hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

ইসলামের ইতিহাস ১ম খণ্ড

লেখকঃ মাওলানা আকবর শাহ খান নজিববাদী

৪২৭
একনযরে আলী (রা)-এর খিলাফতকাল
হযরত আলী (রা) ছিলেন এমনি একজন শীর্ষস্থানীয় সাহাবী যার ইনতিকালের পর এমন কোন ব্যক্তি বর্তমান ছিলেন না যার সম্মান ও মর্যাদা সমগ্র মুসলিম বিশ্বের কাছে স্বীকৃত ছিল এবং যিনি অত্যন্ত দুঃসাহসিকতার সাথে মানুষকে ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের প্রতিরোধ করতে পারতেন। হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রা) তাঁর শাহাদাত লাভের সংবাদ শুনে বলেন, এখন আরবের লোকেরা যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। কেননা তার পরে এমন আর কেউ বেঁচে নেই, যে তাদের খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখতে সক্ষম। অবশ্য একথা মনে করলে চলবে না যে, হযরত আলী (রা)-এর পর সাহাবায়ে কিরাম (রা) ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের প্রতিরোধ করার কাজ ছেড়ে দিয়েছিলেন। তারা নিশ্চয়ই তা করতেন, তবে শুধু একজন উপদেশ দাতা ও নসীহতকারী হিসাবে। আর হযরত আলী (রা) ছিলেন ঐ সমস্ত ব্যক্তির অন্যতম যাঁরা নবী-রাসূলদের মতই মানুষকে কিছু করার আদেশ দিতেন। এমনকি ব্যক্তিগত রাজনৈতিক বিরোধ থাকা সত্ত্বেও আমীরে মুআবিয়া (রা) মাযহাবী বিষয়াদির ক্ষেত্রে আলী (রা) থেকে ফতওয়া গ্রহণ করতেন।

হযরত আলী (রা) কূটকৌশল ও প্রবঞ্চনা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন। তাঁর মতে হক ও সত্যকে স্বীকার করে নেওয়া সবচাইতে বেশি জরুরী। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর নিকটাত্মীয় হওয়ার কারণে তিনি প্রথম থেকেই নিজেকে খিলাফত পদের জন্য সর্বাধিক যোগ্য মনে করতেন এবং একথা তিনি সাধারণ্যে প্রকাশও করেছিলেন। এ কারণেই বেশ কিছু দিন পর্যন্ত তিনি হযরত আবূ বকর (রা)-এর হাতে বায়‘আত করেননি। কিন্তু ঐ সময়ে আবূ সুফিয়ান আবূ বকর (রা)-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য তাঁকে প্ররোচিত করলে তিনি অত্যন্ত কড়া ভাষায় তাকে ধমক দেন। কেননা তিনি এ ধরনের কাজ অত্যন্ত খারাপ মনে করতেন। তারপর যখন তার বুদ্ধিতে একথা আসে যে, খিলাফতের ব্যাপারে আত্মীয়তার কোন সম্বন্ধ নেই, বরং এ ব্যাপারে আরো অনেক জরুরী বিষয় বিবেচনা করতে হয় এবং রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর পর হযরত আবূ বকর (রা) ছিলেন খিলাফত পদের জন্য সর্বাধিক যোগ্য ব্যক্তি তখন তিনি নিজে থেকে হযরত আবূ বকর (রা)-এর কাছে গিয়ে তাঁর হাতে বায়‘আত করেন। আর বায়‘আত করার পর তিনিই ছিলেন আবূ বকর (রা)-এর সবচেয়ে বড় সাহায্যকারী ও সবচেয়ে বেশি অনুগত। উমর ফারূক (রা) তাঁর খিলাফতকালে আলী (রা)-এর পরামর্শকেই সবচাইতে বেশি মূল্য দিতেন এবং যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে প্রধানত তার অভিমতই গ্রহণ করতেন। আলী (রা) উসমান (রা)-কেও সব সময় সুপরামর্শ দিতেন। উসমান (রা) তার পরামর্শ অনুযায়ী চলেন, না অন্যের পরামর্শ অনুযায়ী, সেদিকে তিনি দৃষ্টিপাত করতেন না। আবার উসমান (রা)-এর কোন কাজ তার কাছে আপত্তিকর মনে হলে তিনি বিনাদ্বিধায় তার প্রতিবাদ করতেন। লোকেরা যখন হযরত উসমান (রা)-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে তখন তাঁর (আলীর) দৃষ্টিতে এ অভিযোগ যতটুকু সত্য তিনি ঠিক ততটুকু পর্যন্তই তার বিরোধিতা করেন এবং তা থেকে তাকে বিরত রাখার চেষ্টা করেন। এ ছাড়া বাকি সবটুকুতেই তিনি হযরত উসমান (রা)-কে সমর্থন করেন। মদীনা যখন বিদ্রোহীদের আয়ত্তাধীন এবং সেখানে যখন তারা বাড়াবাড়িমূলক কার্যকলাপ শুরু করে দিয়েছে তখন তিনি নিজেকে নিরপেক্ষ ও দায়মুক্ত রূপে প্রকাশ করার জন্য কোন চালবাজির আশ্রয় নেননি বরং সেই অবস্থায়ও তিনি নিজের পবিত্র স্বভাব ও পবিত্র মানসিকতার উপর কায়েম থাকেন। উসমান (রা)-এর শাহাদত লাভের পর যখন লোকেরা তার হাতে বায়‘আত করতে চায় তখন তিনি যেহেতু নিজেকে খিলাফত পদের জন্য সর্বাধিক যোগ্য মনে করতেন তাই শুধু লোক দেখানোর জন্য তিনি বায়‘আত গ্রহণে ইতস্তত করেননি বা তার প্রতি অনীহা প্রকাশ করেননি। হযরত উসমান (রা)-কে খলীফা নির্বাচন কালে তাঁর (আলীর) ধারণা ছিল যে, তাকেই খলীফা নির্বাচন করা হবে। আর প্রকৃত ব্যাপারও ছিল এই যে, উমর ফারূক (রা)-এর পর যদি তিনি খলীফা নির্বাচিত হতেন তাহলে মুসলিম বিশ্বের সেই অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিত না যা পরবর্তী সময়ে সমগ্র মুসলিম মিল্লাতকে একেবারে ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছিল। কিন্তু সাহাবায়ে কিরামের এই সতর্কতা অবলম্বনের কারণে যে ইসলামী খিলাফতকে আত্মীয়তার সাথে কোনভাবেই সম্পর্কযুক্ত করা উচিত হবে না উসমান (রা)-কে আলীর মুকাবিলায় প্রাধান্য দেওয়া হয়, তখন হযরত আলী (রা)-ও সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রতি লক্ষ্য করে বিনা দ্বিধায় উসমান (রা)-এর হাতে বায়‘আত করেন। মোটকথা, আলী (রা)-এর যাবতীয় কাজকর্ম থেকে একথা পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হয় যে, তিনি যে কথাকে ন্যায় ও সত্য মনে করতেন সে কথাকে প্রকাশ করতে মোটেই দ্বিধা করতেন না। তার চেহারা ছিল তার অন্তরের ছবি এবং তার বাহ্যিক অবস্থা ছিল তাঁর অভ্যন্তরীণ অবস্থার দর্পণ। তিনি ছিলেন এক উলঙ্গ তরবারি। সত্যকে সত্য বলাই ছিল তাঁর প্রকৃতি। যদি তার স্থলে অন্য কোন ব্যক্তি হত তাহলে সে উসমান হত্যার সময়ে অনেক কিছু থেকেই নিজেকে গুটিয়ে রাখত এবং খিলাফতের বায়‘আত গ্রহণকালে অনেক ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করত। অনুরূপভাবে খিলাফতের বায়‘আত অনুষ্ঠানের পর সাধারণ গুজবসমূহের প্রভাব দূরীকরণ এবং বনূ উমাইয়াদের বিরোধিতামূলক প্রচেষ্টাসমূহ বানচাল করার উদ্দেশ্যে মুহাম্মদ ইব্‌ন আবূ বকর, মালিক আশতার প্রমুখ কয়েকজন বিদ্রোহীকে উসমান (রা)-এর হত্যার কিসাসস্বরূপ হত্যা করে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা স্বাভাবিক করে নেওয়া খুব একটা কঠিন ছিল না। কেননা এ ব্যাপারে মুসলিম বিশ্বের জনসাধারণ আলী (রা)-কে সহায়তাদানে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু এ ধরনের নিশ্চিত কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ তার হস্তগত হয়নি যার ভিত্তিতে তিনি (হযরত আলী) ঐসব লোকের মৃত্যুদণ্ড দিতে পারেন। অতএব তিনি বিষয়টি সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করতে থাকেন এবং ইত্যবসরে যে ফিতনার সৃষ্টি হয় তার মুকাবিলাও করেন, কিন্তু যে কাজটি তিনি করণীয় মনে করেননি তা কখনো করেননি।

যে সমস্ত লোক আলী (রা)-এর সংস্পর্শে এসেছিল তাদের বেশির ভাগই ছিল সুযোগ সন্ধানী, সুচতুর ও চালবাজ। তাছাড়া রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর যুগ থেকে ফারূকে আযম (রা)-এর যুগ পর্যন্ত যে ইসলামী পরিবেশ বিরাজ করছিল তা পার্থিব লোভ-লালসা চরিতার্থকরণ, প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জন, বংশগত রেষারেষির পুনরাবির্ভাব— বিশেষ করে একই সাথে ইরান, মিসর প্রভৃতি অঞ্চলের বিরাট সংখ্যক নও-মুসলিমের ইসলামী ভ্রাতৃত্বের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে কিছুটা ম্লান হয়ে পড়তে শুরু করেছিল। যদি হযরত আলী (রা) ফারূকে আযম (রা)-এর পর খলীফা হতেন তাহলে তিনি তাঁর অপরিসীম যোগ্যতা দ্বারা ফারূকী আমলের অবস্থাকেই বহাল রাখতে পারতেন। কিন্তু উসমান (রা) তা পারেন নি। তার যুগে সাহাবীদের সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছিল। প্রভাবশালী ও উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন সাহাবীদের প্রায় সকলেই তখন পরপারে। হাতে গোনা যে কয়জন বেঁচেছিলেন তারাও ছিলেন পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। কেউ ছিলেন কূফায়, কেউ বসরায়, কেউ দামিশকে, কেউ মিসরে, কেউ ইয়ামনে, কেউ ফিলিস্তীনে, কেউ মক্কায়, আবার কেউ মদীনায়। ফারূকে আযম (রা)-এর যুগ পর্যন্ত বিরাট সংখ্যক সাহাবী মদীনায়ই থাকতেন। অল্প যে কয়েকজন প্রয়োজনবশত বাইরে যেতেন, প্রয়োজন শেষ হওয়ার সাথে সাথে তারা পুনরায় মদীনায় ফিরে আসতেন। আলী (রা) তার রাজধানী মদীনা থেকে কূফায় স্থানান্তরিত করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কূফাকে রাজধানী বানিয়ে যে সুযোগ-সুবিধা তিনি পাবেন ভেবেছিলেন তা পাননি। সাথে সাথে তিনি সেই সমস্ত সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হন যা মদীনার সাথে সম্পৃক্ত ছিল। ইসলামী বিশ্বে হিজায প্রদেশের যে গুরুত্ব ছিল, কূফা রাজধানী হওয়ার কারণে তা হ্রাস পায়। ফলে তিনি হিজায প্রদেশ থেকে যে সাহায্য-সহযোগিতা পেতেন তা থেকেও বঞ্চিত হন।

মুনাফিক ও গোপন ষড়যন্ত্রকারীরা রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর যুগেও মুসলমানদের বেশ কয়েকবার অসুবিধায় ফেলেছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের আসল লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। সিদ্দীকী ও ফারূকী আমলে এই দুষ্কৃতিকারীরা উল্লেখযোগ্য কোন দুষ্কর্মের সুযোগ পায়নি। উসমানী যুগে তারা পুনর্গঠিত হওয়ার সুযোগ পায়। আর আলী (রা)-এর যুগ তাদেরই সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা ও দাঙ্গা-হাঙ্গামার মধ্যে অতিবাহিত হয়। যদি তিনি আরো কিছুটা সুযোগ পেতেন এবং এত তাড়াতাড়ি তার শাহাদতের দুর্ঘটনা না ঘটতো তাহলে নিশ্চিতভাবে তিনি আরো কিছুদিনের মধ্যেই সমগ্র ফিতনাবাজদের পর্যুদস্ত করে ইসলামী বিশ্বকে অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা থেকে মুক্ত করে তুলতে পারতেন। কেননা এতসব বিশৃঙ্খলা সত্ত্বেও তার সাহস ও দৃঢ়তায় কোন ভাটা পড়েনি। যে কোন সমস্যার সমাধানে তিনি সদা প্রস্তুত থাকতেন। তার মধ্যে কখনো হতাশার সৃষ্টি হত না। তিনি মানুষের প্রতারণা, প্রবঞ্চনা, ভীরুতা ও কাপুরুষতা সম্বন্ধে ইতিমধ্যে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন। তিনি ঐ সমস্ত বিষয় সম্পর্কেও অবহিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন যেগুলোর প্রতিক্রিয়া ছিল তাঁর ধারণার বিপরীত। কিন্তু এটাই আল্লাহর ইচ্ছা ছিল যে, তিনি শীঘ্রই শাহাদত বরণ করবেন এবং সেই সুযোগে উমাইয়া বংশ বলতে গেলে এক রকম নির্বিবাধেই তাদের আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ লাভ করবে।

উমাইয়া গোত্র নিজেদেরকে আরবের নেতা এবং বনু হাশিমকে তাদের প্রতিযোগী মনে করত। ইসলাম তাদের ঐ অহংকার ও ঔদ্ধত্যকে মুছে ফেলে দিয়েছিল, কিন্তু উসমান (রা)-এর খিলাফতকালে তা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। উমাইয়ারা তাদের হারানো নেতৃত্ব ফিরে পাবার জন্য পুনরায় চিন্তাভাবনা শুরু করে। তারা যে পরিকল্পনা গ্রহণ করে তার সুফল বাস্তবায়নে মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। উসমান (রা)-এর খিলাফতকালে যে সমস্ত অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল সেগুলোর সংস্কার ও সংশোধন এবং অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য আলী (রা)-কে অনেক কষ্ট ভোগ করতে হয় এবং তার বেশির ভাগ সময়, এমন কি সমগ্র খিলাফতকাল এতেই ব্যয় হয়। কিন্তু পরিস্থিতি আয়ত্তে আসার পূর্বেই আল্লাহর ইচ্ছায় তিনি শাহাদত বরণ করেন। যদি এমন হত যে, হযরত উসমান (রা)-এর পর ফারূকে আযম (রা) পুনরায় খিলাফতের আসনে অধিষ্ঠিত হতেন তাহলে নিশ্চিতভাবে তিনি কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সেই প্রথম অবস্থা পুনরায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হতেন। মূলত যা ঘটার তাই ঘটেছে এবং আল্লাহর ইচ্ছায়ই ঘটেছে।

হযরত আলী ও মুআবিয়া (রা)-এর পরস্পর সংঘর্ষ, যুবায়র, তালহা ও আলী (রা)-এর পরস্পর বিরোধ, লড়াই ইত্যাদিকে আমরা নিজেদের যুগের বিরোধ ও যুদ্ধ সংঘাতের সাথে তুলনা করে নানারূপ ধোঁকা ও প্রতারণার শিকার হয়ে পড়ি। আমরা এই মহান ব্যক্তিগণের চরিত্র আমাদের চরিত্রের পাল্লায় তুলে মাপতে চাই। এটা শুধু ভ্রান্তি নয় বরং ধৃষ্টতারই শামিল। এটা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, জামাল যুদ্ধে হযরত তালহা ও যুবায়র (রা) অত্যন্ত দৃঢ়তা ও সাহসিকতার সাথে প্রতিপক্ষের মুকাবিলা করার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু যখন তাদেরকে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর একটি হাদীস স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় আর তাও এমন সময়ে, যখন তাদের অধীনে ছিল উৎসর্গিতপ্রাণ একদল সেনাবাহিনী—তখন তাঁরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। এজন্য তাদেরকে লজ্জা দেওয়া হয়, কাপুরুষ আখ্যা দেওয়া হয় কিন্তু তারা দীন ও ঈমানের উপর অন্য কোন কিছুকে প্রাধান্য দিতে মোটেই রাযী হননি। যে তালহা ও যুবায়র (রা) যুদ্ধক্ষেত্রকে একটি ক্রীড়াক্ষেত্র মনে করতেন, অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশেও যারা অনবরত তরবারি চালিয়ে অতি শক্তিশালী প্রতিপক্ষকেও নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছেন, তাঁরাই একটি হাদীস শোনামাত্র সোজা যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে চলে গেলেন। অথচ আজকাল আমরা দেখি, তথাকথিত কিছু কিছু ধর্মীয় নেতা—যাদেরকে মুসলমানরা অত্যন্ত সম্মান ও শ্রদ্ধার চোখে দেখে, যখন– তাদের মধ্যে কোন মতবিরোধ দেখা দেয় তখন তারা পরস্পর বিতর্ক বাহাস ও মুনাযারা করে বছরের পর বছর কাটিয়ে দেন। তারা একে অন্যকে অপমান করেন, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন, এমন কি সুযোগমত কোর্ট-কাছারীতে একে অন্যের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন, একে অন্যকে গালি-গালাজ করেন— সর্বোপরি একে অন্যকে হেয় জ্ঞান করাকে নিজেদের কর্তব্য বলে মনে করেন। সাধারণত তাদের কেউই নিজের ভুল স্বীকার করেন না এবং প্রতিপক্ষের দাবী ন্যায্য হলেও তা মেনে নিতে চান না। এরূপ ঘটনা আমরা সচরাচর ঘটতে দেখি। সিফফীন যুদ্ধ এবং সালিশদ্বয়ের ফায়সালা ঘোষণার পর একদা মুআবিয়া (রা) আলী (রা)-এর কাছে এই মর্মে একটি ফতওয়া চেয়ে পাঠান যে, হিজড়া (একই দেহে স্ত্রী ও পুরুষ চিহ্নযুক্ত মানুষ)-এর মীরাছ সম্পর্কে শরীআতের হুকুম কি? তিনি লিখে পাঠান, তার লিঙ্গের আকারের প্রাবল্য অনুযায়ী অর্থাৎ লিঙ্গের আকৃতিতে নারীত্বের প্রাবল্য থাকলে তাকে নারী মনে করতে হবে। আর পুরুষত্বের প্রাবল্য থাকলে পুরুষ বিবেচিত হবে, মীরাসের হুকুম জারি করা হবে। জামাল যুদ্ধের পর যখন তিনি বসরায় প্রবেশ করেন তখন কায়স ইব্‌ন উবাদা তাঁর কাছে নিবেদন করেন, লোকেরা বলে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আপনাকে এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তাঁর পর আপনাকেই খলীফা নির্বাচিত করা হবে—একথা কি ঠিক? তিনি উত্তরে বলেন, একথা ভুল। আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সম্পর্কে কখনো মিথ্যা বলতে পারি না। যদি তিনি আমাকে এই প্রতিশ্রুতি দিতেন তাহলে কি আমি হযরত আবূ বকর, উমর ও উসমান (রা)-কে খলীফা বলে মানতাম এবং তাদের হাতে বায়‘আত করতাম? আজকাল কি কারো কাছ থেকে এ ধরনের নির্লোভ আচরণ আশা করা যেতে পারে? এই কুরআন সম্পর্কেও—যার প্রারম্ভিক আয়াতে বলা হয়েছে, ‘এই সেই কিতাব, এতে কোন সন্দেহ নেই’—আল্লাহ্ তা‘আলা বলেছেন :

يُضِلُّ بِهِ كَثِيرًا وَيَهْدِي بِهِ كَثِيرًا .

এর দ্বারা অনেককেই তিনি বিভ্রান্ত করেন, আবার বহু লোককে সৎপথে পরিচালিত করেন (২: ২৬)।

হযরত আদম (আ)-এর সময় থেকে হক ও বাতিলের সংঘর্ষ চলে আসছে এবং তা চিরদিন অব্যাহত থাকবে। রহমানী (সৎ) ও শয়তানী (অসৎ)। এ দু’ দলের অস্তিত্ব অতীতেও ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। হকপন্থী ও বাতিল পন্থীদের অস্তিত্ব থেকে বিশ্ব কখনো খালি থাকতে পারে না। আর এই হক-বাতিলের সংঘর্ষের কারণেই পুণ্যবানরা তাদের পুণ্যকর্মের পুরস্কার পান এবং আল্লাহ্ তা‘আলা মু‘মিনের ঈমানের মর্যাদা দিয়ে থাকেন। অতএব কুরআন যদি বহু লোকের হিদায়াত এবং কারো কারো পথভ্রষ্টতার কারণ হয়ে থাকে তবে তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। আল্লাহ্ তা‘আলা মু’মিনদের প্রশংসা করতে গিয়ে তাদেরকে মধ্যপন্থী জাতিরূপে আখ্যায়িত করেছেন।

যেমন পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে :

وَكَذَٰلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ وَيَكُونَ الرَّسُولُ عَلَيْكُمْ شَهِيدًا .

এভাবে আমি তোমাদের এক মধ্যপন্থী জাতি রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি, যাতে তোমরা মানব জাতির জন্য সাক্ষী হও এবং রাসূল তোমাদের জন্য সাক্ষী হয়। (২: ১৪৩)

ইসলাম মানুষকে মধ্যপন্থা শেখায় এবং যে কোন ধরনের বাড়াবাড়ি থেকে রক্ষা করে। অনেক লোক আলী (রা) সম্পর্কে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে পথভ্রষ্ট হয়েছে। এই পথভ্রষ্ট লোকদের মধ্যে একটি দল তাঁর বিরোধিতার উপর এত জোর দিয়েছে যে, তাদের এই বিরোধিতা শত্রুতার চাইতে হীনতার পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। তারা আল্লাহর এই প্রিয় বান্দাকে তিরস্কার করতেও দ্বিধা করেনি এবং এভাবে তারা তাদের বিভ্রান্তি ও ক্ষতির পথ প্রশস্ত করেছে। আর অপর দলটি তাকে ভালবাসার ক্ষেত্রে প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে তাঁকে খোদায়ী মর্যাদায় পৌঁছে দিয়েছে। তারা এক বান্দাকে আল্লাহর গুণাবলীর প্রকাশস্থল ঘোষণা করে অন্যান্য পবিত্র ও পুণ্যবান বান্দাদের তিরস্কার ও হেয় প্রতিপন্ন করা পুণ্যের কাজ মনে করেছে। এভাবে তারা তাদের পথভ্রষ্টতাকে বর্ধিত ও সম্প্রসারিত করে প্রথম দলেরই সমপর্যায়ভুক্ত হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে আলী (রা)-এর অস্তিত্ব অনেকাংশে ঈসা (আ)-এর অস্তিত্বের সমপর্যায়ভুক্ত হয়ে পড়েছে। কেননা ইয়াহূদীরা ঈসা (আ)-এর বিরোধিতা করে যেমন পথভ্রষ্ট হয়েছে, তেমনি ঈসায়ীরা তাঁকে খোদায়ী মর্যাদায় তুলে দিয়ে পথভ্রষ্ট জাতিতে পরিণত হয়েছে। সাচ্চা মুসলমানরা যেমন ঈসা (আ)-এর ব্যাপারে সব ধরনের বাড়াবাড়ি থেকে বিরত থেকে অর্থাৎ ইয়াহূদী ও ঈসায়ীদের বাতিল আকীদা-বিশ্বাসকে পরিহার করে মধ্যপন্থার উপর কায়েম রয়েছে তেমনি তারা মধ্যপন্থার উপর কায়েম রয়েছে হযরত আলীর ব্যাপারে খারিজী ও শিয়াদের বাড়াবাড়িমূলক আকীদা-বিশ্বাস পরিহার করে। আমার এই কথাগুলো কোন ইতিহাস গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত করা কারো নযরে হয়ত বেমানান ঠেকতে পারে, কিন্তু যে বিষয়টি পরবর্তীকালে সমগ্র ইসলামী বিশ্বের উপর এক মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল তা নিশ্চয় ইসলামী ইতিহাসে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে এবং এতে দোষের কিছু নেই।

সাহাবায়ে কিরামকে আজকালকার মুসলমানদের সাথে তুলনা করা যেমন ভ্রান্তিকর, তেমনি তাদের মানবীয় দুর্বলতা থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র মনে করাও এক ধরনের ভ্রান্তি। শেষ পর্যন্ত তাঁরা মানুষই ছিলেন। অন্য যে কোন মানুষের মত তাদেরও খাওয়া-পরার প্রয়োজন ছিল, প্রয়োজন ছিল জীবন ধারণের অন্যান্য সামগ্রীরও। সাহাবীরা তো দূরের কথা, খোদ রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-ও নিজেকে মানুষ বলে স্বীকার করতে গর্ববোধ করতেন। আমরা আমাদের প্রতিদিনকার সালাতে–

اَشْهَدُ اَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ .

(আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ আল্লাহর বান্দা ও রাসূল) একথা বলে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) যে আল্লাহর বান্দা সে কথা নির্বিবাদে স্বীকার করি এবং তার সাক্ষ্যও প্রদান করি। আমরা একথাও মানি যে, তাঁর জীবন হচ্ছে এমন একটি পরিপূর্ণ আদর্শ জীবন, যা অনুসরণের মাধ্যমে মানব জীবনকে সার্থক করে তোলা যায়। সাহাবীরা হচ্ছেন ঐ সমস্ত ভাগ্যবান ব্যক্তি, যারা কোনরূপ মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আদর্শ জীবন প্রত্যক্ষ করেছেন এবং হিদায়াত ও সৌভাগ্য লাভ করেছেন। কিন্তু যেহেতু তারা নবী ছিলেন না, নিষ্পাপ ছিলেন না, তাঁদের সবার যোগ্যতাও সমান ছিল না তাই তাঁদের মধ্যে একদিকে যেমন আমরা পাই সিদ্দীকে আকবর ও ফারূকে আযম, অন্যদিকে তেমনি পাই মুআবিয়া ও মুগীরাকেও। তাদের মধ্যে একদিকে যেমন আয়িশা ও আলী (রা)-এর ফকীহর অস্তিত্ব রয়েছে, অন্যদিকে তেমনি অস্তিত্ব রয়েছে আবূ হুরায়রা ও ইব্‌ন মাসঊদ (রা)-এর মত রাবী ও মুহাদ্দিসের। একদিকে তাঁদের মধ্যে যেমন আমর ইবনুল ‘আস (রা)-এর মত রাজনীতিক ও কূটনীতিক রয়েছেন, অন্যদিকে তেমনি রয়েছেন আবদুল্লাহ ইব্‌ন উমর ও আবূ যর (রা)-এর মত মুত্তাকী। অতএব যোগ্যতার তারতম্যের কারণে তাদের কর্মকাণ্ডের মধ্যে কোন পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় তবে তা প্রকৃতপক্ষে আমাদের জন্য রহমত ও উন্নতির সোপান বিশেষ। আমাদের উচিত, তাদের সেই মতপার্থক্যকে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সাথে রহমতের উপকরণে পরিণত করা। নির্বোধের মত তাড়াহুড়া করে তাঁদের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করা এবং এভাবে নিজেদের পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত করা আমাদের জন্য মোটেই উচিত নয়।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ওফাতের পর হিজরী ৩০ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ বিশ বছর ধরে মুসলমানরা একের পর এক দেশ জয় করতে থাকেন। শুধু প্রত্যেক বছরে নয়, বরং প্রত্যেক মাসেই কোন না কোন দেশ বা অঞ্চল ইসলামী রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে। এই বিশ বছরে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের প্রায় সব কয়টি সভ্য দেশ মুসলমানদের শাসনাধীনে চলে আসে এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নেতৃত্ব ও প্রাধান্য সমগ্র দুনিয়ার স্বীকৃতি লাভ করে। হিজরী ৩০ সাল থেকে ৪০ সাল পর্যন্ত মুসলমানরা পারস্পরিক ও আভ্যন্তরীণ বিবাদে লিপ্ত থাকে। তাই স্বাভাবিকভাবেই তারা এ সময়কালে কোন দেশ জয় করতে পারে নি। বাহ্যিক দৃষ্টিতে দশ বছরের এই সময়কাল মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক ও ক্ষতিকর মনে হলেও সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালে এর মধ্যেও অনেক মঙ্গলজনক দিক ধরা পড়বে। যে শক্তির মাধ্যমে ঐ বিশ বছরের মহাবিজয় অর্জিত হয়েছিল তা ছিল ঐ আধ্যাত্মিকতা ও রূহানী শিক্ষার ফলশ্রুতি, যা সাহাবায়ে কিরাম কুরআন ও সুন্নাহর মাধ্যমে অর্জন করেছিলেন। আর ঐ দশ বছর সময়কালে মুসলমানদের মধ্যে যে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সৃষ্টি হয়েছিল তা জড়বাদ এবং এই দুনিয়ার অধিবাসী হওয়ার কারণে যে কোন মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হতে পারে। তবে ঐ দশ বছরের প্রতিবন্ধকতা ও আভ্যন্তরীণ বিবাদ মুসলিম বিশ্বকে সেই শক্তি ও আদর্শগত নমুনা সরবরাহ করেছিল, যেভাবে শীতকালে গাছ তার পরিবৃদ্ধির উপাদান সঞ্চয় করে এবং বসন্ত ঋতু আসার সাথে সাথে উপাদানের মাধ্যমে ফলফুল এবং পাতার জন্ম দেয়। যদি ঐ যুগে মুসলমানরা নিজেদের মধ্যকার যুদ্ধ-বিগ্রহ ও ধ্বংসাত্মক কার্যাবলী প্রত্যক্ষ না করত এবং তাদের ইতিহাসের প্রথম দিকে পৃষ্ঠাসমূহের মধ্যে ঐ দশ বছরের দুঃখজনক পৃষ্ঠাগুলো না থাকত তাহলে পরবর্তী যুগে তাদের সোনালী যুগ অতীত হওয়ার অনেক পরে, যখন তারা কখনো এমনি সাংঘাতিক ধরনের কোন ধাক্কা খেত, তখন জ্ঞানবুদ্ধি শূন্য হয়ে এমনভাবে মাটিতে লুটিয়ে পড়ত যে, এরপর পুনরায় উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা তাদের থাকত কিনা সন্দেহ। ধাক্কা খাওয়া, আভ্যন্তরীণ মতবিরোধ সৃষ্টি হওয়া, ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ করা এবং দেশব্যাপী গৃহযুদ্ধের আগুন ছড়িয়ে পড়া—এগুলো হচ্ছে মানব সমাজের হাবীল ও কাবীল যুগের সুন্নাত বা সাধারণ নীতি। মানব জাতি যতদিন এ দুনিয়ায় বসবাস করবে ততদিন এই সমস্ত জিনিসের অস্তিত্বও এখানে থাকবে। হক ও বাতিলের যুদ্ধ যেভাবে দুনিয়ায় জারি রয়েছে সেভাবে আধ্যাত্মিক দুর্বলতা ও বৈষয়িকতার কারণে ন্যায় ও সত্যের অনুসারীদের মধ্যে মাঝে মাঝে পরস্পর মতবিরোধ ও সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়েছে। হযরত মূসা (আ) যখন আপন ভাই হযরত হারূন (আ)-এর দাড়ি ও মাথার চুল ধরে টানাটানি করতে পারেন, যখন ইউসুফ (আ)-কে তার ভাইয়েরা কুয়ার মধ্যে নিক্ষেপ করতে পারেন এবং অধুনা প্রচলিত বাইবেলের বর্ণনানুযায়ী হযরত ঈসা (আ)-এর হাওয়ারীরা (অনুসারীরা) যখন খোদা ঈসা (আ)-এর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে পারে তখন সত্যের অনুসারীদের অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ এবং সাহাবায়ে কিরামের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ নিয়ে অহরহ হৈ চৈ করার পিছনে কোন যুক্তি থাকতে পারে না। পারস্পরিক মতবিরোধ এবং লড়াই-ঝগড়া থেকে মানব জাতি কখনো সম্পূর্ণরূপে মুক্ত থাকতে পারেনি। তাছাড়া এই স্বাভাবিক ব্যাপারটি যদি সাহাবায়ে কিরামের যুগেও না ঘটত তাহলে কিভাবে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ কাটিয়ে উন্নতির পথ অবলম্বন করা যায় এবং কিভাবে পর্বত-প্রমাণ বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে সম্মুখে অগ্রসর হতে হয়, তা তাদের পরবর্তী বংশধররা জানতে পারত না এবং অনেক চিন্তা-গবেষণা করেও আজ ইসলামকে তার আসল রূপে আবিষ্কার করাও কারো পক্ষে সম্ভব হত না। অন্য কথায় বলতে গেলে, হযরত আলী, হযরত মুআবিয়া এবং হযরত তালহা ও যুবায়র (রা)-এর মধ্যকার মতবিরোধ ইসলামী রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য বসন্ত বা প্লেগ রোগের প্রতিষেধক টিকাস্বরূপ। ঐ টিকা প্রকৃতপক্ষে অত্যন্ত উপকারী প্রমাণিত হয়েছে। এটা স্মরণ করে আজো মুসলমানরা তাদের প্রত্যেকটি পতন ও ধ্বংসের পর পুনরায় সতর্ক ও সাবধান হয়ে উঠছে। বনূ উমাইয়া ও বনু আব্বাসের পারস্পরিক বিরোধ, আব্বাসী খিলাফত আমলে নেতৃস্থানীয় কিছু ব্যক্তির বিদ্রোহ, গযনবী ও ঘুরীদের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ-বিগ্রহ, ফাতিমী ও মুওয়াহিদদের মধ্যকার সংঘর্ষ, উসমানী ও সাফাবীদের মধ্যকার সংঘাত, আফগান ও মুঘলদের মধ্যকার যুদ্ধ—মোটকথা এ ধরনের অসংখ্য অভ্যন্তরীণ ঘটনা আছে যার প্রতিটির মধ্যেই ছিল মুসলমানদের ধ্বংস ও পতনের যথেষ্ট উপাদান। যখনই ঐসব ঘটনা সংঘটিত হত তখন অমুসলিমরা সর্বসম্মতিক্রমে এই অভিমত ব্যক্ত করত যে, এরপর আর মুসলমানরা নিজেদের সামলে নিতে পারবে না এবং পুনরায় উন্নতি করার যোগ্যতাও আর ফিরে পাবে না। কিন্তু বিশ্ববাসী সব সময়ই দেখেছে যে, তারা ঐ অবস্থায়ও নিজেদের সামলে নিয়েছে এবং পুনরায় উন্নতিও করেছে। তারা ঐ অবস্থায়ও নিরাশ হওয়াকে কুফরী মনে করেছে এবং নিজেদেরকে সব সময় আশাবাদী ও সুদৃঢ় রেখেছে। তারা ইসলামের মর্যাদাকে নিজেদের সম্মানের উপর এবং ইসলামের অস্তিত্বকে নিজেদের অস্তিত্বের উপর প্রাধান্য দিয়েছে।

হালাকু বাগদাদ ধ্বংস করল। কিন্তু মুসলমানরা সঙ্গে সঙ্গে হালাকুর বংশধরদের অন্তরকে ইসলামের আলোকে আলোকিত করে নিল। ঈসায়ী বিশ্ব একতাবদ্ধ হয়ে মুসলমানদের কাছ থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস ছিনিয়ে নিল, কিন্তু সালাহুদ্দীন আইয়ুবী সমগ্র ইউরোপের সম্মিলিত শক্তিকে একেবারে পর্যুদস্ত করে ঐ পবিত্র শহর পুনরায় দখল করে নিলেন। মোটকথা, খিলাফতে রাশিদার শেষ দশ বছরে যা কিছু ঘটেছে তা নিঃসন্দেহে মুসলমানদের ভবিষ্যত জীবনকে অধিকতর দুঃসাহসী, সংযমী ও সুদৃঢ় করে তুলেছে। অতএব আলী (রা)-এর যুগের যুদ্ধ-বিগ্রহকে ইসলাম এবং ইসলামী বিশ্বের জন্য ক্ষতিকর আখ্যা দেওয়া চলে, তবে তাঁর উপকারের দিকটি—যদিও তার ক্ষতির অনুপাতে অনুল্লেখযোগ্য, একেবারে বিস্মৃত হওয়া চলে না।

দিনের সাথে রাত, আলোর সাথে অন্ধকার, বসন্তের সাথে শীত, ফুলের সাথে কাটা, বাঘের সুন্দর ও আকর্ষণীয় আকার-অবয়বের মধ্যে হিংস্রতা, সাপের চিত্তাকর্ষক আকার ও চলনের মধ্যে প্রাণঘাতী বিষ এবং রত্নরাজিতে পরিপূর্ণ সমুদ্রের মধ্যে ধ্বংস ও ডুবে মরার আশংকা বিদ্যমান। যদি কুফরীর অভিশাপ দুনিয়াতে বিদ্যমান না থাকত তাহলে ঈমানের নিআমাত আমরা মোটেই উপলব্ধি করতে পারতাম না। যদি আমরা গাঢ় অন্ধকার রাতের সম্মুখীন না হতাম তাহলে চাঁদনী রাত আমাদেরকে এত আনন্দ দান করতে পারত না। মোটকথা, আল্লাহ তা‘আলা প্রতিটি সৌন্দর্যের সাথে একটি অসৌন্দর্য সম্পৃক্ত করে দিয়েছেন এবং প্রতিটি মাধুর্যের সাথে রেখে দিয়েছেন একটি তিক্ততা। এই নিয়মের উপরই বিশ্ব কারখানা চলছে। ইসলামী খিলাফত দুনিয়ায় মানবজাতির জন্য একটি নি‘আমতস্বরূপ। যখন চন্দ্র ও সূর্যের চেহারাও কলংকমুক্ত নয় তখন এই নি‘আমাতও যদি কখনো কখনো কালিমালিপ্ত বা পতনোন্মুখ হয়ে পড়ে তবে তাতে বিস্মিত বা আশাহত হওয়ার কোন কারণ নেই। হযরত উসমান (রা)-এর খিলাফত আমলে মুনাফিক ও মুসলিম নামধারী ইসলামের একদল শত্রুর আবির্ভাব ইতিহাস অধ্যয়নকারীদের চোখে খুবই অপছন্দনীয় ঠেকে এবং তারা ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী এই দল সৃষ্টির জন্য ইসলামকে দায়ী করতেও দ্বিধা করে না, কিন্তু তারা যদি গভীরভাবে লক্ষ্য করে তাহলে বুঝতে পারবে জীবনটা টিকে থাকার একটি নিত্যনৈমিত্তিক সংগ্রাম ছাড়া কিছু নয়। প্রকৃতপক্ষে ইসলাম হচ্ছে যাবতীয় শয়তানী শক্তির বিরুদ্ধে রহমানী শক্তিসমূহের অহরহ সংগ্রামেরই অপর নাম। আর শয়তানী শক্তিসমূহের মধ্যে সবচাইতে বড় শক্তি হচ্ছে ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী মুনাফিকদের শক্তি। আজ পর্যন্ত ইসলামী খিলাফত যখনই এবং যেখানেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এই ষড়যন্ত্রকারী মুনাফিকদের কারণেই হয়েছে। এই মুনাফিকরা এখনো দুনিয়ায় বিদ্যমান এবং সত্য কথা বলতে গেলে, তাদেরকে পূর্বের চাইতে অধিক শক্তিশালীই দেখা যাচ্ছে। এই মুনাফিকরা হঠাৎ করে হযরত উসমান (রা)-এর খিলাফত আমলে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেনি, বরং তাদের অভ্যুদয়ের সূচনা হয়েছিল ফারূকে আযম (রা)-এর খিলাফত আমলে। এরপর তারা অতি দ্রুত সংগঠিত হয়ে হযরত উসমান (রা)-এর শাহাদত থেকে হযরত আলী (রা)-এর শাহাদত লাভ পর্যন্ত সময়কালে নিজেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করে। আজ পর্যন্ত এই ধারাই অব্যাহত রয়েছে। হযরত হুযায়ফা (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, যখন উমর ফারূক (রা) শাহাদত লাভ করেন তখন থেকেই ইসলামের ভাগ্যসূর্য অস্তমিত হতে থাকে। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেছেন : যতক্ষণ পর্যন্ত এই ব্যক্তি (উমর ফারুকের দিকে ইঙ্গিত করে) তোমাদের মধ্যে বিদ্যমান থাকবে ততক্ষণ বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয়ের দরজাও বন্ধ থাকবে। ইব্‌ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন : “আসমানের প্রত্যেক ফেরেশতা উমরকে সমীহ করে এবং যমীনের প্রত্যেক শয়তান তাকে ভয় করে। একদা হযরত কা‘ব আহবার (রা)-কে হযরত উমর (রা) জিজ্ঞেস করেন, তুমি কি বনী ইসরাঈলদের আসমানী কিতাবসমূহের কোথাও আমার উল্লেখও দেখেছ? তিনি উত্তর দেন, হাঁ, আপনার সম্পর্কে লেখা হয়েছে আপনি একজন প্রবল প্রতাপান্বিত শাসক হবেন এবং আল্লাহর পথে কোন সমালোচনাকারীরই পরোয়া করবেন না। আপনার পরে যিনি খলীফা হবেন তাকে জালিমরা হত্যা করবে। এরপর বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়বে। মুজাহিদ (র) বলেন, আমরা প্রায়ই বলাবলি করতাম, হযরত উমর (রা)-এর খিলাফত আমলে শয়তানরা বন্দী ছিল এবং তাঁর ইনতিকালের পর তারা শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছে।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন