কারী:

১-হাদীসে এসেছে

عن ابن عباس رضي الله عنهما قال : سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول : كل مصور في النار يجعل له بكل صورة صورها نفسا فتعذبه في جهنم . أخرجه مسلم

বিশিষ্ট সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বর্ণনা করছেন, আমি রাসূলুল্লাহ কে ইরশাদ করতে শুনেছি, নবীজী বলেন: প্রাণীর চিত্রাঙ্কনকারী জাহান্নামে যাবে। তার বানানো প্রত্যেক ছবির পরিবর্তে তার জন্য একটি করে জীবন বানানো হবে এবং জাহান্নামে শাস্তি দেয়া হবে। [বর্ণনায় মুসলিম , হাদীস নং (২১১০)]

২- হাদীসে এসেছে

وعن عائشة رضي الله عنها قالت : دخل علي رسول الله صلى الله عليه وسلم وقد سترت سهوة لي بقرام فيه تماثيل , فلما رآه هتكه و تلون وجهه وقال : يا عائشة أشد الناس عذابا عند الله يوم القيامة الذين يضاهون بخلق الله , قالت عائشة : فقطعناه فجعلنا منه وسادة أو وسادتين . متفق عليه

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন আমার ঘরে প্রবেশ করলেন, আমি ঘরের প্রবেশ পথে একটি পর্দা টানিয়েছিলাম যাতে প্রাণীর ছবি ছিল। রাসূলুল্লাহ তা দেখে ছিঁড়ে ফেললেন এবং তাঁর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। তিনি বললেন: আয়েশা! কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলার নিকট সবচেয়ে কঠিন আযাব সে সব লোকদের হবে যারা আল্লাহর সৃষ্টির সামঞ্জস্য স্থির করেছিল। (অর্থাৎ যারা তাঁর সৃষ্টির অনুরূপ আকৃতি অংকন করেছিল) আয়েশা বলেন: এরপর আমরা সেটি কেটে ফেললাম এবং তা দিয়ে একটি বা দুটি বালিশ বানিয়ে নিলাম। [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং যথাক্রমে (৫৯৫৪) ও (২১০৭)।]

৩- হাদীসে এসেছে

وعن ابن عباس رضي الله عنهما قال سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول : من صور صورة في الدنيا كلف أن ينفخ فيها الروح يوم القيامة وليس بنافخ . متفق عليه

বিশিষ্ট সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ইরশাদ করতে শুনেছি: যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কোন প্রাণীর ছবি অঙ্কন করবে, কেয়ামত দিবসে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাকে তাতে প্রাণ সঞ্চারনের দায়িত্ব দেয়া হবে অথচ সে তাতে অক্ষম। [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম । হাদীস নং যথা ক্রমে (৭০৪২) ও (২১১০)।]

৬-ইয়াতীমের সম্পদ ভক্ষনকারী:

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

إِنَّ الَّذِينَ يَأْكُلُونَ أَمْوَالَ الْيَتَامَى ظُلْمًا إِنَّمَا يَأْكُلُونَ فِي بُطُونِهِمْ نَارًا وَسَيَصْلَوْنَ سَعِيرًا ﴿10﴾

{ النساء :১০}

যারা অন্যায়-অন্যায্যভাবে ইয়াতীমদের অর্থ-সম্পদ ভক্ষণ করে, তারা নিজেদের পেটে আগুনই ভর্তি করেছে এবং সত্বরই তারা প্রজ্বলিত অগ্নিতে (জাহান্নামে) প্রবেশ করবে।

{সূরা নিসা: ১০}

৭-মিথ্যাবাদী, পরনিন্দা ও পরচর্চা কারী:

১-মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করছেন:

وَأَمَّا إِنْ كَانَ مِنَ الْمُكَذِّبِينَ الضَّالِّينَ ﴿92﴾ فَنُزُلٌ مِنْ حَمِيمٍ ﴿93﴾ وَتَصْلِيَةُ جَحِيمٍ ﴿94﴾

{ الواقعة :৯২-৯৪}

আর যদি সে পথভ্রষ্ট মিথ্যারোপকারীদের একজন হয়। তবে তার আপ্যায়ন হবে উত্তপ্ত পানি দ্বারা। এবং সে নিক্ষিপ্ত হবে জাহান্নামে।{সূরা ওয়াকিয়া:৯২-৯৪}

২- হাদীসে এসেছে

وعن معاذ بن جبل رضي الله عنه قال : كنت مع النبي صلى الله عليه وسلم في سفر ـ وفيه ـ فقلت يا نبي الله , وإنا لمؤاخذون بما نتكلم به ؟ فقال : ثكلتك أمك يا معاذ , وهل يكب الناس في النار على وجوههم أو على مناخرهم إلا حصائد ألسنتهم . أخرجه الترمذي وابن ماجة

সাহাবী মুআয বিন জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি এক সফরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ছিলাম, -তাতে আছে- আমি বললাম: ইয়া নবীয়াল্লাহ; আমরা যে সব কথাবার্তা বলি তার কারণেও কি আমাদের ধরা হবে? নবীজী বললেন: মুআয-তোমার মা সন্তানহারা হউক- মানুষকে যে চেহারার উপর ভর করে অথবা নাকের উপর ভরকরে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে, সেতো জিহবারই ফসল(কামাই)। [হাদীসটি সহীহ সনদে তিরমিজী (২৬১৬) ও ইবনে মাজাহ (৩৯৭৩) তে বর্ণিত হয়েছে।]

৮-আল্লাহ তাআলার নাযিলকৃত বিধান গোপনকারী:

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা ইরশাদ করছেন:

إِنَّ الَّذِينَ يَكْتُمُونَ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ مِنَ الْكِتَابِ وَيَشْتَرُونَ بِهِ ثَمَنًا قَلِيلًا أُولَئِكَ مَا يَأْكُلُونَ فِي بُطُونِهِمْ إِلَّا النَّارَ وَلَا يُكَلِّمُهُمُ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلَا يُزَكِّيهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ

{ البقرة :১৭৪}

নিশ্চয় যারা সেসব বিষয় গোপন করে যা আল্লাহ কিতাবে নাযিল করেছেন এবং সে জন্য অল্প মূল্য গ্রহণ করে, তারা আগুন ছাড়া নিজের পেটে আর কিছুই ঢুকায় না। কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তাদের সাথে কথা বলবেন না এবং না তাদের পবিত্র করবেন না, বস্ত্তত: তাদের জন্য রয়েছে বেদনা দায়ক আযাব।{সূরা বাকারা:১৭৪}

২৪৩
জাহান্নামীদের ঝগড়া-বিবাদ:
অমুসলিম-কাফেরদের জন্য আল্লাহ তাআলা যে আযাব প্রস্ত্তত করে রেখেছেন তারা তা প্রত্যক্ষ করার পর নিজেদেরকে এবং পৃথিবীতে যেসকল বন্ধু বান্ধব ছিল তাদেরকে খুব ঘৃণা করতে লাগবে। তাদের মাঝে বিদ্যমান সকল মিল মুহাববত শত্রুতায় পরিবর্তিত হয়ে যাবে।এরপর জাহান্নামীরা একে অপরকে দোষারোপ করতে লাগবে। তাদের নিজস্ব অবস্থানগত বিভিন্নতার জন্য বিতর্কে লিপ্ত হয়ে পড়বে।

১- উপাসকদের স্বীয় উপাস্যদিগকে দোষারোপ করা:

قَالُوا وَهُمْ فِيهَا يَخْتَصِمُونَ ﴿96﴾ تَاللَّهِ إِنْ كُنَّا لَفِي ضَلَالٍ مُبِينٍ ﴿97﴾ إِذْ نُسَوِّيكُمْ بِرَبِّ الْعَالَمِينَ ﴿98﴾ وَمَا أَضَلَّنَا إِلَّا الْمُجْرِمُونَ ﴿99﴾

{ الشعراء :৯৬-৯৯}

তারা তথায় কথা কাটাকাটিতে লিপ্ত হয়ে বলবে, আল্লাহর কসম আমরা প্রকাশ্য বিভ্রান্তিতে লিপ্ত ছিলাম, যখন আমরা তোমাদেরকে বিশ্ব-পালনকর্তা আল্লাহর সমতুল্য গণ্য করতাম। আমাদেরকে দুষ্টকর্মীরাই গোমরাহ করেছিল। {সূরা আশ্ শোআরা:৯৬-৯৯}

২- দুর্বল-অধিনস্থদের অহংকারী নেত্রীবর্গদিগকে দোষারোপ করা:

وَإِذْ يَتَحَاجُّونَ فِي النَّارِ فَيَقُولُ الضُّعَفَاءُ لِلَّذِينَ اسْتَكْبَرُوا إِنَّا كُنَّا لَكُمْ تَبَعًا فَهَلْ أَنْتُمْ مُغْنُونَ عَنَّا نَصِيبًا مِنَ النَّارِ ﴿47﴾ قَالَ الَّذِينَ اسْتَكْبَرُوا إِنَّا كُلٌّ فِيهَا إِنَّ اللَّهَ قَدْ حَكَمَ بَيْنَ الْعِبَادِ ﴿48﴾

{ غافر :৪৭-৪৮}

যখন তারা জাহান্নামে পরস্পর বিতর্ক করবে, অত:পর দুর্বলরা অহংকারীদেরকে বলবে, আমরা তোমাদের অনুসারী ছিলাম। তোমরা এখন জাহান্নামের আগুনের কিছু অংশ আমাদের থেকে নিবৃত করবে কি? অহংকারীরা বলবে, আমরা সবাইতো জাহান্নামে আছি। আল্লাহ তার বান্দাদের ফায়সালা করে দিয়েছেন। { সূরা গাফের:৪৭-৪৮}

৩-পথভ্রষ্ট নেতাদের সাথে অনুসারীদের বিতর্ক:

وَأَقْبَلَ بَعْضُهُمْ عَلَى بَعْضٍ يَتَسَاءَلُونَ ﴿27﴾ قَالُوا إِنَّكُمْ كُنْتُمْ تَأْتُونَنَا عَنِ الْيَمِينِ ﴿28﴾ قَالُوا بَلْ لَمْ تَكُونُوا مُؤْمِنِينَ ﴿29﴾ وَمَا كَانَ لَنَا عَلَيْكُمْ مِنْ سُلْطَانٍ بَلْ كُنْتُمْ قَوْمًا طَاغِينَ ﴿30﴾ فَحَقَّ عَلَيْنَا قَوْلُ رَبِّنَا إِنَّا لَذَائِقُونَ ﴿31﴾ فَأَغْوَيْنَاكُمْ إِنَّا كُنَّا غَاوِينَ ﴿32﴾ فَإِنَّهُمْ يَوْمَئِذٍ فِي الْعَذَابِ مُشْتَرِكُونَ ﴿33﴾

{ الصافات :২৭-৩৩}

তারা একে অপরের সামনা সামনি হয়ে পরস্পরকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। বলবে,তোমরা তো (শক্তি প্রয়োগ করে পথভ্রষ্ট করতে) আমাদের কাছে ডান দিক থেকে আসতে। তারা বলবে, বরং তোমরা তো বিশ্বাসীই ছিলে না। এবং তোমাদের উপর আমাদের কোন কর্তৃত্ব ছিল না, বরং তোমরাই ছিলে সীমানঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়। আমাদের বিপক্ষে আমাদের পালনকর্তার উক্তিই সত্য হয়েছে, আমাদেরকে অবশ্যই শাস্তি আস্বাদন করতে হবে। আমরা তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিলাম কারণ, আমরা নিজেরাই পথভ্রষ্ট ছিলাম। তারা সবাই সেদিন আযাবে শরীক হবে।{সূরা সাফ্ফাত:২৭-৩৩}

৪-কাফের ও তার সহচর শয়তানের বিতর্ক:

قَالَ لَا تَخْتَصِمُوا لَدَيَّ وَقَدْ قَدَّمْتُ إِلَيْكُمْ بِالْوَعِيدِ ﴿28﴾ مَا يُبَدَّلُ الْقَوْلُ لَدَيَّ وَمَا أَنَا بِظَلَّامٍ لِلْعَبِيدِ ﴿29﴾

{ق:২৭-২৯}

তার সহচর শয়তান বলবে: হে আমাদের প্রতিপালক, আমি তাকে অবাধ্য হতে প্ররোচিত করিনি, বস্ত্তত: সে নিজেই ছিল সুদূর পথভ্রন্তিতে লিপ্ত। আল্লাহ বলবেন, আমার সামনে বাকবিতন্ডা করোনা। আমিতো পূর্বেই তোমাদেরকে আযাব দ্বারা ভয় প্রদর্শন করেছিলাম। আমার কাছে কথা রদবদল হয় না এবং আমি বান্দাদের প্রতি জুলুমকারী নই।{সূরা ক্বাফ:২৭-২৯}

৫-মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যখন তার নিজের বিপক্ষে বিতর্ক-বিবাদ করবে তখন বিষয় অতি মারাত্মক পর্যায়ে পৌছে যাবে।

وَيَوْمَ يُحْشَرُ أَعْدَاءُ اللَّهِ إِلَى النَّارِ فَهُمْ يُوزَعُونَ ﴿19﴾ حَتَّى إِذَا مَا جَاءُوهَا شَهِدَ عَلَيْهِمْ سَمْعُهُمْ وَأَبْصَارُهُمْ وَجُلُودُهُمْ بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ ﴿20﴾ وَقَالُوا لِجُلُودِهِمْ لِمَ شَهِدْتُمْ عَلَيْنَا قَالُوا أَنْطَقَنَا اللَّهُ الَّذِي أَنْطَقَ كُلَّ شَيْءٍ وَهُوَ خَلَقَكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ ﴿21﴾ { فصلت :১৯-২১}

যে দিন আল্লাহর শত্রুদেরকে অগ্নিকুন্ডের দিকে ঠেলে নেওয়া হবে। এবং ওদের বিন্যস্ত করা হবে বিভিন্ন দলে। তারা যখন জাহান্নামের কাছে পৌছবে, তখন তাদের কান, চক্ষু ও ত্বক তাদের কর্ম সম্পর্কে সাক্ষ্য দেবে। তারা তাদের ত্বককে বলবে, তোমরা আমাদের বিপক্ষে সাক্ষ্য দিলে কেন? তারা বলবে, যে আল্লাহ সবকিছুকে বাকশক্তি দিয়েছেন, তিনি আমাদেরকেও বাক শক্তি দিয়েছেন। তিনিই তোমাদেরকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন এবং তোমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে।{সূরা ফুসসিলাত:১৯-২১}

২৪৪
জাহান্নামীদের স্বীয় পালনকর্তার নিকট তাদের বিভ্রান্তকারীদের দেখা এবং শাস্তি দ্বিগুন করার প্রার্থনা
১- মহান আল্লাহ তাআলা বলেন:

وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا رَبَّنَا أَرِنَا الَّذَيْنِ أَضَلَّانَا مِنَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ نَجْعَلْهُمَا تَحْتَ أَقْدَامِنَا لِيَكُونَا مِنَ الْأَسْفَلِينَ { فصلت :২৯}

কাফেররা বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা! যেসব জিন ও মানুষ আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল, তাদের দেখিয়ে দাও, আমরা তাদেরকে পদদলিত করব, যাতে তারা যথেষ্ট অপমানিত হয়।{সূরা ফুসসিলাত:২৯}

২-অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

يَوْمَ تُقَلَّبُ وُجُوهُهُمْ فِي النَّارِ يَقُولُونَ يَا لَيْتَنَا أَطَعْنَا اللَّهَ وَأَطَعْنَا الرَّسُولَا ﴿66﴾ وَقَالُوا رَبَّنَا إِنَّا أَطَعْنَا سَادَتَنَا وَكُبَرَاءَنَا فَأَضَلُّونَا السَّبِيلَا ﴿67﴾ رَبَّنَا آَتِهِمْ ضِعْفَيْنِ مِنَ الْعَذَابِ وَالْعَنْهُمْ لَعْنًا كَبِيرًا ﴿68﴾

{ الأحزاب :৬৬-৬৮}

যেদিন অগ্নিতে তাদের মুখমন্ডল উলট পালট করা হবে; সেদিন তারা বলবে হায় আমরা যদি আল্লাহর আনুগত্য করতাম ও রাসূলের আনুগত্য করতাম। তারা আরও বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা, আমরা আমাদের নেতা ও বড়দের কথা মেনেছিলাম, অত:পর তারা আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল। হে আমাদের পালনকর্তা তাদেরকে দ্বিগুন শাস্তি দিন এবং তাদেরকে মহা অভিসম্পাত করুন। {সূরা আহযাব:৬৬-৬৮}

২৪৫
জাহান্নামীদের মাঝে ইবলিসের ভাষণ:
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা যখন বিষয়টি চুড়ান্ত করবেন এবং স্বীয় বান্দাদের মাঝে ফায়সালা করবেন। ইবলিস জাহান্নামীদের মাঝে ভাষণ দেবে যাতে তাদের পেরেশানী, লজ্যা ও অনুতাপ বৃদ্ধি পায়।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

وَقَالَ الشَّيْطَانُ لَمَّا قُضِيَ الْأَمْرُ إِنَّ اللَّهَ وَعَدَكُمْ وَعْدَ الْحَقِّ وَوَعَدْتُكُمْ فَأَخْلَفْتُكُمْ وَمَا كَانَ لِي عَلَيْكُمْ مِنْ سُلْطَانٍ إِلَّا أَنْ دَعَوْتُكُمْ فَاسْتَجَبْتُمْ لِي فَلَا تَلُومُونِي وَلُومُوا أَنْفُسَكُمْ مَا أَنَا بِمُصْرِخِكُمْ وَمَا أَنْتُمْ بِمُصْرِخِيَّ إِنِّي كَفَرْتُ بِمَا أَشْرَكْتُمُونِ مِنْ قَبْلُ إِنَّ الظَّالِمِينَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ

.{ ابراهيم :২২}

যখন সব কাজের ফায়সালা হয়ে যাবে, তখন শয়তান বলবে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে সত্য ওয়াদা দিয়েছিলেন এবং আমি তোমাদের সাথে ওয়াদা করেছি অত:পর তা ভঙ্গ করেছি। তোমাদের উপরতো আমার কোন ক্ষমতা ছিল না, কিন্তু এতটুকু যে, আমি তোমাদেরকে ডেকেছি তোমরা আমার ডাকে সাড়া দিয়েছ। অতএব তোমরা আমাকে ভৎর্সনা করোনা এবং নিজেদেরকেই ভৎর্সনা কর। আমি তোমাদের উদ্ধারে সাহায্যকারী নই এবং তোমরাও আমার উদ্ধারে সাহায্যকারী নও। ইতিপূর্বে তোমরা আমাকে যে আল্লাহর শরীক করেছিলে, আমি তা অস্বীকার করি। নিশ্চয় যারা জালেম তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি। {সূরা ইবরাহীম:২২}

২৪৬
জাহান্নামের আরোও চাওয়া:
১-আল্লাহ তাআলা বলেন:

يوم نقول لجهنم هل امتلأت وتقول هل من مزيد . {ق:৩০}

যেদিন আমি জাহান্নামকে জিজ্ঞেস করব; তুমি কি পূর্ণ হয়ে গেছ? সে বলবে আরও আছে কি? {সূরা ক্বাফ:৩০}

২-হাদীসে এসেছে

وعن أنس بن مالك رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم أنه قال : لا تزال جهنم يلقى فيها و تقول : هل من مزيد , حتى يضع رب العزة فيها قدمه , فينزوي بعضها إلى بعض , وتقول قط قط بعزتك وكرمك , ولا يزال في الجنة فضل حتى ينشئ الله لها خلقا , فيسكنهم فضل الجنة . متفق عليه

বিশিষ্ট সাহাবী আনাস বিন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী আকরাম সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করছেন, নবীজী বলেন, জাহান্নামের ভিতর একের পর এক নিক্ষেপ করা হতে থাকবে আর সে বলতে থাকবে আরো আছে কি? এক পর্যায়ে মহান রাববুল ইয্যত তাতে স্বীয় কদম রাখবেন ফলশ্রুতিতে তার কিছু অংশ অন্য অংশের সাথে মিশে সংকুচিত হয়ে যাবে এবং সে বলবে, তোমার ইয্যত ও করমের কসম আমার যথেষ্ট হয়ে গেছে। আর জান্নাতে কিছু অতিরিক্ত অংশ খালী থেকেই যাবে এক সময় আল্লাহ তাআলা তার জন্য একটি বিশেষ মাখলূক সৃষ্টি করবেন এবং তাদেরকে সেই অতিরিক্ত স্থানে থাকতে দেবেন। [বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং যথাক্রমে (৪৮৪৮) ও (২৮৪৮)।]

২৪৭
জাহান্নামীদের হাল-অবস্থার কিছু নমুনা
ইরশাদ হচ্ছে:

إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا بِآَيَاتِنَا سَوْفَ نُصْلِيهِمْ نَارًا كُلَّمَا نَضِجَتْ جُلُودُهُمْ بَدَّلْنَاهُمْ جُلُودًا غَيْرَهَا لِيَذُوقُوا الْعَذَابَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَزِيزًا حَكِيمًا ﴿56﴾ { النساء :৫৬}

আমার আয়াতসমূহের প্রতি যে সব লোক অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করবে, আমি তাদের সত্তরই আগুনে নিক্ষেপ করব। তাদের চামড়াগুলো যখন জ্বলে-পুড়ে যাবে, তখন আমি আবার তা পালটে দেব অন্য চামড়া দিয়ে, যাতে তারা আযাব আস্বাদন করতে পার। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, হেকমতের অধিকারী। {সূরা নিসা:৫৬}

আল্লাহ তাআলা আরো বলেন:

إِنَّ الْمُجْرِمِينَ فِي عَذَابِ جَهَنَّمَ خَالِدُونَ ﴿74﴾ لَا يُفَتَّرُ عَنْهُمْ وَهُمْ فِيهِ مُبْلِسُونَ ﴿75﴾ وَمَا ظَلَمْنَاهُمْ وَلَكِنْ كَانُوا هُمُ الظَّالِمِينَ ﴿76﴾ { الزخرف :৭৪-৭৬}

নিশ্চয় অপরাধীরা জাহান্নামের আযাবে চিরকাল থাকবে। তাদের থেকে আযাব লাঘব করা হবে না এবং তারা তাতেই থাকবে হতাশ হয়ে। আমি তাদের প্রতি জুলুম করিনি; কিন্তু তারাই ছিল জালেম। { সূরা যুখরুফ: ৭৪-৭৬}

অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

إِنَّ اللَّهَ لَعَنَ الْكَافِرِينَ وَأَعَدَّ لَهُمْ سَعِيرًا ﴿64﴾ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا لَا يَجِدُونَ وَلِيًّا وَلَا نَصِيرًا ﴿65﴾ يَوْمَ تُقَلَّبُ وُجُوهُهُمْ فِي النَّارِ يَقُولُونَ يَا لَيْتَنَا أَطَعْنَا اللَّهَ وَأَطَعْنَا الرَّسُولَا ﴿66﴾ { الأحزاب :৬৪ـ৬৬)

নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরদের অভিসম্পাত করেছেন এবং তাদের জন্য জ্বলন্ত অগ্নি প্রস্ত্তত রেখেছেন। তথায় তারা অনন্ত কাল থাকবে এবং কোন অভিভাবক ও সাহায্যকারী পাবে না। যেদিন অগ্নিতে তাদের মুখমন্ডল ওলট পালট করা হবে; সেদিন তারা বলবে হায় ! আমরা যদি আল্লাহর আনুগত্য করতাম এবং রাসূলের আনুগত্য করতাম। {সূরা আহযাব: ৬৪-৬৬}

আরোও ইরশাদ হচ্ছে:

وَالَّذِينَ كَفَرُوا لَهُمْ نَارُ جَهَنَّمَ لَا يُقْضَى عَلَيْهِمْ فَيَمُوتُوا وَلَا يُخَفَّفُ عَنْهُمْ مِنْ عَذَابِهَا كَذَلِكَ نَجْزِي كُلَّ كَفُورٍ { فاطر :৩৬}

আর যারা কাফের হয়েছে তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন। তাদেরকে মৃত্যুর আদেশও দেয়া হবে না যে, তারা মরে যাবে এবং তাদের থেকে তার শাস্তিও লাঘব করা হবে না। আমি প্রত্যেক অকৃতজ্ঞকে এভাবেই শাস্তি দিয়ে থাকি।{সূরা ফাতির: ৩৬}

আরো ইরশাদ হচ্ছে:

فَأَمَّا الَّذِينَ شَقُوا فَفِي النَّارِ لَهُمْ فِيهَا زَفِيرٌ وَشَهِيقٌ ﴿106﴾ خَالِدِينَ فِيهَا مَا دَامَتِ السَّمَوَاتُ وَالْأَرْضُ إِلَّا مَا شَاءَ رَبُّكَ إِنَّ رَبَّكَ فَعَّالٌ لِمَا يُرِيدُ ﴿107﴾ هود : ১০৬ـ ১০৭}

অতএব যারা হতভাগ্য তারা জাহান্নামে যাবে, সেখানে তারা আর্তনাদ ও চিৎকার করতে থাকবে।তারা সেখানে চিরকাল থাকবে, যতদিন আসমান ও যমীন বিদ্যমান থাকবে।তবে তোমার প্রতিপালক অন্য কিছু ইচ্ছা করলে ভিন্ন কথা । নিশ্চয় তোমার পালনকর্তা যা ইচ্ছা করতে পারেন। {সূরা হুদ:১০৬-১০৭}

আরো ইরশাদ হচ্ছে:

فَوَرَبِّكَ لَنَحْشُرَنَّهُمْ وَالشَّيَاطِينَ ثُمَّ لَنُحْضِرَنَّهُمْ حَوْلَ جَهَنَّمَ جِثِيًّا ﴿68﴾ ثُمَّ لَنَنْزِعَنَّ مِنْ كُلِّ شِيعَةٍ أَيُّهُمْ أَشَدُّ عَلَى الرَّحْمَنِ عِتِيًّا ﴿69﴾ ثُمَّ لَنَحْنُ أَعْلَمُ بِالَّذِينَ هُمْ أَوْلَى بِهَا صِلِيًّا ﴿70﴾ { مريم :৬৮ ــ ৭০}

সুতরাং আপনার পালন কর্তার কসম, আমি অবশ্যই তাদেরকে এবং শয়তানদেরকে একত্রে সমবেত করব, অত:পর অবশ্যই তাদেরকে নতজানু অবস্থায় জাহান্নামের চারপাশে উপস্থিত করব। অত:পর প্রত্যেক সম্প্রদায়ের মধ্যে যে দয়াময় আল্লাহর সর্বাধিক অবাধ্য, আমি অবশ্যই তাকে পৃথক করে নেব। অত:পর তাদের মধ্যে যারা জাহান্নামের অধিক যোগ্য, আমি তাদের বিষয়ে ভালভাবে জ্ঞাত আছি। {সূরা মারইয়াম:৬৮-৭০}

আরো ইরশাদ হচ্ছে:

إِنَّ جَهَنَّمَ كَانَتْ مِرْصَادًا ﴿21﴾ لِلطَّاغِينَ مَآَبًا ﴿22﴾ لَابِثِينَ فِيهَا أَحْقَابًا ﴿23﴾ لَا يَذُوقُونَ فِيهَا بَرْدًا وَلَا شَرَابًا ﴿24﴾ إِلَّا حَمِيمًا وَغَسَّاقًا ﴿25﴾ جَزَاءً وِفَاقًا ﴿26﴾ { النبأ : ২১ـ ২৬}

নিশ্চয় জাহান্নাম প্রতীক্ষায় থাকবে, সীমালঙ্ঘনকরীদের আশ্রয়স্থলরূপে, তারা তথায় শতাব্দীর পর শতাব্দী অবস্থান করবে। তথায় তারা কোন শীতল এবং পানীয় আস্বাদন করবে না। কিন্তু ফুটন্ত পানি ও পুঁজ পাবে। পরিপূর্ণ প্রতিফল হিসেবে।{সূরা নাবা:২১-২৬}

আরো ইরশাদ হচ্ছে:

وَلِلَّذِينَ كَفَرُوا بِرَبِّهِمْ عَذَابُ جَهَنَّمَ وَبِئْسَ الْمَصِيرُ ﴿6﴾ إِذَا أُلْقُوا فِيهَا سَمِعُوا لَهَا شَهِيقًا وَهِيَ تَفُورُ ﴿7﴾ تَكَادُ تَمَيَّزُ مِنَ الْغَيْظِ كُلَّمَا أُلْقِيَ فِيهَا فَوْجٌ سَأَلَهُمْ خَزَنَتُهَا أَلَمْ يَأْتِكُمْ نَذِيرٌ ﴿8﴾ قَالُوا بَلَى قَدْ جَاءَنَا نَذِيرٌ فَكَذَّبْنَا وَقُلْنَا مَا نَزَّلَ اللَّهُ مِنْ شَيْءٍ إِنْ أَنْتُمْ إِلَّا فِي ضَلَالٍ كَبِيرٍ ﴿9﴾ { الملك :৬ـ৯}

যারা তাদের পালনকর্তাকে অস্বীকার করেছে তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের শাস্তি। সেটা কতইনা নিকৃষ্ট স্থান। যখন তারা তথায় নিক্ষিপ্ত হবে, তখন তার উৎক্ষিপ্ত গর্জন শুনতে পাবে। ক্রোধে জাহান্নাম যেন ফেটে পড়বে। যখনই তাতে কোন সম্প্রদায় নিক্ষিপ্ত হবে তখন তাদেরকে তার সিপাহীরা জিজ্ঞাসা করবে, তোমাদের কাছে কি কোন সতর্ককারী আগমন করেনি? তারা হ্যাঁ, আমাদের কাছে সতর্ককারী আগমন করেছিল, অত:পর আমরা মিথ্যারোপ করেছিলাম এবং বলেছিলাম: আল্লাহ তাআলা কোন কিছু নাযিল করেননি। তোমরা মহাবিভ্রান্তিতে পড়ে রয়েছে।{সূরা মুলক: ৬-৯}

আরো ইরশাদ হচ্ছে:

إِنَّ الْمُجْرِمِينَ فِي ضَلَالٍ وَسُعُرٍ ﴿47﴾ يَوْمَ يُسْحَبُونَ فِي النَّارِ عَلَى وُجُوهِهِمْ ذُوقُوا مَسَّ سَقَرَ ﴿48﴾ { القمر :৪৭ـ৪৮}

নিশ্চয় অপরাধীরা পথভ্রষ্ট ও বিকারগ্রস্ত। যেদিন তাদেরকে মুখ হিঁচড়ে টেনে নেয়া হবে জাহান্নামে, বলা হবে:অগ্নির খাদ্য আস্বাদন কর।{সূরা ক্বামার:৪৭-৪৮}

আরো ইরশাদ হচ্ছে:

وَمَا أَدْرَاكَ مَا الْحُطَمَةُ ﴿5﴾ نَارُ اللَّهِ الْمُوقَدَةُ ﴿6﴾ الَّتِي تَطَّلِعُ عَلَى الْأَفْئِدَةِ ﴿7﴾ إِنَّهَا عَلَيْهِمْ مُؤْصَدَةٌ ﴿8﴾ فِي عَمَدٍ مُمَدَّدَةٍ ﴿9﴾ { الهمزة :৪ـ৯}

কখনো নয় , সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে হুতামায় (পিষ্টকারীতে)। আর আপনি জানেন কি; হুতামা কি? আল্লাহর প্রজ্বলিত আগুন, যা হৃদয় অভ্যন্তরে পৌছে যাবে, এতে তাদেরকে বেঁধে দেয়া হবে,উঁচু উঁচু স্তম্ভসমূহে।{সূরা হুমাযাহ :৪-৯}

عن أسامة بن زيد رضي الله عنهما أنه قال : سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول : يجاء بالرجل يوم القيامة فيلقى في النار فتندلق أقتابه في النار , فيدور كما يدور الحمار برحاه , فيجتمع أهل النارعليه فيقولون : يا فلان ما شأنك؟ أليس كنت تأمرنا بالمعروف و تنهانا عن المنكر؟ قال : كنت آمركم بالمعروف ولا آتيه , وأنهاكم عن المنكر وآتيه . متفق عليه

সাহাবী উসামা বিন যায়দ রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ইরশাদ করতে শুনেছি: নবীজী বলেন, কিয়ামতের দিন একব্যক্তিকে উপস্থিত করা হবে, অত:পর জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে ফলে তথায় তার নাড়ী - ভূড়ী বের হয়ে পড়বে, অত:পর সে সেখানে চক্রাকারে ঘুরতে থাকবে যেমন গাধা তার পেষণযন্ত্রের চার পাশে ঘুরে। জাহান্নামীরা তার নিকট সমবেত হবে এবং বলবে, হে অমুক! তোমার খবর কি? তুমি না আমাদেরকে সৎকাজ করতে আদেশ করতে আর মন্দকাজ থেকে বাধা দিতে? সে বলবে : হ্যাঁ, আমি তোমাদেরকে আদেশ করতাম ঠিক কিন্তু নিজে আমল করতাম না আবার অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করতাম, কিন্তু সেটি নিজে করতাম। [বর্ণনায় বুখারী হাদীস নং (৩২৬৭) এবং মুসলিম হাদীস নং (২৯৮৯)।]

২৪৮
জাহান্নামবাসীদের কান্না ও আর্তনাদ:
১- মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

فَرِحَ الْمُخَلَّفُونَ بِمَقْعَدِهِمْ خِلَافَ رَسُولِ اللَّهِ وَكَرِهُوا أَنْ يُجَاهِدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَقَالُوا لَا تَنْفِرُوا فِي الْحَرِّ قُلْ نَارُ جَهَنَّمَ أَشَدُّ حَرًّا لَوْ كَانُوا يَفْقَهُونَ ﴿81﴾ فَلْيَضْحَكُوا قَلِيلًا وَلْيَبْكُوا كَثِيرًا جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ ﴿82﴾ { التوبة : ৮১-৮২}

এবং তারা বলেছে, এ গরমের মধ্যে তোমরা অভিযানে বের হয়ো না। বলে দাও , উত্তাপের দিক থেকে জাহান্নামের আগুন আরো তীব্র।যদি তাদের বিবেচনা শক্তি থাকত। অতএব তারা সামান্য হেসে নিক এবং তাদের কৃতকর্মের বদলাতে অনেক বেশি কাঁদবে। {সূরা তাওবা : ৮১-৮২}

২- আরো ইরশাদ হচ্ছে

وَهُمْ يَصْطَرِخُونَ فِيهَا رَبَّنَا أَخْرِجْنَا نَعْمَلْ صَالِحًا غَيْرَ الَّذِي كُنَّا نَعْمَلُ أَوَلَمْ نُعَمِّرْكُمْ مَا يَتَذَكَّرُ فِيهِ مَنْ تَذَكَّرَ وَجَاءَكُمُ النَّذِيرُ فَذُوقُوا فَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ نَصِيرٍ { فاطر : ৩৭}

সেখানে তারা আর্তচিৎকার করে বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের বের করে দিন, আমরা সৎ কাজ করব, পূর্বে যা করতাম, তা করব না। (আল্লাহ বলবেন) আমি কি তোমাদের এতটা বছর দেইনি, যাতে যা চিন্তা করার বিষয় চিন্তা করতে পারতে? উপরন্তু তোমাদের কাছে সতর্ককারীও আগমন করেছিল। অতএব আস্বাদন কর। জালেমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই। {সূরা ফাতির : ৩৭}

৩-অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

لهم فيها زفير وهم فيها لا يسمعون { الأنبياء :১০০ }

সেখানে তারা চিৎকার - চেঁচামেচি করবে এবং সেখানে তারা কিছুই শুনতে পাবে না।

{সূরা আম্বিয়া : ১০০}

৪-আরোও ইরশাদ হচ্ছে:

وَإِذَا أُلْقُوا مِنْهَا مَكَانًا ضَيِّقًا مُقَرَّنِينَ دَعَوْا هُنَالِكَ ثُبُورًا ﴿13﴾ لَا تَدْعُوا الْيَوْمَ ثُبُورًا وَاحِدًا وَادْعُوا ثُبُورًا كَثِيرًا ﴿14﴾ { الفرقان :১৩-১৪}

যখন এক শিকলে কয়েকজন বাঁধা অবস্থায় জাহান্নামের কোন সংকীর্ণ স্থানে নিক্ষেপ করা হবে, তখন তারা মৃত্যুকে ডাকবে। বলা হবে, আজ তোমরা এক মৃত্যুকে ডেকো না - অনেক মৃত্যুকে ডাকো।{সূরা আল ফোরকান: ১৩-১৪}

৫- আরো ইরশাদ হচ্ছে:

وَيَوْمَ يَعَضُّ الظَّالِمُ عَلَى يَدَيْهِ يَقُولُ يَا لَيْتَنِي اتَّخَذْتُ مَعَ الرَّسُولِ سَبِيلًا { الفرقان : ২৭}

যালিম ব্যক্তি সেদিন নিজ হস্তদ্বয় দাঁত দ্বারা দংশন করতে করতে বলবে, হায় আফসোস! আমি যদি রাসূলের সাথে সুপথ অবলম্বন করতাম।{সূরা আল ফোরকান:২৭}

৬-আরোও ইরশাদ হচ্ছে:

وَقَالَ الَّذِينَ اتَّبَعُوا لَوْ أَنَّ لَنَا كَرَّةً فَنَتَبَرَّأَ مِنْهُمْ كَمَا تَبَرَّءُوا مِنَّا كَذَلِكَ يُرِيهِمُ اللَّهُ أَعْمَالَهُمْ حَسَرَاتٍ عَلَيْهِمْ وَمَا هُمْ بِخَارِجِينَ مِنَ النَّارِ { البقرة :১৬৭}

এভাবেই আল্লাহ তাআলা তাদের কে তাদের কৃতকর্ম দেখাবেন তাদের অনুতপ্ত করার জন্য। অথচ তারা জাহান্নাম থেকে বের হতে পারবে না।

{সূরা বাকারা:১৬৭}

২৪৯
জাহান্নামীদের প্রার্থনা-ফরিয়াদ:
জাহান্নামীরা জাহান্নামে প্রবেশ করার পর যখন কঠিন আযাব চারদিক থেকে তাদের ঘিরে ধরবে তখন সাহায্য ও পরিত্রাণ পাওয়ার আশায় সেখান থেকে ফরিয়াদ করতে থাকবে এবং বিভিন্ন জনেরে ডাকাডাকি করতে লাগবে। পর্যায়ক্রমে তারা আহবান করবে জান্নাতবাসীদের, জাহান্নাম রক্ষীদের, জাহান্নাম রক্ষী মালেককে, অনুরূপ ভাবে স্বীয় পালনকর্তা মহান আল্লাহ তাআলাকে। কিন্তু তাদের কোন আহবানেরই সন্তুষজনক সাড়া দেয়া হবে না বরং উক্ত সাড়াদানের মাধ্যমে তাদের অনুতাপ - আফসোসই বৃদ্ধি পেতে থাকবে। অত:পর তারা সকল আশা ছেড়ে দিয়ে কর্ণবিদারক চিৎকার ও আর্তনাদ জুড়ে দেবে।

১-আল্লাহ তাআলা বলেন:

وَنَادَى أَصْحَابُ النَّارِ أَصْحَابَ الْجَنَّةِ أَنْ أَفِيضُوا عَلَيْنَا مِنَ الْمَاءِ أَوْ مِمَّا رَزَقَكُمُ اللَّهُ قَالُوا إِنَّ اللَّهَ حَرَّمَهُمَا عَلَى الْكَافِرِينَ { الأعراف :৫০}

আর জাহান্নামীরা জান্নাতবাসীদের ডেকে বলবে : আমাদের উপর কিছু পানি ঢেলে দাও অথবা আল্লাহ প্রদত্ত তোমাদের জীবিকা হতে কিছু প্রদান কর, তারা বলবেম, আল্লাহ এসব জিনিষ কাফেরদের উপর হারাম করে দিয়েছেন। {সূরা আ’রাফ: ৫০}

২-আল্লাহ তাআলা আরও বলেন:

وَقَالَ الَّذِينَ فِي النَّارِ لِخَزَنَةِ جَهَنَّمَ ادْعُوا رَبَّكُمْ يُخَفِّفْ عَنَّا يَوْمًا مِنَ الْعَذَابِ ﴿49﴾ قَالُوا أَوَ لَمْ تَكُ تَأْتِيكُمْ رُسُلُكُمْ بِالْبَيِّنَاتِ قَالُوا بَلَى قَالُوا فَادْعُوا وَمَا دُعَاءُ الْكَافِرِينَ إِلَّا فِي ضَلَالٍ ﴿50﴾ { غافر :৪৯-৫০}

জাহান্নামের অধিবাসীরা তার প্রহরীদেরকে বলবে: তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট প্রার্থনা কর, তিনি যেন আমাদের থেকে একদিনের আযাব লাঘব করে দেন। রক্ষীরা বলবে: তোমাদের নিকট কি সুস্পষ্ট প্রমাণাদিসহ তোমাদের রসূলগণ আসেননি? তারা বলবে : হ্যাঁ - এসেছিল।রক্ষীরা বলবে : তবে তোমরাই প্রার্থনা কর, বস্ত্তত: কাফেরদের প্রার্থনা ব্যর্থই হয়। {সূরা গাফের:৪৯-৫০}

৩-অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

وَنَادَوْا يَا مَالِكُ لِيَقْضِ عَلَيْنَا رَبُّكَ قَالَ إِنَّكُمْ مَاكِثُونَ ﴿77﴾ لَقَدْ جِئْنَاكُمْ بِالْحَقِّ وَلَكِنَّ أَكْثَرَكُمْ لِلْحَقِّ كَارِهُونَ ﴿78﴾ { الزخرف :৭৭- ৭৮ }

তারা চিৎকার করে বলবে: হে মালেক (জাহান্নামের রক্ষী) তোমার প্রতিপালক আমাদেরকে নিঃশেষ করে দিন। সে বলবেঃ নিশ্চয় তোমরা চিরকাল থাকবে।( আল্লাহ বলবেন) আমি তোমাদের কাছে সত্যধর্ম পৌছিয়েছিলাম ; কিন্তু তোমাদের অধিকাংশই সত্যধর্মে নিস্পৃহ। {সূরা যুখরুফ: ৭৭-৭৮}

৪-আরও ইরশাদ হচ্ছে:

قَالُوا رَبَّنَا غَلَبَتْ عَلَيْنَا شِقْوَتُنَا وَكُنَّا قَوْمًا ضَالِّينَ ﴿106﴾ رَبَّنَا أَخْرِجْنَا مِنْهَا فَإِنْ عُدْنَا فَإِنَّا ظَالِمُونَ ﴿107﴾ قَالَ اخْسَئُوا فِيهَا وَلَا تُكَلِّمُونِ ﴿108﴾ { المؤمنون : ১০৬ – ১০৮}

তারা বলবে: হে আমাদের পালনকর্তা, আমরা দুর্ভাগ্যের হাতে পরাভূত ছিলাম এবং আমরা ছিলাম বিভ্রান্ত জাতি। হে আমাদের পালনকর্তা ! এ থেকে আমাদেরকে উদ্ধার কর ; আমরা যদি পুনরায় তা (কুফরী ) করি, তবে তো আমরা অবশ্যই সীমালঙ্ঘনকারী হব। আল্লাহ বলবেন, তোমরা হীন অবস্থায় এখানেই পড়ে থাক এবং আমার সাথে কোন কথা বলোনা। { সূরা মুমিনূন: ১০৬-১০৮}

৫- জাহান্নামীরা যখন জাহান্নাম হতে বের হওয়ার ব্যাপারে সকল আশা ছেড়ে দেবে এবং যে কোন কল্যাণ থেকে একেবারে নিরাশ হয়ে যাবে, তখন কর্ণ বিদারক চিৎকার ও আর্তনাদ জুড়ে দেবে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন:

قَالُوا رَبَّنَا غَلَبَتْ عَلَيْنَا شِقْوَتُنَا وَكُنَّا قَوْمًا ضَالِّينَ ﴿106﴾ رَبَّنَا أَخْرِجْنَا مِنْهَا فَإِنْ عُدْنَا فَإِنَّا ظَالِمُونَ ﴿107﴾ { هود : ১০৬ـ ১০৭}

অতএব যারা হতভাগ্য তারা জাহান্নামে যাবে, সেখানে তারা আর্তনাদ ও চিৎকার করতে থাকবে। তারা সেখানে চিরকাল থাকবে, যতদিন আসমান ও যমীন বিদ্যমান থাকবে। তবে তোমার প্রতিপালক অন্য কিছু ইচ্ছা করলে ভিন্ন কথা। নিশ্চয় তোমার পালনকর্তা যা ইচ্ছা করতে পারেন। {সূরা হুদ:১০৬-১০৭}

আল্লাহ তাআলার ক্রোধ , গযব ও শাস্তি থেকে পানাহ চাই। হে আল্লাহ তুমি আমাদের জান্নাত দান কর... এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দাও... তুমিই আমাদের অভিভাবক... কতইনা উত্তম অভিভাবক...এবং কতইনা উত্তম সাহায্যকারী।

২৫০
জান্নাতে জাহান্নামীদের জন্য বরাদ্ধকৃত বাসগৃহগুলো জান্নাত অধিবাসীদের উত্তরাধিকার হয়ে যাওয়া।
عن أبي هريرة رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : ما منكم من أحد إلا له منزلان : منزل في الجنة و منزل في النار , فإذا مات فدخل النار , ورث أهل الجنة منزله , فذلك قوله تعالى : أولئك هو الوارثون الذين يرثون الفردوس هم فيها خالدون . أخرجه ابن ماجة .

বিশিষ্ট সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমাদের প্রত্যেকেরই জন্য দুটি বাসগৃহ বরাদ্ধ আছে, একটি জান্নাতে আরেকটি জাহান্নামে। যদি কেউ মৃত্যুবরণ করে জাহান্নামে প্রবেশ করে তাহলে জান্নাত অধিবাসীরা উত্তরাধিকার সূত্রে তার বাসগৃহের মালিক হয়ে যায়। এটিই আল্লাহ তাআলার বাণী : তারাই হবে উত্তরাধিকারী, উত্তরাধিকার লাভ করবে ফেরদাউসের, যাতে তারা চিরস্থায়ী ভাবে থাকবে। [বর্ণনায় ইবনে মাজাহ , হাদীসের সনদ সহীহ , হাদীস নং (৪৩৪১)]

২৫১
তাওহীদবাদী পাপীদের জাহান্নাম থেকে বের হয়ে আসা।
عن جابر رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : يعذب ناس من أهل التوحيد في النار حتى يكونوا فيها حمما , ثم تدركهم الرحمة , فيخرجون و يطرحون على أبواب الجنة . قال : فيرش عليهم أهل الجنة الماء فينبتون كما ينبت الغثاء في حمالة السيل ثم يدخلون الجنة . أخرجه أحمد و الترمذي .

সাহাবী জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করছেন, তাওহীদ বাদী কিছু (পাপী) লোককে জাহান্নামে শাস্তি দেয়া হবে, এক পর্যায়ে তারা কয়লা হয়ে যাবে। অত:পর তাদেরকে বিশেষ রহমত ও দয়া স্পর্ষ করবে, ফলশ্রুতিতে তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে এবং জান্নাতের দরজার উপর নিক্ষেপ করা হবে। এরপর জান্নাত অধিবাসীরা তাদের উপর পানি ছিটিয়ে দেবে ফলে তারা উৎপন্ন হবে যেমন করে স্রোতে ভেসে আসা খড়কুটুর উপর তৃণ উৎপন্ন হয়। এরপর তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। [হাদীস টি সহীহ। বর্ণনায় আহমাদ (১৫২৬৮) এবং তিরমিযী (২৫৯৭)।]

وعن أنس بن مالك رضي الله عنه أن النبي صلى الله عليه وسلم قال : يخرج من النار من قال : لا إله إلا الله وكان في قلبه من الخير ما يزن شعيرة , ثم يخرج من النار من قال : لا إله إلا الله وكان في قلبه من الخير ما يزن برة , ثم يخرج من النار من قال : لا إله إلا الله وكان في قلبه من الخير ما يزن ذرة . متفق عليه

বিশিষ্ট সাহাবী আনাস বিন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলা ব্যতীত সত্যিকার কোন উপাস্য নেই মর্মে সাক্ষ্য দেবে এবং তার অন্তরে যবের দানা পরিমাণ ঈমানও অবশিষ্ট থাকবে তাকে (এক সময়ে) জাহান্নাম থেকে বের করা হবে। অত:পর বের করা হবে যারা আল্লাহ তাআলা ব্যতীত কোন সত্যিকার উপাস্য নেই মর্মে সাক্ষ্য দেবে এবং তাদের অন্তরে গমের দানা পরিমাণও ঈমান অবশিষ্ট থাকবে। এরপর বের করা হবে যারা সাক্ষ্য দেবে যে আল্লাহ ছাড়া আর কোন সত্যিকার উপাস্য নেই এবং তাদের অন্তরে অনু পরিমাণ ঈমানও অবশিষ্টি থাকবে। [বর্ণনায় বূখারী ও মুসলিম, হাদীস নং যথাক্রমে (৪৪) ও (১৯৩)।]

২৫২
জাহান্নামীদের সবচে কঠিন আযাব:
(১) জান্নাতের সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত হচ্ছে, মুমিনদের স্বীয় প্রতিপালককে স্বচোক্ষে দর্শন লাভ ও তাঁর সন্তুষ্টির ঘোষণায় আনন্দিত ও প্রফুল্ল হওয়া। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন:

وجوه يومئذ ناضرة إلى ربها ناظرة { القيامة :২২-২৩}

সে দিন অনেক মুখমন্ডল হবে উজ্জ্বল। স্বীয় পালনকর্তার দিকে তাকিয়ে থাকবে।{সূরা কিয়ামাহ :২২-২৩}

আরও ইরশাদ হচ্ছে:

وَعَدَ اللَّهُ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِي جَنَّاتِ عَدْنٍ وَرِضْوَانٌ مِنَ اللَّهِ أَكْبَرُ ذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ { التوبة :৭২}

আল্লাহ তাআলা মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের এমন জান্নাতসমূহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছেন যার নিম্নদেশ দিয়ে বইতে থাকবে নহরসমূহ, সেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে, আরও ওয়াদা দিয়েছেন সে সকল উত্তম বাসস্থানসমূহের যা আদন নামক জান্নাতের মাঝে অবস্থিত। আর আল্লাহর সন্তুষ্টি হচ্ছে সর্বপেক্ষা বড় নেয়ামত, এটিই হচ্ছে মহান সফলতা। {সূরা তাওবা:৭২}

(২) আর জাহান্নামের সর্বাপেক্ষা কঠিন আযাব হচ্ছে তাদেরকে স্বীয় পালনকর্তার দর্শন লাভ থেকে বাধা গ্রস্ত হওয়া। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন:

كلا إنهم عن ربهم يومئذ لمحجوبون . ثم إنهم لصالوا الجحيم . { المطففين : ১৫-১৬}

কখনও নয়। অবশ্যই সেদিন তারা তাদের প্রতিপালকের দর্শন লাভ হতে বাধাগ্রস্ত হবে। অত:পর তারা অবশ্যই জাহান্নামে প্রবেশ করবে।{সূরা মুতাফফিফীন:১৫-১৬}

জান্নাত ও জাহান্নাম অধিবাসীদের চিরস্থায়ীভাবে থাকা:

فَأَمَّا الَّذِينَ شَقُوا فَفِي النَّارِ لَهُمْ فِيهَا زَفِيرٌ وَشَهِيقٌ ﴿106﴾ خَالِدِينَ فِيهَا مَا دَامَتِ السَّمَوَاتُ وَالْأَرْضُ إِلَّا مَا شَاءَ رَبُّكَ إِنَّ رَبَّكَ فَعَّالٌ لِمَا يُرِيدُ ﴿107﴾ وَأَمَّا الَّذِينَ سُعِدُوا فَفِي الْجَنَّةِ خَالِدِينَ فِيهَا مَا دَامَتِ السَّمَوَاتُ وَالْأَرْضُ إِلَّا مَا شَاءَ رَبُّكَ عَطَاءً غَيْرَ مَجْذُوذٍ ﴿108﴾ { هود : ১০৬ـ ১০৮}

অতএব যারা হতভাগ্য তারা জাহান্নামে যাবে, সেখানে তারা আর্তনাদ ও চিৎকার করতে থাকবে। তারা সেখানে চিরকাল থাকবে, যতদিন আসমান ও যমীন বিদ্যমান থাকবে। তবে তোমার প্রতিপালক অন্য কিছু ইচ্ছা করলে ভিন্ন কথা। নিশ্চয় তোমার পালনকর্তা যা ইচ্ছা করতে পারেন। আর যারা সৌভাগ্যবান তারা যাবে জান্নাতে, সেখানেই চিরকাল থাকবে, যতদিন আসমান ও যমীন বর্তমান থাকবে। তবে তোমার প্রভূ অন্য কিছু ইচ্ছা করলে ভিন্ন কথা। এ দানের ধারাবাহিকতা কখনো ছিন্ন হওয়ার নয়। {সূরা হুদ:১০৬-১০৮}

(২) আরও ইরশাদ হচ্ছে:

إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوْ أَنَّ لَهُمْ مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا وَمِثْلَهُ مَعَهُ لِيَفْتَدُوا بِهِ مِنْ عَذَابِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ مَا تُقُبِّلَ مِنْهُمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ ﴿36﴾ يُرِيدُونَ أَنْ يَخْرُجُوا مِنَ النَّارِ وَمَا هُمْ بِخَارِجِينَ مِنْهَا وَلَهُمْ عَذَابٌ مُقِيمٌ ﴿37﴾ { المائدة :৩৬-৩৭}

যারা কাফের, যদি তাদের কাছে পৃথিবীর সমুদয় সম্পদ এবং তৎসহ আরও তদনুরূপ সম্পদ থাকে আর এগুলো বিনিময়ে দিয়ে কেয়ামতের শাস্তি হতে পরিত্রাণ পেতে চায়, তবুও তাদের কাছ থেকে তা কবুল করা হবে না। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। তারা জাহান্নাম থেকে বের হয়ে আসতে চাইবে কিন্তু তা থেকে বের হতে পারবে না। বস্ত্তত: তাদের জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী শাস্তি। {সূরা মায়েদা:৩৬-৩৭}

(৩) হাদীসে এসেছে

عن ابن عمر رضي الله عنهما قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : إذا صار أهل الجنة إلى الجنة , وأهل النار إلى النار جيئ بالموت حتى يجعل بين الجنة والنار , ثم يذبح , ثم ينادي مناد : يا أهل الجنة لا موت , يا أهل النار لا موت , فيزداد أهل الجنة فرحا إلى فرحهم , ويزداد أهل النار حزنا إلى حزنهم . متفق عليه

বিশিষ্ট সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যখন জান্নাতীরা জান্নাতে এবং জাহান্নামীরা জাহান্নামে প্রবেশ করবে। মৃত্যুকে উপস্থিত করা হবে এবং জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝে রাখা হবে। অত:পর জবাই করে দেয়া হবে। এরপর জনৈক ঘোষক এ মর্মে ঘোষণা দেবেন: হে জান্নাত অধিবাসীবৃন্দ আর মৃত্যু হবে না, হে জাহান্নামবাসীরা আর মৃত্যু নেই। ঘোষণা শুনে জান্নাতীদের আনন্দ আরো বেড়ে যাবে পক্ষান্তরে জাহান্নামীদের মর্ম যাতনা আরও বৃদ্ধি পাবে। [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং যথাক্রমে (৬৫৪৮) ও (২৮৫০)।]

২৫৩
জান্নাত ও জাহান্নামের আবরণ:
عن أبي هريرة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : حجبت النار بالشهوات , وحجبت الجنة بالمكاره . متفق عليه

প্রখ্যাত সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: জাহান্নামকে কামনার বস্ত্ত দ্বারা ঢেকে দেয়া হয়েছে আর জান্নাতকে আবৃত করা হয়েছে অপছন্দনীয় ও কষ্টসাধ্য জিনিষ দ্বারা । [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং যথাক্রমে ( ৬৪৮৭) ও (২৮২৩)।]

২৫৪
জান্নাত ও জাহান্নামের নৈকট্য:
عن عبد الله بن مسعود رضي الله عنه قال : قال النبي صلى الله عليه وسلم : الجنة أقرب إلى أحدكم من شراك نعله , و النار مثل ذلك . أخرجه البخاري

সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: জান্নাত তোমাদের প্রত্যেকের স্বীয় জুতার ফিতার চেয়েও নিকটে, অনুরূপ ভাবে জাহান্নামও তাই। [বর্ণনায় বুখারী হাদীস নং (৬৪৮৮)]

২৫৫
জান্নাত ও জাহান্নামের বিতর্ক এবং তাদের মাঝে আল্লাহ তাআলার রায় প্রদান:
عن أبي هريرة رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال : تحاجت النار و الجنة , فقالت النار : أوثرت بالمتكبرين و المتجبرين , وقالت الجنة : فمالي لا يدخلني إلا ضعفاء الناس و سقطهم و عجزهم , فقال الله للجنة : أنت رحمتي , أرحم بك من أشاء من عبادي , و قال للنار : أنت عذابي , أعذب بك من أشاء من عبادي , ولكل واحدة منكم ملؤها ... متفق عليه

বিশিষ্ট সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন: জাহান্নাম ও জান্নাত বিতর্কে উপনীত হল; জাহান্নাম বলছে: অহংকরী ও প্রতিপত্তিশালীদের মাধ্যমে আমাকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, আর জান্নাত বলছে, আমার অবস্থাতো এই, যে আমাতে শুধু মাত্র দুর্বল, প্রভাব - প্রতিপত্তিহীন ও উপেক্ষিত লোকেরাই প্রবেশ করে। (এদের বিতর্ক শুনে ) আল্লাহ তাআলা জান্নাতকে লক্ষ্য করে বললেন: তুমি আমার রহমত ও করুণা, তোমার মাধ্যমে আমি আমার বান্দাদের যাকে ইচ্ছা অনুগ্রহ করব। আর জাহান্নামকে উদ্দেশ্য করে বললেন: তুমি আমার আযাব, তোমার মাধ্যমে আমার বান্দাদের যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেব। তবে তোমাদের প্রত্যেককেই পরিপূর্ণ করা হবে...। [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং যথাক্রমে (৪৮৫০) ও (২৮৪৬)।]

২৫৬
জাহান্নাম থেকে সতর্কথাকা ও জান্নাত প্রার্থনা করা:
১-আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

وَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِي أُعِدَّتْ لِلْكَافِرِينَ ﴿131﴾ وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَالرَّسُولَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ ﴿132﴾ { آل عمران :১৩১-১৩২}

এবং তোমরা সেই অগ্নিকে ভয় কর যা কাফেরদের জন্য প্রস্ত্তত করা হয়েছে।এবং আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য কর তাতে তোমরা কৃপা লাভ করতে পারবে।{সূরা আলে এমরান:১৩১-১৩২}

২- হাদীসে এসেছে

وعن عدي بن حاتم رضي الله عنه : أن النبي صلى الله عليه وسلم ذكر النار فأشاح بوجهه فتعوذ منها , ثم ذكر النار فأشاح بوجهه فتعوذ منها , ثم قال : اتقوا النار ولو بشق تمرة , فمن لم يجد فبكلمة طيبة . متفق عليه

সাহাবী আদী বিন হাতিম রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাহান্নামের আলোচনা করলেন, তাঁর চেহারায় ভীতির ছাপ ফুটে উঠলো তিনি চেহারা ফিরিয়ে নিলেন এবং জাহান্নাম থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করলেন, তিনি আবারো আলোচনা করলেন এবং ভীতি ভরে চেহারা ফিরিয়ে নিলেন এবং আশ্রয় চাইলেন। অত:পর বললেন:এক টুকরো খেজুর দিয়ে হলেও তোমরা জাহান্নাম থেকে আত্মরক্ষা কর। আর যে তাতে অসমর্থ হবে তাহলে সুন্দর সুন্দর কথার মাধ্যমে। [বর্ণনায় বূখারী ও মুসলিম। হাদীস নং যথাক্রমে ( ৬৫৬৩) ও (১০১৬)।]

وعن أبي هريرة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : كل أمتي يدخلون الجنة إلا من أبى . قالوا : يا رسول الله ومن يأبى؟ قال : من أطاعني دخل الجنة , و من عصاني فقد أبى . متفق عليه

বিশিষ্ট সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: আমার সকল উম্মত জান্নাতে প্রবেশ করবে কিন্তু যারা অস্বীকার করে তারা ব্যতীত। লোকেরা জিজ্ঞেস করলো : অস্বীকার করে কারা? নবীজী বললেন: যারা আমার আনুগত্য করবে তারা জান্নাতে যাবে আর যারা অবাধ্যতা করবে তারাই মূলত: অস্বীকার করল। [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং যথাক্রমে (৭২৮০) ও (১৮৩৫)।]

হে আল্লাহ আমরা তোমার নিকট জান্নাত প্রার্থনা করছি এবং তাওফীক চাই এমন সব কথা ও কাজের যা জান্নাতের নিকটবর্তী করে দেয়। আর আশ্রয় চাই জাহান্নাম থেকে এবং এমনসব কথা ও কাজ থেকে যা জাহান্নামের নিকটবর্তী করে দেয়।

২৫৭
৬ - তাকদীরের ভাল-মন্দের প্রতি ঈমান:
القدر : দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে: প্রত্যেক বস্ত্ত সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার সম্যক জ্ঞান এবং সে সকল বিষয় সম্বন্ধে যার অস্তিত্ব দান বা বান্দা থেকে সঙ্ঘটনের ইচ্ছা তিনি করেছেন। অনুরূপ ভাবে জগৎসমূহ, জগতের নানাবিধ অবস্থা এবং তার যাবতীয় বস্ত্ত ও বিষয়াবলী সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার পরিজ্ঞান। আর এ সবকিছুর হিসাব ও লিখন সব লাওহে মাহফুজে সংরক্ষিত আছে।আর কদর হচ্ছে নিজ সৃষ্টি সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার গোপন-রহস্য যে ব্যাপারে না কোন নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতা অবহিত হতে পেরেছে, না কোন প্রেরিত রাসূল।

ঈমান বিল কাদার (তাকদীরের ভাল - মন্দের প্রতি বিশ্বাস) এর তাৎপর্য হচ্ছে:

প্রত্যেক সঙ্ঘটিত ও সঙ্ঘটিতব্য বিষয় ভাল কি মন্দ সব আল্লাহ তাআলার সিদ্ধান্ত ও নির্ধারণ অনুযায়ী হয়ে থাকে মর্মে দৃঢ় বিশ্বাস পোষন করা।

যেমন আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করছেন:

إنا كل شىء خلقناه بقدر { القمر :৪৯}

আমি প্রত্যেক বস্ত্ত সৃষ্টি করেছি নির্ধরিত পরিমাপে। {সূরা কামার:৪৯}

২৫৮
ঈমান বিল কাদারের রুকনসমূহ:
ঈমান বিল কাদার চারটি বিষয়কে অন্তর্ভূক্ত করে:

২৫৯
১-এক নম্বর:
এ দৃঢ় বিশ্বাস পোষন করা যে, মহান আল্লাহ তাআলা সর্ববিষয়ে-একত্রে ও বিস্তারিত ভাবে- পরিজ্ঞাত। উক্ত বিষয়াদি তাঁর নিজ কর্ম সংশ্লিষ্টও হতে পারে, যেমন:সৃষ্টি করা, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করা, জীবিত করা, মৃত্যুদান করা এবং এ জাতীয় বিষয়াদি। আবার সৃষ্টিকুলের কর্ম সংশ্লিষ্টও হতে পারে। যেমন মানুষের কথা, কাজ ও তাদের অবস্থাদি অনুরূপ ভাবে জীব-জন্তু , উদ্ভিদ ও জড় পদার্থ ইত্যাদির অবস্থা ও পরিস্থিতি। মহান আল্লাহ তাআলা এ সকল বিষয়ে পরিপূর্ণরূপে পরিজ্ঞাত। যেমন ইরশাদ হচ্ছে:

اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ سَبْعَ سَمَوَاتٍ وَمِنَ الْأَرْضِ مِثْلَهُنَّ يَتَنَزَّلُ الْأَمْرُ بَيْنَهُنَّ لِتَعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ وَأَنَّ اللَّهَ قَدْ أَحَاطَ بِكُلِّ شَيْءٍ عِلْمًا { الطلاق :১২}

আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন সপ্ত আকাশ এবং পৃথিবীও তাদের অনুরূপ, এসবের মাঝে নেমে আসে তাঁর আদেশ, যাতে তোমরা বুঝতে পার যে আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান এবং জ্ঞানে আল্লাহ সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে আছেন। {সূরা তালাক:১২}

২৬০
২- দুই নম্বর:
দৃঢ়ভাবে এ বিশ্বাস পোষন করা যে, আল্লাহ তাআলা তাবৎ সৃষ্টিকুল, পৃথিবীর হাল পরিস্থিতি এবং রিযিক - জীবনোপকরণ সহ সবকিছুর হিসাব - পরিমাপ লাওহে মাহফূজে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। তিনি এর পরিমাণ, ধরণ, সময় ও অবস্থান সবই নির্ধারণ করে রেখেছেন। সুতরাং সেগুলো আল্লাহর নির্দেশ ব্যতীত পরিবর্তিত ও রূপান্তরিত হবে না এবং তাঁর অনুমোদন ছাড়া বৃদ্ধি ও হ্রাস পাবে না।যেরূপ আছে ঠিক সেরূপই থাকবে।

১- আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

أَلَمْ تَعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا فِي السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ إِنَّ ذَلِكَ فِي كِتَابٍ إِنَّ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ { الحج :৭০}

তুমি কি জান না যে, আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু রয়েছে আল্লাহ তা অবগত আছেন। এ সবই লিপিবদ্ধ আছে এক কিতাবে,অবশ্যই এটি আল্লাহ নিকট সহজ। {সূরা হজ্জ:৭০}

২-হাদীসে এসেছে

وعن عبد الله بن عمرو بن العاص رضي الله عنهما قال : سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول : كتب الله مقادير الخلائق قبل أن يخلق السماوات و الأرض بخمسين ألف سنة , قال وعرشه على الماء . أخرجه مسلم

সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, নবীজী বলেন: আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিকুলের ভাগ্যলিপি আকাশ-যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর আগে লিপিবদ্ধ (নির্ধারিত) করে রেখেছেন। বলেন: আর তার আরশ ছিল পানির উপর [বর্ণনায় মুসলিম। হাদীস নং (২৬৫৩)।]।

২৬১
৩- তিন নম্বর:
এ দৃঢ় বিশ্বাস পোষন করা যে, এ নিখিল বিশ্ব এবং তাতে যাকিছু আছে, যা কিছু হয়েছে, যা কিছু হচ্ছে এবং যা কিছু হবে সব কিছুরই অস্তিত্ব আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা ও চাহিদার ভিত্তিতেই বাস্তবায়িত হবে। সুতরাং মহান আল্লাহ যা চাইবেন, হবে আর যা চাইবেন না, হবে না। উক্ত বিষয়াদি তাঁর নিজ কর্ম সংশ্লিষ্টও হতে পারে, যেমন:সৃষ্টি করা, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করা, জীবিত করা , মৃত্যুদান করা এবং এ জাতীয় বিষয়াদি। আবার সৃষ্টিকুলের কর্ম সংশ্লিষ্টও হতে পারে, যেমন মানুষের কথা, কাজ ও তাদের অবস্থাদি অনুরূপভাবে জীব-জন্তু , উদ্ভিদ ও জড় পদার্থ ইত্যাদির অবস্থা - পরিস্থিতি।

১- আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

وربك يخلق ما يشاء ويختار . { القصص :৬৮}

আর তোমার প্রতিপালক যা ইচ্ছা করেন এবং যাকে ইচ্ছা মনোনীত করেন।

{সূরা কাসাস:৬৮}

২-আরো ইরশাদ হচ্ছে:

ويفعل الله ما يشاء . { إبراهيم :২৭}

আল্লাহ যা ইচ্ছা তাই করেন। ( সূরা ইবরাহীম:২৭)

৩-আরো ইরশাদ হচ্ছে:

ولو شاء ربك ما فعلوه . { الأنعام :১১২}

তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করলে তারা এমন কাজ করতে পারত না।{সূরা আনআম:১১২}

৪-আরো ইরশাদ হচ্ছে:

لِمَنْ شَاءَ مِنْكُمْ أَنْ يَسْتَقِيمَ ﴿28﴾ وَمَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَنْ يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ ﴿29﴾ { التكوير :২৮-২৯}

তোমাদের মধ্যে যে সরল পথে চলতে চায়, তার জন্য।মহান রাববুল আলামীন - আল্লাহ না চাইলে তোমরা কিছুই ইচ্ছা করতে পার না। {সূরা তাকভীর:২৮-২৯}

২৬২
৪- চার নম্বর:
এ বিশ্বাস পোষন করা যে আল্লাহ তাআলা সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা। নিখিল বিশ্ব এবং তাতে যা কিছু আছে সবকিছুর মূল, সিফাত এবং তাদের কর্মাবলী সবই তিনিই সৃজন করেছেন। তিনি ভিন্ন কোন সৃষ্টিকর্তা নেই এবং তিনি ব্যতীত কোন প্রতিপালক নেই।

১- আল্লাহ তাআলা বলেন:

اللَّهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ وَكِيلٌ { الزمر :৬২}

আল্লাহ সব কিছুর স্রষ্টা এবং তিনিই সব কিছুর ব্যবস্থাপক। {সূরা যুমার:৬২}

إنا كل شيئ خلقناه بقدر .{ القمر :৪৯}

আমি প্রত্যেক কিছু সৃষ্টি করেছি নির্ধারিত পরিমাপে। {সূরা কামার:৪৯}

والله خلقكم وما تعملون .{ الصافات : ৯৬}

প্রকৃতপক্ষে আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে এবং তোমরা যা কিছু কর।{সূরা সাফফাত:৯৬}

২৬৩
তাকদীর-কে অজুহাত হিসাবে পেশ করা আল্লাহ তাআলা মানুষের জন্য যে নিয়তি নির্ধারণ ও চুড়ান্ত করেছেন তা দুই প্রকার: ১-এক নম্বর: মানুষের ইচ্ছা ও ক্ষমতা বহির্ভূত বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্ত ও নির্ধারণ:
এটি তার নিজের মাঝে পূর্ব হতে বিদ্যমানও থাকতে পারে যেমন তার শারীরিক দৈর্ঘ, প্রস্থ অনুরূপ ভাবে সুদর্শন হওয়া, দেখতে অসুন্দর হওয়া বা তার হায়াত, মওত ইত্যাদি।

অথবা তার অনিচ্ছা সত্বেও তার উপর আপতিত হতে পারে। যেমন বিভিন্ন ধরনের বিপদ মসীবত,অসুখ-বিসুখ, ধন-সম্পদ, ফসলাদি ও জান -জীবণ হ্রাস পাওয়া ইত্যাদি বিপদসমূহ যা কখনো বান্দার উপর শাস্তি স্বরূপ কখনো পরীক্ষা স্বরূপ আবার কখনো মর্যাদার স্তরের উন্নতি স্বরূপ আপতিত হয়।

যেসব আমল পূর্ব হতেই তার মাঝে বিদ্যমান বা তার নিজের কোন এখতিয়ার ছাড়াই তার উপর আপতিত হয় সেগুলোর ব্যাপারে মানুষদের জিজ্ঞেস করা হবে না এবং এ ব্যাপারে তাদের কোন হিসাবও নেয়া হবে না। বরং এ ক্ষেত্রে তার উপর আবশ্যক হচ্ছে, এ দৃঢ় বিশ্বাস পোষন করা যে, এগুলো সব আল্লাহর সিদ্ধান্ত ও নির্ধারণের কারণে হয়েছে এবং পরিপূর্ণ সন্তুষ্টি ও প্রসন্ন মনে এসবের উপর ধৈর্য্য ধারণ করা। সুতরাং নিখিল বিশ্বে বিপদাপদ যা কিছু সঙ্ঘটিত হয় তাতে অবশ্যই সবজান্তা, সর্বজ্ঞ আল্লাহ তাআলার অপার হিকমত রয়েছে।

১- আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন।

مَا أَصَابَ مِنْ مُصِيبَةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي أَنْفُسِكُمْ إِلَّا فِي كِتَابٍ مِنْ قَبْلِ أَنْ نَبْرَأَهَا إِنَّ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ { الحديد :২২}

পৃথিবীতে ও ব্যক্তিগত ভাবে তোমাদের উপর যত বিপদই আসে তা জহৎ সৃষ্টির পূর্বেই কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে । নিশ্চয়ই এটি আল্লাহর পক্ষে সহজ।

২- হাদীসে এসেছে

وعن ابن عباس رضي الله عنهما قال : كنت خلف رسول الله صلى الله عليه وسلم يوما فقال : يا غلام إني أعلمك كلمات احفظ الله يحفظك , احفظ الله تجده تجاهك , إذا سألت فاسأل الله , وإذا استعنت فاستعن بالله , واعلم أن الأمة لو اجتمعت على أن ينفعوك بشيء لم ينفعوك إلا بشيء قد كتبه الله لك , ولو اجتمعوا على أن يضروك بشيء لم يضروك إلا بشيء قد كتبه الله عليك , رفعت الأقلام , وجفت الصحف . أخرجه أحمد و الترمذي .

বিশিষ্ট সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি একদিন রাসূলুল্লাহর পেছনে ছিলাম, তিনি আমাকে বললেন: হে বালক! আমি তোমাকে কয়েকটি বাক্য (বিষয়) শিক্ষা দেব।তুমি আল্লাহকে সংরক্ষণ কর আল্লাহ তোমাকে হেফাজত করবেন। আল্লাহ-কে সংরক্ষণ কর (সব সময়) তাঁকে তোমার সামনে পাবে।

যখন প্রার্থনা করবে তখন আল্লাহর কাছেই প্রার্থনা করবে, আর যখন সাহায্য চাইবে তখন আল্লাহর নিকটই সাহায্য চাইবে। জেনে রাখ! সকল মানুষ যদি তোমার কোন উপকার করবে মর্মে একত্রিত হয় তাহলে ততটুকু উপকারই করতে পারবে যা আল্লাহ নির্ধারণ করেছেন। আর সকল মানুষ যদি তোমার কোন ক্ষতি করবে মর্মে একত্রিত হয় তাহলে ততটুকু ক্ষতিই করতে পারবে যা আল্লাহ তোমার বিরুদ্ধে নির্ধারণ করেছেন। কলমগুলো উঠিয়ে নেয়া হয়েছে এবং ভাগ্যলিপি শুকিয়ে গিয়েছে। [হাদীসের সনদ সহীহ।বর্ণনায় আহমাদ (২৬৬৯) এবং তিরমিযী (২৫১৬)।]

৩- হাদীসে এসেছে

وعن أبي هريرة رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : قال الله عز وجل : يؤذيني ابن آدم يسب الدهر و أنا الدهر , بيدي الأمر , أقلب الليل و النهار . متفق عليه

বিশিষ্ট সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন: বনী আদম আমাকে কষ্ট দেয় যে দাহারকে (যুগ-জামানা) গাল মন্দ করে, অথচ আমিই দাহার, আমার হাতেই সব কর্তৃত্ব-ক্ষমতা, দিন এবং রাত্রির পরিবর্তন করি। [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম। হাদীস নং যথা ক্রমে ( ৪৮২৬) ও (২২৪৬)।]

২৬৪
২-দুই নম্বর:
আল্লাহ তাআলা কর্তৃক নির্ধারিত ও সিদ্ধান্তকৃত এমন কাজ, যা করা না করার ব্যাপারে বান্দার ক্ষমতা আছে এবং আল্লাহ প্রদত্ত বোধ-বিবেক, ক্ষমতা-সামর্থ ও এখতিয়ার বলে সম্পাদন করে। যেমন ঈমান ও কুফর.. আনুগত্য ও অবাধ্যতা..ভালকাজ করা ও মন্দকাজ করা।

সুতরাং এসকল ও এ জাতীয় অন্যান্য কাজের ব্যাপারেই বান্দার হিসাব নেয়া হবে, এবং এরই ভিত্তিতে ছাওয়াব ও শাস্তি দেয়া হবে।

কেননা আল্লাহ তাআলা অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন, অসংখ্য কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, হক্ব ও বাতেল চি ‎‎ হ্নত করে দিয়েছেন, এরপর ঈমান ও আনুত্যের প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন পাশাপাশি কুফর ও অবাধ্যতা থেকে সর্তক করেছেন, উপরন্তু মানুষকে বোধ ও বিবেক দ্বারা সমৃদ্ধ করেছেন এবং গ্রহণ করার ব্যাপারে পরিপূর্ণ সামর্থ ও ক্ষমতা প্রদান করেছেন। অতএব যে রাস্তাই সে গ্রহণ করবে সেটি সম্পূর্ণই তার নিজস্ব এখতিয়ারে (কারো চাপিয়ে দেয়ার কারণে নয়)। অবশ্য ভাল-মন্দ দুই রাস্তার যেটিই সে গ্রহণ করবে সেটি আল্লাহর ক্ষমতা ও ইচ্ছার অধীনে দাখিল থাকবে। কারণ আল্লার রাজত্বে তার ইলম ও ইচ্ছা (অনুমোদন) ব্যতীত কোন কিছু সঙ্ঘটিত হতে পারে না।

১- আল্লাহ তাআলা বলেন:

وقل الحق من ربكم فمن شاء فليؤمن ... { الكهف : ২৯}

বল: সত্য তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আগত। সুতরাং যার ইচ্ছা বিশ্বাস স্থাপন করুক (ঈমান গ্রহণ করুক) আর যার ইচ্ছা অবিশ্বাস করুক (কুফরী করুক)।{সূরা কাহফ:২৯}

২- আরো ইরশাদ হচ্ছে:

مَنْ عَمِلَ صَالِحًا فَلِنَفْسِهِ وَمَنْ أَسَاءَ فَعَلَيْهَا وَمَا رَبُّكَ بِظَلَّامٍ لِلْعَبِيدِ { فصلت : ৪৬}

যে নেক আমল করে সে নিজের উপকারের জন্যই করে, আর যে মন্দকর্ম কর্ম সম্পাদন করে তার ক্ষতি তার উপরই বর্তাবে। তোমার পালনকর্তা বান্দাদের উপর মোটেই যুলুম করেন না। {সূরা ফুসসিলাত:৪৬}

৩-অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

مَنْ كَفَرَ فَعَلَيْهِ كُفْرُهُ وَمَنْ عَمِلَ صَالِحًا فَلِأَنْفُسِهِمْ يَمْهَدُونَ { الروم :৪৪}

যে কুফর করে , তার কুফরের জন্য সে-ই দায়ী (তার ক্ষাতি তারই উপর বর্তাবে) আর যে নেক আমল করে তারা নিজেদের জন্যই সুখ-শয্যা রচনা করে।{সূরা আর রূম:৪৪}

৪-আরো ইরশাদ হচ্ছে:

إِنْ هُوَ إِلَّا ذِكْرٌ لِلْعَالَمِينَ ﴿27﴾ لِمَنْ شَاءَ مِنْكُمْ أَنْ يَسْتَقِيمَ ﴿28﴾ وَمَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَنْ يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ ﴿29﴾ { التكوير :২৭-২৯}

এটিতো কেবল বিশ্ব বাসীদের জন্য উপদেশ। তার জন্য, তোমাদের মধ্যে যে সরল পথে চলতে চায়। মহান রাববুল আলামীন - আল্লাহ না চাইলে তোমরা কিছুই ইচ্ছা করতে পার না। {সূরা তাকভীর:২৭-২৯}

২৬৫
তাকদীরের বরাত দিয়ে অজুহাত দাড় করা কখন সঙ্গত হবে:
১- মানুষের পক্ষে বিপদ-মুসীবতের ক্ষেত্রে তাকদীরের বরাতে অজুহাত দাড় করা বৈধ। যেমন প্রথম ভাগে আলোচনা হয়েছে। সুতরাং সে যদি অসুস্থ হয় বা মৃত্যু বরণ করে অথবা অনিচ্ছা সত্বেও কোন বিপদে আক্রান্ত হয় তাহলে তার পক্ষে আল্লাহর এ সিদ্ধান্ত ও নির্ধারণের মাধ্যমে হুজ্জত ও অজুহাত পেশ করার বৈধতা আছে। বলবে: قدر الله و ما شاء فعل , আল্লাহ তাআলা নির্ধারণ করেছেন এবং তিনি যা চেয়েছেন, করেছেন। সে সময় তার জন্য আবশ্যক ও অত্যন্ত ফলদায়ক হচ্ছে, সবর করা আর পারলে সন্তুষ্ট থাকা তাতে অনেক ছাওয়াব পাওয়া যাবে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন:

وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ ﴿155﴾ الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ ﴿156﴾ أُولَئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَاتٌ مِنْ رَبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُهْتَدُونَ ﴿157﴾ و بشر البقرة : ১৫৫ـ১৫৭)

আপনি ধৈর্য্যশীলগনকে সুসংবাদ দান করুন, যারা তাদের উপর বিপদ আপতিত হলে বলে ‘‘নিশ্চয়ই আমরাতো আল্লাহর জন্যই এবং নিশ্চিতভাবে তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী’’ এরাইতো তারা যাদের উপর তাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ ও রহমত বর্ষিত হয়, আর এরাই হেদায়াত প্রাপ্ত।{সূরা বাকারা : ১৫৫-১৫৭}

২- মানুষের পক্ষে তাকদীরের বরাত দিয়ে পাপ ও অন্যায়কর্মের উপর অজুহাত দাড় করে অবশ্য পালনীয় ইবাদাত ত্যাগ করা বা নিষিদ্ধ ও হারাম কার্যাদি সম্পাদন করা বৈধ নয়। কেননা আল্লাহ তাআলা নেক কার্যাদি সম্পাদন এবং মন্দ কার্যাদি বর্জন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। সাথে সাথে কাজ করার আদেশ দিয়েছেন আর তাকদীরের উপর ভরসা করে অলস বসে থাকতে নিষেধ করেছেন। তাকদীর যদি কারো পক্ষে হুজ্জত হতোই তাহলে আল্লাহ তাআলা রাসূলদের মিথ্যা প্রতিপন্নকারী কাফের যেমন নূহ আলাইহিস সালামের কওম এবং কওমে আদ, কওমে ছামূদ প্রমুখদের শাস্তি দিতেন না। অনুরূপ ভাবে অন্যায় - অপরাধকারীদের উপর দন্ডবিধি মোতাবেক হদ্দ কায়েমের নির্দেশ দিতেন না।

যে ব্যক্তির মতে তাকদীর অন্যায় - অপরাধকারীদের জন্য হুজ্জত, তাকে দোষারোপ ও শাস্তি দেয়া যাবে না। তাহলে কেউ যদি তার প্রতি অন্যায় করে সেও তাকে দোষারোপ ও শাস্তি দিতে পারবে না। এবং যে তার সাথে ভাল ব্যবহার করে এবং যে মন্দ ব্যবহার করে উভয়ের মাঝে পার্থক্য করতে পারবে না!। আসলে এটি একটি বাতিল মতবাদ ও অসার কথা।

২৬৬
উপায়-উপকরণের কার্যকারিতা:
আল্লাহ তাআলা বান্দার জন্য ভাল মন্দ যা কিছুই নির্ধারণ করেছেন সেটি আসবাবের (উপায়-উপকরণের) সাথে যুক্ত করেই নির্ধারণ করেছেন। সুতরাং ভালকর্মের জন্য তার নির্ধারিত উপকরণ আছে আর সেটি হচ্ছে : ঈমান ও আনুগত্য পরায়ণতা। তদ্রুপ মন্দকর্মেরও নির্ধারিত উপায়-উপকরণ আছে আর তাহচ্ছে:কুফর ও অবাধ্য পরায়ণতা।

আর মানুষ কর্ম সম্পাদন করে ইচ্ছা-এরাদার মাধ্যমে যা আল্লাহ তার জন্য নির্ধারণ করেছেন এবং নিজ এখতিয়ারে যা আল্লাহ তাকে দান করেছেন। বান্দা আল্লাহ কর্তৃক লিখিত ও নির্ধারিত সুখ-সমৃদ্ধি বা দূ:খ-কষ্ট পর্যন্ত কেবলমাত্র ঐ উপায়-উপকরণের মাধ্যমেই পৌছতে পারে যা সে গ্রহণ করবে নিজ এখতিয়ারে যে এখতিয়ার আল্লাহ ই তাকে দিয়েছেন। অতএব জান্নাতে প্রবেশের কিছু উপায় - উপকরণ আছে। অনুরূপভাবে জাহান্নামে প্রবেশের কিছু উপায়-উপকরণ আছে।

১- আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

سَيَقُولُ الَّذِينَ أَشْرَكُوا لَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا أَشْرَكْنَا وَلَا آَبَاؤُنَا وَلَا حَرَّمْنَا مِنْ شَيْءٍ كَذَلِكَ كَذَّبَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ حَتَّى ذَاقُوا بَأْسَنَا قُلْ هَلْ عِنْدَكُمْ مِنْ عِلْمٍ فَتُخْرِجُوهُ لَنَا إِنْ تَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ وَإِنْ أَنْتُمْ إِلَّا تَخْرُصُونَ ﴿148﴾ { الأنعام :১৪৮}

যারা শিরক করেছে তারা সত্ত্বরই বলবে, যদি আল্লাহ চাইতেন তবে আমরা ও আমাদের পিতৃপুরুষরা শিরক করতাম না এবং কোন কিছুই হারাম করতাম না। এভাবে তাদের পূর্ববর্তীরাও মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল অবশেষে তারা আমার শাস্তি ভোগ করেছিল। বল: তোমাদের নিকট কোন যুক্তি আছে কি? থাকলে আমার নিকট তা পেশ কর। তোমরা শুধু কল্পনারই অনুসরণ কর এবং শুধু মনগড়া কথা বল। {সূরা আনআম:১৪৮}

২- আরো ইরশাদ হচ্ছে:

و أطيعوا الله و الرسول لعلكم ترحمون . { آل عمران :১৩২}

তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর আর আনুগত্য কর রাসূলের, যাতে তোমরা অনুগ্রহ প্রাপ্ত হও। {সূরা আলে ইমরান:১৩২}

৩- হাদীসে এসেছে

وعن أبي هريرة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : ما منكم من نفس إلا وقد علم منزلها من الجنة و النار . قالوا : يا رسول الله , فلم نعمل ؟ أفلا نتكل؟ قال : لا , اعملوا فكل ميسر لما خلق له , ثم قرأ : فأما من أعطى واتقى , وصدق بالحسنى , فسنيسره لليسرى , و أما من بخل واستغنى , وكذب بالحسنى , فسنيسره للعسرى . متفق عليه .

বিশিষ্ট সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: তোমাদের কেউই এমন নেই যাকে জান্নাত ও জাহান্নামে তার নিজস্ব ঠিকানা সম্পর্কে জানানো হয় না। সাহাবারা বললেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ: তাহলে আমরা আমল করব কেন? আমরা কি আমল ছেড়ে ভরসা করে থাকব না? নবীজী বললেন: না, আমল করে যাও, কারণ প্রত্যেকেই যার জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে তার জন্য তাকে উপযোগীও করা হয়েছে। (সেটি তার জন্য সহজও করা হয়েছে) অত:পর তিনি তেলাওয়াত করলেন, অনন্তর যে দান ও তাকওয়া অবলম্বন করল, এবং যা উত্তম তাকে সত্য মনে করল, অচিরেই আমি তার জন্য সুগম করে দেব সহজ পথ। পক্ষান্তরে যে কার্পণ্য করল ও বেপরওয়া হল, এবং উত্তম জিনিস কে মিথ্যা মনে করল, অচিরেই আমি তার জন্য সহজ করে দেব কঠিন পথ। [বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম হাদীস নং যথা ক্রমে (৪৯৪৫) ও (২৬৪৭)।]

২৬৭
নিম্নোক্ত ক্ষেত্রাবলিতে তাকদীরকে তাকদীর দ্বারা প্রতিহত করা শরিয়ত সিদ্ধ।
১-যে তাকদীরের আসবাব সঙ্ঘটিত হয়ে গিয়েছে কিন্তু বিপরীতমুখী অন্য তাকদীরের আসবাবের কারণে এখনো তা বাস্তবায়িত হয়নি তাহলে ঐ তাকতদীরকে এ তাকদীরের মাধ্যমে প্রতিহত করা শরিয়ত সম্মত। যেমন শত্রুকে প্রতিহত করা লড়াই-যুদ্ধ দ্বারা, শীত-গরম প্রতিহত করা ইত্যাদি।

২-যে তাকদীর সঙ্ঘটিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গিয়েছে সেটিকে অন্য তাকদীরের মাধ্যমে -যা তাকে দূর করে দেবে বা দেয়ার ক্ষমতা রাখে - প্রতিহত করা। যেমন: অসুস্থতার তাকদীরকে চিকিৎসার তাকদীর দিয়ে প্রতিহত করা, অপরাধের তাকদীরকে তাওবার তাকদীরের মাধ্যমে প্রতিহত করা এবং মন্দকর্মের তাকদীরকে ভালকর্মের তাকদীর দ্বারা প্রতিহত করা।

২৬৮
আল্লাহর ইচ্ছা সকল বস্ত্তকে শামিল করে আছে :
বান্দার ভাল-মন্দ সকল কর্ম সৃষ্টি ও অস্তিত্বদানের দিক থেকে আল্লাহর দিকে সম্বন্ধযুক্ত করা রীতি বিরুদ্ধ বা শরিয়ত পরিপন্থী নয়। আল্লাহ সকলকিছুর সৃষ্টিকর্তা। তারই ধারাবাহিকতায় তিনি মানুষ এবং তাদের কর্ম সৃষ্টি করেছেন। তবে এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে প্রনিধানযোগ্য যে আল্লাহর ইচ্ছা কিন্তু তার সন্তুষ্টির প্রমাণ নয়।

সুতরাং কুফরী, অবধ্যতা এবং গোলযোগ-বি:শৃংখলা আল্লাহর ইচ্ছায়ই সঙ্ঘটিত হয় তবে আল্লাহ এগুলো পছন্দ করেন না, এর প্রতি সন্তুষ্ট হন না এবং এগুলোর নির্দেশও প্রদান করেন না। বরং তিনি এসব অপছন্দ, ঘৃণা ও নিষেধ করেন।

অতএব কোন জিনিষ অপছন্দনীয় ও ঘৃণিত হওয়া সেটিকে তাঁর ইচ্ছার আওতা বহির্ভূত হওয়াকে জরুরী করে না যে ইচ্ছা সকল বস্ত্তর সৃষ্টিকে শামিল করে। সুতরাং প্রত্যেক বস্ত্তকেই সৃষ্টি করেছেন আল্লাহই বিশেষ উদ্দেশ্যে ও বিশেষ হিকমতে যা তার রাজত্ব ও সৃষ্টির পরিচালনার বিশেষ কৌশল।

সর্বাধিক মর্যাদাবান ও পরিপূর্ণ মানুষ হচ্ছে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পছন্দনীয় বিষয়াবলীকে পছন্দ করে এবং তাদের অপছন্দনীয় বিষয়াদিকে অপছন্দ করে। এ ব্যতীত তাদের নিকট পছন্দ-অপছন্দের অন্য কোন মানদন্ড নেই।

সুতরাং তারা আদেশ করে যেসব বিষয়ে আদেশ করেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এর বাইরে কোন বিষয়ে তারা আদেশ করেন না।

প্রত্যেক বান্দা প্রতি মহুর্তে মুহতাজ আল্লাহর যে কোন আদেশের প্রতি যা সে বাস্তবায়ন করবে কিংবা কোন নিষেধের প্রতি যার থেকে বেচে থাকবে এবং তাকদীরের প্রতি যার প্রতি সে সন্তুষ্ট থাকবে।

২৬৯
তাকদীরের প্রতি সন্তুষ্ট থাকার বিধান: তাকদীরের প্রতি সন্তুষ্টি তিন প্রকার
১-তা‘আত তথা ইবাদাত-আনুগত্যের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা, এটি ওয়াজিব।

২-বিপদাপদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা, এটি মুস্তাহাব।

৩-কুফর, পাপাচার ও অবধ্যতা। এগুলোর ব্যাপারে সন্তুষ্টির নির্দেশ দেয়া হচ্ছে না বরং ঘৃণা ও অপছন্দ করার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। কেননা এসব আল্লাহ পছন্দ করেন না এবং এসব বিষয়ের প্রতি তিনি সন্তুষ্ট ও নন। যদিও তিনি -পছন্দ নাকরেই- ওগুলো সৃষ্টি করেছেন, তবে সেগুলো আল্লাহর পছন্দনীয় বিষয় পর্যন্ত পৌছে দেয়। যেমন তিনি শয়তানদের সৃষ্টি করেছেন।

সুতরাং আমরা আল্লাহ যা সৃষ্টি করেছেন তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকব আর স্বয়ং ঐ কাজ ও বাস্তায়নকারীর প্রতি সন্তুষ্টও থাকব না, ভালও বাসব না।

অতএব একটি বিষয়কে এক বিবেচনায় ভালবাসব আবার অন্য বিবেচনায় অপছন্দ করব। যেমন অপছন্দনীয় ঔষধ। এটি অপছন্দনীয় ঠিক, তবে পছন্দনীয় অবস্থায় পৌছে দেয়। আর আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছার রাস্তা হচ্ছে তিনি যা পছন্দ করেন ও ভালবাসেন তা বাস্তবায়ন করে তাঁকে সন্তুষ্ট করা। যা কিছু সঙ্ঘটিত হচ্ছে বা হবে তার প্রত্যেকটির প্রতিই সন্তুষ্ট থাকতে হবে এমনটি কিন্তু নয়। আর যত কিছুই তিনি নির্ধারণ করেছেন এর প্রত্যেকটির প্রতিই সন্তুষ্ট থাকতে হবে এমন কোন নির্দেশও আমাদের দেয়া হয়নি। বরং আমরা আদিষ্ট হচ্ছি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশের প্রতি সন্তুষ্ট থাকার যে নির্দেশ আমাদের দেয়া হয়েছে তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকা।

২৭০
আল্লাহর ফায়সালা ভাল হোক কিংবা মন্দ তার দুটি দিক আছে:
১- সেটির সম্পৃক্ততা আল্লাহর সাথে এবং সম্বন্ধও তারই দিকে। সুতরাং এ দিকের বিবেচনায় বান্দা তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে। অতএব আল্লাহর প্রতিটি সিদ্ধান্ত কল্যাণকর, ইনসাফ পূর্ণ ও হিকমতময়।

২- সেটির সম্পৃক্ততা বান্দার সাথে আর সম্বন্ধও তারই দিকে। এসব ফায়সালার কতক আছে যার প্রতি সন্তুষ্ট থাকা হবে। যেমন, ঈমান ও আনুগত্য-ইবাদাত। আর কিছু আছে যার প্রতি সন্তুষ্ট থাকা যাবে না। যেমন; কুফর ও অবাধ্যতা। অনুরূপভাবে আল্লাহও সেগুলোর প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন না তাদের ভালবাসেন না এবং তা বাস্তবায়নের নির্দেশও প্রদান করেন না।

১- আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

وَرَبُّكَ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ وَيَخْتَارُ مَا كَانَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ سُبْحَانَ اللَّهِ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ { القصص :৬৮}

তোমার প্রতিপালক যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং যাকে ইচ্ছা মনোনীত করেন, এতে তাদের কোন হাত নেই। আল্লাহ পবিত্র, মহান এবং তারা যাকে শরীক করে তহতে তিনি অনে উর্দ্ধে।

২- অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

إِنْ تَكْفُرُوا فَإِنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ عَنْكُمْ وَلَا يَرْضَى لِعِبَادِهِ الْكُفْرَ وَإِنْ تَشْكُرُوا يَرْضَهُ لَكُمْ { الزمر :৭}

তোমরা কুফরি করলে আল্লাহ তাআলা তোমাদের থেকে সম্পূর্ণ বেনিয়ায। তিনি তার বান্দাদের জন্য কুফরি পছন্দ করেন না। আর যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় কর তবে তিনি তা পছন্দ করেন। ( সূরা যুমার:৭)

৩-আরো ইরশাদ হচ্ছে:

والله خلقكم وما تعملون . { الصافات :৯৬}

আর আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন তোমাদের এবং তোমরা যা কর। {সূরা সাফ্ফাত:৯৬}

২৭১
বান্দার যাবতীয় কর্ম মাখলূক তথা সৃষ্টিকৃত:
আল্লাহ তাআলা বান্দাকে সৃষ্টি করেছেন এবং সৃষ্টি করেছেন তার যাবতীয় কর্ম। তিনি তার কর্মাদি সম্পর্কে জানেন এবং সেটি সঙ্ঘটিত হওয়ার পূর্বেই তিনি তা লিখে রেখেছেন। সুতরাং বান্দা যখন ভাল কিংবা মন্দ কোন কাজ করে তখন আমাদের নিকট সে বিষয়ে পরিষ্কার হয়ে যায় যা আল্লাহ জানেন, সৃষ্টি করেছেন এবং লিখে রেখেছেন। বান্দার কর্ম সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার জ্ঞান হচ্ছে পরিবেষ্টনকারী জ্ঞান। কারণ আল্লাহ তাআলা জ্ঞানের মাধ্যমে প্রত্যেক বস্ত্তকে পরিবেষ্টন করে আছেন। ভূ-মন্ডল ও নভোমন্ডলে তাঁর থেকে অণু পরিমাণও কিছু গোপন থাকে না।

১- আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

والله خلقكم وما تعملون . { الصافات :৯৬}

আর আল্লাহ তোমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং তোমরা যা কর। {সূরা সাফ্ফাত:৯৬}

২- অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

وَعِنْدَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لَا يَعْلَمُهَا إِلَّا هُوَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَمَا تَسْقُطُ مِنْ وَرَقَةٍ إِلَّا يَعْلَمُهَا وَلَا حَبَّةٍ فِي ظُلُمَاتِ الْأَرْضِ وَلَا رَطْبٍ وَلَا يَابِسٍ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُبِينٍ { الأنعام :৫৯}

গায়েবের চাবি কাঠি তাঁরই নিকট রয়েছে তিনি ব্যতীত আর কেউ তা জানেনা। স্থল ও জল ভাগের সব কিছুই তিনি অবগত রয়েছেন, তাঁর অবগতি ব্যতীত বৃক্ষ হতে একটি পাতাও ঝরে না এবং ভূ-পৃষ্ঠের অন্ধকারের মধ্যে একটি দানাও পড়ে না, এমনিভাবে কোন সরস ও নিরস বস্ত্তও পতিত হয় না; সমস্ত বস্তই সুস্পষ্ট কিতাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে।

{সূরা আন‘আম:৫৯}

৩- আরো ইরশাদ হচ্ছে:

وَمَا تَكُونُ فِي شَأْنٍ وَمَا تَتْلُو مِنْهُ مِنْ قُرْآَنٍ وَلَا تَعْمَلُونَ مِنْ عَمَلٍ إِلَّا كُنَّا عَلَيْكُمْ شُهُودًا إِذْ تُفِيضُونَ فِيهِ وَمَا يَعْزُبُ عَنْ رَبِّكَ مِنْ مِثْقَالِ ذَرَّةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ وَلَا أَصْغَرَ مِنْ ذَلِكَ وَلَا أَكْبَرَ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُبِينٍ { يونس :৬১}

আর তুমি যে অবস্থাতেই থাকনা কেন? আর তুমি কুরআনের যে কোন স্থান হতেই পাঠ কর এবং তোমরা যে কাজই কর কিন্তু আমি তোমাদের নিকটেই উপস্থিত থাকি, যখন তোমরা তাতে আত্মনিয়োগ কর। অনু পরিমাণও কোন বস্ত্ত তোমার প্রতিপালকের অগোচরে নয়, না যমীনে, না আসমানে, আর না কোন বস্ত্ত তাহতে ক্ষুদ্রতর, না তা হতে বৃহত্তর, কিন্তু এই সমস্তই স্পষ্ট কিতাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। { সূরা ইউনুস:৬১}

৪- হাদীসে এসেছে

وعن عبد الله بن مسعود رضي الله عنه قال : حدثنا رسول الله صلى الله عليه وسلم وهو الصادق المصدوق : إن أحدكم يجمع خلقه في بطن أمه أربعين يوما , ثم يكون في ذلك علقة مثل ذلك , ثم يكون في ذلك مضغة مثل ذلك , ثم يرسل الملك , فينفخ فيه الروح , ويِؤمر بأربع كلمات : بكتب رزقه , وأجله , وعمله , وشقي أو سعيد . فوالذي لا إله غيره , إن أحدكم ليعمل بعمل أهل الجنة حتى يكون بينه و بينها إلا ذراع , فيسبق عليه الكتاب فيعمل بعمل أهل النار فيدخلها . وإن أحدكم ليعمل بعمل أهل النار , حتى يكون بينه و بينها إلا ذراع فيسبق عليه الكتاب , فيعمل بعمل أهل الجنة فيدخلها . متفق عليه

সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম - তিনি সত্যবাদী ও সত্যায়িত- আমাদের বর্ণনা করেছেন: নিশ্চয় তোমাদের প্রত্যেকের আকৃতিকে তার মায়ের উদরে চল্লিশন দিন পর্যন্ত জমাকরা হয়। অত:পর সেটি সেখানে রক্তপিন্ড হয় চল্লিশদিন যাবত। এরপর সেটি সেখানে গোশত পিন্ড হয় অনুরূপ সময়। অত:পর (নির্ধারিত) ফেরেশতা প্রেরণকরা হয়। সে এসে তার মধ্যে আত্মা ফূঁকে দেয়। এবং তাকে চারটি বিষয়ে নির্দেশ দেয়া হয়: তার রিযিক, মৃত্যু ও আমল লিপিবদ্ধ করতে বলা হয় এবং (আরো লিখতে বলা হয়) সে দূর্ভাগা নাকি ভাগ্যবান। শপথ সে আল্লাহর যিনি ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই, তোমাদের কেউ আহলে জান্নাতের আমল সদৃশ আমল করবে এক পর্যায়ে তার মাঝে ও জান্নাতের মাঝে মাত্র এক গজের দূরত্ব থাকবে সেসময় তার ভাগ্যলিপি সামনে এসে উপস্থিত হবে এবং জাহান্নামীদের আমল সদৃশ আমল করে বসবে আর তাতে প্রবেশ করবে।

অনুরূপভাবে তোমাদের কেউ জাহান্নাম অধিবাসীদের আমল সদৃশ আমল করবে এক পর্যায়ে তার মাঝে ও জাহান্নামের মাঝে মাত্র এক গজের দূরত্ব থাকবে তখন তার সামনে ভাগ্যলিপি এসে উপস্থিত হবে এবং জান্নাতীদের আমল সদৃশ আমল করবে অত:পর তাতে প্রবেশ করবে। [বর্ণনায় বুখারী হাদীস নং (৩২০৮) ও মুসলিম হাদীস নং (২৬৪৩)।]

২৭২
ইনসাফ ও অনুগ্রহ:
আল্লাহ তাআলার কর্মাবলী ইনসাফ ও অনুগ্রহের মাঝে ঘূর্ণায়মান। তিনি কারো প্রতি যুলুম করবেন এটি কোনক্রমেই সম্ভব নয়। বান্দাদের সাথে হয়ত ইনসাফ ভিত্তিক মুআমালা করবেন নতুবা অনুগ্রহপূর্ণ। সুতরাং মন্দকর্ম সম্পাদনকারীর সাথে ইনসাফপূর্ণ আচরণ করেন।

যেমন ইরশাদ হচ্ছে:

وجزاء سيئة سيئة مثلها . { الشورى :৪০}

মন্দের প্রতিফল অনুরূপ মন্দ। {সূরা শূরা : ৪০}

আর সৎকর্মশীলদের সাথে আচরণ করেন অনুগ্রহপূর্ণ। আল্লাহ তাআলা বলেন:

من جاء بالحسنة فله عشر أمثالها .{ الأنعام :১৬০}

যে নেককর্ম সম্পাদন করল তার জন্য রয়েছে তার দশগুন।{সূরা আনআম:১৬০}

২৭৩
শরয়ী ও কাওনী নির্দেশাবলি:
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলার দু’ধরণের নির্দেশাবলি রয়েছে। কাওনী নির্দেশাবলি ও শরয়ী নির্দেশাবলি।

২৭৪
কাওনী নির্দেশাবলি তিন প্রকার:
১- সৃষ্টি ও অস্তিত্বদান বিষয়ক নির্দেশনা। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে সকল সৃষ্টিজীবের প্রতি প্রেরিত।

আল্লাহ তাআলা বলেন:

الله خالق كل شيء وهو على كل شيئ وكيل . { الزمر :৬২}

আল্লাহ সমস্ত কিছুর স্রষ্টা এবং তিনি সমস্ত কিছুর কর্মবিধায়ক। {সূরা যুমার:৬২}

২- স্থিতি বিষয়ক নির্দেশনা। এ নির্দেশনা স্থিতি ও স্থায়িত্ব সম্বন্ধে আল্লাহর পক্ষ থেকে সকল মাখলূকাতের প্রতি প্রেরিত।

(ক) আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

إِنَّ اللَّهَ يُمْسِكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ أَنْ تَزُولَا وَلَئِنْ زَالَتَا إِنْ أَمْسَكَهُمَا مِنْ أَحَدٍ مِنْ بَعْدِهِ إِنَّهُ كَانَ حَلِيمًا غَفُورًا { فاطر :৪১}

আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীকে আল্লাহই সংরক্ষণ করেন, যাতে তারা স্থানচ্যুত না হয়। তারা স্থানচ্যুত হলে তিনি ব্যতীত তাদেরকে সংরক্ষণ করবে? তিনিতো অতি সহনশীল, ক্ষমাপরায়ণ। {সূরা ফাতির:৪১}

(খ) আরো ইরশাদ হচ্ছে:

وَمِنْ آَيَاتِهِ أَنْ تَقُومَ السَّمَاءُ وَالْأَرْضُ بِأَمْرِهِ ثُمَّ إِذَا دَعَاكُمْ دَعْوَةً مِنَ الْأَرْضِ إِذَا أَنْتُمْ تَخْرُجُونَ

{ الروم :২৫}

এবং তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তাঁরই আদেশে আকাশ ও পৃথিবীর স্থিতি থাকে ; অত:পর আল্লাহ যখন তোমাদেরকে মৃত্তিকা হতে উঠে আসার জন্য একবার আহবান করবেন তখন তোমরা বের হয়ে আসবে। {সূরা রূম:২৫}

৩- উপকার-অপকার, নড়াচড়া-স্থিতি ও জীবন-মরণ ইত্যাদি বিষয়ক নির্দেশনা। আর এটি ফেরানো হয়েছে সকল মাখলূকাতের দিকে।

(ক) আল্লাহ তাআলা বলেন:

قُلْ لَا أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ وَلَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ إِنْ أَنَا إِلَّا نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ { الأعراف :১৮৮}

তুমি বলে দাও, আমি আমার নিজের কোন উপকার ও ক্ষতির মালিক নই তবে আল্লাহ যা চান। আর যদি আমি গায়েব জানতামই তাহলে অধিক কল্যাণ লাভ করতাম আর আমাকে কোন ক্ষতি স্পর্শ করত না। আমিতো শুধুমাত্র একজন ভীতি প্রদর্শক ও সু সংবাদদাতা ঈমান আনয়নকারী সম্প্রদায়ের জন্য। {সূরা আ’রাফ:১৮৮}

(খ) আরো ইরশাদ হচ্ছে:

هُوَ الَّذِي يُسَيِّرُكُمْ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ حَتَّى إِذَا كُنْتُمْ فِي الْفُلْكِ وَجَرَيْنَ بِهِمْ بِرِيحٍ طَيِّبَةٍ وَفَرِحُوا بِهَا جَاءَتْهَا رِيحٌ عَاصِفٌ وَجَاءَهُمُ الْمَوْجُ مِنْ كُلِّ مَكَانٍ وَظَنُّوا أَنَّهُمْ أُحِيطَ بِهِمْ دَعَوُا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ لَئِنْ أَنْجَيْتَنَا مِنْ هَذِهِ لَنَكُونَنَّ مِنَ الشَّاكِرِينَ { يونس :২২}

তিনিই তোমাদিগকে জলে-স্থলে ভ্রমণ করান। এমনকি যখন তোমরা নৌকায় অবস্থান করা আর সেই নৌকাগুলো লোকদের নিয়ে অনুকূলে বায়ূর সাহায্যে চলতে থাকে, আর তারা তাতে আনন্দিত হয়, (হঠাৎ) তাদের উপর এক প্রচন্ড বায়ূ এসে পড়ে এবং প্রত্যেক দিক থেকে তাদের উপর তরঙ্গমালা ধেয়ে আসে, আর তারা মনে করে যে, তারা (বিপদে) বেষ্টিত হয়ে পড়েছে। (তখন) সকলে খাঁটি বিশ্বাসের সাথে আল্লাহকেই ডাকতে থাকে, যদি আপনি আমাদেরকে এটি হতে রক্ষা করেন, তবে আমরা অবশ্যই কৃতজ্ঞ হয়ে যাবো। {সূরা ইউনুস:২২}

৩- অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

هو الذي يحي و يميت فإذا قضى أمرا فإنما يقول له كن فيكون . { غافر :৬৮}

তিনিই জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান এবং যখন তিনি কিছু করার সিদ্ধান্ত নেন তখন বলেন: হয়ে যাও এবং তা হয়ে যায়। {সূরা গাফির: ৬৮}

বাকী থাকল শরয়ী নির্দেশনাবলী, এ নির্দেশনা আল্লাহর পক্ষ হতে শুধুমাত্র সাকালাইন তথা জিন ও মানুষের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আর এটিই দ্বীন। এটি ঈমান, ইবাদাত, লেন-দেন, আচার-আচরণ ও আখলাককে শামিল করে।

আল্লাহ তাআলার নাম ও গুণাবলি, তাঁর কার্যাবলী ও কাওনী নির্দেশনাবলীর উপর বিশ্বাসের দৃঢ়তার অনুপাতে বান্দার নিকট তাঁর শরয়ী নির্দেশনাবলী বাস্তবায়নের আগ্রহ ও উৎসাহ সৃষ্টি হয় এবং এর একটি বিশেষ স্বাদ অনুভূত হয়। এ ব্যাপারে সর্বাধিক ভাগ্যবান মানুষ তাঁরাই, যাঁরা নিজেদের রব সম্পর্কের সবচে বেশি অভিজ্ঞ। আর তাঁরা হচ্ছেন আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম অত:পর তাদের নির্দেশনার অনুসারীবৃন্দ।

আল্লাহ তাআলার শরয়ী নির্দেশনাবলীর বাস্তবায়নের কারণে আল্লাহ তাআলা পৃথিবীতে আমাদের জন্য আকাশ ও যমীনের বরকতের দারসমূহ উন্মোক্ত করে দেবেন এবং আখিরাতে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।

২৭৫
আল্লাহর নির্দেশনাবলি দুই প্রকার:
১-শরয়ী নির্দেশনাবলী কখনো সংঘটিত হয়, আবার কখনো কখনো আল্লাহর ইচ্ছায় বান্দা তার বিরোধিতাও করে। যেমন:

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করছেন:

وقضى ربك ألا تعبدوا إلا إياه وبالوالدين إحسانا . { الإسراء :২৩}

আর তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিচ্ছেন; তোমরা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে আর পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করবে। {সূরা ইসরা:২৩}

২-কাওনী নির্দেশনাবলী অবশ্যই সঙ্ঘটিত হয়, মানুষের পক্ষে তার বিরোধিতা করা অসম্ভব। সেটি আবার দুই প্রকার:

(ক)আল্লাহর সরাসরি নির্দেশ (যা) অত্যাবশ্যকীয়ভাবে সঙ্ঘটিতব্য।

যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন:

إنما أمره إذا أراد شيئا أن يقول له كن فيكون .{ يس :৮২}

তাঁর ব্যাপার শুধু এই, তিনি যখন কোন কিছুর ইচ্ছা করেন, তখন বলেন, হয়ে যাও, ফলে সেটি হয়ে যায়। {সূরা ইয়াসীন:৮২}

(খ) আল্লাহর কাওনী নির্দেশনা আর সেটি হচ্ছে কাওনী রীতি যা বিভিন্ন আসবাব ও নতীজা থেকে গঠিত হয়, যার কিছু অপর কিছুকে প্রভাবিত করে। আর প্রত্যেক কাওনী সববের একটি নতীজা থাকে। আর সুনানে কাওনী থেকে:

১- ইরশাদ হচ্ছে:

ذَلِكَ بِأَنَّ اللَّهَ لَمْ يَكُ مُغَيِّرًا نِعْمَةً أَنْعَمَهَا عَلَى قَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا مَا بِأَنْفُسِهِمْ وَأَنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ

{ الأنفال : ৫৩}

এটি এ জন্য যে, যদি কোন সম্প্রদায় নিজের অবস্থার পরিবর্তন না করে, তবে আল্লাহ এমন নন যে, তিনি তাদেরকে যে সম্পদ দান করেছেন তা পরিবর্তন করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা,সর্বজ্ঞ।

২- আরো ইরশাদ হচ্ছে:

وَإِذَا أَرَدْنَا أَنْ نُهْلِكَ قَرْيَةً أَمَرْنَا مُتْرَفِيهَا فَفَسَقُوا فِيهَا فَحَقَّ عَلَيْهَا الْقَوْلُ فَدَمَّرْنَاهَا تَدْمِيرًا

{ الإسراء :১৬}

আর আমি যখন কোন জনপদ ধ্বংস করতে চাই তখন তার সমৃদ্ধিশালী ব্যক্তিদেরকে সৎকর্ম করতে আদেশ দেই, কিন্তু তারা সেখানে অপকর্ম করে, তখন সে জনপদের উপর আদেশ (দন্ডাজ্ঞা) অবধারিত হয়ে যায়। এবং সেটি আমি সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করি।

{সূরা ইসরা:১৬}

ইবলিস ও তার অনুসারীদের পক্ষে এ কাওনী রীতিকে বশীভূতকরার চেষ্টা করা সম্ভব যাতে করে এটি কোন কোন মানুষের ধ্বংসের কারণ হতে পারে। করুনাময় আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য সেসব থেকে মুক্তির লক্ষ্যে দুআ ও ইস্তেগফারের অনুমোদন করেছেন। দুআ হচ্ছে আল্লাহর আশ্রয় যিনি সকল কাওনী রীতিকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি যে কোন সময় এবং যে ভাবে ইচ্ছা তার কার্যকারিতা নষ্ট করার ক্ষমতা রাখেন অনুরূপভাবে তার নতীজা (পরিণতি) ও পরিবর্তন করতে পারেন। যেমন তিনি নবী ইবরাহীম আলাইহিস সালামের ক্ষেত্রে আগুনের কার্যকরিতা নষ্ট করে দিয়েছিলেন। ইরশাদ হচ্ছে:

قلنا يا نار كوني بردا و سلاما على إبراهيم . { الأنبياء :৬৯}

আমি বললাম: হে আগুন! তুমি ইবরাহীমের জন্য শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও।

{সূরা আম্বিয়া:৬৯}

২৭৬
পাপ ও পুণ্যের প্রকারভেদ:
হাসানাহ (পুণ্য) দুই প্রকার:

১- পুণ্য যার সূত্র ঈমান ও নেক আমল,আর এটিই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য।

২- পুণ্য যার কারণ মানুষের উপর আল্লাহর দান ও অনুগ্রহ যেমন আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদ, সুস্থতা, সাহায্য ও ইয্যত-সম্মান ইত্যাদি।

এবং সাইয়িআত তথা পাপ দুই প্রকার:

১- এমন পাপ, যার কারণ শিরক ও অবাধ্যতা, আর তা হচ্ছে মানুষ দ্বারা সঙ্ঘটিত শিরক ও অবাধ্যতা।

২- এমন পাপ, যার কারণ হচ্ছে, পরীক্ষা বা আল্লাহর প্রতিশোধ, যেমন শারীরিক অসুস্থতা, সম্পদ ধ্বংস হয়ে যাওয়া এবং বিপর্যয় ইত্যাদি

সুতরাং আনুগত্য অর্থে যে পুণ্য তা আল্লাহর দিকে সম্পর্কিত করা হবে না। তিনিইতো এটি বান্দার জন্য অনুমোদিত করেছেন। তাদের শিক্ষা দিয়েছেন। বাস্তবায়ন করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং তার উপর সহযোগিতা করেছেন।

আর আল্লাহ ও রাসূলের অবাধ্যতা অর্থে যে পাপ, সেটি যদি বান্দা তার নিজস্ব এখতিয়ার ও ইচ্ছায় আনুগত্যের উপর প্রাধান্য দিয়ে সম্পাদন করে। তাহলে এরূপ পাপ কর্মের দায়ের সম্পর্ক বাস্তবায়নকারী মানুষের দিকে করা হবে। আল্লাহর দিকে করা হবে না। কারণ আল্লাহ তা অনুমোদিত করেননি এবং বাস্তবায়ন করতে নির্দেশও প্রদান করেননি। বরং হারাম করেছেন এবং শাস্তির হুমকি দিয়েছেন।

যেমন আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

ما أصاب من حسنة فمن الله و ما أصاب من سيئة فمن نفسك وأرسلناك للناس رسولا وكفى بالله شهيدا . { النساء :৭৯}

তোমার নিকট যে কল্যাণ পৌছে সেটি আল্লাহর পক্ষ হতে আর যে অকল্যাণ আপতিত হয় তা তোমার নিজের পক্ষ হতে। আর আমি তোমাকে মানুষের (কল্যাণের) জন্য রাসূল করে প্রেরণ করেছি। এবং সাক্ষী হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট।{সূরা নিসা:৭৯}

আর নিয়ামত অর্থে পুণ্য যথা সম্পদ, সন্তান, সুস্থতা, সাহায্য এবং সম্মান আর শাস্তি ও পরীক্ষা অর্থে পাপ যেমন সম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলে ঘাটতি ও বিপর্যয় ইত্যাদি।

এ ধরণের পাপ ও পুণ্য আল্লাহর পক্ষ হতে। কারণ আল্লাহ তাআলা নিজ বান্দাদের বিভিন্ন পরীক্ষায় ফেলেন পরীক্ষা করার জন্য। বা তাদের উন্নতি দান ও প্রশিক্ষণের জন্য ।

মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন:

وَإِنْ تُصِبْهُمْ حَسَنَةٌ يَقُولُوا هَذِهِ مِنْ عِنْدِ اللَّهِ وَإِنْ تُصِبْهُمْ سَيِّئَةٌ يَقُولُوا هَذِهِ مِنْ عِنْدِكَ قُلْ كُلٌّ مِنْ عِنْدِ اللَّهِ فَمَالِ هَؤُلَاءِ الْقَوْمِ لَا يَكَادُونَ يَفْقَهُونَ حَدِيثًا ﴿78﴾ { النساء : ৭৮}

আর যদি তাদের কোন কল্যাণ সাধিত হয় তাহলে বলে এটি আল্লাহর পক্ষ হতে। আর যদি কোন অকল্যাণ আপতিত হয় তাহলে বলে: এটি তোমার পক্ষ হতে। বলে দাও: সব কিছুই আল্লাহর পক্ষ হতে

। সুতরাং ঐ সম্প্রদায়ের কি হল! তারা কোন কথাই বুঝতে চায় না। { সূরা নিসা :৭৮}

২৭৭
পাপকর্মের শাস্তি প্রতিরোধ প্রসঙ্গ:
মুমিন যদি কোন পাপ করে ফেলে তাহলে সে ঐ পাপের শাস্তি নিম্নোক্ত পদ্ধতিতে প্রতিরোধ করতে পারে:

তাওবা করতে পারে তাহলে আল্লাহ তার তাওবা কবুল করবেন।অথবা ইস্তিগফার করতে পারে তাহলে আল্লাহ তার পাপ ক্ষমা করে দেবেন অথবা নেক কর্ম সম্পাদন করতে পারে যা সে পাপ মিটিয়ে দিবে।অথবা তার জন্য তার মুমিন ভ্রাতৃবৃন্দ দু‘আ করতে পারে এবং ইস্তেগফার করবে আর আল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন।অথবা তারা তার জন্য তাদের কৃত আমলের ছাওয়াব দান করতে পারে যা তার উপকারে আসবে অথবা আল্লাহ তাআলা দুনিয়াতে মুসিবতে ফেলতে পারেন যা তার পাপের কাফফারা হয়ে যাবে অথবা বরযখে কোন বিপদে ফেলতে পারেন যা কাফফারা হিসেবে বিবেচিত হবে অথবা কিয়ামতের ময়দানে কোন বিপদে ফেলতে পারেন যা তার পাপের কাফফারা হবে অথবা তার জন্য তার নবী সুপারিশ করতে পারেন কিংবা পরম করুনাময় আল্লাহ তার প্রতি রহম করতে পারেন। আর আল্লাহ ক্ষমাকারী অতীব করুনাময়।

২৭৮
আনুগত্য ও অবাধ্যতা
ইবাদত-আনুগত্য বহুবিধ কল্যাণের জন্ম দেয় এবং উত্তম আখলাকের উদ্ভব ঘটায়। আর পাপকর্ম ও অবাধ্যতা নানা অনিষ্টির জন্ম দেয় এবং বদ আখলাক সৃষ্টি করে। চন্দ্র, সূর্য, তৃণ-লতা, জীব-জন্তু, পাহাড়-সমুদ্র, স্বীয় প্রতিপালকের আনুগত্য স্বীকার করে তাঁকে মান্য করে চলে তাইতো দেখা যায় এদের থেকে অগণিত-অসংখ্য কল্যাণ বের হয়ে আসছে প্রতিনিয়ত। যার প্রকৃত সংখ্যা কেবলমাত্র আল্লাহ তাআলাই বলতে পারবেন আর কেউ নয়।

নবীগণ জীবন-প্রাণ উৎসর্গ করে আল্লাহর ইবাদত-আনুগত্যে জীবন পরিচালনা করেছেন। আর তাদের থেকে বেশুমার কল্যাণ বের হয়ে এসেছে যা আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ জানেনা।

পক্ষান্তরে ইবলিস আল্লাহর অবাধ্য হয়েছে, তাঁকে অস্বীকার করে তাঁর নাফরমানী করেছে তার কারণে পৃথিবীতে অনেক অনিষ্টি ও বিশৃঙ্খলা জন্ম নিয়েছে। যত পাপ ও অন্যায় একারণেই সঙ্ঘটিত হয়ে চলেছে।

একই নিয়মে মানুষ যদি স্বীয় প্রতিপালকের ইবাদত-আনুগত্যে নিয়োজিত থাকে, শরয়ী বিধি-বিধান যথা নিয়মে পালন করে চলে তাহলে সীমাহীন কল্যাণ বের হয়ে আসবে যার প্রকৃত গণনা একমাত্র আল্লাহই ভাল জানবেন। এবং ঐ কল্যাণের সুফল সে নিজে এবং অন্য সকলে ভোগ করবে। আর যদি তারা আল্লাহর অবাধ্য হয়ে শরিয়ত নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করে, পাপাচারিতায় মত্ত হয়ে সময় অতিবাহিত করে তাহলে পৃথিবীতে অনেক অনিষ্টি ও খারাপির উদ্ভব ঘটবে যার কুফল সেসহ অপরাপর সকল মানুষকে ভোগ করতে হবে।

২৭৯
আনুগত্য ও অবাধ্যতার প্রভাব ও পরিণামঃ
মহান আল্লাহ নেককাজ ও আনুগত্যের মাঝে এমন শুভপরিণাম ও প্রভাব সৃষ্টি করেছেন যা প্রতিটি মানুষের কাছে প্রিয় ও সমাদৃত যার মাধ্যমে সে এক প্রকার মানসিক শান্তি ও স্বাদ অনুভব করে আর সে অনুভূতি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। সে স্বাদ অন্যায়ের স্বাদ হতে বহুগুণে বেশি। অনুরূপভাবে অবাধ্যতা ও পাপকর্মের মাঝেও কিছু মন্দপ্রভাব ও যন্ত্রণা রেখে দিয়েছেন যা পরিতাপ ও লজ্জার জন্ম দেয়, অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ করে প্রতিনিয়ত। মানুষের যাবতীয় অকল্যাণ ও মন্দ অবস্থার মূল কারণ ও কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে তার পাপ ও অবাধ্যতা, অথচ আল্লাহ যা ক্ষমা করেন তার পরিমাণ অনেক বেশি।

বিষ মানুষের শরীরের জন্য যেরূপ ক্ষতিকর, পাপ ও অন্যায় তাদের অন্তরের জন্য অনুরূপ ক্ষতিকর। আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিগতভাবে মানুষকে সুন্দর-সুশ্রী করে সৃষ্টি করেছেন। যদি তারা অন্যায় ও পাপাচারে জড়িত হয় তাদের ঐ সৌন্দর্য তুলে নেয়া হয়। আবার তওবা করে আল্লাহর পথে ফিরে আসলে পূর্বের সৌন্দর্যও ফেরত আসে এবং জান্নাতে তার উৎকর্ষ সাধন হবে।

২৮০
হিদায়াত দান ও বিপথগামী করণ:
আল্লাহ তাআলা-সৃষ্টি ও কর্তৃত্ব তাঁরই। যা ইচ্ছা করতে পারেন-করেন এবং ইচ্ছামতে নির্দেশ ও ফায়সালা করেন। যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দান করেন আবার যাকে ইচ্ছা বিপথগামী করেন। তাঁর রাজত্বই রাজত্ব। তাঁর সৃষ্টিই সৃষ্টি। যা করেন সে ব্যাপারে জবাবদিহী করতে হয় না বরং জবাবদিহী মানুষকেই করতে হবে। তাঁর অনুগ্রহের সীমা-পরিসীমা নেই, বহু নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন, বহু কিতাব অবতীর্ণ করেছেন। কোনটি সত্য আর কোনটি ভুল, কোনটি হিদায়াতের আর কোনটি গোমরাহীর ব্যাখ্যা করে সব রাস্তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে সকল ব্যাধি ও প্রতিবন্ধকতা অপসারিত করেছেন। হিদায়াত ও আনুগত্যের রাস্তা চি ‎‎ হ্নত করণের উপকরণ দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি ও বিবেকবোধ দান করার মাধ্যমে হিদায়াত কবুলের শক্তি দান করেছেন। এরপর:

যে ব্যক্তি হেদায়াতকে প্রাধান্য দেবে, এর প্রতি উৎসাহী-উদ্যোগী হবে, অনুসন্ধান করবে, এর উপায়-উপকরণগুলোকে কাজে লাগাবে এবং তা লাভ করার জন্য শ্রম দেবে-কঠোর পরিশ্রম করবে আল্লাহ তাকে হিদায়াত দান করবেন। হিদায়াত লাভ ও এর পূর্ণতায় পৌছাঁতে সাহায্য করবেন। আর এটি বান্দার প্রতি আল্লাহর বিশেষ দান ও অনুগ্রহ।

আল্লাহ তাআলা বলেন:

وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ اللَّهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِينَ

আর যারা আমার পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, তাদেরকে আমি অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করব (হিদায়াত দান করব)। আর নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সাথেই আছেন। [সূরা আনকাবুত:৬৯।]

আর যে ব্যাক্তি গোমরাহী ও পথভ্রান্তিকে প্রাধান্য দেবে, এর প্রতি অনুরক্ত হবে, অন্বেষণ করবে, এবং গোমরাহীর আসবাব-উপকরণের অনুকূলে কাজ করবে তাহলে তা তার জন্য নিশ্চিত হয়ে যাবে এবং সে যেদিকে যেতে চেয়েছে আল্লাহ তাকে সেদিকে নিয়ে যাবেন। আল্লাহর সিদ্ধান্ত থেকে আর কেউ তাকে ফেরাতে পারবে না। আর এটি হচ্ছে আল্লাহর ইনসাফ।

আল্লাহ সুবহানাহু বলেন:

وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيرًا

‘আর যে রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে তার জন্য হিদায়াত প্রকাশ পাওয়ার পর এবং মুমিনদের পথের বিপরীত পথ অনুসরণ করে, আমি তাকে ফেরাব যে দিকে সে ফিরে এবং তাকে প্রবেশ করাব জাহান্নামে। আর আবাস হিসাবে তা খুবই মন্দ।’ [সূরা নিসা :১১৫।]

২৮১
তাকদীরের প্রতি ঈমানের প্রতিফল:
তাকদীরের প্রতি ঈমান প্রতিটি মুসলিমের সুখ-সমৃদ্ধি, মানসিক প্রশান্তি ও নিশ্চিন্ততার মূল উৎস। সে জানে যে, প্রতিটি বিষয় সঙ্ঘটিত হয় আল্লাহর সিদ্ধান্তে। সুতরাং উদ্দেশ্য সাধন হলে উৎফুল্লে উদ্বেলিত হয়ে মনে দম্ভভাবের সৃষ্টি হয় না। আবার কাঙ্ক্ষিত বস্ত্ত হাতছাড়া হয়ে গেলে কিংবা অনাকিঙ্ক্ষত কিছু সঙ্ঘটিত হয়ে গেলে মনোকষ্টে অস্থির-উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে না। কারণ তার জানা থাকে যে, সবকিছুই আল্লাহর সিদ্ধান্তে হয়, যা হবার তা হবেই।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

مَا أَصَابَ مِنْ مُصِيبَةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي أَنْفُسِكُمْ إِلَّا فِي كِتَابٍ مِنْ قَبْلِ أَنْ نَبْرَأَهَا إِنَّ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ ﴿22﴾ لِكَيْ لَا تَأْسَوْا عَلَى مَا فَاتَكُمْ وَلَا تَفْرَحُوا بِمَا آَتَاكُمْ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ ﴿23﴾

‘যমীনে এবং তোমাদের নিজেদের মধ্যে এমন কোন মুসীবত আপতিত হয় না, যা আমি সংঘটিত করার পূর্বে কিতাবে লিপিবদ্ধ রাখি না। নিশ্চয় এটা আল্লাহর পক্ষে খুবই সহজ। যাতে তোমরা আফসোস না কর তার উপর যা তোমাদের থেকে হারিয়ে গেছে এবং তোমরা উৎফুল্ল না হও, তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তার কারণে। আর আল্লাহ কোন উদ্ধত ও অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না।’ [সূরা হাদীদ:২২-২৩।]

عَنْ صُهَيْبٍ رضي الله عنه قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَجَبًا لِأَمْرِ الْمُؤْمِنِ إِنَّ أَمْرَهُ كُلَّهُ خَيْرٌ وَلَيْسَ ذَاكَ لِأَحَدٍ إِلَّا لِلْمُؤْمِنِ إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ صَبَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ . أخرجه مسلم

‘সাহাবী সুহাইব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, মুমিনের প্রতিটি বিষয় বিস্ময়কর। তার প্রতিটি বিষয় কল্যাণকর। আর এটি শুধুমাত্র মুমিনের জন্য অন্য কারো জন্য নয়। যদি সুদিন আসে-সমৃদ্ধি অর্জন হয় তাহলে কৃতজ্ঞতা আদায় করে। এটি তার জন্য কল্যাণকর। আর যদি দুর্দিন আসে-দারিদ্রে আপতিত হয় তাহলে সবর করে, এটিও তার জন্য কল্যাণকর।’ [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং (২৯৯৯)।]

عَنْ سَعْدِ بْنِ أَبِي وَقَّاصٍ رضي الله عنه قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَجِبْتُ لِلْمُؤْمِنِ إِذَا أَصَابَهُ خَيْرٌ حَمِدَ اللَّهَ وَشَكَرَ وَإِنْ أَصَابَتْهُ مُصِيبَةٌ حَمِدَ اللَّهَ وَصَبَرَ فَالْمُؤْمِنُ يُؤْجَرُ فِي كُلِّ أَمْرِهِ حَتَّى يُؤْجَرَ فِي اللُّقْمَةِ يَرْفَعُهَا إِلَى فِي امْرَأَتِهِ . أخرجه أحمد وعبد الرزاق

‘সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাস রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমি মুমিনের ব্যাপারে অতিশয় আশ্চর্য্য বোধ করি-অবাক হই তার কর্মকান্ডে, যদি তার কোন কল্যাণ সাধিত হয় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। আর যদি কোন মুসীবত আপতিত হয় ধৈর্য্য ধারণ করে। সুতরাং মুমিন তার প্রতিটি কাজের বিনিময়েই পুরস্কার প্রাপ্ত হয়। এমনকি নিজ স্ত্রীর মুখে তুলে দেয়া লোকমার বিনিময়েও তাকে প্রতিদান দেয়া হয়।’ [হাদীসটি হাসান সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। বর্ণনায় আহমাদ, হাদীস নং (১৪৯২) উল্লোখিত ভাষ্য তাঁর। আরনাউত বলেন: এর সনদ হাসান। আরো বর্ণনা করেছেন, আব্দুর রাযযাক, হাদীস নং (২০৩১০)।]

এরই মাধ্যমে শেষ হল ঈমানের ছয় রুকন তথা আল্লাহর প্রতি ঈমান, ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান, কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান, রাসূলগণের প্রতি ঈমান, কিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান এবং তাকদীরের ভাল-মন্দের প্রতি ঈমান-এর বিস্তারিত বর্ণনা। প্রতিটি রুকনের প্রতি ঈমানের বিনিময়েই বান্দার বহুবিধ কল্যাণ ও উপকার সাধিত হয়।

২৮২
ঈমানের রুকনসমূহের প্রতিফল:
১- আল্লাহর প্রতি ঈমান, হৃদয়ে তাঁর ভালবাসা সৃষ্টি করে। তাঁর প্রতি ভক্তি, ও সম্মানবোধকে জাগ্রত করে। তাঁর কৃতজ্ঞতা, আনুগত্য, ইবাদত, তাঁকে ভয় করা ও তাঁর নির্দেশাবলি বাস্তবায়ন করতে উদ্বুদ্ধ করে।

২- ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান, অন্তরে তাদের প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি করে, লজ্জাবোধ জন্ম নেয় এবং তাদের কাছ থেকে অনুগত্যের শিক্ষা অর্জিত হয় ।

৩ - ৪- কিতাবসমূহ ও রাসূলগণের প্রতি ঈমানের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি ঈমানি দৃঢ়তা ও তাঁর ভালবাসা জন্ম নেয়। তাঁর বিধি-বিধান, পছন্দ-অপছন্দ, ও পরকালীন জীবনের অবস্থাদি সম্পর্কিত ধারণা অর্জিত হয়। এছাড়াও অন্তরে রাসূলগণের প্রতি ভালবাসা ও তাদের অনুসরণের স্পৃহা জাগ্রত হয়।

৫- কিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমানের মাধ্যমে নেককাজ ও ইবাদত-বন্দিগির প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পায় সাথে সাথে অন্যায় ও পাপকাজের প্রতি চরম ঘৃণা ও অনীহা সৃষ্টি হয়।

৬- তাকদিরের প্রতি ঈমানের মাধ্যমে মানসিক প্রশান্তি ও আত্মিক স্থিরতা সাধিত হয় এবং আল্লাহর সিদ্ধান্তের প্রতি সন্তুষ্ট থাকার মানসিকতা জন্ম নেয়।

একজন মুসলিমের জীবনে যখন উল্লেখিত গুণাগুণগুলো সন্বেবেশিত হবে তখন জান্নাতে প্রবেশের যোগ্য বলে বিবেচিত হবে। আর এটি আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের আনুগত্য-অনুসরণ ব্যতীত পরিপূর্ণ হবে না। যেমন আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ ﴿13﴾

আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে আল্লাহ তাকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতসমূহে, যার তলদেশে প্রবাহিত রয়েছে নহরসমূহ। সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আর এটা মহা সফলতা। [সূরা নিসা: ১৩।]

বান্দার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা যা-ই করেন- যে সিদ্ধান্তই গ্রহণ করেন তাতেই বান্দার প্রভুত কল্যাণ রয়েছে, রয়েছে প্রজ্ঞাপূর্ণ তাৎপর্য। অনুগ্রহ ও কল্যাণজনক সিদ্ধান্তাদি তাঁর ভালবাসার প্রমাণ বহন করে। আর শাস্তি ও প্রতিশোধমূলক কর্মকান্ড প্রমাণ করে ক্রোধ ও ক্ষোভের। তিনি বান্দাকে সম্মানিত ও মর্যাদাদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন এটি তাঁর মহববতের পরিচায়ক আর অপমান ও অপদস্ত করার যে সিদ্ধান্ত নেন সেটি তাঁর ক্রোধ ও ঘৃণার প্রমাণবাহী। আর সৃষ্টিজীবকে কখনো পরিপূর্ণরূপে দান করেন আবার কখনো হ্রাস করেন। এটি কিয়ামত সঙ্ঘটিত হবার প্রমাণ বহন করে। আল-ইহসান:১১

ইহসান হচ্ছে,

أن تعبد الله كأنك تراه، فإن لم تكن تراه فإنه يراك

অর্থাৎ,আল্লাহর ইবাদত তোমাকে এমনভাবে সম্পন্ন করা যেন তুমি তাঁকে দেখছ। আর তুমি যদি তাঁকে নাও দেখ, নিশ্চই তিনি তোমাকে দেখছেন।

১- আল্লাহ তাআলা বলেন,

إِنَّ اللَّهَ مَعَ الَّذِينَ اتَّقَوْا وَالَّذِينَ هُمْ مُحْسِنُونَ

নিশ্চয় আল্লাহ তাদের সাথে, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং যারা সৎকর্মশীল। [সূরা আন-নাহল: ১২৮।]

২- অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে,

وَتَوَكَّلْ عَلَى الْعَزِيزِ الرَّحِيمِ ﴿217﴾ الَّذِي يَرَاكَ حِينَ تَقُومُ ﴿218﴾ وَتَقَلُّبَكَ فِي السَّاجِدِينَ ﴿219﴾ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ ﴿220﴾

আর তুমি মহাপরাক্রমশালী পরম দয়ালুর উপর তাওয়াক্কুল কর, যিনি তোমাকে দেখেন যখন তুমি দন্ডায়মান হও, এবং সেজদাকারীদের মধ্যে তোমার উঠাবসা, নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, মহাজ্ঞানী। [সূরা আশ- শুআরা: ২১৭-২২০।]

৩-আরও ইরশাদ হচ্ছে,

وَمَا تَكُونُ فِي شَأْنٍ وَمَا تَتْلُو مِنْهُ مِنْ قُرْآَنٍ وَلَا تَعْمَلُونَ مِنْ عَمَلٍ إِلَّا كُنَّا عَلَيْكُمْ شُهُودًا إِذْ تُفِيضُونَ فِيهِ وَمَا يَعْزُبُ عَنْ رَبِّكَ مِنْ مِثْقَالِ ذَرَّةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ وَلَا أَصْغَرَ مِنْ ذَلِكَ وَلَا أَكْبَرَ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُبِينٍ ﴿61﴾

আর তুমি যে অবস্থাতেই থাক না কেন আর যা কিছু তিলাওয়াত কর না কেন আল্লাহর পক্ষ হতে কুরআন থেকে এবং তোমরা যে আমলই কর না কেন, আমি তোমাদের উপর সাক্ষী থাকি, যখন তোমরা তাতে নিমগ্ন হও। তোমার রব থেকে গোপন থাকে না যমীনের বা আসমানের অণু পরিমাণ কিছুই এবং তা থেকে ছোট বা বড়, তবে (এর সব কিছুই) রয়েছে সুস্পষ্ট কিতাবে। [সূরা ইউনুস: ৬১।]

২৮৩
ইসলাম ধর্মের স্তরসমূহ
ইসলাম ধর্মের তিনটি স্তর রয়েছে, এর কোন কোনটি অপরটির চেয়ে উচ্চতর। সেগুলো হচ্ছে, ইসলাম, ঈমান ও ইহসান; আর এটি সবগুলোর মধ্যে উচ্চতর। প্রতিটি স্তরের আবার কিছু রুকন রয়েছে।

عن عمر بن الخطاب رضي الله عنه قال : بَيْنَما نَحْنُ عِنْدَ رَسُولِ الله٬ صلى الله عليه وسلم ذَاتَ يَومٍ، إذْ طَلَعَ عَلَينَا رَجُلٌ شَدِيدُ بِيَاضِ الثِّيَابِ، شَدِيدُ سَوَادِ الشَّعَرِ، لا يُرَى عَلَيهِ أَثَرُ السَّفَرِ، وَلا يَـعْرِفُهُ مِنَّا أَحَدٌ، حَتَّى جَلَسَ إلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم، فَأَسْنَدَ رُكْبَتَيْـهِ إلَى رُكْبَتَيْـهِ، وَوَضَعَ كَفَّيْـهِ عَلَى فَخِذَيْـهِ، وَقَالَ : يَا مُـحَـمَّدُ أَخْبِرْنِي عَنِ الإسْلامِ؟

فَقَالَ رَسُولُ الله٬ صلى الله عليه وسلم : «الإسْلامُ أَنْ تَشْهَدَ أَنْ لا إلَـهَ إلَّا اللهُ وَأَنَّ مُـحَـمَّداً رَسُولُ الله صلى الله عليه وسلم، وَتُقِيمَ الصَّلاةَ، وَتُؤْتِي الزَّكَاةَ، وَتَصُومَ رَمَضَانَ، وَتَـحُجَّ البَيْتَ إنِ اسْتَطَعْتَ إلَيهِ سَبيلاً» . قَالَ : صَدَقْتَ، قَالَ فَعَجِبْنَا لَـهُ يَسْأَلُـهُ وَيُصَدِّقُهُ، قَالَ : فَأَخْبِرْنِي عَنِ الإيمانِ؟

قَالَ : «أَنْ تُؤْمِنَ بِالله، وَمَلائِكَتِـهِ، وَكُتُبِـهِ، وَرُسُلِـهِ، وَاليَومِ الآخِرِ، وَتُؤْمِنَ بِالقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ» قَالَ : صَدَقْتَ قَالَ : فَأَخْبِرْنِي عَنِ الإحْسَانِ؟

قَالَ : «أَنْ تَعْبُدَ اللهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ، فَإنْ لَـمْ تَـكُنْ تَرَاهُ فَإنَّهُ يَرَاكَ» قَال : فَأَخْبِرْنِي عَنِ السَّاعَةِ؟

قَالَ : «مَا المَسْؤُولُ عَنْـهَا بَأَعْلَـمَ مِنَ السَّائِلِ» قَالَ : فَأَخْبِرْنِي عَنْ أَمَارَتِـهَا؟ قَالَ : «أَنْ تَلِدَ الأَمَةُ رَبَّتَـهَا، وَأَنْ تَرَى الحفَاةَ العُرَاةَ العَالَةَ رِعَاءَ الشَّاءِ يَتَطَاوَلُونَ فِي البُنْيَانِ» قَالَ : ثُمَّ انْطَلَقَ، فَلَبِثْتُ مَلِيّاً ثُمَّ قَالَ لِي : «يَا عُمَرُ أَتَدْرِي مَنِ السَّائِلُ؟» قُلْتُ : اللهُ وَرَسُولُـهُ أَعْلَـمُ، قَالَ : «فَإنَّهُ جِبْرِيلُ أَتَاكُمْ يُـعَلِّمُكُمْ دِيْنَكُمْ» . أخرجه مسلم .

উমর বিন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একদা আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বসা ছিলাম, হঠাৎ আমাদের মাঝে উদিত হল এমন এক লোক যার পোষাকের শুভ্রতা ও চুলের কৃষ্ণতা ছিল সুতীব্র। তার মাঝে সফরের কোন নিদর্শন পরিলক্ষিত হচ্ছিল না এবং আমাদের কেউ তাকে চিনতেও পারছিল না। একপর্যায়ে নবীজীর নিকট এসে বসল, তাঁর হাটুদ্বয়ের সাথে নিজ হাটুদ্বয় মিলিয়ে বসল এবং হস্তদ্বয় তাঁর উরুর উপর রাখল এরপর বলল, হে মুহাম্মাদ, আমাকে ইসলাম সম্পর্কে বলুন?

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ইসলাম হচ্ছে, তোমার সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্য ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল, সালাত কায়েম করা, যাকাত আদায় করা, রমযানের সিয়াম পালন করা আর সামর্থ থাকলে হজ করা। সে বলল, আপনি সত্য বলেছেন, এতে আমরা বিস্মিত হলাম (কারণ) সে জানতে চেয়ে প্রশ্ন করছে আবার সত্যায়নও করছে। এরপর বলল, এখন আমাকে ঈমান সম্পর্কে বলুন?

নবীজী বললেন, (ঈমান হচ্ছে) তোমাকে আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাগণের প্রতি, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি, তাঁর রাসূলগণের প্রতি, কিয়ামত দিবসের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা, আরো বিশ্বাস স্থাপন করা তাকদীরের ভাল-মন্দের প্রতি। সে বলল, আপনি ঠিক বলেছেন। এখন আমাকে ইহসান সম্পর্কে বলুন?

নবীজী বললেন, আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে সম্পন্ন করবে, যেন তুমি তাঁকে দেখছ। আর তুমি যদি তাঁকে নাও দেখ, নিশ্চই তিনি তোমাকে দেখছেন। সে বলল, এবার কিয়ামত সম্পর্কে বলুন?

রাসূলুল্লাহ বললেন, এ সম্পর্কে জিজ্ঞেসিত ব্যক্তি জিজ্ঞেসকারীর চেয়ে অধিক জ্ঞানবান নয়। সে বলল, তাহলে কিয়ামতের নিদর্শন সম্পর্কে বলুন,

রাসূলুল্লাহ বললেন, বাঁদী স্বীয় মনিবকে জন্ম দেয়া, নগ্নপদ, বিবস্ত্র বকরীর রাখালদের দেখতে পাবে গর্বভরে উঁচু উঁচু অট্টালিকায় বসবাস করছে। বর্ণনাকারী বলেন, অতপর সে চলে গেল, আমি বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করলাম। এরপর নবীজী আমাকে বললেন, হে উমর, তুমি কি জান, প্রশ্নকারী কে? আমি বললাম আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভাল জানেন। নবীজী বললেন। তিনি জিবরাঈল, তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন শেখানোর জন্য এসেছিলেন। [বর্ণনায় সহীহ মুসলিম, হাদীন নং (৮)।]

২৮৪
ইহসানের দু’টো স্তর রয়েছে:
প্রথম স্তর, মানুষকে নিজ রবের ইবাদত এমনভাবে করা যেন সে তাঁকে

দেখছে। (তার ইবাদতটি হবে) কামনা, প্রার্থনা, অনুরাগ, উৎসাহ ও আগ্রহের ইবাদত। সে ইবাদতের মাধ্যমে স্বীয় প্রেমাষ্পদ আল্লাহ তাআলাকে কামনা করবে। তাঁকে লাভ করতে চাইবে, তাঁর ইবাদত করবে এমনভাবে যেন তাঁকে দেখছে। আর এটি স্তরদ্বয়ের মাঝে উচ্চতর স্তর। ‘‘ أن تعبد الله كأنك تراه ’’ ‘‘ তুমি আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে করবে যেন তুমি তাঁকে দেখছ’’

দ্বিতীয় স্তর, যদি এমন (ভাবের উদয়) না হয় যে, তুমি তাঁকে দেখে দেখে

ইবাদত ও কামনা করছ। তাহলে এমনভাবে কর যেন তিনি তোমাকে দেখছেন। তাঁকে ভয়কারীর ইবাদত (সদৃশ ইবাদত), তাঁর আযাব ও শাস্তি থেকে বাঁচার ইবাদত। তাঁর তরে হীন-অপদস্ত হওয়ার ইবাদত। ‘‘ فإن لم تكم تراه فإنه يراك،، ‘‘অর্থাৎ তুমি যদি তাঁকে নাও দেখ তিনিতো তোমাকে দেখছেন।’’

২৮৫
আল্লাহর ইবাদত দু’টো বিষয়ের উপর ভিত্তিশীল,
(এক) আল্লাহকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ভালবাসা।

(দুই) তাঁকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের সম্মান করা ও তাঁর সামনে নিজেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের হীন করা।

ভালবাসা আগ্রহ ও কামনার জন্ম দেয় আর সম্মান ও হীনতা সৃষ্টি করে ভীতি। এটিই হচ্ছে আল্লাহর ইবাদতে ইহসানের প্রকৃত রূপ। আর আল্লাহ ইহসানকারীদে ভালবাসেন।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

وَمَنْ أَحْسَنُ دِينًا مِمَّنْ أَسْلَمَ وَجْهَهُ لِلَّهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ وَاتَّبَعَ مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا ﴿125﴾ ( النساء :125)

আর দ্বীনের ব্যাপারে তার তুলনায় কে উত্তম, যে সৎকর্মপরায়ণ অবস্থায় আল্লাহর কাছে নিজকে পূর্ণ সমর্পণ করল এবং একনিষ্ঠভাবে ইবরাহীমের আদর্শ অনুসরণ করল। [সূরা নিসা:১২৫।]

وَمَنْ يُسْلِمْ وَجْهَهُ إِلَى اللَّهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى وَإِلَى اللَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِ

আর যে ব্যক্তি একনিষ্ঠ ও বিশুদ্ধচিত্তে আল্লাহর কাছে নিজকে সমর্পণ করে, সে তো শক্ত রশি আঁকড়ে ধরে। আর সকল বিষয়ের পরিণাম আল্লাহরই কাছে। [সূরা লুকমান: ২২।]

بَلَى مَنْ أَسْلَمَ وَجْهَهُ لِلَّهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ فَلَهُ أَجْرُهُ عِنْدَ رَبِّهِ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ

হ্যাঁ, যে নিজকে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করেছে এবং সে সৎকর্মশীলও, তবে তার জন্য রয়েছে তার রবের নিকট প্রতিদান। আর তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না। [সূরা বাকারা:১১২।]

২৮৬
লাভজনক ব্যবসা:
পবিত্র কুরআনে দু’টো ব্যবসার কথা বলা হয়েছে; মুমিনদের ব্যবসা আর মুনাফিকদের ব্যবসা।

মুমিনদের ব্যবসা অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা। এটি দুনিয়া ও আখিরাত, উভয় জগতের সফলতা নিশ্চিত করে। আর এ ব্যবসার নাম হচ্ছে দ্বীন। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَى تِجَارَةٍ تُنْجِيكُمْ مِنْ عَذَابٍ أَلِيمٍ ﴿10﴾ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَتُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ ﴿11﴾ ( الصف :10-11)

হে ঈমানদারগণ, আমি কি তোমাদেরকে এমন এক ব্যবসায়ের সন্ধান দেব, যা তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক আযাব থেকে রক্ষা করবে? তোমরা আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনবে এবং তোমরা তোমাদের ধন-সম্পদ ও জীবন দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করবে। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা জানতে। [সূরা আস-সফ:১০-১১।]

আর মুনাফিকদের ব্যবসা ব্যর্থ ও লোকসানগ্রস্ত ব্যবসা। ইহকাল ও পরকাল, উভয় জগতে ক্ষতি ও দুর্ভোগের কারণ।

وَإِذَا لَقُوا الَّذِينَ آَمَنُوا قَالُوا آَمَنَّا وَإِذَا خَلَوْا إِلَى شَيَاطِينِهِمْ قَالُوا إِنَّا مَعَكُمْ إِنَّمَا نَحْنُ مُسْتَهْزِئُونَ ﴿14﴾ اللَّهُ يَسْتَهْزِئُ بِهِمْ وَيَمُدُّهُمْ فِي طُغْيَانِهِمْ يَعْمَهُونَ ﴿15﴾ أُولَئِكَ الَّذِينَ اشْتَرَوُا الضَّلَالَةَ بِالْهُدَى فَمَا رَبِحَتْ تِجَارَتُهُمْ وَمَا كَانُوا مُهْتَدِينَ ﴿16﴾ ( البقرة : 14-16)

আর যখন তারা মুমিনদের সাথে মিলিত হয়, তখন বলে ‘আমরা ঈমান এনেছি’ এবং যখন গোপনে তাদের শয়তানদের সাথে একান্তে মিলিত হয়, তখন বলে, ‘নিশ্চয় আমরা তোমাদের সাথে আছি। আমরা তো কেবল উপহাসকারী’। আল্লাহ তাদের প্রতি উপহাস করেন এবং তাদেরকে তাদের অবাধ্যতায় বিভ্রান্ত হয়ে ঘোরার অবকাশ দেন। এরাই তারা, যারা হিদায়াতের বিনিময়ে পথভ্রষ্টতা ক্রয় করেছে। কিন্তু তাদের ব্যবসা লাভজনক হয়নি এবং তারা হিদায়াতপ্রাপ্ত ছিল না। [সূরা আল-বাকারা: ১৪-১৬।]

সমাপ্ত

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন