hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

ইসলামের ইতিহাস ১ম খণ্ড

লেখকঃ মাওলানা আকবর শাহ খান নজিববাদী

২৬২
রোম ও ইরান
হযরত নবী করীম (সাঃ)-এর আবির্ভাবকালে দুনিয়ায় দু’টি সাম্রাজ্য ছিল সবচেয়ে বড়। ঐ দু’টি সাম্রাজ্যই প্রায় গোটা দুনিয়ায় প্রভাব বিস্তার করেছিল। একটি রোম সাম্রাজ্য এবং দ্বিতীয়টি ইরানী (পারস্য) সাম্রাজ্য। তখনকার দুনিয়ায় কেবল দু’টি সভ্যতাই বর্তমান ছিল। অর্ধেক দুনিয়ায় রোমান সভ্যতা বিস্তার লাভ করেছিল এবং অর্ধেক দুনিয়ায় ইরানী। আরবদেশ ছিল তখন ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত। সেখানে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আবির্ভূত হলেন। ইসলামের মাধ্যমে একটি নতুন সাম্রাজ্য ও নতুন সভ্যতার পত্তন হলো। সারা দুনিয়া তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো, আরব অথবা ইসলামী সাম্রাজ্যের মুকাবিলায় রোমক ও ইরানী সাম্রাজ্য শূন্যে মিলিয়ে গেলো এবং গোটা দুনিয়া ইসলামী হুকুমত ও ইসলামী সভ্যতার ছায়াতলে জীবন যাপন করতে লাগলো। এসব কথার বিস্তারিত ব্যাখ্যা আমরা পরে বর্ণনা করবো। এখন যেহেতু আরব সাম্রাজ্য এবং রোমক ও ইরানী সাম্রাজ্যের শক্তি পরীক্ষা শুরু হবে আর অতিদ্রুত আমরা ইরান ও রোমকে আরবের মুকাবিলায় টুকরো টুকরো হতে দেখবো, সেহেতু ঐ দু’টি বিখ্যাত ও সংস্কৃতিবান সাম্রাজ্য সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান লাভ করা বাঞ্ছনীয়।

কোন এক সময় ইরানী সাম্রাজ্য ভূমধ্যসাগর, কৃষ্ণসাগর, পারস্যোপসাগর, সিন্ধুনদ, কাশ্মীর, তিব্বত, আলতাই পর্বত ও কাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কায়ানী বংশের (কায়ান নামক সম্রাটের নামানুসারে এই বংশের পত্তন হয়। এই বংশের চারজন বিখ্যাত বাদশাহর নাম-(১) কায়কাউস, (২) কায়খসরু, (৩) কায়কোবাদ ও (৪) কায়লাহ্‌রাসপ্ (অনুবাদক)। রাজত্ব এবং রুস্তম যাবুলিস্তানের (সীস্তান) বীরত্ব-যুগ অতিক্রম করার পর গ্রীক আলোকজান্ডার ইরানী সাম্রাজ্যকে টুকরো টুকরো করে ফেলেছিলেন। কিন্তু ইরানী সভ্যতা তখনো অবশিষ্ট ছিল। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আবির্ভাবের চারশ’ বছর পূর্বে আরদ্‌শের বাবকান সাসানী বংশের পত্তন করেন। সাসানী বংশ কায়ানীদের বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকাংশ তাদের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে পারস্যোপসাগর, ফুরাত নদী, কাস্পিয়ান সাগর, সিন্ধুনদ ও জায়হুন নদের মাঝখানে একটি বিস্তৃত ও নিবিড় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে গোটা এশিয়া মহাদেশের নেতৃত্ব লাভ করলো।

রোমক সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল ইটালীর রোম শহর। এখানে সম্রাট জুলিয়াস সিজার, সেন্ট আনমুস্‌তিস প্রমুখ বাস করেন। এই সাম্রাজ্যের মধ্যে প্রায় গোটা ইউরোপ মহাদেশ এবং মিসর ও মধ্য এশিয়া অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিছুকাল পর এই রোমক সাম্রাজ্য দু’টুকরো হয়ে গেলো। পশ্চিমাংশের রাজধানী রোম শহরই ছিল। কিন্তু পূর্বাংশের রাজধানী হলো কনস্টানটিনোপল শহর। কনস্টানটিনোপলের কায়সারকেও (কায়সার প্রাচীন রোম সম্রাটদের উপাধি) রোমের কায়সার নামেই অভিহিত করা হতো; যাঁর শাসনাধীনে ছিল মিসর, আবিসিনিয়া, ফিলিস্তীন, সিরিয়া, মধ্য এশিয়া ও বলকান রাজ্যসমূহ। এই পূর্ব রোমক সাম্রাজ্যের শান-শওকত ও শক্তি-প্রভাবের কাছে পশ্চিম রোমের প্রভাব-প্রতিপত্তি ম্লান হয়ে গিয়েছিল। মধ্য এশিয়া ও ইরাকের প্রান্তরসমূহে এই দুই সাম্রাজ্য অর্থাৎ রোমক ও ইরানী সাম্রাজ্যদ্বয়ের সীমারেখা কোন নৈসর্গিক বস্তু অর্থাৎ পাহাড়, সমুদ্র প্রভৃতি না হওয়ার দরুন কখনো কখনো একে অপরের সাথে সংঘাত ও সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ারও নিমিত্ত ঘটতো।

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জন্মগ্রহণের সময় ইরানের শাহানশাহ ছিলেন সাসানী বংশের ন্যায়বিচারক নওশেরওয়ান। হযরত নবী করীম (সাঃ)-এর নবুওয়াত লাভের সময় ইরানে ক্ষমতাসীন ছিলেন নওশেরওয়ানের পৌত্র খসরু পারভেয। তখন কনস্টানটিনোপলে কায়সার ফুকাস-এর বিরুদ্ধে এক প্রচণ্ড বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। সাম্রাজ্যের আমীর-উমারা ও দেশের প্রজা-সাধারণ ফুকাশকে সিংহাসন থেকে নামিয়ে হত্যা করলো এবং অধিকৃত আফ্রিকীয় অঞ্চলে গভর্নর অর্থাৎ মিসরের শাসনকর্তাকে কনস্টানটিনোপলের সিংহাসনে বসানোর আহ্বান জানালো। আফ্রিকার গভর্নর বার্ধক্যের কারণে যেতে পারলেন না। কিন্তু সৌভাগ্যবান যুবক পুত্র হিরাক্লিয়াস কনস্টানটিনোপলের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হলেন। হিরাক্লিয়াসের শাসন কর্তৃত্ব সাম্রাজ্যের কর্মকর্তারাও সানন্দে মেনে নিলেন। নিহত কায়সার ফুকাস ও খসরু পারভেযের মধ্যে ছিল বন্ধুত্ব ও ভালবাসার সম্পর্ক। তাই খসরু পারভেয রোমক সম্রাট অর্থাৎ হিরাক্লিয়াসের উপর হামলা করলো-এমন এক ব্যক্তির ক্ষমতাসীন হওয়ার পর, যিনি উত্তরাধিকারসূত্রে সিংহাসনের অধিকারী ছিলেন না। এটা ছিল ইরানীদের জন্য রোমক সাম্রাজ্যের উপর হামলা করার একটি উত্তম সুযোগ। ইরানী ও রোমকদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলো। এই যুদ্ধ ছয়-সাত বছর অব্যাহত ছিল। অবশেষে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নবুওয়াত লাভের অষ্টম বছর ইরানীরা সিরিয়া জয় করে বায়তুল মুকাদ্দাস অধিকার করলো এবং খ্রিস্টানদের নিকট থেকে ক্রুশ ছিনিয়ে নিলো। একই সাথে তারা ফিলিস্তীনের গোটা দেশ জয় করে আলেকজান্দ্রিয়া পর্যন্ত পৌঁছে গেলো।

মক্কার মুশরিকরা ইরানীদের এই দেশ বিজয়ের খবর শুনে বেশ আনন্দ উদযাপন করলো। কেননা, রোমকরা ছিল কিতাবধারী, আর ইরানীরা ছিল মুশরিক। অপরদিকে মুসলমানরা ছিলেন মুশরিকদের বিপরীত কিতাবীদের প্রতি সহানুভূতিশীল। তাই এই খবরে মুসলমানরা ব্যথিত হলো। আল্লাহ তা‘আলা সূরা রূমের আয়াত নাযিল করলেন। তাতে সংবাদ দিলেন যে, যদিও রোমকরা এবার পরাজিত হয়েছে, কিন্তু কয়েক বছর পরই তারা জয়লাভ করবে। আর মুসলমানরা তখন আনন্দিত হবে। অতএব, তাই হলো। হিরাক্লিয়াস ছয়-সাত বছর পর্যন্ত অনবরত সামরিক প্রস্তুতিতে ব্যাপৃত রইলেন। এই সময়ের মধ্যে তিনি তাঁর দেশের অভ্যন্তরীণ শৃংখলা বিধানেও পূর্ণ সক্ষম হন। এরপর তিনি ইরানীদের সীমান্ত অতিক্রম ও পূর্ববর্তী পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য বের হলেন এবং পরিশেষে সিরিয়া প্রান্তরে রোমক বাহিনী ইরানীদেরকে চরমভাবে পরাজিত করলো। ইরানীরা পলায়ন করলো এবং রোমের কায়সার নিজেদের এলাকা পুনর্দখল করা ছাড়াও ইরানীদের কয়েকটি প্রদেশ অধিকার করলেন।

এদিকে রোমকরা ইরানীদের উপর বিরাট বিজয় লাভ করলো, ওদিকে বদর প্রান্তরে মুসলমানরা মক্কার কাফিরদেরকে মারাত্মকভাবে পরাস্ত করলেন। আর এইভাবে কুরআনের ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে পূর্ণ হলো। এরপরও ইরানী ও রোমকদের মধ্যে লড়াই অব্যাহত ছিল। সপ্তম হিজরীর শুরুতে রোমক ও ইরানীদের মধ্যে সন্ধি হলো এবং ইরানীরা বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে যে ক্রুশ ছিনিয়ে নিয়েছিল, তা রোমকদের ফিরিয়ে দিলো। এই সন্ধি হিরাক্লিয়াসের দেশ বিজয়কে একদিকে সম্পূর্ণ করে দিলো, আর অন্যদিকে ইরানীরা তাদের হারানো এলাকা ও প্রদেশগুলো রোমকদের নিকট থেকে ফেরত নিলো। সুতরাং ইরানী ও রোমক উভয় দরবারেই সাবধানতার চিহ্ন ফুটে উঠেছিল এবং উভয়েই নিজ নিজ উন্নতি ও মযবুতীর জন্য উপযুক্ত উপায় গ্রহণে মশগুল হয়েছিল। এই বছরই হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) রাজা-বাদশাহদের নামে পত্র প্রেরণ করেন। কায়ানী যুগে ইরানীদের রাজধানী ছিল ইস্‌তাখার, গ্রীক আলেকজান্ডার যাকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই-ভস্মে পরিণত করেছিলেন। তখন সাসানী বংশের রাজধানী ছিল মাদায়েন। ওদিকে হিরাক্লিয়াস তার দেশ বিজয় ও ক্রুশ ফেরত পাওয়ার আনন্দে যিয়ারতের জন্য বায়তুল মুকাদ্দাস এসেছিলেন।

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর পত্র খসরু পারভেযের নিকট মাদায়েনে এবং হিরাক্লিয়াসের নিকট বায়তুল মুকাদ্দাসে পৌঁছেছিল। খসরু পারভেয তাঁর পত্রখানি ছিঁড়ে ফেললো এবং হিরাক্লিয়াস শ্রদ্ধা ও ভক্তি সহকারে তাঁর পত্রখানি গ্রহণ করলেন। হযরত নবী করীম (সাঃ) ইরানী বাদশাহর অসৌজন্যমূলক আচরণের কথা শুনে বললেন : ইরানী বাদশাহর সাম্রাজ্য ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। খসরু পারভেয কেবল হযরত নবী করীম (সাঃ)-এর চিঠি ও কাসিদের সাথে দুর্ব্যবহারই করলো না বরং তার ইয়ামনী গভর্নর বাযানকে লিখে পাঠালো যে, এই আরবী পয়গাম্বর (মুহাম্মদ সাঃ)-কে গ্রেফতার করে আমার নিকট পাঠিয়ে দাও। বাযান দু’জন লোক মদীনায় প্রেরণ করলো। তারা হযরত নবী করীম (সাঃ)-এর দরবারে হাযির হলো এবং খসরু পারভেযের আদেশ সম্পর্কে তাকে অবহিত করলো। হযরত নবী করীম (সাঃ) বললেন : তোমরা যাকে তোমাদের খোদা মনে কর অর্থাৎ খসরু পারভেয—সে গতরাতে তার পুত্র কর্তৃক নিহত হয়েছে। একথা শুনে তারা যখন বাযানের নিকট ফিরে গেলো, তখন সেখানে মাদায়েন থেকে সংবাদ এলো যে, খসরু পারভেযকে তার পুত্র শায়রুয়া হত্যা করেছে। এ হত্যাকাণ্ড ঠিক সেই রাতেই সংঘটিত হয়েছে, যে রাতের কথা হযরত নবী করীম (সাঃ) বলেছেন। ইয়ামনের গভর্নর বাযান মুসলমান হয়ে গেলেন। আর এইভাবেই ইয়ামন দেশে অতিদ্রুত ইসলাম প্রসারিত হলো। হযরত নবী করীম (সাঃ) বাযানকেই ইয়ামানের গভর্নর রাখলেন। শায়রুয়া অভ্যন্তরীণ কোন্দল মিটিয়ে আরব ও মুসলমানদের প্রতি মনোযোগ দেয়ার ফুরসতই পেলো না। কিছুদিন পর তার স্থলে তার স্বল্প বয়স্ক পুত্রকে ইরানের সিংহাসনে বসানো হলো। যার নাম ছিল আরদেশীর। এই স্বল্প বয়স্ক আরদেশীরকে ইরানী সিপাহসালার শাহরিয়ার কয়েক মাস পর হত্যা করে স্বয়ং সিংহাসনে আরোহণ করেন। এর কয়েক দিন পর সাম্রাজ্যের কর্মকর্তারা তাকে হত্যা করে শায়রুয়ার-এর ভগ্নী ও খসরু পারভেযের কন্যা বুরানকে সিংহাসনে বসান। তিনি মাত্র এক বছর কয়েক মাস রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন। তার শাসনামলেই হযরত নবী করীম (সাঃ) ইনতিকাল করেন। বুরানের পর কয়েকজন বালক ও নারী পরপর ক্ষমতাসীন হন। অবশেষে ক্ষমতায় বসেন ইয়ায্‌দগর্‌দ, যার শাসনামলে ইরান মুসলমানদের অধিকারে আসে। মোটকথা, যেদিন খসরু পারভেয হযরত (সাঃ)-এর চিঠি ছিঁড়ে ফেলেছিল, সেদিন থেকেই ইরানী সাম্রাজ্যের উচ্চ প্রাসাদ প্রাকৃতিকভাবে ভূলুণ্ঠিত হওয়া আরম্ভ করেছিল এবং ইরানের সিংহাসনে দেশবিজয়ী ও বীরবিক্রমে বাদশাহদের স্থান বালক ও নারীরা অধিকার করেছিল। ইরানী সাম্রাজ্যের দখল থেকে তার একটি প্রদেশ অর্থাৎ মূলকে ইয়ামন বের হয়ে গিয়েছিল। এজন্য ইরানীরা মুসলমানদের প্রতি আরো বেশী শত্রুতা পোষণ করতো।

ইরানীরা মুশরিক হওয়ার কারণে খুব অহংকারী ও উদ্ধত ছিল। তাই তারা আরবদেরকে খুব ঘৃণিত মনে করে তাদের শক্তি ও দৃঢ়তার খবর শুনে শুনে অতি বিচলিত ও মুসলমানদেরকে সমূলে বিনাশ করার সংকল্প করেছিল। কিন্তু প্রকৃতি তাদেরকে এমনিভাবে অভ্যন্তরীণ কলহ-কোন্দল ও রাজা-বাদশাহদের উত্থান-পতনের মুসীবতে লিপ্ত করলো যে, আরবদেশের প্রতি সহসা মনোযোগ দিতে পারলো না। মদীনার মুনাফিক ও দেশান্তরিত ইয়াহূদীরা উপর্যুপরি মাদায়েনের রাজদরবারে তাদের বাকপটু ও চতুর দূতদের প্রেরণ করে করে ইরানীদেরকে মদীনা আক্রমণের জন্য উত্তেজিত করেছিল। অপরদিকে তারা হিরাক্লিয়াসের দরবারেও একই ধরনের তৎপরতা শুরু করে দিয়েছিল।

হিরাক্লিয়াসের দরবার যেহেতু অভ্যন্তরীণ কোন্দল থেকে মুক্ত ছিল, তাই তারা সেখানে অধিক সফলতা লাভ করলো। সিরিয়ার দক্ষিণাংশে আরব জাতির লোকেরা বসবাস করতো এবং তাদের অনেকগুলো ছোট ছোট স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠিত ছিল। আরব লোকেরা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিল। তাই তারা আরবী খ্রিস্টানরূপে পরিচিত ছিল। আরবী খ্রিস্টানদের স্বাধীন রাজ্যগুলোর সাথে হিরাক্লিয়াসের ছিল বন্ধুত্বসুলভ ও সহানুভূতিমূলক সম্পর্ক। যখনই ঐ আরব খ্রিস্টানদের রাজ্যগুলো ইরানীদের দ্বারা আক্রান্ত হতো, কনস্টানটিনোপলের কায়সার এসে তাদের সাহায্য ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতো। এজন্যও তারা তাদেরকে রোমের কায়সারের পৃষ্ঠপোষকতায় রাখতে বাধ্য হতো। যেহেতু আরব বংশের লোক হওয়ার কারণে এরা খুব বাহাদুর ছিল, তাই রোমের কায়সার এদের অস্তিত্বকে অত্যন্ত মূল্যবান মনে করতো এবং প্রয়োজনের সময় তাদের যুদ্ধংদেহী যোগ্যতা দ্বারা ফায়দা উঠাতো। আরবদেশে একটি ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হয়েছিল। এই ইসলামী রাষ্ট্র ও রোম সাম্রাজ্যের মধ্যে সীমারেখা ছিল আরব খ্রিস্টানদের স্বাধীন রাজ্যগুলো। যেহেতু এই রাজ্যগুলো ছিল খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী, তাই বলা যেতে পারে যে, রোমক ও আরবদের মাঝখানে তো একটি সীমারেখা ছিল, কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্র ও খ্রিস্টান রাজ্যের মধ্যে কোন সীমারেখা ছিল না। হযরত নবী করীম (সাঃ)-এর জীবদ্দশায় যখন খ্রিস্টান রাজ্যগুলো ও মুসলমানদের মধ্যে মুকাবিলা ও সংঘাত শুরু হলো, তখন একদিকে এই আরব খ্রিস্টানগণ হিরাক্লিয়াসের নিকট সাহায্যের আবেদন করলো, অপরদিকে মুনাফিক ও ইয়াহূদীদের ষড়যন্ত্র হিরাক্লিয়াসকে মুসলমানদের মূলোচ্ছেদ করতে অনুপ্রাণিত করলো।

হযরত নবী করীম (সাঃ) যে সময় হিরাক্লিয়াসের নিকট পত্র প্রেরণ করেছিলেন, তখন বসরা ও দামেশকের সরদারদের প্রতিও পত্র লিখেছিলেন। কিন্তু তারা উভয়ে হযরত নবী করীম (সাঃ)-এর দূতদের সাথে দুর্ব্যবহার করেছিল। বসরার শাসনকর্তা শুরাহবীল তো হযরত নবী করীম (সাঃ)-এর দূত হারিছ (রা)-কে শহীদ করেই ফেলেছিল। হযরত নবী করীম (সাঃ) যায়দ ইব্‌ন হারিছ (রা)-কে শুরাহবীল ইব্‌ন আমর গাস্‌সানীর বিরুদ্ধে হযরত হারিছ (রা)-এর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য প্রেরণ করেন। মূতা যুদ্ধে হযরত যায়দ (রা), হযরত জা‘ফর (রা), হযরত আবদুল্লাহ ইব্‌ন রাওয়াহা (রা) শহীদ হন। হযরত খালিদ ইব্‌ন ওয়ালীদ (রা) যুদ্ধ পরিস্থিতি সামাল দেন। এই যুদ্ধে হিরাক্লিয়াস বাহিনী শুরাহবীল গাস্‌সানীর সমর্থনে মুসলমানদের মুকাবিলা করে। রোমকরা এরপর আরব দেশের উপর চড়াও হয় এবং স্বয়ং হযরত নবী করীম (সাঃ)-কে তাবূক প্রস্রবণ পর্যন্ত লশকর নিয়ে যেতে হয়। তখন রোমকরা সামনে থেকে সরে গেলো। আর কোন বড় যুদ্ধ হলো না। বরং ঐ আরব খ্রিস্টান রাজ্যগুলো থেকে জিযিয়া নিয়ে এবং তাদের উপর প্রভাব প্রতিষ্ঠা করে হযরত নবী করীম (সাঃ) ফিরে এলেন। এই সময় খবর এলো হিরাক্লিয়াস আরব দেশের উপর হামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং সিরিয়া সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ ঘটাচ্ছে। হযরত নবী করীম (সাঃ) হযরত উসামা ইব্‌ন যায়দ (রা)-কে সেদিকে প্রেরণ করেন। কিন্তু তাঁর রোগ বৃদ্ধির কারণে এই বাহিনী মদীনার বাইরে গিয়ে থেমে রইল। এরপর হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) খলীফা হয়ে এই বাহিনীকে প্রেরণের ব্যবস্থা করেন। এই বাহিনী সিরিয়া সীমান্ত পর্যন্ত গেলো এবং সেখানকার অবাধ্য ও বিদ্রোহী সরদারদের দমন করে ফিরে এলো।

হিরাক্লিয়াস বাহিনীর সাথে মুকাবিলা না হওয়ার কারণ হচ্ছে, আরব খ্রিস্টান সরদারদের মধ্য থেকে কেউ কেউ সানন্দচিত্তে ইসলামকে সত্য বলে স্বীকার করে নিয়েছিল। হিরাক্লিয়াস এ ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিল যে, সীমান্ত রাজ্যগুলো ইসলাম গ্রহণ করেছে, না খ্রিস্টধর্মের উপর বহাল থেকে মুসলমানদের মুকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত! নিছক এই রাজ্যগুলোর কারণেই—যারা একাধিকবার ইসলামী শক্তির প্রদর্শনী অবলোকন করেছিল এবং ইসলামী নীতিমালা সম্পর্কে অবগত হওয়ার দরুন ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট মনে হচ্ছিল—হিরাক্লিয়াস যুদ্ধের জন্য অগ্রসর হতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলেন। তাছাড়া তিনি নিজেও ইসলামের সভ্যতাকে আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতেন। তাই একদিকে মুসলমানদের উন্নতি ছিল তাঁর সাম্রাজ্য ধ্বংসের স্বরূপ এবং তিনি মুসলমানদের শক্তিকে আশংকার পূর্বেই মিটিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, অপরদিকে তাঁর পরিণাম ও পরিণতি সন্দেহপূর্ণ মনে হওয়ায় আগামীতে উত্তম সুযোগের অপেক্ষায় তিনি যুদ্ধ মুলতবি রাখতে চেয়েছিলেন। যা হোক, যে হিরাক্লিয়াস ইরানীদের বিশাল সাম্রাজ্যকে হেয় প্রতিপন্ন করেছিলেন, তিনি আপাদমস্তক ইসলামী শক্তিকেও ধ্বংস করার প্রতি মনোযোগী ছিলেন এবং এ ব্যাপারে কোন উপযুক্ত সুযোগকেই হাতছাড়া করতে চাইছিলেন না।

হযরত নবী করীম (সাঃ)-এর ওফাতের পর গোটা আরবদেশে যে বিশৃংখলা ও গোলমাল সৃষ্টি হয়, তা একদিকে ইরানীরা এবং অপরদিকে রোমকরা বড় প্রসন্ন ও সন্তোষ সহকারে শ্রবণ করে। দুনিয়ায় এই প্রথমবারের মতই গোটা আরব উপদ্বীপ একটি সাম্রাজ্য ও একটি সম্মিলিত শক্তি আকারে নিজকে নিজে উদ্ভাসিত করেছিল। আর এ কারণেই রোমক ও ইরানীদের রাজ-দরবারগুলো, এদেশটিকে বিশেষ চিন্তা-ভাবনা ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার দৃষ্টিতে দেখেছিল এবং এই উভয় সাম্রাজ্যই স্বস্থানে স্বতন্ত্রভাবে এই নবতর আরবী শক্তি অর্থাৎ ইসলামী রাষ্ট্রকে মিটিয়ে দিতে ও ধ্বংস করতে প্রস্তুত ছিল। হযরত নবী করীম (সাঃ)-এর ওফাতের খবর শোনা মাত্রই মুরতাদ হওয়ার হিড়িক ঐ দুই সাম্রাজ্যকে বাতলে দিয়েছিল যে, আরবদেশকে পদদলিত করা ও ভবিষ্যত আশংকা দূর করার এটাই হচ্ছে মোক্ষম সুযোগ। সুতরাং একদিকে হিরাক্লিয়াস বাহিনী সিরিয়ায় এবং অপরদিকে ইরানের সেনাবাহিনী ইরাকে সমবেত হতে লাগলো। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-এর পরিণাম চিন্তা, দূরদর্শিতা, সুযোগ-সচেতনতা ও প্রয়োজনানুরূপতার এভাবেও পরিমাপ হতে পারে যে, তিনি মুরতাদ সমস্যাকে অতি দ্রুত মিটিয়ে ফেলেন। আর এই ফিতনা দমন করার পর একটি দিনও নষ্ট না করে তৎক্ষণাৎ রোমক ও ইরানীদের প্রতিরোধ করার জন্য গোটা আরবদেশকে প্রস্তুত করে ফেলেন। যদি হযরত সিদ্দীকে আকবর (রা) আর কয়েকটি দিন মুরতাদ সমস্যা মিটিয়ে ফেলতে সক্ষম না হতেন কিংবা মুরতাদ সমস্যা মিটে যাওয়ার পর কয়েকটি দিন আলস্য ও নির্লিপ্ততায় কাটিয়ে দিতেন, তবে মদীনাতুন্নবী (সাঃ) অর্থাৎ ইসলামের রাজধানী রোমক ও ইরানীদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে মুসলমানদের জীবনকাল সংকীর্ণ করে তুলতো। বিস্মিত হতে হয় যে, সিদ্দীকে আকবর (রা) কি কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ কিরূপ সঙ্গীন ও সীমিত সময়ের মধ্যে কত সতর্কতা ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেন। আর ইসলামের আধ্যাত্মিক ও বৈষয়িক অবস্থা এবং প্রচ্ছন্ন ও প্রত্যক্ষ মাহাত্ম্যকে কত আড়ম্বর ও শক্তিমত্তার সাথে অক্ষুন্ন রাখেন। এখন সামনের দিকে রোমক ও ইরানীদের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে। যে অবস্থা সিরিয়ার ছিল—তার দক্ষিণাংশে আরব খ্রিস্টানদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্য ছিল, সম্পূর্ণ একই অবস্থা ছিল ইরাক ও আরবেরও। এখানেও আরবদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠিত ছিল, যার অধিকাংশই ছিল ইরানী সাম্রাজ্যাধীন এবং কোন কোনটিতে ইরানী রাজ-দরবার থেকে গভর্নর নিযুক্ত হয়ে আসতো এবং শাসন করতো।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন