HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

ইসলামের ইতিহাস ১ম খণ্ড

লেখকঃ মাওলানা আকবর শাহ খান নজিববাদী

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
ইসলামের ইতিহাস

প্রথম খণ্ড

মাওলানা আকবর শাহ খান নজিববাদী

অনুবাদক মণ্ডলীমাওলানা আবদুল মতীন জালালাবাদীমাওলানা মুহাম্মদ আবদুল্লাহ্ বিন সাঈদ জালালাবাদীমাওলানা মুহাম্মদ হাসান রহমতী

অনুবাদ ও সংকলন বিভাগ

ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ

প্রকাশকের কথা
কুরআন, হাদীস, তাফসীর, ফিকহ, আকায়িদ প্রভৃতি ধর্মীয় গ্রন্থের অনুবাদের সাথে সাথে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ইবনে ইসহাক, ইবনে হিশাম এবং আল্লামা ইবনে কাছীরের মত জগদ্বিখ্যাত ঐতিহাসিকদের বিরচিত ইসলামের ইতিহাস বিষয়ে প্রামাণ্য এবং নির্ভরযোগ্য বহু গ্রন্থের অনুবাদ প্রকাশ করেছে। এরই ধারাক্রমে এবার প্রকাশ করা হলো বিখ্যাত ঐতিহাসিক এবং সাহিত্যিক মাওলানা আকবর শাহ খান নজিববাদী প্রণীত ‘তারীখে ইসলাম’ গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ ইসলামের ইতিহাস প্রথম খণ্ড।

ইতিহাস হলো জাতির দর্পণস্বরূপ। এর মাধ্যমে মানুষ জানতে পারে বিগত দিনের সাফল্য ও ব্যর্থতার ইতিকথা। আর জানতে পারে এর কারণসমূহ। তাই মানুষ ইতিহাস পাঠে সাবধানী হয়, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়, সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সচেষ্ট, উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত হয়। ইতিহাসকে জাতির বিবেক বলা চলে। এটা একটা জাতির দিক-দর্শন যন্ত্রের মতও কাজ করে।

ঐতিহাসিক মাওলানা আকবর শাহ খান নজিববাদী তাঁর গ্রন্থের প্রথমদিকে ইতিহাসের সংজ্ঞা, ইতিহাস পাঠেরপ্রয়োজনীয়তা, ইসলামের ইতিহাস ও সাধারণ ইতিহাস সংক্রান্ত পর্যালোচনা করেছেন। এরপর আরবদেশ, আরবদেশের অবস্থান, প্রকৃতি ও এর অধিবাসী সম্পর্কিত আলোচনা করা হয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জন্ম হতে ওফাত পর্যন্ত যাবতীয় ঘটনা সবিস্তারে বিধৃত হয়েছে। গ্রন্থখানির পরিসমাপ্তি ঘটেছে খুলাফায়ে রাশেদার আমলে ইসলাম প্রচার, দেশ বিজয় ও রাজ্য শাসন ইত্যাদি বিষয়ের নিখুঁত, নির্ভুল ও হৃদয়গ্রাহী উপস্থাপনার মাধ্যমে। যার ফলে গ্রন্থখানি প্রাণবন্ত, অনবদ্য ও অনিন্দ্যরূপ পরিগ্রহ করেছে। এ ধরনের একখানি মূল্যবান গ্রন্থের অনুবাদ প্রকাশ করতে পেরে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করছি।

পুস্তকটির প্রথম সংস্করণ নিঃশেষিত হওয়ার পর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশকালে বিজ্ঞ গ্রন্থকার ঐতিহাসিক মাওলানা আকবর শাহ খান নজিববাদী, অনুবাদক জনাব মাওলানা আবদুল মতিন জালালাবাদী, মাওলানা আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী এবং মাওলানা হাসান রহমতীকে জানাই আন্তরিক মুবারকবাদ। মুবারকবাদ জানাই দ্বিতীয় সংস্করণে সম্পাদনাকারী মাওলানা আবূ সাঈদ মুহাম্মদ ওমর আলীকে, যিনি প্রথম সংস্করণে মুদ্রিত অনেক ভুলভ্রান্তি সংশোধন করে দিয়েছেন। প্রুফ দেখার মত শ্রমসাধ্য কাজটি আনজাম দেয়ার জন্য ধন্যবাদ জানাই জনাব মোহাম্মদ মোকসেদকে। গ্রন্থখানি প্রকাশনার সাথে সম্পৃক্ত অন্যান্য সকলকেও জানাই মুবারকবাদ।

গ্রন্থখানি নির্ভুলভাবে প্রকাশ করার প্রচেষ্টায় কিংবা আন্তরিকতায় কোন ইচ্ছাকৃত ক্রটি করা হয়নি। তবু সুধীজনের নজরে কোন প্রমাদ পরিলক্ষিত হলে তা অনুগ্রহ করে আমাদের অবহিত করলে পরবর্তী সংস্করণে সংশোধন করার ব্যবস্থা করা হবে ইন্‌শাআল্লাহ।

মুহাম্মদ শামসুল হকপরিচালক, অনুবাদ ও সংকলন বিভাগইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ

পূর্বকথা
الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ . الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ . مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ . إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ . اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ . صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ . اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ اللَّهُمَّ بَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ . اَمَّا بَعَدُ . رَبِّ اشْرَحْ لِي صَدْرِي وَيَسِّرْ لِي أَمْرِي وَاحْلُلْ عُقْدَةً مِنْ لِسَانِي يَفْقَهُوا قَوْلِي .

লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্
বিশ্ব ইতিহাসের প্রতি নযর বুলালে প্রতীয়মান হয় যে, পৃথিবীর দেশে দেশে যুগে যুগে যত আম্বিয়ায়ে কিরাম, সংস্কারক ও ধর্ম প্রবর্তক এসেছেন তাঁদের সবাই এক মহান সত্তার (স্রষ্টার) অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিলেন এবং সকলেই তাদের অনুসারীদেরকে আল্লাহ্ তা‘আলার অস্তিত্বে বিশ্বাসী করে তোলার প্রয়াস পেয়েছেন। হযরত আদম (আ), হযরত নূহ (আ), হযরত ইবরাহীম (আ), হযরত মূসা (আ) ও হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সময়কালের মধ্যে শত শত হাজার হাজার বছরের ব্যবধান বা দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও তারা সবাই এক আল্লাহর একত্ব তথা তাওহীদের মূলনীতি শিক্ষা দিয়েছেন।

কৃষ্ণজী, রামচন্দ্রজী, গৌতম বুদ্ধ ও গুরু নানক ভারতবর্ষে, কায়কোবাদ ও জরথুস্ত্র ইরানে, কনফুসিয়াস চীনে, হযরত লুকমান গ্রীসে, হযরত ইউসুফ (আ) মিসরে, হযরত লূত (আ) সিরিয়া ও ফিলিস্তীনে ছিলেন, কিন্তু তাদের সকলের শিক্ষায়ই আল্লাহ্ তা‘আলার একত্বের শিক্ষা অভিন্নভাবে বিদ্যমান।

নারী-পুরুষ, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা নির্বিশেষে ইয়াহূদী-খ্রিস্টান প্রভৃতি পৃথিবীর প্রায় সকলেই আল্লাহ তা‘আলার অস্তিত্বে বিশ্বাসী। স্বল্পসংখ্যক লোক এমন যারা কোন দিকেই গণ্য নয়। এমন কিছু লোকও থাকতে পারে, যারা বাহ্যত আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকার করলেও তাদের অন্তর আল্লাহ্‌র অস্তিত্বের স্বীকৃতি দিতে বাধ্য। শেষ পর্যন্ত তাদেরকেও স্বীকার করতে হয় যে, এই কার্যকারণের পেছনেও একজন কুশলীর ইচ্ছা ও পরিকল্পনা সক্রিয় রয়েছে। সেই কুশলী ইচ্ছাময়ের নামই হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলা।

কবির ভাষায় :

به لوح گر هزار ان نقش پید است

نیاید بے قلمزن يك الفت راست

পৃথিবীর এ বিপুল ঐকমত্যকে অস্বীকার করা এবং বিশ্বের তাবৎ জ্ঞানীগুণী দার্শনিকদের সর্ববাদীসম্মত আকীদা-বিশ্বাসকে ভুল প্রতিপন্ন করা পাগল ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভবপর নয়।

হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম
সুবিশাল বায়যান্টাইন সাম্রাজ্য শতধা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তার অর্ধপাশবিক আইন-কানুনও বিকৃত হয়ে তার নিপীড়ন ও ক্রটিসমূহকে বর্ধিত এবং পূর্ব থেকেই যাতে গুণের পরিমাণ ছিল খুবই অল্প তা দিন দিন অবলুপ্ত করে ফেলেছিল। ইরানের শাহানশাহী জুলুম ও বিবাদের গুদামে পরিণত হয়েছিলো। চীন ও তুর্কিস্তান হয়ে উঠেছিল রক্তপাতের এক-একটি নিরাপদ ঘাঁটি। ভারতবর্ষে মহারাজা অশোক এবং রাজা কনিষ্ণের যুগের সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা অবলুপ্ত হয়ে পড়েছিল। মহারাজা বিক্রমাদিত্যের রাজত্বকালের কথা তখন কেউ চিন্তাও করতে পারতো না। বৌদ্ধ রাজত্বের কোন নমুনাও তখন বিদ্যমান ছিল না। বৈদিক ধর্মের কোন উল্লেখযোগ্য নিদর্শনও তখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তথাগত বুদ্ধের নাম যারা ভক্তি গদগদ কণ্ঠে উচ্চারণ করতো, তাদের অবস্থাও এতই শোচনীয় ছিল যে, রাজত্বের মোহ, ভোগস্পৃহা ও বিশ্বাসগত দুর্বলতার দরুন যে কোন লজ্জাকর কাজ করতেও তারা দ্বিধাবোধ করতো না। শ্রীকৃষ্ণের নাম জপকারীদের অবস্থা ছিল এই যে, আশরাফুল মাখলুকাত মানুষকে বৃক্ষলতা ও জড় পদার্থের সম্মুখে অবনত মস্তকে প্রণিপাত করতে তারা একটুও দ্বিধাবোধ করতো না। ইউরোপ ছিল এক ব্যাঘ্র-সঙ্কুল বিভীষিকাময় প্রান্তর আর তার অধিবাসীরা ছিল রক্তলোলুপ ব্যাঘ্রের চাইতেও ভয়ঙ্কর জীব। আরব ছিল সমস্ত নৈতিকতা বিগর্হিত ও শান্তি বিনষ্টকারী কার্যকলাপের অভয়ারণ্য। সেখানকার অধিবাসীরা জীব-জন্তুরও অধম জীবন-যাপন করতো। মোটকথা, পৃথিবীর কোন দেশে কোন ভূখণ্ডে মানুষ মানবীয় মহত্ত্ব ও গুণাবলীসহ বিদ্যমান ছিল না। জল-স্থল অন্তরীক্ষে এক শোকার্ত করুণ পরিবেশ বিরাজ করছিল। গোটা বিশ্ব যখন অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল তখন ভারতবাসীর কর্তব্য ছিল শ্রীকৃষ্ণ মহারাজের সেই বাণীটি স্মরণ করা, যাতে তিনি বলেছেন :

হে অর্জুন! যখন ধর্মের হানি হয় এবং অধর্ম বেড়ে যায়, তখন আমি পুণ্যবানদেরকে রক্ষা করি এবং পাপের বিনাশ সাধন করে ধর্মকে কায়েম রাখি।

ইরানবাসীদের কর্তব্য ছিল জরথুস্ত্রের বাণী অনুসারে কেবল পথ প্রদর্শকের অনুসন্ধান করা। ইয়াহূদীদের কর্তব্য ছিল ফারানের পর্বতশীর্ষ থেকে আলো বিকীরণের প্রতীক্ষা করা এবং খ্রিস্টানদের কর্তব্য ছিল হযরত ইবরাহীম (আ)-এর দু‘আ এবং মসীহ-এর সুসমাচারকে আশা-ভরসার স্থল বানানো। কিন্তু বিশ্বজোড়া ফিতনা-ফাসাদ ও যুগের অন্ধকার সর্বত্র বিবেকসমূহকে এমনি আচ্ছন্ন এবং চোখসমূহকে এমন অন্ধ করে রেখেছিল যে, কারো এতটুকু হুঁশও ছিল না। যে, নিজেদেরকে রুগ্ন জ্ঞান করবে এবং চিকিৎসার জন্য যত্নবান হবে।

এমনি যুগসন্ধিক্ষণে আরব দেশের মতো ভূখণ্ডে হাদীয়ে বরহক, রাসূলে রাব্বিল ‘আলামীন, খায়রুল বাশার, শাফীউল মুযনিবীন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম—শিরকেরভ্রষ্টতা, মূর্তিপূজার অন্ধকার, মারামারি, কাটাকাটি, হানাহানি, পাপাচারিতা ও অশ্লীলতার ক্লেদ থেকে মানুষকে মুক্ত করার জন্য ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’-এর বুলন্দ আওয়াজ তুলে, মানুষরূপী অমানুষগুলোকে প্রকৃত মানুষে ও চরিত্রবান মানুষে এবং চরিত্রবান মানুষকে আল্লাহওয়ালা মানুষে রূপান্তরিত করে দুনিয়ার যুগ-যুগান্তের জমাট অন্ধকাররাশিকে হিদায়াত, আলো, শান্তি ও পুণ্যে রূপান্তরিত করেন অর্থাৎ পথভ্রষ্ট মূর্তিপূজারী ও পাপাচারী লোকদেরকে মুসলমান বানাবার গুরুদায়িত্ব পালন করেন।

হযরত নূহ (আ) ইরাকের পথভ্রষ্ট মানুষকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার সাধনায় শত শত বছর তাবলীগ করার পর অবশেষে ( رَبِّ لَا تَذَرْ عَلَى الْأَرْضِ مِنَ الْكَافِرِينَ دَيَّارًا ) “প্রভু। এ পৃথিবীতে কাফিরদের একটি ঘরও আর অবশিষ্ট রেখো না” (৭১: ২৬) রূপী তরবারি প্রয়োগে সকলের কিসসা খতম করতে বাধ্য হন। হযরত মূসা (আ) মিসরবাসী এবং তাদের মদমত্ত বাদশাহদেরকে সুপথে আনার সম্ভাব্য সকল প্রচেষ্টাই চালান। কিন্তু অবশেষে মূসা (আ)-ও বনী ইসরাঈল সেই দৃশ্যও অবলোকন করলেন যার সম্পর্কে কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে :

وَأَغْرَقْنَا آلَ فِرْعَوْنَ وَأَنْتُمْ تَنْظُرُونَ .

আমি ফিরাউনের দলবলকে ডুবিয়ে মারলাম আর তোমরা তা প্রত্যক্ষ করছিলে। (২:৫০)

ভারতবর্ষে মহারাজা রামচন্দ্রজীকে লঙ্কায় অভিযান চালাতে হয় এবং রাক্ষসদের সাথে যুদ্ধ করতে হয়। শ্রীকৃষ্ণ মহারাজকে কুরুক্ষেত্রে সমরাঙ্গনে অর্জুনকে যুদ্ধে উৎসাহিত করে কুরুদের পাপাচারী দলকে পাণ্ডবদের হাতে ধ্বংস করতে হয়। ইরানে জরথুস্ত্রকে ইসফান্দিয়ারের বাহুবল ও রাজত্বকে ধর্ম প্রচারের মাধ্যমরূপে গ্রহণ করতে হয়।

কিন্তু প্রাচীন শিলালিপি ও প্রত্নতাত্ত্বিক যে সমস্ত বিবরণ পাওয়া যায় তাতে এ ব্যাপারে জ্ঞানীগুণীরা সকলেই ঐকমত্য পোষণ করেন যে, মহামতি ধর্ম প্রবর্তকগণ এবং সত্য সাধকদের জীবনে এ নযীর খুঁজে পাওয়া যায় না যে, মাত্র পঁচিশ বছরের স্বল্প সময়ে আরবের অজ্ঞ বেদুঈনদের মত একটি জাতি সমস্ত সভ্য দুনিয়ার শিক্ষক, সর্বাধিক সভ্য ও চরিত্রবান জাতিতে পরিণত হয়েছে। এক শতাব্দীরও কম সময়ের মধ্যে কেবল আশিটি বছরের মধ্যে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আনীত ধর্মের অনুসারীরা আটলান্টিক মহাসাগর পর্যন্ত অর্থাৎ চীনের পূর্ব উপকূল পর্যন্ত অন্য কথায় সমস্ত সভ্যজগত জয় করে নেয়। এ বিস্ময়কর ও অলৌকিক সাফল্যের কোন নযীর পৃথিবীতে নেই।

ইসলামের নীতিমালার সৌন্দর্য যদি সমস্ত ধর্মের নীতিমালার সৌন্দর্যের সমাহার হয় এবং এর শিক্ষাবলী যদি সকল ধর্মের শিক্ষাবলীর চাইতে উত্তমই হয়, তাহলে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের মানবশ্রেষ্ঠ, খাতিমুন নাবিয়্যীন এবং রাহমাতুল্লিল আলামীন তথা গোটা বিশ্বজগতের জন্য করুণা ও রহমত হওয়ার ব্যাপারে সংশয়ের কী থাকতে পারে? পৃথিবীর কেইবা সাহস করতে পারে যে, তারই আনীত কিতাব কুরআন মজীদের এ অনন্য বিশেষণ আরোপ এবং অনস্বীকার্য দাবী তথা আল্লাহর দাবীর প্রতিবাদ করবে, যাতে তিনি বলেছেন :

إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ .

নিশ্চয়ই আমি কুরআন নাযিল করেছি এবং নিশ্চয় আমিই এর সংরক্ষণ করবো। (১৫:৯)

বিভিন্ন জাতিকে উন্নতি ও প্রগতির পথে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিতে এবং তাদেরকে অধঃপতন ও অবনতি থেকে রক্ষা করতে ইতিহাস একটি অত্যন্ত কার্যকর ও মূল্যবান মাধ্যম। কোন জাতি যখন অধঃপতনের নিম্নতম স্তর থেকে উন্নতি ও অগ্রগতির পথে পা বাড়িয়েছে তখন ইতিহাসকেই সে তার প্রেরণার সবচেয়ে বড় উৎসরূপে পেয়েছে। কুরআনুল কারীম আমাদেরকে এও শিখিয়েছে যে, মানুষের সৌভাগ্য এবং দীন-দুনিয়ার সাফল্য অর্জন করতে হলে ইতিহাস পাঠ অপরিহার্য। তাই কালাম মজীদে আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে উপদেশ গ্রহণের জন্যে স্থানে স্থানে বিগত জাতিসমূহের অবস্থাদি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এভাবে যে অমুক জাতি নিজেদের অনিষ্টকর কার্যকলাপের জন্যে ধ্বংস হয়েছে এবং অমুক জাতি তাদের সৎ কর্মসমূহের বদৌলতে কেমন করে সৌভাগ্য ও সাফল্য অর্জন করেছে।

হযরত আদম (আ), হযরত নূহ (আ), হযরত ইবরাহীম (আ), হযরত মূসা (আ) প্রমুখ নবী-রাসূলের ঘটনাবলী, ফিরাউন, নমরূদ, ‘আদ, ছামূদ প্রভৃতির বর্ণনা কুরআনুল করীমে এ জন্যে উল্লিখিত হয়নি যে, আমরা এগুলো উপভোগ করবো বা আমাদের ঘুমপাড়ানীর কাজে এগুলো লাগবে, বরং এসব সত্য কাহিনী এজন্যে আমাদের সম্মুখে তুলে ধরা হয়েছে যেন আমাদের মধ্যে পুণ্য কাজের সাহস সঞ্চিত হয় এবং পাপাচার থেকে নিবৃত্ত থাকার প্রেরণা সৃষ্টি হয় এবং আমরা আমাদের নিজেদের অবস্থাকে উন্নত ভবিষ্যতের মাধ্যমরূপে গড়ে তুলতে পারি।

মানব জাতির সবচাইতে উপকারী, সর্বাধিক কল্যাণকামী এবং সৃষ্ট জীবসমূহের প্রতি সর্বাধিক সংবেদনশীল দরদী বন্ধু নবী-রাসূলগণ (আ) যখনই কোন জাতিকে ধ্বংস থেকে বাঁচানোর এবং তাদেরকে সম্মান ও সাফল্যের অধিকারী করার জন্যে যত্নবান হয়েছেন, তখনই তাঁরা তাঁদের জাতিসমূহকে অতীত ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির বড় বড় রাজনৈতিক নেতা ও সমাজ সংস্কারকদের মধ্যে এমন একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি অতীত ইতিহাস ও অতীত যুগের ঘটনাবলী দ্বারা অনুপ্রাণিত ও কর্মোদ্দীপ্ত হননি। এজন্যেই প্রত্যেক বাগ্মী বক্তাই তাদের বক্তৃতায় অবশ্য অবশ্যই অতীতের স্মৃতি মন্থন ও অতীত যুগের মহামানবদের ঘটনাবলী রূপী চাটনীর সংমিশ্রণ দিয়ে শ্রোতৃমণ্ডলীকে নিজেদের ইচ্ছেমত উদ্দীপ্ত করে থাকেন। অতীত যুগের খ্যাতনামা পুরুষদের মধ্যে যাদের সাথে আমাদের ধর্মীয়, জাতীয় বা দেশীয় মিল থাকার দরুন নিকট সম্পর্ক থাকে, তাদের ঘটনাবলী আমাদেরকে অধিকতর প্রভাবিত করে থাকে। রুস্তম, ইসফান্দিয়ার বা গশ্‌তাসিপও নওশেরওয়ার দ্বারা একজন পারস্যবাসীর অন্তরে যতটুকু ধর্মরোধ, বীরত্ব ও ন্যায়বোধ জাগিয়ে তোলে কোন চীনদেশীয় বা ভারতীয় ব্যক্তির মধ্যে তা ততটুকু করবে না। ভীম, অর্জুন, পৃথ্বীরাজ বা বিক্রমাদিত্যের ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হিন্দুদেরকে যতটুকু অনুপ্রাণিত করবে, একজন খ্রিস্টানকে তা ততটুকু অনুপ্রাণিত করবে না। এজন্যেই আজ যখন বিভিন্ন জাতির ইতিহাস ও তার প্রভাব সম্পর্কে জনমনে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে এবং এ সত্য দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, কোন জাতিকে জীবন্ত করে তুলতে বা জীবন্ত রাখতে সেই জাতির অতীত ইতিহাসই হচ্ছে সবচাইতে মোক্ষম অস্ত্র, তখন আমরা দিব্যচোখে দেখতে পাচ্ছি যে, যে সমস্ত জাতির তেমন কোন মহিমান্বিত ও গৌরবান্বিত ইতিহাস নেই, তারাও ইতিহাসের নামে কল্পকাহিনী রচনায় ব্যস্ত রয়েছে এবং সেসব স্বকপোলকল্পিত কাহিনীকে ইতিহাসের জামা পরিয়ে তাদের নতুন প্রজন্মকে উপহার দিচ্ছে যেন তারা এগুলোকে সত্য বলে বিশ্বাস করে। মিথ্যার এ বেসাতির আশ্রয় নিতে এ সব জাতি এজন্যে বাধ্য হচ্ছে যে, জাতিসমূহের প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার ময়দানে এরূপ একটা প্রতীতি সৃষ্টি ব্যতিরেকে তাদের লোকজনকে সক্রিয় ও কর্মোদ্দীপ্ত করে তোলার বিকল্প কোন ব্যবস্থা নেই। আর এ জন্যে যে জাতি অপর কোন জাতিকে তাদের শত্রু ও প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে তারা ঐ জাতির লোকজনকে তাদের গৌরবময় ইতিহাসকে বিস্মৃত বা বিকৃত করে তাদের গৌরবময় ইতিহাস সম্পর্কে তাদেরকে অজ্ঞ রাখার অপচেষ্টায় লিপ্ত থাকে।

মুসলমানদের গৌরবোজ্জ্বল কীর্তি
পৃথিবীর জাতিসমূহের মধ্যে মুসলমানই একমাত্র জাতি যার রয়েছে সর্বাধিক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস-ঐতিহ্য। জাতি তাদের মহৎ ব্যক্তিদের কীর্তিসমূহ সম্পর্কে এমনি নিশ্চিতভাবে জানতে পারে যা সকল প্রকার সংশয় ও সন্দেহ থেকে মুক্ত। মুসলমানদের হোমারের এলিয়ড অথবা হিন্দুদের রামায়ণ, মহাভারতের কল্পকাহিনীর প্রয়োজন নেই। কেননা এসব কল্পকাহিনীর চাইতে অনেক বেশী বিস্ময়কর ও গৌরবোজ্জ্বল কাহিনীর বাস্তব উদাহরণ তাদের ইতিহাসের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে, অথচ ঐ সব কল্পকাহিনীর মিথ্যাচারিতা ও অবিশ্বস্ততার ছোঁয়াও তাতে লাগেনি। মুসলমানদের ফেরদৌসীর শাহনামা অথবা স্পার্টাবাসীদের কল্পকাহিনীরও কোনই প্রয়োজন নেই। কেননা, তাদের ইতিহাসের পাতায় পাতায় রয়েছে রুস্তম ও স্পার্টার ছড়াছড়ি। মুসলমানদের ন্যায়পরায়ণ নওশেরওয়া বাদশাহ বা হাতেম তাঈর গল্পেরও কোনই প্রয়োজন নেই। কেননা, তাদের সত্য ইতিহাসের পাতায় পাতায় অসংখ্য হাতেম ও নওশেরওয়া বিদ্যমান। মুসলমানদের এরিস্টটল, বেকন, টলেমী বা নিউটনেরও কোনই প্রয়োজন নেই। কেননা, তাদের পূর্বপুরুষদের মজলিসে এমন সব দার্শনিক ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী বিদ্যমান রয়েছেন-যাঁদের পাদুকাবহনকেও উল্লিখিত যশস্বী লোকেরা গৌরবান্বিত বোধ করবেন।

কতই আক্ষেপ ও বিস্ময়ের ব্যাপার, আজ যখন বিশ্বের তাবৎ জাতি নিজেদেরকে বিশ্বদরবারে সমুন্নত করার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত, তখনও সর্বাধিক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস-ঐতিহ্যের অধিকারী মুসলমানগণ নিজেদের ইতিহাস সম্পর্কে উদাসীন ও নির্বিকার। মুসলমানদের যে শ্রেণীটাকে অনেকটা শিক্ষিত ও সচেতন মনে করা হয়, তারাও তাদের বক্তৃতা-বিবৃতি ও প্রবন্ধাদিতে কোন মহৎ ঘটনার উদাহরণ দিতে চান তখন মনের অজান্তেই তাদের মুখ ও কলম দিয়েও কোন ইউরোপীয়ান বা খ্রিস্টান মনীষীর নামই নির্দ্বিধায় বেরিয়ে আসে। এক্ষেত্রে তার চাইতেও হাজার গুণ উল্লেখযোগ্য কোন মুসলিম মনীষীর নাম তার জানা থাকে না। এ সত্যকে কে অস্বীকার করতে পারে যে, মুসলমানদের শিক্ষিত শ্রেণী বিশেষত নব্য শিক্ষিত শ্রেণীর মুসলমানদের বক্তৃতা-বিবৃতি বা রচনাদিতে নেপোলিয়ান, হ্যানিবল, শেক্সপিয়ার, বেকন, নিউটন প্রমুখ ইউরোপীয় মনীষীর নাম যত নিতে দেখি, খালিদ ইব্‌ন ওয়ালীদ, সালাহউদ্দীন আইয়ুবী, হাসসান ইব্‌ন ছাবিত, ফেরদৌসী, তূসী, ইব্‌ন রুশদ, বু-আলী, ইব্‌ন সীনা প্রমুখ মুসলিম মনীষীর নাম ততো নিতে দেখা যায় না। এর একটি মাত্র কারণ আর তা হচ্ছে বর্তমান যুগে মুসলমানরা তাদের নিজ ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ ও নির্বিকার। মুসলমানদের এই অজ্ঞতা ও উদাসীনতার কারণ হচ্ছে প্রথমত এমনিতেই অন্যান্য জাতির তুলনায় মুসলমানদের জ্ঞানস্পৃহা কম। দ্বিতীয়ত, জ্ঞানান্বেষণের সুযোগ ও অবকাশও তাদের নেই। তৃতীয়ত, সরকারী কলেজ ও মাদরাসাগুলো ইসলামী শিক্ষায়তনগুলোকে ভারতবর্ষে প্রায় অস্তিত্বহীন করে দিয়েছে। চতুর্থত মুসলমানদের যে শ্রেণীটিকে সাধারণত শিক্ষিত বলা হয়ে থাকে এবং মুসলমানদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় বলে গণ্য করা হয় তাদের প্রায় সকলেই শিক্ষায়তনসমূহে লেখাপড়া করে এসেছেন—যেগুলোতে ইসলামের ইতিহাস পাঠ্যভুক্ত নয়, আর তা পাঠ্যভুক্ত থাকলেও ইসলামের ইতিহাস পদবাচ্য নয়-অন্য কিছু, অথচ তাকে ইসলামের ইতিহাস বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। কলেজ থেকে ডিপ্লোমা হাসিল করার পর না জ্ঞানার্জনের বয়স বাকী থাকে আর না তার তেমন কোন অবকাশ বা সুযোগ থাকে। মোটকথা আমাদের শিক্ষিত মুসলমানদেরকে সেই ইসলামের ইতিহাসের উপরই নির্ভর করতে হয় যা ইসলামের প্রতিদ্বন্দ্বী ও শত্রুরা বিকৃত করে তাদের ইংরেজী পুস্তকাদিতে লিখেছে।

মুসলমানদের পূর্বে পৃথিবীর অন্য কোন জাতির এ সৌভাগ্য হয়নি যে, ইতিহাসকে একটা সঠিক ভিত্তির উপর রীতিমত একটা শাস্ত্ররূপে দাঁড় করাবে। তাদের কেউই তাদের পূর্বপুরুষদের সঠিক ইতিহাস রচনায় সমর্থ হননি। ইসলামের পূর্বে ইতিহাস রচনার মান যে কেমন ছিল বাইবেলের পৃষ্ঠাসমূহ বা রামায়ণ মহাভারতের কাহিনীগুলো পাঠই তা উপলব্ধি করার জন্যে যথেষ্ট। মুসলমানরা মহানবী (সাঃ)-এর হাদীস সংরক্ষণ ও বর্ণনায় যে কঠোর সতর্কতা ও নিয়মানুবর্তিতার স্বাক্ষর রেখেছেন পৃথিবীর ইতিহাসে তার কোন নযীর নেই। ‘উসূলে হাদীস’ ও ‘আসমাউর রিজালের’ মত শাস্ত্রগুলো কেবল হাদীসে নববীর হিফাযত ও খিদমতের উদ্দেশ্যে তারা উদ্ভাবন করেছেন। রিওয়ায়াত বা বর্ণনাসমূহের বাছ-বিচার ও যাচাই-বাছাইয়ের জন্য যে সুদৃঢ় নীতিমালা তারা উদ্ভাবন করছেন পৃথিবী তার সুদীর্ঘ আয়ুষ্কালে কোন দিন তা প্রত্যক্ষ করেনি।

মুসলমানদের ইতিহাস সংক্রান্ত সর্বপ্রথম কীর্তি হচ্ছে ইলম হাদীসের বিন্যাস ও সংকলন। ঠিক সেই নীতিমালার ভিত্তিতেই তারা তাদের খলীফাগণ, আমীর-উমরা ও সুলতানগণ, বিদ্বজ্জন ও মনীষিগণের জীবন-চরিত লিপিবদ্ধ করেছেন। এসবের সমাহার হচ্ছে ইসলামের ইতিহাস। মুসলমানদের ইতিহাস হয় না পৃথিবীর জন্যে এক অভাবিত, অভূতপূর্ব অথচ অপরিহার্য উপাদান। অন্যান্য জাতি যেখানে তাদের বাইবেল ও মহাভারত প্রভৃতিকেই তাদের গৌরবজনক ‘ঐতিহাসিক’ সম্পদ বলে বিবেচনা করতে অভ্যস্ত ছিল, তখন বিশ্বের মানুষ সবিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করল যে, মুসলমানরা খতীবের ‘তারীখ’ বা ইতিহাস গ্রন্থকে তাদের নির্ভরযোগ্য ইতিহাস গ্রন্থের আলমারী থেকে বের করে সরিয়ে রাখছে। আজ ইউরোপীয় ঐতিহাসিকদেরকে ইতিহাস শাস্ত্রের অনেক খুঁটিনাটি তত্ত্ব নিয়ে নাড়াচাড়া করতে দেখা যায়। মুসলমানরা তা দেখে অনেকটা হকচকিয়ে যান এবং পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে তাদের স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন। কিন্তু তাদের একথাটিও জানা নেই যে, উত্তর আফ্রিকায় বসবাসকারী জনৈক স্পেনীয় আরব বংশোদ্ভূত মুসলমান ঐতিহাসিক ইব্‌ন খালদূনের ইতিহাসের ভূমিকা ‘মুকাদ্দামায়ে তারীখ’-এর উচ্ছিষ্ট ভোগই গোটা ইউরোপ তথা গোটা বিশ্বকে ইতিহাস শাস্ত্র সম্পর্কে এমনি জ্ঞানদান করেছে যে, ইউরোপীয় ঐতিহাসিকদের সমস্ত ঐতিহাসিক গবেষণাকর্মকে ইব্‌ন খালদূনের মাজারের ঝাড়ুদারকে অর্ধ-স্বরূপ বিনীতভাবে পেশ করা চলে। কিন্তু মুসলিম ঐতিহাসিকদের ইতিহাসকর্ম যে কত উঁচুমানের ছিল তা এ থেকেই অনুমিত হয় যে, মুসলিম বিজ্ঞজনের মজলিসে ইবন খালদূনের অনন্যসাধারণ ‘মুকাদ্দামা’ বাদ দিলে তার আসল ইতিহাসের তেমন কোন মূল্য নির্বিবাদে স্বীকৃত হয়নি।

ইবন হিশাম, ইবনুল আছীর, তাবারী, মাসউদী প্রমুখ থেকে নিয়ে আহমদ ইব্‌ন খাওন্দশাহ এবং যিয়াউদ্দীন বারনী পর্যন্ত বরং মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা এবং মোল্লা বদায়ূনী পর্যন্ত হাজার হাজার মুসলিম ঐতিহাসিকের বিপুল গবেষণা কর্ম যে বিশালায়তন ভলিউমসমূহে সংরক্ষিত রয়েছে, এদের প্রত্যেকটি মুসলমানদের বিস্ময়কর অতীত ইতিহাসের এক একটি খণ্ডচিত্র এবং এদের প্রত্যেকের লিখিত ইসলামের ইতিহাস এমনি উল্লেখযোগ্য যে, মুসলমানরা তা অধ্যয়ন করে অনেক শিক্ষণীয় বিষয়ের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারে। কিন্তু অত্যন্ত আক্ষেপ ও পরিতাপের বিষয় যে, আজ শতকরা একজন মুসলমানও নিজেদের জাতীয় ইতিহাস জানার জন্যে ঐসব মনীষীর রচনাবলী পাঠের এবং তার মর্ম উপলব্ধি করার সামর্থ্য রাখে না। অথচ সেই তুলনায় মিল, কার্লাইল, ইলিয়ট, গিবন প্রমুখের লিখিত ইতিহাস পাঠ করার এবং তার মর্ম উপলব্ধি করার মত যোগ্য মুসলমানের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়।

ইসলামের ইতিহাসের গ্রন্থসমূহ যেহেতু আরবী ও ফার্সীতে রচিত আর ভারতবর্ষের শতকরা একজন মুসলমানও আরবী-ফার্সীতে ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন নয় বলে সেসব গ্রন্থ দ্বারা উপকৃত হতে পারে না। তাই মুসলমানদেরকে তাদের ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে হলে জনসাধারণের ভাষায় ইসলামের ইতিহাস লিখতে হবে। ইতিপূর্বে এ অভাবটির কথা অনেক পূর্বেই অনুভূত হয়েছে এবং অনেকে উর্দু ভাষায় ইসলামের ইতিহাস লিখেছেনও, কিন্তু আজ পর্যন্ত উর্দু ভাষায় এমন একখানি ব্যাপক অথচ সংক্ষিপ্ত পুস্তক এ বিষয়ে লিখিত হয়নি যাতে স্বল্প অবসরের অপেক্ষাকৃত স্বল্প আগ্রহী লোকেরাও ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য ও তত্ত্বাদি জেনে নিতে পারে।

যদি এ জাতীয় আরো দু’চারটি বই লিখিতও হতো তবুও ইসলামের ইতিহাস এমনি একটি প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যে, আরো লেখকদের তাতে নিজ নিজ যোগ্যতা ও প্রতিভা অনুসারে লেখার অবকাশ রয়েই যেতো। এখন আমি আমার দীনহীন প্রচেষ্টা নিয়োগ করে এ পুস্তকখানি পাঠক সমীপে উপস্থাপিত করছি। অধিকতর যোগ্যতাসম্পন্ন ও প্রশস্ত হৃদয় লোকদের জন্যে এ বিষয়ে যোগ্যতর রচনাকর্ম পেশের সুযোগ রইলো। আমার ধারণা, মাতৃভাষায় যত অধিক ইসলামের ইতিহাস রচিত হবে মুসলমানরা ততই এ দিকে আকৃষ্ট হবেন।

ইসলামের ইতিহাসের তাৎপর্য
ইসলামের ইতিহাস আসলে একটি স্বতন্ত্র ও স্বয়ংসম্পূর্ণ বিদ্যা বা বিজ্ঞান। এ বিষয়ে হাজার হাজার যোগ্য ঐতিহাসিকের রচিত রচনাবলী মওজুদ রয়েছে। সাধারণত মুসলিম ঐতিহাসিকগণ নিজেদের সমসাময়িক সুলতানগণ অথবা কোন একটি রাষ্ট্র, জাতি, রাজবংশ বা একজন সুলতানের অথবা কোন একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার ইতিহাস ভিন্ন ভিন্নভাবে রচনা করেছেন। কোন কোন ঐতিহাসিক কেবল উলামায়ে ইসলামের, কেউ মুসলিম দার্শনিকদের, আবার কেউ কেউ মুসলিম সূফী-দরবেশদের জীবনীগ্রন্থ রচনা করেছেন। মোদ্দাকথা, এ জাতীয় হাজার হাজার গ্রন্থ রচিত হয়েছে। এ বিশাল ভাণ্ডার নিয়েই গড়ে উঠেছে ইসলামের ইতিহাস তথা ইসলামের ইতিহাস বিজ্ঞান। যুগ পরিক্রমার সাথে সাথে এ ভাণ্ডার স্ফীত থেকে স্ফীততর হয়ে চলেছে। ইসলামী সালতানাত ও ইসলামী রাষ্ট্রের সংখ্যাও এতই অধিক যে, যদি এক-একটি ইসলামী সালতানাতের ইতিহাস স্বতন্ত্র সংক্ষিপ্ত সংকলনাকারে রচিত হয় তবে সে নির্বাচিত সংকলনগুলোর জন্যেও দু’চারটি আলমারী নয়। পাঠাগারের বেশ কয়েকটি কক্ষেরই প্রয়োজন হবে। একটি মধ্যম অবয়বের ইসলামের ইতিহাস রচনার অর্থ হচ্ছে ঐ সবের সারমর্ম অতি সংক্ষিপ্তাকারে উপস্থাপন করা। কোন বড় দৃশ্যের ফটো একই কাঠে উঠিয়ে নেয়া অথবা একটা বিরাট প্রাসাদের চিত্র কোন তসবীহ দানার ছিদ্রে পুরে দেয়া একটি অপেক্ষাকৃত সহজ কাজ, কিন্তু একটি দু‘ হাজার পৃষ্ঠায় বইয়ে গোটা ইসলামের ইতিহাস পুরে দেয়া নিঃসন্দেহে একটি সুকঠিন কাজ। এজন্যে আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না যে, এ কাজে আমি কতটুকু সফল হয়েছি। একমাত্র পাঠকগণ এ ব্যাপারে ফয়সালা করতে পারবেন যে আমার এ পুস্তকটির মান কি এবং মুসলমানদের জন্যে কতটুকু উপাদেয় হয়েছে।

ঘটনাবলীর ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে আমি সংশ্লিষ্ট ঘটনার এবং সমসাময়িক যুগের সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিকদের লিখিত গ্রন্থাদি পাঠ করে সে ঘটনা সম্পর্কে একটি ধারণায় উপনীত হতে চেষ্টা করেছি। আমার সেই বদ্ধমূল ধারণাকেই পরে নিজ ভাষায় যথাসম্ভব সংক্ষেপে উপস্থাপিত করেছি। যে ব্যাপারে ঐতিহাসিকগণের মতবিরোধ রয়েছে এবং কোন একজনের মতকে প্রাধান্য দেয়া সুকঠিন মনে হয়েছে সেখানে প্রত্যেক ঐতিহাসিকের বক্তব্য হুবহু অনুবাদ করে দিয়ে তার বরাত উদ্ধৃত করেছি এবং এ ব্যাপারে নিজের সিদ্ধান্তও নির্দ্বিধায় উল্লেখ করেছি এবং এ ঘটনার ফল কী দাঁড়িয়েছে তাও ব্যক্ত করেছি। যেহেতু বইটি উর্দু ভাষায় রচিত, তাই উর্দুভাষী হিন্দুস্থানী মুসলমানরাই এ দ্বারা সাময়িক উপকৃত হবেন। এজন্যে আমি ঐসব ইসলামী রাষ্ট্র এবং মুসলিম শাসকদের ব্যাপারে একটু আলোচনা করেছি যাদের সাথে ভারত এবং ভারতীয় মুসলমানদের অধিকতর সম্বন্ধ রয়েছে অথবা যাদের সম্পর্কে ভারতবাসী অধিকতর জ্ঞাত। এতদসত্ত্বেও যেসব ইসলামী রাষ্ট্র অথবা মুসলিম রাজবংশ সম্পর্কে ভারতবাসী তেমন জ্ঞাত নন বা স্বল্প জ্ঞাত তাদের সম্পর্কে আলোকপাত করতে এবং ইসলামের ইতিহাসের পূর্ণাঙ্গ নকশা তুলে ধরার ব্যাপারে মোটেই কার্পণ্য বা অবহেলা করিনি। সাহাবায়ে কিরাম (রা) এবং পরবর্তী যুগে এমন সব মনীষী সম্পর্কে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে যারা কোন না কোন ইসলামী সম্প্রদায় কিংবা গোষ্ঠির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।

মুসলমানদের ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট করে এমন ধরনের বিবরণ পরিহার করা হয়েছে। তাই বলে সঠিক ইতিহাস রচনায় বা ঐতিহাসিক হিসাবে আমার দায়িত্ব পালনেই ত্রুটি হয়ে যায় তেমন সতর্কতার আশ্রয় আমি নেই নি। আমি ইবাদত ও ইসলামী খিদমত মনে করেই এ ইতিহাসটি প্রণয়ন করেছি এবং এ জন্যে আল্লাহর কাছে এর পুরস্কারেরও আশা রাখি।

আমি আমার জ্ঞানগত দীনতার কথা স্বীকার করে নিয়েই বলছি, পদে পদে হোঁচট খাওয়াটাই স্বাভাবিক এবং ভুলত্রুটি থেকে সর্বতোভাবে মুক্ত থাকা এটি অত্যাশ্চর্য ব্যাপার বলে গণ্য হতে পারে। যারা ভুলত্রুটি নিরসনের উদ্দেশ্যে এর সমালোচনা করবেন, আমি তাদেরকে উপকারী বন্ধু বলেই মনে করব। আর যারা বিদ্বেষবশত ছিদ্রান্বেষণে লিপ্ত হবেন তাদেরকে আল্লাহর হাতে সমর্পণ করছি।

আকবর শাহ খান নজীবাবাদী১লা মুহাররম, ১৩৪৩ হিজরি

ভূমিকা ইতিহাস
আরবী, উর্দু, ফার্সী ভাষায় ‘তারীখ’ বাংলাতে ‘ইতিহাস’-এর পরিভাষাগত অর্থ হচ্ছে ঐ বিদ্যা যার মাধ্যমে রাজা-বাদশাহ, নবী-রাসূল, বিজেতা ও বিখ্যাত মনীষিগণের জীবনকাহিনী এবং অতীত যুগের বড় বড় ঘটনা ও রীতিনীতি সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া যায় এবং যা বিগত যুগসমূহের সামাজিক, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থাদি সম্পর্কে জ্ঞান লাভের মাধ্যম হয়ে থাকে। কেউ কেউ ‘ইতিহাস’-এর সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে :

মানুষের একত্রে বসবাসকে ‘তামাদ্দুন’ (সংস্কৃতি) এবং সেই সমাজবদ্ধ জনপদকে ‘মদীনা’ (নগর) বলে। এদের উপর দিয়ে স্বভাবসিদ্ধভাবে অবস্থাদি অতিক্রান্ত হয় তাকে ‘তারীখী ওয়াকিয়াত’ (ঐতিহাসিক ঘটনাবলী) এবং পরবর্তীদের পূর্ববর্তীদের মুখ থেকে শুনে শুনে সে ঘটনাবলীকে সঙ্কলিত করা এবং শিক্ষণীয় উপদেশ স্বরূপ তা পরবর্তীদের জন্যে রেখে যাওয়াকে ‘তারীখ’ বা ইতিহাস বলে। কেউ কেউ বলেন, আসলে আরবী ‘তাখীর’ ( تاخير ) শব্দটিকে উল্টিয়ে ‘তারীখ’ ( تاريخ ) শব্দটি বানানো হয়েছে। তাখীর অর্থ পরবর্তীতে নিয়ে আসা, পূর্ববর্তী যুগকে পরবর্তী যুগের দিকে সম্পর্কিত করা। যেমন বলা হয়, অমুক ধর্ম বা অমুক সাম্রাজ্য বা অমুক যুদ্ধের উদ্ভব অমুক সময় হয়েছিল। যে বিশেষ ঘটনাবলী সে যুগটাতে ঘটেছিল, সে সবের শুরু বা সূচনাই হচ্ছে সে সময়টি। মোদ্দাকথা, তারীখ বা ইতিহাসের সংজ্ঞা সম্পর্কে এরূপ অনেক বিশেষণ রয়েছে। তার সবকটির সারমর্ম হচ্ছে প্রথমোক্ত সংজ্ঞাটি। আরো সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয়, যে সকল অবস্থা ও ঘটনাবলী কাল নির্দেশ করে লিখিত হয়, তাকেই ইতিহাস বলা হয়ে থাকে।

ইতিহাসের প্রয়োজন এবং এর উপকারিতা
ইতিহাস আমাদেরকে পূর্ববর্তী মহাপুরুষদের কাহিনীসমূহ সম্পর্কে অবহিত করে আমাদের মন-মস্তিষ্কে একটি শুভ উদ্দীপনার সঞ্চার করে। মানুষের প্রকৃতিতে একটা বিশেষ ধরনের পিপাসা এবং স্পৃহা থাকে যা অজানা দেশে ভ্রমণের, বাগবাগিচা ও পুষ্পোদ্যান বিচরণে এবং দুর্গম গিরি-পর্বত ও মরুপ্রান্তরে পরিভ্রমণে উদ্দীপ্ত করে। এই সহজাত প্রবৃত্তিই শিশুদেরকে রাতের বেলা পাখ-পাখালীর গল্প শোনায়, যুবকদেরকে তোতা-ময়নার উপাখ্যান শোনার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে :

فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ .

তোমরা যদি না জান তবে জ্ঞানীদিগকে জিজ্ঞাসা কর। (২১ : ৭)

আল্লাহর এই সুস্পষ্ট হুকুম তামীল করার মধ্যেই ঐতিহাসিক গ্রন্থাদি পাঠে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। মানুষের এই সহজাত প্রবৃত্তির দিকে লক্ষ্য রেখেই প্রবৃত্তিসমূহের স্রষ্টা আসমানী কিতাবসমূহে মধুময় আস্বাদন রেখে দিয়েছেন। বনী ইসরাঈলের জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের কথা সর্বজনবিদিত। এমনকি তারা নিজেদেরকে نحن ابنء الله واحبائه (আমরা আল্লাহ্‌র পুত্র এবং তার প্রিয়জন, নাউযুবিল্লাহ) বলে অভিহিত করতো। কিন্তু এমন একটি জাতিই যখন নিজেদের পূর্বপুরুষদের কথা বিস্মৃত হয়ে গেলো তখন তারাও দিন দিন অধঃপতনের দিকে তলিয়ে যেতে লাগলো। এজন্যেই আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে বারবার এই বলে সম্বোধন করেছেন :

يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ اذْكُرُوا .

“হে বনী ইসরাঈল! স্মরণ কর” ... পূর্বপুরুষদের কথা তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

১০
ইতিহাস পাঠের উপকারিতা
ইতিহাস পাঠে পাঠকের সাহস ও আত্মপ্রত্যয় বৃদ্ধি পায়। সৎকর্মের উৎসাহ-উদ্দীপনা বৃদ্ধি পায় এবং পাপাচারের প্রবণতা হ্রাস পায়। ইতিহাস পাঠে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা বৃদ্ধি পায়। বহুদর্শিতা, সৎসাহস ও সতর্কতার অভ্যাস সৃষ্টি হয়। অন্তর থেকে দুশ্চিন্তা ও চিন্তাক্লিষ্টতা দূরীভূত হয় এবং নব-উদ্যম ও উৎসাহের সঞ্চার হয়। ঐতিহাসিক গ্রন্থাদি পাঠে সত্যান্বেষণের এবং সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার মত অন্তর্দৃষ্টি ও মনোবল সৃষ্টি হয় এবং মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণের শক্তি বৃদ্ধি পায়। ঐতিহাসিক গ্রন্থাদি পাঠে ধৈর্যস্থৈর্য বৃদ্ধি পায় এবং মনমগজ সর্বদা সতেজ ও প্রফুল্ল থাকে। মোদ্দাকথা, ইতিহাস শাস্ত্র হচ্ছে হাজার হাজার ধর্মোপদেশ বিতরণকারীর মধ্যে অন্যতম এবং শিক্ষা গ্রহণের সর্বোত্তম মাধ্যম। ঐতিহাসিক গ্রন্থাদি পাঠে পাঠক সর্বদা নিজেকে রাজা-বাদশাহ, দিগ্বিজয়ী নবী-রাসূল, ওলী-আউলিয়া, জ্ঞানীগুণী, দার্শনিক, পণ্ডিত ও কৃতী মনীষীদের দরবারে উপবিষ্ট দেখতে পায় এবং এসব মনীষীদের নিকট থেকে সে অহরহ জ্ঞানার্জন করতে থাকে। বড় বড় রাজা-বাদশাহ, উযীর-উজারা ও সেনাপতিদের দ্বারা সংঘটিত ভুলত্রুটিসমূহের কথা অবগত হয়ে সে নিজেকে এ সব ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে মুক্ত রাখতে সচেষ্ট হয়। অন্য কোন বিদ্যা পাঠ মানুষ এত সানন্দে ও অবসন্নতামুক্ত হৃদয়ে অব্যাহত রাখতে পারে না, যতটুকু পারে ইতিহাস পাঠে।

১১
ইতিহাসের মাধ্যমে সামরিক বৈশিষ্ট্যাদি সংরক্ষণ
যে জাতি নিজের ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং অতীতের গৌরবজনক অধ্যায়গুলো সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখে, তাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্যাদিও অক্ষুন্ন থাকে। সে জাতির কোন ব্যক্তি অন্য জাতির মুকাবিলায় কোন ক্ষেত্রেই সাহসহারা বা হৃতবল হয়ে পিছপা হয় না বরং আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে জাতির হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হয় এবং তাতে তারা সাফল্য অর্জন করে। যে ব্যক্তি তার বাপ-দাদার অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞাত নয়, সে সুযোগ হাতে পেলেই খিয়ানতের আশ্রয় নিতে পারে। কিন্তু যার তা জানা আছে যে, অনেক সুযোগ হাতের মুঠোয় পেয়েও আমার বাপ-দাদা লাখ লাখ টাকার লোভ সম্বরণ করে পূর্ণ বিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়ে সম্মান অর্জন করে গেছেন, তার পক্ষে খিয়ানত বা বিশ্বাসভঙ্গ করা দুষ্কর। অনুরূপভাবে বাপ-দাদার অবস্থা সম্পর্কে অজ্ঞ ব্যক্তি সমরক্ষেত্র থেকে পালিয়ে বাঁচাকে পছন্দ করবে। কিন্তু যার একথা জানা থাকবে যে, আমার বাপ-দাদারা অমুক অমুক যুদ্ধক্ষেত্রে অটলভাবে অবস্থান করে সম্মান অর্জন করেছিলেন, সে কখনো সমরক্ষেত্র থেকে পালিয়ে প্রাণ রক্ষার চিন্তা করতে পারবে না বরং বাপ-দাদার স্মৃতি তখন তার পায়ের জিঞ্জির হয়ে দাঁড়াবে। অনুরূপভাবে বিশ্বস্ততা, সত্য ভাষণ; সচ্চরিত্রতা, লজ্জাশীলতা, দানশীলতা প্রভৃতির ব্যাপারেও পূর্বপুরুষের ইতিহাস সম্পর্কে অবগতিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এ অবগতি বিভিন্ন জাতির মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করে থাকে। সম্ভবত একথা চিন্তা করেই আমাদের প্রতিবেশী বিভিন্ন জাতি তাদের নিজস্ব কোন গৌরবজনক ইতিহাস না থাকলেও মনগড়া রূপকথা ও মিথ্যা কাহিনীসমূহকে ইতিহাসের রূপ দিয়ে কার্যোদ্ধারের প্রয়াস পেয়ে থাকেন। তারা একটু পরোয়া করেন না বা ভেবেও দেখেন না যে, এ মিথ্যাচারের মাধ্যমে সত্য কথনে আদালতের কাঠগড়ায় বা ঐতিহাসিকদের দরবারে তারা কত খাটো ও হাস্যাস্পদ প্রতিপন্ন হবেন।

১২
ইতিহাস ও বংশ কৌলীন্য
ইতিহাসে যেহেতু সৎলোকদের সততার কথা এবং অসৎলোকদের অনাচারের কথা লেখা হয়, তাই কোন নীচ বংশজাত লোকদের কাছে ইতিহাস খুব একটা প্রিয়বস্তু হতে পারে না। পক্ষান্তরে সম্ভ্রান্ত লোকেরা তাদের পিতৃপুরুষের গৌরবজনক কীর্তিগুলোকে স্মরণ করে থাকে এবং নিজেদের কৌলিন্য বজার রাখার জন্যে তারা এগুলো অনুসরণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ইতর জাতির কাল-পরিক্রমায় নিজেদের পূর্বপুরুষদের গৌরবজনক কীর্তিগুলোও বিস্মৃত হয়ে যায়। যে জাতি বা সম্প্রদায়ের লোকদের পিতৃপুরুষরা ধর্মপরায়ণতা, শৌর্যবীর্য, জ্ঞান-গরিমা এবং প্রভাব-প্রতিপত্তিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন তাদের অধঃস্তন পুরুষরা তা কখনো বিস্মৃত হতে পারে না। তাদের পূর্বপুরুষদের এসব গৌরবজনক কীর্তির কথা বারবার স্মরণ করিয়ে করিয়ে তাদের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধ জাগিয়ে তোলা যেতে পারে। কিন্তু ইতর সম্প্রদায়ের মধ্যে তা হবার জো নেই। এজন্যেই ইতিহাসের রসবোধ সাধারণত কুলীন সম্ভ্রান্ত বংশজাত লোকদের মধ্যেই পরিদৃষ্ট হয়। কোন নীচ বংশজাত লোক, নাস্তিক অথবা কাপুরুষতার জন্য কুখ্যাত ব্যক্তি এ যাবত প্রথম শ্রেণীর ঐতিহাসিক বা ঐতিহাসিকদের নেতা হতে পারেনি।

১৩
ইতিহাসবেত্তা
একজন যথার্থ ধার্মিক এবং সঠিক চিন্তাধারার লোকই একজন সত্যিকারের ইতিহাসবেত্তা হতে পারেন। তিনি শুধু তা-ই লিখবেন যা সত্যি সত্যি ঘটেছে। তিনি কোন কিছু গোপনও করবেন না বা নিজের পক্ষ থেকে কিছু বাড়িয়েও লিখবেন না। যেসব ক্ষেত্রে স্বল্পবুদ্ধির লোকদের হোঁচট খাওয়ার আশংকা থাকে বা ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় সেসব ক্ষেত্রে তিনি তার নিজের পক্ষ থেকে এর একটা ব্যাখ্যা অবশ্যই দেবেন বরং এটা ঐতিহাসিকের একটা দায়িত্বও বটে। ইতিহাসবেত্তা কারো অহেতুক তোষামোদও করবে না। আবার বিদ্বেষুবশত কারো বিরুদ্ধেও তিনি কিছু লিখবেন না। ইতিহাসবেত্তার ভাষা ও বর্ণনাভঙ্গি হবে একান্তই সাদাসিধে, অনাড়ম্বর, সহজবোধ্য ও স্বতঃস্ফূর্ত। ছান্দসিক ভাষা প্রয়োগ ও ভাষার অলংকরণের প্রচেষ্টার মধ্যে অনেক সময় ইতিহাসের আসল বক্তব্যই হারিয়ে যায়। আর এজন্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে ছন্দোবদ্ধ ভাষায় বিরচিত ইতিহাসগুলো নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত বলে প্রতিপন্ন হয়নি। ইতিহাসবেত্তার জন্যে বিশ্বস্ততা হচ্ছে অপরিহার্য গুণ। সত্য ভাষণ ও সদাচারে তাকে অবশ্যই অন্য দশজনের তুলনায় অনন্য হতে হবে। মিথ্যাচার ও বাচালতা থেকে তাকে অবশ্যই মুক্ত থাকতে হবে। ইতিহাসের বিন্যাসে একজন ঐতিহাসিককে প্রাণান্তকর পরিশ্রম করতে হয়। তারপরও সঠিক তত্ত্ব হস্তগত হয়েছে তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না।

জ্যোতির্বিদ্যা, ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন স্তর সংক্রান্ত বিদ্যা, সমাজবিদ্যা এবং পৃথিবীর নানা ধর্ম সম্পর্কে ব্যুৎপত্তি অর্জন ছাড়াও ইতিহাসবেত্তাকে অত্যন্ত তীক্ষ্ণধী ও ন্যায়নিষ্ঠ এবং যুগপৎভাবে কথাশিল্পীও হতে হয় যাতে আপন বক্তব্য তিনি অনায়াসে গুছিয়ে যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে পারেন। এতসব সত্তেও এমন কিছু সমস্যা রয়েই যায় যেগুলোর সমাধান প্রায় অসম্ভব মনে হয়। উদাহরণস্বরূপ ধরুন, কোন ব্যক্তির থিয়েটারে যাওয়ার কথা একজন রাবী বা বর্ণনাকারী রিওয়ায়াত করলেন। এ রিওয়ায়াতটির দ্বারা বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়, অথচ নিশ্চিতভাবে বলা মুশকিল যে এগুলোর কোন একটিও যথার্থ বা অযথার্থ। হতে পারে :

১. যে লোকটি থিয়েটারে গিয়েছিল, সে গানের বড় অনুরাগী।

২. গানের অনুরাগী ঠিক সে নয়, তবে সৌন্দর্য অনুরাগী।

৩. আসলে সে সৌন্দর্য অনুরাগীও নয়, ঘটনাচক্রে জনৈকা অভিনেত্রীর প্রেমে পড়ে গিয়েছে।

৪. আসলে কারো প্রেমিক সে হয়নি, কোন এক বন্ধুর সাথে সাক্ষাতের মানসেই সে থিয়েটারে গিয়েছিল।

৫. থিয়েটার সম্পর্কে একটা প্রবন্ধ রচনার প্রয়োজন ছিল বিধায় সে থিয়েটার দেখতে গিয়েছিল।

৬. থিয়েটারের বিরুদ্ধে কোথাও লোকটির একটি বক্তৃতা করার কথা ছিল, তাই স্বচক্ষে তার ত্রুটিপূর্ণ দিকগুলো অবলোকন করার জন্যেই গিয়েছিল।

৭. লোকটির চাকরি ছিল গোয়েন্দা পুলিশের। অফিসিয়াল দায়িত্ব পালনের জন্যেই সে সেখানে গিয়েছিল।

৮. আসলে সে নিজে থিয়েটার দেখা পছন্দ করে না, বন্ধু-বান্ধবের চাপে পড়েই গিয়েছিল।

৯. লোকটি আসলে একজন ধার্মিক আল্লাহওয়ালা লোক ছিল। লোকজনের ভক্তি বিশ্বাসের দৃষ্টি থেকে নিজেকে রক্ষার জন্যেই সে এমনটি করেছে।

১০. কেবল পকেটমারার সুবিধার জন্যেই সে থিয়েটারে গিয়েছিল।

মোটকথা, এরূপ একটি রিওয়ায়াত থেকে শত শত সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসতে পারে। তারপর একটি সিদ্ধান্তের যথার্থতা প্রমাণের জন্যে অন্যান্য উপাদান থেকে সাহায্য ও সমর্থন নিতে হয়। সে সহায়ক উপাদানের মধ্যেও আবার নানারূপ সংশয় সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়। ইতিহাস লেখক যদি নিরপেক্ষমনা না হন এবং পূর্ব থেকেই কোন এক নির্দিষ্ট পক্ষের প্রতি তার দুর্বলতা থেকে থাকে তাহলে তার বিরোধী সব দলীল-প্রমাণকে সে অত্যন্ত বেপরোয়াভাবে উপেক্ষা করে যাবে এবং তার স্বপক্ষের দলীল-প্রমাণ খুঁজে খুঁজে বের করতে থাকবে। এভাবে নিজেও বিভ্রান্ত হয়ে এবং অন্যদেরকেও বিভ্রান্ত করবে।

১৪
ইতিহাস পাঠক
ইতিহাস লেখা বা তার বিন্যাস যেমন একটা সুকঠিন কাজ তেমনি তা পাঠ করা বা তা থেকে যথার্থভাবে উপকৃত হওয়াও কোন সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। ইতিহাস পাঠকের উচিত, অতীত ইতিহাসকে শিক্ষণীয় ব্যাপাররূপে গণ্য করা, অতীতকালের লোকদের অনাচার ও ভুলভ্রান্তির পরিণতি সম্পর্কে অবহিত হয়ে সেসব অনাচার ও ভুলভ্রান্তি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখবার সংকল্প অন্তরে পোষণ করা। সদাচারের সফল সম্পর্কে অবহিত হয়ে সেগুলো আত্মস্থ করার জন্যে যত্নবান হবে। দুনিয়ার এ রঙ্গমঞ্চ থেকে বিদায় নিয়েছে এমন কোন ব্যক্তির নিন্দাবাদ করা কোন পুরুষোচিত কাজ নয়। বিগত দিনের কোন ব্যক্তির প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করা, তার জন্যে দু‘আ করা বা তার ভুলভ্রান্তির একটা সদার্থ করার চেষ্টা-চরিত্র চালানো কোন দূষণীয় ব্যাপার নয়। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ, শহর-বন্দর, নগর, পাহাড়-পর্বত, মরুপ্রান্তর বিয়াবানের সফর করার সাথে ঐতিহাসিক গ্রন্থাদি পাঠের মধ্যে একটা বড় রকমের সামঞ্জস্য রয়েছে। তবে একটা পার্থক্য হলো একজন পর্যটক সারা জীবনের ভূ-পর্যটনের দ্বারা যে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেন একজন ইতিহাস পাঠক ততোধিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা একদিনের বা এক সপ্তাহের অধ্যয়নের মাধ্যমে অর্জন করতে সক্ষম। ইতিহাস পাঠক যতবেশী পক্ষপাতদুষ্ট মনমানসিকতার শিকার হবে ইতিহাস থেকে তার উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা ততই কম।

১৫
ইতিহাসের উৎস
ইতিহাসের উৎসসমূহকে সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে :

১. লিপিবদ্ধ নিদর্শনাদি : যথা পুস্তকাদি, স্মারকলিপি, অফিসিয়াল কাগজপত্র, পরোয়ানাসমূহ, ফায়সালা বা রায়সমূহ, দস্তাবেজ, ফরমান প্রভৃতি।

২. শ্রুতি নির্ভর নিদর্শনাদি : যথা লোকশ্রুতি, লোক কাহিনী, কবিতা ও প্রবাদবাক্য প্রভৃতি।

৩. প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি : প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি বলতে প্রাচীন যুগের নিদর্শনাদি বোঝায়। যথা বিভিন্ন শহরের ধ্বংসাবশেষ, দুর্গসমূহ, ঘরবাড়ি, বিভিন্ন ইমারতের শিলালিপি, পাথরের ছবি ও মূর্তিসমূহ, প্রাচীন যুগের অস্ত্রশস্ত্র, মুদ্রা, পাত্র প্রভৃতি।

কিন্তু এ উপাদানত্রয় থেকে উপকৃত হওয়া এবং ইতিহাস বিন্যস্ত করা কোন সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। তীক্ষ্ণ প্রতিভা, কঠোর পরিশ্রম, উদ্যম ও অন্তর্দৃষ্টি ব্যতিরেকে এসব উপাদান একান্তই তুচ্ছ প্রতিপন্ন হয়। এছাড়া সংশ্লিষ্ট জাতিসমূহের বৈশিষ্ট্যমূলক আচার-আচরণ, প্রথা-পদ্ধতি, রূপ-রেখা ও ভৌগোলিক অবস্থাদিও ইতিহাসবেত্তার জন্যে সহায়ক প্রতিপন্ন হয়ে থাকে।

১৬
ইতিহাসের প্রকরণ
বিভিন্ন দিক থেকে বিবেচনা করলে ইতিহাস বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। যেমন পরিমাণ পরিমিতির দিক থেকে ইতিহাস দ্বিবিধ হতে পারেঃ

(১) সাধারণ ইতিহাস ও (২) বিশেষ ইতিহাস। সাধারণ ইতিহাস হচ্ছে সেই ইতিহাস যাতে সমগ্র বিশ্বের সমগ্র মানুষের ইতিহাস বিধৃত হয় আর বিশেষ ইতিহাস হচ্ছে সেসব ইতিহাস যা কোন বিশেষ জাতি, রাষ্ট্র বা রাজবংশের ইতিহাস।

আবার অবস্থার দিক থেকেও ইতিহাস দু’রকমের হতে পারেঃ

(১) বর্ণনা ভিত্তিক (২) বুদ্ধি ও অনুমান ভিত্তিক।

১. বর্ণনা ভিত্তিক ইতিহাস হচ্ছে ঐগুলো যাতে প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা লিপিবদ্ধ হয় এবং সংশ্লিষ্ট ঘটনা সংঘটিত হওয়ার নির্ভরযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য রিওয়ায়াত বা বর্ণনা ঐতিহাসিকের হস্তগত হয়েছে। অথবা ইতিহাসবেত্তা নিজে প্রত্যক্ষদর্শীরূপে সে ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন। এ জাতীয় ইতিহাসই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য ও উপাদেয় বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। এ জাতীয় ইতিহাসে আন্দাজ অনুমানের ঘোড়া দৌড়াবার বা নিছক আন্দাজ-অনুমানমূলক বাস্তব ইতিহাসের রূপ দেবার প্রয়াস চালানোর প্রয়োজন হয় না বরং এ জাতীয় ইতিহাস অনুধাবনের ব্যাপারে ভুলত্রুটি হয়ে গেলে তার নিরসনও হয়ে যায়।

২. বুদ্ধিভিত্তিক ইতিহাস হচ্ছে সেগুলো যা শুধু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদির শ্রুতিনির্ভর নিদর্শনাদি এবং নিছক আন্দাজ-অনুমানের উপর ভিত্তি করে রচিত হয়ে থাকে এবং ইতিহাসবেত্তার বর্ণনাকারীর সমসাময়িক কোন ব্যক্তির বর্ণনা আদৌ হস্তগত হয় না। যেমন প্রাচীন মিসর, প্রাচীন ইরাক এবং প্রাচীন পারস্যের ইতিহাস সম্প্রতিকালে লিখিত হয়েছে। এসব ইতিহাস থেকেও-প্রভূত উপকার লাভ হয়ে থাকে, কিন্তু তাতে নিশ্চিত জ্ঞান কোনমতেই অর্জিত হতে পারে না।

১৭
ইতিহাসের যুগসমূহ
১. প্রাচীন যুগ

২. মধ্য যুগ

৩. শেষ যুগ

প্রাচীন যুগ হচ্ছে পৃথিবী সৃষ্টির সূচনাকাল থেকে বায়যান্টাইন সাম্রাজ্যের শেষ যুগ পর্যন্ত। মধ্য যুগ হচ্ছে বায়যান্টাইন সাম্রাজ্যের শেষ যুগ থেকে দ্বিতীয় সুলতান মুহাম্মদের যুগে কনস্টান্টিনোবল বিজয়কাল পর্যন্ত যুগ।

পৃথিবীর বিশেষ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলীর দ্বারা পরবর্তী বা পূর্ববর্তীকালের অন্যান্য ঘটনার কাল নির্দেশ করার রেওয়াজ আছে। যথা আদম (আ) সৃষ্টির এত বছর পর, নূহ (আ)-এর প্লাবনের এত বছর পূর্বে বা পরে, ঈসা (আ) অথবা বিক্রমাদিত্যের জন্মের এত বছর পূর্বে বা পরে। অনুরূপভাবে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের বা কোন রাজা বাদশাহর সিংহাসনে আরোহণের দ্বারাও বর্ষ নির্ণয় করা হয়ে থাকে। আজকাল পৃথিবীতে ঈসায়ী সন (খ্রিস্টাব্দ) ও হিজরী সনের প্রচলনই সর্বাধিক।

১৮
ইসলামের ইতিহাস
পৃথিবীর জাতিসমূহের মধ্যে একমাত্র মুসলিম জাতিই এমন একটি জাতি এবং ইসলাম ধর্মই এমন একটি ধর্ম যার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস আনুপূর্বিক সুসংরক্ষিত রয়েছে। এর কোন একটি অংশ বা অধ্যায়ও এমন নয়-যাতে সংশয়-সন্দেহের অবকাশ আছে। মুসলমানরা হুযূর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের যুগ থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত সংঘটিত যাবতীয় ঘটনার বিবরণ লিখিতভাবে সংরক্ষণের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র উদাসীনতা প্রদর্শন করেন নি। মুসলমানদের জন্যে এটা সঙ্গতভাবেই গর্বের কারণ যে, ইসলামের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস প্রত্যেকটি ঘটনার সমসাময়িক ঐতিহাসিক ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনার সাহায্যে তারা বিন্যাস ও রচনা করতে পারেন এবং সেসব সমসাময়িক ঐতিহাসিক ও বিশ্বস্ত রাবীদের বর্ণনা অনস্বীকার্য ধারাবাহিকতাও তাঁরা সপ্রমাণিত করতে পারেন। মোদ্দাকথা, পৃথিবীতে কেবল মুসলমানই এমন একটা জাতি যারা তাদের পূর্ণাঙ্গ ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাস সংরক্ষণ করেছে। দুনিয়ায় অন্য কোন জাতি এ ব্যাপারে মুসলমানদের সমকক্ষ নয়। ইসলামের ইতিহাসবেত্তাগণ এ ব্যাপারে এতই সতর্কতা অবলম্বন করেছেন যে, প্রতিটি ঘটনা হুবহু বর্ণনা করে নিজেরা মন্তব্য করা থেকে বিরত থেকেছেন। কেননা তাতে সন্দেহ হতে পারতো যে, ইতিহাস লেখকের নিজস্ব খেয়ালখুশী ও প্রবণতার ছাপ পড়ায় পাঠকের মনে তার প্রভাব পড়েছে এবং ঘটনা সম্পর্কে তার নিরপেক্ষ বিচারের স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে। ফলে মনের অজান্তেই পাঠক ইতিহাস লেখকের বিশেষ প্রবণতার অন্ধ অনুসারী সেজে বসেছে। ইসলামের ইতিহাসের মাহাত্ম্য এখন অন্তরে আরো বেশি রেখাপাত করে যখন দেখা যায় যে, ইসলামের ইতিহাসের যে কোন অধ্যায়কে বুদ্ধির কষ্টিপাথরে ও যুক্তির বৈজ্ঞানিক মাপকাঠিতে পরীক্ষা এবং বিশ্লেষণ করলেও তাতে কোনরূপ ক্রটি বৈকল্য বা কৃত্রিমতার লেশমাত্র পাওয়া যায় না।

১৯
ইতিহাসের ইতিহাস
বাবেল ও নিনোভার ধ্বংসাবশেষ, নজদের মরুভূমিতে ‘আদ ইরামের স্তম্ভরাশি, মিসরের পিরামিড ও নারীমূর্তিসমূহ দর্শনে স্বভাবতই মানুষের মনে এগুলোর নির্মাতাদের সম্পর্কে জানবার কৌতূহল জন্মে। অনেকে বাবেলীয়দের ইতিহাস রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছেন এবং নিজেদের অপরিপক্ক বুদ্ধিবিবেচনা খাটিয়ে অনেকে বর্ণনাও সংকলিত করেছেন। অত্যাশ্চর্য ধরনের লিপিমালা এবং মিসরীয় সংকেতসমূহ অবলম্বনে পিরামিড নির্মাতাদের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা যেতে পারে।

যেন্দাবেস্তা, দসাতির, সফর, বর্তমানে বিদ্যমান আসমানী কিতাবাদি এবং বাইবেল, বাল্মিকীর রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি এমন সব গ্রন্থ যেগুলো সম্পর্কে ভুল শুদ্ধ কিছু না কিছু ইতিহাস জানা যায়। প্রত্যেক ভাষার বাকবিধি, প্রবাদবাক্য, প্রস্তরনির্মিত অস্ত্রশস্ত্র, লৌহনির্মিত যন্ত্রপাতি, স্বর্ণ-রৌপ্য ও তাম্রনির্মিত গহনাপত্র, প্রস্তরমূর্তি, মিসরের মমিকৃত সুসংরক্ষিত শবদেহসমূহ, অশোকের স্তম্ভসমূহ, রুস্তমের সিংহাসন, চীনের মহাপ্রাচীর প্রতি নিঃসন্দেহে কৌতূহলোদ্দীপক ও আকর্ষণীয় এবং এগুলোর দ্বারা সামগ্রিকভাবে গোটা বিশ্বের ইতিহাস যদিও অবগত হওয়া নাও যায়, তবুও এগুলোর দ্বারা ইতিহাসের উপর বেশ কিছু আলোকপাত হয়, তাতে কোন সন্দেহ নেই। ভারতীয়দের সত্য মিথ্যা কাহিনীসমূহ, মিসরীয়দের প্রাচীন শিলালিপিসমূহ, চীনাদের প্রাচীন লোক কাহিনীসমূহ, পারসিকদের প্রাচীন ইমারতসমূহের ধ্বংসাবশেষ, গ্রীকদের লিপিসমূহ বিশেষত হিরোডোটাসের রচনা, ইসরাঈলী রিওয়ায়াতসমূহ, প্রভৃতি মিলিয়ে ইতিহাসের অপরিহার্য এবং প্রাথমিক উপাদান।

২০
ইতিহাসের সূচনা
রোমীয় এবং গ্রীকদের আমল বিশেষত আলোকজান্ডারের বিজয়সমূহের দ্বারা ইতিহাসের সেই অংশের সূচনা হয়েছে—যা পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের ইতিহাস এমনিভাবে আমাদের সম্মুখে তুলে ধরছে যে, ইতিহাসের ধারাবাহিকতা তারপর খুব কমই বিঘ্নিত হয়েছে। সাধারণত সেই থেকেই ঐতিহাসিক যুগের সূচনা বলে গণ্য হয়ে থাকে। গ্রীস, মিসর ও ইরানের ইতিহাস অধ্যয়ন করতে গিয়ে আগ্রহী ইতিহাস পাঠকরা যেমন আনন্দিত ও উৎসাহিত হন, তেমনি ভারতের ইতিহাস পাঠকালে তারা এই লক্ষ্য করে ক্রুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ হন যে, এই ঐতিহাসিক যুগেও ভারতবর্ষকে ঘন তমসাচ্ছন্ন মনে হয়। এখানকার লোকদের এই উদাসীনতার জন্যে পৃথিবীর ইতিহাস লেখকগণ কঠিন সমস্যায় নিপতিত হন যখন তারা লক্ষ্য করেন যে, এখানকার লোকেরা যতসব রূপকথা ও কল্পকাহিনীকে ইতিহাসের রূপ দিয়ে বসে আছে। এরা কোন দিন যথার্থ ইতিহাস সরল ভাবে উপস্থাপিত করতে পারে নি। এই শস্য-শ্যামল ও জনাকীর্ণ দেশ ভারতবর্ষের ঠিক বিপরীত আরবের মরু রাজ্য তাদের বর্ণনার বিশুদ্ধতা, স্মরণশক্তির প্রখরতা, বংশপঞ্জি সংরক্ষণে নিষ্ঠা এবং ঐতিহাসিক ঘটনাবলী আনুপূর্বিক যথার্থভাবে উপস্থাপনের অপূর্ব ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে—যদ্দরুন সেই অসাধারণ জাতিগুলোও ইতিহাসের একটি মূল্যবান উপাদান বলে বিবেচিত হয়ে থাকে।

২১
ইতিহাসের সত্যিকারের সূচনা
এবার কুরআনুল কারীম নাযিল হতে লাগলো। আরবরা গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লো। সমস্ত সভ্যতা-সংস্কৃতি আরব সংস্কৃতির মুখে খড়কুটো বা ধূলোবালি প্রতিপন্ন হলো। সত্যিকারের ইতিহাস এবার শুরু হলো। হাদীস রিওয়ায়াতের যাচাই-বাছাই এবং ‘আসমাউর রিজাল’ শাস্ত্রের উদ্ভাবনের অনন্য সাধারণ কীর্তিদ্বয়ের কথা বাদ দিলেও মুসলমানদের মধ্যে এমন শত শত হাজার হাজার ঐতিহাসিকের সন্ধান পাওয়া যাবে, যারা ইতিহাস প্রণয়নে এমন অবিস্মরণীয় কীর্তি রেখে গেছেন যে, পাঠক মাত্রকেই তা অভিভূত করে। সমাজ-সভ্যতা সংস্কৃতির এমন কোন দিক নেই, যে ব্যাপারে মুসলিম ইতিহাসবেত্তাগণ ইতিহাস প্রণয়ন করেন নি। ইতিহাসের প্রাণ হচ্ছে তার রিওয়ায়াত বা বর্ণনার বিশুদ্ধতা। এ ব্যাপারটি মুসলমানরা এতই নিষ্ঠার সাথে সংরক্ষণ করেছেন যে, মুসলমান ছাড়া অন্য কোন জাতি তার উদাহরণ দেখাতে ব্যর্থ। এমনকি অন্যান্য রাষ্ট্র ও জাতির ইতিহাস প্রণয়নেও মুসলমান ঐতিহাসিকগণ তাদের মেধা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ব্যয় করেছেন।। ইতিহাসকে একটা শাস্ত্রের মর্যাদায় উন্নীত করা মুসলমানদেরই কার্তি। ইতিহাসের মূলনীতির উদ্‌গাতা ইব্‌ন খালদূন চিরদিন ঐতিহাসিকদের ভক্তিশ্রদ্ধা লাভ করতে থাকবেন। যখন মুসলিম জাতির পতন শুরু হলো এবং মুসলিম ঐতিহাসিকের মধ্যে পূর্ববৎ উৎসাহ-উদ্দীপনা আর তেমন অবশিষ্ট রইল না তখন থেকে তাদেরই ছাত্র ইউরোপীয় ঐতিহাসিকগণ তাদের সে আরদ্ধ কাজ সমাপ্ত করার কাজে ব্রতী রয়েছেন।

২২
সাম্রাজ্যের ইতিহাস
পশুর তুলনায় মানুষের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, পশুকে যেখানে সীমাবদ্ধ শক্তি-সামর্থ্য দেয়া হয়েছে যা সহজাতভাবে তার নিজের মধ্যেই বিদ্যমান, সেখানে মানুষকে এমন সম্ভাবনার অধিকারী করা হয়েছে যে, সে তার শক্তিকে যতই বৃদ্ধি করতে চায় ততই তার শক্তির ক্ষেত্র প্রশস্ত থেকে প্রশস্ততর হতে থাকে। এ কথাটি এভাবেও বলা যায়, মানুষ সর্বদা ঊর্ধ্বগামী। সে সর্বদা নীচ থেকে উপরের দিকে আরোহণ করার জন্যেই সৃষ্ট হয়েছে। মানুষের মধ্যে যে অনেক বেশী উর্ধ্বে সমাসীন হয়ে যায়, অন্যদেরকে সে যেহেতু অনেক নীচে দেখতে পায়, তাই নিজে পরিপূর্ণ না হলেও আপেক্ষিকভাবে নিজেকে অনেক পরিপূর্ণ দেখতে পায়। কিন্তু সাথে সাথে তার এ পূর্ণতা যেহেতু আপেক্ষিক এবং তার উন্নতির অবকাশ থেকেই যায় তাই তার চাইতে অপেক্ষাকৃত পূর্ণতর লোকদের তুলনায় নিজেকে সে অপূর্ণই দেখতে পায়। অপর কথায় বলা যায়, মানুষের মধ্যে সহজাতভাবেই উবুদিয়্যত বা দাস্যভাব বিরাজমান। সে তার শক্তি সামর্থ্যদাতা উপকারী সত্তার কাছে স্বভাবজাতভাবেই বিনীত।

وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ .

আমি জিন ও মানব জাতিকে সৃষ্টিই করেছি ইবাদত করার জন্যে। (৫১: ৫৬)

যে মানুষটিকে সকলের শীর্ষে ও ঊর্ধ্বদেশে সমাসীন দেখা যায় তাই স্বভাবত অন্যরা তার কাছে মাথা নত করে তার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে। এটাই হচ্ছে বাদশাহীর মৌল দর্শন আর এ থেকেই সেই বহুল প্রচলিত প্রবাদ বাক্যটির তাৎপর্য বোধগম্য হয়, যাতে বলা হয়ে থাকে যে, বাদশাহ্ বা শাসক হচ্ছে রূপকভাবে আল্লাহর ছায়াস্বরূপ। এখানে একথা বিস্মৃত হলে চলবে না যে, বাদশাহ্ বা শাসক প্রকৃতই কামেল বা পরিপূর্ণ সত্তা নয়, এ কেবল আপেক্ষিক পূর্ণ মাত্র-যাকে কেবল রূপক অর্থেই পূর্ণ বলা চলে। কেননা, প্রকৃত পূর্ণ সত্তা-কেবল তিনিই হতে পারেন যিনি সকল সীমাবদ্ধতা, সমকক্ষতা, নশ্বরতা ও অপূর্ণতার ঊর্ধ্বে সমাসীন একক অবিনশ্বর স্বয়ম্ভু ও অপরিহার্য সত্তা, সমস্ত গুণের আঁধার। তিনিই প্রকৃত বাদশাহ, শাসক, হাকিম, সার্বভৌমত্বের অধিকারী একক বিধানদাতা। মোটকথা মানুষ যেহেতু স্বভাবজাতভাবে সর্বদা তার আপন সত্তায় অনেক দীনতা ও অপূর্ণতা দেখতে পায়, তাই আনুগত্য ও মাথা নত করার সহজাত প্রবৃত্তিও তার মধ্যে নিহিত এবং এর স্বভাবজাত প্রবৃত্তির বিরুদ্ধাচরণ করতে তাকে বারণ করা হয়েছে :

أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ .

আল্লাহর আনুগত্য কর ও রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের মধ্যকার শাসকেরও। (৪ : ৫৯)

রূপকভাবে আইন ও সার্বভৌমত্বের অধিকারী কেবল সেই বাদশাহ বা রাজন্যই হতে পারেন, যিনি আপেক্ষিকভাবে অন্যদের তুলনায় পূর্ণত্বের অধিকারী। তাই বলা যায়, প্রত্যেক পূর্ণ ও শক্তিমানই তার চাইতে অপেক্ষাকৃত অপূর্ণ এবং শক্তিহীনকে তার কর্তৃত্বাধীন বা প্রভুত্বাধীন দেখতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যেহেতু মানব চরিত্রে তার স্বভাব-বিরোধী কাজ করার এবং আপন প্রতিভা ও শক্তির বিকাশের পরিবর্তে অধঃপতনের দিকে ধাবিত হওয়ার এবং শক্তির অপচয়ের প্রবণতা ও সুযোগও বিদ্যমান রয়েছে, এজন্যে এটাও অপরিহার্য ছিল যে, কখনও দেখা যাবে, কোন ব্যক্তি এক সময়ে অন্যদের তুলনায় অনেক অপরিপূর্ণ ও পশ্চাৎগামী হওয়া সত্ত্বেও আপন স্বভাবধর্মের বিপরীতে সে সেই ক্ষমতা ও যশই কামনা করবে যা কোনমতেই তার প্রাপ্য নয়, বরং তা কেবল পূর্ণ সত্তারই প্রাপ্য হতে পারে। বিভিন্ন সাম্রাজ্য ও সম্রাটের মধ্যে দ্বন্দ্বের মূল কারণ এখানেই নিহিত। কর্তৃত্ব ও শাসন ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার প্রধান হেতু দু’টিই হতে পারে; প্রথমটা রূহানী বা আধ্যাত্মিক, অপরটি দৈহিক বা বাহ্যিক। অন্য কথায় প্রথমটি হচ্ছে নবুওয়াত এবং দ্বিতীয়টি সালতানাত বা রাজত্ব।

সালতানাত বা জড়বাদী রাজত্বের সহিত সংশ্লিষ্ট পূর্ণতার বর্ণনা তালূত এবং হযরত দাউদ (আ)-এর রাজত্বের বর্ণনায় এভাবে রয়েছে :

وَقَالَ لَهُمْ نَبِيُّهُمْ إِنَّ اللَّهَ قَدْ بَعَثَ لَكُمْ طَالُوتَ مَلِكًا .

তাদের নবী তাদেরকে বললেন, আল্লাহ্ তা‘আলা তোমাদের জন্যে তালূতকে বাদশাহ্ মনোনীত করেছেন। (২: ২৪৭)

বনী ইসরাঈল তালূতকে বাদশাহ মনোনীত হওয়ার সংবাদে প্রতিবাদ বা আপত্তি উত্থাপন করলে জবাবে বলা হলো :

إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَاهُ عَلَيْكُمْ وَزَادَهُ بَسْطَةً فِي الْعِلْمِ وَالْجِسْمِ .

নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ তালুতকে তোমাদের উপর রাজত্বের জন্যে মনোনীত করেছেন এবং তাকে বিদ্যাবুদ্ধি ও দেহাবয়বে তোমাদের মধ্যে সেরা ব্যক্তি করেছেন। (২: ২৪৭)

তারপর দাউদ (আ) সম্পর্কে বললেন :

وَقَتَلَ دَاوُودُ جَالُوتَ وَآتَاهُ اللَّهُ الْمُلْكَ وَالْحِكْمَةَ وَعَلَّمَهُ مِمَّا يَشَاءُ .

এবং দাউদ জালূতকে হত্যা করলো এবং আল্লাহ তাকে রাজত্ব দান করলেন এবং তার অভিপ্রায় অনুযায়ী তাকে জ্ঞান দান করলেন। (২: ২৫১)

ইতিহাস পাঠে প্রতীয়মান হয় যে, যে ব্যক্তি কোন জাতির গোত্রপ্রীতি ও জাত্যাভিমানের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পেরেছে এবং জ্ঞানবুদ্ধি, স্বাস্থ্য বা দেহসৌষ্ঠবে অন্যদের তুলনায় প্রাধান্য অর্জন করেছে সে-ই-তার জাতির নেতা ও রাজন্যপদে অনায়াসে বরিত হয়েছে। আজ থেকে তিন হাজার বছর পূর্বেও দৈহিক শক্তিমত্তা রাজত্ব লাভের জন্য প্রয়োজনীয় বিবেচিত হয়েছে—যার সাথে জ্ঞান ও বুদ্ধিগত প্রাধান্যও অপরিহার্য উপাদানরূপে বিবেচিত হয়েছে। তারপর শনৈ শনৈ মানব জাতির মধ্যে যতই নতুন নতুন গুণাবলী সৃষ্টি হয়েছে ততই রাজন্যের গুণাবলী ও পূর্ব শর্তের পরিধিও বিস্তৃত থেকে বিস্তৃততর হয়ে চলেছে। মোদ্দাকথা চিরকালই রাজা-বাদশাহ্ বা রাজন বলতে মূল্যবান ও গুণধর ব্যক্তিরাই বিবেচিত হয়ে এসেছেন। আর যখনই এর ব্যতিক্রমে অযোগ্য লোকেরা এ শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছে তখনই নানারূপ ফিতনা-ফাসাদ ও বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়মের ব্যতিক্রম কোথাও পাওয়া যায় না। প্রতিটি মানুষ যেহেতু জন্মগত ও স্বভাবগতভাবে সমান অধিকার ও মর্যাদার অধিকারী, সুতরাং অধ্যবসায় সাপেক্ষে লভ্য যে মাহাত্ম্য ও গুণাবলী মানুষকে রাজা-বাদশাহর মর্যাদায় উন্নীত করে তাতে সকলেরই সমান অধিকার।

ليس للانسان الا ما سعی .

যে যতটুকু চেষ্টা করবে সে ততটুকুই কর্ম লাভ করবে।

প্রতিটি জাতির সবচেয়ে গুণধর ব্যক্তি তার স্বীয় গুণাবলী ও মাহাত্ম্যের দ্বারা আপন সমগোত্রীয় বা সমজাতীয়দের রাজার আসনে সমাসীন হয়েছে। প্রতিটি গ্রামের মোড়ল তার গ্রামের রাজাস্বরূপ। আর এটা হচ্ছে আদি মানবগোষ্ঠীর রাজত্বের নমুনা-যা আজো আমাদের চোখের সম্মুখে রয়েছে। আজো আমরা এ ব্যবস্থার কোন ত্রুটি নির্দেশ করতে পারবো না। হাঁ, তা তখনই পারবো যখন যোগ্যতর ব্যক্তির স্থলে অযোগ্য ব্যক্তি শাসক পদে বরিত হয় বা কোন গ্রাম বা মহল্লার মোড়ল-মাতব্বর (মেম্বার-চেয়ারম্যান) সেই গ্রাম বা জনপদের যোগ্যতর ব্যক্তিটি না হবে।

২৩
ব্যক্তিতন্ত্র ও গণতন্ত্র
মানুষ যেমন সৃষ্টির সেরা এবং গোটা বিশ্বের সবকিছুর সেবা সে লাভ করছে, তেমনি এটাও তার স্বভাবজাত যে, কোন উচ্চতর শক্তির কাছে সে মাথা নত করে তারই দ্বারা সে পরিচালিত হয়। মানুষের এই সহজাত প্রবৃত্তিই তাকে আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসী হওয়ার প্রেরণা যোগায় এবং সমস্ত বাতিল উপাস্যকে বর্জন করে একক লা-শরীক আল্লাহর ইবাদতে নিয়োজিত হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। শয়তান যে ব্যাপারে মানুষকে সবচাইতে বেশি ধোঁকায় ফেলেছে তা হলো শাসক হওয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় গুণাবলীর কথা বিস্মৃত মানুষ উত্তরাধিকার ও বংশগত সম্পর্ককে এর একটি অপরিহার্য পূর্বশর্তরূপে মেনে নিয়েছে। ফলশ্রুতিতে, অযোগ্য লোকেরা কেবল পূর্ববর্তী রাজা-বাদশাহর সন্তান বা উত্তরাধিকারী হওয়ার ভিত্তিতে রাজা-বাদশাহ বনে গিয়ে যোগ্যতর ব্যক্তিদেরকে বঞ্চিত ও লাঞ্ছিত করার সুযোগ লাভ করেছে। মানব জাতির এ ভুলের দরুন পৃথিবীতে বহু অনর্থের সৃষ্টি হয়েছে এবং এজন্যে মানব জাতিকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে।

কুরআনুল কারীম নাযিল হয়ে এবং হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম নবীরূপে আবির্ভূত হয়ে পৃথিবীবাসীকে তাদের এ বিশ্বজোড়া বিভ্রান্তি ও পর্বততুল্য ভ্রান্তির অপনোদন করেছেন। এর সমস্ত মানবীয় গুণের অধিকারী নবী করীম (সাঃ) স্বয়ং রাজ্য পরিচালনা করে নবুওয়াত ও রিসালতের গুরুদায়িত্ব পালনের সাথে সাথে পার্থিব রাজ্য পরিচালনার প্রকৃষ্ট নমুনাও বিশ্ববাসীর সম্মুখে উপস্থাপিত করেছেন এবং বিশ্ববাসীকে বাস্তবে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, রাজ্যের শাসক কেমন হতে হয় এবং তার দায়িত্ব ও ইখতিয়ারের গণ্ডি কি? তার অব্যবহিত পরে তাঁর সাহচর্য ধন্য এবং তাঁরই হাতে শিক্ষা-দীক্ষা প্রাপ্ত, তাঁর হাতে গড়া সর্বোত্তম মানব শ্রেণী অর্থাৎ সাহাবায়ে কিরাম তাঁর শিক্ষা অনুসারে সর্বোত্তম ব্যক্তিটি অর্থাৎ শাসক হওয়ার যোগ্যতম ব্যক্তিটিকে তাদের শাসকরূপে নির্বাচিত করেন। বাস্তব ক্ষেত্রে এই সর্বপ্রথম পৃথিবীর ইতিহাসে শয়তানের সেই ভোজবাজিটির অবসান ঘটলো যে, শাসক হওয়ার জন্যে অবশ্যই পূর্ববর্তী শাসকের উত্তরাধিকারী বা সন্তান হতে হবে। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-এর পর হযরত উমর ফারূক (রা)-এর নির্বাচনও যোগ্যতার ভিত্তিতেই হয় এবং তার পরে হযরত উছমান গনী (রা)-এর নির্বাচন যদিও বংশগত বা উত্তরাধিকারসূত্রে হয়নি, তবুও মুসলমানদের কোন কোন ব্যক্তি ও শ্রেণীর মনে এ ব্যাপারে কিছুটা অনীহার ভাব বিদ্যমান ছিল এবং উসমান (রা) তাঁর আত্মীয়-স্বজন ও স্বগোত্রীয় লোকদেরকে বিভিন্ন ব্যাপারে প্রাধান্য দিয়ে রেখেছিলেন।১ তাই তার শাসনামল বিক্ষোভমুক্ত ছিল না। তাই বলা যায়, হুযূর (সাঃ) রাসূল হিসাবে যেভাবে দীর্ঘ তেইশ বছরকাল তার আপন জীবনকে মানব জাতির পথ প্রদর্শনের জন্য নিয়োজিত রেখেছিলেন, ঠিক তেমনি ১ম হিজরী থেকে ২৩ হিজরী পর্যন্ত তার রাজ্য শাসনের আদর্শও সুদীর্ঘ ২৩ বছরকাল বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছে। যেভাবে হুযূর (সাঃ)-এর জীবনের নবুওয়াতী জীবনের তেইশটি বছর মানবজাতির অনুকরণীয় আদর্শ, ঠিক তেমনি তার মাদানী জীবন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) এবং হযরত উমর ফারুক (রা)-এর খিলাফত কালব্যাপী তেইশটি বছর বিশ্বের রাজন্যবর্গের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ স্বরূপ।

────────────────১. সত্যিকারের ইতিহাস বিচারে এ বক্তব্য আংশিক সত্য মাত্র। যেমন, হযরত উসমান (রা) তার যেসব আত্মীয় ও স্বগোত্রীয়কে প্রাধান্য দিয়েছিলেন বলে বলা হয়ে থাকে, তাদের অধিকাংশই তার খিলাফত আমলের পূর্ব থেকেই গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে অধিষ্ঠিত ছিলেন। গোত্রীয় জিহালত মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেই এসব প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছিল—অনুবাদক।

খিলাফতে রাশিদার পর মানবীয় দুর্বলতা এবং শয়তানী ভোজবাজি আবার উত্তরাধিকার সম্পর্কে শাসক হওয়ার জন্যে অপরিহার্য পূর্বশর্তের মর্যাদা দিয়ে দিল এবং আবার শাসক হওয়ার জন্যে যোগ্যতর লোকের স্থলে অযোগ্য পাত্ররাই পূর্ববর্তী শাসকের উত্তরাধিকারী হওয়ার ভিত্তিতে শাসক হওয়ার যোগ্যপাত্র বলে বিবেচিত হতে লাগলো। ফলে যোগ্য শাসকদের অযোগ্য উত্তরাধিকারীরাই শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে লাগলো। এ অযোগ্য লোকদেরকে পদচ্যুত করতে প্রচুর মেধাক্ষয় এবং কষ্ট ও নির্যাতন স্বীকার করতে হতো। অবশেষে এসব নির্যাতনে উত্যক্ত হয়ে লোকজন সেই গণতন্ত্রের দ্বারস্থ হলো—যা আজকাল ফ্রান্স, আমেরিকা প্রভৃতি দেশে দৃষ্ট হয়ে থাকে। অথচ প্রকৃতপক্ষে বংশগত উত্তরাধিকার ভিত্তিক রাজতন্ত্র যেমন মানবজাতির জন্যে অনিষ্টকর ছিল, তেমনি এসব গণতন্ত্রও মানব জাতির জন্যে উপাদেয় ও আশীর্বাদস্বরূপ হতে পারে না। মানব জাতির স্বভাবধর্মের সাথে পূর্ণ সঙ্গতিশীল এবং সর্বপ্রকারে উপাদেয় কেবল সেই রাজ্যশাসন পদ্ধতিই যা হিজরী শতকের প্রথম চতুর্থাংশ বিশ্ববাসীর সম্মুখে উপস্থাপিত করেছিল—যা গণতন্ত্র ও রাজতন্ত্রের মাঝামাঝি একটা ব্যবস্থা।

২৪
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণ সাধারণ ভোটে তিন অথবা পাঁচ বছরের জন্যে কোন এক ব্যক্তিকে তাদের শাসক নির্বাচিত—করে যাকে প্রেসিডেন্ট বা রাষ্ট্রপতি নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। একজন মানব দরদী রাষ্ট্রপতির যতটা শক্তি থাকা প্রয়োজন সাধারণত এ ব্যবস্থায় নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির সে ক্ষমতা থাকে না। সামান্য সামান্য ব্যাপারেও এ ব্যবস্থার রাষ্ট্রপতিকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যেন রাষ্ট্রের সত্যিকারের কোন কেন্দ্রীয় পরিচালকের শক্তি নেই এবং মূল শক্তি বহুধা বিভক্ত হয়ে সমগ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বাহ্যত এ রাষ্ট্র ব্যবস্থাটি খুবই চমকপ্রদ ও জনপ্রিয়। কেননা, এতে জনগণ আত্মনিয়ন্ত্রণের সুযোগ হাতে পায় এবং স্বৈরতন্ত্রের শক্তিকে দুর্বল দেখতে পেয়ে আনন্দবোধ করে। কিন্তু এতে তারা নিজেদের অনেক ক্ষতি সাধন করে থাকে। বল্গাহারা স্বাধীনতা এবং সর্বতোভাবে স্বাধীন আস্থা মানবীয় মর্যাদা রক্ষার অনুকূল প্রতিপন্ন হয় না। এ কারণেই ফ্রান্স, আমেরিকা প্রভৃতি গণতান্ত্রিক দেশে আধ্যাত্মিকতা উৎসন্নে গেছে। আধ্যাত্মিকতা ও ধর্মের শিক্ষাশ্রিত উঁচুদরের নৈতিকতা এমন কোন রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত থাকতেই পারে না, যেখানে গণতন্ত্রের তরঙ্গমালা উপচে পড়ছে। গণতন্ত্রের রাষ্ট্রব্যবস্থা মানুষকে এমনি বল্গাহীন করে তোলে যে, তা মানুষের বেশীক্ষণ আল্লাহমুখী ও আল্লাহ প্রেমিক হিসাবে কায়েম থাকতে দেয় না। নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হচ্ছে নাস্তিকতা ও ধর্মহীনতার চারণভূমি। মরুভূমিতে যখন শস্য উৎপন্ন হতে পারে না, পানি থেকে বের করে নিলে মাছ যেমন জীবন ধারণ করতে পারে না, অন্ধকার স্যাতসেঁতে স্থানে মানুষ যেভাবে সুস্থ থাকতে পারে না, তেমনি নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা চিন্তা-চেতনা, বিধি-নিষেধ ও ইবাদত-বন্দেগীর বিকাশ ঘটতে পারে না এবং আল্লাহ প্রদত্ত কোন ধর্মীয় ব্যবস্থা সেখানে বেশীক্ষণ জীবন্ত থাকতে পারে না। ধর্মের প্রাণ হচ্ছে আনুগত্য এবং সত্য ধর্মের আনুগত্য মানব চরিত্রের সেই মৌলিক স্পিরিটকে অক্ষুন্ন রাখে যে, প্রত্যেক সম্মানার্হ ঊর্ধ্বতম সত্তাকে যথাযথ সম্মান দেখাতে হবে এবং আল্লাহ্ তা‘আলা যেহেতু সর্বোচ্চ সত্তা এবং নিরংকুশ কামালিয়ত বা পূর্ণতা কেবল তারই, তাই তাঁর দরবারে সিজদারত হয়ে “সুবহানা রাব্বিয়াল আলা’এর স্বীকারোক্তি করা উচিত। দুনিয়ার প্রত্যেক নবী-রাসূল পথ-প্রদর্শকই এ সঙ্গত দাবীই করেছেন যে, হে মানব জাতি। আমার বিধি-নিষেধ মেনে নাও, আমার আনুগত্য কর। আর এটা অনস্বীকার্য যে, এ নবী-রাসূল, পথ-প্রদর্শকদের নিঃশর্ত অনুসরণ ও আনুগত্যের মাধ্যমেই মানব জাতি চিরদিন মঙ্গল ও সাফল্য লাভ করেছে এবং সর্বনিম্ন স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হয়েছে। তাই যে রাষ্ট্রব্যবস্থা এ উন্নত ব্যবস্থার জন্যে বিষতুল্য এবং মানুষকে বল্গাহারা করে দিতে প্রেরণা যোগায়, তার ফলাফল মানবজাতির জন্যে কখনো মঙ্গলজনক হতে পারে না। পৃথিবীর প্রতিটি পিতা তার সন্তানের আনুগত্য আশা করে এবং সন্তানের জন্যেও তার পিতার আনুগত্যে মঙ্গল নিহিত রয়েছে। প্রতিটি শিক্ষক তার শাগরিদের আনুগত্য চায়। প্রত্যেক পীর তার মুরীদের আনুগত্য চায় এবং শাগরিদ ও মুরীদের জন্যে তাদের শিক্ষক ও পীরের আনুগত্যেই মঙ্গল নিহিত। প্রতিটি নেতা তার দলীয় কর্মীর আনুগত্যের প্রত্যাশী এবং কর্মীর মঙ্গল নেতার আনুগত্যেই নিহিত। প্রতিটি সিপাহসালার যুদ্ধক্ষেত্রে তার সৈনিকের আনুগত্যের প্রত্যাশী এবং সৈনিকের মঙ্গলও তার সেনাপতির নিঃশর্ত আনুগত্যের মধ্যে নিহিত। গণতন্ত্রের সামগ্রিক প্রভাবে পুত্র তার পিতার, শাগরিদ তার উস্তাদের, মুরীদ তার পীরের, জনতা তার নেতার, সৈনিক তার সিপাহসালারের আনুগত্যকে একটি বোঝাস্বরূপ মনে করে এবং ধীরে ধীরে সে আনুগত্যের প্রবণতা বিনষ্ট হয়ে যায়। ফলে মানুষ নাস্তিকতা ও ধর্মহীনতার দিকে ঝুঁকে পড়ে যা তাকে মানবতার গণ্ডি থেকে বের করে পশুত্বের স্তরে নামিয়ে দিতে চায়। গণতন্ত্রের ব্যবস্থা যেহেতু ধর্ম বিরোধী প্রতিপন্ন হয়েছে তাই এ ব্যবস্থা দ্বারা ধর্মের যে পরিমাণ ক্ষতি সাধিত হবে, সুখ-শান্তি সেই পরিমাণই রাষ্ট্র ও জাতি থেকে বিদায় নেবে। কেননা, সত্যিকারের রাজনীতি ও সুখ-শান্তি কেবল ধর্মের মাধ্যমেই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। রাষ্ট্র এ ব্যাপারে কোনদিনই সাফল্যমণ্ডিত হতে পারেনি। আপন বাড়ীর গণ্ডিতে, নির্জন স্থানে বিজন বন বা মরুভূমিতে, পথে-ঘাটে প্রান্তরে মানুষ রাষ্ট্রের ক্ষমতা বা পুলিশের আওতা থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন থাকে। এ সব ক্ষেত্রে মানুষকে চুরি-ডাকাতি, রাহাজানি, ব্যভিচার প্রভৃতি পাপাচার থেকে একমাত্র ধর্মই নিবৃত্ত রাখতে পারে। রাষ্ট্র এ ব্যাপারে কিছুই করতে পারে না। সমগ্র বিশ্বের মানুষ যদি ধর্মহীন হয়ে যায়, তা হলে পৃথিবী চুরি, ডাকাতি, হত্যা, রাহাজানি, ব্যভিচার, মিথ্যাচার প্রভৃতি পাপাচারে পূর্ণ একটি জাহান্নামের রূপ পরিগ্রহ করবে।

ইউরোপ আমেরিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহে এমন কোন সৌন্দর্য আমরা দেখতে পাই না যদ্দরুন সঙ্গতভাবে আমরা ঈর্ষা করতে পারি। এসব দেশে ধর্মহীনতার জয়জয়কার। এদের সমাজ অশ্লীলতায় পূর্ণ। প্রতিশ্রুতিভঙ্গ, বিশ্বাসঘাতকতা, স্বার্থপরতা, মিথ্যাচার, প্রতারণা প্রভৃতি তাদের সমাজ জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কোন নেপোলিয়ন, কায়সার, উইলিয়াম, জুলিয়াস সীজার, তৈমুর, হ্যানিবল, সালাহউদ্দীন, সুলায়মান কানুনী, শেরশাহ, আলমগীর কস্মিনকালেও সৃষ্টি হতে পারে না বা সৃষ্টি হলেও বেঁচে থাকতে পারে না। এমন ব্যবস্থায় কোন খালিদ ইব্‌ন ওয়ালীদের জন্মগ্রহণ অসম্ভব ব্যাপার। মানুষের প্রতারিত হওয়ার এবং হীনম্মন্যতার শিকার হওয়ার সম্ভবত এটাই সর্বনিকৃষ্ট নমুনা যে, আজ আমরা অনেক মুসলিম সন্তানকেও পাশ্চাত্যের ঐ গণতন্ত্রের প্রত্যাশী লক্ষ্য করছি। অথচ এ ব্যবস্থাটি হচ্ছে ইসলামের সম্পূর্ণ পরিপন্থী এবং মানব জাতির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। মুসলমানদের এ প্রবণতার মূলে রয়েছে তাদের কাপুরুষতা ও হীনম্মন্যতা। ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং কুরআন হাদীস সম্পর্কে চিন্তাভাবনা না করার ফলেই এ হীনম্মন্যতার সৃষ্টি হয়েছে।

২৫
ব্যক্তিশাসন ও রাজতন্ত্র
যখন কোন ব্যক্তি রাজ্যের বা সিংহাসনের মালিক বনে বসে তখন রক্ত ও বংশের সম্পর্ক এবং সহজাত প্রবৃত্তি তাকে এ জন্যে উদ্বুদ্ধ করে যেন সে তার সন্তানকে তার ব্যক্তিগত সম্পদরাশির উত্তরাধিকারী করার সাথে সাথে তার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও সিংহাসনের উত্তরাধিকারী করে যায়। কিন্তু আসলে এটা তার ভুল বৈ কিছু নয়। কেননা, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা তার ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ছিল না বরং এটা ছিল একটা আমানত—যা দেশ ও জাতি তার উপর অর্পণ করে রেখেছিল। এ আমানতে খিয়ানত করে অপর কাউকে স্বেচ্ছায় তা হস্তান্তরিত করার অধিকার তাকে কে দিয়েছে? আমানত তার প্রকৃত মালিকের হাতেই প্রত্যর্পণ করতে হয়। তাই ঐ শাসকের পর শাসন ক্ষমতায় অন্য কাউকে আসীন করা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট জাতির দায়িত্ব। তা ঐ শাসকের দায়িত্ব নয়। কিন্তু বাদশাহ, খলীফা বা শাসক যেহেতু শক্তির সমস্ত উৎস ও কেন্দ্রের উপর ক্ষমতাবান থাকে তাই তাকে তার খিয়ানত থেকে বিরত রাখার জন্যে বিপুল সৎ সাহস ও মনোবলের প্রয়োজন। ইসলাম তার প্রতিটি অনুসারীর মধ্যে সেই সৎ সাহস ও মনোবল সৃষ্টি করতে চায় এবং হুযুর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ও কুরআনুল কারীম সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে তা সৃষ্টি করেও ছিলেন। মুসলমানরা ইসলামের শিক্ষা থেকে যতই দূরে সরে যেতে লাগলো ততই তাদের মধ্যে সেই সৎ সাহসের অভাব দেখা দিতে লাগলো এবং শেষ পর্যন্ত তারা তা হারিয়ে ফেললো-যা দ্বারা তারা শক্তিমান শাসকদেরকে খিয়ানত থেকে বিরত রাখতে পারতো। ফলে তারা শাসকদের খিয়ানতের কাছেই আত্মসমর্পণ করে বসলো। অবশেষে খিলাফতে রাশিদার সোনালী যুগে মিটে যাওয়া ব্যক্তিতন্ত্র বা রাজতন্ত্রের পুনরাবির্ভাব ঘটলো মুসলিম সমাজে। এ বদ রুসূমের কাছে আত্মসমর্পণের কুফলও অনেকবারই মুসলমানদেরকে হাড়ে হাড়ে ভুগতে হয়েছে। উত্তরাধিকারীদেরকে শাসনভার হস্তান্তরের এ কুপ্রথার ফলে অনেক সময় এমন সব অযোগ্য অকর্মণ্য লোক মুসলমানদের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে যাদের মামুলী ভদ্রলোকদের দরবারে বসার মত যোগ্যতাও ছিল না। অবশ্যই মুসলমানদের এমন একজন সুলতান বা খলীফা হওয়া উচিত—যিনি হবেন সমস্ত মুসলিম সমাজের যোগ্যতম ব্যক্তি বা অধিকাংশ মুসলমানের বা সকলের সমর্থনপুষ্ট ও সকলের দ্বারা নির্বাচিত। কোন ব্যক্তির সুলতান বা উত্তরাধিকারী হয়ে যাওয়াটা নিশ্চয়ই তার খলীফা হওয়ার যোগ্যতার নিশ্চিত প্রমাণ হতে পারে না।

মুসলমানদের মধ্যে যদি উত্তরাধিকারীদেরকে রাজ্যক্ষমতা হস্তান্তর তথা রাজতন্ত্রের এ কুপ্রথা জারি না হতো এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা খুলাফায়ে রাশিদীনের যুগের মতো পবিত্র আমানতের মর্যাদা নিয়ে অবশিষ্ট থাকতো তাহলে আজ ইসলামী হুকুমত ও মুসলমানদের বর্তমান দুরবস্থা আমাদের দেখতে হতো না। কিন্তু আল্লাহ্‌র মর্যী বুঝি এরূপই ছিল এবং অদৃষ্টের সে লিখনই বাস্তবায়িত হলো। মুসলিম সমাজ যদি গোড়াতেই এর বিরোধিতা করতো এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ব্যাপারটিকে সুসংরক্ষিত রাখতে ত্রুটি না করতো তা হলে প্রথম প্রথম হয়তো তাদেরকে এজন্যে বড় বড় ত্যাগ স্বীকার করতে হতো, তারপর কোন শাসকের এরূপ দুর্গতি হতো না যে নিজের পরে সে তার পুত্রকে শাসক মনোনীত করতে বা যুবরাজ বলে ঘোষণা করতে পারে।

হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-এর একাধিক পুত্র রাজ্য পরিচালনার যোগ্যতাসম্পন্ন ছিলেন। কিন্তু তাঁর দৃষ্টিতে যেহেতু উমর ফারূক (রা)-ই মুসলমানদের মধ্যে যোগ্যতম ব্যক্তি বিবেচিত হয়েছেন, তাই তিনি তাকে শাসক নিযুক্তির পক্ষেই মুসলমানদেরকে সুপারিশ করেন। হযরত উমর (রা)-এর পুত্র হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন উমর নিঃসন্দেহে মুসলমানদের খলীফা হওয়ার যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন। কিন্তু হযরত উমর (রা) যেহেতু রাজতন্ত্রের কুপ্রথাকে নির্মূল করতে আগ্রহী ছিলেন, তাই তিনি ওসীয়ত করে যান যেন অবশ্য তাঁর পুত্রকে খলীফা নির্বাচিত করা না হয়।

লোকে মূর্খতা ও অনভিজ্ঞতার দরুন ব্যক্তিতন্ত্র বা রাজতন্ত্রের কুফলাদি দর্শনে তার মৌল কারণ সম্পর্কে না জেনে সাধারণভাবেই এর বিরুদ্ধাচরণ করে গণতন্ত্রের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠে। ব্যক্তিতন্ত্র বা রাজতন্ত্রের যত কুফল আমাদের চোখে পড়ে তার মূল কারণ হচ্ছে রাজতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যক্তিগত উত্তরাধিকারে পর্যবসিত হয়ে পড়ে এবং শাসক নির্বাচিত করার জনগণের অধিকারকে ছিনিয়ে নেয়া হয়। তাই যুক্তির কথা হলো, আমরা অকল্যাণের আসল হেতু বা উৎস উত্তরাধিকারকে রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে হস্তক্ষেপের সুযোগ দেবো না এবং পিতার পর পুত্র যদি প্রকৃতপক্ষে সমাজের যোগ্যতম ব্যক্তি না হয়ে থাকে তবে অবশ্যই তাকে আমাদের শাসক হতে দেব না। আর যদি প্রকৃতপক্ষে সে ব্যক্তিটিই রাজ্যের বা জাতির যোগ্যতম ব্যক্তি হয়ে থাকে, তবে জনসাধারণের সম্মতি বা রায় পাওয়ার পরই কেবল শাসকরূপে বরণ করা হবে। এটা কোথাকার বুদ্ধিমানের কথা যে, একটি ভুলের কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে আরেকটি ভুলের শিকার হতে হবে। ব্যক্তিতন্ত্র বা রাজতন্ত্রে জনসাধারণের সৎ সাহসের অভাবের দরুনই বাদশাহদের জনগণকে শোষণ ও অত্যাচার করার সাহস বেড়ে যায়। কাউকে যোগ্যতম ব্যক্তি জেনে তার আনুগত্য করা এবং তার জুলুমের ভয়ে তার আনুগত্য করার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে। একথাটি হয়তো এভাবে বোধগম্য হতে পারে যে, হযরত উমর (রা)-এর কোন কোন প্রাদেশিক গভর্নর বলেন, আমাদের কাছে এরূপ মনে হতো, হযরত উমর (রা)-এর এক হাত আমাদের উপরের চোয়ালের উপর, এবং অপর হাত আমাদের নীচের চোয়ালের উপর রয়েছে। মনে হতো, আমরা যদি একটুও ব্যতিক্রম করি, তবে তিনি তৎক্ষণাৎ আমাদের উভয় চোয়াল টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিবেন। হযরত উমর ফারুক (রা)-এর আদেশ খালিদ ইব্‌ন ওয়ালীদের কাছে পৌঁছলো। তৎক্ষণাৎ তিনি প্রধান সেনাপতির পদ থেকে মামুলী সৈন্যের পর্যায়ে নেয়ে গেলেন। আর খালিদ ইব্‌ন ওয়ালীদের মতো বিজয়ী বীর বিনা বাক্য ব্যয়ে তা তাৎক্ষণিকভাবেই মেনে নিচ্ছেন। আবার অন্য দিকে দেখুন, প্রকাশ্য মিম্বরে উমর ফারূক (রা)-এর মত জাদরেল শাসককে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে, আর মামুলী প্রজা তার আমানতদারী ও বিশ্বস্ততার পরীক্ষা নিচ্ছে। জনৈক অবলা মহিলা মোহরানার ব্যাপারে হযরত উমর ফারুক (রা)-এর খুতবা শুনে নিঃসংকোচে আপত্তি উত্থাপন করছে আর খলীফাও মিম্বরের উপর দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে অঙ্গীকার ব্যক্ত করলেন যে, মদীনার রমণীরা যদি এভাবে তাঁকে ভুল ধরিয়ে দেয়, তবে তিনি অবশ্যই তাদের সঙ্গত আপত্তির মর্যাদা রক্ষা করবেন। এবার চিন্তা করুন, এ কেমন ধরনের আনুগত্য-যা হযরত উমর ফারুক (রা)-এর জনগণ তার সাথে দেখিয়েছে। অপরদিকে পরবর্তী যুগের মোগল বাদশাহদের প্রতি প্রজা-সাধারণের আনুগত্যের নমুনাও লক্ষ্য করুন। কেবল পাঞ্জাব, সিন্ধু, দাক্ষিণাত্য ও বাংলার মত দূরবর্তী অঞ্চলের স্বাধীনচেতা জনগণই তাদের ফরমানের বিরুদ্ধাচরণ করেনি, বরং আগ্রা, এলাহাবাদ ও দিল্লীতেও শাহী ফরমানের যথার্থ তামিল হতো না।

২৬
ব্যক্তি গণতান্ত্রিক সরকার
ইসলাম যে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চেয়েছে এবং যে ব্যবস্থার নমুনা ইসলামের প্রারম্ভিক যুগে পেশ করেছে তাকে ব্যক্তি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা বলা যেতে পারে। একে রাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের মাঝামাঝি রূপ বলা যেতে পারে। খলীফা নির্বাচনে সর্বস্তরের মুসলমানদের রায় প্রদানের সুযোগ থাকে। যোগ্যতম ব্যক্তিকে নির্বাচিত করার সম্ভাব্য সকল পন্থাই গ্রহণ করা যেতে পারে-যাতে যোগ্যতম ব্যক্তিটির নির্বাচন সুনিশ্চিত হতে পারে। কোন নতুন শাসনতন্ত্র বা রাষ্ট্রীয় আইন রচনার প্রয়োজনই মুসলমানদের নেই। কেননা কুরআন মজীদ ও সুন্নাতে নববী তাদের কাছে রয়েছে। তাই যোগ্যতম ব্যক্তিকে নির্বাচিত করাও তাদের জন্যে তেমন কোন কঠিন কাজ নয়। যে ব্যক্তি কুরআন হাদীস সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন এবং তার জীবন কুরআন-হাদীসের রঙে অনুরঞ্জিত তিনিই মুসলমানদের নেতা হওয়ার যোগ্যতম ব্যক্তি। কুরআন হাদীসের শিক্ষার আলোকে জাতি ও রাষ্ট্রকে পরিচালিত করা এবং সমাজ জীবনে আল্লাহ ও রাসূলের বিধি-নিষেধ কার্যকরী করাই হচ্ছে শাসকের দায়িত্ব। মুসলমান যদি তার নেতাকে বা শাসককে কুরআন-হাদীসের বিরুদ্ধাচরণ করতে দেখে তখনই সে তার ত্রুটি নির্দেশ করতে এবং তাকে রীতিমত বাধা দিতে পারে। কিন্তু তার কুরআন-হাদীসের পরিপন্থী নয় এমন সব বিষয় মেনে চলা প্রতিটি মুসলমানের উপর ফরয। তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের চিন্তা-ভাবনাও মনে আনা উচিত নয়। মুসলমানদের শাসক যদি কুরআন হাদীসের অনুশাসনের বিরুদ্ধাচরণ করে তবে তৎক্ষণাৎ পদচ্যুত করা যেতে পারে। কিন্তু তিনি যদি তার দায়িত্ব পালনে এবং দেশ ও জাতির সেবায় আল্লাহকে ভয় করে চলেন এবং সদিচ্ছার পরিচয় দেন, তবে তাঁর মত একজন অভিজ্ঞ ও বহুদর্শী, দেশ ও জাতি-হিতৈষী সৎ লোককে কেবল এজন্যে অপসারণ বা পদচ্যুত করা যে, ইতিপূর্বে তার শাসনামলের তিন বা পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে—চরম বোকামী বৈ কিছুই নয়। মুসলমানদের খলীফা প্রকৃতপক্ষে তাদের খাদিম, প্রহরী ও আমানতদার। তিনি যদি তাঁর দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে যেতে পারেন তাহলে কেন অযথা তাঁকে অপসারিত করতে যাবো এবং নবাগত অপর একজনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ঝামেলায় পড়তে যাবো? মুসলমানরা তাদের খলীফার দ্বারা আইন প্রণয়ন করায় না। মুসলমানরা আপন অর্থে খলীফাকে আয়াসে লিপ্ত হবার সুযোগও দিতে চায় না। মুসলমানদের খলীফা একটি অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ এবং ন্যায়সঙ্গত পদ্ধতিতে আমীর-উমরা তথা ধনাঢ্য ব্যক্তিদের নিকট থেকে প্রয়োজন অনুসারে ধনসম্পদ উশুল করে গরীব-মিসকীন, ইয়াতীম-অনাথদের ভরণ-পোষণে তা ব্যয় করবেন। মুসলমানদের রাজকোষের সমস্ত অর্থ মুসলিম জনগণের যৌথ মালিকানাধীন আর তা তাদের কল্যাণেই ব্যয়িত হবে। খলীফা বা সুলতানের এটা ব্যক্তিগত মালিকানা নয় যে, তিনি যথেচ্ছভাবে তা ব্যয় করতে পারবেন। মুসলিম শাসন ব্যবস্থায় যেহেতু ধনাঢ্য ব্যক্তিদের নিকট থেকে একটি সঙ্গত হারে কর উশুল করা হয় এবং তা অভাবীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়, তাই এখানে পুঁজিপতি ও শ্রমিকের দ্বন্দ্ব সৃষ্টিই হতে পারে না—যা গোটা পাশ্চাত্যকে আজ গ্রাস করে রেখেছে।

মুসলমানদের খলীফা একাধারে তাদের প্রহরী ও অভিভাবক। তিনি মুসলিম জনতার পিতাও, আবার পীর বা উস্তাদও। মুসলমানদের খলীফা একাধারে তাদের গৃহশিক্ষক এবং সিপাহসালারও। তিনি তাদের সেবক, আবার শাহানশাহও। যদি কোন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা দেখা দেয়, যেমন কোন দেশ আক্রমণের বা কোন জাতির সাথে যুদ্ধের প্রয়োজন দেখা দেয়, কোন জাতির সাথে সন্ধি করতে হয়, কারো সাহায্যার্থে সৈন্যবাহিনী প্রেরণের প্রয়োজন দেখা দেয়, মুসলমানদের প্রতিরক্ষা এবং দেশের নিরাপত্তার জন্যে কি পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে এমন প্রশ্ন দেখা দেয় তবে মুসলমানদের খলীফা অবশ্যই তাদের সাথে পরামর্শ করবেন। কেননা কুরআনুল কারীমে এরই নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু এ পরামর্শের উদ্দেশ্য এই নয় যে, সাধারণ মানুষ তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে খলীফার বা রাষ্ট্রপ্রধানের সিদ্ধান্তকে অচল করে দেবে এবং তাকে তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কাজ করতে বাধ্য করবে, বরং এ পরামর্শের উদ্দেশ্য হবে, খলীফা যেন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে তাদের সাহায্য লাভ করতে পারেন। অর্থাৎ খলীফা সকলের মতামত শুনবেন এবং পক্ষ-বিপক্ষের দলীল-প্রমাণ সম্পর্কে অবহিত হবেন এবং অবশেষে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে সে অনুযায়ী কার্যক্রম শুরু করে দেবেন।

وشاورهم في الامر فاذا عزمت فتوكل على الله .

এবং তাদের সাথে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারসমূহে পরামর্শ করবে এবং যখন কোন স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হবে, তখন আল্লাহর উপর নির্ভর করে কার্যক্রম শুরু করে দেবে।

ইসলাম উপরিউক্ত রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করার পক্ষপাতী। খিলাফতে রাশিদায় তারই নমুনা প্রত্যক্ষ করা যেতে পারে। খিলাফতে রাশিদার পর মুসলমানদের শাসন-ব্যবস্থা রাজতন্ত্রে পর্যবসিত হয়, কিন্তু এতদসত্ত্বেও ইসলামের শিক্ষার সৌন্দর্য এবং ইসলামী চরিত্রের প্রতিফলন অধিকাংশ রাষ্ট্রে এবং রাজবংশে সুস্পষ্ট পরিলক্ষিত হয়েছে এবং সামগ্রিকভাবে মুসলমানরা যে সুন্দর রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করেছে অন্যত্র তা পরিদৃষ্ট হয় না। ইউরোপ আমেরিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কস্মিনকালেও ইসলামের এ রাষ্ট্র ব্যবস্থার মুকাবিলা করতে পারবে না।

২৭
যেখান থেকে শুরু
সাধারণত মুসলমান ঐতিহাসিকগণ ইসলামের ইতিহাস প্রণয়নে আদম আলায়হিস্ সালাম থেকে বরং কেউ কেউ পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে লিখতে শুরু করেছেন। আমি আমার ইতিহাস হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম থেকে শুরু করছি। কেননা, হুযূর (সাঃ)-এর পূর্বেকার ইতিহাস সর্বতোভাবে সন্দেহমুক্ত নয়। তাঁর যুগের পূর্বে পৃথিবীতে ইতিহাস রচনার তেমন কোন ব্যবস্থা ছিলো না। সাধারণত নবী করীম (সাঃ) থেকেই ইসলামের ইতিহাসের সূচনা বলে ধরা হয়। কেননা, সাধারণ্যে হুযূর (সাঃ)-কেই ইসলামের প্রবর্তক বলে মনে করা হয়ে থাকে এবং তারই অনুসারীদেরকে মুসলমান বলা হয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর আদি মানব হযরত আদম আলাইহিস্ সালামের সময় থেকেই-ইসলাম দুনিয়াতে মওজুদ রয়েছে এবং এভাবেই চলে আসছে।

২৮
ইতিহাস ও ভূগোলের পারস্পরিক সম্পর্ক
ইতিহাসের সাথে নিঃসন্দেহে ভূগোলের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তাই সাম্প্রতিক কালে ইউরোপীয়ান ঐতিহাসিকদের অনুসরণে যেসব ইতিহাসগ্রন্থ লিখিত হয়েছে সেগুলোতে ইতিহাসের সাথে ভূগোলও জুড়ে দেয়া হয়েছে। হুযূর (সাঃ)-এর সীরাত রচয়িতাগণও আরবদেশের ভূগোলের ব্যাখ্যা প্রদান প্রতিপাদ্য বিষয়ের বুঝবার সুবিধার্থে সন্নিবেশিত করাকে জরুরী জ্ঞান করে থাকেন। কিন্তু আমি যেহেতু ইসলামের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লিখতে মনস্থ করেছি তাই ভাবলাম আমি যদি এর সাথে ভূগোলও জুড়ে দেই তাহলে গোটা বিশ্বের ভূগোলই তাতে সন্নিবেশিত করতে হবে। কেননা, মুসলমান এবং তাদের রাজত্ব প্রায় গোটা বিশ্বের সাথে সম্পর্কিত। সংক্ষেপে তা গ্রন্থবদ্ধ করা সুকঠিন ব্যাপার। তাই আমাকে এ সুধারণারই আশ্রয় নিতে হয়েছে যে, এ গ্রন্থের পাঠক নিশ্চয়ই ভূগোল সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিফহাল এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানচিত্র নিশ্চয়ই তাদের হাতের কাছে মওজুদ আছে তারা তা জোগাড় করে নিতে পারবেন। তবুও ইচ্ছা আছে স্থানে স্থানে কোন কোন দেশ ও প্রদেশের মানচিত্র সন্নিবেশিত করে দেব। জাহিলিয়াতের যুগ, আরবের বিভিন্ন জাতি, যেমন কুরায়শ, জাহিলিয়া যুগের প্রথা-পদ্ধতি প্রভৃতি ব্যাপারও এ গ্রন্থে ততো বিস্তারিত আলোচিত হবে না।

হুযূর (সাঃ)-এর জীবনী প্রণয়নে আমি সর্বাধিক নির্ভর করেছি হাদীসের প্রখ্যাত ছয়খানি গ্রন্থ সিহাহ সিত্তাহর উপর। হাদীসের কিতাবসমূহকে এ ব্যাপারে ইতিহাস গ্রন্থসমূহের উপর প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। ইতিহাস গ্রন্থসমূহের মধ্যে তারীখে তাবারী, তারীখুল কামিল, ইব্‌ন আসীর, তারীখে মাসউদী, তারীখে ইব্‌ন খালদূন, তারীখুল খুলাফা, সুয়ূতী প্রভৃতি গ্রন্থের মধ্যে সাধারণভাবে যা বিবৃত হয়েছে তা-ই লিপিবদ্ধ করেছি এবং এভাবে ইতিহাসের সর্বোত্তম সারবস্তু লিখে দিয়েছি। আব্বাসী খিলাফতের দুর্বলতা ও পতনের সূচনাতে যেসব দেশে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হয়েছে, সেসবের পৃথক পৃথকভাবে সমসাময়িক যুগের ঐতিহাসিকদের গ্রন্থাদি থেকে লিখে দিয়েছি। কোন কোন স্থানে খ্রিস্টান ঐতিহাসিকদের বরাত দিয়েছি এবং তাদের হুবহু পাঠও উদ্ধৃত করে দিয়েছি। কিন্তু তা কেবল প্রতিপাদ্য বিষয়ের সত্যতা প্রতিপন্ন করার জন্যে সাক্ষ্য স্বরূপই উদ্ধৃত করেছি। সাধারণভাবে আমার বিশ্বাস, খ্রিস্টান ঐতিহাসিকদের লিখিত ইতিহাস গ্রন্থাদি মুসলমান ঐতিহাসিকদের গ্রন্থাদির তুলনায় নেহাতই মামুলী ও ভাসাভাসা ধরনের। আমাদেরকে প্রকৃত সত্য উদ্ধারের এবং মনের সান্ত্বনা খোঁজার জন্য তাদের দিকে তাকানো আদৌ উচিত হবে না। কেননা, খ্রিস্টান ঐতিহাসিক মাত্রই রিওয়ায়াত বা বর্ণনার বিশুদ্ধতার ব্যাপারে অত্যন্ত বেপরোয়া এবং সীমাহীন অসতর্ক প্রতিপন্ন হয়েছেন। অপরদিকে তারা সমস্ত মেধা ও যোগ্যতাকে সিদ্ধান্ত প্রদানে ব্যয়িত করে ইতিহাসকে উপন্যাস ও কল্পকাহিনীতে পর্যবসিত করতেই ব্যস্ত থাকেন। মুসলমান ঐতিহাসিকগণ আল্লাহর ফযলে এ প্রবণতা থেকে অনেকাংশেই মুক্ত। আর এজন্যেই তারা বিশ্বস্ত সাক্ষ্যের মত আমাদেরকে অনেকটা সহায়তা প্রদান করতে পারেন।

এ ইতিহাস গ্রন্থখানি দ্বারা মুসলিম পাঠকগণ কিভাবে উপকৃত হবেন এবং এতে কোন্ কোন অংশ একটু মনোনিবেশ সহকারে অধ্যয়ন করতে হবে এবন্বিধ অনেক জরুরী ব্যাপারে পাঠক ধারণা অর্জন করতে পারবেন, যা পুস্তকটির উপসংহারে লিপিবদ্ধ করার ইচ্ছা রইলো। আল্লাহই তাওফীক দাতা।

২৯
প্রথম অধ্যায় আরব দেশ আরব দেশ
আরবের একটা মোটামুটি আলোচনা সর্বপ্রথমে এ জন্যই আবশ্যক যে, আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এই আরবেরই প্রসিদ্ধ মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং অপর বিখ্যাত নগরী মদীনাতে হিজরত করেন এবং তা-ই হয় শেষ পর্যন্ত ইসলামী রাষ্ট্রের আদি রাজধানী। আরবই সেই দেশ যার প্রায় সকল অধিবাসীই প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জীবদ্দশায়ই ইসলাম গ্রহণ করেন। এই সে আরব-যেখানে সর্বপ্রথম ইসলামের বিজয় কেতন উড়েছিল। এই আরবের ভাষাতেই পূর্ণাঙ্গ ওয়াহী এবং সর্বশেষ আসমানী কিতাব অবতীর্ণ হয়—যা দেশ, জাতি ও ভাষা নির্বিশেষে সকলের কিয়ামত পর্যন্ত কালের জন্য পূর্ণাঙ্গ দিক-দিশারী। এই আরবের মাটি থেকে পৃথিবীর দশ দিগন্ত ইসলামের আলো বিচ্ছুরিত হয়েছে। এ দেশেই রয়েছে পবিত্র কা‘বা ঘর—পৃথিবীর প্রতিটি দেশ থেকে প্রতিবছর মুসলমানরা যেখানে ছুটে আসে দলে দলে, আরাফাতের ময়দানে সকলে মিলে আল্লাহ্ তা‘আলার স্তুতি ও মুনাজাতে নিমগ্ন হয়। সেখানে রাজা-প্রজা ও আমীর-ফকীর সকলেরই একই বেশ, একই অবস্থা। আসমান যমীনের স্রষ্টার মহিমা ও আধিপত্যই সকলের মনমগজকে আচ্ছন্ন করে রাখে। এই সে আরব যা গোটা বিশ্বের উপর আধিপত্য বিস্তার করে এবং গোটা বিশ্বের জন্যে দিক-দিশারী ও হিদায়াতের দীপ্ত শিখা প্রতিপন্ন হয়।

৩০
অবস্থান ও ভূপ্রকৃতি
এশিয়ার মানচিত্রে দক্ষিণ দিকে ভারতবর্ষের পশ্চিম দিকে একটি বিশাল আয়তক্ষেত্রের মত উপদ্বীপ চোখে পড়ে। এরই নাম জাযীরাতুল আরব—আরব উপদ্বীপ বা আরব দেশ।

দেশটির পূর্বে পারস্য উপসাগর ও ওমান উপসাগর, দক্ষিণে আরব সাগর ও ভারত মহাসাগর, পশ্চিমে লোহিত সাগর ও সুয়েজখাল, উত্তরে সিরিয়া।

আরব দেশের আয়তন বার-তের লক্ষ বর্গমাইল যার মধ্যে পাঁচ লাখ বর্গমাইল কেবল ঊষর মরু অঞ্চল যেখানে কোনো বসতি নেই। সর্বাধিক খ্যাত মরুভূমিটি ‘আল রাবউল খালী বা আল-দাহ্‌না’ নামে পরিচিত। এর আয়তন আড়াই লাখ বর্গমাইল। এ বিশাল মরুভূমির উত্তরে বাহ্‌রায়নের আল-হাসায়া প্রদেশ। রাবউল খালীর দক্ষিণ-পূর্বে ওমান প্রদেশ। এর রাজধানী ও সর্বাধিক বিখ্যাত শহর হচ্ছে মাস্কট। এ প্রদেশটি ওমান উপসাগরের তীরে অবস্থিত। রাবউল খালীর দক্ষিণ-পূর্বে হাদরামাউত ও মাহ্‌রা প্রদেশ অবস্থিত। এগুলো আরব সাগর ও ভারত মহাসাগরের উপকূলবর্তী এলাকা। রাবউল খালীর দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রসিদ্ধ ইয়ামান প্রদেশ অবস্থিত। এ প্রদেশটির সর্বাধিক বিখ্যাত শহর হচ্ছে সাফার। এ প্রদেশটি ভারত মহাসাগর ও লোহিত সাগরের কূল ঘেঁষে অবস্থিত। এডেন ও হাদীদা বন্দর এ প্রদেশেই অবস্থিত। রাবউল খালীর পশ্চিমে এবং ইয়ামার উত্তরে নাজরান প্রদেশ অবস্থিত। লোহিত সাগরের কূল ঘেঁষে এ প্রদেশটির অবস্থান। ইসলামের অভ্যুদয় কালে এ প্রদেশটি ছিলো গোটা আরব দেশে খ্রিস্টানদের পাদপীঠ। রাবউল খালীর পশ্চিমে এবং নাজরানের উত্তরে আসীর প্রদেশ—যা লোহিত সাগরের উপকূলে অবস্থিত। নাজরান এবং আসীর প্রদেশদ্বয় ইয়ামানের অংশ হিসাবে গণ্য হয়ে থাকে। আসীরের উত্তরে লোহিত সাগরের কূলে একটি ছোট এলাকা হচ্ছে তিহামা—যা হিজাযের অন্তর্ভুক্ত অর্থাৎ তা হিজাযের দক্ষিণাংশ বলে গণ্য হয়ে থাকে। রাবউল খালীর উত্তরে বর্গাকৃতির বিশাল নজ্দ প্রদেশ অবস্থিত। এর পূর্বে বাহ্‌রায়ন প্রদেশ, পশ্চিমে হিজায প্রদেশ এবং উত্তরে সিরিয়া মরুভূমি অবস্থিত। নজদের দক্ষিণ-পূর্ব অংশের নাম হচ্ছে ইয়ামামা। নজদের পূর্বে এবং লোহিত সাগরের পশ্চিমে হিজায প্রদেশ অবস্থিত। মক্কা, মদীনা এবং জিদ্দা ও ইয়াম্বু বন্দরদ্বয় এই প্রদেশে অবস্থিত। হিজাযের পশ্চিমে এবং নজদের দক্ষিণ-পূর্বে একটি ছোট এলাকা হচ্ছে খায়বার। সিরিয়া, হিজায ও নজদের মধ্যবর্তী একটা এলাকা হচ্ছে হজ্‌র। রাবউল খালীর মধ্যে হাদরামাউত ও ইয়ামামার মধ্যে আল-আহকাফ হচ্ছে একটি প্রসিদ্ধ অনাবাদী ভূমি যা একদা আরব জাতির বাসস্থান ছিল। মানচিত্রে উপরিউক্ত স্থানসমূহের দিকে নযর বুলালে আরব দেশের প্রদেশসমূহ ও মশহুর এলাকাসমূহ সম্পর্কে সঠিক ধারণা জন্মে।

৩১
আবহাওয়া ও অধিবাসী
আরব দেশে কোন প্রসিদ্ধ বা উল্লেখযোগ্য নদ-নদী নেই। প্রায় গোটা দেশটাই ঊষর মরু ও অনুর্বর ভূমি নিয়ে গঠিত। সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকাসমূহে কিছু কিছু তরুলতা ও মানুষের বসবাস পরিলক্ষিত হয়। পানিশূন্যতা দেশটির মধ্যবর্তী এলাকাসমূহকে মানুষ বসবাসের অনুপযোগী এবং জীবন যাপন দুর্বিষহ রেখেছে। সমস্ত জনপদ সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকাসমূহে অবস্থিত। কেবল নজদের বিশাল প্রদেশটিই এর ব্যতিক্রম—যা রাবউল খালীর উত্তরে দেশের অভ্যন্তরভাগে অবস্থিত। নজ্‌দ হচ্ছে একটি মালভূমি -যাতে বিশালায়তন মরুভূমিসমূহও রয়েছে। নজদের এ মরুভূমিসমূহ একেবারে সিরিয়ার বিশাল মরুভূমিসমূহে গিয়ে মিশেছে। আরব দেশে স্থানে স্থানে পর্বতমালাও রয়েছে। কিন্তু তার একটিতেও তরুলতা নেই। লোহিত সাগরের উপকূলবর্তী ইয়ামান ও হিজায প্রদেশদ্বয় অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় অধিকতর শস্য-শ্যামল। সমগ্র আরব দেশের মোট জনসংখ্যা সোয়াকোটি বলা হয়ে থাকে। অন্য কথায় দেশটির প্রতি বর্গমাইলে মাত্র দশজন লোকের বসবাস। রৌদ্রের প্রখরতা খুব বেশি। এত প্রচণ্ড লু-হাওয়া দেশটির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় যে, এ হাওয়াকে সাইমুম বা বিষাক্ত বায়ু বলা হয়ে থাকে। মানুষ তো মানুষ, মরু হাওয়া যে প্রাণীটির একান্তই গা সওয়া সেই উটও এ হাওয়ার সম্মুখে তিষ্ঠাতে পারে না। লু-হাওয়ার এক ঝটকাতেই উট প্রাণ হারায়। উট সেখানে অত্যন্ত উপকারী পশু। শত শত মাইলের মধ্যে পথিকরা পানির নাম নিশানা পর্যন্ত পায় না। উট হচ্ছে মরুভূমির জাহাজ। এর পিঠে চড়েই বড় বড় সফর করতে হয়। খেজুর ছাড়া অন্য কোন উল্লেখযোগ্য ফসলও হয় না। সে দেশের অধিবাসীরা উটের দুধ ও খেজুর খেয়েই জীবন ধারণ করে। অধিবাসীদের এক বিরাট অংশ যাযাবর জীবন যাপন করে। এজন্যে দেশটিতে বড় বড় শহরের সংখ্যা নগণ্য। কবি হালী দেশটির চিত্র অংকন করেছেন এভাবে :

এক উপদ্বীপ ছাড়া আর কিছুই ছিলো না তো

কোনো দেশের সঙ্গে তার সংযোগ ছিলো না তো

কারো উপর ছিলো না যে তার শাসন-অধিকার-

সাধ্যও ছিলো না কারো তাকে শাসন করবার

তমুদ্দুনের কোনো ছায়া তখনো তাতে পড়েনি

প্রগতির পদচিহ্ন একটুও তাতে পড়েনি।

ছিলো না তার আবহাওয়াতে প্রাণের কোনো রেশ

হয়নি তাই সেখানটাতে সবুজের উন্মেষ

ছিলো না সেখানে এমন কোনো পাত্র গুণাধার

পারতো ঘটাতে হৃদয় মাঝে বিকাশ প্রতিভার

উষর মরু প্রান্তরে নেই শ্যামল পেলবতা

নেই বৃষ্টি অঝর ধারায় নেই নদী বহতা

দেশ ভরা কঙ্কর মাটি-বহে আগুন হাওয়া

লু-ঝড়ে অতিষ্ঠ জীবন যায় না কিছু পাওয়া

পাহাড় টিলায় দেশটি ভরা বিজন বিয়াবান

খেজুর বনের সমারোহ আছে নেই তাতে প্রাণ

খেত-খামারের চিহ্ন নেই, নেই শস্যের লেশ

সব মিলিয়ে এই তো ছিলো সেদিন আরব দেশ।

পুস্তকের কলেবর আরবের ভৌগোলিক বিবরণ সম্পর্কে আর অধিক লেখার অনুকূলে নয় বিধায় এখানেই এ প্রসঙ্গের ইতি টানছি।

৩২
আরবের প্রাচীন অধিবাসী
আরবদেশে প্রাচীনকাল থেকেই হযরত নূহ আলায়হিস সালামের পুত্র সামের বংশধরদের বাস ছিল। কাল হিসাবে ঐতিহাসিকগণ আরবের অধিবাসীদেরকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন। ১. আরবে বায়িদা, ২. আরবে আরিবা ও ৩. আরবে মুস্‌তারিবা।

আরবে বায়িদা বলতে সেসব জাতির লোকজনকে বোঝায় যারা প্রাচীনকালে আরবের আদি অধিবাসী ছিল। তাদের সকলেই ধ্বংস হয়ে গেছে। তাদের কোন বংশধর পৃথিবীতে আর অবশিষ্ট নেই। অনেকে আরবে আরিবা ও আরবে মুস্‌তারিবা এ উভয় গোষ্ঠীকে একই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত বলে অভিহিত করে এদের সম্মিলিত নাম দিয়েছেন আরবে বাকিয়া। তাঁদের মতে আরবের অধিবাসীরা দুই শ্রেণীভুক্ত : ১. আরবে বায়িদা ও ২. আরবে বাকিয়া।

আরবে বাকিয়া হচ্ছে তারা যারা এখনো আরব দেশে বাস করছে। তাদেরও দু’টি শ্রেণী, তারা ‘আরিবা ও মুস্‌তারিবা নামে অভিহিত। কেউ কেউ আরববাসীদেরকে চার শ্রেণীতে ভাগ করেছেন :১. আরবে বায়দা বা আরবে আরিবা, ২. আরবে মুস্‌তারিবা, ৩. আরবে তাবিয়া ও ৪. আরবে মুস্‌তা‘জিমা।

৩৩
আরবে বায়িদা
আরবে বায়িদা হচ্ছে ঐসব প্রাচীন অধিবাসী যাদের গোত্রগুলোর নাম হচ্ছে ‘আদ, ছামূদ আবীল, আমালিকা, তাসাম, জাদীস, উমায়ম, জুরহাম, হাদরামাউত, হাযুর, আবদে যাখাম প্রভৃতি। এরা সকলেই হযরত নূহের পৌত্র লায ইব্‌ন সামের বংশধর ছিল। গোটা আরব উপদ্বীপে তাদের রাজত্ব ছিল। এদের কোন কোন নৃপতি মিসর পর্যন্ত জয় করেছিলেন। এদের বিশদ বিবরণ ইতিহাসে পাওয়া যায় না। তবে নজ্‌দ, আহকাফ, হাদরামাউত ও ইয়ামানে এমন প্রাচীন তাদের ইমারতসমূহ, প্রত্নতত্ত্ব, পাথর স্তম্ভ, অলংকারাদি ও কাটা প্রস্তরাদি পাওয়া যায় যদ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, তাদের যুগে তারা অত্যন্ত শৌর্যবীর্যের অধিকারী ছিল। এদের মধ্যে ‘আদ গোত্রটি ছিল অত্যন্ত প্রসিদ্ধ। এরা আহকাফ সমতলে বসবাস করতো। সামের প্রপৌত্র ‘আদ ইব্‌ন আউস ইব্‌ন ইরাম ছিলেন এদের প্রথম নৃপতি—যার নামে গোটা গোত্রটি খ্যতিলাভ করে। তার ছিল তিন পুত্র :১. শাদ্দাদ, ২. শাদীদ ও ৩. ইরাম। এরা একের পর এক রাজ্যর অধিকারী হন। আল্লামা যামাখশারী এই শাদ্দাস ইব্‌ন ‘আদ সম্পর্কে লিখেন যে, সেই আদন মরুভূমিতে ইরাম নগরীর পত্তন করেছিল। কিন্তু তার কোন নিদর্শনই এখন আর অবশিষ্ট নেই। কুরআন শরীফেও ইরামের উল্লেখ আছে, কিন্তু তা’ আরাম নগরী বা ইরাম বাগিচা নয়, তা হচ্ছে ইরাম গোত্র।

আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেন—

أَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِعَادٍ . إِرَمَ ذَاتِ الْعِمَادِ . الَّتِي لَمْ يُخْلَقْ مِثْلُهَا فِي الْبِلَادِ .

তুমি কী দেখনি তোমার রব ‘আদ-ইরামের লোকদের সাথে কি আচরণ করেছেন-যাদের শারীরিক গঠন অবয়ব ও শক্তি-সামর্থ্য এমনি অদ্বিতীয় ছিলো যে, পৃথিবীর অন্য কোন জনপদে এমনটি সৃষ্টি করা হয়নি। (৮৯:৬-৮)

ঐতিহাসিক মাসউদী লিখেন : ‘আদের পূর্বে তার পিতা ‘আসও বাদশাহ ছিল। এ বংশেরই জনৈক নৃপতি জীরূন ইব্‌ন সাআদ ইব্‌ন ‘আদ ইব্‌ন আওস দামেশক বিজয় করে মর্মর পাথর এবং অন্যান্য বহু মূল্যবান পাথর দিয়ে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেছিল যার নামকরণ সে করেছিল ইরাম। ইব্‌ন আসাকিরও তার তারীখে দামিশ্‌ক বা দামেশকের ইতিহাস গ্রন্থে জীরূনের উল্লেখ করেছেন। হযরত হূদ আলায়হিস সালাম যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে ঐ আদ জাতির প্রতি নবীরূপে আবির্ভূত হন তখন তারা তার অবাধ্যতা করে আল্লাহর আযাবে ধ্বংস হয়। এর বিস্তারিত বর্ণনা কুরআন শরীফে রয়েছে। আদের পর আবীল আমালিকা, ছামুদ, আবদে যাখাম প্রভৃতি কবীলা রাজত্ব করে। অবশেষে ইয়ারিব ইব্‌ন কাহ্তান এদেরকে উৎখাত করে নতুন এক যুগের সূচনা করেন। ছামূদ গোত্র বা ছামূদ জাতির প্রতি নবী হয়ে আসেন হযরত সালিহ আলায়হিস সালাম। ছামূদ জাতির বাস ছিল হাজর এলাকায়। তাসাম এবং জাদীস কবীলাদ্বয়ের বাস ছিল ইয়ামামায়, আমালিকারা বাস করতো তিহামায়। জুরহাম গোত্র থাকতো ইয়ামানে। ইতিহাসে বলা হয়েছে যে, আরবের সকল গোত্রই হযরত নূহ (আ)-এর পুত্র সামের বংশধর। তাই এ গোত্রগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক সুস্পষ্টভাবে অনুধাবনের জন্যে ৫৪ নং পৃষ্ঠায় এদের বংশপঞ্জির রেখা সন্নিবেশিত হলো :

৩৪
আরবে ‘আরিবা
এরা কাহ্তানের বংশধর বলে গণ্য হন। কাহ্‌তানের পূর্ববর্তী নূহ (আ) পর্যন্ত এ বংশের কেউই আরবী ভাষী ছিলেন না। কাহ্‌তানের অধঃস্তন বংশধররাই সর্বপ্রথম আরবী ভাষায় কথা বলতে শুরু করেন। আর এ ভাষা তারা শিখেছিলেন আরবে বায়িদা থেকে। কাহ্তানের বংশধররা দু’ভাগে বিভক্ত :১. ইয়ামিনিয়া ও ২. সাবাইয়া।

কাহ্‌তানের বংশপঞ্জি নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে অনেক মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন ইনি আবির ইব্‌ন শালিখ ইব্‌ন আরাফাখশাদ ইব্‌ন সাম ইব্‌ন নূহ-এর পুত্র এবং ফালিগ ও ইয়াকতানের ভাই ছিলেন। কিন্তু তাওরাতে তার কোন উল্লেখ নেই। অবশ্য ফালিগ ও ইয়াকতানের উল্লেখ তাওরাতে রয়েছে। কারো কারো ধারণা কাহ্‌তান ইয়াকতানেরই আরবী রূপ। অন্য কথায় যাকে ইয়াকতান বলা হযেছে তিনিই কাহ্‌তান। কারো কারো ধারণা, ইয়ামান ইব্‌ন কীদার ইব্‌ন ইসমাঈল (আ)-এর পুত্র ছিলেন কাহ্‌তান। ইব্‌ন হিশাম বলেন, ইয়ারিব ইব্‌ন কাহ্‌তানকে ইয়ামানও বলা হতো এবং তাঁরই নামানুসার ইয়ামান দেশের নামকরণ করা হয়েছে। কাহ্‌তান যদি ইসমাঈল (আ)-এর বংশধর সাব্যস্ত হন, তাহলে গোটা আরবের অধিবাসীরা ইসমাঈল (আ)-এর বংশধর প্রতিপন্ন হন। কেননা, আদনান এবং কাহ্‌তান এ দু’জনই আরব জাতির আদি বংশধর। কিন্তু গবেষণা দ্বারা প্রতীয়মান হয় এবং এটা অধিকতর গ্রহণযোগ্য অভিমত যে, কাহ্‌তান এবং ইয়াকতান অভিন্ন ব্যক্তি। আর কাহ্‌তান ইসমাঈল বংশীয় নয়। আরব দেশে আরিবা বা কাহ্‌তানী বংশের বেশ কয়েকজন বড় বড় বাদশাহ হয়েছেন-গোটা আরব উপদ্বীপ জুড়ে যাদের রাজত্ব ছিল। কাহ্তানের পুত্র ইয়ারিব আরবে বায়িদার শেষ চিহ্নটুকু পর্যন্ত বিলুপ্ত করে দেন এবং তাদের গোটা বংশকে নিশ্চিহ্ন করে দেন। বনী কাহ্‌তানের সংক্ষিপ্ত কুলপঞ্জি ৫১ নং পৃষ্ঠায় সন্নিবেশিত করা হলো।

৩৫
সামের বংশ তালিকা
[এখানে হার্ড কপি বইয়ে ছবি ছিল]

৩৬
বনী কাহ্‌তানের সংক্ষিপ্ত কুলপঞ্জী নিম্নরূপ
[এখানে হার্ড কপি বইয়ে ছবি ছিল]

কাহ্তানী গোত্রসমূহের কেন্দ্রভূমি বা আদি নিবাস ইয়ামান ছিল বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। এদের মধ্যে হিময়ারী ও ইযদী গোত্র অত্যন্ত বিখ্যাত বলে গণ্য হতো। সাবা শহর এবং দক্ষিণ আরবে ইযদীদের রাজত্ব ছিল। ইয়ামান দেশের সমৃদ্ধি সাধনে এরা অত্যন্ত তৎপর ছিলেন। সুলায়মান আলায়হিস সালামের সমসাময়িক বিলকীস রানী এদেরই বংশের লোক ছিলেন। ইয়ামান ও হাদরামাউতের শাসক মালকূক তাবাইয়াও এদেরই লোক ছিলেন। ইযদের একটি গোত্র মদীনায় এসে বসবাস শুরু করে এবং সেখানে তাদের রাজত্ব গড়ে তোলে। খোযাআ গোত্রীয়রা মক্কার দিকে মনোনিবেশ করে এবং সেখানে পূর্ব থেকে রাজত্বকারী জুরহাম গোত্রকে পরাভূত করে। ইযদের পুত্র নাসর তিহামা অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। খোযাআর এক পুত্র ইমরান ওমানে গিয়ে বসতি স্থাপন করেন। তার বংশধর ইযদে ওমান নামে খ্যাতি লাভ করে। তার অপর পুত্র গাস্‌সান সিরিয়া সীমান্তে গিয়ে বসতি স্থাপন করে এবং সীমান্তবর্তী কবীলাসমূহকে পরাস্ত করে সেখানে স্বীয় রাজত্ব গড়ে তোলে। ইয়ামান কাহ্‌তানী বাদশাহদের রাজত্ব ঈসায়ী সপ্তম শতক পর্যন্ত কায়েম ছিল। গাস্‌সানের কাহ্‌তানী রাজত্বের সীমা রোমান সাম্রাজ্যের সীমা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। অপর দিকে হীরার কাহ্‌তানী রাজ্য পারস্য সাম্রাজ্যের প্রতিবেশী ছিল। ইসলামের আবির্ভাবকালে কাহ্‌তানী গোত্রগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল এবং গোটা আরব তারাই দাপটের সাথে শাসন করতো।

৩৭
আরবে মুস্‌তাআরিবা
বনু আদনান ও হযরত ইসমাঈল (আ)-এর বংশধর এ নামে পরিচিত। এরা বাহির থেকে এসে আরবে বসতি স্থাপন করেন। এজন্যেই এদেরকে আরবে মুস্তাআরিবা বা মিশ্র আরব নামে অভিহিত করা হয়। হযরত ইবরাহীম (আ)-এর মাতৃভাষা ছিল আজমী তথা ফার্সী। তিনি যখন তাঁর পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ)-কে তার মা হাজেরাসহ মক্কা মুয়ায্‌যমায় (হিজাযে) রেখে যায়, তখন তিনি কাহ্‌তানী গোত্রের শাখা গোত্র জুরহামের নিকট থেকে আরবী ভাষা শিক্ষা করেন। এরা তখন মক্কায় বসত করতো। পরবর্তীকালে এই আরবীই হয় ইসমাঈল বংশীয়দের ভাষা। হযরত ইসমাঈল (আ)-এর পনের বছর বয়ঃক্রমকালে তার মা হাজেরার ইন্তিকাল হয়। মায়ের মৃত্যুর পর হযরত ইসমাঈল (আ) মক্কা থেকে সিরিয়ার দিকে চলে যেতে মনস্থ করেন। কিন্তু জুরহাম গোত্রের লোকজন পরামর্শক্রমে তাকে মক্কাত্যাগ থেকে বিরত রাখেন এবং আমালিকা গোত্রের আমারা বিন্‌ত সাঈদ ইব্‌ন উসামা ইব্‌ন আকীলের সাথে তার বিবাহ করিয়ে দেন। কিছু দিন পরেই সেখানে হযরত ইবরাহীম (আ) আগমন করলেন এবং তারই ইঙ্গিতে পুত্র ইসমাঈল তাঁর উক্ত স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেন। তারপর তিনি জুরহাম গোত্রের সাইয়িদা বিন্‌ত মাদাদ ইব্‌ন আমরের পাণি গ্রহণ করেন। এ ঘটনার পর আল্লাহর নির্দেশক্রমে হযরত ইবরাহীম (আ) ও হযরত ইসমাঈল (আ) হযরত আদম (আ)-এর যুগের ভিতের উপর খানাকা‘বা নির্মাণের কাজ শুরু করেন, এভাবে যে হযরত ইবরাহীম (আ) গাঁথুনী দিচ্ছিলেন আর হযরত ইসমাঈল (আ) পাথর ও মসলাদি তাঁকে উঠিয়ে দিচ্ছিলেন। উভয়ে তখন এভাবে দু‘আ করছিলেন :

رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا ۖ إِنَّكَ أَنْتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ .

হে আমাদের রব। আমাদের পক্ষ থেকে কবুল করুন! নিঃসন্দেহে আপনি সবকিছু শোনেন, সবকিছু জানেন। (২: ১২৭)

ফলে দেওয়াল কিছুটা উঁচু হলো এবং পুনঃ নির্মাণ কাজ কিছুটা কষ্টকর হয়ে উঠলো। তখন হযরত ইবরাহীম (আ) একটি পাথরের উপর দাঁড়িয়ে কাজ করতে লাগলেন। যে স্থানটিতে দাঁড়িয়ে ইবরাহীম (আ) কাজ করছিলেন, তা-ই মাকামে ইবরাহীম নামে খ্যাত। খানা কা‘বা নির্মাণ যখন সমাপ্ত প্রায়, তখন হযরত ইবরাহীম (আ) হযরত ইসমাঈল (আ)-কে বললেন, আচ্ছা একখণ্ড পাথর নিয়ে এসো, যাতে তা মাকামে রুকনের উপর রেখে দিয়ে লোকজনের জন্যে তা চিহ্নিত করে দিতে পারি। তখন হযরত ইসমাঈল (আ) হযরত জিবরাঈল (আ)-এর নির্দেশনা অনুসারে বূ-কুবায়স পাহাড় থেকে হাজরে আসওয়াদ উঠিয়ে নিয়ে আসেন। হযরত ইবরাহীম (আ) তা মাকামে রুকন-এর উপর স্থাপন করে দিলেন। এটাই সেই বিখ্যাত হাজরে আসওয়াদ বা কাল পাথর—তাওয়াফের সময় যার চুমু খাওয়া হয়। খানা কা‘বা পুনঃ নির্মাণের পর হযরত ইবরাহীম (আ) ও হযরত ইসমাঈল (আ)-এর প্রতি যে সমস্ত লোক ঈমান এনেছিল তাদেরকে নিয়ে মিনা ও আরাফাতের মাকামসমূহের দিকে যাত্রা করলেন। তারা কুরবানী করলেন এবং খানা কা‘বার তাওয়াফ করলেন। হযরত ইবরাহীম (আ) শাম দেশের দিকে চলে যান এবং যতকাল জীবিত ছিলেন প্রতিবছর খানা কা‘বার যিয়ারত ও হজ্জের জন্যে আসতেন। খানা কা‘বা পুনঃ নির্মাণের পর হযরত ইবরাহীম (আ) পুত্রকে কুরবানী করার জন্যে আদিষ্ট হয়েছিলেন।

হযরত ইসমাঈল (আ) শেষ জীবন পর্যন্ত মক্কা মুয়ায্‌যমায়ই বসবাস করেন। বনী জুরহাম কবীলা (এরা জুরহাম সাথী নামে অভিহিত) মক্কা মুয়ায্‌যমায় এবং আমালিকা কবীলা মক্কার আশেপাশে বসবাস করতো (এরা আরবে বায়িদাভুক্ত আমালিকা নয়)। এ কবীলাদ্বয়ের কিছু লোক হযরত ইসমাঈল (আ)-এর প্রতি ঈমান এনেছিলেন। অনেকে তাদের পূর্বতন কুফরী ও নাস্তিকতায় লিপ্ত ছিল। তাওরাতের বিবরণ অনুযায়ী হযরত ইসমাঈল (আ) একশ সাঁইত্রিশ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বারজন পুত্র ছিলেন। এঁদের বংশধরদের সংখ্যা এতই বৃদ্ধি পেলো যে মক্কায় তাদের আর স্থান সঙ্কুলান হলো না। তারা গোটা হিজাযে ছড়িয়ে পড়লেন। কা‘বার রক্ষণাবেক্ষণ ও মক্কার কর্তৃত্ব সর্বদা এঁদেরই হাতে ন্যস্ত ছিল। হযরত ইসমাঈল (আ)-এর পুত্র কীদারের বংশধরদের মধ্যে আদনান নামক এক ব্যক্তির জন্ম হয়। বনী ইসমাঈলের প্রায় প্রত্যেকটি মাশহুর কবীলা এদেরকে নিয়ে গঠিত হয়েছে। এজন্যে আরবে-মুস্তাআরিবা বনী ইসমাঈলকে আলে-আদনান বা আদনানের বংশ বলা হয়ে থাকে। আদনানের পুত্রের নাম মাআদ এবং পৌত্রের নাম নাযার ছিল। নাযারের চার পুত্র থেকেই আদনানী বংশের বিস্তার ঘটে। এ জন্যে আদনানী কবীলাকে মাআদী এবং নাযারীও বলা হয়ে থাকে। ৫৫ পৃষ্ঠায় বর্ণিত বংশপঞ্জি থেকে আদনানী বংশের বিভিন্ন শাখার পারস্পরিক সম্পর্ক বোঝা যায়।

৩৮
আদনানী গোত্রসমূহ
আদনানী গোত্রসমূহের মধ্যে আয়াদ, রবীআ ও মুদার গোত্রসমূহ সমধিক বিখ্যাত। এদের মধ্যেও শেষোক্ত দু’টি গোত্রের খ্যাতি বেশী। মানে মর্যাদায় এরা ছিল পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী। মুদারী গোত্রসমূহের অন্যতম গোত্র বনূ কিনানা গোত্রের ফিহ্‌র ইব্‌ন মালিকের অপর নাম ছিল কুরায়শ। উক্ত কুরায়শের বংশধরগণের মধ্যে অনেক কবীলার উদ্ভব হয়। এদের মধ্যে বনী সাহম, বনী মাখযুম, বনী হুমাহ্, বনী তায়েফ, বনী আদী, বনী আবদেদার, বনী যুহরা, বনী আবদে মানাফ সমধিক বিখ্যাত। আবদে মানাফের ছিল চার পুত্র, আবদে শামস্, নাওফিল, মুত্তালিব এবং হাশিম। হাশিমের বংশধরদের মধ্যে আমাদের নবী করীম হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আবদুল্লাহ ইব্‌ন আবদুল মুত্তালিব ইব্‌ন হাশিমের ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন। বিশ্বের যাবৎ মুসলমান তারই উম্মত এবং তিনি আখেরী যামানার নবী। এ গ্রন্থে তাঁরই উম্মতের বিবরণ দেয়ার প্রয়াস পেয়েছি। আবদে শামসের পুত্রের নাম ছিল উমাইয়া। বনী উমাইয়ারা তারই বংশধর। আদনানী গোত্রের লোকজন যখন বনী খোযায়ার হাতে পরাস্ত হয়ে মক্কা ছেড়ে যেতে বাধ্য হলো, তখন তারা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়লো। বনী বকর বাহ্‌রায়নে, বনী হানীফা ইয়ামামায়, বনী তাগলিব ফোরাত নদীর অববাহিকায়, বনী তামীম আলজাযীরায়, বনী সুলায়ম মদীনার আশেপাশে, বনী ছাকীফ তায়িফে, বনী উর কূফার পশ্চিম পাশে এবং বনী কিনানা তিহামায় গিয়ে বসতি স্থাপন করে। বনী আদনানের কবীলাসমূহের মধ্যে কেবল কুরায়শ গোত্রসমূহই মক্কা ও তার আশেপাশে রয়ে যায়, কিন্তু তাদের মধ্যেও তেমন ঐক্য-সম্প্রীতি ছিল না। এরা ছিল শতধা বিচ্ছিন্ন। কুসাঈ ইব্‌ন কিলাব এদেরকে ঐক্যবদ্ধ ও সংঘবদ্ধ করে (খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে) এমনি শক্তিশালী করে তোলেন যে, তারা কেবল মক্কায়ই নয়, গোটা হিজাযের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। খানা কা‘বার ব্যবস্থাপনা আবার বনী আদনানের করতলগত হয়। কুসাঈ খানা কা‘বা মেরামত করে এবং নিজের জন্য একটি মহল নির্মাণ করেন। ঐ মহলের একটি বিশালায়তন কক্ষ সামাজিক পরামর্শ কেন্দ্ররূপে ব্যবহৃত হতো। এ কক্ষটির নাম রাখা হয়েছিল দারুন নাদওয়া। দারুন নাদ্‌ওয়ায় বসেই কুসাঈ রাজকার্য পরিচালনা করতেন এবং কুরায়শ-সর্দাররা এখানেই পরামর্শের জন্যে জমায়েত হতেন।

কুসাঈ হজ্জের সময় মক্কার তীর্থযাত্রী হাজীদেরকে তিন দিন পর্যন্ত পানাহারে আপ্যায়নেরও ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন এবং এর ব্যয় সঙ্কুলানের জন্য কুরায়শদের নিকট থেকে চাঁদা সংগ্রহের ব্যবস্থা করেন। মোদ্দাকথা, কুসাঈ মক্কা তথা গোটা হিজাযের দীনী ও দুনিয়াবী কর্তৃত্বের অধিকারী হয়ে বসেন। ৪৮০ খ্রিস্টাব্দে কুসাঈ পরলোকগমন করেন এবং তাঁর পুত্র আবদুদদার তার স্থলাভিষিক্তরূপে মক্কার শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। আবদুদ্দারের মৃত্যুর পর তার পৌত্রদের এবং তার ভাই আবদে মানাফের পুত্রদের মধ্যে মক্কার শাসনক্ষমতা নিয়ে গোলযোগের সূত্রপাত হয়। কিন্তু প্রভাবশালী লোকেরা মধ্যস্থতা করে এভাবে এর ফায়সালা করে দেন যে, আবদে মানাফের পুত্র আবদে শামস পানি বিতরণ, চাঁদা ও কর উশুল এবং হাজীদের আপ্যায়নের দায়িত্ব পালন করবেন আর আবদে দারের পৌত্রগণ সামরিক ব্যবস্থাপনা, কা‘বা ঘরের হিফাযত এবং দারুন নাদওয়ার দেখাশোনা করবেন। কিছুদিন পর আবদে মানাফের পুত্র আবদে শামস তার অনুজ হাশিমকে তার রাজত্ব ও সমস্ত অধিকার ফিরিয়ে দেন। হাশিম তার ব্যবসা-বাণিজ্য, ধন-সম্পদ ও বদান্যতার জন্যে মক্কাবাসীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি কুরায়শদেরকে ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য অনুপ্রাণিত করে এবং তার সুযোগ করে দিয়ে তাদের প্রভূত উপকার সাধন করেন।

৩৯
আদনান
[এখানে হার্ড কপি বইয়ে ছবি ছিল]

৪০
আবদুল মুত্তালিব নামকরণের কারণ
হাশিম মদীনার জনৈক সর্দারের কন্যাকে বিবাহ করেন। তার গর্ভে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। নবজাতকের নাম রাখা হয় শায়বা। শায়বার শৈশবেই তার পিতা হাশিমের মৃত্যু হলে হাশিমের সহোদর মুত্তালিব মক্কার শাসক হন। হাশিমের শিশুপুত্র শায়বা মদীনায় প্রতিপালিত হন। শায়বার যৌবনে পদার্পণের সংবাদ পেয়ে মুত্তালিব তার ভাতিজাকে নিয়ে আসার জন্যে মদীনায় যান। তিনি যখন তার ভাতিজাটিকে নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করলেন, তখন মক্কার লোকে ভাবলো এ যুবকটি বনী মুত্তালিবের গোলাম হবে। মুত্তালিব তাদের এ ভ্রমের কথা অবগত হয়ে লোকজনকে উদ্দেশ্য করে বলেন যে, যুবকটি আমার ভাই হাশিমের পুত্র, আমার ভাতিজা। কিন্তু লোকজন তাকে আবদুল মুত্তালিব বা মুত্তালিবের গোলাম নামেই অভিহিত করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত শায়বা ইব্‌ন হাশিম আবদুল মুত্তালিব নামেই মশহুর হয়ে যান। উন্নত চালচলনে, মানে-মর্যাদায়, দানে বদান্যতায় আবদুল মুত্তালিব নিজেকে তাঁর পিতা হাশিমের সুযোগ্য পুত্ররূপে প্রতিষ্ঠিত করেন। কিন্তু উমাইয়া পুত্র হারবের তার প্রভাব-প্রতিপত্তি সহ্য হলো না। তিনিও তাঁর পিতার মত আবদুল মুত্তালিবকে যুদ্ধের জন্য চ্যালেঞ্জ দিয়ে বসলেন। এবারও যথারীতি সালিশ বসলো। সালিশের রায় আবদুল মুত্তালিবের পক্ষেই হলো। এ রায় বনী হাশিম ও বনী উমাইয়ার মধ্যে শত্রুতা বৃদ্ধি করলো। আবদুল মুত্তালিবের সময় হাবশার সৈন্যরা আবরাহা নামক সেনাপতির নেতৃতাধীন মক্কা আক্রমণ করে। এ বাহিনীই ইতিহাসে আসহাবুল ফীল বা হস্তীবাহিনী নামে অভিহিত হয়। আল্লাহর গযব তথা আসমানী আযাবে এ বাহিনী ধ্বংস হয়। কুরায়শদের পারস্পরিক সম্পর্ক ৫৭ নং পৃষ্ঠায় প্রদত্ত বংশপঞ্জি থেকে সুস্পষ্ট বোঝা যাবে।

৪১
ফিহ্‌র ইব্‌ন মালিক (কুরায়শ)
[এখানে হার্ড কপি বইয়ে ছবি ছিল]

৪২
আবদে মানাফের খান্দান
আবদে মানাফ গোটা আরব দেশে সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত ও অভিজাত বলে গণ্য হতেন। তার পরে তাঁর পুত্রগণও গোটা আরবে শ্রদ্ধার পাত্র বলে গণ্য হতেন। আবদে মানাফের আসল নাম ছিল মুগীরা। তাকে কমর ও সাইয়িদ নামেও অভিহিত করা হতো। যেহেতু তার অপর দুই সহোদরের নামে ছিল আবদে দার ও আবদে উজ্জা; তাই লোকে তাকে আবদে মানাত বলে ডাকতে থাকে।১ তারপর আবদে মানাত থেকে কালক্রমে তা আবদে মানাফে রূপান্তরিত হয়ে যায়।

─────────────────১. দার, উজ্জা ও মানাত আরবদের প্রাচীন আমলের মশহুর দেবদেবী। পাশাপাশি এদের নাম উচ্চারিত হতো বলে উক্ত দুই দেবতার পাশাপাশি মানাতের নাম যোগ করে তাকে আবদে মানাত বলা হতো। —অনুবাদক

৪৩
আরবের নৈতিক অবস্থা
পূর্বেই বলা হয়েছে, আরবদেশ প্রাচীনকাল থেকেই সামী খান্দান তথা সেমিটিক জাতির প্রতিপত্তি ছিল। প্রাথমিক যুগে আরবদের তথা আরবে বায়িদার বিবরণ খুব কমই জানা যায়। তাতে এ ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে কিছুই জানা যায় না যে, সমসাময়িকদের বিশ্বের অন্যান্য জাতির তুলনায় আরবে বায়িদার নৈতিক অবস্থা কী ছিলো। তবুও অনুমিত হয় যে, সেকালে গোটা বিশ্বের লোকসংখ্যা যখন মনুষ্য বসতির সংখ্যা ছিলো একান্তই অল্প তখন সকল জাতির অবস্থা প্রায় অভিন্নই ছিলো। বনী ইসমাঈল-এর উন্নতির পূর্বে আরবে বায়িদার পর কাহ্‌তানী আরবদের যুগে আরবদেশে অনেক রাজ্য ও রাজবংশের অস্তিত্ব ছিল বলে জানা যায়। কিন্তু কোন যুগেই গোটা আরব একই শাসনকর্তার অধীনে ছিল না। এক এক প্রদেশে এক একটি রাজবংশের বা রাজার রাজত্ব ছিল। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ বেশ যশস্বীও হয়েছেন। এতদসত্তেও দেশের অভ্যন্তরে স্বাধীনচেতা বেদুঈন পরিবারসমূহের উটের পিঠে তাঁবু ও গৃহসামগ্রী নিয়ে দূর-দূরান্তে পাড়ি জমাবার দৃশ্যও সাধারণভাবে পরিদৃষ্ট হতো পানি ও শস্য-সামগ্রীর অপর্যাপ্ততা আরবদেরকে আবহমানকাল থেকেই মরুচারী, কষ্ট-সহিষ্ণু যাযাবর জীবনে অভ্যস্ত করে রেখেছে। জীবনযাত্রার প্রয়োজনীয় দ্রব্যসম্ভারের অপর্যাপ্ততা তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতিকে অগ্রসর হতে দেয়নি। ফলে তাদের সমাজ জীবনে তেমন কোন পরিবর্তন বা সংস্কারের ছোঁয়া লাগেনি। বৈচিত্র্যহীন জীবনধারা ও নৈসর্গিক দৃশ্য তাদের জীবনকে একান্তই একঘেয়ে ও দুর্বিষহ করে রেখেছিল। দিগন্ত বিস্তৃত মরুভূমি, উৎপন্নজাত দ্রব্যাদির স্বল্পতা, মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রীর অভাব, জনসংখ্যা ও জনপদের স্বল্পতার দরুন বহির্বিশ্বের কোন দিগ্বিজয়ী শাসক বা বিজেতা জাতি কোন দিন আরব জয়ে প্রলুব্ধ হয়নি। পর্যটক বা বণিকদেরকে আকর্ষণ করার মত কোন সামগ্রীও এ উপদ্বীপে বর্তমান ছিল না। ফলে বহির্বিশ্বের জাতিসমূহের উন্নতি-প্রগতি সম্পর্কে আরবরা সাধারণভাবে অনবহিত ছিল। এজন্যে তারা অন্য কোন জাতির সভ্যতা-সংস্কৃতি ও সমাজব্যবস্থা দ্বারা প্রভাবান্বিতও হয়নি।

কবি হালী যথার্থই তাদের সম্পর্কে লিখেছেন :

نه وه غیر قوموں په چڑھ کر گیا تھا

نه اس پر کوئی غیر فرماں روا تھا

অপর জাতির তারা করেনি শাসন

অপরও পায়নি তার শাসক-আসন।

৪৪
বংশগরিমা
এমতাবস্থায় আরবদের মধ্যে স্বভাবতই দু’টি বস্তুর প্রসার ঘটে। দীর্ঘ অবসর ও রাতের উন্মুক্ত আকাশের নীচে কর্মহীন দীর্ঘ আকাশ তাদের মধ্যে কাব্যচর্চার উন্মেষ ঘটায়। দ্বিতীয়ত, স্বাধিকার রক্ষার অব্যাহত অনুশীলন ও সহিষ্ণুতার অভ্যাস তাদেরকে যুদ্ধবাজ ও কথায় কথায় শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার অভ্যাসে অভ্যস্ত করে তুলেছিল। পারস্পরিক যুদ্ধবিগ্রহকে জিইয়ে রাখার জন্যে তারা আত্মপ্রশংসা ও বংশগৌরব প্রকাশের দিকেও অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়ে। অহমিকা প্রকাশ ও নিজের মাহাত্ম্য প্রকাশের জন্যে বীরত্ব ও বদান্যতা ছিল দু’টি আকর্ষণীয় ব্যাপার। নিষ্ক্রিয়তা ও কাব্যিকতা তাদেরকে প্রেম নিবেদনে এবং তাদের সচ্ছল লোকদেরকে মদ্যপানে উদ্বুদ্ধ করে। বীরত্ব ও বদান্যতা তাদেরকে প্রথম শ্রেণীর অতিথিপরায়ণ এবং প্রতিশ্রুতি রক্ষায় অভ্যস্ত করে সকলের শ্রদ্ধাভাজন করে তোলে। জুয়া, তীরন্দাজী, মুশায়েরা (কবিসভা), বংশমর্যাদার অহমিকা প্রকাশ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রভৃতি ছিলো তাদের চিত্তবিনোদনের মাধ্যম। মোদ্দাকথা, আরবের নিঃসর্গ ও আবহাওয়া মনের অজান্তেই তাদের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত চরিত্র গড়ে তুলেছিলো। আরবে বায়িদার প্রতি হযরত হুদ আলায়হিস সালাম, হযরত সালিহ আলায়হিস সালাম প্রমুখ আম্বিয়ায়ে কিরাম প্রেরিত হন। এসব আম্বিয়ায়ে কিরামের প্রতি আনুগত্য না করায় সেই পর্যায়ের জনগোষ্ঠী উজাড় ও ধ্বংস হয়ে যায়। দ্বিতীয় পর্যায়ের অর্থাৎ কাহ্‌তানী আরবদের প্রতিও কতিপয় হিদায়াতকারী প্রেরিত হন। কিন্তু আরববাসীরা খুব কমই তাঁদের কথায় কর্ণপাত করেছে। ফলে পাপাচার, অবাধ্যতার জন্যে বারবার তাদের উপর ধ্বংস নেমে এসেছে। সেদেশের অধিবাসীদের পাপাচার ও বশ্যতাহীন প্রকৃতি তাদেরকে আম্বিয়ায়ে কিরামের শিক্ষা থেকে অনুগৃহীত হতে দেয়নি। হযরত ইবরাহীম (আ) ও হযরত ইসমাঈল (আ)-এর প্রতিও দেশের খুব কম সংখ্যক লোকই ঈমান এনেছিলো। তাদের বংশ নিয়ে অহমিকা এবং আত্ম-গৌরবের অভ্যাস ধর্মের ব্যাপারও তাদেরকে তাদের পূর্বপুরুষদের প্রশস্তির দিকে ঠেলে দিয়ে শেষ পর্যন্ত তাদের নামের প্রতিমাপূজায় অভ্যস্ত করে তুলেছিল। যখন কাহ্তানী কবীলাসমূহের প্রতিপত্তি লোপ পাচ্ছিল এবং বনী ইসমাঈল বা আদনানীদের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেতে শুরু করে তখন খুযায়া গোত্রের মক্কা আক্রমণ এবং জুরহাম গোত্রের বিপর্যয় আদনানী গোত্রসমূহকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আশ্রয়ের সন্ধানে ছড়িয়ে দিয়ে হিজাযে বনী ইসরাঈলদের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে সাংঘাতিকভাবে ব্যাহত করে। ফলশ্রুতিতে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে ও প্রদেশে আদনানী ও কাহ্‌তানী কবীলাসমূহকে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ করে। এভাবে গোটা আরব উপদ্বীপে ছোট ছোট গোত্রীয় রাজ্য ছাড়া কোন উল্লেখযোগ্য রাজ্য আর অবশিষ্ট থাকলো না। যদিও আরবের বড় বড় রাজ্যও অরাজকতামুক্ত ছিল না এবং কোন আরব শাসকেরই প্রজাদের উপর তেমন শক্ত নিয়ন্ত্রণ ছিল না যা পারস্যের কোন সাধারণ সামন্তরাজের বা রাজকর্মচারীর পারসিক প্রজাদের উপর নিয়ন্ত্রণের সাথে তুল্য ছিল। তখন ঐ অরাজকতা এবং কবীলাদের বল্গাহীন আযাদীর ঐ যুগে আরবদেশে সামাজিক অনাচার ও চারিত্রিক ব্যাধির দ্রুত প্রসার ঘটে। আরব দেশে ইসলামের অভ্যুদয় না ঘটা পর্যন্ত চারিত্রিক ব্যাধি ও অসামাজিক কার্যকলাপের প্রসার লাভ অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে।

আরববাসীদের বেশীর ভাগ লোকই যাযাবর জীবন-যাপন করতো এবং তাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক লোকই শহরে জনপদে স্থায়ীভাবে বসবাস করতো। আরববাসীরা তাদের বংশপঞ্জি অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে মুখস্থ ও সংরক্ষণ করতো। পিতৃপুরুষের নামধাম ও কীর্তি তারা গর্বসহকারে প্রকাশ করতো এবং একেই তারা যুদ্ধ-বিগ্রহে বীরত্ব প্রদর্শন ও উদ্দীপনা সৃষ্টির মাধ্যমরূপে ব্যবহার করতো। দেশের আবহাওয়ার প্রভাবেই হোক বা বংশপঞ্জি মুখস্থ রাখার আগ্রহেই হোক আরবদের স্মৃতিশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর। কয়েক শ’ পংক্তির কবিতা তারা দু’ একবার শুনেই অনায়াসে মুখস্থ বলে দিতে পারতো। কাব্যচর্চা তাদের ভাষাকে এমনি উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যায় যে, অত্যন্ত সঙ্গতভাবেই তারা অনারবদেরকে আজমী বা বোবা বলে অভিহিত করতো। কোন গোত্রের কেউ যদি অপর গোত্রের হাতে নিহত হত তার স্বগোত্রীয়ের কারো রক্তের বদলা নিতে না পারতো, তাহলে তার অস্থিরতার অবধি থাকতো না। হত্যার প্রতিশোধ না নিয়ে নির্বিকারভাবে বসে থাকা তাদের নিকট ছিল রীতিমত অপমানজনক ব্যাপার। খানা কা‘বার সাহায্য করা এবং অত্যাচারীর বিরুদ্ধে সোচ্চার ও সক্রিয় থাকা তাদের সমাজে একটি বড় গুণ বলে গণ্য হতো। কাপুরুষতা ও কৃপণতাকে তারা সর্বাধিক ঘৃণা করতো।

৪৫
শান্তির মাসসমূহ
বছরে এক বা একাধিক মাস তারা শান্তিকাল বলে নির্ধারিত করে রাখতো যখন যুদ্ধবিগ্রহ করাকে তারা অবৈধ জ্ঞান করতো। এ সময় সমস্ত যুদ্ধ-বিগ্রহ মুলতবি থাকতো। এ অবকাশে বসতো বড় বড় মেলা। অনুষ্ঠিত হতো মুশায়েরা বা কবিসভা। এ সুযোগে ব্যবসা-বাণিজ্যও তারা করে নিতো। এ-ই ছিল সেকালের আরব সমাজের গুণের দিক। এবার মুদ্রার অপর পিঠটাও দেখা যাক।

৪৬
ধর্মীয় অবস্থা
ইসলামের অভ্যুদয়ের পূর্বে আরবদের ধর্মীয় অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই যে, কোন কোন গোত্র স্রষ্টার অস্তিত্ব ও পরকালে বিশ্বাসী ছিলো না। তাদের কেউ কেউ স্রষ্টার অস্তিত্ব স্বীকার করলেও পরকালে এবং হিসাব-নিকাশে তারা বিশ্বাস করতো না। মূর্তিপূজক ও নক্ষত্র পূজারীদের সংখ্যা ছিলো প্রচুর। কোন কোন গোত্রের মধ্যে অগ্নি উপাসনারও প্রচলন ছিলো। খানা কা‘বাকে তারা মূর্তিপূজার কেন্দ্র বানিয়ে রেখেছিলো এবং সেখানে তারা তিন শ‘ ষাটটি মূর্তি স্থাপন করে রেখেছিলো। সিরিয়ার দিক থেকে কিছু সংখ্যক ইয়াহূদী এসে আরবে বসবাস করতে থাকে। হযরত মূসা (আ)-এর ইন্তিকালের অব্যবহিত পরেই এরা আরবে এসে বসবাস করতে শুরু করে। বনী কুরায়যা, বনী নযীর, বনী কায়নূকা প্রভৃতি ইয়াহূদী গোত্র ছিল সমধিক প্রসিদ্ধ। কিছু সংখ্যক খ্রিস্টানও আরব দেশে বসবাস করতো। এদের নিবাস ছিল গাস্‌সান ও নাজরানে। বনী খুযায়ার কিছু সংখ্যক লোকও খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়ে গিয়েছিলো।

৪৭
মূর্তিপূজা
আরবের সর্বত্র ব্যাপকভাবে মূর্তিপূজার প্রকাশ্য প্রচলন ছিলো। নবী করীম (সাঃ)-এর চার শ‘ বছর পূর্বে পারস্য সম্রাট শাপূরের শাসনামলে হিজাযের বাদশাহ আমর ইব্‌ন লুহায়্যি, সর্বপ্রথম খানা কা‘বার ছাদে হুবল নামের মূর্তি এবং যমযম কূপের ধারে আসাফ ও নায়িলা নামের দু’টি মূর্তি রেখে সেগুলোর পূজার জন্য লোকজনকে উৎসাহিত করে। ঐ ব্যক্তি কিয়ামত বা পরকালে বিশ্বাসী ছিলো না। এ ছাড়াও ইয়াগৃছ, ইয়াউক, নসর, উদ্দ, সুওয়া প্রভৃতির দেবমূর্তির পূজা করতে বিভিন্ন কবীলার লোকজন। প্রত্যেক কবীলার নিজস্ব স্বতন্ত্র দেবমূর্তি ছিলো। উদ্দের আকার ছিল পুরুষের। নায়িলার অবয়ব ছিল নারীর। সুওয়াও ছিল নারীমূর্তি। ইয়াগূছের অবয়ব ছিলো সিংহের। ইয়াউকের অবয়ব ছিল ঘোড়ার এবং নসর ছিল শকুনাকৃতির। তাসাম এবং জাদীসের দেবমূর্তি ছিল অভিন্ন। কালব গোত্র উদ্দের পূজারী ছিল। এটা দূমাতুল জান্দালে অবস্থিত ছিলো। বনূ তামীম পূজা করতো তায়মের। হুযায়ল গোত্রের পূজা ছিল ‘সুওয়া’। মুযজাহ এবং ইয়ামানের গোত্রসমূহ পূজা করতো ইয়াগূছের। হিমইয়ারের ‘যুলকিলা’ গোত্র পূজা করতো শকুনাকৃতির নসর দেবমূর্তির। হামদানরা ইয়াউক দেবমূর্তির আর বনী ছাকীফ গোত্র তায়িফে লাতের পূজা করতো।

বনী ছাকীফের একটি শাখাগোত্র বনী মুগীছ লাত দেবতার দ্বাররক্ষী নিযুক্ত ছিলো। কুরায়শ ও বনী কিনানা উয্‌যার পূজারী ছিলো। বনূ শায়বা ছিলো উয্‌যার দ্বাররক্ষী। আওস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয় পূজা করতো মানাফের। বনী হাওয়াযিন জিহার, বকর ও তাগলিব আউয়ালের, বনী বকর ইব্‌ন ওয়ায়িল মুহরিকের, বনী মালকান ইব্‌ন কিনানা সাআদ-এর, বনী আনতারা সাঈদ-এর, বনী খাওলান উমিয়ানূসের, বনী তাঈ রিযা-এর এবং দুওস গোত্র যুল-কাফফায়নের পূজো করতো। উপরোক্ত দেবমূর্তি ছাড়াও জারীশ, শারিক, আয়িম, মাদান, আওফ, মান্নাফ প্রভৃতি প্রসিদ্ধ দেবমূর্তি কোন-না-কোন গোত্রের দ্বারা পূজিত হতো। খানা কা‘বায় যখন মূর্তিপূজারীদের সমাবেশ হতো তখন কোন গোত্রের লোক নির্ধারিত দিনে কা‘বায় পৌঁছতে না পারলে তারা দাওলার নামে একটি প্রস্তর স্থাপন করে তার চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করতো। আরব দেশে খানা কা‘বার মত আরো কয়েকটি মূর্তিপূজার কেন্দ্র ছিল। গাত্‌ফান গোত্র একেবারে কা‘বার আকৃতির একটি তীর্থকেন্দ্র বানিয়ে নিয়েছিল। তারা এর নাম রেখেছিল লাইস। সেখানেও তারা হজ্জ পালন করতো। বনী খাশআম যুলখালিসা নামে অপর একটি তীর্থকেন্দ্র নির্মাণ করেছিল। সেখানেও অনুরূপ হজ্জ পালিত হতো। উহুদ পাহাড়ের পাদদেশে সাঈদা নামক একটি উপাসনালয় ছিল। আরবের মূর্তিপূজারীরা তারও হজ্জ পালন করতো। রবীআ গোত্রের উপাসনালয়ের নাম ছিল যুল-কা‘বাত। তারও তাওয়াফ করা হতো। নাজরানেও একটি গোত্রীয় উপাসনা মন্দির বিদ্যমান ছিল—যা তিন শ‘ চর্ম দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। ওটাকে বলা হতো নাজরানের কা‘বা। আরবের মূর্তিপূজারীরা কা‘বার মতো, ওটারও-যিয়ারত করতে ছুটে যেতো। অধিকন্তু তারা ওটাকে হারামও বানিয়ে রেখেছিল, অর্থাৎ কোন হত্যাকারী ব্যক্তি ওখানে আশ্রয় গ্রহণ করলে ওখানে সে নিরাপদে থাকতে পারতো। খানা কা‘বার ছাদে হুবল ব্যতীত শামস নামক অপর একটি মূর্তিও ছিল। হযরত ইবরাহীম (আ), হযরত ইসমাঈল (আ), হযরত ঈসা (আ) এবং হযরত মারয়াম (আ)-এর মূর্তিও খানা কা‘বায় পূজিত হতো।

৪৮
কুরবানী
পৌত্তলিকরা যখন হজ্জে আসতো, তখন তার কুরবানীর জন্যে উটও নিয়ে আসতো। সেসব উটের গলায় পরিচিতিস্বরূপ তারা জুতা লটকিয়ে দিতো এবং সেগুলোর কুঁজ যখম করে দিতো। তা দেখলেই লোকে বুঝতে পারতো যে এগুলো কুরবানীর উট। তখন কেউ আর এগুলোর কোন বিঘ্ন সৃষ্টি করতো না। উটের বাচ্চা, ভেড়া প্রভৃতি চতুষ্পদ জন্তু তারা মূর্তির নামে উৎসর্গ করতো। কোন কোন গোত্রের লোকজন এসব মূর্তির জন্যে নরবলি পর্যন্ত দিতো।

কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে আরবের মূর্তিপূজারীরা তাওহীদেও বিশ্বাসী ছিলো এবং এক আল্লাহকে জানতো। তারা উক্ত মূর্তিগুলোকে আল্লাহর দরবারে সুপারিশকারী জ্ঞানে পূজো করতো। এদের মধ্যে কোন কোন্ কবীলার লোকজনের এরূপ বিশ্বাস ছিলো যে কোন মৃত ব্যক্তির কবরে উটনী যবাই করে দিলে সেই উটনীর পিঠে সওয়ার হয়ে ঐ ব্যক্তি কিয়ামতের দিনে উত্থিত হবে। তাদের এ বিশ্বাস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তারা পুনরুত্থানে এবং শেষ বিচারে হিসাব-নিকাশে বিশ্বাসী ছিল।

৪৯
নক্ষত্র পূজা
জাহিলিয়াতের যুগে আরব দেশে নক্ষত্র পূজার ব্যাপক প্রচলন ছিলো। কিন্তু ঐতিহাসিকদের মতে এ ব্যাপারে কোন প্রমাণ নেই যে, আরব, মিসর, গ্রীস ও ইরান এ চারটি দেশের নক্ষত্রপূজারীদের মধ্যে কোন্ দেশের নক্ষত্রপূজারীরা উস্তাদ ছিল আর বাকী কোন্ তিনটি দেশের নক্ষত্রপূজারীরা তাদের শাগরিদ ছিল। মোটকথা, একথা বলা মুশকিল যে, নক্ষত্রপূজার প্রথাটি আরব দেশে বাহির থেকেই এসেছিল, নাকি তারাই এর মূল উদগাতা। হামীর গোত্র সূর্যের, কিনানা গোত্র চাঁদের, তামীম গোত্র ওহরানের, লুখাম ও জুযাম গোত্র বৃহস্পতি গ্রহের, তাঈ গোত্র সুহায়ল নামক নক্ষত্রের, কায়স গোত্র লুব্ধক নক্ষত্রের এবং আসাদ গোত্র বুধ গ্রহের পূজা করতো। অধিকাংশ গোত্রের দেবমূর্তির গ্রহ-নক্ষত্রের নামে নামকরণ করা হতো। প্রস্তর নির্মিত মূর্তিগুলো এবং বিখ্যাত গ্রহ-নক্ষত্রগুলোর পূজা বিভিন্ন গোত্র যৌথভাবেই করতো। গ্রহ-নক্ষত্রের উদয়াস্তের উপরই তাদের উল্লেখযোগ্য গোছের কাজগুলো করা নির্ভর করতো। মরুভূমির খোলা আকাশের নীচে বসতকারীদের জন্যে গ্রহ-নক্ষত্রের প্রতি এরূপ ঘনিষ্ঠতাবোধ করা, এগুলোর কোন কোনটার পূজায় লিপ্ত হওয়াটা বিচিত্র কিছু ছিলো না। কুরআন শরীফের সূরা নূহ পাঠে প্রতীয়মান হয় যে, হযরত নূহ (আ)-এর যুগে ইরাক-আরবে ইয়াগৃছ, ইয়াউক, উদ্দ, নসর, সুওয়া প্রভৃতির পূজা হতো। গ্রহ-নক্ষত্রের নামানুসারেই এসব দেবমূর্তির নামকরণ করা হয়েছিলো। এতে প্রতীয়মান হয় যে, নক্ষত্রপূজা প্রাচীনকাল থেকেই আরবে প্রচলিত ছিল। নক্ষত্রপূজারীদের মধ্যে চাঁদের পূজারী সংখ্যাই ছিলো সর্বাধিক এবং চাঁদই ছিল সর্বাধিক জনপ্রিয় উপাস্য।

৫০
কিহানত (ভবিষ্যত বলা)
আরবে কাহিন বা গণৎকারের সংখ্যা ছিলো প্রচুর। কাহিন বলা হতো ঐ সব লোককে যারা গুপ্ত রহস্য ও অদৃশ্য জগতের সংবাদাদি জানার দাবী করতো। যারা অতীতে সংঘটিত ব্যাপারসমূহের সংবাদ দিতো তাদেরকে কাহিন এবং যারা ভবিষ্যতের সংবাদ দিতো তাদেরকে আর্রাফ বলা হতো। অদৃশ্য জগতের সংবাদ যারা দিতো তাদের মধ্যে নারীপুরুষ উভয় শ্রেণীর লোকই ছিলো। আফআ, জাযীমা, আবরাশ, শিক, সাতীহ্ প্রমুখ ছিলো সেকালের আরবের নামকরা গণৎকার, গণৎকারদের একটি শ্রেণী ছিলো যাদেরকে নাযির বা দ্রষ্টা বলা হতো। এরা দর্পণে বা পানিভর্তি পাত্রে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে অদৃশ্য জগতের সংবাদ বলে দিতো অথবা পশুপক্ষীর অস্থি, যকৃত প্রভৃতি নিরীক্ষণ করে ভবিষ্যদ্বাণী করতো। এদের মধ্যে কঙ্কর নিক্ষেপকারী এবং বীজ নিক্ষেপকারী গণৎকারও ছিল। কিন্তু এদের মর্যাদা আর্রাফ এবং কাহিনদের চাইতে কম বলে গণ্য হতো। তাবীয বা ঝাঁড়ফুঁককারীদের মর্যাদা তাদের চাইতেও নীচে ছিলো।

৫১
ফাল–ভাগ্যপরীক্ষা
অন্ধকার যুগে আরবদেশে সুলক্ষণ এবং কুলক্ষণ পরীক্ষা করার বহুল প্রচলন ছিলো। কাককে তারা খুবই কুলক্ষুণে জ্ঞান করতো এবং একে বিচ্ছেদের হেতু বলে মনে করতো। আরবী ভাষায় কাককে যেহেতু শুরাব বলা হয়ে থাকে তাই মুসাফিরীকে তারা গুরবত এবং মুসাফিরকে গরীব বলে অভিহিত করে। অর্থাৎ তাদের ধারণা ছিল যে, কাকের প্রভাবেই মানুষ বিরহ-বিচ্ছেদের কবলে পড়ে দুর্ভোগের শিকার হয়ে থাকে। তারা পেচাকেও অত্যন্ত অলক্ষুণে জ্ঞান করতো। তাদের ধারণা ছিলো যে, পেচা শব্দ করলে মানুষের মৃত্যু ও ধ্বংস অনিবার্য। তারা হাঁচি দেওয়াকেও কুলক্ষুণে জ্ঞান করতো। তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোক যাদুকরও ছিল। তারা একে পেশা হিসাবে গ্রহণ করতো। অসাধ্য সাধনের উদ্দেশ্যে শয়তানকে বশীভূত করার জন্যে তারা অনেক কঠোর সাধনায় লিপ্ত হতো।

৫২
যুদ্ধপ্রীতি
অতি তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে কথায় কথায় তাদের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ শুরু হতো। আর একবার যুদ্ধের সূত্রপাত হলে তখন কয়েক পুরুষ এবং কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত তা অব্যাহত গতিতে চলতো। তাদের যুদ্ধসমূহের মধ্যে এমন কোন যুদ্ধের সন্ধান পাওয়া যায় না, যা কোন সঙ্গত কারণে বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে শুরু হয়েছিল। জাহিলিয়াত যুগের আরবদের যুদ্ধ-বিগ্রহের মধ্যে শ’ সোয়াশ’ যুদ্ধ অত্যন্ত বিখ্যাত। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বুআসের যুদ্ধ, কিলাবের যুদ্ধ, ফাতরাতের যুদ্ধ, নাখলার যুদ্ধ, কার্নের যুদ্ধ, সুবানের যুদ্ধ, হাতিবের যুদ্ধ প্রভৃতি। এ সব যুদ্ধে কোন পক্ষেরই কোন লাভ হয়নি, বরং উভয় পক্ষই জানে-মালে উৎসন্ন হয়েছে।

আরব জাহিলিয়াতের এটাও একটা রেওয়াজ ছিল যে, যখন তারা প্রতিপক্ষের উপর জয়ী হতো এবং তাদের স্ত্রীপুত্র-পরিজনকে বন্দী করতো তখন তারা নির্দ্বিধায় ঐসব অসহায় বন্দীকে হত্যা করতো। কিন্তু বন্দীদের কেউ যদি তাদের আহার্য থেকে কিছু খেয়ে নিত, তাহলে সে রক্ষা পেতো, তাকে আর হত্যা করা হতো না। তারা যাকে মুক্তি দিতে চাইতো প্রথমে তার মাথার চুল মুণ্ডন করে দিত। তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বযুদ্ধের বহুল প্রচলন ছিল। সারিবদ্ধভাবে লড়াইয়ের রেওয়াজ তাদের মধ্যে ছিল না। যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র ও ঘোড়ার দেখাশোনায় তারা খুবই মনোযোগী ছিল। অসি চালনা, তীরন্দাজী ও বল্লম নিক্ষেপে কৃতিত্বের অধিকারীদের সমাজে খুবই সম্মান ছিল। এ ধরনের লোকদের ডাকনাম দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তো। যুদ্ধ কৌশল ও যুদ্ধাস্ত্র পরিচালনার জন্যে কোন কোন গোত্রের খুবই খ্যাতি ছিল। বিশেষ বিশেষ তলোয়ার, বল্লম, ধনুক, ঘোড়া প্রভৃতির বিশেষ বিশেষ নাম রাখা হতো এবং ঐ নামে এগুলো গোটা দেশে পরিচিত ছিল। উদাহরণস্বরূপ হারছ ইব্‌ন আবূ শামর গাস্‌সানীর তলোয়ারের নাম ছিল খাযুম। আবদুল মুত্তালিব ইব্‌ন হাশিমের তলোয়ারের নাম আতশান এবং মালিক ইব্‌ন যুবায়েরের তলোয়ারের নাম ছিল যুন-নূন।

এসব দেখে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, আরবরা যুদ্ধ-বিগ্রহে অত্যন্ত উৎসাহী ছিল। এজন্যে ঘোড়া ও তরবারির আরবী প্রতিশব্দ হাজারটি পর্যন্ত বলা হয়ে থাকে।

৫৩
প্রেম-প্রীতি
আরব জাহিলিয়াতে পর্দার কোন বালাই ছিলো না। তাদের মহিলারা যথাযথভাবে পুরুষদের সম্মুখে আনাগোনা করতো। জীবন যাত্রার উপায়-উপকরণ ও ব্যস্ততার অভাব, বল্গাহীন চরিত্র ও মেজায, প্রচুর অবসর, কাব্যিকতা ও বংশগৌরব, উপরন্তু উত্তপ্ত আবহাওয়া ও নিঃসর্গ তাদের মধ্যে এ ব্যাধিরও জন্ম দেয়। জাহিলিয়াত আরব সমাজে ঐ ব্যক্তি চরম নীচ ও অভদ্র বলে বিবেচিত হতো যার কোন রমণীর সাথে কোন দিন প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। আরবের কোন কোন কবীলা প্রেমলীলার জন্যে বিখ্যাত ছিলো। উদাহরণস্বরূপ আযরা গোত্রের কথা বলা যেতে পারে। তাদের প্রেমলীলা এতই মশহুর ছিলো যে, আরবের একটি প্রবাদবাক্য অত্যন্ত মশহুর তা হলো : عشق من بنى عذرة । অর্থাৎ অমুক প্রেমলীলায় বনী উযরাকেও মাত করে দিয়েছে। জনৈক বেদুঈনকে তার পরিচয় জিজ্ঞেস করলে সে জবাবে বলেছিলো, আমি এমনি এক গোত্রের লোক যারা প্রেম করলে অনিবার্যভাবে সে প্রেমের জন্যে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে। জনৈক কিশোরী তা শুনে তাৎক্ষণিকভাবে মন্তব্য করলো : عذرى ورب الكعبة অর্থাৎ কা‘বার প্রভুর কসম, তুমি অবশ্যই আযরা গোত্রের লোক হবে।

৫৪
কাব্যচর্চা
আরব জাহিলিয়াতে এমন কোন লোক ছিলো না, যার মধ্যে কাব্যিকতা ছিল না। নারী-পুরুষ, আবাল-বৃদ্ধ বনিতা সকলেরই কিছু না কিছু কাব্যিকতার অধিকার ছিল যেন তারা মাতৃগর্ভ থেকেই কবি হয়ে আসতো। জন্মগতভাবেই তারা ছিল অলংকারসমৃদ্ধ ভাষার অধিকারী।

সাধারণত তাদের কবিতা হতো তাৎক্ষণিক ও স্বতঃস্ফূর্ত। কবিতা রচনার জন্যে চিন্তা-ভাবনা করা বা কষ্ট-কল্পনার আশ্রয় নেয়ার তাদের আদৌ প্রয়োজন হতো না। তাদের ভাষাসৌকর্য ও কাব্যিকতার এমনি গর্ব ছিল যে, গোটা বিশ্বের তাবৎ অনারব লোককে তারা বোবা জ্ঞান করতো। কিন্তু কুরআন শরীফ অবতীর্ণ হয়ে আরবদের সে দর্পকে চিরতরে চূর্ণ করে দেয়। শেষ পর্যন্ত সেই কাব্যিকতা ও ভাষা সৌকর্যের জন্যে দর্পকারী আরবরা আল্লাহর বাণীর অভূতপূর্ব ভাষাসৌকর্য ও লালিত্যের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়।

বার্ষিক মেলা উৎসব এবং হজ্জের সময় অনুষ্ঠিত মজলিসে মুশায়েরা বা কবিসভায় যার কবিতা সর্বোত্তম বলে সাব্যস্ত হতো রাতারাতি সে বিপুল মান-সম্মান ও যশের অধিকারী হয়ে পড়তো। একজন কবির সম্মান সে সমাজে একজন বীরপুরুষ বা রাজা-বাদশাহর সমান বা তার চাইতেও অধিক ছিল। আসলেও গোত্রে গোত্রে যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়া, কোন গোত্রকে অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শনে উদ্বুদ্ধ করা, যুদ্ধ অব্যাহত রাখা বা তার অবসান ঘটানো ছিল কবিদের বাম হাতের খেলা স্বরূপ। সর্বোত্তম কাসীদাগুলো খানা কা‘বায় লটকিয়ে দেয়া হতো। এমনি সাতটি কাসীদা ‘সাবয়ে মুআল্লাকা’ বা ঝুলন্ত কবিতা সপ্তক নামে বিখ্যাত। ইমরাউল কায়েস ইব্‌ন হাজার কিন্দী, যুবায়র ইব্‌ন আবূ সালমা মুযানী, লবীদ ইব্‌ন রবীআ, উমর ইব্‌ন কুলছুম, আন্‌তারা আবসী প্রমুখ কবির দ্বারা এগুলো রচিত হয়।

৫৫
শিকার
জাহিলিয়াত যুগের আরবরা ছিলো অত্যন্ত শিকার প্রিয়। এজন্যে আরবী ভাষায় শিকারের অনেক প্রতিশব্দ পাওয়া যায়। যে শিকার ডান দিক থেকে এসে বাম দিকে চলে যেতো তাকে বলা হতো সালিখ; আবার যে শিকার বাম দিক থেকে এসে ডান দিকে চলে যেতো তাকে বারিহ বলা হতো। যে শিকার সম্মুখ দিক থেকে আসে তাকে নাতিহ্ আবার যে শিকার পিছন দিক থেকে আসে তাকে ‘কাঈদ’ বলা হত। শিকারের জন্য শিকারী যেখানে ওঁৎ পেতে থাকে তাকে কুরাহ বলা হতো। আবার বাঘ শিকারের জন্যে যে গর্ত খনন করা হতো তাকে বলা হতো যাবিয়া। শিকার জন্তু লক্ষ্য করে পেটের উপর ভর দিয়ে মাটি কামড়ে এগিয়ে যাওয়াকে তালবুদ এবং শিকারীর ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে আসাকে আখদাক বলা হতো। তারা যা-ই শিকার করতো তা-ই নির্বিচারে খেয়ে নিত। হালাল হারামের কোন বাছ-বিচার করতো না। ইসলাম হারাম-হালালের শর্ত আরোপ করে এবং শিকারের মধ্যে নিয়ম-কানুন প্রবর্তন করে।

৫৬
পোশাক-পরিচ্ছদ ও খাবার-দাবার
আরব দেশে রেশম বা তুলা কিছুই উৎপন্ন হয় না। যদিও বা কোন প্রদেশে উৎপন্ন হয়, তাও পরিমাণে এতই অল্প যে দেশবাসীর প্রয়োজন তা মেটাতে পারে না। ইয়ামানে প্রাচীনকাল থেকেই বস্ত্র বয়ন হয়ে আসছে। সাধারণভাবে আরববাসীদের লেবাস-পোশাক অত্যন্ত সাদাসিধে ও অনাড়ম্বর ছিল। মোটা কাপড়ের জামায় চর্মের তালি লাগিয়ে পরা ছিল সাধারণ ব্যাপার। কেউ কেউ চামড়ার ছোট ছোট টুকরাকে সূচের দ্বারা ঢেকে নিয়ে চাদর বানিয়ে নিত। এ চাদর নির্দ্বিধায় তারা চাদর ও বিছানারূপে ব্যবহার করতো। উট ও ভেড়ার লোম দিয়েও কাপড় হতো। ঢিলেঢালা লম্বা কোর্তা ও লুঙ্গি এবং মাথায় রুমাল ও পাগড়ী ব্যবহারের প্রচলন ছিল। সুবাসিত কাঠ, আম্বর, লোবান ও কর্পূর প্রভৃতি সুগন্ধি ব্যবহার সম্পর্কেও তারা জ্ঞাত ছিল।

আরবদের আহার্যও ছিল অত্যন্ত সাদাসিধে ও আড়ম্বরবিহীন। নিরস বিস্বাদ খাদ্যেই তারা তৃপ্ত থাকতো। গোশত ছিল তাদের সবচাইতে প্রিয়, মূল্যবান ও সুস্বাদু খাদ্য। দুধ, গোশ্‌ত, চীনা প্রভৃতি ছিল দেশের সাধারণ খাদ্য। পনীর, যবের ছাতু, খেজুর, যয়তূন তৈল, হারীর প্রভৃতির ব্যবহারও চালু ছিল। টিড্ডি, ফড়িংও তারা খেতো-যা ঐ দেশে প্রচুর পাওয়া যেতো। আটা চালুনীতে ছেঁকে খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। বিনা ছাঁকা আটার রুটিও তারা রান্না করে খেতো। মরুভূমির শুশুকও তারা রান্না করে অত্যন্ত সুস্বাদু খাদ্যরূপে খেতো। পানাহারের রীতিনীতিও ছিল একান্তই সাদাসিধে। পানাহার সংক্রান্ত নবী করীম (সাঃ)-এর হাদীসসমূহে বর্ণিত বিধি-নিষেধসমূহ পাঠে সে সম্পর্কে একটি ধারণায় উপনীত হওয়া যায় যাতে অনেক প্রকার অশিষ্ট আচরণ করা হয়েছে। তাতে অধিক ভোজন, নির্লজ্জতা, নোংরামী এবং বাজে বকা থেকে বারণ করা হয়েছে।

৫৭
লুণ্ঠন ও রাহাজানি
উপরেই বলা হয়েছে আরবদেশে শহুরে জীবনে অভ্যস্ত ও যাযাবর এ দু’শ্রেণীর লোক বাস করতো। আর এদের মধ্যে যাযাবরদের সংখ্যাই ছিল অধিক। শহুরে লোকদের মধ্যে যদিও প্রতিবেশীর অধিকার সচেতনতা, বিশ্বস্ততা প্রভৃতি গুণ ছিল, তথাপি ব্যবসায় প্রতারণা প্রভৃতি অপরাধ প্রবণতা তাদের মধ্যে বিদ্যমান ছিলো। বেদুঈন শ্রেণীর লোকেরা ডাকাতি, রাহাজানি ও তস্করবৃত্তিতে ছিলো অত্যন্ত পাকা। পথচারীদেরকে লুটপাট করে তাদের যথাসর্বস্ব অপহরণ করা ছিলো সকলের সাধারণ অভ্যাস। কোন পথচারীকে নিঃসঙ্গ অবস্থায় পেলে তার যথাসর্বস্ব লুণ্ঠন করে তারা তাকে দাসরূপে বিক্রি করে দিত। পথিপার্শ্বের কূয়ো তৃণ গুল্মাদি দিয়ে এ উদ্দেশ্যে ঢেকে রাখা হতো যাতে পথিক পানির অভাবে মৃত্যুবরণ করে আর তার মালপত্র নির্বিবাদে হস্তগত করা যায়। তস্করবৃত্তিতে তারা ছিল পাকা উস্তাদ। কেউ কেউ তো চুরি বিদ্যায় এমনি পাকা ছিল যে, তাদের নাম প্রবাদ বাক্যের মত মশহুর ছিল। এদেরকে আরবের নেকড়ে বলা হতো।

৫৮
দাম্ভিকতা
দম্ভ ও অহংকারের নীচ প্রবৃত্তি জাহিলিয়াতের আরব সমাজে চরমে পৌঁছে ছিল। জাযীমা আবরাশের অহংকারের অবস্থাটি এই যে, সে কাউকে তার মন্ত্রী, উপদেষ্টা বা পারিষদ পর্যন্ত গ্রহণ করেনি। সে বলতো, আকাশের তারকারা হচ্ছে আমার সভাসদ, অন্য কোন সভাসদের আমার প্রয়োজন নেই। বনী মাখযুম গোত্রের লোকেরাও অহংকারের জন্য বিখ্যাত ছিল। অনুরূপভাবে আরও অনেক গোত্রের এ কুখ্যাতি ছিল। তৎকালীন আরবের কোন একটি গোত্রও এ ব্যাধি থেকে মুক্ত ছিল না। তাদের অহংকার ও দাম্ভিকতাই তাদের নবী-রাসূল হিদায়াতকারীদের ওয়ায-নসীহত শ্রবণের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তারা কোন হিদায়াতকারীর আনুগত্যকে দোষাবহ জ্ঞান করতো।

৫৯
বিদ্বেষ ও প্রতিশোধ স্পৃহা
যদি কোন হত্যাকারী বা প্রতিপক্ষের জীবদ্দশায় তাকে বাগে না পাওয়া যেতো, তাহলে তার পুত্র, পৌত্র বা নিকটাত্মীয়কে হত্যা করে তার প্রতিশোধ নেয়া হতো এবং প্রতিশোধ না নেওয়া পর্যন্ত অস্থিরতার অন্ত থাকতো না। শত্রুতার হেতু স্মরণ না থাকলেও শত্রুতা যে আছে তা কিন্তু বিলক্ষণ স্মরণ থাকতো। অনেকে শুধু এজন্যেই নিহত হতো যে, হত্যাকারী গোত্রের সাথে তাদের গোত্রীয় শত্রুতা আছে, কিন্তু সে শত্রুতার হেতু কি তা তারা বলতে পারতো না।

৬০
শোক বিলাপ
যখন কোন ব্যক্তির মৃত্যু হতো তখন তার নিকটাত্মীয়রা ললাট ঘর্ষণ করে এবং মাথার চুল ছিঁড়ে হায় হায় করে বিলাপ করতো। মহিলার চুলের বেণী খুলে মাথায় মাটি মেখে শবদেহের পিছু পিছু চলতো-যেমনটি ভারতের হিন্দুরা তাদের মৃতজনকের শোকে চুল ও গোঁফ দাড়ি মুণ্ডন করে শোক পালন করে থাকে। জাহিলিয়াতের যুগে আরবে মাতমকারিণী মহিলাদেরকে ভাড়া করে বিলাপের জন্যে নিয়ে আসা হতো। তারা অত্যন্ত জোরেশোরে ইনিয়ে বিনিয়ে বিলাপ করতো। দাফন কাফন শেষ করে বিলাপকারিণীদেরকে উত্তমরূপে আপ্যায়িত করা হতো। ইসলাম এসে সেসব জাহিলিয়াতের প্রথা-পদ্ধতির অবসান ঘটায়। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, ভারতবর্ষের মুসলমানদের মধ্যে মৃত্যুর তৃতীয় দিনে দশমী, চল্লিশতম দিনে চেহলাম, ষান্মাসিক এবং বার্ষিক শোক উৎসব করার কুসংস্কার এখনো চালু রয়েছে। আরব জাহিলিয়াতের প্রতিচ্ছবি আজো আমরা আমাদের চোখের সম্মুখে দেখতে পাচ্ছি। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

৬১
কুসংস্কার
জিন-পরী, দৈত্য-দানবেও জাহিলিয়াতের আরবরা বিশ্বাস করতো। তাদের বিশ্বাস ছিল যে, পরীরা পুরুষ লোকের প্রেমে পড়ে এবং জিন্‌রা নারীদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে। জিনদেরকে তারা অদৃশ্য জীবন বলে বিশ্বাস করতো। আবার সাথে সাথে এটাও বিশ্বাস করতো যে, অশরীরী আত্মার সাথে মানুষের জড়দেহের মিলনেও সন্তান ভূমিষ্ঠ হতে পারে। তাদের বিশ্বাস ছিল যে, জুরহাম মানুষ ও ফেরেশতার মিলনের ফসল ছিল। অনুরূপ ধারণা তারা সাবার রানী বিলকীস সম্পর্কেও পোষণ করতো। আমর ইব্‌ন ইয়ারবু’ সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিল যে, মানুষ ও প্রান্তরের ভূতের মিলনে তার জন্ম হয়েছিল। যে উষ্ট্রীর পাঁচটি শাবক হতো এবং তার পঞ্চমটি নর হতো তারা তার কান ছিদ্র করে দিয়ে তাকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দিতো। সে উষ্ট্রী যদৃচ্ছা ঘুরে বেড়াতে এবং যা ইচ্ছা খেতে পারতো, কেউ তাকে বাধা দিতো না। এমন উষ্ট্রীকে তারা ‘বহীরা’ বলে অভিহিত করতো। ভেড়ার নর শাবক হলে তারা তা’ দেবতার নামে বলি দিত। পক্ষান্তরে মাদী হলে তারা তা নিজেদের জন্যে রেখে দিতো। যদি ভেড়ার দুটো শাবক নর ও মাদী এক সাথে জন্মগ্রহণ করতো তবে এগুলো তারা কুরবানী দিতো না। তারা একে وصليه নামে অভিহিত করতো। যে উষ্ট্রের সহবাসে দশটি উষ্টছানার জন্ম হতো, তারা সেটাকে খুবই সম্ভ্রমের চোখে দেখতো। তারা তাতে মাল বোঝাই করতো না বা নিজেরা তাতে আরোহণ করতো না এবং ষাঁড়ের মতো স্বাধীন ছেড়ে দিতো। তারা এর নামকরণ করতে ‘হাম’ ( حام ) বলে। তারা মূর্তির সম্মুখে বা মূর্তিশালার দেউড়ীতে তিনটি তীর রেখে দিতো। তার একটাতে ‘না’ ও একটাতে ‘হাঁ’ লেখা থাকতো। এ তীরগুলো একটা তূণে থাকতো। যখন কোন বিশেষ উল্লেখযোগ্য ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজন দেখা দিত; তখন তারা তূণ থেকে একটা তীর উঠিয়ে দেখতো তাতে কি লেখা আছে। যদি তাতে ‘না’ লিখিত তীর উঠতো তবে তারা সে কাজ থেকে বিরত রইতো। আর ‘হাঁ’ লিখিত তীর উঠলে তাতে দেবতার সম্মতি আছে।

বলে তারা ধরে নিত। যদি তৃতীয় তীরটি উঠতো-যাতে কিছু লিখিত থাকতো না, তাহলে তারা পুনরায় তীর উঠাতো এবং যতক্ষণ ‘হাঁ’ লিখিত তীরের দ্বারা এভাবে দেবতার ইচ্ছা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে না পারতো ততক্ষণ পর্যন্ত এর পুনরাবৃত্তি করে যেতো।

কখনো কার্যব্যাপদেশে বাইরে যেতে হলে তারা ‘রতম’ নামক একটি বৃক্ষের ছোট্ট শাখায় একটা গাঁট দিয়ে যেতো এবং ফিরে এসে দেখতে যে, সে গাঁটটা ঠিক আছে, নাকি খুলে গেছে। ঘটনাক্রমে সে গাঁটটি কোন ভাবে খুলে গেলেই তারা ধরে নিত যে, নিশ্চয়ই ঐ ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রী কারো সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছে। গাঁটটি পূর্ববৎ থাকলেই কেবল স্ত্রীর সতীত্ব বহাল আছে বলে তারা বিশ্বাস করতো।

কোন ব্যক্তির মৃত্যু হলে তারা তার কবরে তার উষ্ট্রীকে চোখ বন্ধ করে বেঁধে রাখতো এবং উষ্ট্রীটির মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত এভাবেই তাকে বেঁধে রাখতো। অথবা ঐ উষ্ট্রীর মাথা পিছনের দিকে টেনে তার বুকের সাথে বেঁধে দিত এবং এভাবেই উষ্ট্রীর মৃত্যু হতো। তাদের ধারণা ছিল যে, তাতে পরকালে যখন ঐ মৃত ব্যক্তি কবর থেকে উত্থিত হবে তখন সে এ উষ্ট্রীটিতে আরোহণ করেই উঠতে পারবে। তাদের বিশ্বাস ছিল, যদি কোন ব্যক্তি কোন জনপদে গিয়ে সেখানকার মহামারী সম্পর্কে ভীত হয় আর সে ব্যক্তি সেই জনপদের দ্বারপথে দাঁড়িয়ে গাধার সুরে চিৎকার করে, তাহলে সে মহামারীর কবল থেকে রক্ষা পাবে। যখন কোন ব্যক্তির উটের সংখ্যা এক হাজার অতিক্রম করতো তাহলে পালের মোটা ষাড়টার দু’টি চোখ উপড়ে ফেলা হতো। তাদের ধারণা ছিল যে, এতে উটের পাল বদনযর থেকে রক্ষা পাবে। যখন কোন উটের খোস-পাঁচড়া হতো তখন সেই অসুস্থ উটের পরিবর্তে তারা সুস্থ উটের গায়ে দাগ দিতো এবং তাদের ধারণা ছিল যে, এভাবে অসুস্থ উটটির রোগ সেরে উঠবে। এ ব্যাপারে কবি নাবেগার উক্তিটি স্মরণ করা যেতে পারে :

حملت على ذنبه وتركته

كذا العز بكوى عيره وهو رائع

তার দোষের বোঝা আমার উপর চাপিয়ে দিয়ে তুমি তাকে ছেড়ে দিলে—যেমনটি পাঁচড়া রোগাক্রান্ত উটকে ছেড়ে দিয়ে চারণক্ষেত্রে বিচরণরত সুস্থ উটকে দাগ দেয়া হয়ে থাকে।

অনুরূপভাবে যখন কোন গাভী পানি পান না করতো তখন তারা ষাঁড়কে ধরে বেদম পিটাতো। তাদের ধারণা ছিল, ষাড়ের উপর জিন সওয়ার হয়ে গাভীকে পানি পানে বাধা দিয়ে থাকে। তাদের ধারণা ছিল যে, কোন নিহত ব্যক্তির রক্তের বদলা না নিলে তার মাথার খুপড়ী থেকে একটি পাখি বের হয়ে অস্থিরভাবে চীৎকার করতে থাকে এবং বলতে থাকে আমাকে পানি পান করাও, আমাকে পানি পান করাও এবং যতক্ষণ পর্যন্ত তার রক্তের শোধ নেয়া না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত সে ক্ষান্ত হয় না। তারা উক্ত কল্পিত পাখির নাম ঠাউরিয়েছিল ‘হামা’। তাদের ধারণা ছিল, প্রতিটি মানুষের পেটে একটি করে সাপ থাকে। যখন সে সাপটি ক্ষুধার্ত হয় তখন পাঁজরের হাড় থেকে সে গোশত খুলে খুলে যায়। তাদের ধারণা ছিল যে, যদি কোন মহিলার গর্ভজাত সন্তান মারা যায়, তাহলে সে মহিলা যদি কোন সম্ভ্রান্তধর্মী ব্যক্তির লাশকে উত্তমরূপে পদদলিত করে, তবে তার সন্তান বাঁচতে শুরু করবে। তাদের ধারণা ছিল যে, জিন-ভূতেরা খরগোশকে ভীষণ ভয় করে। তাই জিন-ভূতের কুপ্রভাব থেকে শিশুদেরকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে তারা খরগোশের হাড্ডি শিশুদের গলায় তাবীযস্বরূপ ঝুলিয়ে দিত।

৬২
কন্যা হত্যা
বনী তামীম এবং কুরায়শদের মধ্যে কন্যা হত্যার সমধিক প্রচলন ছিল। তারা এজন্যে রীতিমত গর্ববোধ করতো এবং একে তাদের জন্যে সম্মানের প্রতীক বলে বিশ্বাস করতো। কোন কোন পরিবারে এ পাষণ্ডতা এতদূর পর্যন্ত গড়িয়েছিল যে, মেয়েরা যখন বেশ বড় হয়ে যেতো এবং মিষ্টি কথা বলতে শুরু করতো, তখন পাঁচ ছ‘বছর বয়সে তাকে সুন্দর বেশভূষায় সজ্জিত করে পিতা তাকে লোকালয়ের বাইরে নিয়ে যেতো। পাষণ্ড পিতারা পূর্বেই সেখানে গিয়ে গর্ত খুঁড়ে আসতো এবং পরে মেয়েকে সেখানে নিয়ে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে গর্তে ফেলে দিত। অবোধ মেয়ে তখন অসহায় অবস্থায় চীৎকার করে করে বাপের সাহায্য চাইতো, কিন্তু পাষণ্ড পিতা তার দিকে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করে ঢিল ছুড়ে ছুড়ে তাকে হত্যা করতো বা জীবন্ত মাটি চাপা দিয়ে নিজ হাতে কবর সমান করে দিয়ে নির্বিকারে ঘরে ফিরে আসতো এবং এভাবে আপন কলিজার টুকরো সন্তানকে জীবন্ত প্রোথিত করার জন্যে সে রীতিমত গর্ববোধ করতো। বনী তামীমের জনৈক কায়স ইব্‌ন আসিম এভাবে একে একে তার দশটি কন্যাসন্তানকে জীবন্ত প্রোথিত করে। কন্যা হত্যার এ অমানুষিক বর্বরতা থেকে আরবের কোন কবীলাই মুক্ত ছিল না। তবে কোন কোন কবীলায় এটি অনেক বেশী হতো, আবার কোন কোন কবীলায় তা কম হতো।

৬৩
জুয়াখেলা
জাহিলিয়াতের যুগে আরবের অধিবাসীরা জুয়াখেলায় অত্যন্ত আগ্রহী ও অভ্যস্ত ছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আযলামের সাহায্যে জুয়াখেলা হতো। আযলাম ছিল জুয়াখেলার তীর বিশেষ। তাতে পালক সংযোজিত থাকতো না। সে তীরের সংখ্যা হতো দশটি। প্রত্যেকটি তীরের স্বতন্ত্র নাম থাকতো। নামগুলি ছিল এরূপ : (১) গুয, (২) তাওয়াম, (৩) রকীব, (৪) নাফিস, (৫) হাল্‌স, (৬) মুবাল, (৭) মুআল্লা, (৮) ফসীহ (৯) ফাইহী (১০) ওগাদ। প্রত্যেকটি তীরের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক ভাগ নির্ধারিত থাকতো। যেমন গুযের এক ভাগ, তাওয়ামের দু’ভাগ। এভাবে সপ্তম তীর পর্যন্ত এক এক ভাগ করে বৃদ্ধি পেয়ে সপ্তম তীরের ভাগ সংখ্যা থাকতো সাতটি। অবশিষ্ট তিনটি তীরের কোন ভাগ ছিল না। দশজন ধনী ব্যক্তি হৃষ্টপুষ্ট দেখে দশটি ছাগল কিনে এনে এগুলোকে যবাই করে আটাশ ভাগে বিভক্ত করতো। সমস্ত তীর একটি তূণে রেখে এক ব্যক্তির হাতে অর্পণ করা হতো এবং সে প্রত্যেককে একটি করে তীর দিতো। তারপর যার তীরে যত ভাগের চিহ্ন থাকতো সে তত ভাগ করে গোশত পেতো এবং শেষোক্ত তিনটি তীর যাদের হাতে পড়তো, তারা কিছুই পেতো না। তারা বঞ্চিত রইতো। খানা কা‘বার মধ্যে হুবল দেবতার সম্মুখে এ জুয়া খেলা হতো। জুয়ার আরেকটি পদ্ধতি ছিল এই যে, কিছু বালি এনে কোন বস্তু তার মধ্যে গোপন করা হতো। তারপর উক্ত বালির স্তূপকে দুভাগে ভাগ করে প্রশ্ন করা হতো, এবার বল দেখি বস্তুটি কোন্ স্তূপের মধ্যে রয়েছে। জিজ্ঞাসিত ব্যক্তি তা সঠিকভাবে বলে দিতে পারলে সে জুয়ায় জিতে যেতো, নতুবা সে হেরে যেতো।

৬৪
জাহিলিয়াতের যুগে আরব ও সমসাময়িক বিশ্ব
উপরে ইসলামের অভ্যুদয় ও নবী করীম (সাঃ)-এর নবুওয়াত লাভের প্রায় এক শ‘ বছর পূর্বে আরবের অধিবাসীদের নৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অবস্থার বিবরণ দেয়া হয়েছে। নবী করীম (সাঃ)-এর আগমন পর্যন্ত প্রায় একই অবস্থা বিরাজমান ছিলো। সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! একটু চিন্তা করে দেখুন, যাদের মধ্যে নবী করীম (সাঃ) প্রেরিত হলেন আর যারা ছিলো ইসলামের প্রথম সম্বোধিত মানবশ্রেণী, তাদের অবস্থা কত শোচনীয় ছিলো। পরবর্তী পৃষ্ঠাসমূহে রাসূলে আরাবীর শিক্ষাবলী এবং ইসলামের প্রভাবে আরবদের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের বিবরণ পাঠ করে তারা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন যে, নবী করীম (সাঃ)-এর আধ্যাত্মিকতা ও ইসলামের প্রভাব কী বিপুল শক্তির নাম। তাদের এ উপলব্ধি আরো যথার্থ হবে যখন তারা নবী করীম (সাঃ)-এর আবির্ভাবের সমসাময়িক যুগের বিশ্বের প্রতি একটি সামগ্রিক দৃষ্টি বুলিয়ে দেখবেন যে, ইসলাম গোটা বিশ্বের বুকে বিস্তার লাভ করে পৃথিবীর বুকে কী পরিবর্তন সাধন করেছে। তাই আরবদের উল্লিখিত বিবরণ প্রদানের পর জাহিলিয়াতের যুগে আরবদের সমসাময়িক বিশ্বের একটি মোটামুটি চিত্র সংক্ষেপে তুলে ধরা সমীচীন মনে করছি।

৬৫
ইরান
ইরান বিশ্বের অত্যন্ত প্রাচীন একটি সম্ভ্রান্ত দেশ বলে গণ্য হয়ে থাকে। প্রাচীনকালে এদেশে মাহ্ আবাদী ধর্ম প্রচলিত ছিল। ঐ প্রাচীন ধর্মটির অনেক সংস্কারকও সেদেশে জন্মগ্রহণ করে তাদের ধর্মের সংস্কারকার্যে ব্রতী হন। এর প্রথম পর্যায় শেষ না হতেই যরথুস্ত্র নতুনভাবে অগ্নি উপাসনার ধর্ম চালু করেন। এ ধর্মটিকে ‘মাহ্ আবাদী’ ধর্মেরই নতুন সংস্কারকৃত রূপ বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। যরথুস্ত্র সত্য ধর্মের প্রচারক বলে নিজের পরিচয় ব্যক্ত করেন। স্বল্পকালের মধ্যেই এ ধর্মটি ইরানী জনসাধারণ ও রাজ-রাজড়ার ধর্মে পরিণত হয়। সম্ভবত ইরানীরাই পৃথিবীতে সর্বাধিক উন্নতি লাভ করে। তাদের চরম উন্নতির যুগে তাদের রাজ্য ভূমধ্যসাগর এবং মিসর থেকে শুরু করে চীন ও মঙ্গোলিয়া পর্যন্ত এবং হিমালয় পর্বত ও পারস্য উপসাগর থেকে খাযর হ্রদ ও আলতাই পর্বত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো। সমগ্র এশিয়া মহাদেশে তাদের সংস্কৃতির জয়-জয়কার ছিলো। তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতি ও নৈতিকতা এশিয়ার প্রতিটি রাষ্ট্র ও জাতির কাছে অনুকরণ ও অনুসরণযোগ্য বলে বিবেচিত হতো। কিন্তু ইসলামের অভ্যুদয়কাল পর্যন্ত তাদের অবস্থা এতই শোচনীয় হয়ে পড়েছিলো যে, শিরকে লিপ্ত হওয়ার দরুন তারা একে একে তাদের সৌন্দর্য ও সকল সৌকর্য হারিয়ে বসেছিলো। যরথুস্ত্র খোদায়ী গুণসমূহে গুণান্বিত ধরে নিয়ে তারা তাকেও তাদের বাতিল উপাস্যদের তালিকায় শামিল করে নিয়েছিলো। মঙ্গল ও অমঙ্গলের দেবতারূপে তারা ইযদান ও আহরিমন নামে দুইজন দেবতার পূজা করতো। প্রকাশ্যে এবং অত্যন্ত জোরেশোরে আগুনের পূজা হতো। চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্রের পূজা ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিলো। দেশব্যাপী চুরি-রাহাজানিরও বেশ প্রকোপ ছিলো। ব্যভিচার এতই চরমে উঠেছিলো যে, মুযদাক নাহিনজার প্রকাশ্য রাজদরবারে ইরান সম্রাটকে তার রাজমহিষীর সাথে সঙ্গম করার পরামর্শ দেয়, অথচ ইরান অধিপতি তার অসঙ্গত ও নির্লজ্জ প্রস্তাবের বিরুদ্ধাচরণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। পারস্পরিক অনৈক্য ও হিংস্রতা, হানাহানি, হিংসা-বিদ্বেষ, প্রতারণা, সবলদের দুর্বলদেরকে পশুর চাইতে অধম জ্ঞান করার মত সামাজিক অনাচারগুলো তাদেরকে দুর্ভাগ্য ও পতনের দিকে এমনিভাবে ধাবিত করছিল যেমনটি বন্যার পানি নিচের দিকে ধাবিত হয়ে থাকে। ইরান যেনো তখন সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান, নৈতিকতা ও সভ্যতা-সংস্কৃতি শূন্য হয়ে পড়েছিলো। ফলে যে দেশটি একদা সভ্যতা-সংস্কৃতির কেন্দ্র ছিল, তাই যেন তমসাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলো। সে সময় দেশে কেবল যে নক্ষত্রপূজা ও অগ্নিপূজাই হতো তাই নয় বরং বাদশাহ, মন্ত্রীবর্গ, সিপাহসালার এবং আমীর-উমারারা পর্যন্ত নিরীহ প্রজাসাধারণ থেকে পূজা আদায় করে নিত। এ লাঞ্ছনা, বিড়ম্বনা ও তমসারাশি থেকে ইরানী রাষ্ট্র ও জাতি নিষ্কৃতি পেল তখনই যখন মুসলমানরা বিজয়ীর বেশে ইরান সীমায় প্রবেশ করলো।

৬৬
রোম ও গ্রীস
ইরানী সাম্রাজ্যের মুকাবিলায় পৃথিবীর অপর সর্বাধিক শক্তিধর শক্তি ছিল রোমান সাম্রাজ্য। রোম ও গ্রীসের সভ্যতা-সংস্কৃতিও অনেক-প্রাচীন ও গৌরবোজ্জ্বল এবং তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল বিশ্বজোড়া। চিকিৎসা বিজ্ঞান, গণিতশাস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান, তর্কশাস্ত্র, দর্শন ও বিজ্ঞানের উৎকর্ষতায় পৃথিবীর অন্য কোন দেশ গ্রীসের মুকাবিলা করতে পারেনি। এদেশেই সুকরাত১, বুকরাত লুকমান, আফলাতুন এবং আরাস্তুর মত বৈজ্ঞানিক, চিকিৎসাবিজ্ঞানী এবং সিকান্দরের মত দিগ্বিজয়ীর জন্ম হয়েছিল। গ্রীসের কায়জার, যার রাজধানী ছিল কনস্টান্টিনোপল, শুধু দেশের বাদশাহই ছিলেন না-একাধারে তিনি বাদশাহ ও ধর্মীয় নেতা বলে গণ্য হতেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানে ও জড়বাদী দিক থেকে এত উন্নতি অগ্রগতি সত্ত্বেও ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকের রোম ও গ্রীস অধঃপতনের এমনি অতল তলে চলে গিয়েছিল যে, ইরানের অধঃপতনকে তার তুলনায় বেশী বলা চলে না। ইরানের খাতকরা যেমন আত্মবিক্রি করে মহাজনদের ঋণ শোধ করতো, তেমনি গ্রীসেও ক্রীতদাস কয়েক ধরনের ছিল। তন্মধ্যে এক ধরনের ক্রীতদাস ছিল তারা যাদেরকে দেশের বাইরে নিয়ে বিক্রি করা চলতো না। কিন্তু সাধারণত ক্রীতদাসদেরকে বহির্দেশে নিয়ে ঠিক তেমনি বিক্রি করা হতো যেমনটি বিক্রি করা হতো গরু, বকরী, উট, ঘোড়া প্রভৃতি চতুষ্পদ জন্তু। মনিব ঠিক তেমনি ক্রীতদাসকে হত্যা করতে পারতো যেমনটি পারে কোন ব্যক্তি তার নিজের পশুপালের যে কোন পশুকে যখন ইচ্ছে যবেহ করতে। পিতা-মাতা তাদের সন্তানকে যথেচ্ছ বিক্রি করে দিয়ে অপরের গোলাম বানিয়ে দিতে পারতো। রোম ও গ্রীসে দাসদের বিয়ে করার অধিকার ছিলো না। তাদের এবং তাদের সন্তানদের মধ্যে আইনগত কোন সম্পর্ক সমাজে স্বীকৃত হতো না।

─────────────────১. টীকা : উর্দু-ফার্সী আরবী ভাষায় নামগুলো এভাবেই পরিচিত। আমাদের বাংলাভাষীরা ইংরেজি ভাষা ও সভ্যতার প্রভাবে এগুলোর ইংরেজি জানার সাথেই পরিচিতি বিধায় আমাদের কাছে এ নামগুলো হচ্ছে : ১. সক্রেটিস, ২. হিপোক্র্যাটস, ৩. প্লেটো ৪. (এরিস্টটল) ও ৫. আলেকজান্ডার—অনুবাদক।

৬৭
খ্রিস্টানদের অধঃপতন
হযরত ঈসা (আ)-এর দু’শ বছর পর পর্যন্ত খ্রিস্টানদের মধ্যে রাহিব বা সন্ন্যাসীদের কোন নাম-গন্ধ ছিলো না। কিন্তু ষষ্ঠ শতাব্দীতে সিরিয়া, গ্রীস ও রোমে এদের এতই আধিক্য দেখা দিলো যে, যে কেউ মান-সম্মান ও প্রতিপত্তির জন্যে লালায়িত হতো, সে-ই রাহবানিয়াত বা সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করতো। এরপর ধীরে ধীরে এ প্রবণতা নারীদের মধ্যেও সংক্রামিত হতে লাগলো। ফলে রাহিব পুরুষ ও রাহিব রমণীদের বাসস্থান গির্জাগুলো লজ্জাজনক কার্যকলাপের কেন্দ্রে পরিণত হলো। রাহিবদের কেউ কেউ প্রান্তরেও বাস করতো। নারীদের প্রাপ্য সম্ভ্রম ও অধিকার এবং পিতামাতার প্রতি ভক্তিশ্রদ্ধা একেবারেই উঠে গিয়েছিলো। চুরি, ব্যভিচার, প্রতারণা সমাজে এমনিভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল যে, কেউ এগুলোকে দূষণীয় বলেও মনে করতো না। এটা ছিলো রাহবানিয়াত বা সন্ন্যাসব্রতের বিস্তৃতিরই ফল। তওহীদ ও খোদাপরস্তির নাম-নিশানাও ছিলো না। সংসার ত্যাগী ধর্মীয় নেতা ও সন্ন্যাসীদের সন্তুষ্টি বিধানেই মুক্তির গ্যারান্টি বা সার্টিফিকেট হাসিল করা হতো। আমীর শ্রেণীর লোকেরা দরিদ্র জনসাধারণকে তাদের সেবক এবং গোলামরূপে ব্যবহারের বৈধ অধিকারী বলে মনে করতো। বাদশাহ ও সিপাহসালাররা জনসাধারণকে পশুর চাইতে অধিক মর্যাদা দিতো না। তারা নিঃসংকোচ চাষীদেরকে কেবল প্রাণরক্ষা উপযোগী আহার্য দিয়ে তাদের মেহনতের ফসল নিজেরা পুরোপুরিই গ্রাস করতো।

৬৮
মিসর
মিসরীয় সভ্যতা যে কত প্রাচীন এবং তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতি যে কত মাহাত্ম্যপূর্ণ ও শানদার তা উপলব্ধি করার জন্যে মিসরের পিরামিডসমূহ আব্দুল হাওল বা স্ফিংকস-মূর্তি এবং সম্প্রতিকালে ভূগর্ভস্থিত কক্ষগুলো থেকে উদ্ধারকৃত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাবলী বেশ সহায়ক। মিসর যেহেতু একটি কৃষিপ্রধান দেশ, তাই প্রাচীন মিসরের শক্তিতে যখন একটু ভাটা পড়লো, তখন দেশটি বহিরাক্রমণের শিকারে পরিণত হতে লাগলো। ইরানী, গ্রীক ও রোমানরা বারবার দেশটির উপর হামলা করতে থাকে এবং দীর্ঘকাল পর্যন্ত দেশটি দখল করে রাখে। এসব হামলাকারীদের তাহযীব-তমুদ্দুনও মিসরীয় সংস্কৃতিতে তাদের প্রভাব ফেলে মিসরীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে সমৃদ্ধতর করে তুলবে, এটা মনে করাটাই স্বাভাবিক। রোমানদের শাসনামলে খ্রিস্ট ধর্ম মিসরে প্রবেশ করে। দেশটির অধিবাসীদের এক বিরাট অংশ খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করে ফেলেছিলো। কিন্তু মিসরীয়দের ইসলামে প্রবেশের পূর্বে দেশটির অবস্থা সবদিক দিয়েই অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়েছিলো। খ্রিস্টীয় ধর্মের অবস্থাও মিসরে মূর্তিপূজার চাইতে উন্নততর ছিলো না। মিসরীয় মূর্তি পূজারীদের অবস্থা অন্য যে কোন দেশের প্রতিমা পূজারীদের চাইতেও নিকৃষ্টতর ছিলো। রোমান ও গ্রীক বিজেতা জাতিসমূহের মধ্যে যেসব ব্যাধি বিদ্যমান ছিল মিসরীয়দের মধ্যে সেগুলো নিকৃষ্টতর রূপ নিয়ে অনুপ্রবেশ করে। দাসপ্রথা তার নিকৃষ্টতম ও সর্বাধিক অমানুষিকরূপে সেখানে চালু ছিল। ব্যভিচার ও রাহাজানির প্রতি উৎসাহব্যঞ্জক আইন-কানুন বানিয়ে নেয়া হয়েছিল। নরহত্যা ছিল তাদের জন্যে নেহায়েত মামুলী উপভোগের ব্যাপার। নারীদের আত্মহত্যার জন্যে উৎসাহিত করা হতো। মোদ্দাকথা, মিসরের অবস্থা অন্য কোন জাতির চাইতে কম শোচনীয় ও তমসাচ্ছন্ন ছিলো না। উন্নত সভ্যতা ও রুচিবোধের নিদর্শন মিসরীয়দের আচার-আচরণ ও চরিত্র থেকে সম্পূর্ণরূপে মুছে গিয়েছিল এবং সর্বদিক থেকে দেশটি তিমিরে ছেয়ে গিয়েছিল।

৬৯
ভারতবর্ষ
অশোক, চন্দ্রগুপ্ত, বিক্রমাদিত্যের মতো বড় বড় রাজা-মহারাজা ভারতবর্ষে অতিবাহিত হয়েছেন। জ্যোতির্বিজ্ঞান, অংক, দর্শন প্রভৃতি শাস্ত্রে ভারতীয়দের কৃতিত্ব ছিল গৌরবজনক। কৃষ্ণ, রামচন্দ্র ও গৌতম বুদ্ধের মত ধর্ম প্রবর্তকদের কথা এবং রামলীলা ও মহাভারতের শৌর্যবীর্য কাহিনীও তাদের স্মরণ ছিল। কিন্তু যে যুগের বিশ্বকে আমরা পর্যবেক্ষণ করছি ঐ যুগে বৌদ্ধধর্ম ভারতবর্ষ থেকে বিদায় নিচ্ছিলো। ধীরে ধীরে তার স্থান দখল করে নিচ্ছিলো ব্রাহ্মণ্য ধর্ম। ভারতবর্ষের কোন বড় প্রদেশেই তেমন কোন উল্লেখযোগ্য হুকুমত প্রতিষ্ঠিত ছিলো না। সর্বত্র প্রতিমা পূজার জয়-জয়কার ছিলো। বৌদ্ধ ও হিন্দু উভয় ধর্মেই প্রতিমাপূজা সমানভাবে মুক্তির উপায় বলে স্বীকৃত ছিলো। ব্রাহ্মণ এবং বৌদ্ধদের দেবমূর্তি অধিকাংশ মন্দিরেই পাশাপাশি স্থান পেতো এবং অত্যন্ত ভক্তি সহকারে ভক্তদের দ্বারা পূজিত হতো। চীনা পরিব্রাজক লিখেন যে, ভারতবর্ষের কোন একটা ঘরও কসম খাওয়া দেবমূর্তি থেকে মুক্ত ছিলো না। বৈষ্ণবদের ঘৃণ্য ও নির্লজ্জ মতবাদ দেশের সর্বত্র জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলো। ব্যভিচারের জন্য মিসরীয়দের মতো আইন-কানুন প্রণীত হয়ে তা রীতিমত আইনসিদ্ধ ও ধর্মর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিলো। সিন্ধুর রাজাদের মধ্যে সহোদরা বিবাহের দৃষ্টান্তও স্থাপিত হয়ে গিয়েছিল। যখন স্বয়ং রাজ-রাজড়াদের অবস্থাই যখন এই, তখন প্রজাসাধারণের অবস্থা যে কত শোচনীয় হতে পারে, তা বলাই বাহুল্য। পুরাণ ও ধর্মীয় গ্রন্থাকারে সে যুগের যে সমস্ত রচনা আজো পাওয়া যাচ্ছে সেগুলোর দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, ভারতীয়দের চরিত্র ও নৈতিকতা অত্যন্ত নীচ পর্যায়ে নেমে গিয়েছিলো। ঐগুলো সে যুগের সমাজব্যবস্থার অত্যন্তনগ্ন লজ্জাজনকচিত্রই তুলে ধরে। গ্রহ-নক্ষত্র, পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী, বৃক্ষলতা, জীবজন্তু, সর্প, প্রস্তর ও লিঙ্গের পূজা ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিলো। এর দ্বারাই সেকালের ভারতবর্ষের অধঃপতন ও তমসার কথা সহজেই অনুমান করা যায়।

৭০
চীন
উপরে আরবের চতুষ্পার্শ্বে অবস্থিত যে দেশগুলোর অবস্থা বিবৃত হয়েছে সে যুগে এগুলোই বিখ্যাত, উন্নত ও সভ্য জাতি বলে গণ্য হতো। এগুলো ছাড়া অপর যে সভ্য জনাকীর্ণ ও শস্য-শ্যামল দেশের নাম নেয়া যায় তা হলো চীন। চীনের অবস্থা উপরিউক্ত দেশগুলোর চাইতেও শোচনীয় ছিল। কনফুসিয়াস, তাও ও বৌদ্ধ ধর্মত্রয়ের রাসায়নিক সংমিশ্রণে সে দেশের তাহযীব-তমুদ্দুন ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে ঠিক ঐ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল যেমনটি হয়ে থাকে সোডা ও টারটারিক এসিডের সংমিশ্রণে। এ অবস্থার পরিবর্তন কেবল তখনই হয়েছিল যখন মুসলমানদের একটি জামাআত চীনে প্রবেশ করে বসবাস করতে শুরু করে এবং নিজেদের চারিত্রিক নমুনা দ্বারা প্রতিবেশীদেরকে প্রভাবান্বিত করে। তুর্কিস্তান, রুশ, ব্রহ্মদেশ, ইউরোপ প্রভৃতি স্থানেও মনুষ্য বসতি বিদ্যমান। কিন্তু সেকালে হয় এসব দেশের অধিবাসীদের সম্পর্কে বিশ্ববাসীরা অনবহিত ছিল নতুবা তারা মানবেতর জীবন যাপন করতো। মোদ্দাকথা তাদের তেমন কোন মানবীয় গুণের কথা জানা যায়নি, যা নিয়ে ঈর্ষা করা চলে।

মোদ্দাকথা, উপরিউক্ত বিবরণ পাঠে একথা দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাবের পূর্বে এবং তার আবির্ভাবের যুগে গোটা পৃথিবী তমসাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলো। অজ্ঞতার অন্ধকার তখন বিশ্বব্যাপী এমনিভাবে ছেয়ে গিয়েছিল যে, পৃথিবীর কোন অঞ্চলে তখন একটি নিভুনিভু আলোও পরিদৃষ্ট হচ্ছিলো না।

ইতিপূর্বে পৃথিবীব্যাপী কখনো এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়নি যে, সভ্যতা-সংস্কৃতি, নৈতিকতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মারিফাতে ইলাহী একই সাথে বিলুপ্ত হয়ে গোটা বিশ্ব অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। পৃথিবীর প্রতিটি দেশে আল্লাহর প্রেরিত নবী-রাসূল হিদায়াতকারীরা উপর্যুপরি এসে সেসব দেশে বিরাজিত তমসারাজিকে বিদীর্ণ করে রাতের পর দিনের আগমনের মতো সেসব দেশকে আলোয় উদ্ভাসিত করেছেন। কিন্তু এবার যেহেতু গোটা বিশ্বের জন্য একই হাদীকে প্রেরণ করার পালা ছিল, তাই আল্লাহ্ তা‘আলা ইতিপূর্বে সমস্ত হিদায়াতকারী এবং সকল দেশের পথপ্রদর্শকদের দ্বারা প্রচারিত শিক্ষার যুগকে একই সাথে খতম করে দুনিয়ায় সর্বত্র এক নতুন হাদীর প্রয়োজন সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন। গোটা বিশ্ব সমকণ্ঠে আর্তনাদ করে এক নতুন হাদীর জন্যে আকুল আকুতি প্রকাশ করছিলো। আল্লাহ্ তা‘আলা সেই কামিল হাদী ও সর্বশেষ রাসূলকে প্রেরণের জন্যে আরবভূমিকে বেছে নিলেন এবং গোটা ভূ-ভাগের নিশ্চিদ্র অন্ধকার রজনীর অবসান ঘটিয়ে মক্কা মুআয্‌যমায় নবুওয়াত-সূর্যের উদয় ঘটালেন। সে সূর্য উদিত হয়ে গোটা বিশ্বকে আলোকে উদ্ভাসিত করে তুললো। আমাদের এ গ্রন্থের সূচনা সেই সূর্যোদয় থেকেই হওয়ার কথা। কিন্তু তার পূর্বে একটি প্রশ্নের জবাব বাকী রয়ে গেছে আর তা হলো আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে নবীরূপে প্রেরণের জন্যে আরবের মাটিকেই কেন বেছে নেয়া হলো, অন্য কোন দেশে কেন তাকে প্রেরণ করা হলো না।

৭১
নবী প্রেরণের জন্যে আরবকে কেন নির্বাচন করা হলো
এ প্রশ্নেরই সবচাইতে সঙ্গত, বুদ্ধিগ্রাহ্য ও মোক্ষম জবাব হচ্ছে, আখিরী যামানার নবী যে দেশেই জন্মগ্রহণ করতেন, সে দেশ সম্পর্কেই এরূপ প্রশ্ন উঠতে পারতো যে, সে দেশকে কেন এজন্যে নির্বাচিত করা হলো? কেননা, নবী তো শেষ পর্যন্ত কোন একটি দেশেই জন্মগ্রহণ করতেন এবং অন্যান্য দেশ এ গৌরব থেকে বঞ্চিত থাকতোই। সুতরাং এরূপ প্রশ্ন অবান্তর।

দ্বিতীয় জবাব হলো, দুনিয়ার অন্যান্য দেশ প্রাচীন আমলের কোন-না-কোন পর্যায়ে একবার একবার উন্নতির শিখরে আরোহণ করেছে। তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতি, নৈতিকতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান এমন একটি পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে যে তারা তখন গোটা বিশ্বকে তাদের বিজয়ডংকা শুনিয়েছে। সকল জাতিই ইতিহাসের কোন না কোন পর্যায়ে অন্যান্য জাতির উপর প্রাধান্য বিস্তারের সুযোগ পেয়েছে বা অপরের বশ্যতা স্বীকার করেছে। উপরন্তু পৃথিবীর অন্য কোন জাতির ভাষা ততটা উৎকর্ষ ও পূর্ণতা লাভ করতে পারেনি। আরবী ভাষা, সে দেশের ভৌগোলিক ও নৈসর্গিক অবস্থা এবং তার অধিবাসীদের প্রচুর অবকাশের জন্য উৎকর্ষ ও পূর্ণতা লাভে সমর্থ হয়েছিলো। আরব ছাড়াও অন্য কোন দেশে যদি এ কামিল নবীর জন্ম হতো তাহলে তার প্রথম সম্বোধিত জাতি যেহেতু ইতোপূর্বে অন্যান্য জাতিকে দুর্দান্ত প্রতাপে শাসন করেছে তাই এ নবীর হিদায়াত ও তাঁর হিদায়াতনামা পূর্ণ প্রভায় উদ্ভাসিত হতো না বরং সংশ্লিষ্ট জাতির এক বিরাট অংশ তাদের প্রাচীন ঐতিহ্যের পরিচয়েই পরিচিত রয়ে গিয়েছিলো। এ কামিল নবীর শিক্ষার দ্বারা সভ্যতা-সংস্কৃতি ও চরিত্র শুদ্ধির ক্ষেত্রে যে বিরাট কীর্তি সাধিত হতো তাও ঐ দেশ ও জাতির প্রাচীন ঐতিহ্যের অবদান বলে গণ্য হয়ে আখেরী যামানার নবী ও শেষ আসমানী কিতাবের বাহকের পূর্ণ প্রভা বিকাশের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করতো। কামিল হিদায়াতনামা নাযিলের জন্যে প্রয়োজন ছিল ঐ ভাষার যা পৃথিবীর যাবৎ ভাষার মধ্যে পূর্ণাঙ্গতার শীর্ষে আরোহণ করেছে। আরবী ছাড়া এ চিরন্তন ও বিশ্বজনীন হিদায়াতনামার উপযোগী অন্য কোন ভাষা ছিল না এ পৃথিবীতে—যা‘ কিয়ামতকাল পর্যন্ত সকল দেশের সকল জাতিকে পথ প্রদর্শন করবে। এজন্যেই মহানবী (সাঃ)-এর আরবদেশে জন্মগ্রহণের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিলো। আরববাসীরা না কোন দিন অন্য কোন জাতির দ্বারা শোষিত হয়েছে, আর না তারা কোন দিন অন্য কোন জাতিকে শাসন-শোষণ করেছে। তাই আরবদের জন্যে গোটা বিশ্বের সকল দেশ সকল জাতি ছিল একই সমান। তারা যখন ইসলামের আলোকবর্তিকা নিয়ে বেরিয়েছে তখন হিস্পানিয়া অর্থাৎ আটলান্টিক মহাসাগরের পূর্ব উপকূল থেকে চীন তথা চীন সাগরের পশ্চিম উপকূল পর্যন্ত গোটা সভ্য দুনিয়া সকল দেশ সকল জাতি তাদের দৃষ্টিতে সমান ছিলো। তারা সকলের কাছেই পর ছিলেন আর সকলেই তাদের নিকট পর ছিল। তাই আল্লাহ্ তা‘আলা যখন গোটা বিশ্বের জন্য এক অভিন্ন ধর্ম সাব্যস্ত করলেন তখন ঐ ধর্ম তিনি এমনি একটি জাতির মাধ্যমে গোটা বিশ্বে প্রচার করলেন, যারা সবার জন্যে সমান এবং একান্তই নিরপেক্ষ। আরবের নৈতিকতা তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতির যেহেতু ইতোপূর্বে মোটেই উন্নতি হয়নি তাই ঐ বিশ্বজনীন ধর্ম রাতারাতি তাদেরকে সর্বাধিক শুদ্ধিশুদ্ধ, সর্বাধিক সভ্য ও নৈতিকতামণ্ডিত ও সকল জাতির শিক্ষক ও পথ প্রদর্শকে রূপান্তরিত করে এ সত্যকে সপ্রমাণিত করলো যে, আরবের এ বিস্ময়কর উন্নতির হেতু ইসলামের শিক্ষা ছাড়া আর কিছুই নয়। সাথে সাথে এটাও প্রমাণিত হলো যে, মহানবী (সাঃ) এমনি বিপুল আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী যে, পৃথিবীর প্রতিটি দেশ প্রতিটি জাতি সব যুগে তা থেকে উপকৃত হতে পারে। উপরন্তু পৃথিবীর সকল হাদী সকল পথপ্রদর্শক সকল নবী-রাসূল বিভিন্ন জাতির জন্যে যেসব শিক্ষা ও হিদায়াতনামা নিয়ে এসেছিলেন সেসবের মূলনীতিই কুরআন শরীফের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে :

فيها كتب قيمة .

আর উম্মী লকবধারী আরবী নবী (সাঃ)-এর মহান সত্তা সমস্ত পূর্ণতার আঁধার।

ফার্সী কবির ভাষায় :

انچه خويان همه دارند توتنها داری

তাদের সকলে যত সৌন্দর্য-সৌকর্যের অধিকারী ছিলেন হে মহানবী! আপনি একাই সে সবের অধিকারী।

এই শেষোক্ত বাক্যগুলোকে হয়ত ঐতিহাসিকের গণ্ডির বাইরের বক্তব্য বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু যেহেতু আমি এ ইতিহাস গ্রন্থটি মুসলমান পাঠকদের অধ্যয়নের জন্যই প্রণয়ন করেছি আর আমি আশা করি যে, মুসলমান পাঠকরাই এ গ্রন্থটি বেশী অধ্যয়ন করবেন, আর আমি নিজেও আল্লাহর শোকর মুসলমানই। তাই হুযূর (সাঃ)-এর জীবনকথা বিবৃত করতে গিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে বাক্যগুলো বেরিয়ে এসেছে, তা আমি প্রত্যাহার করতে পারতাম না। এটা যদি ঐতিহাসিকদের মজলিসে একটা দোষাবহ কাজ হয়েই থাকে, তা হলে আমি এজন্যে অবশ্যই খুশী যে, ঐতিহাসিকদের দল থেকে আমাকে বহিষ্কার করে দিলেও মুসলমানদের দলে তো আমি অবশ্যই শামিল বলে গণ্য হবো।

৭২
দ্বিতীয় অধ্যায় হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ভোর হলো
সূর্যোদয়ের প্রাক্কালে পূর্ব গগনে হালকা আলোর আভা দেখা দিতে শুরু করে। উপরেই বর্ণিত হয়েছে, গোটা বিশ্ব তখন অজ্ঞতা ও কুফরের ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন ছিল। সেই বিশ্বজোড়া ঘন আঁধার রাতের অবসানে সূর্যোদয়ের শুভবার্তা ঘোষণার জন্যে ভোরের প্রথম আভা দেখা দিল। যে আরব ভুমি অন্ধকারের কেন্দ্র হয়ে গিয়েছিলো আর মরুপ্রান্তরে শিরক ও পাপের জোড় তুফান বয়ে চলছিলো। সেই আরব ভূমিতেই এমন কিছু আলামত জাহির হতে লাগলো যার দ্বারা প্রতীয়মান হচ্ছিল যে, অচিরেই নবুওয়াত-সূর্য উদিত হতে যাচ্ছে।

আরবের জাতিসমূহ হাজার হাজার বছর ধরে লাঞ্ছনা, বিড়ম্বনা, অজ্ঞতা ও গোমরাহীর মধ্যে জীবন-যাপন করে আসছিল। কিন্তু মহানবী (সাঃ)-এর নবুওয়াত লাভ নয় বরং তাঁর জন্মগ্রহণের সময় থেকেই আরব গোত্রসমূহের মধ্যে অভিজাতসুলভ প্রবণতা এবং পাপাচার ও নীচতার প্রতি ঘৃণার উদ্রেক হতে শুরু করে। ওয়ারাকা ইব্‌ন নাওফিল ইব্‌ন আসাদ ইব্‌ন আবদুল উযযা, উসমান ইবনুল হুওয়ায়রিছ ইব্‌ন আসাদ, যায়দ ইব্‌ন আমর ইব্‌ন নুফায়ল (উমর ইবনুল খাত্তাবের চাচা), উবায়দুল্লাহ্ ইব্‌ন জাহাশ প্রমুখ কতিপয় ব্যক্তি একত্রে সম্মিলিত হয়ে নিজেদের ধর্মবিশ্বাস ও আচার-আচরণ সম্পর্কে পর্যালোচনা ও চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন। অবশেষে সকলেই এ ব্যাপারে একমত হন যে, পাথর ও গাছপালার পূজা বর্জনীয়। তারা তখন সঠিক ইবরাহীমী দীনের খোঁজে বিভিন্ন স্থানের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে পড়েন।

ওয়ারাকা ইব্‌ন নাওফিল খ্রিস্টীয় ধর্মে দীক্ষিত হন এবং অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে তাওরাত, ইনজীল প্রভৃতি আসমানী কিতাব অধ্যয়ন করেন। উবায়দুল্লাহ্ ইব্‌ন জাহাশ সমতে অটল থাকেন। অর্থাৎ দীনে হানীফ তথা সত্য ধর্মের সন্ধানে ব্যাপৃত থাকেন। ইসলামের অভ্যুদয় পর্যন্ত তাঁর এ অনুসন্ধিৎসা অব্যাহত থাকে। অবশেষে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। সেখানে গিয়ে তিনি খ্রিস্ট ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়েন। উসমান ইব্‌ন হুওয়ায়রিছ রোম সম্রাটের দরবারে গিয়ে খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত হয়ে পড়েন। যায়দ ইব্‌ন আমর ইয়াহূদ-নাসারাও হলেন না। আবার মূর্তিপূজায় যোগ দিলেন না। তিনি রক্ত এবং মৃত জন্তু ভক্ষণ নিজের জন্যে হারাম করে নেন। তিনি আত্মীয়তা সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং নরহত্যা থেকেও বিরত থাকেন। যখন কেউ তাকে ধর্মের ব্যাপারে প্রশ্ন করতো তখন তিনি জবাব দিতেন আমি ইবরাহীম (আ)-এর প্রভুর উপাসনা করি। তিনি মূর্তিপূজার নিন্দাবাদ করতেন এবং নিজ সম্প্রদায়ের লোকজনকে ভর্ৎসনা করতেন এবং তাদেরকে সদুপদেশ দিতেন। তার মুখে প্রায়ই শোনা যেতো :

اللهم او اني اعلم اى الوجه لا احب اليك لعبادتك و لكن لا اعلم .

হে আল্লাহ! যদি আমি নিশ্চিতভাবে জানতে পারতাম যে, কিভাবে তোমার ইবাদত করতে হবে তবে আমি অবশ্যই তোমার ইবাদত করে তোমার সন্তুষ্টি হাসিল করতাম। কিন্তু আমি তো সে সম্পর্কে অজ্ঞ।

এ কথাগুলো বলেই তিনি সিজদায় চলে যেতেন। গণস্কার ও জ্যোতিষীরাও বলাবলি করতে লাগলো যে, আরব দেশে এক মহান নবীর আবির্ভাব হতে যাচ্ছে। অচিরেই তাঁর রাজত্বের সূচনা হবে।

উপরেই বর্ণিত হয়েছে যে, আরব দেশে ইয়াহূদী ও খ্রিস্টানরাও বসবাস করতো। তাদের ধর্মযাজকরাও তাওরাত, ইনজীলের সু-সমাচার জনসমক্ষে বর্ণনা করতে লাগলেন যে, অচিরেই আরব ভূমিতে আখিরী যমানার নবীর অভ্যুদয় হতে যাচ্ছে।

স্বল্পকালের জন্যে ইয়ামান দেশ আবিসিনিয়া সম্রাটের করতলগত থাকে। আবদুল মুত্তালিবের আমলেও ইয়ামান এলাকাটি উক্ত সম্রাটের অধীনে ছিলো। সে সময় আবরাহা ছিলো আবিসিনিয়া রাজ্যের পক্ষ থেকে ইয়ামানের শাসনকর্তা। সে ইয়ামানে একটি উপাসনালয় নির্মাণ করে আরববাসীদেরকে কা‘বার পরিবর্তে তার সে উপাসনালয়ে হজ্জ করার জন্যে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু তার সে উদ্দেশ্য সফল হলো না বরং সুযোগ বুঝে কেউ একজন তার সে উপাসনা-মন্দিরকে অবমাননার উদ্দেশ্যে সেখানে মলত্যাগ করে। তার প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে আবরাহা মক্কা আক্রমণ করে এবং খানা কা‘বা ধ্বংসের জন্য অগ্রসর হয়। তার সেনাদলে হাতিও ছিল বিধায় আরববাসীরা সে বাহিনীর নামকরণ করে আসহাবুল-ফীল এবং সে বছরের নাম দেয় আম-আলফীল বা হস্তীবর্ষ। মক্কার উপকণ্ঠে পৌঁছে আবরাহা যখন তার স্থাপন করলো তখন মক্কাবাসীরা ভীত-সন্ত্রস্ত হলো। কেননা, সে বাহিনীর মুকাবিলা করার সাধ্য তাদের ছিল না। তারা সকলে একত্র হয়ে আবদুল মুত্তালিবকে আবরাহার দরবারে গিয়ে তার একটা বিহিত করার জন্যে গিয়ে ধরলো। আবদুল মুত্তালিব আবরাহার কাছে গিয়ে পৌঁছলেন। তাঁর আভিজাত্যের ছাপমাখা গাম্ভীর্যপূর্ণ চেহারা দর্শনে এবং তাঁর সর্দারীর পরিচয় পেয়ে আবরাহা অভিভূত হলো এবং তাঁকে মর্যাদার আসনে উপবিষ্ট করে তার প্রতি স্ক্রম প্রদর্শন করলো। সে তার আগমনের কারণ জিজ্ঞেস করলো। জবাবে তিনি বললেন : আপনার সৈন্যরা আমার (চল্লিশটি, মতান্তরে দু’শটি) উট নিয়ে এসেছে। দয়া করে তা ফিরিয়ে দিন। আবরাহা বিস্ময়ের সাথে বললো : আমি তো আপনাকে একজন বিজ্ঞ লোক বলে মনে করতাম। কিন্তু এখন দেখছি আমার সে ধারণা ভুল। আপনি জ্ঞাত আছেন যে, আমি খানা কা‘বা ধ্বংস করার জন্যে এসেছি। আপনি নিজের উট উদ্ধারের জন্যে বেশ সচেষ্ট, কিন্তু কা‘বা রক্ষার কোন তদবিরই আপনি করছেন না। আবদুল মুত্তালিব মুখের উপর জবাব দিলেন।

أنا رب الا بل وللبيت رب يمنعه .

আমি তো কেবল আমার উটের প্রভু। ঐ ঘরেরও একজন প্রভু আছেন। তার ঘর রক্ষার ব্যবস্থা তিনি নিজেই করবেন।

জবাব শুনে আবরাহা ক্ষেপে গেলো। সে বললো, “আচ্ছা, দেখা যাবে মালিক (রাব্বুল বায়ত) কি করে আমাকে বিরত রাখে আর কিভাবে সে তার ঘর রক্ষা করে।”

তারপর তার বাহিনীর উপর ধ্বংস নেমে এলো এবং তারা ভক্ষিত তৃণের মতো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো। আবরাহার প্রতি উচ্চারিত আবদুল মুত্তালিবের এ জবাব এবং তারপর তার এ শিক্ষাপ্রদ ধ্বংস ছিলো আরববাসীদের জন্যে এক বিরাট উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ ঘটনা আরববাসীদের মনে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি করে। লোকজন এবার অত্যাচার অবিচার খুন-খারাবি করতে রীতিমত ভয় পেতে লাগলো।

আসহাবুল ফীল বা হস্তী বাহিনীর এ ঘটনার অব্যবহিত পরেই ইয়ামান আবিসিনিয়া অধিপতির শাসন-শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়। এবার সাইফ ইব্‌ন যী-ইয়ান ইয়ামানের শাসন ক্ষমতা দখল করলেন। আবদুল মুত্তালিব কতিপয় কুরায়শ নেতাকে সঙ্গে নিয়ে অভিনন্দন জ্ঞাপন করতে ইয়ামানে গিয়েছিলেন।

সাইফ ইব্‌ন যী-ইয়ামন তার জ্ঞানানুসারে আবদুল মুত্তালিবকে এ সুসংবাদ দেন যে, আখিরী যামানার যে নবীর আগমনের জন্যে পৃথিবীর প্রতিটি দেশ প্রতিটি জাতি উন্মুখ হয়ে অধীর প্রতীক্ষায় দিন কাটাচ্ছে তিনি হবেন তোমারই বংশধর। একথাটি ব্যাপকভাবে প্রচার হয়ে যায়। প্রতিনিধিদলের প্রতিটি সদস্য ভাবতে থাকেন যে, সেই প্রতীক্ষিত নবী তারই বংশে জন্মগ্রহণ করবেন। তারা আহলে কিতাবসম্প্রদায়ের ধর্মযাজক ও সন্ন্যাসীদের কাছে গিয়ে। আখিরী যামানার নবীর নিদর্শনসমূহ সম্পর্কে খুঁটিনাটি ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জিজ্ঞেস করতে থাকে। উমাইয়া ইব্‌ন আবী খালফের ধারণা হয় যে, এই আখিরী নবী বুঝি তিনি নিজেই হবেন। তিনি আবূ সুফিয়ান ইব্‌ন হাবকে সঙ্গে নিয়ে শাম দেশের দিকে যাত্রা করেন, এবং কোন একজন ধর্মযাজকের নিজের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু সেখান থেকে নৈরাশ্যব্যঞ্জক জবাব আসে।

দুনিয়ায় যখনই কোন বড় নবী-রাসূলের নবুওয়াত লাভ বা জন্ম গ্রহণের ঘটনা ঘটেছে তখনই আকাশে ঘন ঘন এবং অস্বাভাবিক হারে নক্ষত্র পতনের দৃশ্য পরিদৃষ্ট হয়েছে। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের জন্মের প্রাক্কালে অনুরূপ ঘন ঘন ও অস্বাভাবিক হারে নক্ষত্র পতনের ঘটনা ঘটতে থাকে। আহলে কিতাব সম্প্রদায়ের ধর্মযাজকগণ তখন একে আখিরী যামানার নবীর আবির্ভাবের পূর্বলক্ষণ বলে অভিহিত করেন। সত্যি সত্যি হস্তীবর্ষের ৯ই রবিউল আউয়াল মুতাবিক পারস্য সম্রাট কিসরার চল্লিশতম অভিষেক বর্ষে মুতাবিক ৫৭১ খ্রিস্টাব্দের ২২ শে এপ্রিল সোমবার সুবহে সাদিকের পর ও সূর্যোদয়ের পূর্বে আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ভূমিষ্ঠ হন।

৭৩
দ্বিতীয় যবীহ আবদুল্লাহ ইব্‌ন আবদুল মুত্তালিব
যমযম কূপের উৎপত্তি হয়েছে হযরত ইসমাঈল (আ) থেকে যখন তিনি আর তার জননী হযরত হাজেরা মক্কার মরুপ্রান্তরে পিপাসায় কাতর হয়ে পড়েছিলেন। তখন আল্লাহ্ তা‘আলার হুকুমে সেখানে পানির প্রস্রবণ নির্গত হয়। হযরত হাজেরা তার চারপাশে বাঁধ দিয়ে সে পানিটুকু ধরে রাখেন। এভাবে তা একটি কূপের রূপ পরিগ্রহ করে। কিছু কাল পর তা মাটি ভরাট হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। লোকমুখে যমযম কূপের কথা শোনা যেত, কিন্তু তা কোথায় কেউ বলতে পারত না। যখন আবদুল মুত্তালিবের উপর হাজীদেরকে পানি পান করানোর দায়িত্ব অর্পিত হলো, তখন তিনি যমযম কূপের অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হলেন। দীর্ঘকাল পর্যন্ত তিনি আর তাঁর পুত্র হারিছ যমযমের সন্ধানে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও ব্যর্থ হন। কুরায়শ বংশের একটি লোকও এ ব্যাপারে তাদের কোনরূপ সহযোগিতা করলো না বরং উল্টো এজন্য তারা পিতাপুত্রকে নিয়ে উপহাস করতো।

৭৪
প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সম্মানিত পিতা
একদিন আবদুল মুত্তালিব স্বপ্নে যমযম কূপের সন্ধান পেয়ে গেলেন এবং সে অনুসারে খননকার্য শুরু করলেন। ঐ স্থানটিতেই আসাফ ও নায়লার মূর্তিদ্বয়ের অধিষ্ঠান ছিল। তাই কুরায়শরা এ খননকার্যে তাদেরকে বাধা দিল। এমনকি তারা তাদের সাথে লড়তে উদ্যত হলো। পিতা পুত্র দু’জন ছাড়া অপর কেউ তাদের সমর্থক ছিল না। কিন্তু সকলে মিলেও তাদের সাথে এঁটে উঠলো না। তারা খননকার্য চালিয়ে গেলেন। এ সময় আবদুল মুত্তালিব হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করলেন যে, তিনি একান্তই নিঃসঙ্গ। তখন তিনি মানত করলেন, আল্লাহ যদি তাঁকে দশটি পুত্র সন্তান দান করেন আর যমযম কূপের সন্ধানও তিনি পেয়ে যান তাহলে তার একটি পুত্রকে তিনি আল্লাহর নামে কুরবানী করবেন। কিছুদিনের মধ্যেই যমযম কূপ বেরিয়ে আসলো আর আবদুল মুত্তালিবও আল্লাহর ইচ্ছায় একে একে দশটি পুত্র সন্তানের পিতা হলেন। যমযম কূপ উদ্ধারের দরুন আবদুল মুত্তালিবের প্রভাব-প্রতিপত্তি ও মান-মর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং সকলেই তার সর্দারী ও আধিপত্য মেনে নেয়। আবদুল মুত্তালিবের সন্তানরা যখন যৌবনে পদার্পণ করলো তখন তিনি তাঁর মানত পূরণ করতে মনস্থ করলেন। তিনি তাঁর দশ পুত্রকে নিয়ে কা‘বা ঘরে উপস্থিত হলেন। হুল দেবতার সম্মুখে তীর নিক্ষেপ করে দশ ছেলের নামে লটারী করলেন। ঘটনাচক্রে লটারীতে প্রিয়তম কনিষ্ঠ পুত্র আবদুল্লাহর নাম উঠলো। আবদুল মুত্তালিব মানত পুরা করার জন্যে দৃঢ়সংকল্প ছিলেন। অগত্যা তিনি আবদুল্লাহকে নিয়ে বধ্যভূমির দিকে অগ্রসর হলেন। আবদুল্লাহর সমস্ত ভাই-বোন এবং কুরায়শ বংশের সর্দাররা হায়! হায়! করে উঠলো। তারা তাঁকে আবদুল্লাহকে কুরবানী করতে বারণ করলেন। কিন্তু আবদুল মুত্তালিব নাছোড়বান্দা। অবশেষে অনেক তর্ক-বিতর্কের পর ব্যাপারটি সাজা নাম্নী এক জ্যোতিষী মহিলার কাছে উত্থাপিত হলো। তিনি বললেন, তোমাদের সমাজে একজন লোকের রক্তপণ হচ্ছে দশটি উট। তোমরা একদিকে দশটি উট আর অপরদিকে আবদুল্লাহকে রেখে লটারী করে দেখ লটারীর ফলাফল কী দাঁড়ায়। যদি লটারীতে উটের নাম আসে তাহলে দশটি উট যবাহ করে দাও। আর যদি আবদুল্লাহর নামই উঠে, তাহলে আরো দশটি উট যোগ করে বিশটি উটের নামে পুনরায় লটারী করো। এভাবে প্রতিবারে দশটি করে উটের সংখ্যা বৃদ্ধি করে লটারী চলতে লাগলো। কিন্তু প্রতিবারই লটারীতে আবদুল্লাহর নাম উঠতে লাগলো। অবশেষে যখন একদিকে একশ উট আর অপরদিকে আবদুল্লাহর নাম দিয়ে লটারী করা হলো, তখন একশ উটের নামই উঠলো। সন্দেহমুক্ত হওয়ার জন্যে আবদুল মুত্তালিব আরো দু’বার করে লটারী করলেন। কিন্তু না প্রতিবারেই উটের নাম আসতে লাগলো। তখন একশ’টি উট যবাহ করা হলো। আর সেদিন থেকেই রক্তপণ একশটি উট বলে সাব্যস্ত হলো। আবদুল মুত্তালিবের ঔরসে মোট তেরজন পুত্র এবং ছ’জন কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। তাদের বংশপঞ্জি ৭৯ নং পৃষ্ঠায় সন্নিবেশিত হল :

[এখানে হার্ড কপি বইয়ে ছবি ছিল]

হস্তীবর্ষের কয়েকদিন পূর্বে আবদুল মুত্তালিব তাঁর পুত্র আবদুল্লাহকে কুরায়শের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের কন্যা আমিনা বিন্‌ত ওয়াহাবের সাথে বিয়ে দেন। সে সময়ে আবদুল্লাহ্‌র বয়স ছিল চব্বিশ বছর। ঐ সময়েই আবদুল মুত্তালিব নিজেও আমিনার নিকটাত্মীয় হালা বিন্‌ত উহায়েবের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই হালার গর্ভেই হযরত হামযা (রা) ভূমিষ্ঠ হন। বিবাহের অল্প কিছুদিন পরেই আবদুল মুত্তালিব তাঁর পুত্র আবদুল্লাহকে ব্যবসা ব্যাপদেশে বাণিজ্য কাফেলার সাথে শাম দেশে প্রেরণ করেন। সেখান থেকে প্রত্যাবর্তনকালে অসুস্থ হয়ে তিনি মদীনায় আত্মীয়-স্বজনের ওখানে উঠেন এবং পিতা আবদুল মুত্তালিবের কাছে লোক মারফত আপন অসুস্থতার সংবাদ প্রেরণ করেন। প্রিয়তম পুত্রের অসুস্থতার সংবাদে বিচলিত আবদুল মুত্তালিব তার সংবাদ নেয়ার এবং তাঁকে মক্কায় সযত্নে ফিরিয়ে নেয়ার জন্যে অপর পুত্র হারিছকে মদীনায় প্রেরণ করলেন। কিন্তু হারিছ মদীনায় পৌঁছাবার পূর্বেই আবদুল্লাহ ইন্তিকাল করেন এবং মদীনায় তার আত্মীয় বনী নাজ্জার বংশের গোরস্তানে সমাহিত হন। হারিছ মক্কায় ফিরে এ হৃদয়বিদারক সংবাদ আবদুল মুত্তালিবকে অবহিত করলেন। মৃত্যুকালে আবদুল্লাহ্ পরিত্যক্ত সম্পদরূপে রেখে যান কয়েকটি উট, কয়েকটি ছাগল এবং একটি দাসী উম্মে আয়মনকে।

আমিনা তখন সন্তানসম্ভবা। আল্লাহর নবী (সাঃ) মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায়ই পিতৃহারা হয়ে গেলেন। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে আবদুল্লাহ্‌র ইন্তিকাল হয়। আসহাবুল ফিল বা হস্তীর ঘটনার বায়ান্ন বা পঞ্চান্ন দিন পর আল্লাহর নবী ভূমিষ্ঠ হন। তাঁর মাতৃগর্ভে থাকাকালেই আমিনা স্বপ্নে দেখেন যে, একজন ফেরেশতা এসে তাকে বলছেন গর্ভস্থিত সন্তানের নাম যেন আহমদ রাখা হয়। এজন্যে মা নবজাতকের নাম রাখলেন আহমদ। আবদুল মুত্তালিব তার আদরের এ পৌত্রটির নাম রাখলেন মুহাম্মদ। ঐতিহাসিক আবুল ফিদার বর্ণনা অনুসারে, লোকজন বিস্ময়ভাবে আবদুল মুত্তালিবকে জিজ্ঞেস করেন যে, বংশের প্রচলিত নামসমূহ বাদ দিয়ে তিনি পৌত্রের এরূপ নামকরণ করলেন কেন? জবাবে আবদুল মুত্তালিব বলেন যে, তাঁর এ নাতিটি যেন বিশ্বজোড়া সকলের প্রশংসার উপযুক্ত হন এজন্যই তিনি তার এরূপ নামকরণ করেছেন। ইব্‌ন সাআদ (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় সাধারণত নবজাতকের দেহের সাথে যেসব ময়লা আবর্জনা মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে থাকে সেরূপ কিছু মহানবী (সাঃ)-এর প্রসবকালে পরিদৃষ্ট হয়নি। তিনি খানা করা অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হন।

ঐতিহাসিকরা এও বর্ণনা করেছেন যে, তিনি যখন ভূমিষ্ঠ হন ঠিক সেই মুহূর্তে পারস্য সম্রাট নওশেরওয়ার রাজপ্রাসাদে ভূমিকম্প উপস্থিত হয় এবং তার চৌদ্দটি চূড়া ভেঙ্গে পড়ে। অস্তাখরের (পারস্যের) বিখ্যাত অগ্নিকুণ্ড অকস্মাৎ নিভে যায়। তার জন্মের আনন্দে সপ্তম দিনে আবদুল মুত্তালিব পশু কুরবানী করে সমস্ত কুরায়শকে দাওয়াত করে আপ্যায়িত করেন।

৭৫
বাল্যকাল
জন্মের পর প্রথম সাতদিন-আবু লাহাবের আযাদকৃত দাসী ছুওয়াইবিয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে স্তন্যপান করান। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পিতৃব্য হামযাকেও এই ছুওয়াইবিয়া স্তন্যদান করেছিলেন। এ সূত্রে ছুওয়াইবিয়ার পুত্র মাসরূক এবং হযরত হামযা তার দুধ ভাই ছিলেন। জন্মের অষ্টম দিনে আরবের অভিজাত খানদানসমূহের প্রথা অনুযায়ী তাঁকে হাওয়াযিন গোত্রের বনী সাআদ বংশের ধাত্রী হালীমার হাতে অর্পণ করা হয়, যাতে তিনি তাকে স্তন্যদান এবং লালন-পালন করেন। অভিজাত আরবরা এজন্যেও আপন সন্তানদের বেদুঈন ধাত্রীদের হাতে তুলে দিতেন যেন মরুভূমির মুক্ত হাওয়ায় অপেক্ষাকৃত স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করে শিশুরা পুষ্ট বলিষ্ঠ হয়ে গড়ে উঠে এবং তাদের মুখে সুললিত ভাষাও ফুটে ওঠে। কেননা শহরের ভাষার তুলনায় মরুপল্লীর ভাষা অনেক সুললিত ও মার্জিত হতো। হালীমা সা‘দিয়া বছরে দু’বার করে অর্থাৎ প্রতি ছ’মাস অন্তর অন্তর মা আমিনা ও দাদা আবদুল মুত্তালিবকে তাদের আদরের শিশু মুহাম্মদকে দেখিয়ে আনতেন। শিশু নবী দু’বছর পর্যন্ত হালীমার দুধপান করেন এবং অতিরিক্ত আরো দু’বছর অর্থাৎ চার বছর পর্যন্ত হালীমার ঘরে বনী সাআদ কবীলায় লালিত-পালিত হন। যখন তার বয়স চার বছর হলো তখন মা আমিনা তাকে মক্কায় রেখে দিলেন। তার বয়স যখন ছয় বছর তখন তার আম্মাজান তাকে নিয়ে মদীনায় তার আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করতে যান। একমাস সেখানে কাটিয়ে মক্কায় প্রত্যাবর্তনের পথে আবওয়া নামক স্থানে পৌঁছে তিনি ইন্তিকাল করেন। এবার দাদা আবদুল মুত্তালিব তাঁর লালন-পালনের ভার আপন হস্তে তুলে নেন। কোন কোন রিওয়ায়াতের দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, শিশু নবী হালীমার কাছে চার বছর নয়, পাঁচ বছরকাল পর্যন্ত লালিত-পালিত হয়েছিলেন এবং আপন মায়ের কাছে কেবল এক বছর কয়েকমাস সময়ই কাটাবার সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন। তার বয়স যখন পাঁচ বছর তখন একদিন যখন তিনি তার দুধ-ভাই দুধ-বোনদের সাথে মরুভূমিতে ছাগল চরাচ্ছিলেন, তখন তাঁর বক্ষ বিদারণের ঘটনাটি ঘটে। ইব্‌ন হিশাম রচিত ‘সীরাতে রাসূলুল্লাহ’ গ্রন্থে বর্ণিত আছে যে, হালীমা বিন্‌ত আবূ যুওয়ায়ের বর্ণনা করেন যে, একদা আমার পুত্র দু’টি দৌড়ে আমার কাছে এসে বললো, দু’জন শ্বেত পোশাকধারী আমাদের কুরায়শ ভাইটিকে ধরে নিয়ে গেছে এবং তারা তার বুক চিরে ফেলেছে। আমি এবং আমার স্বামী (হারিছ ইব্‌ন আবদুল উযযা) দু’জন তখন দৌড়ে সেখানে গিয়ে দেখি তার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। আমি দৌড়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলাম এবং কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলাম। তখন তিনি বললেন : দু’জন শ্বেত বসনধারী আমার নিকটে এসে আমাকে চিৎ করে শুইয়ে দিয়ে আমার বুক চিরে দিলেন। তারা আমার হৃৎপিণ্ড বের করলেন এবং তাথেকে কি যেন বের করলেন। হালীমা তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করেও কোন ক্ষত বা রক্তের চিহ্ন খুঁজে পেলেন না। তিনি ভাবলেন বোধ হয় জ্বিন ভূতের আছর হয়েছে। তাই এভাবে আর বেশীদিন তাকে তার নিজের কাছে রাখা তিনি সমীচীন মনে করলেন না। তিনি তাঁকে মক্কায় নিয়ে গিয়ে তার আম্মার কাছে সমস্ত ঘটনা বিবৃত করলেন এবং সাথে সাথে এও বললেন, আমার ধারণা, ছেলের উপর জ্বিন-ভূতের আছর হয়েছে। সব শুনে হযরত আমিনা বললেন, ঘাবড়াবার কোন কারণ নেই। আমার এ ছেলে ধরাপৃষ্ঠে মহাসম্মানের অধিকারী হবে। সে হবে অসাধারণ। সমস্ত বিপদাপদ থেকে আল্লাহ্ তাঁকে হিফাযত করবেন। কেননা, সে যখন আমার গর্ভে ছিলো, তখন স্বপ্নে ফেরেশতারা তাঁর সম্পর্কে অনেক সুসংবাদ দিয়েছেন এবং তাঁর অনেক অলৌকিক ব্যাপার আমি প্রত্যক্ষ করেছি।

সহীহ মুসলিমে হযরত আনাস ইব্‌ন মালিক (রা)-এর রিওয়ায়াতে বর্ণিত হয়েছে যে, একদিন তিনি মক্কায় ছেলেদের সাথে খেলছিলেন। তখন হযরত জিবরাঈল (আ) তাঁর সকাশে উপস্থিত হলো এবং তাঁর বক্ষ বিদীর্ণ করে হৃৎপিণ্ড থেকে একটি রক্তবিন্দু বের করে দিয়ে বললেন যে, এটা ছিলো শয়তানের অংশ। তারপর সোনার তশতরীতে যমযমের পানিতে ধুয়ে যথারীতি তা দেহে পুনঃ সংযোজিত করেন।

৭৬
আবদুল মুত্তালিবের ওফাত
দু’বছর পর্যন্ত আবদুল মুত্তালিবের আদর যত্নে প্রতিপালিত হয়ে তিনি যখন আট বছর বয়সে পদার্পণ করলেন তখন দাদা আবদুল মুত্তালিবও পরলোক গমন করলেন। আবদুল মুত্তালিবের শবাধার যখন গোরস্তানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো তখন তিনিও অশ্রুসজল চোখে তার অনুগমন করছিলেন। আবদুল মুত্তালিব তাঁর মৃত্যুর পূর্বে আপন পুত্র আবূ তালিবকে ডেকে বিশেষভাবে ওসীয়ত করে যান যে, এ ছেলেটির অর্থাৎ তার ভ্রাতুষ্পুত্রের যত্ন-আত্তিতে তিনি যেন কোনরূপ ক্রটি না করেন। আবূ তালিব ছাড়াও তার আরো চাচা অর্থাৎ আবদুল মুত্তালিবের আরো অনেক পুত্র ছিলেন। কিন্তু বিচক্ষণ আবদুল মুত্তালিব এজন্যেই তাঁকে আবূ তালিবের হস্তে অর্পণ করেন যে, আবূ তালিব ও আবদুল্লাহ্ ছিলেন একই মায়ের গর্ভজাত সন্তান। তাই আবদুল্লাহর সন্তানের জন্যে তার দরদই সবচাইতে বেশী থাকার কথা। আবদুল মুত্তালিবের এ ধারণা কালে যথার্থ প্রতিফলিত হয়েছিলো। আবূ তালিব অক্ষরে অক্ষরে পিতার অন্তিম উপদেশ বাস্তবায়িত করে যোগ্য সন্তানের পরিচয়ই দিয়েছিলেন।

৭৭
আবু তালিবের ক্রোড়ে
আবু তালিব নিজের সন্তানদের চাইতেও শিশু নবীকে বেশী আদর-যত্ন করতেন এবং তাঁকে সব সময় চোখে চোখে রাখতেন। তিনি কখনো তাকে চোখের আড়াল হতে দিতেন না। এমন কি রাতের বেলায়ও তিনি তাঁকে নিজের কাছেই শোয়াতেন। তাঁর শিশুকাল আরবের অন্যান্য শিশুদের চাইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ছিলো। ছেলেদের সাথে খেলাধুলা বা পথে পথে ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাস তার আদৌ ছিলো না বরং তিনি তাদের সাহচর্য এড়িয়ে চলতেন এবং নির্জনতাই অধিকতর পছন্দ করতেন। আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে যাবতীয় কু-অভ্যাস থেকে হিফাযত করেন। তার শৈশব কালের একটি ঘটনা। কয়েকজন কুরায়শ কিশোর একদিন তাঁকে জোর করে ধরে নিয়ে যায় এক বিয়ের মজলিসে। সেখানে নৃত্যগীতের বেজায় ধুমধাম চলছিল। তিনি মজলিসে উপস্থিত হতেই নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। সারা রাত এভাবে তাঁর নিদ্রায় অতিবাহিত হয়। রাত্রি শেষে যখন নৃত্যগীতের অনুষ্ঠান শেষে লোকে যার যার ঘরে চলে গেলো তখন তার ঘুম ভাঙ্গলো। এভাবে তিনি একটা ঘৃণিত মজলিসের অপকার থেকে বেঁচে গেলেন।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সাত বছর বয়ঃক্রমকালে কুরায়শরা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কা‘বা ঘরের পুনর্নির্মাণ কার্যে হাত দেয়। এ সময় তিনিও অন্যদের সাথে মিলে পাথর কুড়িয়ে এনে দিচ্ছিলেন। চলতে ফিরতে ও পাথর উঠাতে এ সময় লুঙ্গি অনেকটা বাধার সৃষ্টি করছিলো। সাত বছরের একটা বালকের উলঙ্গ হওয়াটা সে সমাজে কোন দূষণীয় ব্যাপার ছিলো না, তাই তাঁর চাচা আব্বাস তাকে কিছু না বলেই এক ঝটকা টানে অতর্কিত তার পরনের লুঙ্গি খুলে ফেললেন। শিশু নবী (সাঃ) এতই লাজুক ছিলেন যে, এ অতর্কিত তুচ্ছ ঘটনায়ই তিনি মূর্ছা গেলেন। তার এ অভাবিত লজ্জাশীলতা দর্শনে উপস্থিত সকলেই হতবাক হয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাকে লুঙ্গি পরিয়ে দেয়া হলো।

৭৮
প্রথম সিরিয়া সফর
প্রিয়নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের বয়স তখন বারো বছর। আবূ তালিব এক বাণিজ্য কাফেলার সাথে ব্যবসা উপলক্ষে সিরিয়া যেতে মনস্থ করলেন। কিশোর নবীকে তিনি মক্কায়ই রেখে যেতে চাইলেন। কিন্তু আবূ তালিবের হাতে প্রতিপালিত হওয়ার গোটা সময়টায় যেহেতু তিনি চাচার সাথে সাথে রয়েছেন, তাই এবার চাচাকে ছেড়ে একা মক্কায় থাকতে কোন মতেই তার মন মানছিল না। আবূ তালিব তার ইয়াতীম ভাতিজার মনের কথা টের পেলেন এবং যাতে তার মনের কষ্ট না হয় সেজন্যে তাঁকেও সাথে নিয়েই যাত্রা করলেন। সিরিয়ার দক্ষিণাংশে বসরা নামক স্থানে যখন তারা উপনীত হলেন, তখন সেখানে বসবাসকারী খ্রিস্টান রাহিব বা ধর্মযাজক বাহীরা তাঁকে দেখেই আখিরী যামানার নবী বলে তাকে শনাক্ত করেন। তিনি আবূ তালিবের নিকট এসে বলেন যে, আপনার এ ভাতিজাটি নবী হবেন। তাওরাত ও ইনজীলে আখিরী যামানার নবীর যেসব নিদর্শন বর্ণিত হয়েছে, সেসবই এর মধ্যে বিদ্যমান। আপনি একে নিয়ে ইয়াহূদীদের দেশে যাবেন না। তারা তার ক্ষতি করবার চেষ্টা করবে। বাহীরা রাহিবের কথা শুনে আবূ তালিব সতর্ক হলেন এবং মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করে তার মালপত্র ওখানেই বিক্রি করে দিয়ে ভাতিজাকে নিয়ে মক্কায় ফিরে এলেন। আবূ তালিব এ যাত্রায় সিরিয়ার শহরসমূহে না গিয়েও প্রভূত মুনাফা অর্জন করলেন। একটি রিওয়ায়াতে আছে যে, আবূ তালিব বাহীরা রাহিবের কথা শুনে কিশোর নবীকে সেখান থেকেই মক্কায় ফেরত পাঠিয়ে দেন আর নিজে কাফেলার সাথে সিরিয়ায় যান।

৭৯
ফিজারের যুদ্ধ : প্রথমবারের মত যুদ্ধে অংশগ্রহণ
ওকাযে জমজমাট মেলা বসতো প্রতিবছরেই। সেখানে মুশায়েরা বা কবিসভা হতো। ঘোড়-দৌড় হতো, হতো কুস্তি ও সমরকৌশলের প্রতিযোগিতা। আরবের প্রতিটি কবীলাই ছিলো চরম যুদ্ধবাজ। কথায় কথায় তলোয়ার বের হয়ে আসতো খাপ থেকে। ওকাযের মেলায় কী একটা তুচ্ছ কথা নিয়ে হাওয়াযিন ও কুরায়শ গোত্রদ্বয়ের মধ্যে সংঘর্ষ বেঁধে গেল। প্রথমে তো উভয় কবীলার বিচক্ষণ লোকেরা মধ্যে পড়ে কথা বাড়তে দেননি। ঝগড়া সেখানেই রফা হয়ে যায়। কিন্তু প্রতিটি জাতির মধ্যে দুষ্ট প্রকৃতির লোকই সংখ্যায় বেশী থাকে। এক্ষেত্রেও তাই হলো। ফলে একটা মীমাংসিত ব্যাপারও মীমাংসিত রইলো না। পুনরায় উভয় পক্ষে যুদ্ধ শুরু হলো। মারামারি কাটাকাটি হানাহানিতে পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠলো। এ যুদ্ধটি মুহাররম মাসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাই এটা হরবুল ফিজার বা অন্যায় যুদ্ধ নামে অভিহিত হয়। কেননা আরবদের প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী মুহাররম মাসে যুদ্ধবিগ্রহ অত্যন্ত পাপের কাজ ছিল। তাই পূর্ব থেকে চলে আসা যুদ্ধও এ মাসে মুলতবি হয়ে যেতো। এ যুদ্ধটি ছিল চারটি বড় বড় যুদ্ধের এক অবিশ্রান্ত ধারা। এক যুদ্ধের পর আরেক যুদ্ধের তীব্রতা ও ভয়াবহতা হতে অনেক বেশী। কেননা হাওয়াযিন কবীলার পক্ষে কায়স আইলানের সমস্ত শাখা গোত্র এবং কুরায়শের পক্ষে কিনানা কবীলার সমস্ত শাখা গোত্র এসে যুদ্ধে যোগদান করে। ফলে যুদ্ধটি বিস্তৃত হয়ে তা মারাত্মক আকার ধারণ করে। চতুর্থ বা সর্বশেষ যুদ্ধটি ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ। এ যুদ্ধে অনেক সর্দার নিজ নিজ পায়ে এজন্য জিঞ্জির বেঁধে নেন যাতে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাবার সুযোগ অবশিষ্ট না থাকে। এই শেষ বা চতুর্থ যুদ্ধে আমাদের মুহাম্মদ (সাঃ) প্রথমবারের মতো অস্ত্র সজ্জিত হয়ে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। বনূ কিনানার প্রতিটি কবীলার ভিন্ন ভিন্ন সিপাহসালার ছিল। সে হিসাবে বনূ হাশিমের সিপাহসালার ছিলেন তাঁর চাচা যুবায়র ইব্‌ন আবদুল মুত্তালিব এবং বৃহত্তর বনূ কিনানা বংশের প্রধান সেনাপতি ছিলেন হার্‌ব ইব্‌ন উমাইয়া। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর বয়স ছিলো তখন পনের বছর। তার উপর দায়িত্ব ছিল চাচাদেরকে তীর কুড়িয়ে এনে দেয়া। সরাসরি কারো সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ তার হয়নি। যুদ্ধের প্রথম দিকে বনী হাওয়াযিনের পাল্লা ভারী ছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বনী কিনানাই জয়ী হয় এবং কায়েস বংশীয় কবীলাসমূহ পরাস্ত হয়। ইব্‌ন খালদূনের রিওয়ায়ত অনুসারে ফিজার যুদ্ধের সময় নবী করীম (সাঃ)-এর বয়স ছিল দশ বছর মাত্র। কিন্তু বিশুদ্ধতম মত হলো ফিজার যুদ্ধ ৫৮১ খ্রিস্টাব্দে১ সংঘটিত হয় আর তখন তার বয়স ছিলো এগার বছর।২

─────────────────১. এ পুস্তকে প্রদত্ত জন্মসাল (৫৭১ খৃ.)-কে বিশুদ্ধ মেনে নিলে ৫৮১ খৃ. কোনক্রমেই নবী (সাঃ)-এর বয়স এগার বছরের বেশী ছিলো না। তবে এ যুদ্ধটি দীর্ঘ চার বছর পর্যন্ত চলেছিলো বিধায় যুদ্ধের শেষ দিকে চতুর্থ যুদ্ধের সময় তার বয়স পনের বছর হতে পারে।—অনুবাদক

২ কারো কারো মতে ৫৮৪ খৃ.-৫৮৯ খৃ. হরবে ফিজার সংঘটিত হয়।—সম্পাদক।

৮০
বাণিজ্যে গমন
হযরত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম যৌবনে পদার্পণ করলে তিনি ব্যবসা করতে মনস্থ করলেন। চাচা আবূ তালিবও তার জন্যে এ পেশা পছন্দ করলেন। তিনি কয়েক বারই ব্যবসাপণ্য নিয়ে যাত্রা করেন এবং প্রতিবারেই ব্যবসায়ে বেশ মুনাফা হয়। এ সব সফরে লোকজন তার বিশ্বস্ততা, আমানতদারী ও চমৎকার লেনদেন প্রত্যক্ষ করে। মক্কা শহরেও যাদের সাথেই তার লেনদেন বা ব্যবসায়িক আদান-প্রদান হয়েছে সকলের কাছেই তিনি অত্যন্ত বিশ্বস্ত, সত্যবাদী ও চমৎকার চরিত্রের লোক বলে প্রতিপন্ন হন। সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইব্‌ন আবুল হামসা (রা) বলেন, নবুওয়াত পূর্বের ঐ সময়টাতে একবার হযরত নবী (সাঃ)-এর সাথে আমার একটি ব্যবসা সংক্রান্ত লেনদেনের কথা হচ্ছিলো। এমন সময় কোন একটি কাজে একটু বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হয়। তাই কথা শেষ না করেই “আমি একটু আসছি, আপনি অপেক্ষা করুন” বলেই চলে যাই। তারপর তার সাথে আমার এ ওয়াদার কথা আমি ভুলে যাই। তৃতীয় দিনে যখন সেখান দিয়ে আমি যাচ্ছিলাম আমি লক্ষ্য করি যে, তিনি তখনো সেখানে এক ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি আমাকে দেখেই কেবল এটুকুই বললেন, তুমি আমাকে ভীষণ বিপদে ফেলে দিয়েছ। আমি এ পর্যন্ত ঠায় দাঁড়িয়ে তোমার অপেক্ষাই করছি। অনুরূপভাবে সাহাবী হযরত সায়েব (রা) যখন ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন কেউ কেউ হুযুর (সাঃ)-এর নিকট তাঁর প্রশংসা করছিলেন। তখন হুযূর (সাঃ) বললেন : আমি সায়েবকে তোমাদের চাইতে বেশী চিনি। তখন হযরত সায়েব (রা) বলে উঠলেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার পিতামাতা আপনার জন্যে কুরবান হোক! একবার ব্যবসায়ে আমি আপনার অংশীদার ছিলাম। আপনার লেনদেন ছিল অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন।

৮১
হযরত খাদীজাতুল কুবরা (রা)-এর প্রস্তাব
বনূ আসাদ কবীলার সম্ভ্রান্ত মহিলা খাদীজা বিন্‌ত খুয়ায়লিদ কুরায়শ বংশের একজন ধনাঢ্য মহিলা বলে গণ্য হতেন। তিনি ছিলেন বিধবা এবং ইতিপূর্বে দু’জন স্বামীর ঘর করেছিলেন। তাঁর দ্বিতীয় স্বামী অনেক ধনসম্পদ রেখে যান। খাদীজা (রা) কর্মচারীদের মাধ্যমে সর্বদা শাম, ইরাক ও ইয়ামানে ব্যবসা পণ্য পাঠাতেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আমানতদারী ও বিশ্বস্ততার খ্যাতির কথা শুনে তিনি তার ভ্রাতুষ্পুত্র কাতীহা মারফত প্রস্তাব দিয়ে পাঠান যে, তিনি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে ব্যবসা পণ্য দিয়ে শাম দেশে তার ব্যবস্থাপকরূপে পাঠাতে চান। তিনি চাচা আবু তালিবের সাথে পরামর্শক্রমে এ প্রস্তাবে সম্মতি দেন। খাদীজা তাঁর জন্য সঙ্গত পারিশ্রমিক ধার্য করেন। যথাসময়ে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) খাদীজার ব্যবসার ব্যবস্থাপকরূপে তাঁর ব্যবসা পণ্য নিয়ে শাম দেশের দিকে যাত্রা করেন। এ সময়ে খাদীজার ক্রীতদাস মায়সারা এবং জনৈক প্রিয়জন হাকীম ইব্‌ন হিযামও প্রিয়নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সফরসঙ্গী ছিলেন।

৮২
সিরিয়ায় দ্বিতীয় সফর
হযরত খাদীজা (রা)-এর ব্যবসাপণ্যসহ বাণিজ্যিক কাফেলার সাথে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) শাম দেশে প্রবেশ করে একটি উপাসনালয়ের নিকট তাঁবু স্থাপন করেন। এ উপাসনালয়ে নাস্তুরা নামক একজন ধর্মযাজক বাস করতেন। নাস্তুরা তাকে দেখতে পেয়েই তার উপাসনালয় থেকে কয়েকটি আসমানী কিতাব নিয়ে এলেন এবং হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর দেহাবয়ব ও চেহারা তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। তিনি একবার কিতাবের দিকে আর একবার হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর দিকে দেখতে লাগলেন। তিনি হযরত নবী (সাঃ)-এর চেহারার সাথে কিতাবের বিবরণ মিলিয়ে দেখছিলেন। তাঁর এ অদ্ভুত হাবভাব লক্ষ্য করে, খুযায়মার মনে সন্দেহ দেখা দিলো। তিনি চিৎকার করে উঠলেন ইয়া আলে গালিব! অর্থাৎ হে গালিব বংশীয়রা! বাঁচাও! বাঁচাও!! তার এ চীৎকার শুনে কুরায়শরা চতুর্দিক থেকে এসে সমবেত হলো। কুরায়শদেরকে এভাবে তেড়ে আসতে দেখে নাস্তুরা রীতিমত ঘাবড়ে গেলেন। তিনি দৌড়ে গিয়ে তার উপাসনালয়ের ছাদে উঠলেন। সেখান থেকেই তিনি কাফেলার লোকদেরকে লক্ষ্য করে বললেন : তোমাদের ভয়ের কোন কারণ নেই। আমি আসমানী কিতাবসমূহের সাথে তোমাদের সঙ্গীটির অবস্থা মিলিয়ে দেখলাম। আখিরী যামানার নবীর যেসব নিদর্শনের কথা কিতাবে বর্ণিত হয়েছে তার সবক’টি নিদর্শনই এর মধ্যে বিদ্যমান। শুনে সকলে আশ্বস্ত হলেন। এ যাত্রায়ও কাফেলার পণ্য বিক্রি করে প্রচুর মুনাফা হলো। এভাবে কয়েকবারই খাদীজার ব্যবসা পণ্য নিয়ে তিনি বাহ্‌রায়ন, ইয়ামান ও সিরিয়ায় যাত্রা করেন এবং প্রতিবারই ব্যবসায় প্রচুর মুনাফা হয়।

৮৩
শাদী মুবারক
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আমানতদারী ও বিশ্বস্ততা, উন্নত চালচলন ও নিষ্কলুষ চরিত্রের কথা হযরত খাদীজা (রা)-এর কাছে গোপন ছিলো না। মক্কার প্রতিটি ধনাঢ্য ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি তাঁকে শাদী করার জন্যে অত্যন্ত লালায়িত থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজে নুফায়সা নাম্নী মহিলার মাধ্যমে এবং অন্য রিওয়ায়াত অনুসারে আতিকা ইব্‌ন আবদুল মুত্তালিবের মাধ্যমে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কাছে শাদীর প্রস্তাব পাঠালেন। চাচা আবূ তালিবও এ প্রস্তাব অনুমোদন করলেন। তিনিই শাদীর খুতবা পড়ালেন। এ শাদীর মজলিসে আমর ইব্‌ন ‘আসাদ, ওয়ারাকা ইব্‌ন সাওফিল প্রমুখ, হযরত খাদীজাতুল কুবরা (রা)-র সমস্ত ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন এবং অনুরূপ হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আত্মীয়-স্বজনরাও উপস্থিত ছিলেন। বিবাহের সময় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর বয়স পঁচিশ বছর এবং হযরত খাদীজা (রা)-এর বয়স চল্লিশ বছর ছিল। হযরত খাদীজা (রা)-এর গর্ভে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর তিন পুত্র এবং চার কন্যার জন্ম হয়।

৮৪
সাদিক ও আল-আমীন খিতাব
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সততা, সদাচরণ, আমানতদারী, বিশ্বস্ততা ও উন্নত চরিত্রের খ্যাতি মক্কার সীমানা ছাড়িয়ে গোটা আরবে এতই ছড়িয়ে পড়ে যে, কেউ কেউ আর তাকে নাম ধরে ডাকতো না। সকলেই তাঁকে আস-সাদিক অথবা আল-আমীন বলে ডাকতো। গোটা আরবে এ নামটি বলতেই সকলে তার কথাই বুঝতো এবং এ নামেই লোকে তাকে এক ডাকে চিনতো বা স্মরণ করতো। নিখিল ভারত থিওসফিক্যাল সোসাইটির নেত্রী বিখ্যাত ইংরেজ মহিলা মিসেস এনি বেসান্ত লিখেন :

শ্রেষ্ঠ নবীর [হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর] যে গুণটি আমার অন্তরে তাঁর প্রতি ভক্তির সঞ্চার করেছে, তা হলো তাঁর সেই অনন্য বিশেষণ যা তাঁর স্বদেশবাসীকে তাকে আল-আমীন (পরম বিশ্বস্ত) নামে অভিহিত করতে বাধ্য করেছিল। মুসলিম অ-মুসলিম নির্বিশেষে সকলের কাছে এর চাইতে বেশী অনুসরণযোগ্য ব্যাপার আর কিছুই হতে পারে না। যার গোটা সত্তা সততা ও সত্যবাদিতার প্রতিমূর্তি, তিনি যে সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত ও সম্মানিত তাতে সন্দেহের অবকাশ কোথায়? সত্যের পয়গাম-বাহক কেবল এমন ব্যক্তিই হতে পারেন।

৮৫
হিলফুল ফুযূল
প্রাচীনকালে আরবের কতিপয় মহৎ ব্যক্তি মিলে এ মর্মে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন :

আমরা সর্বদা মজলুমদের সাহায্য করবো এবং জালিমদেরকে প্রতিরোধ করবো।

ঘটনাচক্রে যারা এ প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হয়েছিলেন এদের প্রত্যেকের নামই ছিল ফযল শব্দযুক্ত। এজন্যে তাদের এ প্রতিজ্ঞা বা চুক্তি ‘হিলফুল ফুযূল’ নামে খ্যাতিলাভ করে। এ সংগঠনটির অস্তিত্ব লোপ পেয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু আলোচনা তখনও লোকমুখে প্রচলিত ছিলো। ফিজারের যুদ্ধের পর হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর চাচা যুবায়র ইব্‌ন আবদুল মুত্তালিবের মনে এ চুক্তি তথা সংগঠনটিকে পুনর্জীবিত করার প্রেরণা দেখা দেয়। কতিপয় মহৎ ব্যক্তি আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন জাদআনের বাড়ীতে একত্রিত হয়ে এ মর্মে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন :

“আমরা সর্বদা জালিমদেরকে প্রতিরোধ করবো এবং মজলুমদেরকে সাহায্য করবো।”

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর বয়স তখন অল্প হলেও তিনিও এ চুক্তিতে শামিল ছিলেন। তারপর তিনি যখন যৌবনে পদার্পণ করলেন তখন তিনি অধিকাংশ কবীলার সরদার এবং বিজ্ঞ লোকদেরকে দেশের প্রচলিত অরাজকতা, পথচারীদের লুণ্ঠিত হওয়া, দরিদ্রদের প্রতি ধনী ও আমীর ব্যক্তিদের অত্যাচার-অনাচারের কথা বলে তাদেরকে এ অবস্থায় নিরসনের জন্যে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। অবশেষে বনূ হাশিম, বনূ আবদুল মুত্তালিব, বনূ যুহরা ও বনূ তামীমের লোকদের সমন্বয়ে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রতিটি সদস্যকে অঙ্গীকার করতে হয় :

(ক) আমরা দেশের অরাজকতা ও অশান্তি দূর করবো।

(খ) আমরা পথিকদের জানমালের হিফাযত করবো।

(গ) আমরা নিঃস্ব দরিদ্রদেরকে সাহায্য করবো।

(ঘ) সবলদেরকে দুর্বলদের প্রতি অত্যাচার অবিচার করা থেকে বিরত রাখবো।

এ সংগঠনের দ্বারা জনগণের প্রভূত উপকার সাধিত হয়। নবুওয়াত লাভের পরও হুযূর (সাঃ) বলতেন : যদি আজো কেউ আমাকে সেই অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সাহায্যার্থে আহবান করে তবে আমি তার ডাকে সাড়া দেবো।

৮৬
কুরায়শ কবীলাসমূহের মধ্যে বিবাদ মীমাংসাকারী হিসেবে
একদা কোন এক অসতর্ক মুহূর্তে কা‘বা ঘরে আগুন ধরে যায় এবং এর ফলে কা‘বা ঘরের দেওয়ালের স্থানে স্থানে ফাটল দেখা দেয়। কুরায়শরা ইমারতটি ভেঙ্গে ফেলে নতুনভাবে তা নির্মাণ করতে মনস্থ করে। সকলে তো এ মর্মে সম্মতি দিলো কিন্তু কেউই এ ইমারতটি ভাঙ্গতে সাহসী হলো না। অবশেষে কুরায়শ সরদারদের মধ্যে ওয়ালীদ ইব্‌ন মুগীরা এ কাজটি শুরু করেন। তার দেখাদেখি এ অপসারণ কার্যে অন্যান্য কবীলার লোকেরাও অংশগ্রহণ করলো। এ সময় জেদ্দা বন্দরের নিকটে একটি জাহাজ বিধ্বস্ত হয়। সংবাদ পেয়ে কুরায়শরা লোক পাঠিয়ে তা খরিদ করে এবং উটে বোঝাই করে তার কাঠ মক্কায় নিয়ে আসে। এ কাঠ কা‘বা ঘরের ছাদের জন্যে কেনা হয়েছিল।

কা‘বা ঘরের প্রাচীর ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে যখন ইব্রাহীমী ভিত্তির গোড়া পর্যন্ত তারা পৌঁছে গেল, তখন পুনর্নির্মাণের কাজ তারা শুরু করলো। ছাদের কাঠ যেহেতু পরিমাণে কম ছিল তাই সেবার তারা কা‘বা ঘর ইবরাহীমী ভিতের উপর পুরোপুরি সম্পন্ন করতে পারলো না বরং একদিকের কিছু অংশ তারা বাদ দিয়ে দিল। প্রাচীরের কাজ যখন হাজরে আসওয়াদের স্থান পর্যন্ত পৌঁছলো তখন কুরায়শ কবীলাসমূহের মধ্যে এক বিরাট সংঘাত দেখা দিল। প্রত্যেক কবীলার সর্দার নিজ হাতে এ পবিত্র কাল পাথরটি কা‘বা প্রাচীরে স্থাপন করার জন্যে লালায়িত ছিলো। এ নিয়ে তুমুল যুদ্ধ বাধবার উপক্রম হলো। প্রত্যেক গোত্রের,লোক তলোয়ার কোষমুক্ত করে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেল। বনু আবদেদার এজন্যে প্রয়োজন হলে মরতে বা মারতে প্রস্তুত বলে কসম খেয়ে বসলো। এ কলহে পাঁচ দিন পর্যন্ত নির্মাণ কার্য মুলতবি রইলো। অবশেষে কুরায়শ কবীলাসমূহ এর একটা সুরাহা করার উদ্দেশ্যে কা‘বা ঘরে সমবেত হলো। আবূ উমাইয়া ইব্‌ন মুগীরা প্রস্তাব করলেন : সর্বপ্রথম যে ব্যক্তিটি কা‘বা ঘরে প্রবেশ করবেন তাকেই এর ফায়সালার ভার অর্পণ করা হোক। এমনি সময় লোকজন দেখতে পেলো হুযূর (সাঃ) কা‘বা ঘরে প্রবেশ করলেন। সকলেই ‘আল-আমীন’ ‘আল-আমীন’ বলে সমস্বরে চীৎকার করে উঠলো। তারা জানালো যে, তিনি এ ব্যাপারে যে ফায়সালা করবেন, তাতেই সকলে রাযী থাকবে।

এখানে প্রণিধানযোগ্য, যে মর্যাদাটি লাভের জন্য প্রতিটি কবীলা লালায়িত ছিল এবং রক্তভর্তি পেয়ালায় অঙ্গুলি ডুবিয়ে ডুবিয়ে সে যুগের প্রথামত যে সম্মানটি অর্জনের জন্যে সকলেই মরতে এবং মারতে কসম খেয়ে বসেছিল সে মহাসম্মানের ফায়সালার ভার হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উপর সমর্পণ করতে কারো কোন দ্বিধা ছিল না। এ থেকে এ কথাই প্রতীয়মান হয় যে, হযরতের বিশ্বস্ততা ও ন্যায়নিষ্ঠার প্রতি সকলেরই অগাধ আস্থা ছিল। ব্যাপারটি অনুধাবন করতে পেরে তিনি তৎক্ষণাৎ সে কলহ দূর করে দিলেন। কুরায়শ বংশের প্রবীণ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা পর্যন্ত তখন তাঁর এ অপূর্ব ন্যায়নিষ্ঠা ও বিচক্ষণতা দেখে অভিভত হয়ে যান এবং সকলেই মারহাবা বলে তাকে অভিনন্দিত করেন। তিনি এর ফায়সালা করেন এভাবে, একটি চাদর বিছিয়ে স্বহস্তে তাতে হাজরে আসওয়াদ স্থাপন করেন এবং সকল কবীলার সরদার সে চাদরের চতুর্দিকে ধরে পাথরটি বহন করে নিতে বলেন। কুরায়শ সরদাররা তাঁর কথামত চাদরের চতুর্দিকে ধরে পাথরটি যথাস্থানে বয়ে নিয়ে যায়। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তখন আপন হস্তে তা উঠিয়ে প্রাচীরে স্থাপন করে দেন। এতে সকলেই খুশী হলো এবং কারো বলার কিছু রইলো না। এ ঘটনায় উত্‌বা ইব্‌ন রবী‘আ ইব্‌ন আবদে শামস, আসওয়াদ ইব্‌ন মুত্তালিব ইব্‌ন আসাদ ইব্‌ন আবদুল উজ্জা, আবূ হুযায়ফা ইব্‌ন মুগীরা ইব্‌ন উমর ইব্‌ন মাখদূম এবং কায়স ইব্‌ন আদী আস্-সাহামী অগ্রণী ছিলেন। এরা যেমন করেই হোক এ ব্যাপারটির একটি সুরাহা কামনা করছিলেন। হযরত নবী (সাঃ)-এর এ ফায়সালায় তারা অত্যন্ত মুগ্ধ হন। ঘটনাচক্রে এ নিয়ে যদি যুদ্ধ বাঁধতো তাহলে এ হতো জাহিলিয়াত যুগে সংঘটিত এ যাবৎ কালের সবচাইতে প্রচণ্ড ও ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। হাজরে আসওয়াদের সমস্যা সমাধানকালীন এ ঘটনার সময় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর বয়স ছিলো পঁয়ত্রিশ বছর।

৮৭
গরীবদের লালন-পালন
মান-মর্যাদা ও জনপ্রিয়তায় সম্ভবত তিনিই ছিলেন মক্কার শীর্ষস্থানীয় পুরুষ। কেউ তার শত্রু ছিল না। সকলেই তাঁকে ভক্তি ও শ্রদ্ধার চোখে দেখতো এবং ভালবাসতো। তাঁর বিচক্ষণতা, সুন্দর চালচলন, বিশ্বস্ততা ও আমানতদারীর দেশজোড়া খ্যাতি ছিল। ব্যবসা তাঁর পেশা ছিলো। খাদীজা (রা)-এর সঙ্গে শাদী হবার পর বেশ সচ্ছলতার সাথেই তার জীবন অতিবাহিত হচ্ছিলো। একবার দেশে খুব দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। তার চাচা আবূ তালিবের পরিবারের লোকসংখ্যা ছিল বেশী। খান্দানের প্রবীণতম ব্যক্তি এবং বনী হাশিম গোত্রের সরদার রূপে তাঁর প্রভূত সম্মান ছিল। কিন্তু সাংসারিক সচ্ছলতার অভাবে খুব কষ্টেই তাঁর জীবিকা নির্বাহ হতো। চাচার এ অর্থকষ্ট লক্ষ্য করে একদিন তিনি তাঁর অপর চাচা আব্বাসকে লক্ষ্য করে বললেন, আজকাল দেশে দারুণ দুর্ভিক্ষ চলছে। আবূ তালিবের সংসার বড়। তার পুত্রকে আপনি আপনার সংসারে নিয়ে যান আর একজনকে আমি আমার সংসারে নিয়ে আসি। এভাবে তার সাংসারিক বোঝা বেশ হালকা হয়ে যাবে। তার এ পরামর্শ আব্বাসের খুবই মনঃপূত হলো। তারা দু’জনে তখন আবূ তালিবের খিদমতে উপস্থিত হয়ে তাঁদের প্রস্তাব তাঁর কাছে পাড়লেন। জবাবে আবূ তালিব বললেন : আকীলকে তো আমার কাছে থাকতে দাও আর অন্যদেরকে ইচ্ছে হলে তোমরা নিয়ে যেতে পার। সে মতো হযরত জা‘ফরকে হযরত আব্বাস নিয়ে গেলেন আর হযরত আলীকে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর নিজ ঘরে নিয়ে আসলেন। এটা ঐ বছরেরই ঘটনা, যে বছর কা‘বা ঘর পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু এটা কা‘বা নির্মাণের সময়কার উপরোক্ত ঘটনার পূর্ববর্তী ঘটনা। তখন হযরত নবী (সাঃ)-এর বয়স ছিল পঁয়ত্রিশ বছর আর হযরত আলী (রা)-এর বয়স ছিলো পাঁচ বছর।

৮৮
যায়দ ইব্‌ন হারিছ-এর প্রতি স্নেহ
হযরত খাদীজাতুল কুবরা (রা)-এর ভাতিজা হাকীম ইব্‌ন হিযাম কোথা থেকে যেন একটা ক্রীতদাস কিনে এনে তার ফুফু হযরত খাদীজা (রা)-কে দান করেন। হযরত খাদীজা (রা) তাকে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর খিদমতে সমর্পণ করেন। এরই নাম ছিল যায়দ ইব্‌ন হারিছা। আসলে ইনি একজন স্বাধীন খ্রিস্টান বংশের সন্তান ছিলেন। কোন এক লুটপাটের সময় তিনি ধৃত হয়ে ক্রীতদাসরূপে বিক্রিত হয়ে যান। কিছুদিন পর তাঁর পিতা হারিছা এবং চাচা কাআব যখন জানতে পারলেন যে, তাদের ছেলে যায়দ মক্কার কোন একটি পরিবারে দাসরূপে বসবাস করছেন, তখন তারা উভয়ে মক্কায় এসে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর খিদমতে উপস্থিত হয় এবং বিনীতভাবে প্রার্থনা জানান যে, তাদের ছেলেটিকে যেন তিনি মুক্ত করে দেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তৎক্ষণাৎ তাদের আবেদন মঞ্জুর করেন এবং বলেন যে, যায়দ যদি তোমাদের সাথে চলে যেতে চায়, তবে আমার পক্ষ থেকে তার অনুমতি রইলো। সাথে সাথে যায়দকে ডাকানো হলো। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি এদেরকে চিনতে পারছো? জবাবে যায়দ বললেন, জ্বী হাঁ। এরা হচ্ছেন আমার পিতা ও চাচা। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বললেন, এরা তোমাকে নিতে এসেছেন। আমার পক্ষ থেকে তোমার যাবার অনুমতি আছে। জবাবে যায়দ বললেন : আমি আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। তখন তার পিতা হারিছ ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, তুই কি স্বাধীনতার উপর গোলামীকেই প্রাধান্য দিচ্ছিস? যায়দ মুখের উপর বললেন, জ্বী হাঁ। আমি মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মধ্যে এমন কিছু প্রত্যক্ষ করেছি যে, তাঁর মুকাবিলায় আমি পিতাকে কেন, সারা পৃথিবীরও প্রাধান্য দিতে পারি না। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যায়দের মুখে এ জবাব শুনে তৎক্ষণাৎ তাঁর হাত ধরে কা‘বা ঘরে উপস্থিত হলেন এবং চীৎকার করে ঘোষণা করলেন, “লোক সকল! তোমরা সাক্ষী থেকো, আজ থেকে আমি যায়দকে মুক্ত করছি এবং তাকে আমার ছেলে রূপে গ্রহণ করছি।” সে হবে আমার উত্তরাধিকারী এবং আমি হবো তার উত্তরাধিকারী। যায়দের পিতা ও পিতৃব্য তা দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হলো এবং যায়দকে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কাছে খুশীমনেই রেখে গেলেন। সেদিন থেকে যায়দ ইব্‌ন হারিছ হলেন যায়দ ইব্‌ন মুহাম্মদ (সাঃ)। কিন্তু হিজরতের পর যখন মহানবীর প্রতি ওয়াহী নাযিল হলো যে পালক পুত্রকে পুত্র বলা যাবে না, তখন থেকে আবার সকলে তাঁকে যায়দ ইব্‌ন হারিছা নামেই ডাকতে থাকেন। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁকে পূর্ববৎ ভালবাসতে থাকেন বরং তাঁর এ অনুরাগ আরো বৃদ্ধি পায়। এ ঘটনা দ্বারাই বোঝা যায় যে, নবুওয়াতের পূর্বেও মুহাম্মদ (সাঃ)-এর চরিত্র কত উন্নত ছিল।

৮৯
আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ
বত্রিশ অথবা পঁয়ত্রিশ বছর বয়ঃক্রমকালে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আল্লাহতে অনুরাগ বৃদ্ধি পায় এবং তিনি অত্যধিক নির্জনতাপ্রিয় হয়ে উঠেন। তিনি প্রায়ই একটি জ্যোতি (নূর) দেখতে পেতেন এবং এতে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হতেন। এ জ্যোতির মধ্যে কোন আকার দেখা যেতো না বা কোন আওয়াজও শোনা যেতো না। আরবের মুশরিকী প্রথা-পদ্ধতির প্রতি তিনি সর্বদাই বিমুখ ছিলেন। একদা মক্কায় প্রতিমা পূজারীরা কোন উৎসব উপলক্ষে তাঁর সম্মুখে দেবমূর্তির প্রতি উৎসর্গীকৃত খাবার রেখে দেয়। তিনি সে খাবার যায়দ ইব্‌ন আমরের দিকে ঠেলে দিলেন। কিন্তু তিনিও তা খেলেন না, বরং প্রতিমা পূজারীদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, আমরা দেবমূর্তির নামে উৎসর্গিত খাবার খাই না। ইনি হচ্ছেন সেই যায়দ ইব্‌ন আমর ইব্‌ন নুফায়ল, যার কথা উপরে বর্ণিত হয়েছে এবং যিনি হযরত উমর (রা)-এর চাচা ছিলেন। তিনি নির্জনতার মুহূর্তগুলোতে আল্লাহর সৃষ্টিলীলা সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করতেন এবং অধিকাংশ সময়ই আল্লাহর গুণগানে রত থাকতেন। মুশরিকী কার্যকলাপ ও প্রথা-পদ্ধতি থেকে পুরোপুরি দূরে থাকতেন। বয়স চল্লিশ বছরের যতই নিকটবর্তী হতে লাগলো তাঁর নির্জনবাস ততই বৃদ্ধি পেতে লাগলো। প্রায় সময়ই তিনি ছাতু ও পানি নিয়ে হেরা পর্বতের গুহায় চলে যেতেন এবং সেখানে গিয়ে বেশ কয়েকদিন পর্যন্ত যিকির-আযকার ও ইবাদতে নিমগ্ন থাকতেন। যখন ছাতু ও পানি শেষ হয়ে যেতো তখন ঘরে এসে পুনরায় ছাতু ও পানি নিয়ে যেতেন এবং পুনরায় আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন হতেন। হেরা গুহা হলো হেরা পর্বতের একটি গুহা। হেরা পর্বতকে আজকাল ‘জাবালে নূর’ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। মক্কা থেকে তিন মাইল দূরে মিনায় যেতে এ পাহাড়টি বাঁয়ে পড়ে। এ গুহাটি দৈর্ঘ্যে চার গজ এবং প্রস্থে দুই গজ। এ অবস্থায় তিনি সত্য স্বপ্ন দেখতেন। পরদিন প্রত্যুষে অনুষ্ঠিতব্য ঘটনাবলী তিনি রাত্রে স্বপ্নে প্রত্যক্ষ করতেন। এভাবে দীর্ঘ সাতটি বছর তাঁর আল্লাহর ইবাদতের সাধনায় অতিবাহিত হয়। শেষে দু’টি মাস এভাবে কাটে যে তিনি যেন ইবাদতের প্রতিমূর্তি হয়ে দাঁড়ান। হেরা পর্বতের গভীর নির্জনতায় তিনি এ সময়টা পুরোপুরিই নিমগ্ন থাকেন এবং এ সময় উপর্যুপরি তিনি সত্য স্বপ্ন দেখতে থাকেন।

৯০
সূর্যোদয়
প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের বয়স চল্লিশ বছর পূর্ণ হলো। হিদায়াতের রবি এবার উদয়াচলে। আল্লাহর পক্ষ থেকে তাকে প্রদত্ত আধ্যাত্মিক শক্তি যখন চরমভাবে বিকশিত হলো, ইবাদত, সিয়াযত ও নির্জন সাধনায় পূর্ণতা লাভ করে যখন তিনি ওয়াহী বহনের পূর্ণ যোগ্যতা অর্জন করলেন তখন একদা হেরা গিরি গুহায় ফেরেশতার আবির্ভাব ঘটলো।

ফেরেশতা তাকে লক্ষ্য করে বললেন : اقْرَأْ -অর্থাৎ “আপনি পড়ুন!”

তিনি জবাব দিলেন : مَا اَنَا بِقَارِئٍ –“আমি তো পড়তে জানি না।”

তারপর তিনি তাঁকে আলিঙ্গন করে জোরে চাপ দিলেন এবং বললেন : اقْرَأْ

তিনি আবার জবাব দিলেন : مَا اَنَا بِقَارِئٍ

তিনি আবার তাঁকে আলিঙ্গন করে জোরে চাপ দিলেন। তারপর ছেড়ে দিয়ে পুনরায় বললেন : اقْرَأْ পুনরায় তিনি জবাব দিলেন : مَا اَنَا بِقَارِئٍ

এবার তৃতীয়বার ফেরেশতা তাঁকে আলিঙ্গন করে জোরে চাপ দিয়ে বললেন :

اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ . خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ . اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ . الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ . عَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ .

পড় সেই রব-এর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। মানুষকে যিনি জমাট রক্তপিণ্ড থেকে সৃষ্টি করেছেন। পড় এবং তোমার রব-ই সবচাইতে সম্মানিত ও মহান। যিনি কলমের দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানতো না। (৯৬: ১-৫)

প্রিয়নবী (সাঃ) পাঠ করলেন। ফেরেশতা অদৃশ্য হয়ে গেলেন। তিনি সেখান থেকে ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় ঘরে ফিরলেন এবং খাদীজা (রা)-কে লক্ষ্য করে বললেন : زملونى زملونى “আমাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও। আমাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও।” হযরত খাদীজা (রা) তাঁকে কম্বল দিয়ে আবৃত করে দিলেন। তিনিও রীতিমত ঘাবড়ে গেলেন যে, ব্যাপার কী! কিছুক্ষণ পরে যখন তিনি কিছুটা শান্ত হলেন, তখন তিনি সমস্ত বিবরণ আনুপূর্বিক খাদীজাকে শোনালেন এবং বললেন : لقد خشيت على نفسى “আমার তো ভয় হচ্ছে আমি বুঝি আর বাঁচবো না।”

৯১
হযরত খাদীজা (রা)-এর ঐতিহাসিক সান্ত্বনা বাণী
জবাবে হযরত খাদীজা (রা) বললেন :

كلا البشر فوالله لا يحزيك الله ابدا انك لتصل الرحم وتصدق الحديث وتحمل الكل وتكسب المعدوم وتقري الضيف وتعين على نوائب الحق .

“কখনো তা হতে পারে না। আপনি শান্ত হোন! আল্লাহ আপনাকে কখনো লাঞ্ছিত অপদস্থ করতে পারেন না। কেননা–

(ক) আপনি সর্বদা আত্মীয়-স্বজনের সাথে ঘনিষ্ঠ আচরণ করেন (তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন না বা অনাত্মীয়সুলভ আচরণ করেন না।)

(খ) সর্বদা সত্য কথা বলেন।

(গ) অপরের বোঝা বহন করেন (কর্জ প্রভৃতি শোধ করেন।)।

(ঘ) নিঃস্বদের দেখাশোনা করেন।

(ঙ) অতিথিদের সেবা-যত্ন করেন।

(চ) বিপদগ্রস্তদের সাহায্য করেন এবং সত্যের সহায়তা করেন।

এভাবে সান্ত্বনা দেওয়ার পর তিনি তাকে নিয়ে তার চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইব্‌ন নাওফিলের কাছে যান। তিনি তখন অত্যন্ত বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ওয়ারাকা ইব্‌ন নাওফিলের কাছে সবকিছু আনুপূর্বিক বর্ণনা করেন। সব শুনে ওয়ারাকা বললেন : ইনি হচ্ছেন সেই মহান ফেরেশতা যিনি মূসা (আ)-এর কাছে এসেছিলেন। হায়, যদি আমি যুবক হতাম এবং ঐ সময় পর্যন্ত জীবিত থাকতাম যখন আপনার স্বজাতি আপনাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করবে। হুযূর (সাঃ) তখন বললেন :

او مخرجوهم

“কি, তারা আমাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করবে?”

ওয়ারাকা ইব্‌ন নাওফিল বললেন, “জ্বী হাঁ। এ পৃথিবীর যিনিই রাসূল এসেছেন, তিনিই একত্ববাদের দাওয়াত দিয়েছেন, লোকে প্রথমে তাদের সাথে শত্রুতাই করেছে।” তারপর যথারীতি তিনি হেরা গুহায় যাতায়াত করতেন। কিছুদিন পর্যন্ত আর তার কাছে কোন ওয়াহী আসে নি। এ সময়টাকে ফাতরা বা বিরতিকাল বলা হয়ে থাকে।

অবশেষে একদিন তিনি হেরাগুহা থেকে বাড়ীতে ফিরছেন এমন সময় তিনি সেই ফেরেশতাকে দেখতে পেলেন। তিনি তাকে দেখে রীতিমত ঘাবড়ে গেলেন এবং ঘরে এসে বস্ত্রাবৃত হয়ে শুয়ে পড়লেন। এ সময় তার কানে এ গুরুগম্ভীর আওয়াজ এলোঃ

يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ . قُمْ فَأَنْذِرْ . وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ . وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ . وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ .

হে বস্ত্রাচ্ছাদিত! উঠো এবং লোকদেরকে (আল্লাহর শাস্তি থেকে) সতর্ক কর এবং তোমার রব-এর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর এবং তোমার পরিচ্ছদ পবিত্র রাখ এবং অপবিত্রতা শির্‌ক ও খারাবি থেকে দূরে থাক। (৭৪:১-৫)

তারপর একের পর এক ওয়াহী আসা অব্যাহত থাকে। একদা হযরত জিবরাঈল আমীন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে পাহাড়ের পাদদেশে নিয়ে যান। তাঁর সম্মুখে নিজে ওযূ করেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-ও তার দেখাদেখি অনুরূপ ওযূ করেন। তারপর জিবরাঈল (আ) তাঁকে নামায পড়ালেন।

৯২
ইসলাম প্রচারের সূচনা
তাওহীদ প্রচারের হুকুম পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) তাওহীদের তথা ইসলামের প্রচারকার্য শুরু করেন। লোকজনকে শির্‌ক থেকে বিরত রাখার এবং তাওহীদ বা আল্লাহর একত্বের দাওয়াতের কাজ তিনি নিজ ঘর থেকেই শুরু করেন। সর্বপ্রথম হযরত খাদীজা (রা) তাঁর প্রতি ঈমান আনয়ন করেন। হযরত আলী ইব্‌ন আবূ তালিব (রা) এবং যায়দ ইব্‌ন হারিছা (রা) প্রথম দিনই তার প্রতি ঈমান আনয়ন করেন। এরা সবাই ছিলেন তার ঘরের মানুষ। তার বন্ধু হযরত আবূ বকর (রা)-ও ঈমান আনয়ন করেন। সর্বপ্রথম ঈমান আনয়নকারীদের একজন ছিলেন তাঁর সহধর্মিণী, একজন চাচাতো ভাই, একজন আযাদকৃত ক্রীতদাস আর একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বলা বাহুল্য, এদের প্রত্যেকেই তার আচার-আচরণ সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলেন এবং তাঁর জীবনের কোন দিক এদের কাছে গোপন ছিলো না। এদের সর্বপ্রথম ঈমান আনয়ন তার উন্নত চরিত্রের একটি বলিষ্ঠ প্রমাণ। প্রথমে তিনি তাঁর এ প্রচারকার্য গোপনে গোপনে নিকটাত্মীয় ও বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন। প্রথম পর্যায়ে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) সবচাইতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। তাঁর বন্ধুমহল কুরায়শদের মধ্যে অনেক বিস্তৃত ছিলো। তারই প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে হযরত উসমান ইব্‌ন আফফান (রা), হযরত তালহা ইব্‌ন উবায়দুল্লাহ্ (রা), হযরত সা‘দ ইব্‌ন আবী ওয়াক্কাস (রা), হযরত আবদুর রহমান ইব্‌ন আওফ (রা), হযরত যুবায়র ইব্‌ন আওয়াম (রা) প্রমুখ ঈমান আনয়ন করেন। এরপর হযরত আবূ উবায়দা ইবনুল জাররাহ (রা), হযরত আবূ সালামা (রা), হযরত আবদুল আসাদ ইব্‌ন হিলাল (রা), হযরত উছমান ইব্‌ন মাজউন (রা), হযরত কুদামা ইব্‌ন মাজউন (রা), হযরত সাঈদ ইব্‌ন যায়দ (রা), হযরত উমর (রা)-এর ভগ্নি হযরত ফাতিমা (রা) প্রমুখও ইসলামে দাখিল হন। এঁদের পরে হযরত সা‘দ ইব্‌ন আবী ওয়াক্কাসের সহোদর হযরত উমায়র (রা), হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন মাসঊদ (রা), হযরত জা‘ফর ইব্‌ন আবূ তালিব (রা) প্রমুখ ঈমান আনয়ন করেন এবং এ ভাবে মুসলমানদের একটি ছোটখাট জামাআত তৈরী হয়ে যায়। এঁদের মধ্যে নারী-পুরুষ, যুবা, বৃদ্ধা সর্বশ্রেণীর লোক ছিলেন। মুশরিকদের ভয়ে মুসলমানরা মক্কার বাইরে পাহাড়ের ঘাঁটিতে গিয়ে সালাত আদায় করতেন। তিন বছর পর্যন্ত ইসলামের প্রচারকার্য এভাবে গোপনে গোপনেই হতে থাকে এবং শনৈঃ শনৈঃ লোকজন শিরুক ও মূর্তিপূজা থেকে বিমুখ হয়ে ইসলামে দাখিল হতে থাকে। এ তিন বছর পর্যন্ত কুরায়শদের প্রতিটি মজলিশে এ নতুন ধর্মের কথা আলোচিত হতে থাকে। মুসলমানরা যেহেতু নিজেদের নবধর্মে দীক্ষিত হওয়ার কথা প্রচার করতেন না, তাই তাদের নিজেদের মধ্যেও একে অপরকে মুসলমান বলে সম্বোধন করতে পারতেন না। কুরায়শরা প্রথম দিকে এ নতুন ধর্মকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ বা মারাত্মক কিছু বলে মনে করেনি। তাই তারা এ নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতো এবং মুসলমানদেরকে মৌলিকভাবে কষ্ট দিতো। সামগ্রিকভাবে এ নতুন ধর্মকে উৎখাত করার জন্যে সমস্ত সম্প্রদায়ের লোকজন সক্রিয় হয়ে উঠেনি। কুরায়শের কোন কোন দুষ্ট লোক ফাঁক পেলেই দুর্বলতার সুযোগে মুসলমানদেরকে দৈহিক নির্যাতন করতেও ছাড়তো না। একবার হযরত সা‘দ ইব্‌ন আবী ওয়াক্কাস (রা) মুসলমানদের একটি ঘাঁটিতে সালাত আদায় করছিলেন। অতর্কিতে সেখানে কয়েকজন মুশরিক মক্কাবাসীর আগমন ঘটলো। তারা অত্যন্ত কঠোরভাবে মুসলমানদেরকে সালাত আদায়ে বাধা দিলো। হযরত সাআদ (রা)-ও অত্যন্ত শক্তভাবে তার মুকাবিলা করেন। একজন বিধর্মী হযরত সাআদ (রা)-এর তরবারির আঘাতে আহতও হয়। আল্লাহর রাস্তায় এটাই ছিলো মুসলমানদের সর্বপ্রথম তরবারি চালনা।

একদিন প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ও হযরত আলী (রা) একটি ঘাঁটিতে সালাত আদায়ে রত ছিলেন। এমন সময় কোথা থেকে আবূ তালিব এসে সেখানে উপস্থিত। তিনি নীরবে দাঁড়িয়ে তা লক্ষ্য করলেন। তারপর যখন তাঁদের সালাত শেষ হলো, তখন তিনি বললেন : এ কোন ধর্ম তোমরা গ্রহণ করলে? হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নির্বিকারে জবাব দিলেন : এটাই হচ্ছে ইবরাহীম (আ)-এর ধর্ম। সাথে সাথে তিনি চাচাকেও এ ধর্ম গ্রহণের দাওয়াত দিলেন। জবাবে আবূ তালিব বললেন : আমি তো আমার বাপ-দাদার ধর্ম ত্যাগ করবো না। কিন্তু হযরত আলী (রা)-কে উদ্দেশ্য করে বললেন : বেটা, তুমি কিন্তু মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সঙ্গ পরিত্যাগ করবে না। আমার গভীর আস্থা রয়েছে যে, মুহাম্মদ তোমাকে পুণ্য ছাড়া কোনদিন পাপের উৎসাহ দিবেন না। মোদ্দাকথা, ওয়াহী অবতীর্ণ হওয়ার দিন থেকে শুরু করে তিন বছরকাল পর্যন্ত ইসলামের প্রচারকার্য নীরবে নিভৃতে চলতে থাকে এবং সৌভাগ্যবানরা ধীরে ধীরে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট হতে থাকেন।

৯৩
সাফা পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে প্রথম সত্য-ঘোষণা
এবার আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ এলো ওয়াহীর মাধ্যমে :

فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ

(হে রাসূল!) আপনি যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছেন তা প্রকাশ্যে প্রচার করুন।

এ নির্দেশ আসার পর প্রিয়নবী (সাঃ) সাফা পাহাড়ে আরোহণ করলেন এবং এক একটি করে কবীলার নাম ধরে সবাইকে উচ্চৈঃস্বরে আহবান জানাতে লাগলেন। আরবের তৎকালীন প্রথা অনুসারে লোকজন এসে তার চতুষ্পার্শ্বে জমায়েত হলো। তখন তিনি বললেন :

اخبرتكم ان العدو مصبحكم او ممسكم اما کنتم

হে কুরায়শ, আমি যদি তোমাদেরকে সংবাদ দেই যে, সকালে অথবা সন্ধ্যায় তোমাদের উপর শত্রুর আক্রমণ হবে। তাহলে কি তোমরা আমার কথায় বিশ্বাস করবে?

সকলে সমস্বরে বলে উঠলো : “আলবৎ, আমরা সব সময় আপনাকে সত্যকথা বলতে শুনেছি।” এবার হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলে উঠলেন :

“আমি তোমাদেরকে সংবাদ দিচ্ছি, আল্লাহর শাস্তি অতি নিকটবর্তী। তাঁর প্রতি ঈমান আনয়ন করো, যাতে করে তার শাস্তি থেকে রেহাই পেতে পারো।”

তাঁর কথা শুনে কুরায়শরা হেসে উঠলো। আবূ লাহাব বলে উঠলো, “তোমার জন্য ধ্বংস আসুক : এজন্যেই কি তুমি আমাদেরকে ডেকে এনেছো?”

এরপর সমাবেশ ভঙ্গ হয়ে গেলো। লোকজন যার যার ঘরে নানা কথা বলাবলি করতে করতে চলে গেলো। আবূ লাহাব উঠে যেতেই নাযিল হলো : تَبَّتْ يَدَا أَبِي لَهَبٍ সূরা। আরো কয়েকদিন পর নাযিল হলো :

وَأَنْذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ

অর্থাৎ নিকটাত্মীয়দেরকে সতর্ক করুন (হে রাসূল!)।

হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হযরত আলী (রা)-কে একটি যিয়াফতের আয়োজন করতে বললেন। হযরত আলী (রা) নির্দেশ মাফিক যিয়াফতের আয়োজন করলেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নিকটাত্মীয়দেরকে দাওয়াত করলেন। প্রায় চল্লিশজন আত্মীয়-স্বজন এলেন। যখন সকলের খাওয়া-দাওয়া শেষ হলো তখন তিনি কিছু বক্তৃতা করতে চাইলেন। কিন্তু আবূ লাহাব এমনি আজে-বাজে কথাবার্তা শুরু করে দিলো যে, লোকজন একে একে চলে গেলো। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কথা বলার কোন সুযোগই আর হয়ে উঠলো না। পরদিন আবার সবাইকে দাওয়াত দেওয়া হলো। সকলের খাওয়া দাওয়া শেষ হলে হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদেরকে সম্বোধন করে বললেন :

দেখো, আমি তোমাদের নিকট এমন উত্তম কথা নিয়ে এসেছি যার চাইতে উত্তম কথা কেউ কোনদিন তার স্ব-সম্প্রদায়ের জন্যে নিয়ে আসেনি। বলো, তোমাদের মধ্যে কে কে এ কাজে আমাকে সাহায্য করবে?

একথা শুনে সকলেই নিশ্চুপ হয়ে রইলো। কারো মুখেই কোনো জবাব শোনা গেলো না। এমনি সময় হযরত আলী (রা) দাঁড়িয়ে বললেন :

যদিও আমি বয়সে সবার চাইতে ছোট এবং সবচাইতে দুর্বল,

আমি আপনাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে প্রস্তুত রয়েছি।

তাঁর এ কথা শুনে সবাই হেঁসে উঠলো এবং ঠাট্টা-মশকরা করতে করতে প্রস্থান করলো।

৯৪
প্রকাশ্য প্রচার
এবার রাসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রকাশ্যে লোকজনকে তাওহীদ ও ইসলামের দাওয়াত দিতে লাগলেন। এ সময়েই তার উপর এবং তার ছোট দলটির উপর দুর্ভোগ নেমে এলো। মেলায়, মজলিসে, বাজারে, বৈঠকখানায় তথা ঘরে ঘরে গিয়ে তিনি লোকজনকে তাওহীদের সৌন্দর্য বোঝাতে লাগলেন এবং মূর্তিপূজা করতে নিষেধ করতে লাগলেন। তিনি ব্যভিচার, জুয়া, মিথ্যা কথন, বিশ্বাসভঙ্গ, চুরি-ডাকাতি, রাহাজানি প্রভৃতি অনাচারের পথ থেকে লোকজনকে ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করতে লাগলেন। কুরায়শরা ছিলো ভীষণ দাম্ভিক প্রকৃতির। তাদের বাপদাদার ধর্ম ও আচার-আচরণের নিন্দাবাদ শুনে যাওয়া তাদের পক্ষে মোটেই সহজ ব্যাপার ছিলো না। তাদের মধ্যে মনিব ও গোলামের পার্থক্য বা ভেদাভেদ ছিলো একটা স্বীকৃত ব্যাপার। ইসলাম মনিব ও গোলামের এ পার্থক্যকে মিটিয়ে দিয়ে একই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে সবাইকে আবদ্ধ করে ছিলো। এ সাম্যও তাদের মনঃপূত ছিলো না। কুরায়শ ও মক্কাবাসীদের মর্যাদা গোটা আরবে স্বীকৃত ছিলো। তাদের এ মর্যাদা ছিলো সেই মূর্তিগুলোর জন্যে যেগুলোর পূজার জন্যে গোটা আরব থেকে বিভিন্ন কবীলার লোক মক্কায় ছুটে আসতো এবং মূর্তি পূজার আনুষ্ঠানিক উৎসব পালন করতো। ইসলাম ছিল মূর্তিপূজার ঘোর বিরোধী। যার ফলশ্রুতিতে তাদের মান-মর্যাদা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি খর্ব হওয়া ছিল অনিবার্য। বড় বড় সরদাররা কোনমতেই একথা মেনে নিতে রাযী ছিলো না যে, মহানবীর আনুগত্য মেনে নিয়ে তারা তাদের নিজ নিজ সরদারী থেকে হাত গুটিয়ে নেবে। কুরায়শদের অধিকাংশ কবীলার লোকজন এমনিতেই বনূ হাশিম গোত্রের প্রতি অন্তরে বিদ্বেষ পোষণ করতো। এজন্যে তারা একথা কোনমতেই মেনে নিতে পারছিল না যে, একটা প্রতিদ্বন্দ্বী গোত্রের একজন লোককে নবীরূপে স্বীকার করে নিয়ে তারা তাঁর আনুগত্য করবে। এ প্রকাশ্য প্রচারের ফলে সমস্ত কুরায়শ বংশ তাঁদের শত্রুতায় অবতীর্ণ হলো এবং তারা ইসলাম ও তার নবী (সাঃ)-এর মূলোৎপাটন করার জন্যে সক্রিয় হয়ে উঠলো। কুফর ও ইসলামের এ প্রকাশ্য সংঘাত নবুওয়াতের চতুর্থ বছরে অত্যন্ত জোরেশোরে শুরু হয়ে যায়।

৯৫
ইসলামের প্রথম মাদরাসা-দরস্‌গাহ
এ সময়েই হযরত নবী (সাঃ) সাফা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত, আরকাম ইব্‌ন আরকাম (রা)-এর বাড়ীকে ইসলামের দরস্‌গাহ বা শিক্ষাগাররূপে ব্যবহার করতে শুরু করেন। নবদীক্ষিতরা এ বাড়ীতে এসে ইসলামের শিক্ষা দিতেন, তা‘লীম দিতেন। এ বাড়ীতে সর্বদা মুসলমানদের ভিড় লেগেই থাকতো। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এখানে বসেই সকলকে ইসলামের শিক্ষা দিতেন এবং এখানেই সকলে মিলে একত্রে সালাত আদায় করতেন। নবুওয়াতের ষষ্ঠ বছর পর্যন্ত পুরো তিন বছর এই দারুল-আরকামই ছিলো প্রিয় নবী (সাঃ)-এর অবস্থানস্থল এবং ইসলামের প্রাণকেন্দ্রস্বরূপ। এ তিন বছরে যারাই ইসলাম গ্রহণ করেছেন তাদেরকে আদি পর্যায়ের মুসলমানদের মর্যাদা দেয়া হয়ে থাকে। দারুল আরকামে ইসলাম গ্রহণকারীদের তালিকায় হযরত উমর ফারূক (রা)-এর নামই হচ্ছে সর্বশেষ নাম। তার ইসলাম গ্রহণের ফলে মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং তারা দারুল আরকাম থেকে মুক্তাঙ্গনে বেরিয়ে এলেন। কুরায়শরা যখন হযরত রসূল (সাঃ) ও তাঁর দলের মূলোৎপাটনকে একান্তই অপরিহার্য বলে বিবেচনা করলো, তখন তারা নির্যাতনের নতুন নতুন পন্থা অবলম্বন করলো।

৯৬
কুরায়শদের বিরোধিতা
ঈমান আনয়ন করে যারা মুসলমান হলেন, তাঁদের মধ্যে এমন লোকও ছিলেন যারা ক্রীতদাস। আর কিছু লোক এমনও ছিলেন যারা কবীলা বা গোত্রের বল বা আত্মীয়-স্বজনের সংখ্যা প্রচুর না থাকায় সমাজে অত্যন্ত দুর্বল বলে বিবেচিত হতেন। এমন লোকদেরকে ইসলামচ্যুত করার জন্যে বিরুদ্ধবাদীরা তাদেরকে দৈহিকভাবে নির্যাতন করতে শুরু করলো। যারা কোন কবীলাভুক্ত ছিলেন তাদেরকে নির্যাতন করলে তাঁদের আত্মীয়-স্বজন তাদের সমর্থনে দাঁড়িয়ে যেতে পারে এরূপ আশঙ্কায় তারা তাদের আত্মীয়-স্বজনকেই ইসলাম গ্রহণকারী নিকটাত্মীয়দেরকে শাস্তি দিয়ে ও নির্যাতন চালিয়ে ধর্মচ্যুত করার জন্যে উদ্বুদ্ধ করতে লাগলো। যাতে কেউ ইসলাম গ্রহণে সাহসী না হয় তজ্জন্য মুসলমানদেরকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করার এবং তাদেরকে প্রকাশ্যে নিন্দাবাদ করার জন্যে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হলো। এদিকে হযরত রাসূল (সাঃ)-ও ইসলামের প্রকাশ্য প্রচারকার্যের মাত্রা বাড়িয়ে দিলেন। ওদিকে কুরায়শরাও পূর্ণ উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে বিরোধিতার জন্যে কোমর বাঁধলো। হযরত বিলাল (রা) ছিলেন উমাইয়া ইব্‌ন খালফের ক্রীতদাস। তার ইসলাম গ্রহণের কথা জানতে পেরে উমাইয়া তাঁকে নানারূপ পীড়া দিতে থাকে। মরুভূমির উত্তপ্ত বালিতে তাঁকে শুইয়ে দিয়ে বুকের উপর ভারী পাথর চাপা দিয়ে রাখা হতো। বেত্রাঘাতে গোটা দেহ জর্জরিত করা হতো। ভুখা রাখা হতো। গলায় রশি বেঁধে দুষ্ট ছেলেদের হাতে তাকে তুলে দেয়া হতো। তারা তাকে মক্কার অলিতে-গলিতে, শহরে-বাইরে, পাহাড়-পর্বতে ও মরুপ্রান্তরে টেনে নিয়ে ফিরতো এবং বেদম মারপিট করতো। হযরত বিলাল (রা) এ সব নির্যাতনই সহ্য করে যেতেন আর মুখে ‘আহাদ’ ‘আহাদ উচ্চারণ করতেন।

হযরত আম্মার (রা) তার পিতা ইয়াসির এবং মাতা সুমাইয়ার সাথে একত্রে মুসলমান হন। আবূ জাহেল তাদেরকে নানারূপে ক্লেশ দিতো। জালিম আবূ জাহেল হযরত সুমাইয়া (রা)-কে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে বর্শার আঘাতে শহীদ করে। হযরত যুবায়র (রা)-কে আবূ জাহেল এতই প্রহার করে যে, প্রহারের ফলে তিনি অন্ধ হয়ে যান। এমন গোলাম-বাঁদীর সংখ্যা প্রচুর যাদেরকে এত কঠোর ও অমানবিক নির্যাতন করা হয় যে, এগুলো কল্পনা করতেও শরীর শিউরে উঠে। কিন্তু ইসলাম এমনি এক শক্তি যে, ঐ নিষ্ঠুর নরপিশাচের এতরূপ নির্যাতন করেও কোন একটি মুসলমানকেও ইসলামচ্যুত করে মুরতাদ বানাতে সমর্থ হয়নি।

হযরত উসমান (রা) ছিলেন বনী উমাইয়া গোত্রের একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি। ইসলাম গ্রহণের অপরাধে তাঁর চাচা রশি দিয়ে তাকে বেঁধে বেদম প্রহার করে এবং নানাভাবে দৈহিক নির্যাতন চালায়। হযরত যুবায়র ইব্‌ন আওআম (রা)-কে তাঁর চাচা চাটাইর উপর শুইয়ে দিয়ে তার নাকে ধোয়া দিতো। হযরত আবূ যর গিফারী (রা)-কে কুরআন পড়তে শুনে কুরায়শরা এরূপ প্রহার করে যে, তাঁর সংজ্ঞা লোপ পায় এবং তিনি ভূমিতে লুটিয়ে পড়েন। তারা তাঁকে প্রাণে বধ করতেই উদ্যত হয়েছিল। এমন সময় হযরত আব্বাস (রা) এই বলে তাদেরকে বাধা দেন যে, এ হচ্ছে বনী গিফার গোত্রের লোক। তোমাদের বাণিজ্য কাফেলা চলার পথেই এদের বাস। এরা তোমাদের নাকে দম এনে তবে ছাড়বে। অর্থাৎ বাণিজ্য কাফেলার পথ রুদ্ধ করে অর্থনৈতিকভাবে তোমাদেরকে অবরোধ করবে।

হযরত আবদুল্লাহ ইব্‌ন মাসঊদ (রা)-কেও অনুরূপভাবে কা‘বা প্রাঙ্গণে প্রহার করতে করতে তারা বেহুশ করে ফেলে। অনুরূপভাবে হযরত খাব্বাব ইব্‌ন আরাতকে তারা নানাভাবে নির্যাতন করে। একবার জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর তাকে চিৎ করে শুইয়ে দিয়ে এক ব্যক্তি তার বুকের উপর চেপে বসে যাতে তিনি পার্শ্ব পরিবর্তন করতে না পারেন। তার কোমরের চামড়া ও গোশত পুড়ে গিয়ে কা‘বাব হয়ে যায়। কোন কোন সাহাবাকে গরু বা উটের কাঁচা চামড়ার মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলে দিত। কাউকে কাউকে লোহার বর্ম পরিয়ে জ্বলন্ত আগুনে এবং জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর ফেলে দিতো।

৯৭
নবী করীম (সাঃ)-এর সাথে ধৃষ্টতামূলক আচরণ
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) একদিন খানায়ে কা‘বায় সালাতরত ছিলেন। এমন সময় উক্‌বা ইব্‌ন আবী মু‘আইত তার গলায় চাদর ফেলে এভাবে পেচাতে লাগলো যে, তাঁর শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছিল। সংবাদ পেয়ে হযরত আবূ বকর (রা) দৌড়ে আসলেন এবং তাঁকে দুষ্টের কবল থেকে উদ্ধার করলেন। সাথে সাথে তিনি কুরায়শদেরকে লক্ষ্য করে বললেন :

أَتَقْتُلُونَ رَجُلًا أَنْ يَقُولَ رَبِّيَ اللَّهُ .

তোমরা কি এক ব্যক্তিকে কেবল এ অপরাধেই হত্যা করবে যে, সে বলে আমার রব আল্লাহ্। (৪০ : ২৮)

তখন কাফিররা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে তো ছেড়ে দিলো কিন্তু হযরত আবূ বকর (রা)-কে ঘিরে ফেললো এবং তাকে বেদম প্রহার করলো।

একবার কা‘বা প্রাঙ্গণে কাফিররা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে লাঞ্ছিত করতে উদ্যত হয়। হযরত হারিছ ইব্‌ন আবী হালা (রা) সংবাদ পেয়ে দৌড়ে এসে সেখানে উপস্থিত হন এবং তাকে দুষ্টদের কবল থেকে রক্ষার প্রয়াস পান। কাফির নরপিশাচরা তাঁকে সেখানেই শহীদ করে ফেলে! কিন্তু আর তার গায়ে হাত তোলার সাহস কারো হয় নি। রাতের বেলা হযরত রাসূল (সাঃ) যে পথ দিয়ে চলাফেরা করতেন, তাকে কষ্ট দেওয়ার মানসে সে পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখা হতো।

একবার প্রিয় নবী (সাঃ) কা‘বা প্রাঙ্গণে সালাত আদায়ে রত ছিলেন। কুরায়শরা তখন সেখানে উপবিষ্ট ছিল। এমন সময় আবূ জাহেল বলে উঠলো, অমুক স্থানে উট যবাহ হয়েছে। তার ভুঁড়ি সেখানে পড়ে আছে। কেউ একজন তা উঠিয়ে নিয়ে এসে মুহাম্মদের উপর ফেলে দাও। উকবা ইব্‌ন আবী মুআইত উঠে গিয়ে তৎক্ষণাৎ তা নিয়ে এলো এবং যখনই তিনি সিজদায় গেলেন তখন সে তা তার পিঠের উপর ফেলে দিল। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তো তখন আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন ছিলেন বিধায় তা টেরও পেয়ে উঠেন নি, কিন্তু কাফিররা পৈশাচিক উল্লাসে ও অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। হযরত আবদুল্লাহ ইব্‌ন মাসঊদ (রা) তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু কাফিরদের ভিড় দেখে তিনি কিছু করতে সাহস পেলেন না। ঘটনাচক্রে হযরত ফাতিমাতুয্ যুহরা (রা) সেখানে এসে উপস্থিত হন। তিনি তখন বালিকা মাত্র। তিনিই অগ্রসর হয়ে পিতার পিঠ থেকে বহুকষ্টে উটের ভুঁড়ি সরালেন এবং এ সময় তিনি নরপিশাচ কাফিরদেরকে আচ্ছা করে ভর্ৎসনা করেন।

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ঘরে প্রায়ই ঢিল পাথর ছোঁড়া হতো। নানারূপ আবর্জনাও নিক্ষিপ্ত হতো তাঁর বাসগৃহে। একবার তিনি ভর্ৎসনার সুরে বললেন : হে বনূ আবদে মানাফ। প্রতিবেশীর উত্তম হকই তোমরা আদায় করছো! কখনো তাকে শায়ের বা কবি, আবার কখনো সাহের বা যাদুকর বলে আখ্যায়িত করা হতো। কখনো তাঁকে জ্যোতিষীর খেতাব দেয়া হতো, আবার কখনো জিনগ্রস্ত বা উন্মাদ বলে অভিহিত করা হতো। মোদ্দাকথা, মক্কার কাফিররা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ও তাঁর অনুসারীদেরকে নির্যাতন করতে এবং তাদের কাজে বাধা সৃষ্টি করতে কোনরূপ শৈথিল্য প্রদর্শন করেনি। এ জন্যে হেন কোন পন্থা নেই–যা তারা অবলম্বন করেনি। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-ও পূর্ণোদ্যমে সাহস ও প্রত্যয়ের সাথে তার প্রচারকার্যে নিয়োজিত ছিলেন। কাফিররা যখন নিশ্চিত হলো যে, তাদের সকল চেষ্টাই পণ্ড হতে চলেছে এবং এতসব পরেও বিন্দুমাত্র সাফল্য অর্জন তাদের পক্ষে সম্ভবপর হয়নি, তখন তারা বাধ্য হয়ে অন্য পথ অবলম্বন করলো।

৯৮
দ্ব্যর্থহীন জবাব
এক বার কুরায়শরা সমবেত হয়ে পরামর্শ করলো এবং উত্‌বা ইব্‌ন রবীআকে তাদের প্রতিনিধি স্বরূপ হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে পয়গাম দিয়ে পাঠালো। উত্‌বা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সকাশে উপস্থিত হয়ে নম্র ভাষায় বললোঃ

মুহাম্মদ! তুমি অত্যন্ত ভদ্র ও মর্যাদাসম্পন্ন। তোমার বংশও অত্যন্ত অভিজাত ও মর্যাদাসম্পন্ন। কিন্তু সম্প্রদায়কে এক মহাপরীক্ষার মধ্যে ফেলে দিয়েছো। শেষ পর্যন্ত তোমার অভীষ্ট কি বল দেখি! যদি তুমি ধন-সম্পদেরই প্রত্যাশী হও, তা হলে আমরা তোমার জন্যে এত বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পদের সংস্থান করবো যে, তুমিই হবে আরবের সবচাইতে বনাঢ্য ব্যক্তি। আর যদি সরদারী ও রাজত্বই তোমার কাম্য হয়ে থাকে, তবে আমরা তোমাকে সরদার বানাতে এবং তোমার প্রাধান্য মেনে নিতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। যদি কোন সুন্দরী রমণীই তোমার কাম্য হয়, তবে আমরা সবচাইতে অভিজাত খানদানের সব চাইতে সুন্দরী তন্বীকেই বধুরূপে তোমার হাতে তুলে দেবো। যদি এসবই তোমার কাম্য হয়ে থাকে, তবে এসবের সংস্থান করে দিয়ে আমরা তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত! তুমি আমাদেরকে তোমার অভীষ্ট সম্পর্কে স্পষ্টভাবে অবহিত করো।

উতবা যখন তার বক্তৃতা শেষ করলো তখন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সূরা হা-মীম সিজদা তিলাওয়াত করতে শুরু করলেন। যখন তিনি এ আয়াতে পৌঁছলেন :

فَإِنْ أَعْرَضُوا فَقُلْ أَنْذَرْتُكُمْ صَاعِقَةً مِثْلَ صَاعِقَةِ عَادٍ وَثَمُودَ .

—তবু এরা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে বলুন, আমি তো তোমাদেরকে সতর্ক করছি এক ধ্বংসকর শাস্তির, আদ ও ছামুদের শাস্তির অনুরূপ (৪১ : ১৩)।

তখন উত্‌বার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। সে তখন হুযূর (সাঃ)-এর মুখে হাত দিয়ে বললো : “এমনটি বলো না।” হুযূর (সাঃ) সিজদা করলেন এবং সিজদা থেকে উঠে বললেন : “তোমরা আমার জবাব শুনলে তো?”

উতবা তখন সেখান থেকে প্রস্থান করে কুরায়শদের কাছে এসে বললো: আমার অভিমত হচ্ছে একে তার অবস্থার উপর ছেড়ে দাও এবং তোমরা এর ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা অবলম্বন কর। যদি সে গোটা আরবের উপর বিজয়ী হয় তাহলে সে তো তোমাদেরই ভাই, তার সাফল্য হবে তোমাদেরই সাফল্য। আর যদি সে ধ্বংস হয়ে যায়, তবে তোমরা নির্বিঘ্নে বেঁচে গেলে!

তার এরূপ বক্তব্য শুনে কুরায়শরা উতকে বলে উঠলো : মুহাম্মদ (সাঃ) তোমাকে যাদু করে ফেলেছে। জবাবে উত্‌বা বললো:তোমরা যা ইচ্ছে বলতে পারো। আমি আমার মত তোমাদেরূকে-জানিয়ে দিলাম।

৯৯
আবু তালিব সকাশে কুরায়শ প্রতিনিধি দল
উতবার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেলে উতবা, শায়বা, আবুল বুখতারী, আসওয়াদ, ওয়ালীদ, আবূ জাহেল প্রমুখের একটি প্রতিনিধি দল আবূ তালিব সকাশে উপস্থিত হয়ে অনুযোগ করলো, আপনার ভাতিজা আমাদের দেব-দেবীকে মন্দ বলা থেকে বিরত হতে অনিচ্ছুক। আপনি তাকে একটু বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বলুন এবং এ কাজ থেকে তাকে বিরত করুন।

আবু তালিব এ প্রতিনিধি দলকে সঙ্গত জবাব দেন। তিনি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন যে, তোমরাও তো নির্যাতনের ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন করে চলেছো। সেদিনের মতো তারা আবূ তালিবের কাছ থেকে উঠে চলে গেলো। পরদিন শলা-পরামর্শ করে তারা আবার এসে হাযির হলো। আবূ তালিব তাদের আসার পর হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে তাদের সম্মুখেই ডেকে আনলেন। তার উপস্থিতিতেই কথোপকথন শুরু হলো। কুরায়শ সরদাররা উত্‌বার মাধ্যমে প্রেরিত তাদের প্রস্তাব পুনরায় পেশ করলো। পূর্বে এ প্রস্তাব উত্‌বা একা এসে পেশ করেছিলো।

তারা বললো : মুহাম্মদ (সাঃ)! আপনাকে কয়েকটি জরুরী কথা বলার জন্য ডাকা হয়েছে। আল্লাহর কসম, কোন ব্যক্তি তার নিজের কওমকে এতটুকু বিপদে ফেলেনি, যতটুকু বিপদে আপনি আপনার কওমকেই ফেলেছেন। যদি আপনি এ নতুন ধর্ম দিয়ে ধন-সম্পদ উপার্জনে আগ্রহী হন, তবে আমরা এত ধন-সম্পদ আপনার জন্য সংগ্রহ করে দেবো যে, আর কারো কাছে এতো সম্পদ থাকবে না। যদি মান-মর্যাদার খায়েশ হয়ে থাকে, তবে আমরা আপনাকে এখনই আমাদের সরদার স্বীকার করে নিচ্ছি। যদি রাজত্বই এর দ্বারা আপনার কাম্য হয়, তবে আমরা আপনাকে সমগ্র আরবের বাদশাহ মেনে নিতে প্রস্তুত। যদি কোন জিনভূতের আছরের জন্যে আপনি এরূপ করে থাকেন, তবে আমরা ওঝা-বদ্যি ডেকে চিকিৎসা করাবো।

তিনি তাদের এসব বক্তব্যের জবাবে কুরআন শরীফের কয়েকটি আয়াত তিলাওয়াত করলেন। তারপর বললেন : আল্লাহ্ তা‘আলা আমাকে তোমাদের নিকট রাসূলরূপে প্রেরণ করেছেন। আমি আল্লাহ তা‘আলার পয়গাম তোমাদের নিকট পৌঁছিয়ে দিয়েছি। যদি তোমরা আমার শিক্ষাগুলো গ্রহণ করে নাও, তবে তোমাদের দীন-দুনিয়ার কল্যাণ হবে, আর যদি তোমরা তা প্রত্যাখ্যানই করো, তবে আমি তোমাদের ব্যাপারে তার ফায়সালা কি হয় তা দেখার জন্যে অপেক্ষা করবো।

তাঁর এ কথা শুনে কাফিররা বলে উঠলো, আচ্ছা, যদি আপনি আল্লাহর রাসূলই হয়ে থাকেন তাহলে আপনি এ পাহাড়গুলোকে তাদের স্থান থেকে সরিয়ে দিন এবং মরুভূমিকে শস্য-শ্যামল করে তুলুন তো দেখি! আমাদের বাপ-দাদাদেরকে পুনর্জীবিত করে দেন। তাদের মধ্য থেকে কুসাই ইব্‌ন কিলাবকে অবশ্যই উঠাতে হবে। তিনি যদি পুনর্জীবিত হয়ে আপনাকে রাসূলরূপে সনাক্ত করেন, তাহলে আমরা আপনাকে রাসূলরূপ স্বীকার করে নেবো।

জবাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদেরকে বললেন : এসব কাজের জন্যে আমাকে রাসূলরূপে প্রেরণ করা হয়নি। আমার কাজ হলো, আমার প্রতি নাযিলকৃত আল্লাহ তা‘আলার বিধান আমি তোমাদেরকে শুনিয়ে দেবো এবং উত্তমরূপে তা বুঝিয়ে দেবো। নিজ এখতিয়ারে আমি কিছুই করতে সক্ষম নই।”

এরূপ কথোপকথনের পর কুরায়শ সরদার অত্যন্ত ক্রুদ্ধ ও উত্তেজিত হয়ে উঠে চলে গেলো। যাবার সময় তারা আবূ তালিবকেও মুকাবিলা ও বিরোধিতার জন্য চ্যালেঞ্জ দিয়ে গেলো।

কুরায়শ সরদারের প্রস্থানের পর আবূ তালিব হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে লক্ষ্য করে বললেন : “ভাতিজা, আমি এখন বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছি। কুরায়শদের মুকাবিলা করার মতো শক্তি এখন আর নিজের মধ্যে খুঁজে পাচ্ছি না। এমন শক্ত বোঝা তুমি কাঁধে চাপিয়ে দিও না, যা বহন করার শক্তি-সামর্থ্য তোমার এ দুর্বল চাচার নেই। তোমার দীনের প্রচার এবং দেবমূর্তিসমূহের প্রকাশ্য সমালোচনা তোমার ছেড়ে দেয়াটাই সমীচীন বলে আমি মনে করি। সব শুনে তিনি বললেন : “চাচাজান! এরা যদি আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাম হাতে চন্দ্রও তুলে দেয় তবুও আমি আমার কাজ থেকে বিরত হবো না।” আবূ তালিবের কথায় তার সন্দেহ হলো, এবার চাচাও বুঝি আমাকে সাহায্য করা থেকে হাত গুটিয়ে নেবেন। আবূ তালিব মক্কার কুরায়শ সরদারদের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। বনূ হাশিম কবীলার সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেতা বলে তিনি গণ্য হতেন। তার কারণে আক্রমণকারীরা তার উপর আক্রমণ করতে অনেকটা দ্বিধাবোধ করতো। তাদের আশঙ্কা ছিলো, বনূ হাশিম কবীলার সকলে মিলে যদি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর পক্ষে দাঁড়িয়ে যায়, তাহলে ব্যাপারটা বেশ সঙ্গীন ও নাযুক হয়ে দাঁড়াবে। তাই আবূ তালিবের সমর্থন তাঁর জন্যে বেশ সহায়কই ছিলো। এবার তার এ নৈরাশ্যব্যঞ্জক বক্তব্য শুনে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হলেন। অশ্রুসজল কণ্ঠে তিনি বললেন : চাচাজান! আমি আমার কাজ ত্যাগ করবো না যতক্ষণ না আল্লাহ্‌র কাজ পূর্ণ হয়, কিংবা এই কাজ করতে করতে আমি নিজেই কুরবান হয়ে যাই।—একথা বলেই তিনি আবূ তালিবের নিকট থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন।

দৃঢ়চেতা ইয়াতীম ভাতিজাটির কথায় আবূ তালিব অভিভূত হয়ে পড়লেন। তিনি তাঁকে ফিরিয়ে এনে বললেন : তুমি অবশ্যই তোমার কাজ চালিয়ে যাবে। আমি যতদিন বেঁচে থাকি ততদিন আমি তোমাকে সাহায্য করেই যাবো এবং কোনদিনই তোমাকে শত্রুদের হাতে তুলে দেবো না।

১০০
আবিসিনিয়ায় হিজরত
কুরায়শদের সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হলো। তারা তাওহীদের প্রচারকার্য অব্যাহত গতিতে চলতে দেখে রীতিমত প্রমাদ গুণলো। তারা লক্ষ্য করলো যে, যে আন্দোলনকে তারা শিশু বলে তুচ্ছ জ্ঞান করছিলো, তা এখন বিকশিত হয়ে এমনি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে, তার মূলোৎপাটন আর এখন মোটেই সহজ নয়। তারা সর্বাত্মক চেষ্টায় মেতে উঠলো। তারা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর খানায়ে কা‘বায় প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করলো। শহরের বখাটে ছেলেদেরকে হযরত রাসূল (সাঃ) ও মুসলমানদেরকে দেখামাত্র সমবেতভাবে হাত তালি দেয়া ও গালিগালাজ করবার জন্য নিযুক্ত করলো। এখন থেকে এদের কাজ হলো, রাস্তাঘাটে, অলিতে-গলিতে মুসলমানদের চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করা, বাইরের কোন আগন্তুককে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করতে না দেয়া এবং যখন যেখানে যেভাবে পারা যায় দুর্বল মুসলমানদেরকে উত্যক্ত করা। ফলে মক্কায় মুসলমানদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠলো। এমনতরো পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মুসলমানদেরকে খ্রিস্টান শাসিত আবিসিনিয়ায় হিজরতের অনুমতি দান করেন। সে অনুসারে নবুওয়াতের পঞ্চম বর্ষের রজব মাসে এগারোজন পুরুষ এবং চারজন নারী আবিসিনিয়ার উদ্দেশ্যে মক্কা ত্যাগ করেন। পনেরো সদস্যের এ কাফেলাটি রাতের আঁধারে গোপনে মক্কা ত্যাগ করে। ঘটনাক্রমে জিদ্দা বন্দরে এসে তারা নোঙর খুলে ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন অবস্থায় জাহাজ পেয়ে গেলেন। তাঁরা সেই জাহাজে করে আবিসিনিয়ায় গিয়ে উপনীত হন। সেই প্রথম হিজরতকারী দলের সদস্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন :

১. হযরত উসমান ইব্‌ন আফফান (রা)।

২. হযরত উসমান (রা)-এর সহধর্মিণী রুকাইয়া বিন্‌ত রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)।

৩. হযরত হুযায়ফা ইব্‌ন উত্‌বা (রা)।

৪. হযরত উসমান ইব্‌ন মাযউন (রা)।

৫. হযরত আবদুল্লাহ ইব্‌ন মাসঊদ (রা)।

৬. হযরত আবদুর রহমান ইব্‌ন আওফ (রা)।

৭. হযরত যুবায়র ইবনুল আওয়াম (রা)।

৮. হযরত মুসআব ইব্‌ন উমায়র (রা)।

৯. হযরত আমির ইব্‌ন রবীআ (রা)।

১০. হযরত সুহায়ল ইব্‌ন বায়দা (রা)।

১১. হযরত আবূ সালামা ইব্‌ন আবদুল আসাদ (রা)।৩

১২. হযরত আবূ সাবুরা ইব্‌ন রেহেম আমিরী (রা)।

১৩. হযরত হাতিম ইব্‌ন আমির (রা)।

১৪. হযরত উম্মে সালামা বিন্‌ত আবূ উমাইয়া (আবু সালামার স্ত্রী যিনি আবূ সালামার মৃত্যুর পর নবী-সহধর্মিণী হয়েছিলেন)।

১৫. হযরত সাহল বিন্‌ত সুহায়ল আবূ হুযাফা (রা)-এর সহধর্মিণী—সীরাতে মুস্তফা জিলদে আউয়াল পৃঃ ২৪১-৪২ এর বরাতে (অনুবাদক)।

─────────────────৩. প্রথমবার আবিসিনিয়ায় হিজরতকারী অপর পাঁচজন হচ্ছেন ক্রমিক নম্বর ১১ থেকে ১৫ পর্যন্ত।

এরা কুরায়শদের মশহুর ও শক্তিশালী কবীলার লোক ছিলেন, যদ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, এ পর্যায়ে অত্যাচার কেবল গোলাম-বাঁদী বা দুর্বল শ্রেণীর মুসলমানদের উপরই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা সকল দুর্বল নির্বিশেষে সকল কবীলার ও সকল শ্রেণীর মুসলমানদের প্রতিই নির্বিচারে ও নির্ধিধায় চালিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। উপরন্তু এটাও প্রতীয়মান হচ্ছে যে, দুর্বল শ্রেণীর মুসলমানদের এত দূরদেশে হিজরত করে যাওয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় সফর-সামানও ছিল না যে, তারা এত দূরবর্তী দেশে সফরে যাবেন।

কাফিররা যখন মুসলমানদের হিজরত ও আবিসিনিয়ার দিকে যাত্রার সংবাদ পেলো, তখন তারাও তাদের পশ্চাদ্ধাবন করলো। কিন্তু কাফিরদের জিদ্দায় পৌঁছাবার পূর্বেই জাহাজ জিদ্দা থেকে ছেড়ে দিয়েছিল। আবিসিনিয়ায় পৌঁছে মুসলমানরা স্বস্তির সাথে জীবন যাপন করছিলো। তারপর একে একে আরো অনেক মুসলমানই আবিসিনিয়ায় হিজরত করতে থাকেন। হযরত জা‘ফর ইব্‌ন আবূ তালিবও আবিসিনিয়ায় মুসলমান ভাইদের সাথে গিয়ে মিলিত হন। ফলে এ পর্যন্ত আবিসিনিয়ায় মুসলমানদের সংখ্যা তিরাশিতে উন্নীত হলো।

মুসলমানদের আবিসিনিয়ার উপস্থিতির কয়েক মাসের মধ্যেই তারা গুজব শুনতে পেলেন যে, মক্কাবাসীরা ইসলাম গ্রহণ করে ফেলেছে বা তাদের সাথে মুসলমানদের সন্ধি হয়ে গেছে। এখন আর মক্কায় মুসলমানদের ভয়ের কোন কারণ নেই। এ গুজব শুনে মুসলমানদের কেউ কেউ আবিসিনিয়া থেকে মক্কায় ফিরেও যান। কিন্তু মক্কার নিকটবর্তী হতেই তাঁরা জানতে পারল যে, ঐ সংবাদ আসলে ছিল গুজবমাত্র। তাই কেউ কেউ রাস্তা থেকেই আবিসিনিয়ায় ফিরে যান, আবার কেউ কেউ কোন প্রভাবশালী কুরায়শী ব্যক্তির জামানত নিয়ে মক্কায় আসেন। এঁরা মক্কায় এসে আরও মুসলমানদেরকে সঙ্গে নিয়ে পুনরায় আবিসিনিয়ায় যাত্রা করল। এটাকে আবিসিনিয়ায় মুসলমানদের দ্বিতীয় হিজরত নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এ পর্যায়ে আবিসিনিয়ায় মুসলমানদের সংখ্যা একশ’তে উন্নীত হয়।

১০১
আবিসিনিয়ার সম্রাটের নিকট কুরায়শদের আবদার
মক্কার লোককে মুসলমান হয়েই আবিসিনিয়ায় হিজরত করে চলে যেতে দেখে এবং সেখানে আরামে জীবন-যাপন করতে দেখে মক্কার কাফিররা প্রমাদ গুণলো। এভাবে ক্রমে ক্রমে তাদের বিরাট শক্তি মুসলিম শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে বাইরেএকটি শক্তিশালী কেন্দ্র গড়ে তুলবে এবং শেষ পর্যন্ত বাইরে থেকে তাদের উপর কোন বিপদ আপতিত হতে পারে। এসব ভেবে তারা ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলো।

তাই তারা মক্কায় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর অনুচরবর্গের উপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দিলো এবং মক্কার দু’জন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি আমর ইবনুল ‘আস ও আবদুল্লাহ ইব্‌ন রবীআকে দূত রূপে আবিসিনিয়ার সম্রাট নাজাশীর দরবারে প্রেরণ করলো। পূর্ব থেকেই মক্কার কুরায়শবর্গ এবং আবিসিনিয়া সম্রাটের মধ্যে একটা বাণিজ্যচুক্তি বর্তমান ছিলো আর সে অনুসারেই আবিসিনিয়া ও মক্কার মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য চলছিলো। এ দু’জন দূতের নিকট তারা আবিসিনিয়ার সম্রাটের জন্যে বহু মূল্যবান উপঢৌকনাদিও দিয়েছিলো। শুধু আবিসিনিয়ার সম্রাটের জন্যেই নয়, তার পারিষদবর্গের জন্যেও তারা মূল্যবান উপঢৌকন প্রেরণ করলো। কুরায়শ দূতদ্বয় আবিসিনিয়ায় পৌঁছে আবিসিনিয়ার রাজদরবারে এসব উপঢৌকন পেশ করলো। তারা আবিসিনিয়ার সম্রাটের পারিষদদেরকেও নিজেদের সমর্থক বানিয়ে নিয়ে এভাবে তাদের দাবী উত্থাপন করলো :

রাজন! আমাদের কিছু ক্রীতদাস বিদ্রোহী হয়ে আপনার দেশে এসে পৌঁছেছে এবং নিজেদের পৈতৃক ধর্ম ছেড়ে দিয়ে তারা এক অভূতপূর্ব নতুন ধর্ম গ্রহণ করেছে। তাই এ ক্রীতদাসদেরকে আমাদের হাতে তুলে দেয়া হোক।

সম্রাট তাদের আবেদন শুনে বললেন : আগে আমি এ সম্পর্কে তদন্ত করে দেখি। তারপর তোমাদের দাবী বিবেচনা করা হবে। পারিষদরাও কুরায়শ দূতদেরকে সমর্থন জানালো। কিন্তু সম্রাট নাজাশী সেদিকে কর্ণপাত না করে মুহাজির মুসলমানদেরকে দরবারে ডেকে পাঠালেন। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন : তোমরা যে ধর্ম গ্রহণ করেছো সেটা কোন্ ধর্ম? মুসলমানদের পক্ষ থেকে হযরত জা‘ফর ইব্‌ন আবূ তালিব (রা) অগ্রসর হয়ে নাজাশীর দরবারে নিম্নধারার ভাষণ দেন।

১০২
জা‘ফর ইব্‌ন আবূ তালিবের মর্মস্পর্শী ভাষণ
বাদশাহ নামদার! আমরা ছিলাম অজ্ঞ ও মূর্তিপূজারী। মৃত জন্তু ভক্ষণকারী, অসামাজিক কার্যকলাপ ও প্রতিবেশীদেরকে নির্যাতনে আমরা অভ্যস্ত ছিলাম। আমাদের সবল ব্যক্তিরা দুর্বলদের অধিকার গ্রাস করতো। এমন সময় আল্লাহ্ আমাদের নিকট একজন রাসূল প্রেরণ করলেন। তার উচ্চ বংশমর্যাদা, সততা ও বিশ্বস্ততা সম্পর্কে পূর্বেই আমরা অবগত ছিলাম। তিনি আমাদের এক আল্লাহ্‌তে বিশ্বাসীতে পরিণত করে মূর্তিপূজা থেকে ফিরিয়ে এনেছেন, সত্য বলতে, আমানত রক্ষা করতে ও নেক আমল করতে হুকুম করেছেন এবং পাপাচার, মিথ্যা কথন এবং পিতৃহীনদের সম্পদ গ্রাস করতে তিনি আমাদেরকে বারণ করেছেন। সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা ও প্রতিবেশীর প্রতি সৌহার্দমূলক আচরণের নির্দেশ দান করেছেন। তিনি আমাদের হত্যা ও রাহাজানি থেকে ফিরিয়ে এনেছেন এবং আল্লাহর ইবাদত করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা সেই রাসূলের উপর ঈমান এনেছি এবং তার আনুগত্য অবলম্বন করি। এজন্যে আমাদের স্বজাতি আমাদের প্রতি রুষ্ট হয়ে গেছে। তারা আমাদেরকে নানারূপে নির্যাতন করে। অগত্যা আমরা দেশত্যাগ করে আপনার দেশে এসে আশ্রয় নেই। আমাদের এ প্রতীতি রয়েছে যে, আপনার দেশে আমাদের প্রতি কোনরূপ অবিচার করা হবে না।

এ ভাষণ শুনে নাজাশী বললেন : তোমাদের নবীর প্রতি আল্লাহর যে কালাম নাযিল হয়েছে তার কিছুটা শোনাও দেখি। হযরত জা‘ফর (রা) সূরা মারয়াম তিলাওয়াত শুরু করলেন। কুরআনুল কারীমের আয়াত শুনে নাজাশী এবং পারিষদবর্গের চোখে পানি এসে গেলো। হযরত জা‘ফর (রা) সূরা মারয়ামের প্রথম দিকের আয়াতগুলো পড়ে শোনাতেই নাজাশী বলে উঠলেন: হযরত মূসা (আ)-এর তাওরাতের আর এ কালামের ধরন তো একই। উভয়টি অভিন্ন মনে হচ্ছে।

কুরায়শ দূতেরা বলে উঠলেন : এরা কিন্তু হযরত ঈসা (আ)-এরও বিরোধী। একথাটির দ্বারা তারা খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী আবিসিনীয় রাজাকে মুসলমানদের প্রতি ক্ষেপাতে চেয়েছিলো। হযরত জা‘ফর ইব্‌ন আবূ তালিব (রা) তৎক্ষণাৎ জবাব দিলেন : মিথ্যে কথা বরং

هو عبد الله ورسوله وكلمة ألقها الى مريم وروح منه .

তিনি আল্লাহর বান্দা ও রাসূল এবং আল্লাহর বাণী যা তিনি মারয়ামের নিকট প্রেরণ করেছিলেন এবং তার আদেশ।

নাজাশী বলে উঠলেন : তোমাদের এ বিশ্বাস যথার্থ। ইনজীল কিতাবের মর্মও ঠিক তাই। তিনি কুরায়শ দূতদ্বয়কে ব্যর্থ মনোরথ ফিরিয়ে দিলেন এবং স্পষ্ট বলে দিলেন, আমি এদেরকে তোমাদের হাতে তুলে দিতে পারি না। সাথে সাথে কুরায়শদের দেয়া উপহার সামগ্রীও তিনি ফেরত দিয়ে দিলেন। ফলে তাদের অপমানের অন্ত রইলো না। এটা নবুওয়াতের ষষ্ঠ সালের ঘটনা। নাজাশীর দরবারে কুরায়শদের এ ব্যর্থতা মুসলমানদের প্রতি তাদের বিদ্বেষ আরো বাড়িয়ে তুললো।

১০৩
হযরত আমীর হামযা (রা)-এর ইসলাম গ্রহণ
মক্কার কুরায়শরা নবী করীম (সাঃ)-এর প্রতি বিদ্বেষে পাগল হয়ে উঠেছিলো। একদিন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সাফা পাহাড়ের চূড়ায় কিংবা এর পাদদেশে উপবিষ্ট ছিলেন। এমন সময় সেখানে আবূ জাহেল এসে উপস্থিত। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে দেখতে পেয়েই সে প্রথমে তো ভীষণ কর্কশ ও অশ্রাব্য ভাষায় গালি-গালাজ করলো। তিনি এ সবের জবাব মাত্র না দিয়ে নির্বিকার রইলেন। তখন সে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে লক্ষ্য করে একটি প্রস্তর নিক্ষেপ করলো। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাতে আহত হলেন এবং তার পবিত্র দেহ থেকে লহু মুবারক নির্গত হতে লাগলো। তিনি চুপচাপ বাড়িতে চলে আসলেন। আবূ জাহেল কা‘বা প্রাঙ্গণে আলাপরত লোকদের সাথে এসে বসে তাদের সাথে আলাপে মেতে উঠলো।

হযরত আমীর হামযা (রা) ছিলেন আবদুল মুত্তালিবের ছেলে। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আপন চাচা। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে তিনি অত্যন্ত ভালবাসতেন। কিন্তু তিনি তখনও মুশরিকদের দলভুক্ত। তিনি প্রতিদিন ভোরে তীর-ধনুক নিয়ে শিকারে বের হতেন এবং সারাদিন শিকারের সন্ধানে ঘোরাফিরা করে শিকার করে সন্ধ্যায় ফিরতেন। ফিরেই সর্বপ্রথম তিনি কা‘বায় গিয়ে তাওয়াফ করতেন। তারপর ঘরে ফিরতেন। ঐ দিনও শিকার করে আপন অভ্যাস মতো তিনি ফিরছিলেন। পথেই আবূ জাহেলের বাঁদীর সাথে তার দেখা হয়ে গেলো। বাঁদী তাঁকে বলল, আবূ জাহেল হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে গালাগালি দেয় এবং পাথর মেরে জখম করে কিন্তু মুহাম্মদ (সাঃ) ধৈর্য ধারণ করে চুপ থাকে।

হযরত হামযা (রা) শুধু হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর চাচাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন তার দুধ-ভাইও। রক্ত ও দুধের সম্পর্ক তাঁকে অধীর করে তুললো। তিনি প্রথমে খানায়ে কা‘বায় গেলেন। তাওয়াফ শেষ করেই তিনি সোজা ঐ মজলিসের দিকে রওনা হলেন যেখানে বসে আবূ জাহেল আলাপ-আলোচনায় মত্ত ছিলো। হযরত হামযা (রা) ছিলেন বীর পাহলোয়ান। তিনি একজন যোদ্ধা ও বীর পুরুষ বলে গণ্য হতেন। তিনি সেখানে পৌঁছেই ধনুক দিয়ে আবূ জাহেলের মাথায় এমনি জোরে আঘাত করলেন যে, তার মাথা ফেটে দর দর করে রক্ত প্রবাহিত হলো। তারপর মুখে বললেন : আজ থেকে আমিও মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ধর্মের অনুসারী এবং তিনি যা বলে থাকেন আমিও তাই বলি। বলো দেখি হতভাগা তোর কি বলার আছে? আবূ জাহেলের লোকজন তাতে ক্রুদ্ধ হয়ে তার স্বপক্ষে উঠে দাঁড়াল। কিন্তু আবূ জাহেল হামযাকে তার বীরত্বের জন্য ভয় করতো। তাই সে নিজেই তাদেরকে সংযত করলো এবং বললো, “আসলেও আমার পক্ষ থেকে একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছিলো। হামযা যদি তার ভাতিজার অপমানের প্রতিশোধ না নিতেন তাহলে এটা তার আত্মমর্যাদার পরিপন্থী হতো।” সম্ভবত হযরত হামযার কথা শুনেই আবূ জাহেলের মনে আশংকা সৃষ্টি হয়েছিলো যে, পাছে এর রাগ ও জেদের বশে তিনি মুসলমানই না হয়ে যান। আর এজন্যেই সে হযরত হামযা (রা)-কে শুনিয়েই কথাগুলো বলছিলো যেন ব্যাপারটির এখানেই ইতি ঘটে আর তিনি ইসলামের দিকে ঝুঁকে না পড়েন।

আবু জাহেলের সাথে বোঝাপড়া করে হযরত হামযা (রা) হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কাছে এলেন এবং তাকে লক্ষ্য করে বললেন : ভাতিজা, তুমি শুনে আনন্দিত হবে যে, আবূ জাহেলের নিকট থেকে আমি তোমার প্রতিশোধ এরই মধ্যে নিয়ে নিয়েছি।

জবাবে হযরত নবী (সাঃ) বললেন : “চাচা! এ জাতীয় ব্যাপার আমাকে আনন্দ দেয় না। হ্যাঁ, যদি আপনি ইসলাম গ্রহণ করেন তবে তা আমাকে অপার আনন্দ দেবে।” এ কথা শুনে হযরত হামযা (রা) তৎক্ষণাৎ ইসলাম গ্রহণ করলেন। হযরত হামযা (রা)-এর ইসলাম গ্রহণে বিপর্যস্ত মুসলমানদের শক্তি ও মনোবল অনেকটা চাঙ্গা হয়ে উঠলো। এটা ছিলো নবুওয়াতের ষষ্ঠ পর্যায়ের কথা। সে সময় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) হযরত আরকাম (রা)-এর বাড়ীতে অবস্থান করতেন। মক্কার কুরায়শরা তাঁর সাথে অত্যন্ত ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ শুরু করে দিয়েছিলো। হযরত হামযা (রা)-এর ইসলাম গ্রহণে তারা অনেকটা সংযত হলো এবং হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর শানে গোস্তাখী করার ক্ষেত্রে দ্বিধায় পড়ে গেলো।

১০৪
হযরত উমর ফারুক (রা)-এর ইসলাম গ্রহণ
হযরত হামযা (রা)-এর ইসলাম গ্রহণের সংবাদে কুরায়শদের দুশ্চিন্তা ও বিদ্বেষের মাত্রা আরো বেড়ে গেল। তারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ ও নানারূপ ফন্দি-ফিকির করতে লাগলো।

হযরত উমর ফারুক (রা) ছিলেন হযরত হামযা (রা)-এর মতো আরবের বিখ্যাত বীরপুরুষ। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে মুসলমানদেরকে নির্যাতন এবং হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে তৎপরতায় তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিলো। তিনি মুসলমানদেরকে ধরে এনে বেদম প্রহার করতেন এবং প্রহার করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলে থামতেন এবং বিশ্রাম নেওয়ার পর পুনরায় উঠে মারধর শুরু করতেন। মোটকথা, মুসলমানদেরকে ইসলাম থেকে মুরতাদ বানানোর জোর কোশেশ করেন কিন্তু ব্যর্থ হন। অবশেষে একদিন তিনি শেষ সিদ্ধান্ত নেন এবং কাফিরদের মজলিসে অঙ্গীকার করেন যে, এবার তিনি একাই কুরায়শদের উপর আপতিত এ ফিতনার মূলোচ্ছেদ করবেন অর্থাৎ এ ফিতনার প্রবর্তক মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেবেন।

আবু জাহেল তার এ ঘোষণা শুনে সোৎসাহে ঘোষণা করলেন : সত্যি সত্যি তুমি যদি এ কাজটি করে আসতে পার, তাহলে তোমাকে একশটি উট এবং এক হাজার উকিয়া পরিমাণ রৌপ্য বখশিশ স্বরূপ প্রদান করা হবে।

আর যায় কোথায়! কোষমুক্ত তলোয়ার হাতে উমর তক্ষণি হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন। পথে সাআদ ইব্‌ন আবী ওয়াক্কাসের সাথে সাক্ষাৎ। তিনি জিজ্ঞেস করলেন : কি হে উমর! এ অবস্থায় কোথায় যাচ্ছ? জবাবে উমর বললেন :মুহাম্মদ (সাঃ)-কে কতল করতে যাচ্ছি, কেননা, আজ আমি সংকল্প করেছি যে, কুরায়শ কওমকে আপদমুক্ত করবো এবং তাদের রকমারি তদবিরকে সহজ করে দেবো। হযরত সাআদ (রা) জিজ্ঞেস করলেন : বনী হাশিম-এর প্রতিশোধের ভয় কর না? জান না যে, মুহাম্মদ (সাঃ)-কে কতল করা চাট্টিখানি কথা নয়? জবাবে উমর বললেন : আমার হাতে এ কোষমুক্ত তলোয়ারখানা থাকতে আমি কাউকে পরোয়া করি না। তারপর হযরত সাআদ (রা)-কে লক্ষ্য করে বললেন : তুমিও বুঝি তার সমর্থক বনে গেছো? তাহলে প্রথমে তোমাকেই শেষ করছি! সাআদ (রা) বললেন : আমাকে এবং মুহাম্মদ (সাঃ)-কে পরেই বধ করো হে! আগে নিজের খবর নাও। তোমার বোন যে মুসলমান হয়ে গেছে আর ইসলাম তোমার নিজ ঘরেই ঢুকে পড়েছে, সে খবর রাখ?

হযরত সাআদ (রা)-এর এ জবাব হযরত উমর (রা)-এর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো বিধলো। তিনি তৎক্ষণাৎ তাঁর বোনের বাড়ীর দিকে ছুটলেন। তিনি বেরিয়েছিলেন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে কতল করার সংকল্প নিয়ে। রাস্তায় গিয়ে পথ ধরলেন বোনের বাড়ীর। সেখানে যখন তিনি পৌঁছলেন তখন হযরত খাব্বাব ইবনুল আরাত (রা) উমরের বোন ফাতিমা (রা) এবং তাঁর স্বামী হযরত সাঈদ ইব্‌ন যায়দ (রা)-কে কুরআন শরীফ শিক্ষা দিচ্ছিলেন। উমরের উপস্থিতি টের পেয়ে তিনি ঘরের এক কোণে আত্মগোপন করলেন এবং যে পৃষ্ঠাসমূহে কুরআন শরীফের আয়াত লিখিত ছিলো তাড়াতাড়ি তাও লুকালেন। তিনি ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করলেন : তোমরা কি পড়ছিলে? তারপর ভগ্নিপতি সাঈদ ইব্‌ন যায়দ (রা)-কে ধরেই ফেলে দিলেন এবং বেদম প্রহার করতে লাগলেন এবং বললেন : তোমরা কেন মুসলমান হতে গেলে? স্বামীকে ভাইয়ের কবল থেকে মুক্ত করার জন্যে বোন আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে ভাইকে জাপটে ধরলেন। জাপটাজাপটিতে ফাতিমা (রা)-এর মাথায় এমনি আঘাত লাগলো যে দরদর করে তার মাথা থেকে রক্ত ঝরতে লাগল। উমর (রা) বোন এবং ভগ্নিপতির দু’জনকেই বেদম প্রহার করলেন। অবশেষে বোনটি বেপরোয়া হয়ে উঠলেন এবং বললেন :

قد اسلمنا وتابعنا محمدا افعل ما بذالك .

হাঁ, আমরা মুসলমান হয়ে গেছি এবং মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আনুগত্য অবলম্বন করেছি। এ জন্যে তুমি যা করতে পার কর!

বোনের এ বেপরোয়া জবাব শুনে হযরত উমর (রা) যখন বোনের দিকে নজর তুলে তাকালেন তখন তাঁর রক্তাক্ত দেহের উপর চোখ পড়তেই তাঁর রাগ অনেকটা পানি হয়ে গেলো। বোনের রক্তমাখা দৃশ্য ভাইয়ের মনে পরিবর্তনের সূচনা করলো।

এবার অনেকটা শান্তস্বরে তিনি বোনকে বললেন : আচ্ছা, এই মাত্র তোমরা যা পড়ছিলে তা আমাকে দেখাও এবং পড়ে শোনাও যার আওয়াজ আমি ঘরে ঢুকবার সময় শুনতে পাচ্ছিলাম। উমর (রা)-এর কণ্ঠ অনেকটা শান্ত দেখে বোন আরো সাহসী হয়ে উঠলেন। তিনি বললেন : এ পবিত্র কিতাব পড়তে হলে প্রথমে তোমাকে গোসল করতে হবে। উমর (রা) তৎক্ষণাৎ গোসল করলেন। গোসল সেরেই কুরআন শরীফের আয়াতগুলো যে পৃষ্ঠাগুলোতে লিখিত ছিলো তা পড়তে লাগলেন। মাত্র কয়েকটি আয়াত পড়তে না পড়তেই মনের অজান্তে বলে উঠলেন : কী মধুর বাণী! এ বাণী আমার অন্তরে রেখাপাত করছে।

হযরত খাব্বাব (রা) ভেতরে লুকিয়েছিলেন। একথা শোনা মাত্র তিনি তৎক্ষণাৎ বের হয়ে এসে বলে উঠলেন : হে উমর (রা)! মুবারক, হো। হযরত মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের দু‘আ তোমার পক্ষেই কবূল হলো দেখছি। আমি কালই হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে দু‘আ করতে শুনেছি, “হে আল্লাহ! উমর ইবনুল খাত্তাব ও আবূ জাহেল এ দু’জনের একজনকে তুমি মুসলমান বানিয়ে দাও! তারপর হযরত খাব্বাব (রা) সূরা ত্বা-হার প্রথম রূকূ তিলাওয়াত করে শোনালেন। হযরত উমর (রা) সূরা ত্বা-হার এ তিলাওয়াত শুনতে শুনতে অঝোরধারায় কাঁদছিলেন। তিনি হযরত খাব্বাব (রা)-কে বললেন : আমাকে এক্ষুণি হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর কাছে নিয়ে চলো! সত্যি সত্যিই তিনি তাঁকে নিয়ে দারে আরকামের দিকে রওয়ানা হলেন। তখনো কোষমুক্ত তলোয়ারখানা তার হাতে ছিলো। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে তিনি সে তলোয়ারখানা নিয়ে বোনের বাড়ীর দিকে যাচ্ছিলেন, সে উদ্দেশ্য আর এখন ছিলো না।

আরকামের বাড়ীতে পৌঁছে হযরত উমর (রা) দরজায় করাঘাত করলেন। উমরের হাতে কোষমুক্ত তলোয়ার দেখে সাহাবায়ে কিরাম প্রথমে দরজা খুলতে দ্বিধাবোধ করেন এবং হুযুর (সাঃ)-কে জানান যে, উমর (রা) খোলা তলোয়ার হাতে দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। হুযুর (সাঃ) বললেন : দরজা খুলে দাও! হযরত হামযা (রা)-ও তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, আসতে দাও। সদিচ্ছা নিয়ে এসে থাকলে তো ভাল, নতুবা তারই তলোয়ারে তার শির উড়িয়ে দেবো।

দরজা খুলে দেয়া হলো। হযরত উমর (রা) ভিতরে প্রবেশ করলেন। তিনি ভিতরে প্রবেশ করতেই হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) অগ্রসর হয়ে তাঁর জামার এক প্রান্ত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে বললেন : কী হে উমর! আর কতদিন বিরোধিতা করে চলবে? তুমি কি এখনো বিরত হবে না? জবাবে হযরত উমর (রা) আরয করলেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (সাঃ)! ঈমান আনার জন্যেই আপনার খিদমতে হাযির হয়েছি! একথা শুনতেই আনন্দ উচ্ছ্বাসে হযরত (সাঃ) উচ্চকণ্ঠে “আল্লাহু আকবার” বললেন। অমনি দারে আরকামে উপস্থিত সাহাবায়ে কিরামগণও গগনবিদারী কণ্ঠে সমবেতভাবে আল্লাহু আকবর উচ্চারণে মক্কার পাহাড়-পর্বত প্রকম্পিত করে তুললেন।

হযরত হামযা (রা) ও হযরত উমর (রা)-এর ইসলাম গ্রহণেমুসলমানদের শক্তি অনেক গুণে বৃদ্ধি পেলো। হযরত উমর (রা) মুসলমান হয়েই সোজা আবূ জাহেলের বাড়ীতে গিয়ে উপস্থিত হলেন এবং দরজায় করাঘাত করলেন। সে বের হয়েই আহলান ওয়া সাহ্‌লান এবং মারহাবা বলে তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালো এবং তার আগমনের কারণ জিজ্ঞেস করলো। হযরত উমর (রা) বললেন : আল্লাহ্ তা‘আলার শোকর যে, আমি মুসলমান হয়ে গিয়েছি। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে রাসূল বলে মেনে নিয়েছি। কথাটি শুনেই আবূ জাহেল রাগান্বিত হয়ে অন্দরে চলে গেলো। হযরত উমর (রা)-ও ফিরে আসলেন। তার ইচ্ছেই ছিলো ইসলামের সবচাইতে বড় শত্রুকে তার ইসলাম গ্রহণের সংবাদ জানিয়ে আসবেন।

হযরত উমর (রা) মুসলমান হয়েই হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কাছে নিবেদন করলেন : আমাদের এখন আর গোপনে ঘরে সালাত আদায়ের প্রয়োজন নেই। প্রকাশ্যে খানায়ে কা‘বাতেই আমাদের সালাত আদায় করা উচিত। সত্যি সত্যি তাই করা হলো। প্রথম প্রথম কুরায়শদের পক্ষ হয়ে যারাই প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতো হযরত উমর (রা) তাদের মুকাবিলা করতেন। শেষ পর্যন্ত সকল বাধাই অপসারিত হলো এবং মুসলমানগণ বিনা বাধায় সেখানে সালাত আদায় করতে লাগলেন। ইসলাম এখন মক্কায় প্রকাশ্যে পালিত হতে লাগলো। এটা হচ্ছে নবুওয়াতের ষষ্ঠ বর্ষের শেষ মাসের কথা। হযরত উমর (রা)-এর বয়স তখন ছিল ৩৪ বছর। হযরত উমরের ইসলাম গ্রহণের সময় মক্কায় মুসলমানদের সংখ্যা দাঁড়ালো চল্লিশে। আবিসিনিয়ায় অবস্থানরত মুসলমান এর বাইরে ছিলেন।

১০৫
বয়কট
হযরত উমর (রা)-এর ইসলাম গ্রহণে কুরায়শরা দারুণ আঘাত পেলো। এদিকে মুসলমানরা প্রকাশ্যে খানায়ে কা‘বায় সালাত আদায় করতে লাগলেন। অনেক মুসলমান নাজাশীর দেশে চলে গিয়েছিলেন যাদের উপর কুরায়শের কোন জারিজুরিই চলতো না। হযরত হামযা (রা) ও হযরত উমর (রা)-এর বর্তমানে মক্কার মুসলমানদের গায়েও নির্বিবাদে হাত দেয়ার সাধ্য ছিলো না। এ অবস্থা দেখে নবুওয়াতের সপ্তম বছরের প্রথম মাসে অর্থাৎ মুহাররম মাসে কুরায়শরা একটি পরামর্শ সভায় মিলিত হলো। মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান শক্তি যে একটা সংকটরূপে দেখা দিয়েছে তাও মজলিসকে অবহিত করা হলো এবং সে সংকট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে কী কী ব্যবস্থা অবলম্বন করা যায় সে সম্পর্কে যথেষ্ট চিন্তা-ভাবনা ও সলা-পরামর্শ করা হলো। অবশেষে সকলে একমত হলো যে বনী হাশিম ও বনী আবদুল মুত্তালিবের সকলেই যদিও মুসলমান হয়নি, তবু হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর পক্ষ সমর্থন ও পাশে দাঁড়ানো থেকে বিরত থাকবে না। তাই প্রথমে আবূ তালিবকে বলা হোক যে, আপনি আপনার ভাতিজা মুহাম্মদ (সাঃ)-এর পাশ থেকে সরে দাঁড়ান এবং তাকে আমাদের হাতে তুলে দিন! যদি তিনি তাতে সম্মত না হন, তাহলে বনী হাশিম ও বনী আবদুল মুত্তালিবের সাথে বিয়ে-শাদী, মেলামেশা, সালাম-কালাম সব বন্ধ করে দিতে হবে। তাদের কাছে কোন বস্তু বেচাকেনা করা বা তাদের কাছে কোনরূপ খাদ্যদ্রব্য পৌঁছতে দেয়া চলবে না। যতদিন পর্যন্ত তারা মুহাম্মদকে আমাদের হাতে তুলে না দেবে ততদিন পর্যন্ত এ প্রাণান্তকর বয়কট চলতেই থাকবে।

এ বয়কট সম্পর্কে একটা চুক্তিনামাও লেখা হলো। কুরায়শ সরদারদের সবাই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে তাতে সই করলো। সইকৃত চুক্তিপত্র খানায়ে কা‘বায় ঝুলিয়ে রাখা হলো। আবূ তালিব বনূ হাশিম ও বনূ আবদুল মুত্তালিবের সবাইকে নিয়ে মক্কার অদূরবর্তী এ গিরিসংকটে স্বেচ্ছাবন্দী হলেন। ইতিমধ্যে যারা মুসলমান হয়েছিলেন, তারাও তাদের সাথে যোগ দিলেন। বনূ হাশিমের একটি মাত্র লোক এর ব্যতিক্রম ছিল, সে হচ্ছে আবূ লাহাব। সে কুরায়শদের পক্ষে ছিল। বনূ হাশিম যে খাদ্যদ্রব্যাদি সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন তা অল্প কয়েক দিনেই নিঃশেষিত হলো। দারুণ খাদ্যাভাবে তাদের ভীষণ কষ্ট হতে লাগলো। গিরি-সংকট থেকে বেরোনোর একটি মাত্র সংকীর্ণ গিরিপথ ছিল। কারো বাইরে যাওয়ার সাধ্য ছিলো না।

বনী হাশিমের লোকজন ও মক্কার মুসলমানগণ দীর্ঘ তিন বছর ভীষণ কষ্টে অতিবাহিত করেন। শি’বে আবী তালিব নামক উক্ত গিরিসংকটে তারা সে সময় যে অবর্ণনীয় কষ্ট স্বীকার করেন তা কল্পনা করতেও গা শিউরে ওঠে। কেবল হজ্জের মওসুমে এ অবরুদ্ধ লোকগুলো বাইরে আসতে পারতেন। আরবের চিরাচরিত প্রথা অনুসারে ঐ সময়টিতে পূর্ণ শান্তি বিরাজ করতো। কেউ কারো সাথে যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হতো না। ঐ সুযোগে তারা নিজেদের আহার্য ও পানীয় দ্রব্যাদি ক্রয় করে সঞ্চয় করে নিতেন। ঐ সুযোগে হুযূর (সাঃ) বাইরে বের হতেন এবং বহিরাগত লোকদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতেন। কিন্তু কুরায়শরাও তার সাথে সাথে লেগে থাকতো এবং যেখানেই তিনি যেতেন সেখানেই লোকদেরকে তার কথা শোনা থেকে বারণ করতো। তারা তাকে পাগল ও যাদুকর বলে আখ্যায়িত করে তার দিকে কাউকে মনোযোগী হতে দিতো না। শি’বে আবূ তালিবের তিন বছর ব্যাপী নির্যাতনের কথাটি চিন্তা করলে এ কথাটি বোধগম্য হয় যে, গোত্রীয় টান ও বংশের নৈকট্যানুভূতিও এমনি একটি শক্তি যে বনূ হাশিমের লোকেরা মুসলমান না হওয়া সত্ত্বেও শুধু এ টানের জন্যে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সমর্থন ও সাহায্য করতে এতদূর কষ্ট বরণ করতে বাধ্য করেছিল। অপর দিকে গিরিসংকটে ঐ বন্দিত্বের সময়টাতে তারা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে অতি নিকট থেকে অবলোকনের এবং তার চারিত্রিক সৌন্দর্য দর্শনে প্রভাবান্বিত ও ইসলামকে জানার সুযোগ পায়। এ বংশগত আভিজাত্যবোধ এভাবে তাদেরকে (বনূ হাশিমকে) সঙ্গতভাবেই সম্মানের যোগ্য করে তোলে। তিন বছরের এ নিবর্তনমূলক বন্দিত্ব এবং বনূ হাশিমের দুঃখকষ্ট অবশেষে কুরায়শদের কোন কোন ব্যক্তির উপরও প্রভাব বিস্তার করে।

বনী হাশিমের ছোট ছোট বাচ্চাদের ক্ষুধার্ত অবস্থায় ছটফট করা এবং ক্ষুধার্ত পিতামাতার সম্মুখে তাদের কচি সন্তানদের আর্ত চীৎকার সেই অসহনীয় অবস্থা মক্কার কুরায়শরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতো। যুবায়র ইব্‌ন উমাইয়া ইব্‌ন মুগীরা বনী হাশিমের-এ যাতনা এজন্যে সর্বপ্রথম উপলব্ধি করল যে, আবূ তালিব ছিলেন তার মামুজান। যুবায়র প্রথমে মুত‘ঈম ইব্‌ন আদী ইব্‌ন নাওফিল ইব্‌ন আবদে মানাফকে আত্মীয়তা বন্ধনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে এ চুক্তি ভঙ্গের জন্যে তাকে উদ্বুদ্ধ করেন। তারপর আবুল বুখতরী ইব্‌ন হিশাম এবং যুমআ ইব্‌ন আসওয়াতকে তিনি তার সমর্থক বানান। মোটকথা, বনী হাশিমের সাথে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা বন্ধনে আবদ্ধ কয়েক ব্যক্তি বনী হাশিমের ভোগান্তির কথা উপলব্ধি করে এ ব্যাপারে বলাবলি শুরু করেন। এমনি একদিন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আবূ তালিবকে বললেন, আমাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে অবহিত করা হয়েছে যে, ঐ চুক্তিপত্রে লেখাগুলো পোকায় খেয়ে ফেলেছে। কেবল যেখানে যেখানে আল্লাহর নাম আছে, সে স্থানগুলো অক্ষত অবস্থায় আছে। আল্লাহ নাম ছাড়া বাকী সমস্ত অক্ষর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। একথা শুনে আবূ তালিব ঘাঁটি থেকে বেরোলেন এবং কুরায়শদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, আমাকে তো মুহাম্মদ (সাঃ) এরূপ অবহিত করেছেন। তোমরা চুক্তিপত্র পরীক্ষা করে দেখো। যদি তার দেয়া সংবাদ যথার্থ হয়ে থাকে, এবং সত্যি সত্যি চুক্তিপত্র নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়ে থাকে তবে এ বয়কটের অবসান হওয়া উচিত। তার কথা শুনে কুরায়শরা তৎক্ষণাৎ খানায়ে কা‘বায় গিয়ে উপস্থিত হলো এবং লক্ষ্য করলো যে, সত্যি সত্যি পোকায় চুক্তিপত্রটি খেয়ে নষ্ট করে দিয়েছে, কেবল আল্লাহ শব্দটি যেখানে যেখানে লিখিত ছিল তাই অক্ষত রয়েছে। তাদের বিস্ময়ের সীমা-পরিসীমা রইলো না এবং তৎক্ষণাৎ তারা বয়কট অবসানের কথা ঘোষণা করে দিল। বনী হাশিম এবং মুসলমানরা দীর্ঘ তিন বছর বেরিয়ে এসে মক্কায় নিজ নিজ ঘরে পুনরায় বসবাস শুরু করেন। শি’বে আবূ তালিবে অধিকাংশ সময়ই মুসলমানদেরকে ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির হয়ে গাছের পাতা খেতে হতো। কারো কারো অবস্থা এমন সংগীন হয়ে উঠে যে, কোথাও একটু শুকনো চামড়া পাওয়া গেলে তাই ধুয়ে একটু নরম করে আগুনে সিদ্ধ করে চিবুতেন। হাকীম ইব্‌ন হিযাম মাঝে মাঝে নিজ গোলামকে দিয়ে আপন ফুফু হযরত খাদীজা (রা)-এর জন্যে গোপনে খাদ্য পাঠাতেন। একবার আবূ জাহেল তা জানতে পেরে গোলামের হাত থেকে খাবার ছিনিয়ে নেয় এবং কঠোর প্রহরা বসিয়ে দেয়।

১০৬
শোকবর্ষ : নবুওয়াতের দশম সাল
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যখন শি’বে আবূ তালিব থেকে বের হলেন, তখন নবুওয়াতের দশম বর্ষ শুরু হয়ে গেছে। এবার মুসলমানদের সাথে কুরায়শদের ব্যবহার অনেকটা মার্জিত ও নম্র হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু না, মুসলমানদের দুঃখকষ্ট এবং হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর বিপদ পূর্বের তুলনায় আরো বেড়ে গেলো। শীঘ্রই এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হলো যে, এ বছরটি মুসলমানদের কাছে শোকবর্ষ নামে খ্যাতিলাভ করে। রজব মাসে আবূ তালিব অসুস্থ হয়ে অশীতিপর বয়সে পরলোকগমন করেন। আবূ তালিবের মৃত্যুর সাথে সাথে কাফিরদের সাহস বৃদ্ধি পায়। আবূ তালিবই ছিলেন এমন এক ব্যক্তিত্ব এবং বনী হাশিমের এমন একজন প্রভাবশালী সরদার যাকে সকলে ভয় করতো এবং সমীহ করে চলতো। তার মৃত্যুর সাথে সাথে বনী হাশিমের সেই পূর্বের প্রভাব আর মক্কায় বাকী রইলো না। মাঠ খালি পেয়ে কুরায়শরা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উপর যদৃচ্ছা অত্যাচার-উৎপীড়ন চালাতে শুরু করলো।

এ বছরই হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-ও মক্কায় কুরায়শদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে হিজরত করার ইরাদা করলেন। তিনি মক্কা থেকে বেরিয়ে পড়লেন। মক্কা থেকে চার মঞ্জিল পথ অতিক্রম করে তিনি বিরকুল গিমাদ নামক স্থানে উপনীত হলেন। কারা কবীলার সরদার ইবনুদ দাগিনার সাথে তার সাক্ষাৎ হলো। ইবনুদ দাগিনা জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাচ্ছেন! হযরত আবূ বকর (রা) জবাবে বললেন : আমার কওম আমাকে অত্যাচারে এমনি অতিষ্ঠ করে তুলেছে যে, এখন আমি ইরাদা করেছি মক্কার বাইরে কোথাও গিয়ে থাকবো এবং আমার রব-এর ইবাদত করবো। ইবনুদ দাগিনা বললেন : আপনি তো এমনি এক ব্যক্তি যার নিজেরও মক্কা ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাওয়া সমীচীন হবে না আর আপনার স্বজাতিরও আপনাকে যেতে দেয়া ঠিক হবে না। আমি আপনাকে আমার আশ্রয়ে নিচ্ছি। আপনি ফিরে চলুন এবং মক্কাতে থেকেই নিজের রব-এর ইবাদত করুন! তাঁর কথায় হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) মক্কায় ফিরে এলেন। ইবনুদ দাগিনা কুরায়শ সরদারদের ডেকে একত্র করে তাদের ভর্ৎসনা করলেন এবং বললেন : তোমরা এমন এক সৎগুণের অধিকারী ব্যক্তিকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করছো যার উপস্থিতি যে কোনো কওমের জন্য গর্বের হেতু হতে পারে। হযরত আবূ বকর (রা) তার বাড়ীর আঙিনায় একটি ছোট চবুতরা মসজিদরূপে বানিয়ে সেখানে কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করতেন এবং ইবাদতে মশগুল থাকতেন। তাঁর কুরআন তিলাওয়াতের আওয়াজে মহল্লার মহিলা ও শিশুরা অভিভূত হয়ে যেতো। কুরায়শদের কাছে তাও ছিলো অসহনীয়। ইবনুদ দাগিমা তাকে এরূপ করতে বারণ করলে তিনি স্পষ্ট বলে দিলেন। আমি তোমার আশ্রয় থেকে বেরিয়ে আমার আল্লাহর আশ্রয়ই অবলম্বন করছি। তার আশ্রয়ই আমার জন্যে যথেষ্ট। তবুও কুরআন তিলাওয়াত থেকে বিরত থাকতে পারবো না।

আবু তালিবের ওফাতের প্রায় দুই মাস পরে নবুওয়াতের দশম বছরে হযরত খাদীজাতুল কুবরা (রা)-ও ইন্তিকাল করেন। হযরত খাদীজা (রা)-কে হুযূর (সাঃ) অত্যন্ত ভালবাসতেন। সমস্ত দুঃখ-কষ্টে তিনি ছিলেন হযরত নবী (সাঃ)-এর সহধর্মিণী। সর্বপ্রথম তিনিই-তার প্রতি ঈমান আনয়ন করেছিলেন। সব সময়েই তিনি তাকে সাহস যুগিয়েছেন। বিপদে আপদে তাকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। আবূ তালিব ও হযরত খাদীজা (রা) হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর এমন দু’জন সঙ্গী ও সহমর্মী ছিলেন যে, তাদের মৃত্যু হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে ভীষণ শোকার্ত করে তোলে। সাথে সাথে কুরায়শদের অত্যাচার-উৎপীড়নও বৃদ্ধি পায়। একদিন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) পথ অতিক্রম করছিলেন—এমন সময় কোন এক দুরাচার তার উপর কাঁদা নিক্ষেপ করে। তাঁর মাথার চুল, দেহ মুবারক, কাপড়-চোপড় কর্দমাক্ত হয়ে গেলো। এই অবস্থায় ঘরে ফিরলে হযরত ফাতিমা যুহ্‌রা (রা) তা দেখে দৌড়ে পানি নিয়ে আসলেন। তিনি পিতার এই হাল দেখে কেঁদে ফেললেন এবং পানি এনে মাথা ধুয়ে দিলেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বললেন : কেঁদো না মা! আল্লাহই তোমার পিতাকে রক্ষা করবেন।

একদিন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) খানায়ে কা‘বায় গেলেন। সেখানে মুশরিকদের অনেকেই উপবিষ্ট ছিলো। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে দেখে আবূ জাহেল উপহাসের স্বরে বলে উঠলো : হে আবদে মানাফের বংশধররা! দেখো দেখো, তোমাদের নবী এসে গেছেন! উত্‌বা ইব্‌ন রবীআ বলে উঠলো, কেউ নবী হোক, কেউ ফেরশতা বনে যাক, তাতে আমাদের কি? হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) উতবাকে সম্বোধন করে বলেন : তুমি কোনো দিনই আল্লাহ ও রাসূলের পক্ষ সমর্থন করোনি। নিজের জেদ নিয়েই অটল রয়েছো। এরপর আবূ জাহেলকে লক্ষ্য করে বললেন : তোমার জন্যে সেদিন বেশী দূরে নয়, যখন তুমি হাসবে অল্পই, কাঁদবে অনেক বেশী। তারপর উপস্থিত মুশরিকদেরকে লক্ষ্য করে বললেন: সেদিন বেশী দূরে নয় যখন তোমরা এ দীনের ছায়াতলে আশ্রয় নেবে, যে দীনকে আজ তোমরা অস্বীকার করছ।

১০৭
তায়িফ সফর
কুরায়শদের জেদ ক্রমেই বেড়ে চললো। শি’বে আবূ তালিবের বন্দিত্বের জীবনেই হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যখন হজ্জের মওসুমে বেরিয়ে আসতেন, তখন মক্কায় আগত বাইরের তীর্থ যাত্রীদের কাছে ইসলামের তাবলীগ শুরু করে দিয়েছিলেন। সে সময় তার সে প্রচারকার্যে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ফল পাওয়া যায়নি। এখন মক্কাবাসীদের ইসলামের প্রতি সীমাহীন বিরাগভাব লক্ষ্য করে তিনি তায়িফবাসীদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতে মনস্থ করেন।

তায়িফ ছিলো মক্কা থেকে তিন মন্‌যিল অর্থাৎ ষাট মাইল দূরবর্তী মক্কার মতোই বড় শহর। ছাকীফ গোত্র সেখানে বাস করতো। ওরা ছিলো লাতের পূজারী। সেখানে লাতের মন্দির ছিলো। গোটা শহরের লোক ছিলো সে মন্দিরের ভক্ত পূজারী। নবুওয়াতের দশম বছর শওয়াল মাসে অর্থাৎ হযরত খাদীজা (রা)-এর ইন্তিকালের এক মাস পরে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যায়দ ইব্‌ন হারিছা (রা)-কে সঙ্গে নিয়ে পায়ে হেঁটে তায়িফ গিয়ে উপনীত হন। সেখানে পৌঁছবার পূর্বে রাস্তায় তিনি ইব্‌ন বকর কবীলায় গিয়ে উঠেন। যখন তিনি লক্ষ্য করলেন যে, এরাও মক্কাবাসীদের সমধর্মী ও সহমর্মী তখন তিনি কাহ্তান বংশীয়দের কাছে গিয়ে উপনীত হলেন। কিন্তু যখন দেখতে পেলেন যে, এরাও নিষ্ঠুরতার কোন অংশে মক্কাবাসীদের চাইতে কম না তখন তিনি তায়িফে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তায়িফে পৌঁছে সর্বপ্রথম তিনি সেখানকার নেতৃস্থানীয় লোকদের সাথে সাক্ষাৎ করলেন। তায়িফের সরদারদের মধ্যে আবদে ইয়ালীল ইব্‌ন উমর এবং তার দুই ভাই মাসঊদ ও হাবীব বনী ছাকীফের নেতৃস্থানীয় সরদার ও সর্বাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি বলে গণ্য হতেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সর্বপ্রথম এদের সাথে দেখা করে তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। এরা ছিল অত্যন্ত দাম্ভিক ও অহংকারী। তাদের একজন বললো : আল্লাহ যদি তোমাকে নবীই বানাতেন, তবে কি আর এমন করে জুতা চটর চটর করে পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াতে? দ্বিতীয় জন বলল : আল্লাহ্ বুঝি তোমাকে ছাড়া নবী বানাবার জন্যে আর কোন লোক খুঁজে পেলেন না? শেষ পর্যন্ত তিনি তোমাকেই নবী বানালেন।

لَوْلَا نُزِّلَ هَٰذَا الْقُرْآنُ عَلَىٰ رَجُلٍ مِنَ الْقَرْيَتَيْنِ عَظِيمٍ . ( ٣١ : ٤٣ )

তৃতীয় জন বললো: আমি, তোমার সাথে বাক্য ব্যয় করতে চাই না। কেননা, তোমার দাবী অনুসারে সত্যিই যদি তুমি আল্লাহর রাসূল হয়ে থাক তাহলে তোমার কথা প্রত্যাখ্যান করা বিপজ্জনক হবে। আর যদি তুমি আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করে থাক, তবে এমন ব্যক্তির সাথে বাক্যালাপ না করাই শ্রেয়।

১০৮
তায়িফবাসীদের ঔদ্ধত্যমূলক আচরণ
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যখন আবদে ইয়ালীল ও তার ভাইয়ের ব্যাপারে নিরাশ হয়ে গেলেন, তখন তিনি তাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন : আচ্ছা, আপনারা আপনাদের এ চিন্তাধারা নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখুন, অন্যদেরকে আর এসব কথা বলবেন না। সেখান থেকে বিদায় গ্রহণ করে তিনি তায়িফের অন্যান্য লোকের মধ্যে ইসলাম প্রচারের কাজে আত্মনিয়োগ করলেন। কিন্তু আবদে ইয়ালীল ও তার ভাইয়েরা নিজেদের গোলামদেরকে এবং শহরের ছেলে-পিলে ও গুণ্ডা বদমায়েশদেরকে তার পিছনে লেলিয়ে দিল। তিনি যেখানেই যেতেন, তারাও পিছু পিছু গালি দিতে দিতে এবং ঢিল ছুঁড়তে ছুঁড়তে চলতে লাগলো। তাঁর বিশ্বস্ত খাদিম যায়দ ইব্‌ন হারিছ (রা) তাঁর সাথে সাথে চলছিলেন এবং তাঁকে দুরাচারদের ঢিল ও আক্রমণ থেকে হিফাযত করার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। পাথর ও ঢিলের আঘাতে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ও যায়দ উভয়েই রক্তাক্ত হয়ে গেলেন। তাদের-তায়িফে অবস্থান অসম্ভব হয়ে উঠলো। অগত্যা তারা সেখান থেকে বের হয়ে গেলেন।

তায়িফের গুণ্ডা-বদমায়েশেরা দল বেঁধে পাথর আর ঢিল নিক্ষেপ করতে করতে তাদের পিছু পিছু ছুটে চলেছিলো। তারা যখন তায়িফের সীমা পেরিয়ে বের হয়ে গেলেন তখন তারা তাদের পিছন ছাড়ছিল না। দীর্ঘ তিন মাইল পর্যন্ত তারা তাদের পিছু পিছু ছুটতে থাকে। তার পদযুগল তাদের পাথরের আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে গেল। আহত পদযুগল থেকে প্রবাহিত রক্তে জুতা পর্যন্ত ভরে উঠলো। এরূপভাবে সারা দেহই আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে উঠেছিলো। তিনি নিজে বলেন : আমি তায়িফ থেকে তিন মাইল দূর চলে আসি। তখনো আমার হুঁশ ছিল না যে, কোথা থেকে আসছি আর কোথায় যাচ্ছি! তায়িফ থেকে তিন মাইল দূরে মক্কার জনৈক সরদার উত্‌বা ইব্‌ন রবীআর একটি বাগান ছিল। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সেখানে এসে আশ্রয় নিলেন। তায়িফের গুণ্ডা-বদমায়েশেরা তখন তায়িফে ফিরে চললো। তিনি তখন উক্ত বাগানের দেয়ালের ছায়ায় বসলেন এবং নিজের অসহায় অবস্থার জন্যে আল্লাহ্‌র দরবারে এভাবে ফরিয়াদ জানালেন :

“ইলাহী, অসহায় ও দুর্বলদের তুমিই হিফাযতকারী

আমি তোমারই দরবারে মদদ কামনা করছি।”

উতবা ইব্‌ন রবীআ তখন বাগানে উপস্থিত ছিলো। সে তাকে এ অবস্থায় দূর থেকে দেখতে পেলো। আরবের আভিজাত্যবোধ ও অতিথিপরায়ণতা তার মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। একটি রেকাবীতে আঙুরের কয়েকটি থোকা রেখে সে তার গোলাম আদ্দাসের মাধ্যমে তার কাছে পাঠিয়ে দিলো। গোলামটি ছিলো নিনোভার অধিবাসী একজন খ্রিস্টান। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আঙুর খেতে খেতে গোলামটিকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। গোলাম আদ্দাসের অন্তরে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কথা দাগ কাটলো। সে মাথা নিচু করে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর দাস্ত মুবারকে চুমু খেলো। উত্‌বা দূর থেকে গোলামের এ চুমু খাওয়ার দৃশ্যটি লক্ষ্য করলো। আদ্দাস ফিরে গেলে উত্‌বা তাকে বললো, সাবধান! ঐ লোকটির কথায় কান দিও না; তার চেয়ে তো তোমার ধর্মই উত্তম। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কিছুক্ষণ উত্‌বার বাগানে বিশ্রাম নিলেন। তারপর সেখান থেকে চলে গেলেন। সেখান থেকে বেরিয়ে নাখলা নামক স্থানে এক খেজুর বাগানে এসে উপনীত হলেন। সেখানে জিন সরদাররা তাকে কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করতে শুনে তার উপর ঈমান আনয়ন করে।

১০৯
মক্কায় প্রত্যাবর্তন
নাখলা থেকে রওনা হয়ে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) হেরা পর্বতে আসেন এবং সেখানে অবস্থান করে কুরায়শ সরদারদের কারো কারো কাছে এ মর্মে পয়গাম পাঠালেন যে, তারা যেনো তাকে তাদের জামানতে বা আশ্রয়ে গ্রহণ করেন। কিন্তু কেউই তাতে সম্মত হলো না। মূত‘ঈম ইব্‌ন আদীর কাছে যখন তার পয়গাম পৌঁছলো তখন তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং তিনি মুশরিক ও কাফির হওয়া সত্ত্বেও তার আরবী আভিজাত্য এবং গোত্রীয় টান তার মধ্যে এমনিভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো যে, তিনি তৎক্ষণাৎ সোজা হেরা পর্বতে গিয়ে উপস্থিত হলেন এবং হযরত নবী (সাঃ)-কে সঙ্গে নিয়ে মক্কায় এসে উপস্থিত হলেন। মুত‘ঈমের পুত্র তখন উক্ত তরবারি হাতে খানায়ে কা‘বার সম্মুখে দাঁড়িয়ে গেলেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কা‘বা শরীফ তাওয়াফ করলেন। তারপর মুত‘ঈম এবং তাঁর পুত্রগণ উন্মুক্ত তরবারির প্রহরায় তাকে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছিয়ে দিলেন। কুরায়শরা মুত‘ঈমকে জিজ্ঞেস করলো : মুহাম্মদের সাথে তোমার কী সম্পর্ক? মুত‘ঈম জবাব দিলেন : সম্পর্ক কিছুই নেই, তবে আমি তাঁর একজন সমর্থক। যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি আমার আশ্রয়ে আছেন ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ তাঁর দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারবে না। মুত‘ঈমের এ দৃঢ় সমর্থন ও নির্ভীক আচরণে কুরায়শরা অনেকটা স্তব্ধ হয়ে গেলো।

একটি রিওয়ায়াতে আছে, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যখন তায়িফে কাফির-মুশরিকদের কংকর আঘাতে জর্জরিত তখন জনৈক ফেরেশতা তাঁর খিদমতে উপস্থিত হয়ে আরয করেন যে, যদি আপনি নির্দেশ দেন তবে আমি পাহাড় উত্তোলন করে তায়িফবাসীদের উপর নিক্ষেপ করবো। তাতে তারা পিষে মরবে। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) জবাবে বলেন : না, তা কখনো হতে পারে না। আমি আশা করি, এরা যদি ইসলাম গ্রহণ না করে, তবে এদের সন্তানরা অবশ্যই ইসলামের খিদমতে আত্মনিয়োগ করবে। তাদের পরবর্তী গোটা প্রজন্ম ইসলাম গ্রহণ করবে। আমি তাদের ধ্বংস কামনা করি না।

১১০
হযরত আয়িশা (রা)-এর সাথে শাদী মুবারক : মি‘রাজ
এ বছরই অর্থাৎ নবুওয়াতের দশম বর্ষে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) হযরত আয়িশা বিন্‌ত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) এবং হযরত সাওদা বিন্‌ত যামআ (রা)-এর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ঐ বছরই তিনি মি‘রাজে গমন করেন। মি‘রাজ সম্পর্কে তাবারীর অভিমত হচ্ছে তা’ ওয়াহী অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে অর্থাৎ নবুওয়াতের প্রথম বর্ষের ঘটনা, যখন নামায ফরয হয়েছিল। ইব্‌ন হাযমের মতে, তা দশম হিজরীর ঘটনা।

কোনো কোনো রিওয়ায়াতের দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, মি‘রাজ মদীনায় হিজরতের পরে ঘটেছিল। যেভাবে বক্ষ বিদারণ সম্পর্কে কোন কোন আলেমের ধারণা যে তা’ একাধিকবার সংঘটিত হয়েছে তেমনিভাবে মি‘রাজ সম্পর্কেও কোনো কোনো পণ্ডিতের ধারণা যে, তাও একাধিকবার হয়েছে। মোটকথা, এ বিতর্কের স্থান এটা নয়। এজন্যে স্বতন্ত্র পুস্তক এবং তাফসীর ও হাদীসের কিতাবাদি দেখা যেতে পারে।

১১১
বিভিন্ন স্থানে ও বিভিন্ন গোত্রে ইসলাম প্রচার
মক্কাবাসীদের প্রতি নিরাশ হয়ে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তায়িফ গমন করেছিলেন। সেখানকার লোক মক্কাবাসীদের চাইতেও জঘন্যতর আচরণ করলো। মক্কাবাসীদের ঘৃণ্য ও জিদ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে লাগলো। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সাহস হারালেন না। তায়িফ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি মক্কার আশেপাশে বসবাসরত গোত্রসমূহের কাছে যেতে এবং তাদের মধ্যে ইসলামের বাণী প্রচার করতে লাগলেন। সে অনুসারে বনূ কিন্দা ও বনূ আবদুল্লাহ গোত্রদ্বয়ের আবাসস্থলেও তিনি গমন করেন। বনূ আবদুল্লাহ্ গোত্রকে লক্ষ্য করে তিনি বলেন : হে বনু আবদুল্লাহ গোত্রের লোকজন! তোমাদের আদি পুরুষ ছিলেন আবদুল্লাহ, আল্লাহর দাস। সুতরাং তোমরাও সত্যিকারের আল্লাহর দাস হয়ে যাও! বনী হানাফিয়ার আবাসভূমিতেও তিনি গমন করেন। কিন্তু সে জালিমরা গোটা আরবের মধ্যে তাঁর সাথে সবচাইতে জঘন্য ও নিষ্ঠুর পন্থায় তাকে প্রত্যাখ্যান করে।

বাইরে থেকে যেসব পথচারী মক্কায় আসতো বা হজ্জের সময় দূর-দূরান্ত থেকে যেসব কাফেলা আসতো হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাদের কাছেও ইসলামের দাওয়াত পৌঁছিয়ে দিতেন।

কিন্তু আবূ লাহাব তার বিরোধিতার জন্যে এক পায়ে খাড়া থাকতো। এসে সর্বত্র তার পিছু পিছু লেগে থাকতো এবং বহিরাগতদেরকে তাঁর কথায় কর্ণপাত করতে বারণ করতো। হযরত নবী করীম (সাঃ) একে একে বনূ আমির, বনূ শায়বান, বনূ কাল্‌ব, বনূ মাহারিব, ফাযারাহ, গাস্‌সান, সুলায়ম, আবাস, হারিছ, আযারা, ফাহল, মুর্‌রা প্রভৃতি গোত্রকে ইসলামের দাওয়াত প্রদান করেন।

যখন তিনি বনূ আমিরকে ইসলামের দাওয়াত দিতে গেলেন তখন তাদের মধ্যকার ফার্‌রাস নামক এক ব্যক্তি বললো : আচ্ছা, আমরা যদি মুসলমান হয়ে যাই আর আপনি দুশমনদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হন, তাহলে আপনি কি আমাকে আপনার খলীফা মনোনীত করে যাবেন? জবাবে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বললেন : এটা তো আল্লাহ্‌র ইখতিয়ারে। তিনি যাকে ইচ্ছে আমার খলীফা বানাবেন। এ কথা শুনে ঐ ব্যক্তি বলে উঠলো : বাঃ! এখন তো আমরা আপনার অনুসারী ও সমর্থক হয়ে নিজেদের গলা কাটাবো, আর যখন আপনি কৃতকার্য হয়ে যাবেন, তখন অন্যরা শাসন ক্ষমতার মজা লুটবে! যান, আমাদের আপনার দরকার নেই।

১১২
সুয়াইদ ইব্‌ন সামিত
নবুওয়াতের একাদশ বর্ষ তখন শুরু হয়ে গেছে। মদীনাবাসী আওস গোত্রের জনৈক সুয়াইদ ইব্‌ন সামিত মক্কায় এলো। লোকটি তার স্বগোত্রে কামিল খিতাবে মশহুর ছিলো। ঘটনাচক্রে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সাথে তাঁর মূলাকাত হলো। তিনি লোকটাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। সে বললো, সম্ভবত আমার কাছে যা আছে আপনার কাছেও তা-ই আছে। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তখন জিজ্ঞেস করলেন : তোমার কাছে কী আছে হে! সে বললো : লুকমানের হিকমত বা জ্ঞানরাশি। তিনি বললেন : আচ্ছা, তা থেকে একটু শোনাও তো দেখি! সে তা পড়ে শোনালে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বললেন : এটা ভালো বাণী! কিন্তু আমার কাছে রয়েছে কুরআন মজীদ, এর থেকে উত্তম ও শ্রেয় এবং এটা হচ্ছে হিদায়াত ও নূর। তারপর তিনি তাকে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করে শোনালেন। সে তা শুনে স্বীকার করলো যে, সত্যিই এ হিদায়াত ও নূর। কোনো কোনো রিওয়ায়াতে আছে যে, সে মুসলমান হয়ে যায়। আবার কোনো কোনো রিওয়ায়াতে আছে যে, সে মুসলমান হয়নি বটে, কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর বিরোধিতা মোটেই করেনি। মদীনায় প্রত্যাবর্তনের পর আওস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয়ের মধ্যে সংঘটিত এক যুদ্ধে সে নিহত হয়।

১১৩
আয়াস ইব্‌ন মুআয (রা)
ঐ দিনগুলোতে আনাস ইব্‌ন রাফি‘ তার স্বগোত্রে ইব্‌ন আবদুল আশহালের কতিপয় লেখকসহ মদীনা থেকে মক্কায় আসে। উদ্দেশ্য ইব্‌ন খাযরাজের বিরুদ্ধে মক্কাবাসীদের সহযোগিতা লাভের জন্যে চুক্তিবদ্ধ হওয়া। এ প্রতিনিধি দল আসার সংবাদ পেয়ে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সর্বপ্রথম তাদের কাছে গেলেন। কুরায়শ নেতাদের সাথে তখনো তারা তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছুই বলে সারেননি। তিনি গিয়েই তাদেরকে বললেন : আমার কাছে এমন বস্তু আছে যাতে (তাদের কল্যাণ নিহিত রয়েছে) তোমরা রাযী থাকলে আমি তা তোমাদের কাছে তুলে ধরতে পারি। তারা বললো : বেশ তো, আপনি তা উপস্থাপন করুন। তিনি বললেন : মানবজাতির হিদায়াত ও পথ প্রদর্শনের জন্যে আল্লাহ তা‘আলা আমাকে নবীরূপে প্রেরণ করেছেন। আমি শির্‌ক করতে নিষেধ করি এবং কেবল এক আল্লাহর ইবাদত করার নির্দেশ দিয়ে থাকি। আমার উপর আল্লাহ তা‘আলা কিতাব নাযিল করেছেন। তারপর তিনি একে একে ইসলামের মূলনীতি তাদের সম্মুখে তুলে ধরেন এবং কুরআন শরীফ পড়ে তাদেরকে শোনান। মদীনায় এ প্রতিনিধি দলে আনাস ইব্‌ন রাফির সাথে আয়াস ইব্‌ন মুআয নামক এক যুবকও ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কথা এবং কুরআনের বাণী শুনে তিনি তার স্বগোত্রীয়দেরকে লক্ষ্য করে বললেন : “হে আমার স্বগোত্রীয় ভাইয়েরা! তোমরা মদীনা থেকে যে উদ্দেশ্যে এসেছ আল্লাহর কসম, তার চাইতে এটাই আমার কাছে শ্রেয় মনে হয়। প্রতিনিধি দলের নেতা আনাস ইব্‌ন রাফি‘ তাকে ধমক দিয়ে বলল : ওহে! এ কালাম শোনার জন্যে আমরা এত দূর থেকে এখানে আসিনি। আয়াস তখন চুপ হয়ে গেলেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-ও চুপ করে সেখান থেকে উঠে চলে আসলেন। ফলশ্রুতিতে মদীনার এ প্রতিনিধি দল ব্যর্থ মনোরথ হয়ে মক্কা থেকে ফিরে আসে। কুরায়শ এবং তাদের মধ্যে আর কোন চুক্তিই হলো না। মদীনায় প্রত্যাবর্তনের অল্প কিছু দিন পরই হযরত আয়াস ইব্‌ন মুআয (রা)-এর ইন্তিকাল হয়ে যায়। মৃত্যুর পূর্বেই তিনি তার ঈমান আনয়ন ও ইসলাম গ্রহণের কথা ঘোষণা করে দেন।

১১৪
যিমাদ ইযদী (রা)
যিমাদ ইযদী ছিলেন আরবের মশহুর যাদুকর। তিনি ছিলেন ইয়ামানের অধিবাসী। তিনি একবার মক্কায় আসলেন। তিনি কুরায়শদের কাছে শুনতে পান যে, মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উপর জিন ভূতের আছর আছে। তিনি বলে উঠলেন : আমি আমার মন্ত্র প্রয়োগে এক্ষুণি তার চিকিৎসা করে দিচ্ছি। সত্যি সত্যি ঐ ব্যক্তি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কাছে এসে বললেন, আমি আপনাকে আমার মন্ত্র শোনাচ্ছি। হযরত নবী করীম (সাঃ) বললেন : প্রথমে আমারটা শুনে নাও, তারপর তোমার মন্ত্র শুনিয়ো। তারপর তিনি তাঁর খুতবার ভূমিকা অংশ এভাবে শুরু করলেন :

الحمد لله نحمده ونستعينه من يهد الله فلا مضل له ومن يضلله فلا هادي له واشهد ان لا اله الا الله وحده لا شريك له واشهدوا ان محمدا عبده ورسوله .

এতটুকু উচ্চারণ করতেই যিমাদ চীৎকার করে বলে উঠলো : আচ্ছা, এ কথাগুলো আবার বলুন তো! পুনঃ পুনঃ কয়েকবার তিনি এ বাক্যগুলো তার মুখে উচ্চারণ করিয়ে শুনলেন। তারপর বললেন : আমি অনেক ভবিষ্যদ্বক্তা, যাদুকর ও কবিকে দেখেছি এবং তাদের কথাবার্তা শুনেছি, কিন্তু এমন ব্যাপক অর্থবোধক অলংকারসমৃদ্ধ কথা আমি কারো মুখে কোনো দিন শুনিনি। তারপর তিনি বললেন : আপনি হাত বাড়ান, আমি আপনার হাতে মুসলমান হচ্ছি এবং ইসলামের জন্যে বায়‘আত হচ্ছি।

১১৫
তুফায়ল ইব্‌ন আমর দুওসী (রা)
ইয়ামানে দুওস কবীলার বাস ছিলো। সেই কবীলার সরদার তুফায়ল ইব্‌ন আমর ইয়ামানের বিখ্যাত রঈসদের অন্যতমরূপে গণ্য হতেন। তুফায়ল তার জ্ঞানবত্তা ছাড়াও একজন বড় কবি ছিলেন। ঐ বছর অর্থাৎ একাদশ নববী বর্ষে তিনি ঘটনাক্রমে মক্কায় আগমন করেন। তুফায়ল ইবন আমরের আগমন সংবাদে মক্কার সরদারগণ তাঁকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে মক্কার বাইরে এগিয়ে যায়-এবং অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ অভ্যর্থনা দ্বারা তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে। তারা তাকে মক্কায় নিয়ে আসে। কুরায়শদের ভয় ছিল পাছে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সাথে তুফায়লের সাক্ষাৎ না হয়ে যায় আর তিনি তার উপর তার যাদুকরী প্রভাব বিস্তার করে না বসেন। তাই তুফায়লের মক্কা প্রবেশের সাথে সাথে তুফায়লকে বলে যে, আমাদের এ মক্কায় আজকাল এমন এক যাদুকরের আবির্ভাব ঘটেছে—যে গোটা শহরকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। তার কুপ্রভাবে পিতা তার পুত্র থেকে, পুত্র তার পিতা থেকে, ভাই তার ভাই থেকে, স্বামী তার স্ত্রী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আপনি যেহেতু আমাদের সম্মানিত অতিথি, তাই এর ব্যাপারে আপনি সতর্ক থাকবেন এবং এ যাদুকরের অর্থাৎ মুহাম্মদের মুখ থেকে কোন কথা শুনবেন না। কুরায়শদের বার বার সতর্কীকরণ ও ভীতি প্রদর্শনে তুফায়ল এতই ভীত হলো যে, তিনি তার দুই কানে তুলা ঠেসে দিলেন—যাতে কোনক্রমেই ঐ যাদুকরের কথা তার কর্ণমূলে প্রবেশ করতে না পারে।

একদিন ভোরবেলা তুফায়ল স্বীয় কানে তুলো দিয়ে খানায়ে কা‘বায় প্রবেশ করলেন। হযরত নবী করীম (সাঃ) তখন সেখানে ফজরের নামায পড়ছিলেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নামাযের নিয়ম পদ্ধতি চোখে দেখে তুফায়লের কাছে ভালই ঠেকলো। তিনি তাঁর আরো নিকটবর্তী হলেন। সেখানে তার কিরাতের ধ্বনি অল্প অল্প তার কানে ঢুকছিলো। তারপর তুফায়ল ভাবলেন, আচ্ছা, আমি নিজেও তো একজন কবি মানুষ। নিজের জ্ঞানবুদ্ধি ও বিবেক আছে। ঐ ব্যক্তির কথা ভাল হলে মেনে নেবো, মন্দ হলে প্রত্যাখ্যান করবো। একথা মনে আসতেই তিনি কান থেকে তুলো খুলে ফেলে দিলেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নামায শেষে যখন ঘরের দিকে পা বাড়ালেন তখন তুফায়লও পিছে পিছে তার সাথে যেতে লাগলেন। তিনি তাকে তার বাণী শোনাবার আবেদন জানালেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করে শোনালেন। সাথে সাথে তুফায়ল ইসলাম গ্রহণ করলেন। তিনি আরয করলেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি দুআ করুন, আমার মাধ্যমে যেন আমার গোটা গোত্রকে ইসলাম গ্রহণের তাওফীক আল্লাহ তা‘আলা দান করেন। তুফায়ল মক্কা থেকে বাড়ি প্রত্যাবর্তন করে তাঁর গোত্রের লোকজনকে ইসলামের দাওয়াত দিতে লাগলেন। তুফায়ল হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে বলেন যে, মক্কাবাসীরা আপনাকে জ্বালাতন করে। আপনি হিজরত করে আমাদের ওখানে চলুন। জবাবে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেন : যখন আল্লাহ তা‘আলা আমাকে হিজরত করার আদেশ দিবেন, তখনই আমি হিজরত করবো। তিনি যেখানে হিজরত করার নির্দেশ দেবেন, সেখানেই আমি হিজরত করবো।

১১৬
হযরত আবূ যর গিফারী (রা)
হযরত আবূ যর (রা) ছিলেন গিফার গোত্রের লোক। তিনি মদীনার (ইয়াছরিবের) উপকণ্ঠে বসবাস করতেন। মদীনায় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর খবর সুয়িদ ইব্‌ন সামিত ও আয়াস ইব্‌ন মুআযের মাধ্যমে পৌঁছে এবং এরকম একটা উড়ো খবর হযরত আবূ যরের কান পর্যন্ত পৌঁছে। সাথে সাথে তিনি বিষয়টি তদন্ত করে দেখার জন্যে তার কবি ভাই আনিসকে মক্কায় পাঠালেন। আনিস মক্কায় গিয়ে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। মদীনায় ফিরে তিনি ভাইয়ের কাছে বর্ণনা করেন যে, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এমন এক ব্যক্তি যিনি সৎকাজের আদেশ দেন এবং অসৎকাজের বারণ করেন। এ সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় আবূ যরের মন ভরলো না। তিনি নিজে পায়ে হেঁটে মদীনা থেকে মক্কায় গেলেন। শেষ পর্যন্ত হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর খিদমতে উপস্থিত হওয়া মাত্র ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি তৎক্ষণাৎ খানায় কা‘বায় উপস্থিত হয়ে কুরায়শের সম্মুখে প্রকাশ্যে উচ্চৈঃস্বরে কালেমা পাঠ করেন এবং ততক্ষণে যতটুকু কুরআন তিলাওয়াত রপ্ত করেছিলেন তা তিলাওয়াত করে সবাইকে শোনালেন। কুরায়শরা মার মার রবে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। কুরায়শদের বেদম প্রহারে তিনি চৈতন্য হারালেন। হযরত আব্বাস তখনো কুরায়শদের দলে ছিলেন। তিনি তখনো মুসলমান হননি। তিনি এসে সেখানে উপস্থিত হলেন। কাণ্ড দেখে তিনি চিৎকার করে বললেন : সর্বনাশ, এ কী কাণ্ড! এ যে গিফারী গোত্রের লোক, যেখান থেকে তোমরা খেজুর ক্রয় করে এনে থাক! একথা শোনা মাত্র লোকজন কেটে পড়লো। চৈতন্য ফিরতেই তিনি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কাছে ছুটে এলেন। পরদিন আবার তিনি পূর্বদিনের মতো প্রকাশ্যে এবং উচ্চৈঃস্বরে কালেমা পাঠ করলেন। আবার কুরায়শরা তাকে প্রহার করলো। এভাবে মক্কায় ইসলামের ঘোষণা দিয়ে তিনি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন।

১১৭
ইয়াছরিবের সৌভাগ্যবান ছয়জন
নবুওয়াতের একাদশ বর্ষের শেষ মাসের কথা। মদীনার আওস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয়ের মধ্যকার সেই বিখ্যাত লড়াই যার প্রস্তুতি গ্রহণের নিমিত্ত বনী আশহাল গোত্রের প্রতিনিধিদল মক্কায় এসেছিলো—যা ইতিহাসে বুআছ যুদ্ধ নামে খ্যাত এবং যাতে গোত্রদ্বয়ের বড় বড় সর্দাররা নিহত হয়েছিল—তখন তা শেষ হয়েছে। কা‘বা ঘরে হজ্জের জন্যে আরবের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোক আসা তখন শুরু হয়ে গেছে। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ঐ সব কাফেলার কাছে গিয়ে গিয়ে ইসলামের দাওয়াত দিতেন। আবূ জাহেল, আবূ লাহাবরা-তার পিছু পিছু গিয়ে বহিরাগতদেরকে তাঁর কথায় কর্ণপাত করতে মানা করতো। দুষ্টদের এ দুষ্টামী থেকে বাঁচবার জন্যে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) অধিকাংশ সময় রাতের অন্ধকারে দুই তিন মাইল পায়ে হেঁটে বহিরাগতদের তাঁবুতে গিয়ে পৌঁছতেন। তিনি তাদের কাছে বসতেন। মূর্তিপূজার অসারতা বর্ণনা করে তাদেরকে বোঝাতেন এবং তাওহীদ বা আল্লাহর একত্বের পানে তাদেরকে আহবান জানাতেন। এভাবে এক রাতে মক্কায় কয়েক মাইল দূরবর্তী আকাবা স্থানে তিনি কয়েকজন তীর্থযাত্রীকে আলাপ করতে শুনতে পেলেন। তিনি তাদের নিকটবর্তী হলেন। লক্ষ্য করলেন তারা ছয়জন। তিনি তাদের কাছে গিয়ে বসলেন। জিজ্ঞেস করে জানতে পেলেন যে, এরা ইয়াছরিব থেকে হজ্জ করতে এসেছেন। এরা খাযরাজ বংশের লোক। তিনি তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। কুরআন শরীফের আয়াত তিলাওয়াত করে শোনালেন। তারা পরস্পরে মুখ চাওয়া-চাওয়ি শুরু করলেন এবং তৎক্ষণাৎ ঈমান আনয়ন করলেন। ইয়াছরিববাসীরা তখন প্রধানত দু’ভাগে বিভক্ত ছিল। এক ভাগ ছিল ইয়াহূদী, অন্যভাগে মূর্তিপূজারী মুশরিকরা। এ মুশরিকদের মধ্যে আওস ও খাযরাজ কবীলা দু’টি ছিলো অত্যন্ত শক্তিশালী ও মশহুর কবীলা।

এরা ইয়াহূদীদের মুখে শুনে আসছিলেন যে, একজন মহান নবীর আবির্ভাব হতে যাচ্ছে। তিনি সকলের উপর বিজয়ী হবেন। কথাগুলো যেহেতু আগে থেকেই তারা শুনে আসছিলেন তাই তাকে নবীরূপে বরণ করতে তারা আর দেরী করলেন না। সকলের আগে ভাগেই তারা ইসলাম গ্রহণ করলেন। এ ছ’জনের নাম হলো :

১. আবূ উমামা আসআদ ইব্‌ন যুরারা-(ইনি ছিলেন বনী নাজ্জারের লোক এবং ইনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আত্মীয়ও ছিলেন। এদের মধ্যে ইনিই সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন।)

২. আওফ ইব্‌ন হারিছ

৩. রাফি ইব্‌ন মালিক

৪. কুতবা ইব্‌ন আমির

৫. জাবির ইব্‌ন আবদুল্লাহ্

৬. উকবা ইব্‌ন ‘আমির ইব্‌ন নাবী

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) উক্ত দু’জনের মধ্যে রাফি ইব্‌ন মালিককে ঐ পর্যন্ত নাযিলকৃত আয়াতসমূহের একটি লিখিত কপি প্রদান করলেন। ঐ ছোট্ট কাফেলাটি মুসলমান হয়ে ওখান থেকেই মদীনায় ফিরে গেলো। যাবার সময় তারা ওয়াদা করে যায় যে, নিজেদের গোত্রে গিয়ে তারা ইসলাম প্রচার করবেন। সত্যি সত্যি মদীনায় ফিরেই তারা ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু করে দিলেন। মদীনার অলি-গলি ইসলামের আলোচনায় মুখর হয়ে উঠলো।

১১৮
আকাবার প্রথম বায়‘আত
মক্কার নবুওয়াতের একাদশ বর্ষ অতিবাহিত হলো। দ্বাদশতম বর্ষটিও দেখতে দেখতে এমনিভাবে কেটে গেলো। কুরায়শদের বিরোধিতা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে লাগলো। আশা-নিরাশার দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর বছরটি কেটে গেলো। কেননা, মদীনায় ঐ ছ’জন ভক্ত মুসলমানের কথা বার বার তাঁর মানসপটে উঁকি দিচ্ছিল যারা তাঁর কাছে স্বদেশে ইসলামের তাবলীগের প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছিলেন। সুদূর মদীনায় দীর্ঘ এক বছর কালের মধ্যে সে প্রচার কাজের কি প্রতিক্রিয়া হলো তা তিনি জানতেই পারলেন না। অবশেষে দ্বাদশতম নববী বর্ষের শেষ মাসে অর্থাৎ যিলহাজ্জ মাসে তিনি মিনার নিকটবর্তী উক্ত আকাবা নামক স্থানে গিয়ে ইয়াছরিব কাফেলার খোঁজ করতে লাগলেন। ঘটনাক্রমে একদিন সত্যি সত্যি তিনি তার সেই ভক্তদের দেখা পেলেন যারা গত বছর তার হাতে বায়‘আত হয়ে গিয়েছিলেন। তারাও হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে দেখতে পেলেন এবং সাগ্রহে তাঁর দিকে অগ্রসর হলেন। এবার তারা সংখ্যায় ছিলেন বারজন। গতবছরের সেই ছয়জনের অতিরিক্তরা এবার নতুন এসেছেন। এরা আওস ও খাযরাজ উভয় গোত্রের লোক। ঐ বারজনের নাম হলো :

১. আবূ উমামা

২. আওস ইব্‌ন হারিছ ইব্‌ন রিফাআ

৩. রাফি ইব্‌ন মালিক ইবনুল আজলান

৪. কুতবা ইব্‌ন আমির ইব্‌ন হাদবা

৫. উকবা ইব্‌ন আমির

৬. মুআয ইবনুল হারিছ

৭. যাক্‌ওয়ান ইব্‌ন কায়স ইব্‌ন খালিদ

৮. খালিদ ইব্‌ন মুখাল্লাদ ইব্‌ন আমির ইব্‌ন যুরায়ক

৯. ইবাদা ইব্‌ন সামিত ইব্‌ন কায়স

১০. আব্বাস ইব্‌ন উবাদা ইব্‌ন ফাযালা (উক্ত দশজন ছিলেন খাযরাজ গোত্রের)

১১. আবুল হায়ছাম ইবনুত তায়্যিহান (ইনি ছিলেন বনূ আবদে আশহাল গোত্রের)

১২. উয়িম ইব্‌ন সায়িদা (শেষোক্ত দু’জন আওস গোত্রভুক্ত ছিলেন)

উক্ত বারোজন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর হাতে বায়‘আত হন। এটা যেন ছিলো আকাবার প্রথম বায়‘আতের ছয়জনের দাওয়াতের ফসল। স্বদেশে প্রত্যাবর্তনকালে এরা তাদের সাথে একজন কারী বা মুবাল্লিগ দেওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে আবেদন জানালেন। তিনি হযরত মুসআব ইব্‌ন উমায়র (রা)-কে তাঁদের সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি মদীনায় গিয়ে আস‘আদ ইব্‌ন যুরারার ঘরে অবস্থান করেন এবং ঐ বাড়ীটিতেই ইসলাম প্রচারের কেন্দ্ররূপে গড়ে তোলেন।

আকাবার প্রথম বায়‘আতের সময় মুহাম্মদ (সাঃ) যে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন, তা নিম্নরূপ :

১. আমরা এক অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদত করবো এবং কাউকে তার সাথে শরীক করবো না।

২. আমরা চুরি-ব্যভিচারের কাছেও যাবো না।

৩. নিজেদের কন্যা সন্তানদের হত্যা করবো না।

৪. কারো উপর মিথ্যা অপবাদ দেবো না।

৫. চোগলখুরি করবো না।

৬. সৎ কাজে নবী করীম (সাঃ)-এর আনুগত্য করবো।

১১৯
মদীনায় মুসআব ইব্‌ন উমায়রের সাফল্য
মুসআব ইব্‌ন উমায়র (রা) মদীনায় পৌঁছে অত্যন্ত উদ্যম ও নিষ্ঠার সঙ্গে ইসলামের প্রচারকার্যে মনোনিবেশ করলেন। আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহ ও দয়ায় মদীনাবাসীদের সৌভাগ্য সূর্য উদিত হলো। তাই তারা দলে দলে গোত্রে গোত্রে ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করেন। মদীনায় আওস গোত্রের শাখা গোত্রসমূহের মধ্যে বনূ যুফার অত্যন্ত মশহুর ও শক্তিশালী গোত্র ছিল। সা‘দ ইব্‌ন মুআয বনূ আবদে আশহাল কবীলার সরদার হওয়ার সাথে সাথে সকল গোত্রের মধ্যে প্রধান সর্দার বলে গণ্য হতেন। বুআছ যুদ্ধে নিহত হওয়ার পর আওস গোত্রসমূহের মধ্যে যিনি সর্বাধিক গণ্যমান্য বলে বিবেচিত হতেন তিনি হলেন আসআদ ইব্‌ন যুরারা—যার বাড়ীতে মুসআব ইব্‌ন উমায়র (রা) অবস্থান করছিলেন। তিনি ছিলেন সাআদ ইব্‌ন মুআযের খালাতো ভাই।

একদিন মুসআব ইব্‌ন উমায়র (রা) ও আসআদ ইব্‌ন যুরারা (রা) বনী আবদে আশহালের মহল্লায় কূপের পাশে বসে আলাপ-আলোচনা করছিলেন। সাআদ ইব্‌ন মুআয তার মহল্লায় তাদের আগমন ও ইসলাম প্রচার পছন্দ করতেন না। সা‘দ উসায়দ ইব্‌ন হুযায়রকে ডেকে বললো, আমার খালাতো ভাই বলে আমি একটু সতর্কতা অবলম্বন করছি, তুমি গিয়ে কঠোর ভাবে বলে দাও ওরা যেন আর কখনো আমাদের মহল্লায় না আসে। ওরা আমাদের লোককে পথভ্রষ্ট করে বিধর্মী বানাতে আসে। তার কথামত উসায়দ তৎক্ষণাৎ তলোয়ার হাতে আসআদ ও মুসআবের কাছে গিয়ে উপনীত হলেন এবং তাহাদের বেশ কষে গালমন্দ দিলেন। তিনি তাদেরকে অত্যন্ত কঠোরভাবে ধমকালেন। তারা বললেন : আপনি যদি দয়া করে একটু বসে আমাদের দু’টি কথা শোনেন, তাতে আপনার তো কোন ক্ষতি হবে না।

তারপর আপনি যা ইচ্ছে আদেশ দেবেন, আমাদের বলার কিছু থাকবে না। উসায়দ বললেন, বেশ তো, তারপর তিনি তাদের কাছে বসে পড়লেন। মুসআব তাকে ইসলামের তাৎপর্য বুঝিয়ে বললেন, এবং কুরআন মজীদ পড়ে শোনালেন। উসায়দ চুপচাপ তা শুনে যাচ্ছিলেন। মুসআবের কথা শেষ হতেই উসায়দ বলে উঠলেন : আমি ইসলাম গ্রহণ করছি। একথা বলেই তিনি তৎক্ষণাৎ ইসলাম গ্রহণ করলেন। উসায়দ (রা) বললেন : আরও এক ব্যক্তি আছে তাকে যদি আপনারা মুসলমান বানাতে পারেন তাহলে আপনাদের বিরোধিতা করার মতো কেউ থাকবে না। আমি এক্ষুণি গিয়ে তাকে আপনাদের কাছে পাঠাচ্ছি। উসায়দ সেখান থেকে উঠে সাআদ ইব্‌ন মুআযেব কাছে গেলেন। সা‘দও এতক্ষণ তারই প্রতীক্ষায় ছিলেন। বললেন : বলো হে! তুমি তাদেরকে কী বলে আসলে? উসায়দ (রা) বললেন : তারা অঙ্গীকার করেছেন যে, তোমাদের মতের বিরুদ্ধে তারা কিছুই করবেন না। কিন্তু সেখানে আরেকটি কাণ্ড ঘটে গেছে। বনু হারিছের কতিপয় যুবক কোথা থেকে সেখানে এসে পৌঁছেছে। তারা আসআদ ইব্‌ন যুরারাকে হত্যা করতে চাচ্ছিলো। এ কথাটি শোনামাত্র সা‘দ ইব্‌ন মুআয উঠে দাঁড়ালেন এবং তলোয়ার হাতে ওখানে গিয়ে উপনীত হলেন। তিনি গিয়ে দেখলেন আসআদ ও মুসআব অত্যন্ত শান্ত শিষ্টভাবে নির্বিকারে সেখানে বসে আছেন। তা দেখে তার সন্দেহ হলো উসায়দ বুঝি আমাকে মিথ্যা কথা বলে ধোঁকা দিয়ে এদের কাছে পাঠিয়েছেন যাতে আমিও তাদের কথা শুনি। সাথে সাথে তিনি দু’জনকে গাল দিতে দিতে আসআদকে লক্ষ্য করে বললেন : আমি কেবল আত্মীয়তার খাতিরে চুপ করে আছি, নতুবা তোমার কি সাধ্য ছিল যে, আমার মহল্লায় এসে লোকদেরকে পথভ্রষ্ট করবে। মুসআব বললেন : আপনি একটু শান্ত হয়ে বসুন। আমাদের দু’টি কথা শুনুন। যদি শোনার মত হয় শুনবেন, নতুবা শুনবেন না, প্রত্যাখ্যান করবেন। এ ব্যাপারে কেউ কি আপনাকে জোর করতে পারবে?

সা‘দ তলোয়ারখানা রেখে দিয়ে বসে পড়লেন। মুসআব সা‘দকেও ঠিক তা-ই শোনালেন যা একটু আগে উসায়দকে শুনিয়েছিলেন। আল্লাহ্‌র কী মর্যি, সাদও তৎক্ষণাৎ ইসলাম গ্রহণ করলেন। কবীলায় ফিরে এসে তিনি সকলকে একত্রিত করে বললেন, তোমাদের আমার সম্পর্কে কী ধারণা? তারা সমস্বরে বললো, আপনি আমাদের সর্বজনমান্য সর্দার। আপনার নির্দেশ আমরা সর্বদা মেনে আসছি। এবার সা‘দ বললেন : যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা মুসলমান না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের সাথে আমার কোনই সম্পর্ক নেই। একথা শোনা মাত্র আবদে আশহাল গোত্রের সবাই একযোগে ইসলাম গ্রহণ করলো। অনুরূপভাবে মদীনায় অন্যান্য গোত্রেও ইসলামের প্রচার-প্রসার ঘটতে লাগলো। এটা ছিল নবুওয়াতের ত্রয়োদশ বছর। এদিকে মুসআব ইব্‌ন উমায়র একের পর এক সাফল্য অর্জন করে চলেছিলেন; ওদিকে মক্কায় মুসলমানদের প্রতি কুরায়শদের অত্যাচার সকল সীমা ছাড়িয়ে অসহনীয় হয়ে উঠছিলো। ১৩তম নববী সালের যিলহাজ্জ মাসে হযরত মুসআব ইব্‌ন উমায়র (রা) মদীনার ৭২ জন মুসলিম নর-নারীর একটি কাফেলা নিয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। মদীনার নবদীক্ষিত মুসলিমগণ এই কাফেলাকে এজন্য প্রেরণ করে যে, তারা প্রিয়নবী (সাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁকে মদীনায় তশরীফ আনার জন্য মদীনাবাসীদের পক্ষ থেকে দরখাস্ত করবে।

১২০
আকাবার দ্বিতীয় বায়‘আত
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এ কাফেলার আগমন সংবাদ আগেই পেয়ে গিয়েছিলেন। রাতের বেলায় তিনি ঘর থেকে বেরিয়েছেন এমন সময় চাচা আব্বাসের সাথে দেখা। আব্বাস (রা) তখনো মুসলমান না হলেও হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে তিনি অত্যন্ত ভালবাসতেন এবং তিনি তার প্রতি হামেশা সমমর্মী ছিলেন। কুরায়শদের ব্যাপক বিরোধিতার মধ্যেও পর্দার অন্তরালে তিনি যে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর প্রতি সহানুভূতিশীল, তা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) জানতেন। হুযুর (সাঃ) তাঁকে সঙ্গে নিয়ে নিলেন। তিনি তাকে তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে জ্ঞাত করলেন। দু’জন রাতের আঁধারে আকাবা উপত্যকায় গিয়ে উপস্থিত হলেন।। মদীনা থেকে আগত কাফেলাটি সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এখানে শুধু মদীনা থেকে কেবল মুসলমানরাই হজ্জ করতে আসেননি, প্রাচীন প্রথা অনুসারে সেখানকার মুশরিকরাও হজ্জ করতে এসেছে। তারাও এসে মক্কার বাইরে তাঁবু গেড়েছিলো। কিন্তু আকাবার ঘাঁটিটি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সাথে সাক্ষাতের জন্যে নির্ধারিত ছিলো। সেখানে কেবল মদীনা থেকে আগত মুসলমান এবং তাঁদের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং ইসলামকে পছন্দ করতো এমন কিছু অমুসলিম ছিলেন। তাঁরা সকলেই হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জন্য উন্মুখ হয়ে প্রতীক্ষা করছিলেন। মদীনার অন্যান্য মুশরিক আকাবার এ সাক্ষাৎ সম্পর্কে ঘুণাক্ষরেও কিছু জানতো না। তারা তাদের মূল অবস্থান স্থলে ঘুমোচ্ছিল। তিনি আকাবায় পৌঁছে প্রতীক্ষারত মুসলমানদের সাথে সাক্ষাৎ করলেন। তাঁদের সাথে আলাপকালে তার মদীনায় চলে যাওয়ার আগ্রহের কথা শুনতে পেয়ে হযরত আব্বাস (রা) সময়োপযোগী ও জরুরী একটি ভাষণ দিলেন। তাতে তিনি বললেন :

হে মদীনাবাসীরা! মুহাম্মদ (সাঃ) এখানে তাঁর স্বগোত্রের সাথে আছেন। গোত্রের লোকজন তাঁর দেখাশোনা ও হিফাযত করে থাকে। তোমরা তাকে নিয়ে যেতে চাও ভাল কথা কিন্তু মনে রেখো, তোমাদেরকে তার দেখাশোনা ও হিফাযত করতে হবে। এ কিন্তু সহজসাধ্য কথা নয়, বলে রাখছি। তোমরা যদি বিরাট যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে পার, তাহলেই কেবল তা সম্ভবপর। তোমরা যদি এরূপ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাক, তাহলে কেবল তাকে তোমাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে পার, নতুবা তাকে সঙ্গে নেওয়ার কথাটিও উচ্চারণ করো না।

হযরত বারা ইব্‌ন মা‘রূর (রা) দাঁড়িয়ে বললেন : আব্বাস! আমরা আপনার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেছি। এখন আমরা চাই যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-ও এ ব্যাপারে কিছু বলুন! তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-ও ভাষণ দিলেন। তিনি কুরআন মজীদের আয়াত পড়ে শোনালেন।

তাঁর ভাষণে হক্‌কুল্লাহ এবং হক্‌কুল ইবাদের বর্ণনা করলেন এবং তাঁকে সঙ্গে নিয়ে গেলে মদীনাবাসীদের উপর কি কি দায়িত্ব বর্তাবে তাও বর্ণনা করলেন। বারা ইব্‌ন মা‘রূর (রা) সব শুনে বললেন : আমরা এ সবের জন্যে প্রস্তুত। আবুল হায়ছামা ইব্‌ন তায়্যিহান (রা) বললেন : আপনি এটা অঙ্গীকার করুন যে, আপনি আমাদেরকে ত্যাগ করে স্বদেশে আবার চলে আসবেন না। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন : না, আমার বেঁচে থাকা এবং আমার মরে যাওয়া তোমাদের সাথে হবে। আবদুল্লাহ ইব্‌ন রাওয়াহা বললেন : এর বিনিময়ে আমরা কী পাবো ইয়া রাসূলাল্লাহ!

জবাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন : জান্নাত এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি। আবদুল্লাহ বলে উঠলেন; ব্যস, সওদা হয়ে গেছে। এখন আপনিও কথা থেকে সরতে পারবেন না। আমরাও আমাদের কথা থেকে সরবো না। তারপর সকলে মিলে বায়‘আত হলেন। এ বায়‘আতে বারা ইব্‌ন মা‘রূর (রা) ছিলেন সকলের অগ্রগামী। এটাই আকাবার দ্বিতীয় বায়‘আত নামে বিখ্যাত। বায়‘আত সম্পন্ন হওয়ার পর আসআদ ইব্‌ন যুরারা সকলকে লক্ষ্য করে বললেন : লোক সকল! মনে রেখো, এ প্রতিজ্ঞার অর্থ হচ্ছে আমরা গোটা পৃথিবীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে প্রস্তুত! সকলে সমস্বরে বলে উঠলো : প্রস্তুত। আমরা খুব ভাল করেই জানি যে, আমাদেরকে গোটা পৃথিবীর বিরুদ্ধে লড়তে হবে। তারপর হুযুর (সাঃ) তাঁদের মধ্যকার বারো জনকে নির্বাচিত করলেন এবং তাদেরকে ইসলাম প্রচারের বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে নিজের নকীব নিযুক্ত করলেন। তাদের নাম হলো।

১. হযরত আসআদ ইব্‌ন যুরারা (রা)

২. হযরত উসায়দ ইব্‌ন হুযায়র (রা)

৩. হযরত আবূল হায়ছাম ইবনুত তায়্যিহান (রা)

৪. হযরত বারা ইব্‌ন মা‘রূর (রা)

৫. হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন রাওয়াহা (রা)

৬. হযরত উবাদা ইব্‌ন সামিত (রা)

৭. হযরত সা‘দ ইবনুর রবী‘ (রা)

৮. হযরত সা‘দ ইব্‌ন উবাদা (রা)

৯. হযরত রাফি‘ ইব্‌ন মালিক (রা)

১০. হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন ‘আমর (রা)

১১. হযরত সা‘দ ইব্‌ন হায়ছামা (রা)

১২. হযরত মুনযির ইব্‌ন আমর (রা)

এ বারোজন সরদারের মধ্যে নয়জন ছিলেন খাযরাজ গোত্রের, আর বাকী তিনজন ছিলেন আওস গোত্রের। এ বারোজনকে লক্ষ্য করে তিনি বললেন :

“যেভাবে হযরত ঈসা (আ)-এর হাওয়ারিগণ যিম্মাদার ছিলেন, ঠিক তেমনি আমিও তোমাদেরকে তোমাদের স্বজাতিকে শিক্ষা দানের যিম্মাদারী অর্পণ করছি। আর আমি নিজে তোমাদের সকলের যিম্মাদাররূপে রইলাম।”

যে সময় আকাবার ঘাঁটিতে এ বায়‘আত কার্য সম্পন্ন হচ্ছিলো তখন পর্বতশীর্ষ থেকে একটি শয়তান মক্কাবাসীদেরকে লক্ষ্য করে চীৎকার করে বললো : দেখ, দেখ, মুহাম্মদ ও তার দলবল তোমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) ও মুসলমানগণ সেদিকে ভ্রূক্ষেপ মাত্র করলেন না। যখন সবকিছু চূড়ান্তভাবে ঠিকঠাক হয়ে গেলো, তখন হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) মদীনায় হিজরতের দিনকাল নির্ধারণের ব্যাপারটি আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশের উপর ছেড়ে দিলেন। তারপর একজন করে তারা নীরবে সে স্থান ত্যাগ করতে লাগলেন—যাতে কেউ তাদের এ সমাবেশ ও পরামর্শের কথা টের না পায়। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এবং হযরত আব্বাস (রা)-ও মক্কায় ফিরে আসলেন। কিন্তু ভোর না হতেই দেখা গেলো যে, রাতের এ পরামর্শের কথা কুরায়শদের কাছে জানাজানি হয়ে গেছে। তারা তৎক্ষণাৎ মদীনাবাসীদের তাঁবুতে গিয়ে উপনীত হলো এবং জিজ্ঞেস করলো যে, রাতের বেলা মুহাম্মদ (সাঃ) কি তোমাদের কাছে এসেছিলেন? মুশরিকরা নিজেরাই রাতের এ সমাবেশের ব্যাপারটি অবগত ছিলো না। এদের মধ্যে আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন উবায়্য ইব্‌ন সুলূলও ছিলো—যে পরবর্তীকালে মুনাফিকদের সর্দার হয়েছিল। সে সবিনয়ে বললো : মদীনাবাসীরা এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে আর আমি তা ঘুণাক্ষরেও টের পাবো না এমনটি তো হতে পারে না। কুরায়শরা তাতে সন্দেহমুক্ত হলো এবং সেখান থেকে ফিরে এলো।

মদীনাবাসীরা তখনই রওয়ানা হয়ে গেলো। কুরায়শরা মক্কায় ফিরে এসে বিশ্বস্ত সূত্রে পুনরায় রাতের সলা-পরামর্শের কথা জানতে পারলো। তারা পুনরায় সশস্ত্র হয়ে আকাবায় এসে পৌঁছলো। কিন্তু তখন মদীনার কাফেলা সেখান থেকে চলে গিয়েছে। কেবল হযরত সা‘দ ইব্‌ন উবাদা (রা) এবং হযরত মুনযির ইব্‌ন আমর (রা) কোনো প্রয়োজনে সেখানে থেকে গিয়েছিলেন। হযরত মুনযির (রা) কুরায়শদেরকে দেখেই স্থান ত্যাগ করলেন। ফলে তারা তার নাগাল পেলো না। কিন্তু হযরত সা‘দ ইব্‌ন উবাদা (রা) তাদের হাতে বন্দী হয়ে গেলেন। কুরায়শরা তাকে প্রহার করতে করতে মক্কায় নিয়ে এলো। হযরত সা‘দ ইব্‌ন উবাদা (রা) এ সম্পর্কে বলেন যে, মক্কাবাসীরা যখন আমাকে প্রহার করছিলো তখন লাল ও সাদা পোশাকধারী এক ব্যক্তিকে আমি আমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখতে পেলাম। আমি মনে মনে ভাবলাম এ লোকটির কাছে হয়তো সদয় ব্যবহার পাবো।....... কিন্তু সে কাছে আসতেই আমাকে সজোরে একটা চপেটাঘাত করলো। তখনই আমার স্থির বিশ্বাস জন্মালো যে, এদের মধ্যে কোন ভাল লোক নেই—যার কাছে মানবতা বা বিবেকপূর্ণ ব্যবহার আশা করা যেতে পারে। এমন সময় আর এক ব্যক্তি এসে বললো, কি হে! কুরায়শদের মধ্যে তোমার কোন পরিচিত লোকজন নেই? আমি বললাম, হাঁ। যুবায়র ইব্‌ন মুত‘ঈম এবং হারিছ ইব্‌ন উমাইয়া—দু’জনেই আবদে মানাফের পৌত্র-আমার পরিচিত। তখন ঐ ব্যক্তি বললেন : তাহলে ঐ দু’জনের নাম ধরে তুমি সাহায্য প্রার্থনা করছ না কেন? আমাকে এ বুদ্ধি বাতলে দিয়ে তিনি ঐ দুই ব্যক্তির কাছে গিয়ে বললেন, খাযরাজ গোত্রের জনৈক ব্যক্তিকে বেদম প্রহার করা হচ্ছে আর লোকটি তোমাদের নাম নিয়ে নিয়ে সাহায্যের জন্যে ফরিয়াদ করছে। তারা জিজ্ঞেস করলেন লোকটির নাম কি? ঐ ব্যক্তি বললেন : ওর নাম সা‘দ ইব্‌ন উবাদা।... তখন তারা দু’জনে বললেন, হাঁ। ঐ ব্যক্তির যথেষ্ট ঋণ আমাদের উপর রয়েছে। আমরা ব্যবসা উপলক্ষে মদীনা গেলে ওর ওখানেই উঠি এবং সে আমাদের দেখাশোনা করে। তারপর ঐ দু’জন এসে আমাকে মারমুখী কুরায়শদের হাত থেকে উদ্ধার করে। আমি তক্ষণি ইয়াছরিবের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। এখানে উল্লেখ্য যে, আকাবার দ্বিতীয় বায়‘আতের বহু পূর্বেই আল্লাহ্ তা‘আলার তরফ থেকে প্রিয় নবী (সাঃ)-কে হিজরত করতে হতে পারে তা জানিয়ে দেয়া হয়েছিলো। এমন কি স্বপ্নে তিনি খেজুর গাছের সারি ঘেরা এক জায়গায় হিজরত করছেন দেখতে পান। পরে তিনি নিশ্চিত হন যে জনপদ হচ্ছে ইয়াছরিব (মদীনা)।

১২১
মদীনায় হিজরতের সাধারণ অনুমতি
আকাবার দ্বিতীয় বায়‘আতের পর মক্কার মুসলমানদের উপর কুরায়শদের অত্যাচারের মাত্রা এতোই বৃদ্ধি পেলো যে, মক্কায় তিষ্টানো তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠলো। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাদের সীমাহীন-অত্যাচার উৎপীড়ন লক্ষ্য করে মক্কার মুসলমানদেরকে তাদের মদীনায় হিজরতের অনুমতি দিয়ে দিলেন। এ অনুমতি পেয়েই মুসলমানরা নিজেদের বাড়িঘর ফেলে দিয়ে আত্মীয়-পরিজনের মায়া কাটিয়ে মদীনায় হিজরত করতে শুরু করলেন। কুরায়শরা যখন দেখলো যে, এরা বাড়িঘর ত্যাগে প্রস্তুত এবং মদীনায় গিয়ে শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ জীবন-যাপন করবে তখন এটাও তাদের সহ্য হলো না। তারা হিজরতকারীদের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে লাগলো।

হযরত উম্মে সালামা (রা) বলেন, আমার স্বামী আবূ সালামা (রা) হিজরত করতে মনস্থ করলেন। আমাকে তিনি উটের পিঠে চড়ালেন। যখন আমরা রওয়ানা হয়ে পড়লাম, তখন গোত্রের লোকেরা এসে আবূ সালামাকে ঘিরে ফেললো। তারা বললো, তুই যেতে চাস, যেতে পারিস, কিন্তু আমাদের গোত্রের এ মেয়েকে আমরা তোর সাথে নিয়ে যেতে দেবো না। এমন সময় আবূ সালামার গোত্রের লোকজনও এসে উপস্থিত হলো। তারা এসে বললো, তুই যেতে চাস্ যা, কিন্তু এ শিশু আমাদের গোত্রেরই একজন। তাকে নিয়ে যেতে আমরা তোকে দেবো না। ফলে বনূ আবদুল আসাদ শিশুকে ছিনিয়ে নিয়ে গেলো। বনূ মুগীরা উম্মে সালামাকে কেড়ে নিলো। অগত্যা আবূ সালামা একাকীই মদীনায় হিজরত করলেন। উম্মে সালামা তার স্বামী ও শিশু সন্তান উভয়কেই হারালেন। আবূ সালামা স্ত্রী ও পুত্র উভয়ের মায়া কাটিয়ে একাকী হিজরত করে সওয়াবের ভাগী হলেন।

হযরত সুহায়ব রূমী (রা) যখন মক্কা থেকে বেরোলেন, তখন তার যাবতীয় ধন-সম্পদ মক্কাবাসীরা লুটে নিলো। হাজার হাজার টাকার সম্পদ তাঁর নিকট থেকে ছিনিয়ে নিয়ে নিতান্তই রিক্তহস্তে তাঁকে তারা মদীনায় হিজরত করতে দিলো। হযরত হিশাম ইব্‌ন আস (রা) যখন হিজরত করতে মনস্থ করলেন তখন সংবাদ পেয়ে মক্কার কুরায়শরা এসে তাকে বন্দী করলো এবং তাকে নানারূপ নির্যাতন করতে লাগলো। হযরত আয়িশা (রা) হিজরত করে মদীনায় গিয়ে উপনীত হয়েছিলেন। আবূ জাহেল তার পিছু পিছু মদীনায় গিয়ে পৌঁছলো এবং সেখানে থেকে তাকে ধোঁকা দিয়ে মক্কায় ফিরিয়ে নিয়ে এসে বন্দী করলো।

এ জাতীয় বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও এক এক, দুই দুই জন করে বহু মুসলিম হিজরত করে মদীনায় গিয়ে উপনীত হন। সেখানে এই মুহাজিরগণ মদীনায় মুসলমানদের মেহমান হন। মক্কা থেকে আগত এ মুসলমানরা মুহাজির এবং মদীনায় তাদের মেজবান মুসলমানরা আনসার নামে খ্যাত হন। এরপর থেকে আমরা তাদেরকে এ নামেই উল্লেখ করবো।

নবুওয়াতের চতুর্দশ বছর তখন শুরু হয়ে গেছে। মক্কায় তখন কেবল হযরত মুহাম্মদ (সাঃ), হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা), এবং হযরত আলী (রা) এবং তাদের পরিবার-পরিজনদের হিজরত করা বাকী। আর রয়েছেন এমন কতিপয় দুর্বল মুসলমান যাদের হিজরত করার মতো সামর্থ্য ছিলো না। অন্যান্য মুসলমান সকলেই মক্কা থেকে হিজরত করে চলে গিয়েছেন। মক্কায় মুসলমানদের আবাস স্থলগুলো একদম জনশূন্য হয়ে পড়েছিলো। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তখনও হিজরত করার সিদ্ধান্ত নেননি। কেননা তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে ওয়াহীর নির্দেশের প্রতীক্ষা করছিলেন। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-কে তিনি পথসঙ্গীরূপে পাবার জন্যে রেখে দিয়েছিলেন। অনুরূপভাবে হযরত আলী (রা)-ও হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নির্দেশক্রমে তখনো মক্কাতেই আছেন।

১২২
দারুন নাদওয়ায় কুরায়শদের পরামর্শ সভা
কুরায়শরা যখন লক্ষ্য করলো যে, মুসলমানরা একে একে প্রায় সকলেই চলে গিয়েছে এবং এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক মদীনায় গিয়ে উপনীত হয়ে এখন এক শক্তির রূপ পরিগ্রহ করেছে যা মোটেই উপেক্ষণীয় নয়, তখন তাদের ভবিষ্যত সংকটের আশংকা মনে মনে দেখা দিলো। তারা স্পষ্টই দেখতে পেলো যে, তাদের সম্ভ্রম ও জীবনের নিরাপত্তা মুসলমানদের পূর্ণ মুলোৎপাটনের উপরই নির্ভরশীল। যেহেতু মক্কা থেকে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সমর্থকদের প্রায় সকলেই তখন চলে গেছেন, বলতে গেলে তিনি এখন একান্তই একাকী। তাই এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া তাদের জন্যে খুবই সহজ ছিল যে, সেখান থেকে ধর্মের প্রবর্তককে খতম করে দেয়াই একান্ত জরুরী হয়ে পড়েছে এবং এ ব্যাপারে উদাসীনতা প্রদর্শন করা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। কেননা মুহাম্মদ (সাঃ) যদি মক্কা থেকে বেরিয়ে যান এবং মদীনায় গিয়ে তার সমর্থকদের সাথে মিলিত হয়ে যান তাহলে এ নতুন ধর্মের সংকট মুকাবিলা করা সহজসাধ্য থাকবে না, দুঃসাধ্য হয়ে উঠবে। একথাটি কুরায়শের প্রত্যেকটি ব্যক্তির মুখে মুখে এবং এ চিন্তা তাদের প্রতিটি লোকের মগজে ঘুরপাক খাচ্ছিলো। দেখতে দেখতে মক্কার সমস্ত গোত্রের মধ্যে এ সর্বনাশা নিষ্ঠুর চিন্তাধারা ছড়িয়ে পড়লো। অবশেষে নবুওয়াতের চতুর্দশ বর্ষের সফর মাসে বনূ হাশিম ছাড়া কুরায়শের অন্যান্য গোত্রের সকল উল্লেখযোগ্য সরদাররা এ ব্যাপারে সলা-পরামর্শ করার জন্যে দারুন নাদওয়ায় একত্রিত হলো। এ পরামর্শ সভায় কুরায়শদের মশহুর ও উল্লেখযোগ্য যেসব সরদার সমবেত হয়েছিলো তারা হলো :

১. আবূ জাহেল ইব্‌ন হিশাম (বনী মাখযুম-এর পক্ষ থেকে)

২. নাবিলা (তারা দু’জনেই হাজ্জাজের পুত্র, এরা বনূ সাহমের লোক)

৩. মুনাব্বাহ (বনূ জুমাহ-এর প্রতিনিধি)

৪. উমাইয়া ইব্‌ন খাল্‌ফ

৫. আবুল বুখতরী ইব্‌ন হিশাম

৬. যুমআ ইব্‌ন আসওয়াদ (বনূ সাহমের প্রতিনিধি)

৭. হাকীম ইব্‌ন হিযাম

৮. উমাইয়া নযর ইব্‌ন হারিছ (বনূ আবদে দার-এর প্রতিনিধি)

৯. উত্‌বা (এরা দু’জনই রবীআর পুত্র)

১০. শায়বা

১১. আবূ সুফিয়ান ইব্‌ন হার্‌ব (এরা বনূ উমাইয়া গোত্রের লোক)

১২. তায়মা ইব্‌ন আদী

১৩. জুবায়র ইব্‌ন মুতঈম

১৪. হারিছ ইব্‌ন আমির (এরা বনী নাওফিল-এর লোক)

উল্লেখযোগ্য, উক্ত লোকদের ছাড়াও আরো অনেক সরদার এ পরামর্শ সভায় উপস্থিত ছিলো। জনৈক অভিজ্ঞ বৃদ্ধ নজ্‌দবাসী শয়তানও এ মজলিসে উপস্থিত ছিলো। ঐ বৃদ্ধটিই ছিলো ঐ মজলিসের সভাপতি। এ ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হলো যে, ভাবী সঙ্কটের কেন্দ্রবিন্দু ও উৎস হচ্ছেন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। এখন বিবেচ্য বিষয় ছিলো তার সাথে কী আচরণ করা হবে? একজন বললো, মুহাম্মদকে জিঞ্জিরাবদ্ধ করে একটি কুঠরিতে বন্দী করে রেখে দিলেই হয়। দৈহিক কষ্ট এবং ক্ষুৎপিপাসায় কাতর হয়ে সেখানে তার মৃত্যু ঘটবে। নজদের সেই বৃদ্ধটি বললো : এ অভিমতটি ঠিক নয়। কেননা, তার আত্মীয়-পরিজন এবং অনুসারীরা তাকে মুক্ত করতে সচেষ্ট হবে এবং তাতে ফ্যাসাদ বাড়বে বৈ কমবে না। অপর একজন বললো, মুহাম্মদকে মক্কা থেকে বের করে দিয়ে পুনরায় ঢুকতে না দিলেই হয়। নজদী বৃদ্ধ এ অভিমতকেও যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে নাকচ করে দিল। মোটকথা, নানা জনে নানা প্রস্তাবই উত্থাপন করলো আর নজদী বৃদ্ধ প্রত্যেকটি প্রস্তাবই নাকচ করে দিল। অবশেষে আবূ জাহেল তার প্রস্তাব উত্থাপন করলো। সে বললো, আমার মতে আমাদের প্রত্যেক গোত্র থেকে এক একজন অসি চালক বেছে নেয়া দরকার। এরা একযোগে চতুর্দিক থেকে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উপর চড়াও হয়ে তাকে হত্যা করবে। ফলে মুহাম্মদের রক্তপণ আদায়ের দায়িত্ব যৌথভাবে সকল গোত্রের উপর বর্তাবে। বনু হাশিম একা এতগুলো গোত্রের মুকাবিলাও করতে পারবে না। ফলে তারা রক্তের বদলা নেওয়ার পরিবর্তে রক্তপণ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে বাধ্য হবে। আর এ রক্তপণ আদায় করায় তেমন কোন বেগ পেতে হবে না। সবাই মিলে সব গোত্র থেকে চাঁদা উঠিয়ে সহজেই তা পরিশোধ করা যাবে। আবূ জাহেলের এ প্রস্তাবই নজদী বুড়োর খুবই মনঃপূত হলো এবং সভার সকলেই তা একবাক্যে মেনে নিলো। এদিকে দারুন নাদওয়ায় এ সলা-পরামর্শ চলছিল। ওদিকে আল্লাহ্ তা‘আলা ওয়াহীর মাধ্যমে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে কাফিরদের সব সলা-পরামর্শের কথা জানিয়ে দিলেন এবং হিজরতের হুকুম নাযিল করলেন।

১২৩
সফরের আয়োজন
আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে হিজরতের নির্দেশ পাওয়া মাত্র হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ভরা-দুপুরে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লেন। গ্রীষ্মের মওসুমে দুপুর বেলা লোক রৌদ্রের উত্তাপ ও লু-হাওয়া থেকে আত্মরক্ষার জন্যে ঘরের কোণে আশ্রয় নেয়। রাস্তা-ঘাট থাকে জনশূন্য ও নিরিবিলি। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) হযরত আবূ বকর (রা)-এর ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলেন। এই অসময়ে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে আসতে দেখেই হযরত আবূ বকর (রা)-এর বুঝতে বাকী রইলো না যে, হিজরতের আদেশ নাযিল হয়ে গেছে। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন : ঘরে বাইরের কেউ নেই তো? যখন জানতে পারলেন যে, আবূ বকর (রা) এবং তাঁর কন্যাদ্বয় আসমা ও আয়িশা ছাড়া অপর কেউই এখন ঘরে নেই তখন তাঁকে তিনি বললেন যে, ইয়াছরিবে (মদীনায়) হিজরতের হুকুম এসে গেছে।

হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) তখন জিজ্ঞেস করলেন : সফরসঙ্গী কে হবে? হযরত নবী করীম (সাঃ) বললেন : তুমিই হবে আমার সফরসঙ্গী। শুনে আবূ বকর (রা) এতই আনন্দিত হলেন যে, খুশিতে তার চোখ দু’টি থেকে টপটপ করে আনন্দাশ্রু ঝরতে লাগলো। তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি পূর্ব থেকেই দু’টি উটনী খরিদ করে খুব ভাল করে খানা-দানা দিয়ে মোটা তাজা করে রেখেছি। তার একটি আমি আপনার হাতে তুলে দিচ্ছি। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বললেন, আমি তার মূল্য শোধ করবো। অগত্যা হযরত আবূ বকর (রা) মূল্য নিতে বাধ্য হলেন। ঠিক তক্ষুণি হিজরত করার আয়োজন শুরু হয়ে গেলো। হযরত আসমা বিন্‌ত আবূ বকর (রা) ছাতুর থলে এবং খাবার-দাবার ঠিক করতে লেগে গেলেন। হযরত আয়িশা (রা)-র বয়স তখন খুবই কম। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) হযরত আবূ বকর (রা)-কে সংবাদ দিয়েই নিজ ঘরে ফিরে আসলেন। সামনের রাতটিই ছিলো মুশরিকদের আগের রাতের প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য নির্ধারিত রাত। আজই তারা তাকে হত্যা করবে। সন্ধ্যার সময়ই তারা তাঁর বাড়ি অবরোধ করলো। তারা অপেক্ষায় রইলো যে, যখন তিনি রাতের বেলা নামাযের উদ্দেশ্যে বের হবেন তখন একযোগে হামলা করে তাকে হত্যা করবে। তিনি ওয়াহীর নির্দেশ অনুসারে হযরত আলী (রা)-কে তার বিছানায় শুইয়ে দিয়ে চাদর দিয়ে তাঁকে ঢেকে দিলেন। মক্কাবাসীদের যেসব গচ্ছিত দ্রব্য তার কাছে রাখা ছিলো তাও তিনি হযরত আলী (রা)-কে বুঝিয়ে দিলেন এবং বললেন যে, সকালে উঠেই এ গচ্ছিত দ্রব্যগুলো মালিকদের বুঝিয়ে দিও। তারপর তুমিও মদীনায় চলে এসো। এসব সম্পন্ন করে রাতের আঁধারে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। সর্বপ্রথম তিনি সূরা ইয়াসীনের শুরুর দিকের আয়াতসমূহ فَهُمْ لَا يُبْصِرُونَ পর্যন্ত পড়ে এক মুষ্টি মাটিতে ফুঁক দিয়ে কাফিরদের দিকে নিক্ষেপ করলেন। তারপর তাদের সম্মুখ দিয়েই অকপটে বেরিয়ে গেলেন, কিন্তু কাফিরদের কেউই তাকে দেখতে পেলো না।

وَإِذْ يَمْكُرُ بِكَ الَّذِينَ كَفَرُوا لِيُثْبِتُوكَ أَوْ يَقْتُلُوكَ أَوْ يُخْرِجُوكَ ۚ وَيَمْكُرُونَ وَيَمْكُرُ اللَّهُ ۖ وَاللَّهُ خَيْرُ الْمَاكِرِينَ .

স্মরণ কর, কাফিরগণ তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তোমাকে বন্দী করিবার জন্য, হত্যা করিবার অথবা নির্বাসিত করিবার জন্য এবং তাহারা ষড়যন্ত্র করে এবং আল্লাহ্ও কৌশল করেন; আর আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশলী। (৮: ৩০)

হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) বাহন উটনী দুটো আবদুল্লাহ ইব্‌ন উরায়কিতের হাতে ন্যস্ত করেন। উক্ত আবদুল্লাহ্ যদিও মুসলমান ছিলো না কিন্তু নির্ভরযোগ্য ছিলো বিধায় মদীনা পর্যন্ত পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সঙ্গত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তখন আবূ বকর (রা) তাকে পথ প্রদর্শক নিয়োগ করেছিলেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নিজ বাড়ি থেকে বেরিয়ে হযরত আবূ বকর (রা)-এর বাড়িতে গেলেন। তিনি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর প্রতীক্ষায়ই ছিলেন। কাল-বিলম্ব না করে উভয়ে তক্ষুনি বেরিয়ে পড়লেন এবং মক্কার নিম্নাঞ্চল দিয়ে চার মাইল দূরে অবস্থিত ছওর পর্বতের গুহায়-যা ছওর গুহা নামে বিখ্যাত-গিয়ে উপনীত হলেন। তারা সেখানে আত্মগোপন করে রইলেন।

এ দিকে মক্কায় হযরত আলী (রা) সারারাত ধরে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর বিছানায় নিদ্রা গেলেন। মক্কার কাফিররাও সারা রাত ধরে বাড়ি অবরোধ করে দাঁড়িয়ে রইলো। তারা হযরত আলী (রা)-কে শায়িত দেখে নিশ্চিত রইলো যে, হযরত মুহাম্মদ তো বিছানায়ই শুয়ে আছেন। তারা তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য অধীরভাবে অপেক্ষা করছিলো। ফজরের সময় যখন হযরত আলী (রা) নামায পড়ার জন্যে ঘুম থেকে জেগে উঠলো তখন তারা জিজ্ঞেস করলো : মুহাম্মদ কোথায়? হযরত আলী (রা) বললেন : আমি তার কি জানি?

জানার কথা তো তোমাদের! কেননা তোমরা পাহারায় ছিলে। আমি তো সারা রাত শুয়ে কাটিয়েছি। কাফিররা হযরত আলী (রা)-কে পাকড়াও করলো। তারা তাকে প্রহার করলো এবং কিছুক্ষণ পর্যন্ত তাঁকে বন্দী করে রাখলো। তার পর ছেড়ে দিলো। হযরত আলী (রা) ধীরে সুস্থে সমস্ত গচ্ছিত দ্রব্য মালিকদের হাতে প্রত্যর্পণ করলেন।

এখানে লক্ষণীয়, কাফিররা হযরত নবী (সাঃ)-এর প্রাণের বৈরী ছিল, কিন্তু তাঁর বিশ্বস্ততার প্রতি এতই আস্থাশীল যে, তাদের মূল্যবান সোনা-দানা অলংকারাদি তাঁরই কাছে গচ্ছিত রাখতো। তিনিও মক্কা ত্যাগের সময়ও তার এ বিশ্বস্ততা রক্ষার জন্যে সেই প্রিয় চাচাতো ভাই, যাকে তিনি আপন পুত্রসম প্রতিপালন করছিলেন, শুধু এজন্যে একাকী মক্কায় রেখে যাচ্ছেন যেন তিনি সেই গচ্ছিত দ্রব্যাদি যথারীতি মালিকের হাতে প্রত্যর্পণ করে আসেন।

কাফিররা তখন আলী (রা)-কে ছেড়ে সোজা হযরত আবূ বকর (রা)-এর বাড়ীতে গিয়ে উপস্থিত হলো। দরজায় করাঘাত করতেই হযরত আসমা (রা) বেরিয়ে এলেন। আবূ জাহেল জিজ্ঞেস করলো, হে বালিকা! তোর পিতা কোথায়? তিনি বললেন : আমি তা জানিনে। বলতেই দুরাচার এমনি জোরে তাঁকে চপেটাঘাত করলো যে তার কানের বালি (দুল) নীচে পড়ে গেল। তারপর তারা মক্কার আনাচে-কানাচে তন্ন-তন্ন করে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সন্ধান করতে লাগলো, কিন্তু কোথাও তার খোঁজ পেলো না। অবশেষে তারা ঘোষণা করলো : যে কেউ মুহাম্মদ (সাঃ)-কে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ধরে দেবে তাকে একশ’ উট পুরস্কার স্বরূপ দান করা হবে। এ পুরস্কারের ঘোষণা শুনে অনেকেই মক্কার চতুর্দিক দূর-দূরান্ত পর্যন্ত তার খোঁজে বেরিয়ে পড়লো।

১২৪
ছওর গিরি গুহায় আফতাব (সূর্য) ও মাহতাব (চাঁদ)
রাতের অন্ধকারে প্রেমিক ও প্রেমাস্পদ যখন ছওর গুহার নিকটে গিয়ে পৌঁছলেন, তখন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে প্রথমে আবূ বকর (রা) গুহার অভ্যন্তরে ঢুকলেন। তিনি তার অভ্যন্তর ভাগ পরিষ্কার করলেন এবং গুহার ছিদ্রসমূহ খুঁজে বের করে পরনের কাপড় ছিঁড়ে ছিঁড়ে সেগুলো বন্ধ করতে লাগলেন। এভাবে সমস্ত ছিদ্র বন্ধ করার পর তিনি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে গুহার ভিতরে নিয়ে গেলেন। এ চন্দ্র ও সূর্য পূর্ণ তিন দিন তিন রাত এ গুহায় আত্মগোপন করে থাকেন। কুরায়শদের বড় বড় সর্দাররা পুরস্কারের ঘোষণা দিয়ে নিজেরাও সন্ধানী লোকদের সাহায্যে পায়ের চিহ্ন ধরে এগুতে এগুতে ছওর গুহার মুখ পর্যন্ত গিয়ে উপস্থিত হলো। সন্ধানীরা জানালো, এরপর তো আর পায়ের কোনো চিহ্নই পাওয়া যাচ্ছে না, হয় মুহাম্মদ এখানেই কোথাও লুকিয়ে আছেন, নতুবা এখান থেকে সোজা আসমানে উঠে গেছেন। একজন বললো, তাহলে এ গুহার অভ্যন্তরে গিয়েই দেখা যাক না। দ্বিতীয়জন বললো, এত অন্ধকার বিভীষিকাময় গুহায়ও মানুষ ঢুকতে পারে নাকি? আমরা তো বহুকাল ধরে এগুলোকে এভাবেই দেখে আসছি। তৃতীয়জন বললো, দেখ, দেখ, এ গুহার মুখে মাকড়সা জাল বুনে রেখেছেন। কেউ যদি একান্তই এখানে ঢুকতোই তবে এ জাল অবশ্যই ছিন্ন হয়ে যেতো। চতুর্থজন বললো, ঐ দেখ, ওখান থেকে কবুতর উড়ে যাচ্ছে। তার ডিমও দেখা যাচ্ছে—যাতে বসে তা দিচ্ছিল। সকলেই তখন এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গেল যে, গুহায় আর কোন লোক নেই। নিশ্চিন্ত হয়ে সবাই অন্য দিকে পথ ধরলো। কাফিররা গুহার এতই নিকটে পৌঁছে গিয়েছিল যে, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ও আবূ বকর (রা) তাদের পা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন। তাদের কথাবার্তার আওয়াজও স্পষ্টই শোনা যাচ্ছিলো। এমন বিপজ্জনক অবস্থায় হযরত আবূ বকর (রা) বলে উঠলেন : হুযুর! কাফিররা তো এসেই গেল! এখন উপায়? হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বললেন :

لاتحزن ان الله معنا

ভীত-বিহবল হয়ো না, আল্লাহ্ নিশ্চয়ই আমাদের সাথে রয়েছেন।

তারপর তিনি বললেন :

وما ظنك باثنين الله ثالثهما

সে দুই ব্যক্তি সম্পর্কে তোমার কী ধারণা যাদের তৃতীয় জন হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলা?

কাফিররা তাদের খোঁজাখুজিতে ব্যর্থমনোরথ হয়ে ফিরে গেল। একে একে তিন দিন অতিবাহিত হওয়ার পর কাফিররা একেবারে ক্লান্ত-শ্রান্ত ও নিরাশ হয়ে পড়লো। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) তদীয় পুত্র আবদুল্লাহ ইতিপূর্বেই বলে রেখেছিলেন যে, কাফিরদের অবস্থা ও তাদের সারাদিনের কর্মতৎপরতা সম্পর্কে তিনি যেন রাত্রে এসে অবহিত করে যান। অনুরূপভাবে তদীয় গোলাম আমির ইব্‌ন ফুহায়রাকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন যে, ছাগলপালকে সারা দিন এদিক-সেদিক চরিয়ে রাতের বেলা তিনি যেন মেষটাকে চরাতে চরাতে ছওর গুহার কাছে নিয়ে আসেন। আসমা বিন্‌ত আবূ বকর (রা)-এর উপর এ দায়িত্ব অর্পণ করে রেখেছিলেন যে, আহার্য দ্রব্যাদি সযত্নে প্রস্তুত করে রাতের বেলা যেন তা গুহাবাসীদের কাছে পৌঁছিয়ে দেন। আবদুল্লাহ ও আসমা ভাইবোন দু’জন নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে যখন ঘরে ফিরতেন তখন আমির ইব্‌ন ফুহায়রা ছাগল দোহন করে এবং গুহাবাসীদেরকে তা পান করিয়ে ছাগলপাল নিয়ে অধিক রাতে মক্কায় প্রবেশ করতেন। এভাবে আবদুল্লাহ ও আসমার পদচিহ্ন ছাগলপালের চলাচলের দ্বারা মুছে যেতো। যখন মক্কাবাসীদের উৎসাহ-উদ্দীপনায় ভাটা পড়ার সংবাদ জানা গেলো তখন আবদুল্লাহ ইব্‌ন উরায়কিতের কাছে সংবাদ পাঠানো হলো যেন প্রতিশ্রুতি অনুসারে উটনী দু’টি নিয়ে ছওর পাহাড়ের পাদদেশে এসে উপস্থিত হন। এখানে আবদুল্লাহ, আসমা ও আমির ইব্‌ন ফুহায়রার গোপনীয়তা রক্ষায় প্রশংসা না করলে নাও করতে পারেন, কেননা তারা ছিলেন হযরত আবূ বকর (রা)-এর ঘনিষ্ঠজন। কিন্তু আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন উরায়কিতের গোপনীয়তা রক্ষা, প্রতিশ্রুতির মর্যাদা রক্ষা ও ধৈর্য-স্থৈর্যের প্রশংসা না করে পারা যায় না–যে নিছক একজন শ্রমিকই ছিল আর সে ব্যক্তি মুসলমানও ছিল না। তার এসব গুণের প্রতি গভীরভাবে মনোনিবেশ করলে আরবদের জিদ, আত্মমর্যাদাবোধ ও জাতীয় আভিজাত্যবোধের প্রশংসা না করে পারা যায় না। আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন উরায়কিত উক্ত দু’টি উটনী এবং তার নিজস্ব একটি উট নিয়ে ছওর পাহাড়ের পাদদেশে ছওর গুহার নিকট রাতের বেলা এসে উপনীত হলেন। রাতটি ছিল রবিউল আউয়াল চাঁদের প্রথম রাত। হযরত আসমা বিনত আবূ বকর (রা)-ও সফরের জন্যে ছাতু প্রভৃতি আহার্য দ্রব্য নিয়ে এসে উপস্থিত হলেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ও আবূ বকর সিদ্দীক ছওর গুহা থেকে বেরিয়ে পড়লেন। একটি উটনীতে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আরোহণ করলেন। সে উটনীটির নাম ছিলো কাসওয়া। অপর উটনীতে হযরত আবূ বকর (রা) ও তার গোলাম আমির ইব্‌ন ফুহায়রা আরোহণ করেন। পথ প্রদর্শক আবদুল্লাহ ইব্‌ন উরায়কিত তার নিজস্ব উটে আরোহণ করলেন। চার ব্যক্তির এ সংক্ষিপ্ত কাফেলাটি সাধারণ পথ এগিয়ে মদীনার অন্য পথে এগিয়ে চললো। যেহেতু তখন পশ্চাদ্ধাবনের আশংকা ছিল, তাই যাত্রা শুরুর পূর্বে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটলো এই যে, হযরত আবূ বকর-তনয়া আসমা ছাতুর যে থলে ঘর থেকে নিয়ে এসেছিলেন, ভুলক্রমে তিনি তা লটকানোর জন্যে কোন ফিতে বা রশি নিয়ে আসননি। হযরত আসমা তখন কালবিলম্ব না করে আপন কোমরের ফিতা খুলে অর্ধেক কোমরে বেঁধে বাকী অর্ধেক দিয়ে তা উটের হাওদার সাথে বেঁধে দিলেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তার এ তাৎক্ষণিক ও সময়োপযোগী কাজটি দেখে অত্যন্ত প্রীত হন এবং তাঁকে ‘যাতু’ন-নিতাকায়ন বা দুই ফিতাধারিণী’ বলে অভিহিত করেন। পরবর্তীকালে হযরত আসমা এ খেতাবেই প্রসিদ্ধি লাভ করেন। এ আসমা বিন্‌ত আবূ বকর (রা) ছিলেন আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন যুবায়রের জননী। এটাও একটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার এই যে, হযরত আবূ বকর (রা) যাত্রা শুরুর সময় তার ঘরের সমুদয় নগদ অর্থ সম্পদ, যার পরিমাণ ছিল পাঁচ ছয় হাজার দিরহাম, সাথে নিয়ে রওয়ানা হয়েছিলেন। তাঁর পিতা আবূ কুহাফা তখনো কুফরের উপর অবিচল ছিলেন এবং অন্ধ ছিলেন। তিনি ঘরে তার নাতনীদ্বয়কে লক্ষ্য করে বললেন, আবূ বকর নিজেও গেল এবং সমুদয় অর্থ-সম্পদও নিয়ে গেল। হযরত আসমা বললেন : দাদাজান, আব্বা আমাদের জন্যে অনেক অর্থ রেখে গেছেন। বলেই তিনি একটি বস্ত্র খণ্ডে অনেক কাঁকর মুড়িয়ে ঠিক সেই স্থানে নিয়ে রেখে দিলেন, যেখানে সাধারণত টাকার থলে রাখা হতো। তিনি দাদার হাত ধরে সেখানে নিয়ে গেলেন। তিনি হাতড়ে দেখে নিয়ে ধারণা করলেন যে, আসলেও অর্থ সেখানে আছে। তখন তিনি নাতনীদেরকে বললেন, তাহলে আবূ বকর গেছে, তজ্জন্য চিন্তা নেই।

১২৫
হিজরতের সফর
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কাসওয়ার পিঠে চড়ে রওয়ানা হওয়ার প্রাক্কালে মক্কার দিকে অত্যন্ত বিষাদ মাখা কণ্ঠে বললেন :

“হে মক্কা! তাবত শহরের মধ্যে তুমিই আমার প্রিয়তম শহর। কিন্তু তোমার অধিবাসীরা আমাকে এখানে থাকতে দিলো না।”

হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) বলে উঠলেন : “এরা আপন নবীকে দেশছাড়া করলো। এরা ধ্বংস হয়ে যাবে।”

ঐ সময়েই নাযিল হলো আল-কুরআন-এর এই আয়াত :

أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا ۚ وَإِنَّ اللَّهَ عَلَىٰ نَصْرِهِمْ لَقَدِيرٌ

যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হইল তাহাদিগকে যাহারা আক্রান্ত হইয়াছে; কারণ তাহাদের প্রতি অত্যাচার করা হইয়াছে। আল্লাহ নিশ্চয়ই তাহাদিগকে সাহায্য করিতে সম্যক সক্ষম। (২২:৩৯)

এখানে প্রণিধানযোগ্য, এ অবধি যারা মুসলমান হয়েছিলেন তারা কোন্ পরিস্থিতিতে এবং কীভাবে ইসলামের সভ্যতার দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে কতো হৃদয়বিদারক যাতনা ও পর্বত-প্রমাণ বিপদাপদের মুকাবিলা করে এসেছেন। এ মুসলমানদের সম্পর্কে এ ধারণা করা যেতে পারে যে তারা প্রলোভন বা ভীতির দ্বারা ইসলাম গ্রহণে বাধ্য হয়েছিলেন? তা কখনো হতে পারে না। উক্ত আয়াত নাযিল হওয়ার পর এবার নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো যখন দুরাচারদের এবং সত্য ধর্মের প্রচারে বিঘ্ন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে হত্যা ও লুণ্ঠন থেকে যারা বিরত না থাকে তাদেরকে শাস্তি প্রদান এবং সত্যের প্রচারের পথ থেকে বাধা-বিপত্তি দূর করার অনুমতি পাওয়া গেলো। এবার ভবিষ্যতের ঘটনাবলীর দিকেও দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখুন আর প্রত্যক্ষ করুন, কিভাবে মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে।

এ ছোট্ট কাফেলাটি রাত্রের প্রথম ভাগেই সফর শুরু করে। পরবর্তী দিন অর্থাৎ নবুওয়াতের চতুর্দশ বর্ষের প্রথম রবিউল আউয়াল তারিখের তৃতীয় প্রহর পর্যন্ত একটানা পথ চলতে থাকে। তৃতীয় প্রহরে তারা উম্মে মা‘বাদের খিমায় গিয়ে পৌঁছেন। উম্মে মা‘বাদ ছিল খুযাআ গোত্রের এক অতিথিপরায়ণা বৃদ্ধা। এখানে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বকরীর দুধ পান করেন এবং কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার পথ চলতে নির্দেশ দেন। অল্প একটু পথ চলতেই লক্ষ্য করলেন সুরাকা ইব্‌ন মালিক তাদের পিছু পিছু ধেয়ে আসছে। সুরাকা ছিল মক্কার কুরায়শদের একজন বীর যোদ্ধা। সুরাকার ঘটনাটি এরূপ :

“সুরাকা কয়েক ব্যক্তির সাথে বসে মক্কায় গল্পগুজবে রত ছিল। কাকডাকা ভোরে এক ব্যক্তি এ মজলিসে এসে বললো, আমি তিনজন উষ্ট্রারোহীকে পথ অতিক্রম করতে দেখেছি। তারা ঐ দিকে যাচ্ছিলো। আমার ধারণা, এরা মুহাম্মদ আর তার সঙ্গীরাই হবেন। সুরাকা ইঙ্গিতে ঐ লোকটিকে চুপ করতে বলে বললো, তিনি ছিলেন অমুক ব্যক্তি। তিনি আজ রাতেই যাত্রা করেছেন। তার উদ্দেশ্য ছিল, আমিই তাঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসবো। অন্য কেউ যেন একথা শুনে লাফিয়ে না উঠে। নতুবা একশ‘ উটের বিরাট উপহারটি আমার হাতছাড়া হয়ে যাবে। একটু পরেই সুরাকা সেখান থেকে উঠে নিজ ঘরে চলে আসে। সে চুপিসারে তার ঘোড়া ও অস্ত্র-শস্ত্র শহরের বাইরে পাঠিয়ে দেয় এবং নিজেও লোকের চোখ ফাঁকি দিয়ে শহর থেকে বেরিয়ে আসে। অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সে ঘোড়ায় আরোহণ করে এবং উটসমূহের পায়ের দাগ ধরে দ্রুতবেগে এগিয়ে যায়। অল্প কিছুদূর এগুতেই তার ঘোড়াটি হোঁচট খায় এবং সুরাকা ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে। তারপর আবার সে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসে এবং পুনরায় যাত্রা শুরু করে। তার মনে মনে আশা ছিল, আমি মুহাম্মদকে গ্রেফতার বা হত্যা করে একশ‘ উট উপহার স্বরূপ লাভ করবো। যখন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ও তাঁর সঙ্গীদের উট দেখা যাচ্ছিলো, তখন তার ঘোড়াটি পুনরায় হোঁচট খেয়ে ভূমিতে পড়ে গেলো এবং তার ঘোড়ার সামনের দু’টি পা হাঁটু পর্যন্ত মাটিতে গেড়ে গেলো। সুরাকা ঘোড়ার জীন থেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। তারপর উঠে পুনরায় ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসলো এবং পথ চলতে শুরু করলো। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উটনীর একেবারে নিকটে পৌঁছে তার ঘোড়াটি পেট পর্যন্ত মাটির নীচে প্রোথিত হয়ে গেল। সুরাকা আবার ভূমিতে ছিটকে পড়লো। এ অবস্থা দেখে সে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল এবং স্পষ্ট বুঝতে পারলো, আমি এ মহাত্মার গায়ে হাত দিতে পারবো না। তাই সে তার বাহন ঘোড়াটিকে থামিয়ে দিল। সে বললো, আমি তো আপনাকে গ্রেফতার করতেই এসেছিলাম, কিন্তু এখন আমি ফিরে চলছি এবং আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমাকে একটি নিরাপত্তাপত্র লিখে দিন এবং ক্ষমা করে দিন। ফিরে যাবার কালে আরো যারা আপনার পশ্চাতে একই উদ্দেশ্যে ছুটে আসছে তাদেরকেও ফিরিয়ে নিয়ে যাবো। সত্যি সত্যি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নির্দেশে আবূ বকর সিদ্দীক (রা) অথবা তার খাদিম আমির ইব্‌ন ফুহায়রা উটের উপর বসে বসে একটি নিরাপত্তাপত্র লিখে তার দিকে ছুঁড়ে দিলেন। সে ঐ পত্রখানা নিয়ে মক্কার দিকে ফিরে চললো। পথে যাদেরকেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সন্ধানে আসতে পাওয়া গেল সবাইকে সে এই বলে ফিরিয়ে নিয়ে গেল যে, এদিকে তার তো কোন সন্ধান পাওয়া গেল না। মক্কা বিজয়ের সময় সুরাকা ইসলাম গ্রহণ করেন এবং হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) প্রদত্ত উপরোক্ত নিরাপত্তাপত্রকেই তিনি তার দলীল বা প্রমাণপত্ররূপে গ্রহণ করেন।

ছওর গিরিগুহা তথা নিম্ন মক্কা থেকে রওয়ানা হয়ে আবদুল্লাহ ইব্‌ন উরায়কিত হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে সমুদ্রোপকূলের পথ ধরে এগিয়ে নিয়ে চলেন। আসফান নামক স্থান থেকে সামান্য দূর এগিয়ে সাধারণ চলাচলের পথ ডিঙ্গিয়ে উমাজ নামক স্থানের নিম্নভাগে কাদীদ পর্যন্ত তারা এগিয়ে যান। তারপর আবার রাজপথ ডিঙ্গিয়ে খার্রার প্রান্তর তারা অতিক্রম করেন। সানাতুল মুররা, লাফত, মুদলিজা, মাখাজ প্রভৃতি স্থান অতিক্রম করে যুল-আযওয়াইন অঞ্চল পেরিয়ে যী-মুসলিম মরুভূমির মধ্য দিয়ে আল-আবাবীদ, আল-আ‘রাজ প্রভৃতি স্থান তাঁরা অতিক্রম করেন। আল-আ‘রাজের নিম্নভূমি অতিক্রমকালে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উটনী ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লো। সেখানে আসলাম গোত্রের জনৈক আওস ইব্‌ন হাজারের নিকট থেকে একটি উট নেন। আওস ইব্‌ন হাজার তার একটি গোলামকেও হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সাথে দিয়ে দেন। সেখান থেকে এ কাফেলাটি মুছান্নাতুল-গায়ের-এর রাস্তায় রীম প্রান্তরে এসে পৌঁছেন। রীম প্রান্তর অতিক্রম করে দুপুর বেলা তারা কুবার নিকটে এসে পৌঁছেন।

সুরাকা ইব্‌ন মালিকের প্রত্যাবর্তনের পর সামান্য পথ অতিক্রম করতেই হযরত যুবায়র ইব্‌ন আওআম (রা)-এর সাথে সাক্ষাৎ। তিনি তখন সিরিয়া থেকে বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে মক্কায় ফিরছিলেন। যুবায়র ইব্‌ন আওআম হযরতের খিদমতে পরিধেয় বস্ত্র পেশ করলেন এবং জানালেন যে, তিনিও মক্কায় ফিরেই কালবিলম্ব না করে মদীনায় চলে আসবেন। এ সফরে যেখানেই লোকের সাথে সাক্ষাৎ হতো, তারা হযরত আবূ বকর (রা)-কে চিনে ফেলতো। কেননা, ব্যবসা ব্যাপদেশে প্রায়ই তার এ পথে আসা-যাওয়া ছিল। পক্ষান্তরে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে লোকে চিনতো না। তাই তাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করতো, আপনার আগে আগে পথ অতিক্রমকারী এ ব্যক্তিটি কে? তিনি জবাব দিতেন : هذا يهدينى السبيل “ইনি আমার পথ প্রদর্শক।”

১২৬
সফরের সমাপ্তি
আট দিন পথ চলে হযরত নবী (সাঃ) ৮ই রবিউল আউয়াল ১৪ নববী সালে দুপুর বেলা কুবার নিকটে এসে পৌঁছেন। কুবা মদীনা থেকে কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত এবং এটি মদীনারই একটি পল্লী বলে বিবেচিত হতো। সেখানে বনী আমর ইব্‌ন আওফ গোত্রের প্রচুর লোক বাস করতো এবং তারা ইসলামের আলোকে ইতিপূর্বেই আলোকিত হয়েছিলেন। মক্কা থেকে নবী (সাঃ)-এর রওয়ানা হওয়ার সংবাদ মদীনায় কয়েক দিন পূর্বেই পৌঁছে গিয়েছিল। এজন্যে মদীনার আনসারগণ প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তার আগমন, প্রতীক্ষায় জনপদের বাইরে এসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতেন। তাদের আশা ছিলো এভাবে নবী করীম (সাঃ)-এর শুভাগমনের দৃশ্য বহু দূর থেকেই তারা দেখতে পাবেন। যখন সূর্যের উত্তাপ বৃদ্ধি পেয়ে সহ্যসীমার বাইরে চলে যেতো, কেবল তখনই তারা নিজ নিজ বাড়ীতে ফিরে যেতেন।

জনৈক ইয়াহূদী মুসলমানদেরকে এ ভাবে বিপুল সংখ্যায় ভিড় করে থাকতে প্রতিদিনই দেখতে পেতো। সে জানতো যে, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মক্কা থেকে আসছেন এবং এরা প্রতিদিন তারই প্রতীক্ষায় ভিড় করে। ঘটনাক্রমে ঐ ইয়াহূদীটি সেদিন তার ঘরের ছাদের উপর উপবিষ্ট ছিল। সে দূর থেকে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) তাশরীফ আনছেন দেখতে পেলো। তাই সে চীৎকার করে বললো :

يا معشر العرب يا بني قيله هذا جدكم قد جاء

ওহে আরবরা! ওহে দুপুরে বিশ্রামকারীরা!! ঐ যে তোমাদের অভীষ্ট আগন্তুক, তোমাদের সৌভাগ্যের হেতু এসে পড়েছেন!

আওয়াজটি শুনতেই লোকজন যার যার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। গোটা কুবা পল্লীতে মহা ধুমধাম পড়ে গেল। আনসাররা লক্ষ্য করলেন, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) একটি খেজুর বাগানের দিক থেকে আসছেন। আল্লাহর রাসূল কোনজন তা চিনতে যেন কারো বেগ পেতে না হয় তাই হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) চট করে উঠে তার পিছনে দাঁড়িয়ে আপন চাদর দিয়ে তাকে ছায়া দান করতে লাগলেন। ফলে কে মনিব আর কে তার ভক্ত তা চিনতে কাউকে আর বেগ পেতে হলো না।

মহানবী (সাঃ) কুবা পল্লীতে প্রবেশ করছিলেন আর আনসার বালিকারা মনের আনন্দে আবৃত্তি করছিলো :

طلع البدر علينا * من نبات الواداع

وجب الشكر علينا * ما دعا الله داع

ايها المبعوث فينا * جنت بالأمر المطاع .

পূর্ণ শশীর উদয় আজি মোদের আঙিনায়ছানিয়াতুল বিদা-য় তোরা দেখবি যদি আয়ওয়াজিব হলো মোদের তরে শোকর আদায়যাবৎ কেউ ডাকিবে লোকে ডাকিতে খোদায়হে মহান সত্তা তুমি প্রেরিত হেথায়শিরোধার্য তব আদেশ যদিও প্রাণ যায়। —(অনুবাদক)

[এখানে ‘ছানিয়াতুল বিদা’ বলতে ঐ স্থানটিকেই বোঝানো হয়েছে যেখান পর্যন্ত মদীনাবাসীরা মক্কায় হজ্জযাত্রীদেরকে বিদায় দেয়ার সময় বিদায় অভিনন্দন জানাতে অগ্রসর হতো। আজ সেই বিদায়-অভিনন্দনের স্থান দিয়েই নবুওয়াত-সূর্য মদীনায় প্রবেশ করছিলেন মক্কা থেকে এসে। তাই এ অভিনন্দন কাব্যে শব্দের কবিত্বের সাথে সাথে ভাবের একটা চমৎকার কাব্যিকতাও বিদ্যমান।—অনুবাদক]

হযরত নবী (সাঃ) সোমবার দিন কুবায় প্রবেশ করেন এবং শুক্রবার পর্যন্ত এখানেই অবস্থান করেন। হযরত নবী (সাঃ) কুলছুম ইব্‌ন হাদামের ঘরে এবং হযরত আবূ বকর (রা) হাবীব ইব্‌ন আসাফের ঘরে অবস্থান করেন। মজলিস হতো সাআদ ইব্‌ন খায়ছামা (রা)-এর বাড়িতে। অর্থাৎ সেখানে লোকজন এসে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং সেখানেই তারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর চতুষ্পার্শ্বে ভিড় জমিয়ে থাকতেন। এ কয়দিনের মধ্যেই তিনি কুবায় একটি মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন। এটাই ছিল ইসলামের সর্বপ্রথম মসজিদ। তারপর ১২ই রবিউল আউয়াল শুক্রবার তিনি কুবা থেকে রওয়ানা হয়ে মদীনায় প্রবেশ করেন। তিনি কুবায় থাকতেই হযরত আলী কার্‌রামাল্লাহু ওয়াজহাহু মক্কা থেকে এসে তাঁর খিদমতে উপনীত হন। মক্কা থেকে মদীনার এ দীর্ঘ পথ তিনি পদব্রজে অতিক্রম করেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যখন সওর গিরিগুহায় অবস্থান করছিলেন, তখন তিনি মক্কায় অবস্থান করে লোকজনের গচ্ছিত দ্রব্যাদি প্রত্যর্পণ করছিলেন। ঘটনাচক্রে যেদিন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সওর গিরিগুহা থেকে মদীনার দিকে রওয়ানা হন ঐ দিনই হযরত আলী (রা)-ও মক্কা থেকে মদীনার পানে রওয়ানা হন। কিন্তু হযরত আলী (রা) যেহেতু একাকী ছিলেন তাই রাতের বেলায় তিনি সারারাত ধরে পথ চলতেন এবং দিনের বেলায় কোথাও আত্মগোপন করে পড়ে রইতেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সর্বজনপরিচিত রাস্তা এড়িয়ে অন্য পথে দূরত্বটুকু অতিক্রম করেন এবং তাতে কুবা পৌঁছতে তার আটদিন সময় অতিবাহিত হয়। হযরত আলী (রা) পরিচিত রাস্তা দিয়েই আসেন। কিন্তু যেহেতু তিনি পায়ে হেঁটে এসেছিলেন, তাই কুবায় পৌঁছতে তার তিন চার দিন বেশী সময় লাগে।

১২৭
মদীনায় প্রবেশ
শুক্রবার দিন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কুবা এবং কুবার অধিবাসী বনী আমর ইব্‌ন আওয়াফ গোত্রের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। মদীনার প্রতিটি মহল্লার প্রতিটি পরিবার সর্বান্তঃকরণে কামনা করতো যে, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যেন তাদেরই ঘরে গিয়ে বসবাস করেন। তিনি বনী সালিম ইব্‌ন আওফের মহল্লায় পৌঁছতেই জুমুআর সালাতের ওয়াক্ত হয়ে যায়। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) একটি খোলা মাঠে একশত জন ভক্তদের নিয়ে জুমুআর সালাত আদায় করেন। এটা ছিল মদীনায় তাঁর প্রথম জুমুআ এবং প্রথম খুতবা। এখানেও একটি মসজিদ নির্মিত হলো।

জুমুআর সালাত অন্তে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর উটনীতে চড়ে বসলেন। বনী সালিম ইব্‌ন আওফ-এর লোকেরা এসে তাঁর উটের বল্গা ধরে বসলো এবং তাকে তাদের ওখানেই থাকার জন্য আবদার জানালো। অন্যান্য কবীলার এবং অন্যান্য মহল্লার লোকেরাও তাঁকে তাদের ওখানে নিয়ে যেতে তাদের আগ্রহ প্রকাশ করলো। এভাবে তাদের মধ্যে বাদানুবাদের সৃষ্টি হলো। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বললেন : আমার উটনীকে তোমরা থামিও না! তার লাগাম ছেড়ে দাও! আল্লাহর পক্ষ থেকে সে নির্দেশ ইতিমধ্যেই পেয়ে গেছে। যেখানে আমার উটনীটি বসে পড়বে সেখানেই আমি অবস্থান করবো। উটনীর লাগাম তাই ছেড়ে দেয়া হলো, এবং সে এগিয়ে চললো। সমস্ত আনসার ও মুহাজির তার অগ্র-পশ্চাতে ও ডানে-বামে সাথে সাথে এগিয়ে চললেন। হযরত নবী (সাঃ) লাগাম ঢিলা দিয়ে দিলেন এবং সে তার নিজ খুশিতে ধীরে ধীরে চলতে লাগলো। সকলেই অধীর আগ্রহে অপলক নেত্রে উটনীর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। সকলেই পরম কৌতূহল—শেষ পর্যন্ত সে কোথায় গিয়ে থামে এবং কার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয় তা-ই দেখবেন। উটটি যখন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে নিয়ে বনু বায়াদিয়া গোত্রের মহল্লায় গিয়ে উপনীত হলো তখন সেই গোত্রের সর্দার যিয়াদ ইব্‌ন লবীদ এবং উরওয়া ইব্‌ন আমর অগ্রসর হয়ে উটনীর লাগাম ধরতে উদ্যত হন। তখন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলে উঠলেন :

دعوها فانها مامورة

একে ছেড়ে দাও। কেননা সে ইতিমধ্যেই সুনির্দিষ্ট আদেশ পেয়ে গেছে।

তারপর উটনীটি বনূ সাঈদা গোত্রের মহল্লায় গিয়ে উপনীত হয়। বনু সাঈদা গোত্রের সরদার সা‘দ ইব্‌ন উবাদা এবং মুনযির ইব্‌ন আমর উটনীকে বাধা দিতে চাইলেন। তখন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আবারও বললেন :

دعوها فانها مامورة

একে ছেড়ে দাও, কেননা ইতিমধ্যেই সে সুনির্দিষ্ট আদেশ পেয়ে গেছে।

তারপর উটনীটি বনু হারিছ ইব্‌ন খাযরাজ গোত্রের মহল্লায় গিয়ে উপনীত হলো। এখানে সা‘দ ইবনুর রবীঈ, খারিজা ইব্‌ন যায়দ ও আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন রাওয়াহা থামাতে চাইলেন। তাদেরকেও পূর্বোক্ত নিষেধাজ্ঞাটি শোনানো হলো। সেখান থেকে রওয়ানা হয়ে উটনীটি বনূ আদী ইবনুল নাজ্জারের মহল্লায় গিয়ে উপনীত হলো। এটি যেহেতু আবদুল মুত্তালিবের নানার গোত্র ছিল এজন্য তাদের দাবী ছিল এই যে, আবদুল মুত্তালিবের মা সালমা বিন্‌ত আমর যেহেতু আমাদেরই গোত্রের মেয়ে ছিলেন, তাই হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আমাদেরই সাথে থাকবেন। সাথে সাথে বনূ আদী গোত্রের সর্দার সলীত ইব্‌ন কায়েস ও আসীর ইব্‌ন খারিজা অগ্রসর হয়ে উটনীর লাগাম ধরেও বসলেন, কিন্তু তাদেরকেও হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বললেন : উটনীকে যেতে দাও! কেননা, আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে সে ইতিমধ্যেই সুনির্দিষ্ট নির্দেশ পেয়ে গেছে। তারপর উটনী বনু মালিক ইব্‌ন নাজ্জার গোত্রের মহল্লায় গিয়ে একটি অনাবাদী জমির উপর বসে পড়লো। একটু পরে উঠেই আবার কিছু দূর পর্যন্ত অগ্রসর হলো। তারপর আবার ফিরে এসে পূর্ববর্তী স্থানে এসে বসে পড়লো। এবার উটনীটি বসে গা ঝাড়া দিল, ঘাড় নীচু করে ফেললো এবং লেজ দোলাতে লাগলো।

সেই অনাবাদী জমির পাশেই ছিল হযরত আবূ আইয়ুব খালিদ ইব্‌ন যায়দ আনসারী (রা)-এর বাড়ী। তিনি অত্যন্ত হৃষ্টচিত্তে হযরত নবী করীম (সাঃ)-এর সামান-পত্র বহন করে নিজের ঘরে নিয়ে উঠালেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সেখানেই অবস্থান করলেন।

ঐ পতিত জমিটি ছিলো সুহায়ল ও সুহায়ল নামক দু’টি ইয়াতীম বালকের। সেখানে কয়েকটি খেজুর গাছ দাঁড়িয়েছিল। মূর্তিপূজারীদের কয়েকটি কবরও ছিল সেখানে। পশুপাল এসে এখানে বসতো। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন : এ জমিটি কার? মুআয ইব্‌ন আফরা আরয করলেন : জমিটা আমার দু’টি ইয়াতীম আত্মীয়ের ছেলের। এরা আমারই ঘরে প্রতিপালিত হচ্ছে। আমি তাদেরকে রাযী করে ফেলবো-। আপনি আপনার খুশিমত এখানে মসজিদ বানাতে পারেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বললেন : আমি তা মূল্য দিয়ে কিনতে চাই। বিনা মূল্যে তা আমি কোন মতেই গ্রহণ করবো না। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) তখনই তার মূল্য পরিশোধ করলেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নির্দেশক্রমে খেজুর গাছগুলো কেটে ফেলা হলো। মূর্তিপূজারীদের কবরগুলোকে ভূমির সাথে সমান করে দেয়া হলো এবং মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু হয়ে গেল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্বয়ং মসজিদ নির্মাণের কাজে অংশ গ্রহণ করতেন। মুহাজিরীন ও আনসার স্বতঃস্ফূর্ত উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে এ কাজে লেগে থাকতেন। মসজিদের দেয়ালের গাঁথুনী পাথর ও কাদামাটির দ্বারা দেয়া হলো। খেজুর গাছের কাণ্ড ও পাতা দিয়ে তার ছাদের কড়িকাঠ ও চাল ছাওয়ার কাজ সম্পন্ন করা হলো। মসজিদ এবং তার পাশে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর বাসস্থান নির্মিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি হযরত আবূ আইয়ুব আনসারী (রা)-এর ঘরে তার মেহমানরূপে অবস্থান করেন। ইনি সেই ইতিহাস বিখ্যাত আবূ আইয়ুব আনসারী (রা) যার মাযার কনস্টান্টিনোপলে রয়েছে। তিনি ৪৮ হিজরীতে হযরত : আমীর মু‘আবিয়া (রা)-এর আমলে কনস্টান্টিনোপল অবরোধকালে ইন্তিকাল করেন।

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এগারো মাস কয়েকদিন হযরত আবূ আইয়ুব আনসারী (রা)-এর ঘরে অবস্থান করেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আমলে নির্মিত এ মসজিদটি হযরত উমর (রা)-এর আমল পর্যন্ত ঐরূপই ছিলো। হযরত উমর (রা) তাঁর খিলাফত আমলে মসজিদটি আরো প্রশস্ত করেন। হযরত উছমান (রা) তাঁর খিলাফত আমলে মসজিদের দেয়ালগুলো পাকা করান। তারপর ওয়ালীদ ইব্‌ন আবদুল মালিকের আমলে তা আরো প্রশস্ত করা হয় এবং নবী সহধর্মিণিগণের হুজরাসমূহও এর অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়। আব্বাসী খলীফা মামুনুর রশীদ মসজিদের শোভা বর্ধন করেন। হযরত আবূ আইয়ুব আনসারীর বাড়ীতে অবস্থানকালেই হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যায়দ ইব্‌ন ছাবিত ও আবূ রাফি‘ঈ (রা)-কে মক্কা পাঠিয়ে হযরত ফাতিমা (রা), হযরত উম্মে কুলসূম (রা), হযরত সাওদা বিন্‌ত যাম্‌আ (রা), হযরত উসামা ইব্‌ন যায়দ (রা) এবং তার মা হযরত উম্মে আয়মন (রা)-কে মদীনায় আনিয়ে নেন এবং তাদের সকলের আসার পর হুযুর (সাঃ) তার নব নির্মিত হুজরায় গিয়ে উঠেন।

১২৮
হিজরী সন
এ যাবত আমরা সন তারিখ উল্লেখ করতে নববী সন তারিখ ব্যবহার করে এসেছি। এর অর্থ ছিলো উক্ত ঘটনার সময়টি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নবুওয়াত প্রাপ্তির এত বছর পরের ঘটনা। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, চান্দ্রমাসের প্রচলিত ক্রম ও নাম প্রাচীনকাল থেকে আরবে যেভাবে চলে আসছিল সেভাবেই আছে। তাই নববী সনের প্রথম বর্ষটি কয়েক মাস পরেই শেষ হয়ে যায়। এ জন্যেই হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মদীনা প্রবেশকে ১৪তম নববী বর্ষের রবিউল আউয়াল মাসের ঘটনা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আসলে কিন্তু তখন নবুওয়াতের বা রিসালাত প্রাপ্তির মাত্র সাড়ে বার বছর কাল অতিক্রান্ত হয়েছিল। আর এভাবেই হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মদীনা গমন থেকে হিজরী সন গণনা আরম্ভ করা হয়। যেহেতু হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বারই রবিউল আউয়াল তারিখে মদীনায় আগমন করেছিলেন, তাই প্রথম হিজরী বর্ষটি সাড়ে নয় মাস পরেই সমাপ্ত হয়ে যায়। ১লা মুহাররম থেকে হিজরী দ্বিতীয় বর্ষের সূচনা হয়। সুতরাং হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) দ্বিতীয় হিজরীর সফর মাস পর্যন্ত হযরত আবূ আইয়ূব আনসারী (রা)-এর বাড়ীতে অবস্থান করেছিলেন বলে বুঝে নিতে হবে।

১২৯
হিজরী প্রথম বর্ষ
হিজরী প্রথম বর্ষের ঘটনাবলীর মধ্যে মসজিদে নববী নির্মাণ, নবী করীম (সাঃ)-এর বাসস্থান নির্মাণ, মক্কার অবশিষ্ট মুসলমানদেরকে মদীনায় নিয়ে আসার কথা পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে হযরত আবূ উমামা আসআদ ইব্‌ন যুরারা (রা)-এর মৃত্যুর ঘটনাটিও উল্লেখের দাবী রাখে। আবূ উমামার কোন রোগ-শোক ছিলো না। অকস্মাৎ রোগাক্রান্ত হয়ে তিনি ইন্তিকাল করেন। এ খবরটি পাওয়া মাত্র হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছিলেন, বিধর্মীদের এ কথা বলার সুযোগ এসে গেলো যে, এ কেমনতর রাসূল যে, তার বন্ধুদের একজন আকস্মিকভাবে মারা গেলো। তার ইন্তিকালের পর বনূ নাজ্জার-এর লোকজন এসে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে বললো: “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আবূ উমামা আমাদের সরদার ছিলেন। তাঁর ইন্তিকালে আমরা সরদার শূন্য হয়ে গেলাম। আপনি আমাদের মধ্য থেকে কাউকে তার স্থলাভিষিক্ত করে দিন।”

জবাবে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বললেন : বনূ নাজ্জারের তোমরা তো আমার মামু। এজন্যে আমি নিজেও তোমাদেরই একজন। আমি নিজেই তোমাদের নকীব বা সরদাররূপে রইলাম। এ কথা শুনে বনু নাজ্জারের লোকদের খুশির সীমা-পরিসীমা রইলো না। তারা আনন্দে বাগ বাগ হয়ে গেলো। তাদের মধ্য থেকে কাউকে নেতা নিযুক্ত করলে নেতৃত্ব প্রয়াসী অন্যরা হয়তো তাকে সহজে মেনে নিতে পারতো না। ফলে সাময়িকভাবে হলেও গোত্রটির মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হতো। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর এ বিচক্ষণ সিদ্ধান্তে সে আশংকা দূর হয়ে গেল। এভাবে গোত্রটির সাহস ও ঐক্য পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধিই পেলো।

হযরত নবী করীম (সাঃ) মদীনায় এসে সর্বপ্রথম যে ব্যাপারটির প্রতি মনোযোগী হলেন তা হলো শহরের নিরাপত্তা বিধান এবং নাগরিকদের পারস্পরিক সম্প্রীতি-সৌহার্দ বৃদ্ধি। তিনি মদীনায় পৌঁছেই উপলব্ধি করেন যে, মক্কা থেকে মুহাজিরগণ যেন মদীনাবাসীদের কষ্টের কারণ ও সমস্যা হয়ে না দাঁড়ান। সাথে সাথে দীনের খাতিরে সীমাহীন কষ্ট অকাতরে গ্রহণকারী এবং নিজেদের প্রিয় ঘরবাড়ি, আত্মীয়-পরিজন, অর্থ-সম্পদ, জমি-জমার মায়াত্যাগী মুহাজিরগণও যাতে কোনরূপ মর্মযাতনার শিকার না হন, সেদিকেও তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিলো। তাই তিনি সমস্ত আনসার ও মুহাজিরকে একটি সমাবেশে একত্রিত করে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব সম্পর্কে তাদেরকে উপদেশ দিলেন এবং মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক স্থাপন করে মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে সুসম্পর্ক ও সম্প্রীতি স্থাপন করেন। প্রায় সকল মুহাজিরই কোন-না-কোন আনসারের ভাইয়ে পরিণত হলেন। হযরত আবূ বকর (রা)-এর দীনী ভাই হলেন খারিজা ইব্‌ন যুবায়র আনসারী (রা)। হযরত আবূ উবায়দা ইবনুল জাররাহ (রা)-এর ভ্রাতৃত্ব স্থাপিত হলো হযরত সা‘দ ইব্‌ন মুআয আনসারী (রা)-এর সাথে। হযরত আবদুর রহমান ইব্‌ন আউফ (রা)-এর ভাই হলেন সা‘দ ইব্‌ন রবী‘ আনসারী। হযরত যুবায়র ইব্‌ন আওআম (রা)-এর ভ্রাতৃত্ব হলো সালামা ইব্‌ন সালামা (রা)-এর সাথে। হযরত উছমান ইব্‌ন আফফান (রা) ছাবিত ইব্‌ন মুনযির আনসারী (রা)-এর ভাই হলেন। অনুরূপভাবে হযরত তালহা ইব্‌ন উবায়দুল্লাহ্ (রা) ও হযরত কা‘ব ইব্‌ন মালিক (রা), হযরত মুসআব ইব্‌ন উমায়র (রা) ও হযরত আবূ আইয়ুব আনসারী (রা), আম্মার ইব্‌ন ইয়াসির (রা) ও হযরত হুযায়ফা ইব্‌ন ইয়ামান (রা) পরস্পরে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। মোটকথা এক এক জন মুহাজির এক একজন আনসারীর সাথে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। মদীনার আনসারগণ এ ভ্রাতৃত্ব সম্পর্কের যে মর্যাদা প্রদর্শন করেন পৃথিবীর ইতিহাসে তার কোন নজীর নেই। মুহাজিরগণকে আনসারগণ তাঁদের সত্যিকারের ভাই বলেই গ্রহণ করেন এবং নিঃসংকোচে নিজেদের সমস্ত ধন-সম্পদ তাদের হাতে তুলে দেন। কোন কোন আনসার ভাই তো তার মুহাজির ভাইয়ের মনতুষ্টির জন্য নিজের দু’টি স্ত্রীর একজনকে তালাক দিয়ে মুহাজির ভাইয়ের হাতে তুলে দিতে অগ্রসর হন। মুহাজিরগণও এমনি সতর্ক ছিলেন যে, তারা তাদের ব্যয়ভার আনসার ভাইদের উপর চাপানো থেকে বিরত থাকেন। তারা অত্যন্ত পরিশ্রম করতেন। কেউ কেউ ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে দেন এবং এভাবে তারা নিজেদের জীবিকা কায়িক শ্রম দ্বারা নির্বাহ করতে শুরু করেন। এভাবে তারা তাদের আনসার ভাইদের শক্তি বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়ালেন।

১৩০
প্রথম শাসনতান্ত্রিক সনদ
হিজরী প্রথম বর্ষের একটা বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো এই যে, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মদীনাবাসী ইয়াহূদী ও মূর্তিপূজারী নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মদীনাবাসীদেরকে নিয়ে একটি চুক্তিনামা প্রণয়ন করেন। সকল পক্ষই সন্তুষ্টচিত্তে এ চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করেন। এ চুক্তিপত্রে অনেকগুলো শর্তের মধ্যে ছিলো :

(ক) যখন মদীনায় কোন বহিঃশত্রুর আক্রমণ হবে, তখন সকলে মিলে তা প্রতিরোধ করবে।

(খ) মদীনার ইয়াহূদীরা মক্কার কুরায়শ কিংবা তাদের সাথে মিত্রচুক্তিতে আবদ্ধ মুসলমানদের কোন শত্রুকে আশ্রয় দিবে না।

(গ) মদীনাবাসীরা কেউ কারো ধর্ম বা জানমালে হস্তক্ষেপ করবে না।

(ঘ) মদীনাবাসীদের কোন দুই পক্ষের মধ্যে যদি কলহ উপস্থিত হয় এবং তারা নিজেরা এর সমাধান করতে সমর্থ না হয়, তা হলে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-ই তাঁর ফায়সালা করবেন। এতে কোন পক্ষের আপত্তি থাকবে না।

(ঙ) যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি বা লাভের মধ্যে সমস্ত মদীনাবাসীরা সমানভাবে অংশীদার থাকবেন।

(চ) যে সমস্ত গোত্রের সাথে মদীনার ইয়াহূদীদের চুক্তি বা বন্ধুত্বের সম্পর্ক রয়েছে, ঐ গোত্রসমূহ মদীনার মুসলমানদেরও মিত্র বলে গণ্য হবেন এবং বন্ধুত্বমূলক আচরণ তাদের প্রাপ্য হবে। অনুরূপভাবে যে সমস্ত গোত্রের সাথে মুসলমানদের মিত্রতা রয়েছে, মদীনায় ইয়াহূদীরা তাদেরকে মিত্ররূপে গণ্য করবে এবং তারা তাদের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করবে।

(ছ) মদীনার সীমানার মধ্যে খুনাখুনি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ বলে বিবেচিত হবে।

(জ) অত্যাচারিতের সাহায্য করা সকলের সাধারণ কর্তব্য বলে গণ্য হবে, ইত্যাদি।

এ চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পর হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মদীনার আশেপাশের গোত্রসমূহকেও এ চুক্তিতে শামিল করতে প্রয়াসী হন—যাতে করে হত্যা, হানাহানি ও অশান্তির মূলোৎপাটন হয়ে যায়। এ উদ্দেশ্যে তিনি মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী ‘উসফান’ নামক স্থান সফর করেন এবং বনী হামযা ইব্‌ন বকর ইব্‌ন আবদে মানাফ গোত্রকে এ চুক্তির মধ্যে শামিল করে তাদের সরদার আমর ইব্‌ন মাখশীর স্বাক্ষর আদায় করেন। বাওয়াত পার্বত্য অঞ্চলের বাসিন্দাদেরকেও তিনি এ চুক্তিতে শামিল করেন। ইয়াম্বুঈর দিকে অবস্থিত যিল-আশারা নামক স্থানেও তিনি গমন করেন এবং বনূ মুদলিজ গোত্রকেও এতে স্বাক্ষর করান। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মদীনা মুনাওয়ারায় পৌঁছেই শান্তি-শৃংখলা বিধান ও জনসেবামূলক কার্য তৎপরতার দ্বারা এমন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ প্রতিষ্ঠার দিকে মনোনিবেশ করেন যাতে মানুষ দীন-ইসলামকে বুঝে শুনে তা গ্রহণ করতে পারে। হযরত নবী (সাঃ)-এর এ প্রচেষ্টা যখন অব্যাহত গতিতে চলছিল, তখন মদীনার পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহে বসবাসকারী সকল গোত্র পুরোপুরি এতে শামিল হওয়ার পূর্বেই মদীনার ভিতরে ভিতরে এবং মদীনার বাইরে থেকে প্রকাশ্যেই শত্রুরা হামলা চালাতে শুরু করলো।

১৩১
মুনাফিকীর উদ্ভব
মদীনায় আবদুল্লাহ ইব্‌ন উবায়্য ইব্‌ন সলূল নামক একজন অত্যন্ত বুদ্ধিমান, অভিজ্ঞ ও ধুরন্ধর লোক বাস করতো। আওস ও খাযরাজ গোত্রে তার অপ্রতিহত প্রভাব ছিল। সকলেই তাকে নেতা বলে গণ্য করতো। আওস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয় এর কিছু দিন আগেও বুআছের যুদ্ধে একে অপরের মুকাবিলা করছিল। এ যুদ্ধে উভয় গোত্রেরই বাছা বাছা সরদাররা নিহত হন এবং গোত্রদ্বয় অত্যন্ত হীনবল হয়ে পড়ে। আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন উবায়্য এ পরিস্থিতির সুযোগ নেয় এবং উক্ত দু’টি গোত্রে নিজের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির কোন সুযোগই হাতছাড়া হতে দেয়নি। মদীনাবাসীরা তাকে তাদের সর্বসম্মত নেতারূপে ঘোষণার উপক্রম করছিল। এমন কি তার অভিষেকের উদ্দেশ্যে তারা একটা মুকুটও তৈরী করে ফেলেছিল। এমনি সময় মদীনায় ইসলাম ও তার নবীর আবির্ভাব ঘটে।

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মদীনায় আগমনের সাথে সাথে মুসলমানরাই মদীনার সবচাইতে বড় শক্তি বলে বিবেচিত হতে লাগলো। অবশেষে উপরোক্ত চুক্তিপত্রে সকলে সই করে দিয়ে তাদের সে শক্তি ও আধিপত্যকে সকলেই আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়ে দিল। এর অনিবার্য পরিণতি স্বরূপ আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন উবায়্যর বাড়াভাতে ছাই পড়লো। তার বাদশাহী ও সরদারীর স্বপ্ন ধুলোয় মিশে গেল। কিন্তু লোকটি যেহেতু অত্যন্ত ধুরন্ধর ছিল, তাই হযরত নবী (সাঃ)-কে তার পরম শত্রু ও প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করলেও সে মনোভাবের প্রকাশকে নিরর্থক মনে করে সে তা মনে মনেই চেপে রইলো। আওস ও খাযরাজের যেসব লোক তখনো মূর্তিপূজারী ছিলো তাদের উপর তার আধিপত্য তখনো পূর্ববৎ অটুট ছিল। মক্কার কুরায়শরা যখন জানতে পারলো হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ও তার অনুচরগণ মদীনায় গিয়ে শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করছেন এবং দিন দিন ইসলামের প্রসার ঘটছে, তখন সর্বপ্রথম তারা যে দুষ্টামিটি করলো তা হলো আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন উবায়্য এবং মদীনার মুশরিকদেরকে তারা এ মর্মে একটি সতর্কবাণী পাঠালো যে, আমাদের লোকদেরকে তোমরা আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তোমাদের ওখানে থাকতে দিচ্ছ। তোমাদের এখন উচিত তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করা এবং তাদেরকে মদীনা থেকে বের করে দেয়া। যদি তোমরা তা না কর তবে আমরা সুসজ্জিত হয়ে মদীনা আক্রমণ করবো। তোমাদের যুবকদেরকে হত্যা করা হবে এবং তোমাদের রমণীদেরকে আমরা হস্তগত করবো।

এ খবর পাওয়া মাত্র আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন উবায়্য মদীনার মুশরিকদেরকে একত্রিত করলো এবং তাদেরকে মক্কাবাসীদের এ বার্তাটি সম্পর্কে অবহিত করে সকলকে যুদ্ধের জন্য প্ররোচিত করলো। ঘটনাচক্রে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তার এ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত হয়ে গেলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ সেই সমাবেশে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তিনি সেই সমাবেশকে লক্ষ্য করে বললেন : “মক্কার কুরায়শরা তোমাদেরকে প্রতারিত করতে চাচ্ছে। যদি তোমরা তাদের প্রতারণার জালে ধরা দাও এবং তাদের হুমকিকে আমল দাও, তাহলে তোমরা দারণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তোমাদের জন্যে সমীচীন হবে এই যে, তোমরা তাদেরকে সাফ জবাব দিয়ে দেবে এবং আমাদের সাথে কৃত তোমাদের চুক্তির উপর অটল থাকবে। যদি একান্তই কুরায়শরা মদীনা আক্রমণ করেও তবে তাদেরকে প্রতিরোধ করা এবং তাদের সাথে লড়াই করা আমাদের জন্যে খুব সহজই হবে। কেননা, আমরা সংঘবদ্ধভাবে তাদের মুকাবিলা করবো। পক্ষান্তরে যদি তোমরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হও, তাহলে নিজ হাতে তোমরা নিজেদের পুত্র, ভাই ও নিকটাত্মীয়দেরকে হত্যা করবে এবং এভাবে নিজেরাই নিজেদেরকে ধ্বংস করবে।” হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কথাগুলো উপস্থিত সকলেই সমর্থন করলো এবং তৎক্ষণাৎ সভা বঙ্গ হয়ে গেলো। আবদুল্লাহ ইব্‌ন উবায়্য তা নীরবে প্রত্যক্ষ করলো।

এ বছরই মুসলমানদেরকে মসজিদে আহবান করার জন্যে আযানের ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলো। এ বছরই ইয়াহূদীদের একজন প্রাজ্ঞ পণ্ডিত ব্যক্তি হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন সালাম (রা) ইসলাম গ্রহণ করলেন। ঐ বছরই হযরত সালমান ফারসী (রা) যিনি প্রথমে মজুসী বা অগ্নি উপাসক ছিলেন তারপর খ্রিস্টান হন এবং ইয়াহূদী-নাসারাদের কিতাবাদি অধ্যয়ন করে আখিরী যামানার নবীর প্রতীক্ষায় ছিলেন তিনি হযরত নবী (সাঃ)-এর খিদমতে হাযির হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হন। এ বছরই যাকাতও ফরয হয়।

১৩২
হিজরী দ্বিতীয় বর্ষ
রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর মক্কা থেকে সহি-সালামতে তাশরীফ নিয়ে চলে যাওয়াটাকেই কাফির মুশরিকরা মস্ত পরাজয় বলে মনে করছিল। এবার থেকে তাদের সমস্ত প্রচেষ্টা মুসলমানদের উপর থেকে প্রতিশোধ গ্রহণের চিন্তায় নিয়োজিত হলো। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ও মুসলমানদেরকে ধ্বংস করাটাই ছিলো তাদের সর্বাগ্রগণ্য ও সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এ কাজের তুলনায় অন্যান্য কাজ ছিলো তাদের কাছে গুরুত্বহীন। এজন্যে তারা তাদের নিজেদের মধ্যকার খুঁটিনাটি মতপার্থক্য ভুলে গিয়ে গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের সমস্ত শক্তি ও যোগ্যতা এ কাজে নিয়োগের জন্য প্রস্তুত ছিলো। মক্কা ও মদীনার দূরত্ব ছিলো প্রায় তিন শত মাইলের। মদীনার উপর আক্রমণ চালাতে হলে তাদের বিশেষ প্রস্তুতি গ্রহণের প্রয়োজন ছিলো। মদীনায় যেতে যেসব গোত্র পথে পড়ে সেসব গোত্র এবং আরবের অন্যান্য সম্প্রদায়কে নিজেদের পক্ষে টানা বা কমপক্ষে তাদের সহানুভূতি লাভও জরুরী বলে বিবেচিত হচ্ছিলো। একজন বিচক্ষণ নেতা এবং দুরদর্শী সিপাহসালাররূপে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-ও এ অবশ্যম্ভাবী সংকটের কথা উপলব্ধি করেছিলেন। আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের অনুমতিও তিনি ইতিমধ্যেই লাভ করে ফেলেছিলেন। দীন ইসলামের প্রচার-প্রসার এবং ইসলামে প্রবেশকারীদের পথের অহেতুক অন্তরায় দূর করাও ছিল একটি জরুরী কাজ। এদিকে মদীনায় মুসলমান পুরুষদের সংখ্যা তিন চারশ’র বেশী ছিলো না। যদিও সংখ্যা ও যুদ্ধ সরঞ্জামের দিক থেকে তারা দুর্বল ছিলেন, কিন্তু কাফিরদের দুষ্টামি ও সীমাহীন ঔদ্ধত্য দেখে তাদের আরবী জিদ এবং বীরত্ব মাথাচাড়া দিয়ে উঠতো। তারা বারবার কাফিরদের মুকাবিলা করার এবং তীর তলোয়ার দিয়ে তাদের সমুচিত জবাব দানের অনুমতি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর দরবারে পেশ করছিলেন। এখন যেখানে ইসলামের সভ্যতা এবং ঈমানের শক্তি দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে, মুসলমানরা হৃদয়বিদারক অত্যাচার-অবিচারকে হাসিমুখে বরণ করে নিয়ে দুনিয়ার সম্মুখে ইসলামের প্রতি আসক্তি যে সর্বপ্রকার ভীতি ও প্রলোভনের ঊর্ধ্বে তা সুপ্রমাণিত করে ফেলেছেন। আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে দুরাচারদেরকে শাস্তি দানের এবং আত্মরক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণের অনুমতি লাভের পর অনুমতিও এসে গেছে, তারপরও ঘটনাবলীর ধারাবাহিকতার প্রতি গভীর ভাবে মনোনিবেশ করলে দেখা যাবে যে, হযরত নবী করীম (সাঃ) সব সময়েই যুদ্ধের উপর শান্তিকে এবং প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের উপর ক্ষমাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। মক্কার জনৈক কাফির নেতা কুরয ইব্‌ন জাবির একটি দলকে সাথে নিয়ে মক্কা থেকে এসে মদীনার সন্নিহিত চারণ ভূমিতে হানা দিয়ে মুসলমানদের বিপুল সংখ্যক উট নিয়ে পালিয়ে যায়। মুসলমানরা এ সংবাদ জানতে পেয়ে সাফওয়ান নামক স্থান পর্যন্ত তার পশ্চাদ্ধাবন করেন। কিন্তু শিকার তখন হাতছাড়া হয়ে গেছে। তারা আর শত্রুর দেখা পেলেন না। অগত্যা তারা ফিরে আসেন। এটা ছিল মক্কাবাসীদের পক্ষ থেকে খোলা চ্যালেঞ্জ ও যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। তারা মদীনাবাসীদেরকে বুঝিয়ে দিল যে, আড়াইশ’ মাইল দূর থেকে এসে আমরা মদীনায় তোমাদের ঘরে হানা দিয়ে তোমাদের ধন-সম্পদ লুট করে নিতে পারি। আনুসঙ্গিক অন্যান্য প্রচেষ্টা থেকেও তারা হাত গুটিয়ে ছিল না। তারা একদিকে আবদুল্লাহ ইব্‌ন উবায়্যর সাথে এবং অপর দিকে মদীনার ইয়াহূদীদের সাথে রীতিমত চিঠিপত্র আদান-প্রদানের মাধ্যমে সংযোগ রক্ষা করে চলছিলো এবং ভিতরে ভিতরে এদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্ররোচনা দিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে তুলেছিল।

এ বছরেরই শাবান মাসে কিবলা পরিবর্তনের আদেশ নাযিল হয়। এর কয়েকদিন পরেই শাবান মাস শেষ হওয়ার আগেই রমযানের সাওম ফরয হয়। রমযানের শুরুতেই মদীনায় এ খবরটি পৌঁছলো যে, মক্কাবাসীদের একটা কাফেলা শামদেশ থেকে আসছে এবং মদীনার পাশ দিয়ে তা অতিক্রম করবে। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মক্কাবাসীদের মনে এক প্রকার ভীতি সৃষ্টি এবং কুরয ইব্‌ন জাবিরের হামলার জবাব স্বরূপ মুহাজির ও আনসারদের একটি জামাআতকে মক্কাবাসীদের এ কাফেলাকে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করলেন, যাতে করে তারা উপলব্ধি করতে পারে যে, মদীনাবাসীদের সাথে সম্পর্কের অবনতি তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্যে অত্যন্ত ক্ষতিকর হবে, এমন কি এতে সিরিয়ার সাথে তাদের বাণিজ্যপথ বন্ধও হয়ে যেতে পারে। এ কাফেলাটি আদৌ যুদ্ধের উদ্দেশ্যে প্রেরিত হয়নি-নিছক খবরদারী ও হুশিয়ারী প্রদানই এর উদ্দেশ্য ছিল বিধায় সামরিক গোপনীয়তাও তাঁদেরকে প্রেরণের সময় রক্ষিত হয় নি। ফলে, তাদের রওয়ানা হওয়ার সংবাদ সাথে সাথেই মক্কাবাসীদের কাছে পৌঁছে যায় এবং তারা সতর্ক হয়ে যায়। কাফেলার সর্দার আবূ সুফিয়ান অত্যন্ত সন্তর্পণে কাফেলাকে পাশ কাটিয়ে নিয়ে যেতে সমর্থ হয়। সে যামযাম ইব্‌ন আমর গিফারীকে পারিশ্রমিক দিয়ে রাস্তা থেকেই মক্কায় সংবাদ দিয়ে পাঠালো যে, মুসলমানদের পক্ষ থেকে হামলার আশংকা রয়েছে, সুতরাং নিজেদের বাণিজ্যসম্ভার রক্ষার্থে সাহায্যের জন্য দ্রুত অগ্রসর হও। সংবাদ পাওয়া মাত্র আবূ জাহেল সাতশ’ উট ও তিনশ’ ঘোড়াসহ এক হাজার দুর্ধর্ষ সৈন্যের একটি বাহিনীসহ অত্যন্ত উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে মক্কা থেকে বের হলো। এ বাহিনীর প্রতিটি সৈন্যই ছিল অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত এবং বর্ম পরিহিত। গায়ক-সংবাদ পাঠকরাও তাদের সাথে ছিল। আব্বাস ইব্‌ন আবদুল মুত্তালিব, উত্‌বা ইব্‌ন রবীআ, উমাইয়া ইব্‌ন খালফ, নযর ইব্‌ন হারিছ, আবূ জাহেল ইব্‌ন হিশাম প্রমুখ তেরজন খাদ্য পরিবেশনকারী ছিল। আবূ সুফিয়ানের কাফেলা নিরাপদে মক্কায় উপনীত হলো। মুসলমানদের যে দলটি কেবল কাফেলাওয়ালাদেরকে সতর্ক করার উদ্দেশ্যে গিয়েছিল তারা মদীনায় ফিরে চললেন।

১৩৩
বদর যুদ্ধ
আবু সুফিয়ান আবূ জাহেলের কাছে সংবাদ পাঠালো যে, আমরা নিরাপদে মক্কায় পৌঁছে গিয়েছি। সুতরাং তোমরা ফিরে এসো। কিন্তু আবূ জাহেল তার দুর্ধর্ষ বাহিনীর জন্যে গর্বিত ছিলো। এমনি ফিরে যাওয়াটা তার মনঃপূত হলো না। আসলে আবূ জাহেল কেবল কাফেলার হিফাযতের উদ্দেশ্যে মক্কা থেকে সদলবলে বেরোয়নি, বরং কুরায়শদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে বতনে নাখলার দিকে হযরত নবী (সাঃ)-এর প্রেরিত কয়েকজন মুসলমানের হাতে নিহত কুরায়শদের জনৈক মিত্র আমর ইব্‌ন হাযরামীর হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের ছলে যুদ্ধের পূর্ণ প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রেখেছিলো। যামযাম ইব্‌ন আমর কাফেলাওয়ালাদের পক্ষ থেকে সাহায্যের অনুরোধ পৌঁছানো মাত্র সে সদলবলে বেরিয়ে পড়ে এবং মারমার রবে মদীনার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। কুরায়শ বাহিনীর যাত্রার সংবাদ হযরত নবী (সাঃ) যথাসময়েই পেয়ে যান। তিনি এও জানতে পারলেন যে আবূ জাহেল, উত্‌বা, শায়বা, ওয়ালীদ, খাকলা, উবায়দা, ‘আসী, হুরছ, তুআয়মা, যামআ, আকীল, আবুল বুখতারী, মাসঊদ, বানিয়া, মুনাব্বা, নাওফিল, সাইব, রিফাআ প্রমুখ বড় বড় কুরায়শ সরদাররা এ বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

এ সংবাদ পাওয়া মাত্র হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) একটি পরামর্শ সভা আহবান করে সাহাবায়ে কিরামকে বললেন যে, মক্কা তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদেরকে তোমাদের দিকে রওয়ানা করে দিয়েছে। এদের সাথে মুকাবিলা করার ব্যাপারে তোমাদের অভিমত কি? হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা), হযরত উমর (রা) ও হযরত মিকদাদ (রা) একে একে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত তেজোব্যঞ্জক ও বীরত্বপূর্ণ ভাষায় বললেন : আমরা ঐ বনী ইসরাঈলদের মতো নই যারা হযরত মূসা (আ)-কে বলে দিয়েছিল :

فاذهب انت وربك فقاتلا انا ههنا قاعدون

আপনি আর আপনার প্রভু দু’জনে গিয়ে ফিরাউনের সাথে যুদ্ধ করুন! আমরা এখানে বসে বসে তা উপভোগ করব।

তারপর হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আবার বললেন : কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ব্যাপারে তোমাদের কী অভিমত? দ্বিতীয় বার জিজ্ঞাসার উদ্দেশ্য ছিলো আনসারদের অভিমত সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া। কেননা, উপরিউক্ত তিনজনই ছিলেন মুহাজির। আনসারগণ হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর অভিলাষ উপলব্ধি করলেন। তাই তাদের পক্ষ থেকে হযরত সা‘দ ইব্‌ন মুআয (রা) উঠে দাঁড়ালেন এবং আরয করলেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনার এ প্রশ্নের উদ্দিষ্ট বোধ হয় আমরা আনসাররাই? জবাবে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বললেন : হাঁ, তাই। হযরত সা‘দ (রা) তখন বললেন :

আমরা আপনার প্রতি ঈমান এনেছি। আপনাকে আল্লাহর রাসূল বলে আমরা দৃঢ় বিশ্বাস করি। এটা কেমন করে সম্ভবপর হতে পারে যে, আল্লাহর রাসূল কাফিরদের মুকাবিলা করার জন্যে নির্গত হবেন আর আমরা ঘরে বসে থাকবো? এই কাফিররা তো আমাদের মতো মানুষই! আপনি যদি নির্দেশ দেন যে, ঐ সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়, তাহলে আমরা নিঃসংকোচে আপনার সে নির্দেশও পালন করবো এবং অকাতরে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়বো।

যখন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এ মর্মে আশ্বস্ত হলেন যে, সাহাবায়ে কিরাম যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রয়েছেন, তখন তিনি মদীনা থেকে রওয়ানা করতে মনস্থ করলেন। যুদ্ধে যাবার মতো উপযুক্ত লোকের সংখ্যা ছিলো মোট তিন শ’ দশ, অথবা তিন শ’ বার অথবা তিন শ’ তের জন, শহর থেকে বেরিয়ে যখন তিনি তার বাহিনীর পর্যালোচনা করলেন তখন লক্ষ্য করলেন তিন শ’ তেরজন লোক। এর মধ্যেও কেউ কেউ বয়সে এতোই কম ছিলো যে, যারা যুদ্ধ করার মতো উপযুক্ত হয়নি। তিনি তাদেরকে ফিরে যেতে নির্দেশ দিলেন, কিন্তু তারা ফিরে যেতে রাযী হলেন না, অনেক কাকুতি-মিনতি করে যুদ্ধে অংশগ্রহণের অনুমতি হাসিল করলেন।

১৩৪
এ যুদ্ধে মুসলমানদের সরঞ্জাম ছিল নিম্নরূপ
দুটো মাত্র ঘোড়া—যেগুলোতে হযরত যুবায়র (রা) ও হযরত মিকদাদ (রা) সওয়ার ছিলেন। উট ছিলো সত্তরটি—এর প্রত্যেকটিতে তিন তিন জন চার চার জন করে আরোহী ছিলেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যে উটটিতে সওয়ার ছিলেন, তার পিঠেও আরো দু’তিনজন আরোহী ছিলেন। তারপরও অনেকে সওয়ারী হীন ছিলেন। এ ইসলামী বাহিনীটি যখন বদর প্রান্তরে উপস্থিত হলো, তখন দেখা গেলো যে, কাফিররা ইতিপূর্বেই সেখানকার উঁচু ভূমিতে এসে তাঁবু গেড়ে ফেলেছে। অগত্যা মুসলমানদেরকে নীচু ও বালুময় অংশেই অবস্থান নিতে হলো। কিন্তু বদরের পানির ঝরনাগুলো মুসলমানদের অংশেই পড়লো। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তার বাহিনীর লোকদেরকে বলে দিলেন, কাফিরদের কেউ পানি নিতে আসলে তাদেরকে বাধা দিও না। সাহাবায়ে কিরাম হুযূর (সাঃ)-এর জন্যে একটি ছোট ঝুপড়ি তৈরী করে দিলেন। তিনি সেখানে ইবাদত ও দু‘আ করতেন। সংখ্যায় সাহাবায়ে কিরাম তো কুরায়শদের এক-তৃতীয়াংশ ছিলেন, কিন্তু সাজ-সরঞ্জামের দিক থেকে তারা তাদের এক-শতাংশও ছিলেন না। কাফিরদের সবাই ছিলো বর্ম পরিহিত এবং প্রত্যেকে বয়সে ছিলো যুবক। পক্ষান্তরে মুসলমানদের সাধারণ অবস্থা ছিলো তারা ক্ষুধা কাতর, দুর্বল, অসুস্থ ও ক্ষীণকায়। সকলের কাছে মামুলী হাতিয়ারও পুরোপুরি ছিলো না। কারো কাছে হয়তো তলোয়ার আছে, কিন্তু বল্লম বা ধনুক নেই, কারো কাছে হয়তো বল্লম আছে, কিন্তু তলোয়ার নেই। মুসলমানগণ সেনা ছাউনী স্থাপন করলেন। ওদিকে কুরায়শরা উমায়র ইব্‌ন ওয়াহাব জামূহীকে গোয়েন্দাগিরির জন্য পাঠালো। মুসলমান বাহিনীর সংখ্যা জানার জন্য তারা তাকে পাঠিয়েছিলো। উমায়র ফিরে গিয়ে জানালো যে, মুসলমানদের সংখ্যা তিন শ’ দশের বেশী নয় এবং এদের মধ্যে কোন দু’জন অশ্বারোহী আছে। কাফিরদের দর্প যে কী পরিমাণ ছিলো তা এর দ্বারাই অনুমেয় যে, উত্‌বা ইব্‌ন রবীআ মুসলমানদের এ সংখ্যাস্বল্পতার কথা শুনেই বলে উঠলো, এ অল্প কয়টি লোকের সাথে যুদ্ধ করে কাজ নেই, চল আমরা যুদ্ধ না করেই ফিরে যাই। কেননা, আমাদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে এত বেশী যে, এ হবে এক অসম যুদ্ধ। এতে বাহাদুরীর কিছুই নেই। কিন্তু আবূ জাহেল তাতে সম্মত হলো না। সে বললো : হোকগে,এদের মূলোৎপাটন করাই হবে আমাদের কাজ।

১৩৫
যুদ্ধ শুরু
অবশেষে পরদিন অর্থাৎ দ্বিতীয় হিজরীর ১৭ই রমযান রণক্ষেত্র জেগে উঠলো। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) প্রথমে তার ইবাদতের সেই ছোট্ট ঝুঁপড়ীতে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করতে লাগলেন :

اللهم ان تهلك هذه العصابة من اهل الإيمان فلا تعب في الارض ابدا

হে আল্লাহ, যদি ঈমানদারদের এই দলটিকে তুমি ধ্বংস করে দাও, তবে যমীনে তোমার ইবাদতকারী কেউ থাকবে না।

তারপর তিনি দু’রাকাআত নামায পড়লেন। তারপর কিছুক্ষণের জন্য তিনি তন্দ্রাগ্রস্ত হলেন। তারপরই মুচকি হাসতে হাসতে বেরিয়ে এসে বললেন :

سيهزم الجمع ويولون البر .

কাফির বাহিনী পরাজিত হবে এবং যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করবে।

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন যে, যুদ্ধের সূচনা তোমরা করবে না। মুসলমানদের মধ্যে আশিজন অথবা তার চাইতে আরো দু’তিনজন বেশী সংখ্যক মুহাজিরীন এবং অবশিষ্টরা আনসার ছিলেন। আনসারদের মধ্যে আওস গোত্রসমূহের একষট্টিজন ও ১৭০ জন খাযরাজ গোত্রের লোক ছিলেন। উভয় পক্ষের সৈন্যরা সারিবদ্ধ হলেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর হাতে একটি তীর ছিল। তিনি সেই তীরের ইংগিতে সারিগুলোকে বিন্যস্ত করছিলেন। তারপর আরবের প্রথা অনুসারে কাফিরদের মধ্য থেকে সর্বপ্রথম রবীআর পুত্রদ্বয়, উত্‌বা ও শায়বা এবং ওয়ালীদ ইব্‌ন উত্‌বা যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হলো এবং মুসলিম সৈন্যদের তিনজনকে দ্বন্দ্বযুদ্ধের জন্য আহবান জানালো। এদের মুকাবিলা করার জন্যে আনসারদের মধ্য থেকে আফরার পুত্রদ্বয় আওফ ও মুআব্বিয এবং আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন রাওয়াহা (রা) বেরিয়ে এলেন। উত্‌বা জিজ্ঞেস করলো : من انتم -তোমরা কারা হে? তারা জবাব দিলেন : رهط من الانصار আমরা আনসার অর্থাৎ মদীনাবাসী মুসলমান। উত্‌বা অত্যন্ত দর্পের সাথে শ্লেষাত্মক সুরে বলে উঠলো :

ما لنا بكم من حاجة

তোমাদের সাথে আমাদের লড়বার প্রয়োজন নেই।

তার পর চীৎকার করে বললো :

محمد اخرج الينا احفاءنا من قومنا

হে মুহাম্মদ! আমাদের স্বজাতীয় এবং সমকক্ষদেরকে আমাদের সাথে মুকাবিলার জন্যে প্রেরণ করো!

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) উত্‌বার মুকাবিলায় হযরত হামযা ইব্‌ন আবদুল মুত্তালিব (রা)-কে, শায়বার মুকাবিলায় হযরত উবায়দা ইবনুল হারিছ (রা)-কে এবং উত্‌বার পুত্র ওয়ালীদের মুকাবিলায় হযরত আলী ইব্‌ন আবূ তালিব (রা)-কে অবতীর্ণ হতে আদেশ দিলেন। উত্‌বা এ তিন জনের নাম কি কি জিজ্ঞেস করলো। অথচ এদেরকে সে খুব ভাল করেই চিনতো। এঁদের নাম শুনে বললো : হাঁ, তোমাদের সাথে আমাদের লড়াই হতে পারে। দ্বন্দ্বযুদ্ধ শুরু হলো। হযরত হামযা (রা) এবং হযরত আলী (রা) প্রথম আঘাতেই উত্‌বা এবং ওয়ালীদ পিতাপুত্র উভয়কে পরাভূত ও কতল করলেন। শায়বার মুকাবিলায় হযরত উবায়দা (রা) আহত হলেন। যখম ছিল মারাত্মক, তাই সে আঘাত তিনি সহ্য করতে পারলেন না। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। হযরত আলী (রা) তখন অগ্রসর হয়ে শায়বাকে হত্যা করলেন এবং উবায়দা (রা)-কে উঠিয়ে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কাছে নিয়ে আসলেন। তারপর কাফিররা সারিবদ্ধ হলো। এদিকে মুসলমানরাও সক্রিয় হলেন। উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ শুরু হলো। উভয় পক্ষ বীরত্বের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করলো। ফলাফল দাঁড়ালো এই যে, কাফির পক্ষ তাদের সত্তর জন বীরের শবদেহ এবং নব্বই জনকে বন্দী অবস্থায় রেখে রণে ভঙ্গ দিয়ে পলায়ন করলো। ব্যাপক যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর হুযূর (সাঃ) একটি ছায়াযুক্ত স্থানে দাঁড়িয়ে যুদ্ধের গতিবিধি প্রত্যক্ষ করছিলেন এবং নিজ বাহিনীকে প্রয়োজনীয় নির্দেশাদি দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি মুসলমানদেরকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন যে, কুরায়শদের সাথে আগত বনী হাশিম-এর লোকজন যেহেতু স্বেচ্ছায় ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে নয়, কুরায়শদের চাপের মুখে এসেছেন তাই তাদের প্রতি যেন কঠোরতা প্রদর্শন না করা হয় এবং আব্বাস ইব্‌ন আবদুল মুত্তালিবকে যেন হত্যা করা না হয়। অনুরূপভাবে আবদুল বুখতরী সম্পর্কেও তিনি বলে রেখেছিলেন যে, তার ব্যাপারেও যেনো তেমন কঠোরতা অবলম্বন না করা হয়। এ নির্দেশ শুনে আবূ হায়ফা বলে উঠলেন : এটা কেমন করে হতে পারে যে, আমি আমার সহোদরকে হত্যা করবো এবং আব্বাসকে ছেড়ে দেবো। আব্বাস যদি আমার মুকাবিলায় আসেন, তাহলে তো নির্ঘাত তাকে আমি হত্যা করবো, একটুও দ্বিধাবোধ করবো না। পরবর্তীকালে হুযায়ফা এজন্যে অত্যন্ত লজ্জিত হয়েছিলেন এবং এজন্যে দুঃখ প্রকাশও করেছিলেন। মাহ্‌যার ইব্‌ন যিয়াদের মুকাবিলা হয় আবুল বুখতরীর সাথে। মাহযার ইব্‌ন যিয়াদ বলেন যে, আমাদের প্রতি তোমার সাথে লড়তে নিষেধ আছে, তাই তুমি আমার সম্মুখ থেকে চলে যাও! আবুল বুখতরী তার এমন একজন সাথীকে বাঁচাতে প্রয়াস পায়-যাকে মাহযার ইব্‌ন যিয়াদ হত্যা করতে যাচ্ছিলেন। এ প্রয়াস চালাতে গিয়ে আবুল বুখতরী নিহত হয়। উমাইয়া ইব্‌ন খাল্‌ফ এবং তার পুত্র আলী ইব্‌ন উমাইয়া নিজেদের প্রাণ রক্ষার জন্যে অস্থির হয়ে ছুটাছুটি করছিলো। উমাইয়া ও আবদুর রহমান ইব্‌ন আওফের মধ্যে জাহিলিয়াতের যুগে বন্ধুত্ব ছিলো। হযরত আবদুর রহমান ইব্‌ন আওফ (রা) তাকে এ অবস্থায় দেখে নিজের হিফাযতে নিয়ে নেন এবং উমাইয়ার হাত ধরে অগ্রসর হতে থাকেন। এমন সময় হযরত বিলাল (রা) তাকে দেখতে পেয়ে চীৎকার করে আনসার যুবকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং সবাই মিলে পিতাপুত্র দু’জনকে হত্যা করেই তবে ছাড়েন। হযরত উমায়র ইব্‌ন হুমাম আনসারী (রা) নামক এক সাহাবী খেজুর খেতে খেতে হুযূর (সাঃ)-এর কাছে এসে আরয করেন : যদি আমি কাফিরদের সাথে লড়তে লড়তে মারা যাই তা হলে কি সাথে সাথে জান্নাতে চলে যাবো? প্রিয়নবী (সাঃ) বললেন : হাঁ। তখন ঐ সাহাবী হাতের খেজুর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তলোয়ার হাতে দুশমনদের মধ্যে ঢুকে পড়েন এবং লড়াই করতে করতে শহীদ হয়ে যান।

লড়াই যখন খুব জোরসোরে চলছিল তখন হুযুর (সাঃ) এক মুষ্টি ধূলো মাটি নিয়ে তাতে দম করে তা কাফিরদের দিকে নিক্ষেপ করেন। সাথে সাথে কাফির সৈন্যরা পালাতে শুরু করে। ঘটনাক্রমে এক আনসারী তরুণ হযরত মুআয ইব্‌ন আমর (রা)-এর সাথে আবূ জাহেলের মুকাবিলা হয়। আবূ জাহেলের দেহ লৌহ বর্মাদির দ্বারা পূর্ণ আচ্ছাদিত ছিলো। হযরত মুআয ইব্‌ন আমর (রা) এক ফাঁকে আবূ জাহেলের পা খোলা দেখে সেই বরাবর এমন জোরে কোপ দিলেন যে, পা দূরে গিয়ে ছিটকে পড়লো। আবূ জাহেলের পুত্র ইকরামা পিতার এ শোচনীয় অবস্থা লক্ষ্য করে মুআয ইব্‌ন আমর (রা)-এর উপর এমনি এক আঘাত হানলো যে, তাঁর বাম হাত স্কন্ধের নিকট থেকে কেটে গিয়ে ঝুলে পড়লো। হাতটি তখন কেবল চামড়ার উপরই লটকে ছিলো। হযরত মুআয (রা) সারা দিন এ অবস্থাতেই লড়াই করে যেতে লাগলেন। ঝুলন্ত হাতটি যখন একটা বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো তখন তিনি নিজেই হাতটি পায়ের নীচে রেখে টান দিয়ে বিচ্ছিন্ন করে ফেললেন। তারপর আনসারের অপর এক তরুণ মুআব্বিয ইব্‌ন আফরা আবূ জাহেলের নিকটবর্তী হয়ে এমনি এক আঘাত হানলেন যে, সে অর্ধমৃত হয়ে গেলো। কাফিররা রণক্ষেত্র ছেড়ে পালালো আর মুসলমানেরা বিজয় পতাকা উড্ডীন করলো। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আবূ জাহেলের শবদেহ যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে আছে কিনা তদন্ত করে দেখতে নির্দেশ দিলেন। নির্দেশ পাওয়া মাত্র হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন মাসঊদ (রা) যুদ্ধক্ষেত্রে শবদেহগুলো পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলো। আবূ জাহেলকে অর্ধমৃত অবস্থায় পাওয়া গেলো। হযরত আবদুল্লাহ ইব্‌ন মাসঊদ (রা) তার বুকের উপর চেপে বসে বললেন : আল্লাহর দুশমন, দেখ, আল্লাহ তোকে কিভাবে অপদস্থ করলেন! আবূ জাহেল জিজ্ঞেস করলো, যুদ্ধের ফলাফল কী হলো? হযরত আবদুল্লাহ ইব্‌ন মাসঊদ (রা) বললেন : মুসলমানদের জয় এবং কাফিরদের পরাজয় হয়েছে। একথা বলেই তিনি তার শির কাটতে উদ্যত হলেন। আবূ জাহেল বললো : আমার গলাটি কাঁধের একেবারে নিকটে এমনভাবে কাটবে যেনো অন্যান্য কাটা শিরের তুলনায় তা একটু দীর্ঘ বলে মনে হয় এবং স্পষ্ট বোঝা যায় যে, এটা সরদারের শির। হযরত আবদুল্লাহ ইব্‌ন মাসঊদ (রা) তার শির কেটে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর খিদমতে এসে উপস্থিত হলেন এবং তাঁর কদম মুবারকের নিকট তা ফেলে দিলেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আবূ জাহেলের কর্তিত শির দেখে আল্লাহর শোকর আদায় করলেন। এ যুদ্ধে মোট চৌদ্দজন সাহাবী শহীদ হন। এঁদের মধ্যে ছয়জন ছিলেন মুহাজির এবং আটজন আনসার। যুদ্ধান্তে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) শহীদদের লাশ দাফন করলেন। মুশরিকদের লাশ একটি বড় গহবরে বা কূপে ফেলে দিয়ে মাটি চাপা দেয়া হলো। কেবল উমাইয়া ইব্‌ন খালফের লাশ শতধাবিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে উঠিয়ে নিয়ে কূপে নিক্ষেপ করা সম্ভবপর হয়নি। তার লাশ যেখানে ছিলো, সেখানেই মাটি চাপা দেয়া হয়।

কাফিররা এমনি দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্যভাবে মাঠ পরিত্যাগ করেছিল যে, তাদের অর্ধমৃত নেতা আবূ জাহেলকে পর্যন্ত তারা রণক্ষেত্রেই আহত অবস্থায় ফেলে যায়। হারিছ ইব্‌ন যামআ, আবুল কায়স ইবনুল ফাকিহ, আলী ইব্‌ন উমাইয়া ও ‘আস ইব্‌ন খাবআ ছিল বয়সে তরুণ। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মক্কায় অবস্থানের সময় এরা তার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন অথবা সম্ভবত মুসলমান হয়ে গিয়েছিলেন। নবী করীম (সাঃ)-এর মদীনায় হিজরতের পর তাদের আত্মীয়-স্বজনরা তাদেরকে অত্যন্ত কঠোরভাবে শাসন করে এবং মুরতাদ হওয়ার প্ররোচনা দেয়। প্রাণ রক্ষার্থে বাহ্যিকভাবে তাঁরা নবী করীম (সাঃ)-এর সাথে সম্পর্ক ত্যাগের কথা ঘোষণা করতে বাধ্য হন এবং কাফির বাহিনীর সাথে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে যুদ্ধক্ষেত্রেই নিহত হন। মক্কার যেসব বড় বড় সরদার এ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিল তাদের প্রায় সবাই নিহত হয়। পরাজিত এ কাফির বাহিনী মক্কায় প্রত্যাবর্তন করলে ঘরে ঘরে কান্নার রোল উঠে। হযরত নবী করীম (সাঃ) যুদ্ধলব্ধ সমস্ত গনীমতের মাল একত্রিত করে বনু নাজ্জার বংশীয় আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন কা‘বের হাতে অর্পণ করেন। হযরত আবদুল্লাহ ইব্‌ন রাওয়াহা (রা) এবং হযরত যায়দ ইব্‌ন হারিছা (রা)-কে মদীনার উঁচু ও নীচু এলাকায় যুদ্ধজয়ের সুসংবাদ দানের জন্যে প্রেরণ করলেন। হযরত উসামা ইব্‌ন যায়দ—যাঁকে হযরত নবী করীম (সাঃ) মদীনায় তাঁর নায়েবরূপে রেখে এসেছিলেন, তিনি বলেন যে, যুদ্ধজয়ের এ সুসংবাদ ঠিক ঐ সময় আমাদের কাছে পৌঁছলো যখন আমরা নবীনন্দিনী ও হযরত উসমান (রা)-এর সহধর্মিণী হযরত রুকাইয়া (রা)-কে দাফন করছিলাম। মদীনায় ১৮ই রমযান তারিখে এ সুসংবাদটি পৌঁছে।

যুদ্ধশেষে বদরের যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে হযরত নবী করীম (সাঃ) মদীনার দিকে রওয়ানা হলেন। সাফরা নামক স্থানে এসে তিনি আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে সমস্ত গনীমতের মাল মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করলেন এবং যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে নযর ইব্‌ন হারিছের প্রাণদণ্ডাদেশ দান করলেন। সেখান থেকে রওয়ানা হয়ে আরকুয যাবিয়া নামক স্থানে পৌঁছে উকবা ইব্‌ন আবূ মুআয়ত ইব্‌ন আমর ইব্‌ন লায়তের প্রাণ দণ্ডাদেশ দান করলেন। বদর যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে এরা দু’জন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ও ইসলামের সঙ্গে চরম শত্রুতা করতো এবং বিবাদ ও ষড়যন্ত্র করার ব্যাপারে আবূ জাহেলের সমকক্ষ ছিলো। নযর ইব্‌ন হারিছকে সাফরা নামক স্থানে হযরত আলী (রা) এবং উকবা ইব্‌ন আবূ মুআয়তকে আরকুয যাবিয়া নামক স্থানে হযরত আসিম ইব্‌ন ছাবিত আনসারী (রা) কতল করেন। তারপর হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বন্দীদেরকে এবং তাদের প্রহরায় নিযুক্ত বাহিনীকে পিছনে রেখে দ্রুত মদীনার দিকে রওয়ানা হন। তার একদিন পরে বন্দীরাও মদীনায় পৌঁছে।

১৩৬
যুদ্ধবন্দীদের প্রতি সদ্ব্যবহারের তাকীদ
যুদ্ধবন্দীরা মদীনায় পৌঁছলে হযরত নবী করীম (সাঃ) তাদেরকে সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে তাদের সাথে সদ্ব্যবহারের তাকীদ দিলেন। বন্দীদের মধ্যে আবূ আযীয ইব্‌ন উমায়র যুদ্ধে কাফির বাহিনীর পতাকাবাহক ছিলো। এ দিকে সে হযরত মুসআব ইব্‌ন উমায়র (রা)-এর ভাইও ছিলো।

স্বয়ং আবূ আযীযের বর্ণনা : যখন মুসলমানরা আমাকে বন্দী করে বদর থেকে মদীনার দিকে নিয়ে চলেছিলো তখন আমি আনসারদের একটি দলের প্রহরাধীন ছিলাম। ঐ আনসার দলটি যখন খাবার খেতে বসতেন, তখন তারা আমাকে রুটি খেতে দিয়ে নিজেরা খেজুর খেয়েই দিন কাটাতেন। আমি লজ্জায় তাদের কোন একজনের দিকে রুটি ঠেলে দিলে সে ব্যক্তি পুনরায় আমাকে তা ফিরিয়ে দিতো। মদীনা পৌঁছার পর আবূ আযীয আবূ বশীর আনসারীর ভাগে পড়লো। হযরত মুসআব ইব্‌ন উমায়র (রা) আবূ বশীর আনসারীর সাথে দেখা করে বললেন : একে খুব দেখে শুনে রাখবে এবং এর সাথে খুবই কঠোর ব্যবহার করবে। এর মা খুবই ধনাঢ্য মহিলা। আবূ আযীয যখন লক্ষ্য করলো যে, তার আপন ভাই তার প্রতি কঠোরতা প্রদর্শনের জন্য তার রক্ষণাবেক্ষণকারীকে তাকীদ দিচ্ছেন, তখন সে বলে উঠলো : ভাইজান, এই কি ভাইয়ের প্রতি আপনার শুভ কামনা? হযরত মুসআব (রা) জবাব দিলেন : তুই আমার ভাই না। আমার ভাই হচ্ছে তোর রক্ষণাবেক্ষণকারী-ই। আবূ আযীযের মা চার হাজার দিরহামের মুক্তিপণ পাঠিয়ে ছেলেকে মুক্ত করেন। বদর যুদ্ধে মুশরিকদের পরাজয়ের সংবাদ মক্কায় পৌঁছলে যেভাবে কাফিররা বিষন্ন হলো, ঠিক তেমনি যেসব মুসলমান হিজরত করে আসতে পারেননি বরং নিজেদের মুসলমান হওয়ার কথা গোপন করে মক্কায় বসবাস করছিলেন তারা এ সংবাদে অত্যন্ত উল্লসিত হলেন। আবূ লাহাব কোন কারণে এ যুদ্ধে শরীক হতে পারেনি। সে যখন মক্কার বড় বড় সরদারদের নিহত ও কুরায়শদের পরাজিত হওয়ার সংবাদ জানতে পারলো তখন এতই মর্মাহত হলো যে, এর এক সপ্তাহ পরে সে মারাই গেলো।

১৩৭
যুদ্ধবন্দী সংক্রান্ত নীতি
যুদ্ধবন্দীদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য হযরত নবী করীম (সাঃ) মসজিদে নববীতে সাহাবায়ে কিরামের সঙ্গে পরামর্শে বসলেন। হযরত উমর ফারূক (রা) বললেন : আমার অভিমত হচ্ছে, বন্দীদের মধ্যে আমাদের যার যে নিকটাত্মীয় রয়েছে সে তাকে নিজ হাতে হত্যা করবে যাতে করে মুশরিকরা উত্তমরূপে উপলব্ধি করতে পারে যে, আমাদের অন্তরে আমাদের নিকটাত্মীয়দের চাইতে আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি অনুরাগ অনেকগুণ বেশী রয়েছে এবং ইসলামের মুকাবিলায় আত্মীয়তা বন্ধন আমাদের কাছে অতি তুচ্ছ ব্যাপার। হযরত আবূ বকর (রা) বললেন : আমার অভিমত হচ্ছে ফিদয়া (মুক্তিপণ) গ্রহণ করে এদেরকে ছেড়ে দেয়া হোক। এতে মুসলমানরা যেমন কিছু অর্থ লাভ করে যুদ্ধাস্ত্র প্রভৃতি কিনে নিতে পারবে, অপরদিকে যুদ্ধবন্দীদের অনেকেই হয়তো পরবর্তীকালে ইসলাম গ্রহণের তাওফীক লাভ করবে। হযরত আবূ বকর (রা)-এর অভিমতকেই হযরত নবী করীম (সাঃ)-এর মনঃপূত হলো। কোনো কোনো বন্দীকে বিনা মুক্তিপণেই মুক্তি দেয়া হলো। মাথা প্রতি চার হাজার দিরহাম থেকে নিম্নতম এক হাজার দিরহাম মুক্তিপণ পাঠিয়ে মক্কাবাসীরা তাদের বন্দীদেরকে ছাড়িয়ে নেয়। যে সমস্ত বন্দী লেখাপড়া জানতো আর মুক্তিপণ আদায়ের সামর্থ্য তাদের ছিল না, তাদেরকে বলা হলো দশটি করে মুসলিম শিশুকে লেখাপড়া শিক্ষা দিয়ে নিজেদেরকে মুক্ত করে নাও। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কন্যা যয়নাব (রা) তখনো মক্কায় তাঁর স্বামী আবুল ‘আসের সাথে বসবাস করতেন। আবুল ‘আসও বন্দীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। হযরত যয়নাব (রা) তাঁর গলার হার খুলে আবুল ‘আসের মুক্তিপণরূপে প্রেরণ করেছিলেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সাহাবায়ে কিরামকে ডেকে বললেন : তোমরা যদি সঙ্গত মনে করো তা হলে যয়নাবের হারটি ফিরিয়ে দাও। কেননা এটা তার মা খাদীজাতুল কুবরা (রা)-এর স্মৃতিরূপে তাঁর কাছে রয়েছে। সবাই খুশীমনে সে প্রস্তাব গ্রহণ করলেন এবং আবুল ‘আসকে ছেড়ে দিলেন। আবুল ‘আস মক্কায় গিয়েই হযরত যয়নাব (রা)-কে মদীনায় হযরত নবী করীম (সাঃ)-এর কাছে পাঠিয়ে দেন। এ ঘটনার দীর্ঘ ছয় বছর পর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।

১৩৮
মক্কায় কাফিরদের প্রতিশোধস্পৃহা
মক্কায় এ পরাজয়ের পর যে প্রতিক্রিয়া হয় তা হয় অতি সংগোপনে। নিহতদের উত্তরাধিকারীরা উচ্চৈঃস্বরে কোন বিলাপ করেনি। কেননা এ সংবাদে মুসলমানরা উল্লসিত হতো। সাফওয়ান ইব্‌ন উমাইয়া তার নিহত পিতা উমাইয়া ও সহোদর আলীর রক্তের প্রতিশোধ নেয়ার উদ্দেশ্যে উমায়র ইব্‌ন ওয়াহবকে মদীনায় গিয়ে গোপনে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে হত্যা করার জন্যে প্ররোচিত করে। উমায়র ইব্‌ন ওয়াহব বিষমাখা তলোয়ার নিয়ে মক্কা থেকে মদীনায় গিয়ে হাযির হলো। তাকে দেখে কেন যেন হযরত উমর (রা)-এর মনে সন্দেহ হলো। তিনি উমায়রের তলোয়ারের হাতল ধরে তাকে নিয়ে নবী করীম (সাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত হলেন। হযরত নবী (সাঃ) বললেন, উমর! তুমি উমায়রকে ছেড়ে দাও! তারপর তিনি উমায়রকে কাছে ডেকে নিয়ে বললেন : বল তো, তুমি কেন এসেছিলে? জবাবে উমায়র বললো : আমার ছেলে আপনাদের হাতে বন্দী, তাকে মুক্ত করার জন্যে এসেছি। দয়া করে তাকে আপনি মুক্ত করে দিন! হযরত নবী করীম (সাঃ) বললেন : সত্যি কথা বলছো না কেন, আমাকে হত্যা করার জন্য সাফওয়ান তোমাকে প্ররোচনা দিয়ে পাঠায়নি? তিনি সাফওয়ান ও উমায়রের গোপন পরামর্শের খুঁটিনাটি বিবরণ দিয়ে দিলেন। উমায়র তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেন : আমি এক্ষুনি মুসলমান হচ্ছি এবং স্বীকার করছি যে, আপনি নিঃসন্দেহে আল্লাহর রাসূল। কেননা, এ ব্যাপারটি সাফওয়ান ও আমি ছাড়া তৃতীয় কোনো ব্যক্তির ঘুণাক্ষরেও কিছু জানা ছিলো না।

বদর যুদ্ধে আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদের দ্বারা মুসলমানদের সাহায্য করেন। ফেরেশতাদের যুদ্ধে অংশগ্রহণের কথা স্বয়ং কুরায়শরা মক্কায় গিয়ে বর্ণনা করে। মদীনার কোন কোন মুশরিক যুদ্ধের দৃশ্য উপভোগ করার উদ্দেশ্যে যুদ্ধক্ষেত্রের আশেপাশে পাহাড়ের উপর বসেছিল অথবা ঘটনাচক্রেই তারা সেসব পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে যুদ্ধের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছিলো। তাদের বর্ণনা: আমরা ঠিক যুদ্ধের সময় আমাদের মাথার উপর দিয়ে একটি মেঘখণ্ড যুদ্ধের দিকে যেতে দেখলাম। সে মেঘখণ্ড যখন আমাদের অতি নিকট দিয়ে অতিক্রম করছিলো তখন আমরা তাতে ঘোড়ার হ্রেষা ধ্বনি শুনতে পাই। কেউ একজন তখন বলছিলো, দ্রুত অগ্রসর হও! বর্ণনাকারী বলেন, এ আওয়াজ শুনে আমরা এতই ভীত-বিহ্বল হয়ে পড়লাম যে, ভয়ে আমার চাচাতো ভাই ঘটনাস্থলেই মারা গেলো।

বদর যুদ্ধশেষে ২২শে রমযান হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মদীনায় আসেন। এ রমযান মাসের শেষ দিকে সাদাকায়ে ফিতর ওয়াজিব হয়। ঈদের নামাযদ্বয় এবং কুরবানীও এ বছরই ধার্য হয়। এ বছরই হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর দ্বিতীয় কন্যা উম্মে কুলছুম (রা)-কে হযরত উসমান (রা)-এর সাথে শাদী দেন এবং তিনি ‘যিন্‌নূরায়ন’ বলে অভিহিত হন। এ বছরই বদর যুদ্ধের পরে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর কনিষ্ঠা কন্যা হযরত ফাতিমা (রা)-এর শাদী হযরত আলী (রা)-এর সাথে সম্পাদন করেন।

মক্কার কাফিরদের মনে দ্রুত প্রতিহিংসার বহ্নি জ্বলে উঠলো। বদর যুদ্ধের ছ’মাস পর আবূ সুফিয়ান দুইশ’ অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে যুদ্ধার্থে মক্কা থেকে বের হলো। এরা মদীনার নিকটবর্তী স্থানে পৌঁছতেই হযরত নবী করীম (সাঃ) সংবাদ পেয়ে গেলেন। তিনিও মুসলমানদেরকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। আবূ সুফিয়ান খেজুর বাগান জ্বালিয়ে দিয়ে পলায়ন করলো। সাথে সাথে শিকারের উদ্দেশ্যে সেখানে আগত দুই ব্যক্তিকে তারা হত্যাও করে যায়। ঐ নিহত দু’ ব্যক্তির একজন হলেন হযরত সাঈদ ইব্‌ন আমর আনসারী (রা) এবং অপরজন তার একজন চুক্তিবদ্ধ মিত্র। মুসলমানদের আগমন সংবাদ পেতেই কাফির বাহিনী পালিয়ে গেল। তারা সংঘর্ষে লিপ্ত হতে সাহস পায়নি। পলায়নপর কাফির বাহিনী দ্রুত পলায়নের উদ্দেশ্যে ছাতুর বস্তাসমূহ ফেলে দিয়ে যায়। মুসলমানরা কিদর নামক স্থান পর্যন্ত তাদের পশ্চাদ্ধাবন করেন এবং স্থানে স্থানে তারা ছাতুর বস্তা পান। হযরত নবী (সাঃ) সদলবলে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন। আরবী ভাষায় ছাতুকে সাবীক বলা হয়ে থাকে। তাই এ যুদ্ধ পত্রটি সাবীক অভিযান নামে খ্যাত হয়। সাবীক অভিযানটি দ্বিতীয় হিজরীর যিলহাজ্জ মাসের প্রথম দিকে পরিচালিত হয়। যিলহাজ্জ মাসের শেষ পর্যন্ত হযরত নবী করীম (সাঃ) মদীনায় অবস্থান করেন এবং আর কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা এ বছর ঘটেনি।

১৩৯
হিজরী তৃতীয় বর্ষ
আবদুল্লাহ ইব্‌ন উবায়্য ইব্‌ন সলুলের কথা পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে যে, মদীনাবাসীরা তাকে তাদের বাদশাহ বানাতে উদ্যত ছিলো। হযরত নবী করীম (সাঃ)-এর মদীনা আগমনে তার সে বাদশাহীর স্বপ্ন ভণ্ডুল হয়ে যায়। তাই মুসলমানদের প্রতি সে অন্তরে গভীর বিদ্বেষ পোষণ করতো। কিন্তু যেহেতু সে ছিল ধুরন্ধর ব্যক্তি, তাই সে তা তার অন্তরে গোপন রাখে। তারপর তলে তলে মক্কাবাসীদের সাথে ষড়যন্ত্র করে মদীনাবাসীদেরকে প্রকাশ্যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উসকিয়ে দিতে প্রয়াস পায়। কিন্তু তাও পণ্ড হয়ে যায়। মুসলমানদের বদর যুদ্ধ বিজয় প্রত্যক্ষ করে সে ভীত হয় এবং বাহ্যত ইসলাম গ্রহণ করে। কিন্তু অন্তরে যেহেতু মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করতো, তাই এ বাহ্যিক ইসলাম গ্রহণে তার কোনই উপকার হয়নি বরং তার অন্তরে লালিত এ বিদ্বেষ মুসলমানদের জন্যে পূর্বের চাইতে বেশী মারাত্মক প্রতিপন্ন হয়। তার নেতৃত্বাধীন ইয়াহূদীটি বলে উঠলো : অধঃপাতে যাও! মক্কাবাসীরা হচ্ছে আরবদের বাদশাহ এবং অভিজাত শ্রেণী। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যদি তাদেরকেই পদানত করে ফেলে, তবে এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটাই অর্থহীন।

এ সংবাদটির যথার্থতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর কা‘ব ইব্‌ন আশরাফ মদীনা ছেড়ে মক্কায় চলে গেল। মক্কায় গিয়ে বদর যুদ্ধে নিহতদের শোকগাথা লিখতে এবং লোকদেরকে শোনাতে লাগলো। বেশ কয়েকদিন পর্যন্ত সে তাদেরকে এসব শোকগাথা শোনাতে শোনাতে তাদের প্রতিশোধ কামনাকে তীব্রতর করার কাজে ব্যস্ত রইলো। তারপর মদীনায় প্রত্যাবর্তন করে মুসলমানদের নিন্দাসূচক কবিতা লিখে বিষোদগার করতে লাগলো। ইয়াহূদীদের গোটা সম্প্রদায়ই ছিলো সুদখোর এবং বড় বড় মহাজন। আওস ও খাযরাজ গোত্রের লোকেরা তথা মদীনায় গোটা আনসার সম্প্রদায় ছিলো তাদের খাতক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেকটা তাদের উপর নির্ভরশীল। নিজেদের আর্থিক সমৃদ্ধি এবং ধুরন্ধর বুদ্ধির জন্যে তাদের গর্বের অন্ত ছিলো না। তারা নিজেদেরকে অত্যন্ত অভিজাত শ্রেণী এবং আশেপাশের প্রতিবেশী গোত্রসমূহের অশিক্ষিত ও গবেট মনে করে তাদেরকে পাত্তাই দিতো না। বদর যুদ্ধের পর তারা মক্কার কুরায়শদের পূর্ণ সমর্থক ও সহযোগী শক্তিরূপে সক্রিয় হয়ে উঠলো। আবদুল্লাহ ইব্‌ন উবায়্য ও ইয়াহূদীদের মধ্যে সখ্যতা প্রতিষ্ঠিত হলো এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে যেসব মুশরিক এ পর্যন্ত শির্‌ক, মূর্তিপূজা এবং মুসলমানদের প্রতি শত্রুতায় অবিচল ছিল, তাদেরকেও সে বাহ্যিকভাবে ইসলাম গ্রহণের পরামর্শ দেয় এবং এ শ্রেণীর লোকদের নেতৃত্বে সে আসীন থাকে। এরাই মুনাফিক বলে কুখ্যাতি অর্জন করে। এই মুনাফিকদের সাথে কিছু ইয়াহূদীও এসে যোগ দেয় এবং বাহ্যত তারাও ইসলাম গ্রহণ করে ফায়দা লুটতে থাকে।

১৪০
ইয়াহূদীদের শত্রুতামূলক আচরণ
মুসলমানদের কর্তৃত্ব এবং ইসলামের ব্যাপক প্রচার-প্রসারকে ইয়াহূদীরাও সুনজরে দেখত না। তারা আবদুল্লাহ ইব্‌ন উবায়্যর চাইতেও অধিকতর শত্রুতা করতে থাকে। মদীনার আশেপাশের এলাকাসমূহে ইয়াহূদীদের তিনটি গোত্র অত্যন্ত শক্তিশালী ছিলো। তারা নিজেদেরকে পৃথক পৃথক দুর্গ বানিয়ে রেখেছিলো। গোত্র তিনটি ছিলো : (১) বনী কায়নুকা, (২) বনী নযীর ও (৩) বনী কুরায়যা। হযরত নবী (সাঃ) মদীনা আগমনের অব্যবহিত পরে যে সনদ প্রণয়ন করেন এতে ইয়াহূদীদের এ গোত্রগুলোও শামিল ছিলো। কুরায়শরা যেভাবে আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন উবায়্যর সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়, তেমনি এ ইয়াহূদী গোত্রগুলোকেও সমর্থনে নেওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত থাকে। ইয়াহূদীরা যেহেতু মুসলমানদের উন্নতি দু’চোখে দেখতে পারতো না, তাই তারা কুরায়শদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন এবং মুসলমানদের ধ্বংস সাধনের জন্যে অহরহ সচেষ্ট থাকে। এবার বদর যুদ্ধের পর তাদের সে শত্রুতা আরো বৃদ্ধি পেলো এবং বিদ্বেষের বহ্নিতে জ্বলে তারা কাবাব হয়ে যাচ্ছিলো। তাই বদর যুদ্ধ জয়ের সুসংবাদ নিয়ে হযরত যায়দ ইব্‌ন হারিছা (রা) যখন মদীনায় পৌঁছলেন, তখন কা‘ব ইব্‌ন আশরাফ নামক মদীনার মুনাফিকরাও ইয়াহূদীদের নিয়ে বিরাট বিরাট ও মারাত্মক ষড়যন্ত্র পাকাতে লাগলো। মক্কায় কুরায়শদের অভিযানসমূহকে সাফল্যমণ্ডিত করার দায়িত্ব এবার যেন তারাই নিজ হাতে গ্রহণ করলো। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জনপ্রিয়তা ও প্রভাবকে মুছে ফেলার জন্যে সাধারণভাবে তারা নানারূপে কুবাক্য ও অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ শুরু করে দিল। এমন কি তারা তার মজলিসে পর্যন্ত উপস্থিত হয়ে অপমানজনক কথাবার্তা বলতে ও শুনতে লাগলো। আসসালামু আলায়কুম (তোমার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক) এর ন্যায় কুশল বাক্যের স্থলে তারা আস-সামু আলায়কুম (তোমার মৃত্যু হোক), راعنا (আমাদের প্রতি একটু নেক নজর দিন বা আমাদের কথাটুকু শুনুন) ركن (নির্বোধ) প্রভৃতি মূর্খতাব্যঞ্জক শব্দ তারা ব্যবহার করতে শুরু করলো। মুনাফিক ও ইয়াহূদীরা মিলে এ পরিকল্পনাও তৈরি করে যে, প্রথমে বাহ্যত মুসলমান হয়ে যেতে হবে, তারপর এই বলে মুরতাদ বা ধর্মত্যাগী হতে হবে যে, আমরা মুসলমান হয়ে দেখলাম, এ ধর্মটি ভালো না। এভাবে অনেক মুসলমানও হয়ত প্রভাবান্বিত হয়ে মুরতাদ হয়ে যাবে এবং তাদের ঐক্য ক্ষুন্ন হবে। মোদ্দাকথা, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ও মুসলমানদের জন্য মদীনায় নানারূপ সমস্যার উদ্ভব হলো। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ইয়াহূদীদের সভাসমিতি ও সমাবেশসমূহে গিয়ে তাদেরকে এ মর্মে বোঝাতে লাগলেন যে, তোমরা উত্তমরূপেই অবগত আছ যে, আমি আল্লাহর সত্য নবী। তোমরা নিজেরাও আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী আগমনের প্রতীক্ষা করছিলে। সর্বপ্রথম তোমরাই আমার সত্যতার অনুমোদন করবে এবং তোমাদের আসমানী কিতাবসমূহ লিখিত ভবিষ্যদ্বাণীসমূহ খুঁজে দেখা ছিল তোমাদের কর্তব্য। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তোমরা বিরোধিতার ক্ষেত্রই তৈরি করে যাচ্ছ! আল্লাহর গযবকে ভয় কর এমন যেন না হয় যে, আবূ জাহেল, উত্‌বা প্রমুখের মত তোমাদের উপরও আল্লাহর শাস্তি নেমে আসে। এরা বদর প্রান্তরে অত্যন্ত লাঞ্ছনাগ্রস্ত হয়ে ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে। ইয়াহূদীরা উপদেশ গ্রহণের পরিবর্তে তাঁকে উল্টো জবাব দেয় এবং বলে যে, কুরায়শরা যুদ্ধকৌশল সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল। আমাদের সাথে যখন মুকাবিলা হবে তখন মজাটা টের পাবেন। আমাদেরকে কুরায়শদের মতো মনে করবেন না।

১৪১
ইয়াহূদী গোত্র বনী কায়নুকা
ইয়াহূদীরা নানা ধরনের অসঙ্গত ও কুরুচিপূর্ণ কথাবার্তা প্রকাশ্যেই বলাবলি করতে লাগলো। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাদের অশ্রাব্য কথাবার্তা অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে শুনতে থাকেন এবং এভাবে এ হতভাগাদেরকে চুক্তির বিরুদ্ধাচরণ করে প্রায় চুক্তিভঙ্গ করতে দেখেও তাদেরকে কোনরূপ শাস্তি প্রদান সমীচীন বোধ করেননি। তাঁর একান্ত ইচ্ছে ছিলো যে, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে উপদেশ দিয়ে তাদেরকে সুপথে আনয়ন করবেন এবং এ উদ্ধতদেরকে আপন ঔদার্য, ভদ্র আচরণ ও ক্ষমাপরায়ণতা দিয়ে জয় করবেন। কিন্তু তাদের দুর্ভাগ্য তাদের ধ্বংসের পথ প্রশস্ত করলো। একদিন বনী কায়নুকা বস্তিতে একটি মেলা বা বাজার বসেছিলো। সেখানে আনসারের জনৈক রমণী দুধ বিক্রি করতে গিয়েছিলেন। দুধ বিক্রির পর তিনি স্বর্ণকারের দোকানে একটি অলংকার ক্রয় করতে বা বানাতে যান। ইয়াহূদী স্বর্ণকারটি উক্ত মুসলিম রমণীটিকে উত্যক্ত করে। বাজারে আগত জনৈক আনসারী সাহাবী আনসারী মহিলাকে অপদস্থ হতে দেখতে পেয়ে তার সাহায্যে এগিয়ে যান। আশেপাশের ইয়াহূদীরা এসে উৎপীড়নকারী ইয়াহূদীর পাশে দাঁড়ায় এবং তারা একযোগে উক্ত আনসারী সাহাবীর উপর হামলা করে তাঁকে হত্যা করে। তাঁর হাতেও একজন ইয়াহূদী প্রাণ হারায়। এ সংবাদ পেয়ে বাজারে উপস্থিত অন্যান্য মুসলমানও এসে পৌঁছেন। ইয়াহূদীরা তাদের উপর সশস্ত্র আক্রমণ চালায়। সংবাদটি মদীনায় হযরত নবী করীম (সাঃ)-এর কানে পৌঁছে। তিনি সাহাবায়ে কিরামকে নিয়ে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হন এবং ইয়াহূদীদেরকে সশস্ত্র ও যুদ্ধংদেহী অবস্থায় দেখতে পান। উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হলো এবং পরিস্থিতি এ পর্যন্ত গড়ালো যে, বনূ কায়নুকার সাত শ’ যোদ্ধা যাদের মধ্যে তিনশ’ বর্ম পরিহিত ছিলো, নিজেদের সংরক্ষিত দুর্গাভ্যন্তরে আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য হলো। বনূ কায়নুকার সঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ ইব্‌ন সালামের কুটুম্বিতা ছিলো। মুসলমানরা সে দুর্গ অবরোধ করলেন। পনের ষোল দিনের অব্যাহত অবরোধের ফলে মুসলমানরা দুর্গের আধিপত্য লাভ করলেন এবং বনী কায়নুকা গোত্রের সমস্ত লোককে বন্দী করলেন। আরব দেশে যুদ্ধবন্দীদেরকে নির্দয়ভাবে হত্যার নিয়ম প্রচলিত ছিলো। মক্কাবাসীদের তো বিস্ময়ের সীমা ছিলো না যখন তারা লক্ষ্য করলো যে, বদরের যুদ্ধবন্দীদের মধ্য থেকে সভ্যতা-ভব্যতার সমস্ত সীমা অতিক্রমকারী চরম দুরাচার দু’জন মাত্র বন্দীকেই হত্যা করা হয়েছে এবং অবশিষ্ট সকলকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। এমন কি বনী কায়নুকার সাতশ’ লোক এক সাথে বন্দী হওয়ায় সকলেরই নিশ্চিত ধারণা ছিলো যে, এবার আর কারো রক্ষা নেই, সমস্ত বন্দীকে নির্ঘাত মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। কিন্তু মুনাফিক সরদার আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন উবায়্য ইব্‌ন সলূল যে বাহ্যত মুসলমানদের মধ্যেই শামিল ছিলো, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর খিদমতে ইয়াহূদীদেরকে হত্যা না করার সুপারিশ করলো। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এ ব্যাপারে দ্বিধান্বিত ছিলেন। কিন্তু আবদুল্লাহ ইব্‌ন উবায়্য-এর উপর্যুপরি অনুরোধে তিনি তাদেরকে প্রাণে রেহাই দেন। হযরত উবাদা ইব্‌ন ছামিত (রা) তাদেরকে খায়বার পর্যন্ত বের করে দিয়ে আসলেন। আবদুল্লাহ ইব্‌ন উবায়্য পর্দার অন্তরালে ইয়াহূদীদের মিত্র ছিল। এজন্যে সে সুপারিশ করে তাদেরকে প্রাণে রক্ষা করে তাদের মিত্রের হক আদায় করে।

কা‘ব ইব্‌ন আশরাফের কথা উপরেই বলা হয়েছে। এখন সে প্রকাশ্যে মুসলমান ললনাদের নাম তার প্রেমের কবিতায় ব্যবহার করতে লাগলো। এতে মুসলমানরা অত্যন্ত মনঃক্ষুন্ন হতেন। তারপর সে হযরত নবী (সাঃ)-কে হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো। ফলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর এতটুকু সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন দেখা দিল যে, রাতের বেলায় তিনি ঘর থেকে বেরোতে খুবই সতর্ক থাকতেন। তার দৌরাত্ম্য যখন সীমা অতিক্রম করলো তখন জনৈক সাহাবী মুহাম্মদ ইব্‌ন মাসলামা (রা) হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নিকট থেকে তাকে হত্যার অনুমতি নিয়ে কয়েকজন সহচরসহ তার বাড়িতে যান এবং তাকে হত্যা করে আসেন। কা‘ব ইব্‌ন আশরাফের পর সালাম ইব্‌ন আবূ হাকীক ঐ একই ধরনের দৌরাত্ম্যে লিপ্ত হলো এবং সে কা‘ব ইব্‌ন আশরাফের চাইতেও অধিকতর শত্রু হয়ে দাঁড়ালো। কা‘বকে যেহেতু আওস গোত্রীয়রা হত্যা করেছিলেন, তাই এবার বনী খাযরাজের আট ব্যক্তি খায়বার অভিমুখে রওয়ানা হলেন এবং তাকে তার বাসস্থানে হত্যা করে নিরাপদে মদীনায় ফিরে আসেন।

১৪২
উহুদের যুদ্ধ
(হিজরী তৃতীয় বর্ষ)

বদর যুদ্ধের পর একদিকে তো স্বয়ং মক্কাবাসীদের অন্তরে প্রতিশোধ বহ্নি দাউ দাউ করে জ্বলছিলো, অপর দিকে মদীনার ইয়াহূদী ও মুনাফিকরা তাদেরকে উত্তেজিত করতে বিন্দুমাত্র ত্রুটি করেনি। অপরদিকে আবূ সুফিয়ানের পত্নী হিন্দাও তাকে ভর্ৎসনা করে উত্তেজিত করে চলেছিল,-যার পিতা ও ভাই বদর যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে নিহত হয়েছিল। মক্কার সমস্ত বড় বড় সরদার নিহত হওয়ার পর আবূ সুফিয়ান তখন মক্কার প্রধান সরদার। সে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণে লিপ্ত হলো। শামের যে বাণিজ্য কাফেলা আবূ সুফিয়ানের নেতৃত্বে নিরাপদে মক্কায় পৌঁছেছিল তাতে পাঁচ হাজার মিছকাল স্বর্ণ ও এক হাজার উট মুনাফা স্বরূপ পাওয়া গিয়াছিল। এ মুনাফা মালিকদের মধ্যে বন্টন করা হলো না এবং এর পুরোটাই যুদ্ধ প্রস্তুতিতে ব্যয়িত হলো। আরবের বিভিন্ন গোত্রে কবিদেরকে প্রেরণ করে তাদেরকে কুরায়শদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করা হলো। এর চমৎকার ফলও পাওয়া গেলো। গোটা বনী কিনানা এবং তিহামাবাসী কুরায়শদের সাথে মিলিত হলো। কুরায়শদের সমস্ত মিত্র গোত্র তাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে এলো। মক্কার হাবশী গোলামদেরকেও সৈন্যবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হলো। বীর গাথা গায়ক পুরুষ এবং বীরত্বের জন্যে উদ্বুদ্ধকারিণী নারীদেরকেও সাথে নেয়া হলো। মোটকথা, পূর্ণ একটি বছর মক্কাবাসীরা যুদ্ধ প্রস্তুতিতে ব্যয় করলো। এ প্রস্তুতি গ্রহণে মদীনায় ইয়াহূদী ও মুনাফিকরা গোপনে গোপনে সংবাদ সরবরাহ করে এবং পরামর্শ দিয়ে দিয়ে কুরায়শদের সর্বাধিক সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করে।

মোটকথা তিন হাজার দুর্ধর্ষ সৈন্যের একটি বাহিনী শাওয়াল মাসের প্রথম দিকে রওয়ানা হয়ে পড়লো। বদর যুদ্ধে নিহত সরদারদের জায়া-কন্যারাও এ উদ্দেশ্যে সাথে রওয়ানা হলো যে, তাদের প্রিয়জনদের হত্যাকারীদের নিহত হওয়ার দৃশ্য স্বচক্ষে অবলোকন করবে। কবিরাও সাথে চললো। তারা তাদের কবিতাদি শুনিয়ে গোটা রাস্তায় সৈন্যদেরকে যুদ্ধের জন্য প্রেরণা দান করছিলো। কুরায়শদের অভিজাত মহিলাদের মধ্যে আবূ সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা বিন্‌ত উত্‌বা মহিলাদের সেনাপতিরূপে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে, যেমনটি আবূ সুফিয়ান ছিল পুরুষদের সেনাপতি। জুবায়র ইব্‌ন মুতঈম-এর ওয়াহ্‌শী নামক একটি হাবশী ক্রীতদাস ছিলো। ছোট বল্লম চালনায় সে ছিল অত্যন্ত দক্ষ। তাকেও সাথে নেয়া হলো। তার লক্ষ্য বড় একটা ভ্রষ্ট হতো না। জুবায়র ইব্‌ন মুতঈম তাকে বলে যে, তুই যদি হামযাকে হত্যা করতে পারিস, তা হলে তোকে আমি মুক্ত করে দেবো। আবূ সুফিয়ান-পত্নী ও উতবা-তনয়া হিন্দা বললো, তুই যদি আমার পিতার হন্তা হামযাকে হত্যা করতে পারিস তাহলে তোকে আমার সমস্ত গহনা খুলে দিয়ে দেবো। কোন কোন ইতিহাসে এ বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা পাঁচ হাজার ছিলো বলে উল্লেখ আছে। কিন্তু বিশুদ্ধ বর্ণনা হচ্ছে এটা যে, বাহিনী তিন হাজার যোদ্ধা নিয়েই গঠিত হয়েছিলো। ললনার এবং যুদ্ধ শিক্ষার্থীদের সংখ্যা তার অতিরিক্ত হয়ে থাকবে।

কাফির বাহিনী মক্কা থেকে বেরিয়ে মদীনার উপকণ্ঠে এসে উপনীত হলো। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এ সংবাদ পেয়েই সাহাবায়ে কিরামকে নিয়ে পরামর্শ সভায় বসলেন। মুসলমানদের মধ্যে গণ্য বলে পরিচিত আবদুল্লাহ ইব্‌ন উবায়্য মুনাফিকও সে মজলিসে উপস্থিত ছিলো। রাসূল আকরাম (সাঃ)-এর অভিমত ছিল এই যে, আমরা মদীনার শহরাভ্যন্তরে অবস্থান করেই আক্রমণ প্রতিরোধ করবো। তাঁর এ অভিমতের একটি কারণ এও ছিল যে তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন, তলোয়ারের কিছুটা ধার কমে গিয়েছে। তাই তিনি (সাঃ) এ যুদ্ধে মুসলমানদের কিছুটা ক্ষতির আশংকা করছিলেন। তারপর তিনি দেখেছিলেন যে, তিনি তাঁর পবিত্র হাত তার বর্মের মধ্যে রাখলেন। বর্মের ব্যাখ্যা তিনি মদীনা শহর বলে স্থির করেন। আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন উবায়্যরও অভিমত ছিল এই যে, মদীনার অভ্যন্তরে থেকেই প্রতিরোধ করতে হবে। সম্ভবত নিজের বিশেষ কোন স্বার্থে সে এ অভিমত পোষণ করতো। কিন্তু অধিকাংশ সাহাবী শত্রুরা যেন মুসলমানদের মধ্যে দুর্বলতা দেখা দিয়েছে বলে সন্দেহ না করে এজন্যে শহরের বাইরে গিয়ে শত্রুদের মুকাবিলা করার পক্ষপাতী ছিলেন। প্রবীণ সাহাবায়ে কিরামের অধিকাংশই মদীনার শহরাভ্যন্তর থেকে আক্রমণ প্রতিরোধের পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু যুবকদের তা মোটেই মনপূত ছিলো না। এটা হচ্ছে ১৪ই শাওয়াল শুক্রবারের কথা। এ পরামর্শ অনুষ্ঠানের পর তিনি জুমুআর নামায আদায় করেন। নামায পড়ে তিনি ঘরে চলে যান এবং সেখান থেকেই বর্ম পরিহিত অবস্থায় যুদ্ধাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বেরিয়ে আসেন। তারপর যুবক সাহাবায়ে কিরামের ভাবনা হলো, আমরা নবী করীম (সাঃ)-এর মতের বিরুদ্ধাচরণ করায় তার অবাধ্য বলে না গণ্য হয়ে যাই। তখন তারা আরয করলেন : আপনি যদি মদীনার অভ্যন্তর থেকে আক্রমণ প্রতিরোধ করাই সমীচীন মনে করেন তবে তাই করুন, এতে আমাদের পক্ষ থেকে কোনই আপত্তি নেই। কিন্তু তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠের মত এবং পরামর্শ সভার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কিছু করাটা এজন্যে সমীচীন বোধ করেন নি যে, এ মর্মে তিনি ওয়াহীযোগে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে নির্দেশপ্রাপ্ত হননি। বদর যুদ্ধে যারা অংশ গ্রহণ করতে পারেননি তাদের মনরক্ষাও এর একটা উদ্দেশ্য ছিলো। কেননা, তারা তাদের বীরত্ব প্রদর্শনের একটা সুযোগ লাভের জন্যে উন্মুক্ত ছিলেন।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জুমুআর নামাযের অব্যবহিত পরেই সদলবলে মদীনা থেকে বেরিয়ে পড়লেন। মদীনায় তার অনুপস্থিতিতে নামাযের ইমামতির ও মদীনার দেখাশোনা করার জন্য আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন উম্মে মাকতূম সাহাবীকে রেখে গেলেন। এক হাজার লোক হযরত নবী করীম (সাঃ)-এর সাথে মদীনা থেকে রওয়ানা হলেন।

১৪৩
মুনাফিকদের ঔদ্ধত্য
মদীনা থেকে বেরিয়ে দেড় দু’মাইল যেতে না যেতেই এক হাজার লোকের মধ্যে তিন শ’ জনকে নিয়ে আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন উবায়্য মদীনায় ফিরে চললো। সে বললো, আমাদের মতামত অনুসারে যেহেতু কাজ করা হয়নি এজন্যে আমরা মদীনার বাইরে গিয়ে লড়তে প্রস্তুত নই। এ তিন শ’ মুনাফিক দলত্যাগ করায় মুসলিম বাহিনীর সংখ্যা কেবল সাত শ’তে এসে দাঁড়ালো। এ সাত শ’র মধ্য থেকেও অল্প বয়স্কদেরকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনায় ফেরত পাঠিয়ে দিলেন। দিনের অল্প কিছু সময় বাকী থাকতেই তিনি সদলবলে মদীনা থেকে তিন মাইল দূরবর্তী উহুদ পাহাড়ের পাদদেশে এসে পৌঁছলেন। তাঁরা পৌঁছেই দেখতে পেলেন যে, কাফির বাহিনী ইতোপূর্বেই সেখানে পৌঁছে ছাউনি স্থাপন করেছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় কোন পক্ষই যুদ্ধের কোন লক্ষণ দেখালো না। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উহুদ পাহাড়কে পিছনে রেখে ছাউনি স্থাপন করলেন। রাত নির্লিপ্তভাবে অতিবাহিত হওয়ার পর পরদিন ১৫ই শাওয়াল ৩ হিজরী রোজ শনিবার উভয় পক্ষ সক্রিয় হয়ে উঠলো। যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে হযরত নবী করীম (সাঃ) পঞ্চাশ জন দক্ষ তীরন্দাজের একটি বাহিনীকে হযরত আবদুল্লাহ ইব্‌ন জুবায়র আনসারী (রা)-এর নেতৃত্বে পিছনের ঘাঁটিতে এই আদেশ দিয়ে মোতায়েন করেন যে, যুদ্ধের অবস্থা যাই হোক না কেন, পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত তোমরা স্থান ত্যাগ করবে না। ব্যাপার ছিলো এই যে, ঐ সংকীর্ণ গিরিপথ দিয়ে শত্রুর পাহাড়ের পিছন দিক থেকে এসে হামলা করার আশংকা ছিল। যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থান দেখেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ব্যাপারটি অনুধাবন করেছিলেন। এজন্যে শত্রুপক্ষের সে সম্ভাব্য হামলা প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে তিনি এদেরকে ঐ স্থানে মোতায়েন করেছিলেন।

যোদ্ধাদেরকে সারিবদ্ধ করে নবী করীম (সাঃ) ডানের বাহিনীর নেতৃত্ব হযরত যুবায়র ইব্‌ন আওয়াম (রা)-এর উপর এবং বামের বাহিনীর নেতৃত্ব হযরত মুনযির ইব্‌ন আমর (রা)-এর উপর ন্যস্ত করেন। হযরত হামযা (রা)-কে বাহিনীর অগ্রভাগে অগ্রপথিক সেনানী নিযুক্ত করেন এবং পতাকা হযরত মুসআব ইব্‌ন উমায়র (রা)-এর হাতে দেন। নবী করীম (সাঃ) তার নিজ তলোয়ার হযরত আবূ দুজানা (রা)-কে দেন। তিনি এ তলোয়ার নিয়ে গোটা যুদ্ধক্ষেত্রে উল্লাসের সাথে গর্বভরে প্রদক্ষিণ করতে থাকেন। তার এতাদৃশ আচরণে তিনি বলেন যে, এরূপ পদক্ষেপ আল্লাহ পছন্দ করেন না। কিন্তু কাফিরদের সঙ্গে মুকাবিলা করতে যেয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে এভাবে চলা জাইয।

অপর দিকে কুরায়শরাও তাদের সারি বিন্যস্ত করলো। তারা একশত জন অশ্বারোহী সৈন্যে সম্বলিত ডান বাহিনীর নেতৃত্ব খালিদ ইব্‌ন ওয়ালীদের হাতে অর্পণ করে (তিনি তখনো ইসলাম গ্রহণ করেন নি)। কুরায়শের পতাকা বহনের দায়িত্ব প্রাচীনকাল থেকেই বনী আবদে দার-এর উপর ন্যস্ত ছিল। আবূ সুফিয়ান বনী আবদে দারকে উত্তেজিত করার জন্যে বললো, যদিও প্রাচীনকাল থেকেই তোমরা কুরায়শদের পতাকা বহন করে আসছো, কিন্তু বদর যুদ্ধে তোমাদের পতাকা বহনের অলক্ষুণে প্রভাবের কথাটি স্মরণ হলেই ইচ্ছে হয় যে, পতাকা বহনের দায়িত্ব অন্য কোন গোত্রকে অর্পণ করি। তোমরা যদি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হও যে, পতাকা বহনের গুরুদায়িত্ব তোমরা প্রাণপণে পালন করবে তাহলে পতাকা তোমাদের কাছে রাখ, নতুবা তা ফিরিয়ে দাও। বনু আবদের দার গোত্র পতাকা ফেরত দিল না বরং বীরত্বের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনের অঙ্গীকার করলো। উক্ত দু’জন অশ্বারোহী ছাড়া দুইশ রিজার্ভ ঘোড়া প্রয়োজনের সময় ব্যবহারের জন্য তৈরী রাখা হয়। মুশরিকদের তীরন্দায বাহিনীর সরদার ছিলো আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন রবীআ। ওদিকে কুরায়শ ও অন্যান্য গোত্রের বাছাই করা অন্তত তিন হাজার সশস্ত্র সৈন্যের দুর্ধর্ষ বাহিনী আর এদিকে সাতশ’রও কম সৈন্য হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর বাহিনী ছিল। এ বাহিনীতে পনের বছরের কম বয়সের বালকরাও ছিল। মুসলিম বাহিনীতে ঘোড়া ছিল কেবল দুটি। মোটকথা সংখ্যার দিক থেকে মুসলমানরা এক-চতুর্থাংশেরও কম ছিলেন এবং যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জামের অনুপাত ছিল তার চাইতে অনেক গুণ কম।

১৪৪
যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গেলো
যুদ্ধের সূচনা হয় এভাবে যে, সর্বপ্রথম আবূ আমির রাহিব কাফির বাহিনীর পক্ষ থেকে মাঠে অবতীর্ণ হয়। লোকটি ছিলো মদীনার অধিবাসী এবং আওস গোত্রের লোক। আপন সম্প্রদায়ের মধ্যে সে একজন জ্ঞানীগুণী সম্মানিত ব্যক্তি হিসাবে গণ্য হতো। মদীনায় মুসলমানদের আগমনে সে তীব্র অন্তর্জালায় ভুগতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত মক্কায় গিয়ে বসবাস করতে থাকে। সে এই ভেবে কাফির বাহিনীর সাথে যুদ্ধক্ষেত্রে এসেছিলো যে, আওস গোত্রের লোকদেরকে সে বিরুদ্ধপক্ষে টেনে নিতে পারবে। সে যুদ্ধক্ষেত্রে নেমেই আওস গোত্রীয়দেরকে আহবান করে, কিন্তু আওস গোত্রীয় আনসারগণ তাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন এবং সে অত্যন্ত অপদস্থ হয়।

তারপর উভয় পক্ষ একে অপরকে আক্রমণ করে। হযরত হামযা (রা), হযরত আলী (রা), হযরত আবূ দু’জানা (রা) প্রমুখ বীর সাহাবায়ে কিরামে যুদ্ধে যে অপূর্ব বীরত্ব প্রদর্শন করলেন তাতে প্রতিপক্ষের সাহস উবে গেল। আবূ দুজানা (রা) শত্রুদেরকে কতল করতে করতে তাদের ব্যুহ ভেদ করে আবূ সুফিয়ান পত্নীর এতই নিকটে পৌঁছে গেলেন যে, সে তার আয়ত্তের মধ্যে চলে আসলো। তাকে হত্যার উপক্রম করতেই মহিলাটি প্রাণভয়ে চীৎকার করে উঠলো। নারীকণ্ঠের আওয়াজে আবূ দুজানা হকচকিয়ে যান। এ যে নারী! রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর তরবারি নারীরক্তে কলুষিত করা চলে না। এভাবে হিন্দা বিন্‌ত উত্‌বার প্রাণ বেঁচে গেলো।

১৪৫
হযরত হামযা (রা)-এর শাহাদত বরণ
হযরত হামযা (রা) আক্রমণ চালিয়ে মুশরিকদের পতাকাবাহী তালহাকে হত্যা করেন। তিনি বীরবিক্রমে অসি চালিয়ে মুশরিকদেক ব্যুহ ভেদ করে সম্মুখপানে অগ্রসর হচ্ছিলেন। হাবশী গোলাম ওয়াহশী তাকে অগ্রসর হতে দেখে একটি পাথরের আড়ালে আত্মগোপন করে বসে থাকে। কাফিরদের হত্যা করতে করতে যখন তিনি আরো সম্মুখে অগ্রসর হন তখন সুযোগ বুঝে সে তার প্রতি বর্শা নিক্ষেপ করে এবং তা তার নাভিমূলে আঘাত হেনে পার্শ্বদেশ ভেদ করে চলে যায়। তিনি শাহাদত লাভ করেন। ওয়াহশী হিন্দা বিনত উত্‌বার নিকট গিয়ে হযরত হামযার শাহাদত লাভের খবর শোনায়। হযরত হানযালা (রা) আক্রমণ চালিয়ে কাফিরদের সম্মুখ হতে হটিয়ে দিয়ে আবূ সুফিয়ানের নিকট পৌঁছে যান। তিনি তাকে তরবারি দ্বারা আঘাত করতে উদ্যত হলে শাদ্দাদ ইবনুল আসওয়াদ আল-লায়ছী পেছন থেকে এসে তাকে আঘাত করে। ফলে তিনি শহীদ হন। এ যুদ্ধে হযরত নযর ইব্‌ন আনাস এবং সা‘দ ইবনুর রবী তরবারি যুদ্ধে অসাধারণ বীরত্বের পরিচয় দেন। এই যুদ্ধে কুরায়শদের বারজন পতাকাবাহী পর পর মুসলমানদের হাতে নিহত হয়। এদের মধ্যে আটজনকে হযরত আলী (রা) একাই ধরাশায়ী করেন। এদের একজন নিহত হওয়ার পর পতাকা মাটিতে পতিত হলে আর একজন এসে তা উত্তোলন করতে থাকে। এমনিভাবে যখন তাদের শেষ পতাকাবাহী সওয়ার নিহত হয় তখন আর কেউ পতাকা উত্তোলন করার সাহস করেনি এবং তা ভূমিতেই পড়ে থাকে।

মুসলমানদের ব্যুহ ভেদকারী আক্রমণ এবং বীরত্বপূর্ণ তরবারি যুদ্ধ নৈপুণ্যে তিন হাজার বীর সৈন্যের পায়ের তলার মাটি সরে যায়। দুপুরের কাছাকাছি কাফিররা পশ্চাদপসরণ করতে থাকে। প্রথমে তারা উল্টো পায়ে যুদ্ধ করতে করতে পিছু হটতে থাকে। অতঃপর পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পালাতে থাকে, এমন কি তারা নিজেদের সীমানার বাইরেও চলে যায়। যেসব কুরায়শ নারী পেছনে পেছনে দফ বাজিয়ে এবং কবিতা আবৃত্তি করে তাদের পুরুষ সৈন্যদের যুদ্ধের জন্য উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করছিল মুসলমানেরা দেখলো তারাও সমস্ত সাজ-সরঞ্জাম ফেলে নিজেদের পলায়নপর সৈন্যদের সাথে মিলিত হচ্ছে। মুশরিকদের জেনারেল হিন্দা বিনত উতবাও দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে নিজের সমস্ত সামান ময়দানে ফেলে পালিয়ে যায়।

১৪৬
যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেল!
মুশরিকদের শোচনীয় পরাজয় এবং মুসলমানদের বিজয় প্রায় সুনিশ্চিত হয়ে উঠলো। কাফির সৈন্যরা যখন পিছটান দিচ্ছিলো তখন বেলা দ্বিপ্রহর। পলায়নপর কাফির সৈন্যদের পলায়নের দৃশ্য এবং কাফির বাহিনীর পতাকা দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত ভূলুণ্ঠিত অবস্থায় প্রত্যক্ষ করে ঘাঁটিতে মোতায়েন তীরন্দায বাহিনীর মনেও স্পৃহা জাগলো যে, আমরা কাফির সেনাদেরকে ধাওয়া করায় অংশ গ্রহণ করি। তাদের সরদার হযরত আবদুল্লাহ ইব্‌ন জুবায়র আনসারী তাদেরকে অনেক করে বললেন যে, মহানবী (সাঃ)-এর পুনরাদেশ না পাওয়া পর্যন্ত আমরা এ স্থান ত্যাগ করতে পারি না। কিন্তু যুদ্ধজয়ের আনন্দ এবং কাফিরদের পশ্চাদ্ধাবনের অতি আগ্রহ তাদেরকে তা শুনতে দেয়নি। ফলে তারা স্থান ত্যাগ করলেন। কুরায়শদের ডান বাহিনীর পরিচালক খালিদ ইব্‌ন ওয়ালীদ এ ঘাঁটির গুরুত্ব যে কত অধিক তা সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তিনি তাঁর এক শ’ সৈন্যসহ এক মাইল পথ ঘুরে পশ্চাৎ দিক থেকে ঐ ঘাঁটি দিয়ে এসে মুসলমানদের আচমকা হামলা চালালেন। হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন জুবায়র (রা) এবং তার অল্প ক’জন সঙ্গী সে আক্রমণ প্রতিরোধে ব্যর্থ হলেন। কেননা, তার অধীনস্থ অন্য সকলে ইতিপূর্বেই স্থান ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন। হযরত আবদুল্লাহ ইব্‌ন জুবায়র (রা) ঘটনাস্থলেই শহীদ হলেন। এ আকস্মিক হামলাটি ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত। তীরন্দাজদের স্থান ত্যাগে মুসলমানদের মধ্যে বিব্রতকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। মুসলমানরা এবার কাফির সেনাদের পশ্চাদ্ধাবন ছেড়ে দিলেন।

মুসলমানদের এ বিব্রতকর অবস্থা লক্ষ্যে ইকরামা ইব্‌ন আবূ জাহেল তার অশ্বারোহী সৈন্যদেরকে নিয়ে অন্যদিক থেকে হামলা চালালো। সাথে সাথে ইতিপূর্বে ময়দান পরিত্যাগ করে পলায়নকারী আবূ সুফিয়ান ও পলায়নপর কুরায়শ সৈন্যদেরকে নিয়ে রুখে দাঁড়ালো। কাফির বাহিনী এবার নব উদ্যমে মুসলমানদের উপর হামলা চালালো। মুসলমানদের উপর অতর্কিতে এবং উপর্যুপরি এ সব হামলা পরিচালিত হয়। ফলে যুদ্ধের মোড় সম্পূর্ণ ঘুরে গেলো। মুসলমানরা চতুর্দিক থেকে কাফির বাহিনীর দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়লো। তারা ছত্রভঙ্গ ও দিশাহারা হয়ে গেলেন। যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থা দাঁড়ালো এই যে, স্থানে স্থানে গুটি কয়েক মুসলমান বিরাট বিরাট কাফির দলের অবরোধের মধ্যে পড়ে গেলেন। তারা পরস্পরের সংযোগ হারিয়ে ফেললেন এবং এ অবস্থায় চতুর্দিক থেকে তাদের উপর তরবারি বর্ষিত হচ্ছিলো। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মাত্র বারজন সঙ্গীসহ কাফিরদের এক বিরাট দলের মধ্যে পড়ে গেলেন। হযরত মুসআব পতাকা হাতে ধরে তাঁর নিকটেই দাঁড়িয়েছিলেন। কাফির বাহিনীর জনৈক নামজাদা অশ্বারোহী ইব্‌ন কুমাইয়া লায়ছী আক্রমণ চালিয়ে হযরত মুসআব (রা)-কে শহীদ করে দিলো। হযরত মুসআব (রা)-এর অবয়ব যেহেতু দেখতে অনেকটা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর অবয়বের মতো ছিলো তাই সে ধারণা করলো যে, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) শহীদ হয়ে গেছেন। সে একাই উঁচু স্থানে আরোহণ করে সে মুহূর্তেই উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করলো : قد قتلت محمدا আমি মুহাম্মদকে হত্যা করেছি। তার এ ধ্বনি শুনে মুশরিকদের মনোবল অনেক গুণে বৃদ্ধি পেলো। তারা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। মুসলমানদের জন্যে এ ধ্বনিটি ছিল প্রাণান্তকর। তাঁরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন। এমন সময় হযরত কা‘ব ইব্‌ন মালিক (রা)-এর দৃষ্টি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর প্রতি নিবদ্ধ হলো এবং তিনি তৎক্ষণাৎ চীৎকার করে বলে উঠলেন : “মুসলমানরা! শুনে সুখী হও। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) জীবিত এবং সুস্থই রয়েছেন।” তখনি রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) উচ্চৈঃস্বরে আহবান জানাল :

الى عباد الله انا رسول الله .

“আল্লাহর বান্দারা, আমার দিকে এগিয়ে এসো; আমি আল্লাহর রাসূল।

এ ধ্বনি উচ্চারিত হওয়া মাত্র মুসলমানরা তা শুনতে পেয়ে চতুর্দিক থেকে এসে জমায়েত হতে শুরু করলেন। কাফিরদের সাথে যুদ্ধ করে তাদের হামলা প্রতিরোধ করে, তাদেরকে মারতে মারতে তারা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নিকটে আসতে লাগলেন। ওদিকে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সে আওয়াজ কাফিরদেরকেও তাঁর অবস্থান জানিয়ে দিলো। ফল দাঁড়ালো এই যে, তারাও সেদিকে মনোনিবেশ করলো এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর অবস্থানস্থল যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ালো। মুসলমানদের কিছু সংখ্যক সৈন্য এমন স্থানে এবং এমন অবস্থায় ছিলেন যে, তারা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নিকট পর্যন্ত পৌঁছতে পারেন নি। তাঁরা এদিকসেদিক ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। এই বিশৃংখল অবস্থায় আবদুল্লাহ ইব্‌ন শিহাব হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নিকটে এসে সজোরে তরবারির এমন একটি আঘাত হানে যে শিরস্ত্রাণের দু’টি কড়া তাঁর পবিত্র গণ্ডদেশে অক্ষির নিচের অস্থির মধ্যে ঢুকে পড়লো। হযরত আবূ উবায়দা ইবনুল জাররাহ (রা) আপন দাঁত দিয়ে তা সজোরে টেনে বের করে আনেন। এতে নবী করীম (সাঃ)-এ দু’টি দন্ত মুবারক উঠে আসে। কাফির বাহিনী, তার উপর আক্রমণ পরিচালনায় সর্বশক্তি নিয়োগ করে।

১৪৭
নবুওয়াত দীপের পতঙ্গকুল
এদিকে কয়েকজন নিবেদিতপ্রাণ মুজাহিদ হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর চতুর্দিকে একটি ব্যূহ রচনা করে তাঁর চতুষ্পার্শ্বে দাঁড়িয়ে গেলেন। হযরত আবূ দুজানা (রা) হযরত নবী করীম (সাঃ)-এর দিকে মুখ করে তার নিজ পিঠকে ঢাল বানিয়ে ফেললেন। যদি মুখ কাফিরদের দিকে আর পিঠ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দিকে থাকতো তবে হয়তো তীর আসতে দেখলে স্বাভাবিকভাবে আত্মরক্ষার সহজ প্রবণতায় একটু সরে দাঁড়িয়ে আপন দেহকে বাঁচাবার প্রশ্নটা আসতো, কিন্তু এ অবস্থায় সে প্রশ্ন আর ছিলো না। পাছে তীর হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর পবিত্র দেহ স্পর্শ করে বসে এজন্যেই তাঁর এ সতর্কতা! তাঁর পিঠ তীরের পর তীরে ঝাঁঝরা হয়ে গেলো। তবু তিনি একচুলও নড়লেন না। হযরত সা‘দ ইব্‌ন ওয়াক্কাস (রা), হযরত আবূ তালহা (রা) ও হযরত আবদুর রহমান ইব্‌ন আওফ (রা) হযরত রসূল আকরাম (সাঃ)-এর চারপাশে লৌহপ্রাচীরের মত দাঁড়িয়ে যান এবং তীর ও তলোয়ার দিয়ে শত্রুদেরকে প্রতিহত করতে থাকেন। হযরত তালহা (রা) দুশমনদের তলোয়ারের আঘাত আপন হাত দিয়ে প্রতিহত করেন, এমন কি তার দু’টি হাত যখম হতে হতে অচল হয়ে যায়। হযরত যিয়াদ ইব্‌ন সাকান আনসারী (রা) তাঁর পাঁচজন সঙ্গীসহ হযরত (সাঃ)-এর হিফাযত করতে গিয়ে শাহাদত বরণ করেন। হযরত উমারা ইব্‌ন যায়দ (রা)-ও হুযূর আকরাম (সাঃ)-এর হিফাযত করতে গিয়ে পতঙ্গের মত প্রাণ দান করে শহীদ হয়ে যান। উম্মে আমারা, যার নাম ছিল নসীবা বিন্‌ত কা‘ব (রা), যুদ্ধের অবস্থান স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করার উদ্দেশ্যে মুসলিম বাহিনীর পিছু পিছু ছুটে আসেন। দুপুরের পর যখন যুদ্ধের গতি অকস্মাৎ পরিবর্তিত হয়ে গেল যখন দূরাত্মা ইব্‌ন কামিয়্যা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপর তলোয়ারের আঘাত হানলো তখন তিনি উপর্যুপরি ইব্‌ন কামিয়্যার উপর তলোয়ার হানতে থাকেন। কিন্তু সে দু’ দু’টি বর্মে সজ্জিত ছিলো বলে তার সেসব আঘাত তার গায়ে লাগেনি। সে উম্মে আমারাকে একটি আঘাত হানলে স্কন্ধের নীচে তার হাতটি যখমী হয়ে যায়।

১৪৮
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর দৃঢ়তা
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর চতুষ্পার্শ্বে যখন তুমুল যুদ্ধ চলছিলো, তখন একটি দুরাচার দূর থেকে তার প্রতি একটি পাথর ছুঁড়ে মারে। তাতে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর ঠোঁটে আঘাত লাগে এবং তার নীচের একটি দন্ত মুবারক শহীদ হয়ে যায়। এ অবস্থায়ই তার কদম মুবারক একটি গর্তের মধ্যে পড়ে যায় এবং তিনি পড়ে যান। হযরত আলী (রা) তাঁর হাত ধরেন। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) এবং হযরত তালহা (রা) তাঁকে উঠিয়ে বের করেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর চতুষ্পার্শ্বে যখন সাহাবায়ে কিরামের একটি ছোটো খাটো দল এসে সমবেত হয়ে গেলো এবং তারা প্রাণপণে লড়তে লাগলেন তখন কাফিরদের হামলার তীব্রতা হ্রাস পেলো। সাহাবায়ে কিরাম এবার কাফিরদেরকে মেরে মেরে হটিয়ে দিলেন। এ অবস্থায় নবী (সাঃ) সাহাবায়ে কিরামকে পাহাড়ের দিকে যেতে বললেন এবং তাদেরকে নিয়ে পাহাড়ের বেশ উঁচু অংশে আরোহণ করলেন। উদ্দেশ্য ছিলো কাফিরদের ব্যুহ থেকে বেরিয়ে গিয়ে পাহাড় পিছনে রেখে যুদ্ধের জন্য একটি ব্যুহ রচনা করা। এ কার্য প্রণালীটি অর্থাৎ যুদ্ধের জন্যে সুবিধামত অবস্থান গ্রহণ অত্যন্ত উপাদেয় প্রতিপন্ন হয়। মুসলমানদেরকে উচ্চ ভূমিতে অবস্থান নিতে দেখে আবূ সুফিয়ানও পাহাড়ে আরোহণের প্রয়াস পায়। সে কাফিরদের একটি বাহিনী নিয়ে ভিন্ন পথে উচ্চতর অবস্থানে আরোহণ করতে প্রয়াস পাচ্ছিলো। এমন সময় নবী করীম (সাঃ) হযরত উমর ফারুক (রা)-কে তাদেরকে উচ্চভূমিতে আরোহণে বাধাদানের নির্দেশ দিলেন। হযরত উমর (রা) কতিপয় সঙ্গীসহ তৎক্ষণাৎ সেদিকে অগ্রসর হয়ে আবূ সুফিয়ানের দলকে নীচে অবতরণে বাধ্য করেন।

এবার মুসলমানরা দ্রুত এগিয়ে চললেন। যারা ইতিপূর্বে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন তারাও পাহাড়ের ঐ উচ্চ স্থানে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর চারপাশে এসে সমবেত হয়ে গেলেন। এবার আর কাফিররা মুসলমানদের উপর হামলা করতে সাহস পেলো না। কিন্তু পূর্ব থেকেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে হত্যার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এক কাফির উবায়্য ইব্‌ন খালফ তার আপন ঘোড়ায় চড়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপর হামলা করলো। তাকে আসতে দেখেই আল্লাহর রসূল (সাঃ) বললেন, একে নিকটে আসতে দাও! সে কাছে এসে হামলা করতে উদ্যত হতেই হযরত নবী করীম (সাঃ) জনৈক সাহাবী হারিছ ইব্‌ন সুম্মা (রা)-এর হাত থেকে বল্লম নিয়ে তার উপর আঘাত হানলেন। বল্লমের তীক্ষ্ণ ফলা তার স্কন্ধের নীচের হাড়ে স্পর্শ করলো। বাহ্যত এ আঘাত ছিল মামুলী, কিন্তু এ আঘাতেই সে দিশাহারা হয়ে ছুটে পলালো। সে যখন আক্রমণ করতে এসেছিল তখন চীৎকার করে করে বলছিল, আমি আজ মুহাম্মদ (সাঃ)-কে হত্যা করবই। এবার যখন দিশাহারা হয়ে ছুটে পালাচ্ছিল তখন মুশরিকরা তাকে নিয়ে হাসাহাসি করছিল। এ আঘাতেই হতভাগা উবায়্য ইব্‌ন খালফ ফেরার পথে মক্কায় পৌঁছবার পূর্বেই মৃত্যুবরণ করে।

আবু সুফিয়ান চীৎকার করে জিজ্ঞেস করলো : افى القوم محمد -তোমাদের মধ্যে কি মুহাম্মদ রয়েছে? হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সাহাবাদেরকে এর উত্তর দিতে বারণ করলেন। তারপর সে দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করলো : তোমাদের মধ্যে কি আবূ বকর রয়েছে? এবারও কোন জবাব মিললো না। তারপর সে প্রশ্ন করলো, তোমাদের মধ্যে কি উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) রয়েছে? তারও কোন জবাব দেওয়া হলো না। তখন সে স্বগতোক্তি করলো : বোঝা গেলো এদের কেউই আর বেঁচে নেই, সবাই নিহত হয়েছে। এবার হযরত উমর ফারূক (রা) আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। তিনি চীৎকার করে বললেন : “হে আল্লাহর দুশমন! এঁদের সকলেই জীবিত রয়েছেন। অপমানিত ও লাঞ্ছিত হবি তুইই।” এ জবাব শুনে সে আচমকা থতমত খেয়ে গেলো এবং অনেকটা গর্বের সুরে বলে উঠলো : اعل هبل اعل هبل “জয় ‘হবলের, জয় ‘হবলের–

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) হযরত উমর (রা)-কে বললেন : এর জবাবে বল : الله اعلى واجل “আল্লাহই সর্বোচ্চ ও সর্বাধিক মর্যাদাসম্পন্ন।” আবূ সুফিয়ান হযরত উমর (রা)-এর কন্ঠে একথা শুনে বললো لنا عزى ولا عزى لكم

“আমাদের উজ্জা দেবী রয়েছে, তোমাদের কোন উজ্জা দেবী নেই।” হযরত উমর ফারুক (রা) হুযূর আকরাম (সাঃ)-এর কথামতো জবাব দিলেন :

الله مولانا ولا مولى لكم .

“আল্লাহ আমাদের মওলা, তোমাদের কোন মওলা নেই।” আবূ সুফিয়ান বললো : এ যুদ্ধটি বদর যুদ্ধের সমান সমান হয়ে গেলো। অর্থাৎ আমরা এবার বদর যুদ্ধের প্রতিশোধ কড়ায় গণ্ডায় নিয়ে নিলাম। হযরত উমর (রা) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কথামতো জবাব দিলেন : না না, সমান সমান হয়নি। কেননা, আমাদের নিহতরা জান্নাতে এবং তোমাদের নিহতরা জাহান্নামে। তারপর আবূ সুফিয়ান চুপ হয়ে গেলো। তারপর সে চীৎকার করে বললো : আবার আগামী বছর বদর প্রান্তরে তোমাদের সাথে বোঝাপড়া হবে। হযরত রসূল (সাঃ) আদেশ করলেন বলে দাও :

نعم هو بيننا وبينكم موعد .

হাঁ, এ চ্যালেঞ্জ আমরা গ্রহণ করলাম!

আবু সুফিয়ান এরূপ বলাবলি করে এবং জবাব শুনে প্রস্থান করলো। নবী করীম (সাঃ) হযরত আলী (রা)-কে তাদের প্রত্যাবর্তনের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার জন্যে পিছু পিছু পাঠিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, লক্ষ্য রাখবে যদি তারা উটের উপর হাওদা বাঁধে এবং ঘোড়াগুলোকে আরোহী শূন্য রাখে তবে বুঝে নিতে হবে যে এরা মক্কায় ফিরে চলেছে। পক্ষান্তরে যদি তারা ঘোড়ায় আরোহণ করে এবং উটের উপর হাওদা না বেঁধে থাকে তবে বুঝে নিতে হবে যে, এরা মদীনায় হামলা চালাতে উদ্যত হয়েছে। যদি তারা একান্তই মদীনায় হামলা করতে উদ্যত হয় তবে আমরা এ মুহূর্তে তাদের উপর আঘাত হানবো। কিছুক্ষণ পরেই হযরত আলী (রা) ফিরে এসে জানালো যে, এরা উটের পিঠে হাওদা বেঁধে ঘোড়াগুলোকে আরোহী শূন্য অবস্থায় রেখেছে। অর্থাৎ সত্যি সত্যি তারা মক্কার পথে রওয়ানা হয়েছে।

১৪৯
যুদ্ধের ময়দানের দৃশ্য
এরপর নিশ্চিন্ত হয়ে তিনি পাহাড় থেকে নেমে এলেন। যুদ্ধের ময়দানে শহীদানের লাশগুলো দাফন করা হলো। ৬৫ জন আনসার এবং ৪ জন মুহাজির শাহাদত বরণ করেছিলেন। কাফিররা কোনো কোনো শহীদের লাশ টুকরো টুকরো করে ফেলেছিল। আবূ সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা বিন্‌ত উত্‌বা সুযোগ পেয়ে হযরত আমীর হামযা (রা)-এর লাশের ‘মুছলা’ করলো। অর্থাৎ তার নাক, কান প্রভৃতি কেটে চেহারা বিকৃত করে ফেলেছিল। চক্ষু বের করে নিয়েছিল।

বুক চিরে কলিজা বের করে দাঁত দিয়ে চিবালো। কিন্তু গিলতে পারলো না। উগরে ফেলে দিলো। এজন্য সে ‘কলিজাখোর’ নামে কুখ্যাত হলো। হযরত যুবায়র ইবনুল আওয়াম (রা)-এর মাতা এবং হযরত হামযা (রা)-এর সহোদরা ভগ্নী হযরত সাফিয়্যা (রা) তাঁর ভাইয়ের লাশ দেখার জন্য এলেন। হযরত নবী করীম (সাঃ) যুবায়র (রা)-কে বললেন, সাফিয়্যা (রা)-কে লাশের কাছে যেতে বারণ করো। তিনি বারণ করলে হযরত সাফিয়্যা (রা) বললেন, আমি জানতে পেরেছি যে, আমার ভাইয়ের লাশ বিকৃত করা হয়েছে। আমি বিলাপ করতে আসিনি, আমি সবর করবো এবং তার মাগফিরাত কামনা করব। নবী করীম (সাঃ) একথা শুনে অনুমতি দিলেন। সাফিয়া (রা) তার ভাইয়ের লাশ ও তার কলিজার টুকরোগুলো মাটির উপর পড়ে থাকতে দেখে নীরবে সবর করলেন এবং ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজিউন’ পড়লেন। মাগফিরাত কামনা করলেন এবং চলে এলেন। ইসলামের পতাকাবাহী হযরত মুসআব ইব্‌ন উমায়র (রা)-এর কাফনের জন্য কেবল একটি চাদর ছিল। এটি এতই ছোট ছিল যে, মাথা ঢাকলে পা উদোম হয়ে যেতো এবং পা ঢাকলে মাথা উদোম হয়ে যেতো। পরিশেষে মাথা ঢেকে দেয়া হয় এবং পায়ের উপর ইখির ঘাস দ্বারা আবৃত করা হয়। বিনা গোসলে এক একটি কবরে দু’ দু’জন করে শহীদকে দাফন করা হয়। যুদ্ধের ময়দান থেকে মদীনা মুনাওয়ারা ফেরার সময় পথে হযরত মুসআব ইব্‌ন উমায়েরের স্ত্রী হামনা বিন্‌ত জাহাশ (রা)-এর সাথে দেখা হল। তাকে তার মামা হযরত হামযা (রা)-এর শাহাদতের খবর জানানো হলো। তিনি ইন্না লিল্লাহ... পড়লেন। এরপর তার ভাই হযরত আবদুল্লাহ ইব্‌ন জাহাশ (রা)-এর শাহাদতের খবর দেয়া হলো। তিনি ইন্না লিল্লাহ... পড়ে তার মাগফিরাত কামনা করলেন। এরপর তাঁর স্বামী মুসআব ইব্‌ন উমায়র (রা)-এর শাহাদতের সংবাদ দেয়া হলো। একথা শুনে তিনি দিশেহারা হয়ে যান এবং কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। হযরত নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এই হাল দেখে বললেন, মেয়েরা স্বামীদের প্রতি অধিকতর প্রীত থাকে।

আনসারদের এক গোত্রের এক মহিলার পিতা, ভ্রাতা ও স্বামী তিনজনই শহীদ হয়েছিলেন। তিনি নবী (সাঃ)-এর শাহাদতের গুজব শুনে মদীনা মুনাওয়ারা রওয়ানা করেন। পথে তাকে কেউ খবর দিল যে, তোমার পিতা শহীদ হয়েছেন। তিনি বললেন, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সুস্থ আছেন কিনা-তাই বলো। তারপর তাকে বলা হলো, তোমার ভাইও শহীদ হয়েছেন। তিনি এ খবর শুনে ঐ একই কথা বললেন : আমাকে হযরত নবী করীম (সাঃ)-এর খবর শোনাও। তিনি নিরাপদ আছেন কিনা। তারপর তাঁকে বলা হলো, তোমার স্বামীও শহীদ হয়েছেন। তিনি এ খবর শুনেও সেই একই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করলেন : হযরত নবী করীম (সাঃ) কেমন আছেন, তাই বলো। ইতিমধ্যে হযরত নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের নিকটে পৌঁছে গিয়েছিলেন। মহিলাকে বলা হলো-ঐ তো তিনি আসছেন। হযরত নবী করীম (সাঃ)-এর চেহারা মুবারক দেখে মহিলা বললেন : আপনি যখন সুস্থ আছেন তখন সব মুসীবতই তুচ্ছ। এ যুদ্ধ মদীনা থেকে মাত্র তিন-চার মাইল দূরে সংঘটিত হয়। চুক্তিপত্র অনুসারে মদীনা মুনাওয়ারার ইয়াহূদীদের মুসলমানদের পক্ষে এবং মক্কা মুয়াযযামার কাফিরদের বিপক্ষে যুদ্ধ করা উচিত ছিল।

আবদুল্লাহ ইব্‌ন উবায়্য-এর ফিরে আসার দরুন লোকসংখ্যা হ্রাস পাওয়ার পর কোন কোন সাহাবী নবী করীম (সাঃ)-কে বলেছিলেন ইয়াহূদীদের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করতে। কিন্তু হযরত রাসূল করীম (সাঃ) ইয়াহূদীদের নিকট সাহায্য চাওয়া পছন্দ করলেন না। সুতরাং ইয়াহূদীরা পরম আনন্দে নিজ নিজ গৃহে অবস্থান করলো এবং যুদ্ধের ফলাফল প্রত্যক্ষ করার অপেক্ষায় থাকলো। ইয়াহূদীদের মধ্যে মুখায়রিক নামক জনৈক ব্যক্তি তার সম্প্রদায়কে বললো যে, মুহাম্মদ (সাঃ)-কে সাহায্য করা তোমাদের উপর ফরয। তারা বললো, আজ শনিবার, তাই আমরা যুদ্ধ করতে পারি না। মুখায়রিক বললেন, এটা আল্লাহর নবী ও কাফিরের মধ্যে যুদ্ধ। এতে শনিবার অন্তরায় হতে পারে না। একথা বলে তিনি তলোয়ার হাতে তুলে নিলেন এবং সোজা যুদ্ধের ময়দানে পৌঁছে গেলেন। যাবার সময় ঘোষণা করে গেলেন : “আমি মারা গেলে মুহাম্মদ (সাঃ)-কে দোষারোপ করবে না। যুদ্ধে শরীক হলেন এবং নিহত হলেন। হযরত নবী (সাঃ) শুনে বললেন, ইয়াহূদীদের মধ্যে সে উত্তম ব্যক্তি ছিল। হারিছ ইব্‌ন সুওয়ায়দ নামক জনৈক মুনাফিক মুসলমানদের সাথে যুদ্ধের ময়দানে গিয়েছিল। তুমুল যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সে মুজযির ইব্‌ন যিয়াদ (রা) ও কায়স ইব্‌ন যায়দ (রা) নামে দু’জন মুসলমানকে শহীদ করে মক্কার দিকে পালিয়ে গেল। এর কিছুদিন পর সে মদীনায় ফিরে এলো এবং গ্রেফতার হয়ে হযরত উসমান ইব্‌ন আফফান (রা)-এর হাতে নিহত হলো। এ যুদ্ধে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ফায়দা হলো এই যে, তারা মুনাফিকদের ভাল করে চিনতে পেরেছেন। শত্রু ও মিত্রের মধ্যে তফাৎ করার সুযোগ হলো। মদীনায় পৌঁছার পর দিন অর্থাৎ তৃতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসের রোববার হযরত নবী করীম (সাঃ) হুকুম দিলেন, যারা গতকাল আমাদের সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, কেবল তারাই কাফিরদের সাথে মুকাবিলা করার জন্য যেন বের হয়। উহুদ যুদ্ধে যোগদান করেনি এরূপ নতুন কোন ব্যক্তিকে সঙ্গে নেয়ার অনুমতি ছিল না। শুধু হযরত জাবির ইব্‌ন আবদুল্লাহ (রা)-কে তিনি সঙ্গে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। সুতরাং উহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সমস্ত সাহাবী এমনকি আহতরাও নবী (সাঃ)-এর সঙ্গে মদীনা থেকে বের হলেন। তিনি মদীনা থেকে রওয়ানা হয়ে আট মাইল চলার পর হামরাউল আসাদ নামক স্থানে তাঁবু গাড়েন এবং তিন দিন পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। ঘটনাক্রমে মক্কাগামী মা‘বাদ ইব্‌ন আবী মা‘বাদ খুযাঈ মক্কার দিকে এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। রূহা নামক স্থানে পৌঁছে মুশরিকরা ভাবলো, এ যুদ্ধে আমাদের মুসলমানদের মুকাবিলায় কোনো বিজয় হয়নি। বড়জোর সমান সমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা বলা চলে। কেননা, আমরা যদি বলি যে, আমরা বিজয়ী বেশে ফিরে এসেছি, তবে লোকেরা বলবে যে, তোমাদের সাথে মুসলমান বন্দীরা কোথায়? তারপর জিজ্ঞেস করবে, গনীমতের মাল কোথায়? কাজেই আমাদের নিকট যখন কোন বন্দী নেই, গনীমতের মালও নেই এবং ওয়ালীদ ইব্‌ন আদী, আবূ উমাইয়া ইব্‌ন আবী হুযায়ফা, হিশাম ইব্‌ন আবী হুযায়ফা, উবায়্য ইব্‌ন খালাফ, আবদুল্লাহ ইব্‌ন হুমায়দ আসাদী, তালহা ইব্‌ন আবী তালহা, আবূ সাঈদ ইব্‌ন আবী তালহা, মাসাফি ও জিলাস নামক তালহার দুই পুত্র, আরতাত ইব্‌ন শারজীল প্রমুখ সতের জন বিখ্যাত কুরায়শ নেতা এবং পাঁচ-ছয়জন অপর বাহাদুর ব্যক্তিকে হারিয়ে এলাম, তখন আমাদেরকে বিজেতা বলবে কে? অন্যদিকে, আমরা কেবল হামযা (রা), মুসআব (রা) প্রমুখের মতো তিন-চারজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিকেই কতল করতে পেরেছি। একথা চিন্তা করে সবার মত পাল্টে গেলো। নতুন করে আবার যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুতি চললো। আবূ সুফিয়ান সমুদয় সৈন্য নিয়ে ‘রূহা’ থেকে মদীনার উপর হামলা করার প্রস্তুতি নিল। ইত্যবসরে মা‘বাদ ইব্‌ন আবী মা‘বাদ রূহায় এসে পৌঁছলো। সে আবূ সুফিয়ানকে তথ্য সরবরাহ করল যে, মুহাম্মদ (সাঃ) মদীনা থেকে বের হয়ে তোমার পশ্চাদ্ধাবনে এগিয়ে আসছেন। হামরাউল আসাদে আমি তাদের সেনাবাহিনী দেখতে পেয়েছি। সম্ভবত খুব শীঘ্রই তারা তোমাদের কাছে পৌঁছে যাবেন। এ খবর শোনা মাত্রই কাফির বাহিনী হতবুদ্ধি হয়ে সেখান থেকে সোজা মক্কার দিকে ছুটে চললো। মক্কায় পৌঁছে তারা যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। হযরত নবী করীম (সাঃ) যখন নিশ্চিত হলেন যে, কাফিররা হতবুদ্ধি হয়ে মক্কার দিকে পালিয়ে যাচ্ছে, তখন তিনি মদীনায় ফিরে এলেন। তাঁর এ যুদ্ধযাত্রা ‘গাযওয়ায়ে হামরাউল আসাদ’ নামে খ্যাত। এর ফলে কাফিরদের অন্তরে মুসলমানদের ভয় দৃঢ় হয় এবং মদীনা তাদের আক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকে। উহুদ যুদ্ধে তীরন্দাজদের রাসূলে করীম (সাঃ)-এর নির্দেশ পালনে ভুল বুঝাবুঝির দরুন মুসলিম পক্ষে বিপদ দেখা দেয়। তারা হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। এই যুদ্ধ সম্পর্কে সাধারণভাবে মশহুর হয়ে আছে যে, মুসলিম পক্ষ পরাজিত হয়েছে। কিন্তু এটা অত্যন্ত বিরাট ভুল। মুসলমানগণ কাফিরদেরকে তাদের সম্মুখ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং কাফিররা পরাস্ত হয়েছিল। পরে তারা পুনরায় আক্রমণ করে। কিন্তু নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ও মুসলিম বাহিনী যুদ্ধের ময়দান ত্যাগ করেননি। কাফিররাই পরবর্তী বছরের জন্য যুদ্ধ মুলতবি করে এবং মুসলিম বাহিনী তাদের যুদ্ধ বিরতি মেনে নেয়। ময়দান থেকে প্রথমে কাফিররা মক্কার দিকে রওয়ানা হয়। তারপর মুসলমানগণ সেখান থেকে মদীনায় রওয়ানা করেন।

হামরাউল আসাদে মুসলমানদের আগমন সংবাদ পেয়ে কাফিররাই হতবুদ্ধি হয়ে পলায়ন করে। তবে এটা ঠিক যে, নিহত কাফিরদের তুলনায় মুসলিম শহীদদের সংখ্যা বেশী ছিল। এ হচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্রে সাধারণ ঘটনা। এই যুদ্ধের পর যিলহাজ্জ মাস পর্যন্ত এ বছর আর কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি। এ বছরই রমযান মাসের প্রায় মাঝামাঝি হযরত হাসান ইব্‌ন আলী (রা) জন্ম গ্রহণ করেন। উহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের আঘাত প্রাপ্তির দরুন মদীনার মুনাফিক ও ইয়াহূদীরা খুব খুশী হয় এবং তাদের স্পর্ধা বেড়ে যায়। কিন্তু হযরত নবী করীম (সাঃ) তাদের উপেক্ষার চোখেই দেখতে থাকেন।