hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

ইসলামের ইতিহাস ১ম খণ্ড

লেখকঃ মাওলানা আকবর শাহ খান নজিববাদী

৩০৫
কাদিসিয়া যুদ্ধ
হযরত মুগীরা (রা) ফিরে আসার সাথে সাথে রুস্তম তার বাহিনীকে প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দেন। উভয় বাহিনীর মধ্যে একটি নদী প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রুস্তম সে নদীর উপর সেতু নির্মাণের নির্দেশ দেন এবং তার নির্দেশ সাথে সাথে কার্যকর হয়। পরদিন ভোর বেলা রুস্তম হযরত সা‘দ (রা)-এর কাছে পয়গাম পাঠান : তুমি নদীর এপারে এসে লড়বে, না আমরাই ওপারে আসবো? হযরত সা‘দ (রা) বলে পাঠান : তোমরাই নদীর এপারে চলে এসো। কাজেই সমগ্র ইরানী বাহিনী নদী অতিক্রম করে রণক্ষেত্রে এসে দাঁড়ালো। ডান পাশের বাহিনী বাম পাশের বাহিনী, অগ্রবর্তী বাহিনী, পশ্চাদবর্তী বাহিনী তথা সমগ্র বাহিনীর প্রত্যেকটি অংশকে রুস্তম জঙ্গী হাতি ও বর্ম পরিহিত অশ্বারোহী বাহিনী দ্বারা মজবুত ও সুদৃঢ় করে তুললেন। তিনি নিজে মধ্যবর্তী বাহিনীতে অবস্থান নেন। ইরানী বাহিনীর সংখ্যা ছিল দু’লক্ষেরও অধিক। তাছাড়া ইসলামী বাহিনীর তুলনায় ইরানী বাহিনী ছিল রণ-সজ্জায় অধিকতর সজ্জিত। ইসলামী বাহিনীর প্রধান সেনাপতি হযরত সা‘দ ইব্‌ন আবূ ওয়াক্কাস (রা) ‘ইরকুন্ নিসা’ (উরু থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত অসহ্যকর ব্যথা) রোগাক্রান্ত ছিলেন বলে না ঘোড়ার উপর আরোহণ করতে পারছিলেন, আর না চলাফেরা করতে পারছিলেন। রণক্ষেত্রে ইসলামী বাহিনীর ঠিক সম্মুখভাগে প্রাচীন যুগে নির্মিত একটি দালান দাঁড়িয়েছিল। হযরত সা‘দ (রা) স্বয়ং ঐ দালানের ছাদে উঠে একটি বড় তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে পড়েন এবং আপন জায়গায় হযরত খালিদ ইব্‌ন আরফাতা (রা)-কে যুদ্ধক্ষেত্রের নেতা মনোনীত করেন, তবে যুদ্ধের ছক প্রণয়ন এবং যুদ্ধ কৌশল রদবদলের যাবতীয় দায়িত্ব তিনি নিজ হাতেই রেখে দেন। সে অনুযায়ী তিনি সব সময় হযরত খালিদ ইব্‌ন আরফাতার কাছে প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রেরণ করতে থাকেন। যা হোক ইরানী বাহিনীর প্রস্তুতির সংবাদ শুনে ইসলামী বাহিনীর মধ্যেও সাজ সাজ রব পড়ে যায়। হযরত সা‘দ (রা)-এর নির্দেশ অনুযায়ী হযরত আমর ইব্‌ন মা‘দীকারিব (রা), হযরত আসিম ইব্‌ন আমর (রা), হযরত রিবঈ (রা), হযরত আমের (রা) প্রমুখ নেতা সমগ্র ইসলামী বাহিনী পরিক্রম করে মুসলমানগণকে জিহাদের জন্য উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করে তোলেন। কবিরা রণসঙ্গীত গাইতে থাকে এবং কারী সাহেবরা সুমধুর সুরে যুদ্ধের বর্ণনাসম্বলিত সূরা ‘আনফাল’-এর আয়াতসমূহ তিলাওয়াতের মাধ্যমে সমগ্র বাহিনীর মধ্যে এক অতুলনীয় প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে।

মোটকথা, উভয় বাহিনী যুদ্ধাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সারিবদ্ধভাবে পরস্পরের সম্মুখীন হয়। সর্বপ্রথম ইরানী বাহিনীর পক্ষ থেকে হরমুয নামীয় একজন রাজকুমার যুদ্ধক্ষেত্রে আসে। তার মাথায় ছিল সোনার মুকুট। সে ছিল ইরানের বিখ্যাত বীরদের অন্যতম। তার সাথে মুকাবিলা করার জন্য মুসলিম বাহিনী থেকে হযরত গালিব ইব্‌ন আবদুল্লাহ্ (রা) এগিয়ে যান এবং মুহূর্তের মধ্যে হরমুযকে বন্দী করে নিয়ে এসে হযরত সা‘দ (রা)-এর হাতে সমর্পণ করেন। তারপর আর একজন বীর অশ্বারোহী পারস্য বাহিনী থেকে এগিয়ে আসে। তার মুকাবিলা করার জন্য মুসলিম বাহিনী থেকে হযরত আসিম (রা) এগিয়ে যান। উভয় পক্ষের মধ্যে দু’একটি সংঘাত হতে না হতেই ইরানী অশ্বারোহী পলায়ন করে। হযরত আসিম (রা) তার পশ্চাদ্ধাবন করেন এবং পারস্য বাহিনীর সম্মুখসারির নিকটবর্তী হতেই তার (প্রতিপক্ষের) ঘোড়ার লেজ টেনে ধরে তাকে ঘোড়ার পিঠ থেকে নামিয়ে তারপর জাপটে ধরে নিজের ঘোড়ার উপর বসিয়ে বন্দী করে নিয়ে আসেন। হযরত আসিম (রা)-এর এ বীরত্ব প্রত্যক্ষ করে ইরানী বাহিনীর আর একজন বীর রৌপ্য নির্মিত একটি বিরাট গদা নিয়ে এগিয়ে আসে। তার মুকাবিলায় হযরত আমর ইব্‌ন মাদীকারিব (রা) এগিয়ে যান এবং চোখের পলকে তাকে বন্দী করে নিয়ে আসেন। রুস্তম তার বেশ কয়েকজন সেনাপতিকে এভাবে বন্দী হতে দেখে সমগ্র বাহিনীকে একসাথে মুসলমানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। প্রথমে সারিবদ্ধ রণহস্তীদেরকে মুসলিম বাহিনীর মুখোমুখী দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। বুজায়লা গোত্র হস্তীদের এ আক্রমণ প্রতিরোধ করে। তবে এজন্য তাদেরকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। হযরত সা‘দ (রা) যিনি অত্যন্ত গভীরভাবে যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিলেন, বনী আসাদ গোত্রের লোকদেরকে নির্দেশ দেন, যেন তারা অতি শীঘ্রই বুজায়লা গোত্রের সাহায্যে এগিয়ে যায়। বনী আসাদ সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে যায় এবং বীরদর্পে হস্তী বাহিনীকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের অবস্থাও যখন নাজুক হয়ে পড়ে তখন হযরত সা‘দ (রা) কিনদাহ গোত্রকে সে দিকে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। বনূ কিনদাহ এমনভাবে হস্তী বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে যে, ইরানীরা অনন্যোপায় হয়ে পিছনে হটতে থাকে। রুস্তম এ পরিস্থিতি লক্ষ্য করে তার সমগ্র বাহিনীকে একসাথে মুসলমানদের উপর হামলা করার নির্দেশ দেন। শত্রুদের এ সম্মিলিত আক্রমণ লক্ষ্য করে হযরত সা‘দ (রা) উচ্চৈঃস্বরে তাকবীর ধ্বনি তোলেন। সমগ্র মুসলিম বাহিনীও তাঁর অনুসরণে তার ধ্বনি তুলে এবং ইরানীদের উপর একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে। উভয় বাহিনীর আক্রমণ প্রতি আক্রমণ দেখে মনে হচ্ছিল, যেন দু’টি সমুদ্র পরস্পরের উপর আছড়ে পড়ছে বা দু’টি পর্বত পরস্পরকে সজোরে ধাক্কা মারছে। শীঘ্রই দু’টি বাহিনীর সৈন্যরা পরস্পরের সাথে মিশে গেল। এমতাবস্থায় ইরানী জঙ্গী হাতিরা ইসলামী বাহিনীর মারাত্মক ক্ষতিসাধন করতে থাকে। হযরত সা‘দ (রা) তীরন্দাজদেরকে তৎক্ষণাৎ নির্দেশ দেন যেন তারা হাতি ও হাতির আরোহীদের উপর অবিলম্বে তীর নিক্ষেপ করতে শুরু করে। হযরত আসিম (রা) বর্শা দিয়ে হাতির শুঁড় ক্ষতবিক্ষত করতে শুরু করলেন। মুসলিম তীরন্দাজরা এমন ভয়ানকভাবে তীর বর্ষণ করল যে, হাতির উপর আরোহী ইরানী তীরন্দাজরা তাদের তীর নিক্ষেপের অবকাশই পেল না। ফলে হস্তীবাহিনী পিছনে হটতে থাকে এবং এ সুযোগে মুসলিম বীরেরা তাদের তরবারি চালনার অপূর্ব কৌশল প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলতে থাকে। রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে এলে, পরদিন ভোর পর্যন্ত যুদ্ধ আপনা আপনি স্থগিত হয়ে যায়। তা হলো হিজরী ১৪ সনের মুহাররম মাসের রোববারের ঘটনা।

পরদিন ফজরের নামাযের পর হযরত সা‘দ ইব্‌ন আবূ ওয়াক্কাস (রা) শহীদগণকে কাদিসিয়ার পূর্ব প্রান্তে দাফনের ব্যবস্থা করেন। শহীদগণের সংখ্যা ছিল পাঁচশ’। রাতের বেলায়ই আহতদের ক্ষতস্থানে মলম পট্টি লাগানোর ব্যবস্থা করা হয়। শহীদগণের দাফন সম্পন্ন করে ইসলামী বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ায়। ইরানীরাও অবস্থান গ্রহণ করে। যুদ্ধ তখনো শুরু হয়নি। এমন সময় সংবাদ এলো যে, সিরিয়া থেকে যে মুসলিম বাহিনী পাঠানো হয়েছিল, তারাও কাদিসিয়ার সন্নিকটে পৌঁছে গেছে। হযরত আবূ উবায়দা ইব্‌ন জাররাহ (রা), হযরত হাশিম ইব্‌ন উতবা (রা)-এর নেতৃত্বে ঐ বাহিনী ইরাক থেকে পাঠিয়েছিলেন। এর সম্মুখভাগের দায়িত্বে ছিলেন হযরত কা‘কা‘ ইব্‌ন আমর (রা)। তিনি তার ভাগের এক হাজার মুজাহিদ নিয়ে সর্বপ্রথম কাদিসিয়ায় পৌঁছেন এবং হযরত সা‘দ (রা)-কে অবশিষ্ট বাহিনীসমূহেরও আগমন সংবাদ দিয়ে তাঁরই অনুমতিক্রমে নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে চলে যান এবং প্রতিপক্ষের কাছে একজন প্রতিদ্বন্দ্বী পাঠাবার আহবান জানান। তার সাথে মুকাবিলা করার জন্য বাহমান জাদওয়ায়হ এগিয়ে আসে। দীর্ঘক্ষণ আক্রমণ প্রতি-আক্রমণ চলে। শেষ পর্যন্ত হযরত কা‘কা‘ (রা)-এর হাতে বাহমান নিহত হয়। অনুরূপভাবে আরো কয়েকজন নামকরা ইরানী যোদ্ধা একের পর এক হযরত কা‘কা‘ (রা)-এর হাতে ধরাশায়ী হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে এবার রুস্তম তার সমগ্র বাহিনীকে একজোটে মুসলমানদের উপর হামলা করার নির্দেশ দেন। জোরে লড়াই শুরু হয়। পথিমধ্যে হযরত হাশিম ইব্‌ন উতবা (রা) যখন এ ভীষণ যুদ্ধের সংবাদ পান, তখন তিনি তার বাহিনীর ছয় হাজার সৈন্যকে অনেকগুলো ছোট ছোট দলে বিভক্ত করেন এবং কিছুক্ষণ পর পর এক একটি দলকে তাকবীর ধ্বনি তুলে যুদ্ধরত মুসলিম বাহিনীর সাথে মিলিত হওয়ার নির্দেশ দেন। এভাবে মুজাহিদগণের এক এক খণ্ড বাহিনীর মূল বাহিনীর সাথে মিলিত হতে থাকে। আর মুসলিম বাহিনীর সাহায্যার্থে এভাবে একটির পর একটি বাহিনী আসতে দেখে ইরানীদের অন্তরে দারুণ ভীতির সঞ্চার হয়।

আজও হস্তীবাহিনী মুসলমানগণকে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ফেলে রাখে। কিন্তু তারা আজ একটি নতুন কৌশল অবলম্বন করে। তারা তাদের উটের উপর থলের মত করে লম্বা লম্বা কাপড় ঝুলিয়ে দেয়। ফলে উটগুলোও হাতির মত ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। আর তা দেখে ইরানী ঘোড়াগুলো ভীতিগ্রস্ত হয়ে এদিক-সেদিক ছুটে পালাতে শুরু করে। ফলে ইরানী হাতি দ্বারা এতক্ষণ ইসলামী বাহিনী যতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, এখন মুসলিম বাহিনীর কৃত্রিম হাতি দ্বারা ইরানী বাহিনীও সেরূপ ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। আর এ সুযোগে হযরত কা‘কা‘ (রা) শত্রুপক্ষের অনেক পদাতিক সৈন্য ও অশ্বারোহীকে হত্যা করেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলে। এদিন মোট এক হাজার মুসলমান এবং দশ হাজার ইরানী যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ হারায়।

তৃতীয় দিন প্রত্যুষে ফজরের নামায আদায় করেই হযরত সা‘দ (রা) প্রথমে শহীদগণের লাশ দাফনের ব্যবস্থা করেন। আহত সৈন্যদের দায়িত্ব মহিলাদের উপর অর্পণ করা হয়। মহিলারা আহতদের ক্ষতস্থানে মলম-পট্টি লাগাবার ব্যবস্থা করে। তারপর উভয় বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে একে অন্যের মুখোমুখি হয়। আজও ইরানীরা হাতিগুলোকে সম্মুখে ঠেলে দেয়। কিন্তু হযরত কা‘কা‘ ও হযরত আসিম (রা) সম্মিলিতভাবে আক্রমণ চালিয়ে জঙ্গী হাতিদের সরদার সাদা হাতিটিকে বধ করে ফেলেন। তারপর অন্য একটি বিরাট হাতিকে বধ করে ফেলেন। তারপর অন্য একটি হাতিকে আক্রমণ করা হয় এবং সে আক্রমণ সহ্য করতে না পেরে হাতিটি ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালায়। আর ঐ পলায়নপর হাতিটিকে অনুসরণ করে অন্য হাতিরাও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাতে শুরু করে। এভাবে আজ হাতিদের দ্বারা ইসলামী বাহিনী ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরিবর্তে ইরানী বাহিনীই উল্টো ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। কেননা, হাতিগুলো পিছন ফিরে পালাবার সময় ইরানী বাহিনীকে দলিত-মথিত করে যাচ্ছিলো। এদিনও ঘোরতর যুদ্ধ হয় এবং সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। সূর্য অস্ত যাওয়ার পর কিছু সময়ের জন্য উভয় বাহিনী পরস্পর থেকে পৃথক হয়ে যায়। তারপর তাৎক্ষণিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে পুনরায় একে অন্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মাগরিবের সময় থেকে শুরু করে ভোর পর্যন্ত যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। সারারাত ব্যাপী এমনভাবে হৈ চৈ চলে যে, হযরত সা‘দ (রা) কিংবা রুস্তম কেউই যুদ্ধের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হতে পারছিলেন না। মোটকথা, এটি ছিল একটি বিস্ময়কর রাত। ইসলামী বাহিনীর প্রধান সেনাপতি হযরত সা‘দ (রা) সারা রাত দু‘আর মধ্যে কাটিয়ে দেন। মধ্যরাত্রির পর যুদ্ধক্ষেত্রের হৈ চৈ-এর মধ্যে তিনি হযরত কা‘কা‘ (রা)-এর আওয়াজ শুনতে পান। তিনি তার লোকদেরকে বলছিলেন : সব দিক গুটিয়ে নিয়ে মধ্যবর্তী বাহিনীকে আক্রমণ কর এবং রুস্তমকে বন্দী কর। এ আওয়াজ শুধু হযরত সা‘দ (রা)-কে আশ্বস্ত করেনি, বরং সমগ্র মুসলিম বাহিনীর মধ্যে নবজীবনের সঞ্চার করে। সারাদিন এবং সারারাত লড়াই করে মুসলিম মুজাহিদরা একেবারে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। এতদসত্ত্বেও প্রত্যেক গোত্রের সরদার নিজ নিজ লোকদেরকে লড়াই চালিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করেন। পুনরায় মুসলমানরা নব উদ্যমে তরবারি চালাতে শুরু করে। হযরত কা‘কা‘ (রা) তার সেনাদল নিয়ে সেই স্থান পর্যন্ত পৌঁছে যান, যে স্থানে রুস্তম একটি সোনার সিংহাসনে বসে আপন বাহিনীকে পরিচালনা করছিলেন। মুসলিম আক্রমণকারীরা রুস্তমের নিকটবর্তী হতেই তিনি সিংহাসন থেকে নেমে স্বয়ং লড়তে শুরু করেন। কিন্তু কিছুটা আহত হওয়ার সাথে সাথে পিঠটান দেন। তখন হযরত হিলাল (রা) বিদ্যুৎ বেগে এগিয়ে গিয়ে তাকে লক্ষ্য করে বর্শা নিক্ষেপ করেন। ফলে তার (রুস্তমের) মাজা টুটে যায় এবং তিনি নদীতে গড়িয়ে পড়েন। হিলাল সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়া থেকে নেমে রুস্তমের পা দু’টি টেনে ধরেন। তারপর তাকে উপরে তুলে এনে হত্যা করেন। এবার তিনি রুস্তমেরই সিংহাসনে দাঁড়িয়ে উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করেন : মহান আল্লাহর শপথ, আমি রুস্তমকে হত্যা করেছি। এ ঘোষণা প্রচারের সাথে সাথে ইসলামী বাহিনীতে উচ্চৈঃস্বরে তাকবীর ধ্বনি উঠে। ফলে ইরানীরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যায়। ইরানী বাহিনীতে অশ্বারোহীদের সংখ্যা ছিল ত্রিশ হাজার—এদের মধ্য থেকে শুধু ত্রিশ জন সেদিন প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। বাকী সবাই শোচনীয়ভাবে মৃত্যুবরণ করে। হযরত যেরার ইব্‌ন খাত্তাব (রা) ইরানের রাজকীয় পতাকাটি দখল করে নেন এবং তা ত্রিশ হাজার দীনারে বিক্রি করেন। প্রকৃতপক্ষে ঐ পতাকাটির মূল্যমান ছিল দু’লক্ষ দশ হাজার দীনার। এ যুদ্ধে মুসলমানদের সর্বমোট ছয় হাজার মুজাহিদ শাহাদত বরণ করে। হযরত সা‘দ (রা) রুস্তমের সমগ্র সম্পদ ও অস্ত্রশস্ত্র হযরত হিলাল ইব্‌ন আলকামা (রা)-কে প্রদান করেন। হযরত কা‘কা‘ (রা) ও হযরত শুরাহবীল (রা)-কে ইরানীদের পশ্চাদ্ধাবনের জন্য প্রেরণ করা হয়। কিন্তু এর আগেও হযরত যুহরা ইব্‌ন হাওয়াহ একদল মুজাহিদসহ পলায়নপর ইরানীদের পশ্চাদ্ধাবনে রওয়ানা হয়ে গিয়েছিলেন। পথিমধ্যে একটি জায়গায় জালীনূস পলায়নপর ইরানী যোদ্ধাদেরকে একত্র করছিলেন। হযরত যুহরা (রা) তাকে হত্যা করেন এবং তার পরিত্যক্ত যাবতীয় আসবাব-সামগ্রীসহ হযরত সা‘দ (রা)-এর কাছে নিয়ে যান। জালীনূসের আসবাব-সামগ্রী হযরত যুহরা (রা)-কে প্রদানের ব্যাপারে হযরত সা‘দ (রা) কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে ছিলেন। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি চূড়ান্ত বিবেচনার জন্য খলীফার দরবারে পেশ করা হয়। হযরত ফারূকে আযম (রা) যুহরা (রা)-এর এ বীরত্বপূর্ণ কাজের প্রশংসা করেন এবং জালীনূসের যাবতীয় আসবাব-সামগ্রী তাঁকে দিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন।

রণক্ষেত্রের হাঙ্গামা নিবৃত্ত হওয়ার পরহযরত সা‘দ গনীমত-সামগ্রী একত্র করেন এবং এ বিজয়-সংবাদ জানিয়ে হযরত ফারূকে আযম (রা)-এর কাছে একটি পত্র লিখেন। একটি দ্রুতগামী উট-সওয়ারের মাধ্যমে পত্রটি মদীনা মুনাওয়ারায় প্রেরণ করা হয়। মদীনা তাইয়িবায় তখন হযরত ফারূকে আযম (রা)-এর এ অবস্থা ছিল যে, তিনি প্রত্যহ ভোর বেলা মদীনা শরীফ থেকে বের হয়ে অনেক দূর পর্যন্ত চলে যেতেন এবং সেখানে বেশ কিছুক্ষণ কাদিসিয়ার দূতের অপেক্ষা করে দুপুরের পর মদীনা শরীফে ফিরে আসতেন। একদিন যথারীতি মদীনা শরীফের বাইরে গিয়ে তিনি দূতের অপেক্ষা করছিলেন, এমন সময় অনেক দূরে একটি উট-সওয়ার তার নজরে পড়ে। তিনি তার দিকে দ্রুতবেগে ছুটে যান এবং নিকটে পৌঁছে তাকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কোত্থেকে আসছো। সে উত্তর দিল, আমি কাদিসিয়া থেকে এ সংবাদ নিয়ে এসেছি যে, আল্লাহ তা‘আলা মুসলমানদেরকে বিজয়ী করেছেন। হযরত ফারূকে আযম (রা) তাকে যুদ্ধের অবস্থা এবং বিজয়লাভের খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন করতে থাকেন এবং উট সওয়ারের জীনের রেকাব টেনে ধরে তার সাথে ছুটতে ছুটতে মদীনায় প্রবেশ করেন। উট সওয়ার হযরত উমর ফারুক (রা)-এর কাছে যুদ্ধের অবস্থাদি বর্ণনা করতে করতে উটের পিঠে বসেই দরবারে খিলাফতের দিকে দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু শহরে দাখিল হওয়ার পর উট সওয়ার দেখতে পেলেন যে, প্রতিটি লোক সামনে এগিয়ে এসে তার সাথের লোকটিকে সালাম করছে এবং ‘আমীরুল মু‘মিনীন’ বলে সম্বোধন করছে। তখন সে বুঝতে পারে যে, যে ব্যক্তি তার সাথে হেঁটে আসছেন তিনিই মুসলমানদের খলীফা। এটা বুঝতে পেরেই তিনি ভীত হয়ে উট থেকে অবতরণ করার চেষ্টা করেন। এতে হযরত ফারূকে আযম (রা) বললেন : তুমি যুদ্ধের অবস্থাদি বর্ণনা করতে থাক এবং উটের পিঠে বসেই সামনের দিকে এগিয়ে চল। এভাবে তিনি তার ঘরে গিয়ে পৌঁছেন। তারপর মসজিদে নববীতে গিয়ে লোকজনদের জড়ো করে এ বিজয় সংবাদ প্রদান করেন। ঐ সমাবেশে তিনি একটি অতি হৃদয়গ্রাহী ভাষণ দেন এতে তিনি এও বলেছিলেন–

ভাইসব! আমি বাদশাহ নই ; আমি তোমাদেরকে আমার গোলামে পরিণত করতে চাই না। আমি নিজেই তো মহান আল্লাহ্‌র গোলাম। তবে খিলাফতের দায়িত্বে এমনভাবে আঞ্জাম দিই যে, তোমরা শান্তির সাথে নিজ নিজ ঘরে বসবাস করতে পার তাহলে তা হবে আমার জন্য সৌভাগ্যের বিষয়। মহান আল্লাহ না করুন, যদি আমার অভিলাষ হয় যে, তোমরা আমার দরজায় এসে ধর্না দাও—তাহলে তা হবে আমার জন্য দুর্ভাগ্যের বিষয়। আমি তোমাদেরকে শিক্ষা দেই এবং উপদেশ দেই—তবে শুধু বাক্য দ্বারা নয়, কর্মের দ্বারাও।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন